وَلَا يَـُٔودُهُۥ حِفْظُهُمَا وَهُوَ ٱلْعَلِىُّ ٱلْعَظِيم
সুরা বাকারার ২৫৫ নাম্বার আয়াতের একদম শেষ অংশ, যার অর্থ এমন,
"(নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডল এর উভয়ের) যাবতীয় সমস্ত কিছুর প্রতিপালন/সংরক্ষন/হেফাযত আল্লাহ কে ক্লান্ত/ পরিশ্রান্ত করে না, তিনি সমুন্নত, মহীয়ান!"
কিছু দিন আগের একটা ঘটনা, কিছু কাজের জন্য আমি সারা রাত জেগে কাজ করছিলাম। একটু পর পর খেয়াল হচ্ছিলো বাইরে একড়া বিড়াল ডাকছে, রাত একটা, দুইটা, এমন কি ফজর এর পরেও শুনি বিড়াল ডাকছে। ডাক টা স্বাভাবিক না, করুন ভাবে, এবং অনবরত। কোন থামাথামি নাই। আমি ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি। বাড়ির সামনে রাস্তায় গিয়ে দেখি একটা বিড়ালের বাচ্চা, খুব বেশি হলে ১ সপ্তাহ বয়স! ঠান্ডায় কাঁপছে! আশে পাশে মা আছে কিনা লক্ষ্য করলাম, কিছুক্ষণ পর মোটামুটি নিশ্চিত হলাম মা নাই। এরপর আমি কিছু রুটি এনে বিড়ালের সামনে দিলাম। এরপর উপলব্ধি হলো, এই বিড়াল রুটি খেতে পারবেনা, এর একমাত্র খাবার হচ্ছে দুধ। আমি ভাবলাম কি আর করা, আমি চলে গেলাম। কিছুখন পর আবার ফিরে আসলাম, ভাবলাম বাসায় নিয়ে যাই, নিতে আসলাম কিন্তু দেখি কোনভাবেই আসতে চায়না, আমি ভাবলাম কি আর করা, চলে গেলাম। বাসায় গিয়ে চিন্তা হলো, বিড়াল টা খাবার না পেয়ে মরতে পারে, ঠান্ডায় মরতে পারে, রাস্তার বাচ্চারা গলায় দড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে মেরে ফেলতে পারে।
মনে হলো, রাসুল (সাঃ) এর সেই কথা, একজন মহিলা শুধু মাত্র একটা কুকুর কে পানি দিয়ে সেই কুকুরের জীবন বাচিয়েছিলো, আর এ জন্য সে জান্নাতে যাবে। মনে হলো শাইখ আওলাকি (রহঃ) সেই কথা, "আল্লাহ তোমার সামনে যে কোন একটা ভালো কাজ করার সুযোগ করে দিবেন, তুমি এটা চাওনি, কিন্তু আল্লাহ স্রেফ এটা কে তোমার সামনে ফেলে দিবেন, যত ছোট হোক বা যত বড় হোক, এই সুযোগ গ্রহন কর, কারন তুমি জানোনা আল্লাহ এই কাজে কি পরিমান বারাকাহ দিবেন" আমি ভাবলাম আল্লাহ বলেছেন প্রত্যেকটা সৃষ্টি আল্লাহ্*র তাসবিহ পড়ে। এই বিড়াল টা যত দিন বেঁচে থাকবে আল্লাহ্*র অনুগত থাকবে আর আল্লাহ্*র তাসবিহ পড়বে। আমি নিজের জন্য এবার গেলাম আর বিড়াল টাকে তুলে নিয়ে আসলাম।
এরপর সেই বিড়াল কে খেতে দেয়া, বিড়ালের ময়লা পরিষ্কার করা, ম্যাও ম্যাও ইত্যাদি তে আমি মাত্র ৭ দিনের মাথায় বিরক্ত হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে এমন রাগ উঠে যেত, মনে হয় আছাড় মারি। এভাবে আরো কিছু দিন চললো, একটা পর্যায়ে এমন হলো যে আমার থাকার জায়গায় বিড়াল টা আর রাখা সম্ভব হচ্ছেনা। এক সকালে পশুপাখির দোকানে গিয়ে ছেড়ে আসতে গেলাম, বিড়াল আর যায়না, বিড়ালের চোখে যে ভয় দেখলাম, আবার সাথে নিয়ে চলে আসলাম।
এবার বিরক্তি আরো বাড়তে লাগলো,কারন এখন বড় হয়েছে খাবার না পেলেই দিন নাই রাত নাই ক্যাও ম্যাও করতে থাকে.. কিন্তু এই বিরক্তির মধ্য দিয়ে একটা উপলব্ধি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে শুরু করলো,
একটা বিড়ালের বাচ্চার সাথে মাত্র ২০ দিনেই আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম!
এই মুহূর্তেই আল্লাহ্*র জমিনে অগুনিত প্রানী জন্ম নিচ্ছে, মারা যাচ্ছে, তাদের মুখে খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে, তারা ঘরে ফিরে আসছে, শিকার ধরছে, কেউ ঘুমাচ্ছে, কারো মা তাকে আগলে রেখেছে, কেউ বাচ্চাকে দুধ দিচ্ছে, কেউ বা বাচ্চাকে খেলা শিখাচ্ছে, কেউ ডিম পাড়ছে, কেউ বাচ্চার হেফাজত করছে.. এত গেলো শুধু প্রানী কুলের কথা, মানুষ আর জিন এর বাইরে নাই .. বরং তাদের মধ্যে অগুনিত আল্লাহ্*র কাছে চাইছে, বিপদে স্মরন করছে, কেউ পানিতে ডুবে ডাকছে, কেউ রোগে শোকে ডাকছে, কেউ খাবারের জন্য ডাকছে, কেউ কুফুরি করছে, কেউ গালি দিচ্ছে, কেউ অস্বীকার করছে, কেউ চ্যালেঞ্জ করছে..
আল্লাহ কে ডাকছে গর্তের পিপড়া রা, বনের পশুরা, গাছের পাখিরা, জমিনের পতঙ্গরা, সাগরের প্রানীরা, বাতাসে ভেসে থাকা অণুজীবেরা, আল্লাহ কে ডাকছে মায়ের পেটে থাকা ভ্রুন কিংবা শিশু, আল্লাহ কে ডাকছে অবহেলায় পড়ে থাকা বৃদ্ধ বাবা মা, আল্লাহ ডাকছেন ময়দানের মুজাহিদিন গণ ..
সৃষ্টিজগতের সবাই ডাকছে ঐ এক আল্লাহ কে!
আর এজন্য কি, তিনি ক্লান্ত হয়ে গেছেন? তিনি রাগ করেছেন? যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন? আকাশ তুলে নিয়েছেন? তার হুকুম প্রদানে কোন সমস্যা হয়েছে? বৃষ্টি আটকিয়ে গেছে, বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে, সাগরের ঢেউ থেমে গেছে? নদী পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে? সূর্য মাঝ আকাশে উঠে দ্বিধায় ভুগছে? চাঁদ এক কোনায় গিয়ে আটকিয়ে গেছে, পাহাড় গুলো টালমাটাল করছে, বনের হিংস্র পশুরা ক্ষুধার জালায় বন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে, সাগরের সমস্ত প্রাণী ক্ষুধার জালায় সাগর মাতিয়ে তুলেছে, সগরের বুকে নৌযানগুলো এদিক সেদিক আছড়ে পড়ছে.. সাত আকাশ আর নিজেদের ধরে রাখতে পারছেনা, আকাশ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে...
এর কোনটা হয়েছে? কোনটাই না! বরং আল্লাহ কি বলছেন? আল্লাহ কত বিনম্র ভাবে আর ভালোবাসা নিয়ে বলছেন "কে এমন আছে যে আমার কাছে চাইবে আর আমি দিবো?" "এমন কেউ কি আছে যার প্রয়োজন আছে, আর আমার কাছে চাইবে আর আমি তাকে দিব?" আল্লাহু আকবর! আল্লাহ আপনার শান অনুযায়ী আপনি মহান আর সমুন্নত!
সারা দিন পাপ করে রাতে এসে ঘুমিয়ে গেছে, আর সেই মহান আল্লাহ ডেকে ডেকে বলছেন, "কেউ কি আছে যে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে আর আমি ক্ষমা করে দিব, আমি ক্ষমা করে দেয়ার জন্য দুই হাত প্রসারিত করে দিয়েছি!"
আর এগুলোর কোন কিছুতেই তিনি আল্লাহ ক্লান্ত হোন না, বিরক্ত হোন না, পরিশ্রান্ত হোন না, রাগ করেন না, যোগাযোগ বন্ধ করে দেন না। বরং আরো খুশি হন!
আর এমন ই তো আল্লাহ বলছেন,
"(নভোমণ্ডল এবং ভূমণ্ডল এর উভয়ের) যাবতীয় সমস্ত কিছুর প্রতিপালন/সংরক্ষন/হেফাযত আল্লাহ কে ক্লান্ত/ পরিশ্রান্ত করে না, তিনি সমুন্নত, মহীয়ান!"
একটা বিড়ালের বাচ্চা আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেলো, আল্লাহ ক্লান্ত হোন না। আল্লাহ রাগ করেন না, আল্লাহ বিরক্ত হোন না, আল্লাহ ঝেড়ে ফেলে দিতে চান না, আল্লাহ পরিত্যাগ করেন না।
আর আল্লাহও এমনই বলছেন, "আল্লাহ কখনই তাঁর বান্দাহদের পরিত্যাগ করেন না"
এই সেই আয়াত এর অংশ, যেটা আমি জীবনে বহুবার পড়েছি কিন্তু কখনো উপলব্ধি করিনি, এই আয়াত আমার সাথে এত জড়িত! এই এক আয়াতের এই এতটুকু অংশের মধ্যেই জড়িয়ে আছে আমার সৃষ্টি থেকে আমার শেষ পর্যন্ত সমস্ত সমস্ত চাওয়া পাওয়ার উত্তর, শুধু আমার না, আবারো বলছি, শুধু আমার না, বরং...
শুধু মাত্র এই এক আয়াতের এই অংশটুকুর মধ্যে আকাশ ও জমিনের সমস্ত সৃষ্টির চাওয়া পাওয়ার উত্তর দিয়ে দেয়া আছে!
এই সমস্ত কিছু এবং আরো এমন কিছু যা আমার সামান্য জ্ঞানের বাইরে এর সবই শুধুমাত্র একটা আয়াতের অংশ বিশেষ! আর এমন পুরা একটা কিতাবই পড়ে আছে ঘরের মধ্যে! বাকি রয়ে গেছে আরো হাজার হাজার আয়াত!
হে আল্লাহ আপনি আমাদের জন্য আপনার কিতাব কে সহজ করে দেন, আর আপনার কিতাবের সাথে আমাদের সম্পর্ক করে দেন!
Comment