'তাওয়াক' এর গল্প
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ৫
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
মুজাহিদীন ও শামের বরফ
(শামের বরকতময় জিহাদের ময়দানে শাহাদাতবরণকারী এক মুজাহিদের ডায়েরি)
পর্ব: ৫
অনুবাদ: আশ-শাম মিডিয়া
মুজাহিদীন ও শামের বরফ
বাতাসে ছড়িয়ে থাকা পেঁজা তুলার মত তুষার শান্ত শীতল শেষরাত্রিকে সাজিয়ে দিচ্ছিল। জ্বলন্ত লাকড়িগুলো শুষ্ক হাত-পায়ে তাপ সরবরাহ করছিল... ভাইয়েরা আল্লাহর দরবারে রুকু ও সিজদারত অবস্থায় আপন রবের রাহমাহ (দয়া ও করুণা) অন্বেষণ করছিল।
আযানের সময় ঘনিয়ে এলে আমরা ফজরের সালাত আদায় করতে মাসজিদের উদ্দেশে বের হলাম। বাইরে এসে দেখি রাস্তা-ঘাট বরফে ঢাকা। গাড়িটি নড়ানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হলাম। ফিরে এলাম ক্যাম্পে। দরজা খুলতে চাবিটা বের করলাম, হঠাৎ সেটা বরফের ফাঁকে পড়ে গেল। চাবিটা খুঁজতে বরফের ফাঁকায় হাত ঢোকালাম, অবশ হয়ে গেল হাত। হাত বাইরে এনে দেখি সেটাও একটা বরফখণ্ডে পরিণত হয়েছে।
তুষারপাতের এত সুন্দর দৃশ্য জীবনে প্রথমবার দেখছি। কিছু বরফ জমা করে বল বানিয়ে ফেললাম। আমার বন্ধু আবু আওসের দিকে ছুড়ে দিয়ে দৌড়ে পালালাম। তারপর শুরু হল ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া... আমরা যেন গোলাপবর্ণের স্বপ্নের মধ্যে আছি!
কিছু সময় চলল এভাবে, হাত পা ততক্ষণে ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছে। ক্যাম্পের দরজায় নক করলাম, ভিতরে ঢুকলাম... আমার বন্ধু তার মোবাইলটা খুজে পাচ্ছিল না। ফিরে গিয়ে বরফের মধ্যে খুঁজতে লাগলাম। আলহামদুলিল্লাহ, পাওয়া গেল সেটা...
ভাইদের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলাম। পানিভর্তি কেটলি চুলায় দিলাম। সেখানে বন্ধু আবু আওস দারুণ একটা খুশির খবর শোনালো, আনন্দে ভরে গেল মন...
জামাতে ফজরের সালাত আদায় করলাম। সালাতের পর ইমাম সাহেব আমাদের উদ্দেশে কিছু কথা বললেন, নিয়ামাতের শোকর আদায় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করলেন তিনি। আমরা তো ঠাণ্ডা থেকে বাঁচার জন্য ঘরের ভেতরে অবস্থান করছি, অথচ কত মানুষ এমন আছে যাদের ঘর নেই, আশ্রয় নেয়ার মত জায়গাও নেই!
সালাতের পরের যিকর শেষ করে ভাইয়েরা চা পান করতে আঙিনায় বেরিয়ে এল। অবাক হয়ে দেখল, পুরো এলাকা স্কেটিংয়ের (বরফের ওপরের খেলা বিশেষ) মাঠ হয়ে আছে। সবাই একে অন্যের হাত ধরাধরি করে চলতে লাগল যেন পিছলে পড়তে না হয়। তুষারও পড়ছিল মুষলধারে। এমন সময় আমি সবাইকে পিছনে রেখে সামনে এগিয়ে গেলাম। সামনের স্কেটিংয়ের মাঠ সহ ভাইদের একটা ছবি তুললাম...
ভাইয়েরা ভালোভাবেই নেমে এলেন স্কেটিং ফিল্ডে, কিন্তু মাঝামাঝি আসতেই বাঁধল বিপত্তি। এক ভাই একটু দূরে সরে গেল, একটা বরফের বল বানিয়ে হঠাৎ ছুড়ে দিল অন্যদের দিকে। ভাইয়েরা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল... তারপর বেঁধে গেল বরফ যুদ্ধ!
সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল, প্রত্যেকেই বরফের মিসাইল বানিয়ে ছুড়ে দিচ্ছিল অন্যদের দিকে...
হঠাৎ বরফের একটা গোলক গড়িয়ে নামতে লাগল ঢাল বেয়ে। ‘কুবরি’ নামের একজন যুবকের দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেল সেটা, তার কিছুই হয় নি আলাহামদুলিল্লাহ।
আমার দিকে ছুটে আসল বরফের একঝাক বুলেট। বরফের উৎস খুঁজে বের করে আমিও পাল্টা ফায়ারিং শুরু করলাম সেদিকে, আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত চলল বরফের গুলিবর্ষন...
এমন সময় অন্য একদিক থেকে বরফের একটা বোমা এসে লাগল আমার মুখে, আমি পড়ে গেলাম মাটিতে। ডান দিক থেকে এসেছে বোমাটি... পর মূহুর্তেই শোনা গেল ‘আবু বকর হামাবি’র হাসির শব্দ, দৌড়ে পালাতে দেখা গেল ওকে। আমি হাতা গুটিয়ে পিছু নিলাম, হঠাৎ দেবে গেলাম বরফের ভেতর। আমার দশা দেখে হাসছিল সে!
‘আবু আওস’ ‘আবু আব্দুল্লাহ’র দিকে বরফ-বোমা ছুড়ছিল, হাসতে হাসতে বলল, ‘আল্লাহর শপথ, বুলেটের মজুদ শেষ হয়ে গেলেও কুফফারদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাব, বরফের ব্লক বানিয়ে তা দিয়েই ওদের মোকাবেলা করব!’
‘আবু আব্দুল্লাহ’ ‘আবু আওসকে’ পাল্টা একটা বরফ-বোমা মেরে আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। বলল, ‘রাজা বাদশাহরা যদি জানত আমরা কত আনন্দে আছি, তাহলে আমাদেরকে হিংসা করত!’
বরফ যুদ্ধ শেষ হল। সফলভাবে আকাশপথে হামলা (Air Strike) ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা (Surgical Strike) সম্পাদন করার পর ‘আবুল মুসান্না’ ভাইদের জন্য চা বানিয়ে ফেলল। তারপর সবাই একটি টেবিল ঘিরে বসে পড়ল। ভাইদের মন প্রফুল্লতায় ভরা ছিল...
গরম চায়ের কাপে চুমুক দেবার সময়ই জেগে ওঠে প্রিয়জনের সাথে সাক্ষাতের প্রবল ইচ্ছা। আবু ওমর হামাবীর মনে পড়ল তার পরিবারের কথা, যাদের সাথে দু’বছর দেখা সাক্ষাৎ নেই। মনের কথাটা ব্যক্ত করল ভাইদের কাছে: ‘কেবল পরিবারের উপস্থিতির আনন্দটাই বাকি থাকল, এটা ছাড়া আর কোন আনন্দের স্বাদ নিতে বাকি নেই আমার।’
একটু গরম হয়ে নিয়ে আবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম দুর্লভ কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে। গাড়িগুলো বরফের নিচে চাপা পড়ে ছিল... আরেকটু এগিয়ে অসাধারণ একটি দৃশ্য দেখতে পেলাম।
দেখলাম আমার সামনে কেবল সাদা বরফ, ‘নজদ’ এলাকার বালু যেভাবে টিলাগুলিকে ঢেকে ফেলে সেভাবে সবকিছু ঢেকে ফেলেছে বরফ... সৃষ্টিকর্তা কত পবিত্র...
আমি ছবি তুলছিলাম, চারিদিকে নিরবতা বিরাজ করছিল... হঠাৎ সেখানে একদল হামলাকারী উপস্থিত হল, সবাই মিলে আক্রমণ করল আমার ওপর। চারিদিক থেকে আমার দিকে বোমা ছুড়তে লাগল! পরমূহুর্তেই বুঝে ফেললাম, আমাদের কয়েকজন ভাই, যথা নিয়মে বরফ হামলা চালাতে এসেছিল আমার ওপর। সবার একটা ছবি তোলার শর্তে ওদেরকে ক্ষমা করলাম, ওরাও শর্ত মেনে নিল...
বরফ-বোমা হামলা বন্ধ হবার পরেও শিরায় শিরায় ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম। ঠাণ্ডার উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিস্কার করলাম, প্রচণ্ড বোমাবর্ষণের ফলে জ্যাকেটের ভেতরেও ঢুকে পড়েছে কিছু বরফ!
ভাই আবু নাসেরের গাড়িটা আসতে দেখা গেল। আমরা লুকিয়ে পড়লাম। গাড়িটা কাছাকাছি আসতেই বরফ-বোমা হামলা চালালাম ওটার ওপর!
আমিও আবু নাসেরের গাড়িতে উঠলাম, মু’তাসিম বিল্লাহ ও অন্য একজন শাইখকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম, ঘুরে বেড়াতে লাগলাম বরফের ওপর... গাড়ি পিছলে ডানে বামে সরে যাচ্ছিল, আমরা যেন স্কেটিংয়ের মাঠে আছি। আরেকটু হলেই ধাক্কা খেত গাড়ি। আবু নাসের স্পিড কমিয়ে দিলে ভারসাম্য রক্ষা হল...
‘ওয়াদদাহ আল-কুসাইমি’ গাড়ি থেকে নামল, এক জায়গায় জমে থাকা বরফের ওপর পা রাখতেই উল্টো হয়ে পড়ে গেল, একেবারে পা ওপরে আর মাথা নিচে। দৃশ্যটা হাস্যকর ছিল।
আমরা বাজারের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেখানে একদল মুহাজির ভাইকে দেখলাম যাদের মধ্যে আবু আব্দুল্লাহও ছিল, আনসার শিশুদের সাথে বরফ নিয়ে খেলা করছিল তারা। যেন সবাই এক পরিবারের। দৃশ্যটা ভোলার মত না।
যখন মুহাজিররা আনসার শিশুদের সাথে খেলছিল তখন বড় বড় স্পিকারে জিহাদী নাশীদ বাজছিল, যার আওয়াজ বাজার এলাকার বাতাসে প্রফুল্লতা ও ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। আর খেলার মধ্যে ফুটে উঠছিল মুমিনদের প্রতি মুজাহিদদের মমতা...
আমরা উদ্বাস্তু শিবিরের নিকট দিয়ে অতিক্রম করলাম, হৃদয়বিদারক এক দৃশ্য দেখলাম সেখানে। তাপমাত্রা ছিল শূণ্য ডিগ্রির নিচে, আর ওদের তাবু এত পাতলা ছিল যে তাতে ঠাণ্ডা অথবা চারিদিকে ভেসে বেড়ানো তুষার, কোনটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না!
এই সুন্দর মূহুর্তে সেই শহীদ বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে যারা মনের ভেতরে সুবাস ছড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে... ইচ্ছা করছে তাদের সাথে দেখা করার। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তিনি যেন শীঘ্রই আমাকেও তাদের সাথে মিলিত করেন।
#অনুভব
“তুমি তোমার ভাইদের জন্য ন্যূনপক্ষে যতটুকু করতে পার তা হল, বিনয়ভরে হাত দুটি আকাশের দিকে তুলবে, তাদের জন্য মন খুলে দোয়া করবে, যেন তোমার দোয়াগুলো আকাশ থেকে অবতরণ করে দুর্বলদের জন্য শীতলতা ও শান্তি হয়ে, আর জালিমদের জন্য আগুন ও পাথরের টুকরা হয়ে!”
“তাদের যদি কামান ও জঙ্গিবিমান থাকে, তবে আমাদেরও আছে রাতের আঁধারে রবের সামনে দণ্ডায়মান হবার ক্ষমতা।”
তাওয়াক...!
Comment