'তাওয়াক' এর গল্প
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ১
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
বারা' আত তামিমি
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ১
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
বারা' আত তামিমি
আবুল মুসান্না বারা' আল-খালিফাহ আত-তামিমি (তাওয়াক) শামের জিহাদে শাহাদাতবরণকারী একজন মুহাজির মুজাহিদ।
তিনি ২৩/৩/১৪৩৪ হি: (৫/৩/২০১৩ ইং) ২০ বছর বয়সে শামের জিহাদের উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। তিন বছরের কিছু কম সময় শামের বরকতময় জিহাদে সক্রিয় ছিলেন। গত ১৪/৩/১৪৩৭ হি: (২৫/১২/২০১৫ ইং) জুমুয়ার দিন আসরের পরে হালাবে (আলেপ্পো) শাহাদাতবরণ করেন। শাহাদাতের সময় তার বয়স ছিল ২৩ বছর।
তিনি কুরআনের হাফেজ ও তালিবুল ইলম ছিলেন। হিজরতের পূর্বে একটি জামেয়াহ-এ (বিশ্ববিদ্যালয়) শরিয়াহ বিভাগে অধ্যায়নরত ছিলেন। একজন পরিশ্রমী ও ভালো ছাত্র ছিলেন। ইলমে দীনের প্রতি তার আগ্রহ ও ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। মসজিদে নববীর ইলমে দীনের হালাকাহগুলোর একজন পরিচালকও ছিলেন। পাশাপাশি একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন।
হিজরতের পর তিনি যেমন একজন বীর মুজাহিদ ছিলেন, তেমনই একজন দায়ী ও মুআল্লিমও ছিলেন। শামে তার হাতে বিশটি কুরআন শিক্ষার হালাকাহ চালু হয়েছে। যার ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচশত। মেয়েদের দীনী তা'লীমের জন্য চারটি একাডেমি প্রতিষ্ঠায়ও তিনি অংশগ্রহণ করেন। সে সময়ই তার ছাত্রিসংখ্যা সাড়ে তিন শত ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
হালাবে মুসলিম নারীদেরকে দাওয়াত প্রদান ও হিজাবের প্রসারের লক্ষে 'ইবনাতুল ইসলাম' প্রকল্পটি চালু করার মূলে তিনিই ছিলেন। এই প্রকল্পের দাওয়াতে হাজার হাজার নারী হিজাব ব্যবহার শুরু করেন।
তার ওসিয়ত মোতাবেক এই লেখাগুলো একত্রিত করে প্রকাশ করেন শামের মুজাহিদীন।
শাইখ আব্দুল্লাহ মুহাইসিনী বইটির ভূমিকায় লিখেছেন:
"...এগুলো গল্প নয়, যদিও নাম দেয়া হয়েছে গল্প, এগুলো এমন কিছু কাহিনী যা মনের পর্দা ভেদ করে হৃদয়ের গভীরে করাঘাত করবে। তারপর আল্লাহ তাআলার পথে জিহাদে বের হবার জন্য একটি জ্বলন সৃষ্টি করবে অন্তরে।
"এগুলো কিছু গল্প নয়, বরং আল্লাহর পথে জিহাদে বের হবার একটি জোরদার উদ্বুদ্ধকরণ। পাঠক আসুন, পড়ুন। পড়ে জিহাদে বের হোন। যদি ইতিমধ্যেই জিহাদে শামিল হয়ে থাকেন তাহলে দৃঢ় থাকুন, ধৈর্যধারণ করুন। সেভাবে ইতিহাস রচনা করুন যেভাবে তারা করেছেন..."
মায়ের হাতের কফি
আব্বা, আমার ইচ্ছা হয়, যদি তোমার পাশে থাকতে পারতাম। তোমার মাথায় চুমু খেতাম। শরীরের খবর নিতাম। তারুণ্যকে ধরে রাখতে যে সাদা চুলগুলো সব সময় তুমি মেহেদিতে ঢেকে রাখ, গভীরভাবে দেখতাম সেগুলো।
আব্বার সাথে আমার সকালটা অন্যরকম ছিল...। এখনো সবখানে তার ঘ্রাণ পাই...। যখন ফজর সালাতের পর ঘরে ফিরে আসতাম আম্মা তখন এক জাদুময় মমতা মেশানো হাসি নিয়ে আমার সামনে আসতেন।
আম্মার অভ্যাস ছিল সুবহে সাদিকের আগেই জেগে ওঠা। তিনি ঘুম থেকে উঠে আল্লাহ যতটা তাওফিক দেন সালাত আদায় করতেন।
তারপর সুবহে সাদিকের সময় ঘনিয়ে এলে একে একে আমাদের সবাইকে জাগিয়ে দিতেন।
আম্মা যখন আমাকে ডাকতে আসতেন তখন আমি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার ভান করতাম। কারণ আর কিছু না, আম্মার কণ্ঠ আমার ভালো লাগত। আমি জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত আম্মা আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতেন। ছোট বাচ্চার মত আমাকে আদর করে দিতেন।
সবাই জেগে উঠলে আম্মা চা, কফি আর নাস্তা তৈরি করতে চলে যেতেন। আর আমরা যেতাম মসজিদে। সালাত শেষে আমরা বাসায় চলে আসতাম। আব্বা মসজিদ থেকে বের হতেন সব মুসল্লিদের শেষে।
আব্বাকে অনেক ভালোবাসি। তিনিও আমাকে অনেক ভালোবাসেন। প্রতিদিন সকালে আব্বার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকতাম তাকে মায়ের তৈরি এক কাপ কফি খাওয়াতে। সেই এক কাপ কফির সাথে তার প্রতি আমার ভালোবাসা ও অনুরাগটুকুও ঢেলে দিতাম। আর তিনি আমাকে বলতেন তার মনে জমে থাকা গোপন কথাগুলো।
আম্মার হাতের কফির স্বাদটাই অন্যরকম ছিল। সে রকম স্বাদের কফি আমি কোথাও পাই নি, আর কখনো পাবো-ও না। কারণ একটাই- সেটা তার হাতের।
আব্বা ছিলেন চাপা স্বভাবের। তার গোপন কথাগুলো কাউকে জানাতেন না। কিন্তু কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে আমাকে অনেক কিছুই বলতেন। আমাকে জানাতেন বিভিন্ন ব্যাপারে তার মতামত। আমার সাথে ভাগাভাগি করে নিতেন তার উদ্বেগের বিষয়গুলো। শোনাতেন তার কাহিনীগুলো।
আব্বার কথা বলার সবচেয়ে উপযোগী সময় এটাই ছিল...। একদিন আমি তার পাশে ছিলাম না। তিনি সেদিন আমাকে বকা দিয়েছিলেন।
তিনি চাইতেন আমি যেন প্রতিদিন এ সময় তার পাশে থাকি। যেন তার দুশ্চিন্তার বিষয়গুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারি। তিনি যেন আমাকে বলতে পারেন কাউকে না বলা কথাগুলো।
আব্বার অনেক গোপন কথা ছিল যা তিনি কাউকে বলেন নি। দিনের শুরুর মূহুর্তগুলো আর আম্মার হাতের কফি - এই দুটি একসাথে হয়ে আব্বার সেসব গোপন কথা প্রকাশ করে দিত...। আব্বা আমাকে সেগুলো বলতেন।
আব্বার গোপন কথাগুলো অনেক মূল্যবান ছিল। তিনি সেগুলোর ব্যাপারে আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। আমার বুকের ভেতর সেগুলো আমানত রেখেছিলেন... আমি আব্বার আমানতগুলো সংরক্ষণ করেছিলাম...। একটা সময় পর্যন্ত তা রেখেছিলাম আমার কাছে...। হিজরতের পর সেগুলো গভীর কুপের ভেতরে নিক্ষেপ করেছি।
আম্মা তখন ব্যাস্ত থাকতেন। ছোটদেরকে ঘুম থেকে জাগাতেন। চুল আঁচড়ে দিতেন, কাপড় পরাতেন, নাস্তা খাওয়াতেন, স্কুলে যাবার আগে ওদের ব্যাগগুলো গুছিয়ে দিতেন। আর আমরা তাদের রেডি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।
চেপে রাখা কষ্টকর কাজ। কাউকে বলতে পারলে কষ্ট হালকা হয়... খুব ইচ্ছা হয় আব্বার গোপন কথাগুলো শুনতে। কথাগুলোর আকর্ষণে না, বরং আব্বার লুকিয়ে রাখার কষ্ট লাঘব করতে।
শামের জিহাদের বাজার চালু হল। শামের অধিবাসীরা উদ্ধত পাপিষ্টদের জ্বালানো আগুনে ঝলসে যেতে লাগল। ফলে জিহাদের জন্য বের হওয়াটাও জরুরি হয়ে গেল...। আমি মায়ের হাতের চা আর আব্বার সাথে বসে কথা বলাকে অনেক উপভোগ করতে লাগলাম। কারণ, আমি অনুভব করছিলাম যে বিদায়ের মূহুর্ত ঘনিয়ে আসছে।
কাফেলার ঘোষক মুহাজিরদের কাফেলায় শামিল হবার দাওয়াত সবখানে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। এদিকে আব্বার প্রতি আমার ভালোবাসা আর আমার প্রতি তার ভালোবাসা আমাকে একটি জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছিল...। কিন্তু আমি অনুভূতিগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে সিদ্ধান্তে অনড় থাকলাম।
জিহাদে বের হবার ইচ্ছার কথা আব্বাকে স্পষ্টভাবে বলাটা ছিল কল্পনার বাইরে। আব্বা কখনো ভাবেন নি যে এক দিন অথবা এক মুহূর্তের জন্যও আমি তার থেকে পৃথক হব...। এটা জীবনের এমন একটি মাইলফলক ছিল, যা আমার ও আব্বার দুজনের জন্যই অনেক কষ্টের ছিল।
প্রথমে আব্বা ভেবেছিলেন আমি রসিকতা করছি, তাই অনুমতি দিয়েছিলেন। যখন আমি রওয়ানা হবার জন্য গোছাতে লাগলাম, তখন বুঝতে পারলেন যে এটা রসিকতা না। তার জন্য বড় একটা আঘাত ছিল এটা। যার একশ ভাগের একভাগও তিনি কখনো আশা করেন নি।
আমি বারবার পীড়াপীড়ি করতে থাকলাম...। আব্বা আমাকে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে থামাতে চেষ্টা করলেন...। তিনি আমাকে একটি উজ্জল ভবিষ্যতের কথা বলছিলেন, যেভাবে বাবারা ছেলেদের বলে...। কিন্তু কোন ভাবেই তিনি আমাকে টলাতে পারলেন না...। অবশেষে আমাকে বললেন আগে আম্মাকে রাজি করাতে।
আম্মার ইন্দ্রিয়গুলো যেন সব সময় আমার সাথেই থাকে...। আমি আম্মার কাছে গেলাম। হাত ধরে হাতে একটা চুমু খেলাম। আমি কোন কথা বলার আগেই তিনি বলে দিলেন আমার আসার কারণ। তার হৃদয় যেন আমার হৃদয়ের সাথেই স্পন্দিত হয়।
আমি তাকে একজন সত্যিকার ইমানদার নারী মনে করি...। আমার ইচ্ছার বিরোধিতা করেন নি। বরং আমার কাছে তার চাওয়া এটাই ছিল। তার হৃদয়টা কেবল তার ছিল না বরং পুরো উম্মাহর ছিল। তাই তিনি আবেগ ও অনুভূতিকে পদদলিত করে রবের নির্দেশকে সামনে রেখেছিলেন।
আম্মার সাথে অনেক কথা বললাম...। এটাই ছিল বিদায়ী আলাপ...। আমি আবেদন করলাম আম্মা যেন স্পষ্ট ভাষায় সম্মতি দেন। আম্মা মাথা নিচু করে ফেললেন। বললেন, 'আমার একথা মুখে বলার শক্তি নেই, বাবা!' আমি তার মাথায় চুমু খেয়ে আব্বার কাছে ফিরে এলাম।
আব্বাকে জানালাম, আম্মা রাজি আছেন। আব্বা খুব অবাক হলেন। দীর্ঘ সময় চুপ থাকলেন। একটু পরে আবার অসম্মতি প্রকাশ করলেন। তিনি বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার কী হবে? ভবিষ্যত কী হবে? বিয়ে শাদির কী হবে?...'
আম্মা আমার সাথে ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। আর আমি দীর্ঘ সময় ধরে আব্বাকে রাজি করানোর চেষ্টা করছিলাম...। প্লেনের টিকেট কাটা হয়ে গেছে। ফ্লাইটের আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি।
সেদিন সকালে আব্বাকে রাজি করাবার শেষ চেষ্টা করছিলাম। আমি বারবার অনুরোধ করছিলাম। খুব পীড়াপীড়ি করছিলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমার মন তার ভালোবাসায় কাঁদছিল। অবশেষে আল্লাহ আব্বার মনকে ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি দীর্ঘ এক নিরবতা দিয়ে কথা শেষ করলেন।
যখন আমি প্রায় হতাশ হয়ে পড়েছি সেই মু্হূর্তে আব্বার মৌন সম্মতি পেয়ে গেলাম। আব্বার মাথায় চুমু খেয়ে ব্যাগটা গাড়িতে নিয়ে রাখলাম...। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। এক ফোটা অশ্রুও ঝরে নি তখন তার চোখ থেকে।
সকাল বেলার কফি আব্বার জন্য ছেড়ে গেলাম...। মায়ের হাতের সেই কফি ছেড়ে আসার পর অন্য কোন কফিতে আর স্বাদ পাই নি...।
"ওরা কেল্লা ও দেয়াল গড়ে আমাদেরকে স্বজন থেকে আলাদা করে রেখেছে...। আবার আমাদেরকেই বানিয়েছে অপরাধী...। আমাদেরকে কারাবাসের ভয় দেখায়...। আল্লাহর কাছেই বাদী-বিবাদী একত্রিত হবে।"
#অনুভব
তোমার ব্যথিত উম্মাহর অশ্রু ঝরেই চলেছে। অবনত দৃষ্টিতে তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। রক্ত ঝরা হাতটি তোমার দিকে বাড়িয়ে আছে। হয়তো তুমি বীর হয়ে তার সাহায্যে এগিয়ে যাবে...
অলসভাবে বসে থাকার সময় নেই...
এখন তোমার জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের মূল্য হাজারগুণ বেড়ে গিয়েছে...
তাওয়াক...!
Comment