অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে মানুষ তার নিজের জীবনের সাথে ঘটে যাওয়া জুলুমকে ভুলে যা তাকে শেখানো হচ্ছে সেটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে! আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন জঙ্গিরা কি করে? তার বলবে, বোমা মারে, মানুষ মারে। আপনি এবার জিজ্ঞেস করেন জঙ্গিরা গত ৫ বছরে কতজন মানুষ মেরেছে আর পুলিশ, আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী কত মানুষ মেরেছে? নিঃসন্দেহে তারা লা জবাব হয়ে যাবে! কিন্তু তাহলে কেন মানুষ এমন সম্মোহিত হয়ে গেছে? কারন প্রোপ্যাগান্ডার মাধ্যমে মানুষের ভিতরে নতুন এক আকিদাহ, বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের আগে মানুষের মাঝে ব্যাপক ভাবে ছড়ানো হয়েছিলো অ্যামেরিকানরা ঝুকির মুখে, তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত। আপনারা জানেন ঠিক একই কাজ করা হয়েছিলো ইরাক যুদ্ধের আগে, এটা প্রচার করা হয়েছিলো ইরাকে পরমানু অস্ত্র শুধু মজুদ আছে তাই নয় বরং যে কোন সময়ে তা অ্যামেরিকানদের উপরে ব্যাবহার করা হতে পারে, অ্যামেরিকানদের জীবন ঝুকির সম্মুখীন! ইতিহাসে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সুতরাং বুঝা গেলো যে প্রোপ্যাগান্ডা মানুষের বিশ্বাস কে পরিবর্তন করে ফেলে। তারা সবার সামনে এটিকে একটি দলগত/জাতিগত/রাস্ট্রীয় ঝুকি হিসেবে দেখায়। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে এধরনের কম বেশি সেন্টিমেন্ট লুকানো থাকে, আর তাগুতরা এই সেন্টিমেন্ট কে কাজে লাগায়, তারা জঙ্গিদেরকে দেশের জন্য ঝুকি হিসেবে চিত্রিত করে এবং প্রোপাগান্ডা চালায়। এই জন্যই মানুষ নিজের জীবন দিয়ে পুলিশ এবং আওয়ামী ক্যাডার এর অত্যাচার এর সাক্ষী হলেও তা বিশ্বাসের উপর খুব বেশি প্রভাব ফেলতে সমর্থ হয়না, কারন তাদের এই জুলুম গুলোকে কেউ চিত্রিত করেনি, বরং এগুলো সবসময়ে খন্ডচিত্র হিসেবেই ছিলো। আম মানুষের যদি কারো জুলুমে ভীত থাকার দরকার ছিল তবে তা হচ্ছে তাগুতের বাহিনি এবং আওয়ামী ক্যাডার বাহিনী। কিন্তু তার পরিবর্তে মানুষ জঙ্গীদের ভয় পায় কারন এভাবেই তাদের কে চিন্তা করতে শেখানো হয়েছে, এটাই হচ্ছে প্রোপ্যাগান্ডার ফসল।
আমরা তাহলে দেখলাম যে এই যুদ্ধ টা আসলে শুধু মিডিয়া কেন্দ্রিক না, যদিও মিডিয়ার ভুমিকা কম না। কিন্তু আমরা যদি শুধু মিডিয়ার দিকে তাকাই আর মনে করি মিডিয়াই শুধু আমাদের আক্রমণ করছে তাহলে ভুল হবে। এই যুদ্ধে মিডিয়া শুধু একটি হাতিয়ার মাত্র। আমরা আরো দেখলাম যে, এই যুদ্ধের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল এবং এটি আসলে এখন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, পুকুরে ঢিল ছুড়ে দেয়ার ফলে সৃষ্ট ঢেউ এর মত। আমাদের মত আম মানুষ এই প্রোপ্যাগান্ডাকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, আমাদের আপন পরিবার, বাবা মা, ভাই বোন নিজেদের অজান্তে এই প্রোপ্যাগান্ডার সৈনিক হয়ে কাজ করছে! এখন তাহলে আমাদের করনীয় কি?
এটা পরিষ্কার যে এই প্রোপ্যাগান্ডার অন্যতম হাতিয়ার মিডিয়া কে আমরা কন্ট্রোল করতে পারবোনা। এটাও সত্য যে আমরা তাগুতের মত সেটআপ তৈরি করে তাদের প্রোপ্যাগান্ডার জবাব দিতে পারবোনা। তাহলে আমাদের করনীয় কি? আমাদের করনীয় হচ্ছে আমাদের ঈমান এবং আকিদাহ কে নষ্ট হতে না দেয়া। আর এটি কোথায় থাকে? এটি থাকে মানুষের অন্তরে, অর্থাৎ আমাদের কে আবার আম মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে। লক্ষ্য করেন মুরতাদ, কাফির রা এবং জাহেলিয়াতের এই সমাজ ব্যাবস্থা প্রতি মুহূর্তে আমাদের ঈমান এবং আকিদাহ এর উপরে অনবরত আঘাত করেই চলেছে! অনবরত, দিন রাত কোন বিরাম নাই। একটা বাস্তব উদাহরন দেই, একবার একভাই বলছিলেন, ভাই ঢাকা শহরে আমার পক্ষে চলা সম্ভব না। কারন হিসেবে বলেছিলেন, ভাই কিভাবে এই শহরে চলা সম্ভব? এখানে তো মানুষের ঈমান ই ঠিক থাকবে না। আসলে এটাই বাস্তবতা! নির্মম বাস্তবতা। কেন এখানে ঈমান নিয়ে বেচে থাকা যাবেনা এই আলোচনা শেষ করা বেশ কঠিন একটা কাজ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সেই আলোচনায় যাচ্ছিনা। যা বলছিলাম যে, লক্ষ্য করেন আমাদের ঈমানের উপরে প্রতিনিয়ত আঘাত হানা হচ্ছে, এক দিক থেকে নয়, বরং সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে। মনে করেন হাজার দিক থেকে হাজার টা তীর আমাদের অন্তরের ঈমান লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। এমন অবস্থায় আপনি কি হাজার টা তীর ঠেকাতে যাবেন নাকি নিজের অন্তরের ঈমান কে সুরক্ষা দিবেন? কারন আপনি জানেন হাজার দিক থেকে ছুটে আসা তীর সামলানো সম্ভব না, বরং এটা সম্ভব যে নিজের ঈমান কে সুরক্ষা দেয়া। তাই সবার আগে আমাদের করনীয় হচ্ছ আমাদের ঈমান কে সুরক্ষা দেয়া। একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে, একসময় তাগুত জনবিচ্ছিন্ন ছিলো, আমরাই বরং তাগুতের চেয়ে কিছু বেশি হলেও জনগনের পাশে ছিলাম তা যে ভাবেই হোক না কেন। একসময় তাগুত তাদের ভুল বুঝতে পারলো এবং জনগন কে নিজেদের সাথে নেয়ার চেস্টা করলো এবং একপর্যায়ে তারা সফল ও হলো, এবং তারা জনগনের মাঝে তাদের প্রোপ্যাগান্ডা ছড়াতে লাগলো একই সাথে তারা তাদের বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে আমাদের কে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে বেশ ভালো রকম সফল হলো, এই কাজটি তারা প্রোপ্যাগান্ডা এবং বিভিন্ন অপ্স এর মাধ্যমে সম্মিলিত ভাবে করলো। এখন অবস্থা এমন হয়ে গেছে যে আমরা আম মুসলিমের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, এখন তাদের মনে শুবুহাতের বিশাল পাহাড় জমে গেছে। এমন অবস্থায় আমাদের মূল কাজ আবার সেই আম মানুষের কাছে ফিরে যাওয়া। মানুষ কে নিজেদের ঈমানের সুরক্ষার ব্যাপারে সচেতন করা এবং ঈমাদের উপরে আক্রমণ গুলোকে চিহ্নিত করে দেয়া।
আমাদের কাজের ফর্মুলা কি হবে? শত্রুর কাজের ভিতরেই আমাদের কাজের ফর্মুলা লুকানো আছে। কাফিররা জানে যে আম মসুলিম কে তারা সরাসরি ইসলাম, আল্লাহ, কুরআন, সুন্নাহ এসবের বিরুদ্ধে নিতে পারবেনা। কারন এমন করলে কাফিরদের পরিকল্পনা এক কদম ও সামনে আগাবেনা! তাহলে এটা স্পষ্ট যে কাফিররা ভয় পায় এদেশের আম মুসলিম এখনো কুরআন কে কুরআন হিসেবেই বুঝে, আল্লাহ কে আল্লাহ হিসেবেই বুঝে, সুন্নাহ কে সুন্নাহ হিসেবেই বুঝে।কিন্তু আম মুসলিমের সহিহ জ্ঞানের অভাবে তাগুত শ্রেণী আল্লাহর দ্বীনের আহকাম সমুহ কে বিভিন্ন স্টেজ সাজিয়ে ধাপে ধাপে বিকৃত করে ফেলেছে, আর নিঃসন্দেহে তাদের এই কাজ এক শ্রেনির মুনাফিকদের সহযোগিতা ছাড়া অনেক বেশি কঠিন ছিলো। তাই এখন আমাদের মূল কাজ আম মুসলিমের কাছে শুদ্ধ কুরআন এর জ্ঞান শিক্ষা দেয়া, একেবারে বেসিক ঈমান এবং আকিদাহ। মানুষের মরে যাওয়া মন কে কিংবা বিকৃত হয়ে যাওয়া চিন্তা ভাবনা কে শুদ্ধ করা, গোড়া থেকে। কারন মনে রাখতে হবে কাফিরদের আঘাত করার জায়াগা হচ্ছে আমাদের ঈমান এবং আকিদাহ, তাই সবার আগে আমাদের ঈমান এবং আকিদাহ’র চারপাশে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলা দরকার। আর এই কাজ টি হওয়া চাই বিশুদ্ধ কুরআন এবং সুন্নাহ থেকে। কাফিরদের কাজে যেমন মুনাফিক আলিমদের দরকার ছিলো এই কাজেও তেমনি হক্কপন্থী আলিমদের দরকার, উনাদের ছাড়া এই কাজ আমাদের জন্যও অনেক কঠিন। যেমন কঠিন ছিলো তাগুতের জন্য। সুতরাং কোন সন্দেহ নাই যে একটি বিশাল দাওয়াহ কার্যক্রম আমাদের দরকার হবে। এই দাওয়াহ কাজে আমরা আক্রমণ করবো পরে, নিজেদের ঈমান এবং আকিদাহ এর প্রতিরক্ষা করব আগে। কারন যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য আগে যুদ্ধে টিকে থাকতে হবে, আর এখন টিকে থাকার অর্থ হচ্ছে ঈমান এবং আকিদাহ’র শুদ্ধতা নষ্ট না হতে দেয়া। কারন এটিই আমি বলার চেস্টা করেছি যে কাফেরদের লক্ষ্য আমাদের ঈমান এবং আকিদাহ, যদিও সাধারন ভাবে তা চোখে পড়েনা।
অতঃপর, এই যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য দরকার বিশুদ্ধ জ্ঞান। আর বিশুদ্ধ জ্ঞান হচ্ছে কুরআন। মক্কার কাফেরদের সমস্ত প্রোপ্যাগান্ডা, কূট কৌশল আর মিথ্যাচারের জবাব দিয়েছিলো এই কুরআন, আবার একই সাথে বিশ্বাসীদের অন্তরকে ঈমানের উপর মজবুত রেখেছিলো তাও এই কুরআন। আল্লাহ কি রাসুল (সাঃ) এর সম্পর্কে বলেননি, যার ভাবার্থ - আমি তোমাকে স্থির না রাখলে তুমি তাদের (কাফিরদের) দিকে প্রায় কিছুটা ঝুকেই পড়তে। আল্লাহ আরো বলেছেন, এই কুরআন মুমিনদের জন্য প্রশান্তি। সুতরাং আমাদের দাওয়াহ এর মূল উপকরন বিশুদ্ধ কুরআন। আর এর সহিহ জ্ঞান এবং ইস্তেমাল আলিমদের ব্যাতিত সম্ভব নয়। তবে এতটুকু আমরা বুঝলাম যে এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে আমাদের আবার আম মানুষের কাছে ফিরে যেতে হবে বিস্তৃত ভাবে এবং আমদের মূল লক্ষ্য হবে ঈমান এবং আকিদাহ কে রক্ষা করা আর আমাদের উপকরন হবে কুরআন। আমাদের বিশ্বাস থাকতে হবে আল্লাহ বলেছেন, “আমি সত্যকে মিথ্যার উপর নিক্ষেপ করি, অতঃপর তা মিথ্যার মস্তক চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, তৎক্ষণাৎ মিথ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তোমরা (আল্লাহ সম্পর্কে অযথা বহু মিথ্যা কথা) যা বলেছো এ কারনে তোমাদের দুর্ভোগ” সুতরাং আল্লাহ আমাদের কে বলেই দিচ্ছেন কুরআন দিয়েই মিথ্যার মাথায় আঘাত করতে, আর তাতেই মিথ্যা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আর আল্লাহ সম্পর্কে (আল্লাহর আহকাম সম্পর্কে) মিথ্যা বানোয়াট কথা/ধারনা/ব্যখ্যা জন্ম দেয়ার কারনে কাফের জন্য দুর্ভোগ!
পরিশেষে, এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে কাফিরদের কোন দুর্বলতা আছে কি? যা আমাদের প্রেরনা যোগাবে?
* চলবে ইনশাআল্লাহ
Comment