আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি, কাফেরদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ফরয যতক্ষণ না তারা মুসলমান হয় অথবা জিযিয়া প্রদানে সম্মত হয়। যুদ্ধবিরতি চুক্তির অর্থ হচ্ছে, উপরোক্ত দুইটির কোন একটি ছাড়াই জিহাদ বন্ধ করে দেয়া। কাজেই যুদ্ধের সামর্থ্য থাকা অবস্থায় তা জায়েয হবে না। তবে যদি মুসলমানদের মাঝে দুর্বলতা থাকে তাহলে (কাফেররা প্রস্তাব দিলে) যুদ্ধের পর্যাপ্ত শক্তি সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত তাদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে পারবে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হবে ই’দাদ করে যুদ্ধের পর্যাপ্ত সামর্থ্য অর্জন করা। ই’দাদ ছেড়ে দিয়ে আরাম আয়েশে দিন কাটানোর উদ্দেশ্যে চুক্তি করা জায়েয হবে না। ই’দাদ করত পর্যাপ্ত শক্তি অর্জন হলে তখন কাফেরদেরকে অবগত করাবে যে, ‘আমরা তোমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলাম যুদ্ধ না করার। এখন আমরা উক্ত চুক্তি আর বহাল রাখতে চাচ্ছি না। এখন থেকে তোমাদের ও আমাদের মাঝে কোন চুক্তি নেই। তোমরা হয় ইসলাম গ্রহণ করবে নতুবা জিযিয়া প্রদানে সম্মত হবে। অন্যথায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’ তবে তাদেরকে অবগত না করিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া জায়েয হবে না। কেননা, তা গাদ্দারী। আর ইসলাম গাদ্দারী হারাম করেছে।
শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. বলেন,
وإن قالوا للمسلمين: وادعونا على أن لا نقاتلكم ولا تقاتلونا فليس ينبغي للمسلمين أن يعطوهم ذلك لقوله تعالى: {ولا تهنوا ولا تحزنوا وأنتم الأعلون} [آل عمران: 139] . ولأن الجهاد فرض، فإنما طلبوا الموادعة على أن تترك فريضة، ولا يجوز إجابتهم إلى مثل هذه الموادعة، كما لو طلبوا الموادعة على أن لا يصلوا ولا يصوموا، إلا أن يكون لهم شوكة شديدة لا يقوى عليهم المسلمون، فحينئذ لا بأس بأن يوادعهم إلى أن يظهر للمسلمين قوة ثم ينبذ إليهم.
قال الله تعالى: {وإن جنحوا للسلم فاجنح لها} [الأنفال: 61] . وصالح رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أهل مكة عام الحديبية على أن يضع الحرب بينه وبينهم عشر سنين، ولأن حقيقة الجهاد في حفظ المسلمين قوة أنفسهم أولا، ثم في قهر المشركين وكسر شوكتهم، فإذا كانوا عاجزين عن كسر شوكتهم كان عليهم أن يحفظوا قوة أنفسهم بالموادعة إلى أن يظهر لهم قوة كسر شوكتهم، فحينئذ ينبذون إليهم ويقاتلونهم، وهو بمنزلة إنظار المعسر إلى الميسرة، كما قال الله تعالى: {وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة} [البقرة: 280] .اهـ
“তারা যদি মুসলমানদের কাছে প্রস্তাব পেশ করে যে, তোমরা আমাদের সাথে এই শর্তে চুক্তিবদ্ধ হও যে, আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না, তোমরাও আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না; তাহলে মুসলমানদে জন্য এই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া জায়েয হবে না। কেননা,
(১). আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
“তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না (যে, ভয় ও হীনমন্যতার কারণে কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করে বসবে)। প্রকৃত মু’মিন হলে তোমরাই বিজয়ী হবে।” [আলে ইমরান: ১৩৯]
(২). তাছাড়া (আরেকটি কারণ হচ্ছে,) জিহাদ ফরজ। তারা চাইছে আমরা আমাদের একটি ফরয পরিত্যাগ করার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হই। অথচ এ ধরণের চুক্তিতে সম্মত হওয়া জায়েয নয়। যেমন জায়েয নয় এই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যে, মুসলমানরা নামায পড়তে পারবে না, রোযা রাখতে পারবে না। তবে যদি তাদের শক্তি সামর্থ্য এত বেশি থেকে থাকে যদ্দরুণ মুসলমানরা তাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, তাহলে ভিন্ন কথা। তখন তাদের সাথে ততদিনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া জায়েয আছে যতদিন না মুসলামনদের শক্তি সামর্থ্য অর্জন হয়। শক্তি সামর্থ্য অর্জন হলে তখন তাদেরকে অবগত করিয়ে পূর্বকৃত চুক্তি রহিত করে দেবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
(৩). (আরেকটি দলীল হচ্ছে,) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার সময় মক্কাবাসীর সাথে দশ বছরের যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করেছিলেন।
(৪). তাছাড়া (আরোও একটি কারণ হচ্ছে,) জিহাদের হাকিকত হল, প্রথমত মুসলমানদের নিজেদের শক্তি হিফাযত করা, তারপর কাফেরদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া। যখন তারা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চূর্ণ করতে অক্ষম তখন তাদের কর্তব্য হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার সামর্থ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদের শক্তি হিফাযত করা। সামর্থ্য অর্জন হলে তখন তাদেরকে অবগত করিয়ে পূর্বকৃত চুক্তি রহিত করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করবে। (সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির) এই অবকাশ প্রদান, ঋণ পরিশোধে অক্ষম গরীব ব্যক্তিকে পরিশোধের সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত অবকাশ প্রদানের অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة}
(আর যদি সে অস্বচ্ছল হয় তাহলে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে।) [বাকারা: ২৮০]”
((শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ১/১৯০-১৯১))
***
লক্ষ্যনীয়:
১. আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
এখানে বলা হয়েছে, কাফেররা যদি নিজে থেকে স্বেচ্ছায় মুসলমানদেরকে চুক্তির প্রস্তাব পেশ করে তাহলে প্রয়োজন বোধ হলে মুসলমানরা তাতে সম্মত হতে পারবে। কাজেই, বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত মুসলমানরাই আগে আগে নিজেদের থেকে কাফেরদেরকে চুক্তির প্রস্তাব দিতে পারবে না। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন,
فلا تهنوا وتدعوا إلى السلم وأنتم الأعلون والله معكم
(অতএব, তোমরা হীনবল হয়ো না এবং চুক্তির প্রতি আহ্বান জানিও না। তোমরাই বিজয়ী হবে। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।) [মুহাম্মাদ: ৩৫]
২. আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
এটি কেবল ঐ অবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যখন মুসলমানরা দুর্বলতার কারণে জিহাদ করতে সমর্থ্য না হয়। জিহাদের সামর্থ্য থাকা অবস্থায় এই আয়াত প্রযোজ্য। কাজেই, কেউ যদি এই আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করে যে, সর্বাবস্থায় চুক্তি জায়েয, তাহলে তা গলদ হবে।
ইমাম জাসসাস রহ. বলেন:
فالحال التي أمر فيها بالمسألة هي حال قلة عدد المسلمين وكثرة عدوهم والحال التي أمر فيها بقتل المشركين وبقتال أهل الكتاب حتى يعطوا الجزية هي حال كثرة المسلمين وقوتهم على عدوهم.اهـ
“সন্ধির আদেশ দেয়া হয়েছে ঐ অবস্থায় যখন মুসলমানগণ সংখ্যায় থাকে অল্প আর শত্রু সংখ্যা অনেক। আর মুশরেকদেরকে কতল করা এবং আহলে কিতাবের বিরুদ্ধে জিযিয়া প্রদানে সম্মত হওয়া পর্যন্ত কিতাল করে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে যখন মুসলমানরা সংখ্যায় হয় অনেক এবং শত্রুদের উপর হয় ক্ষমতাবন।” [আহকামুল কুরআন: ৩/৯০]
৩. যুদ্ধের সামর্থ্য না থাকলে ই’দাদ-জিহাদের প্রস্তুতি ফরয। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ
“আর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, যার দ্বারা তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের নিজেদের দুশমনদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখবে এবং ঐ সব দুশনমনকেও যাদেরকে তোমরা জাননা কিন্তু আল্লাহ জানেন।” [আনফাল: ৬০]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
يجب الاستعداد للجهاد بإعداد القوة ورباط الخيل في وقت سقوطه للعجز فإن ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب.اهـ
“সামর্থ্য না থাকার কারণে জিহাদ করা সম্ভব না হলে, শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত করার মাধ্যমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ফরয হবে। কেননা, যে জিনিস ব্যতীত ফরয আদায় করা সম্ভব না হয় সেটাও ফরয হয়ে থাকে।” [মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/২৫৯]
ইমাম সারাখসী রহ. তাঁর বক্তব্য-
وهو بمنزلة إنظار المعسر إلى الميسرة، كما قال الله تعالى: {وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة} [البقرة: 280] .اهـ
“(সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির) এই অবকাশ প্রদান, ঋণ পরিশোধে অক্ষম গরীব ব্যক্তিকে পরিশোধের সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত অবকাশ প্রদানের অনুরূপ।”
তাঁর এই বক্তব্যে তিনি এ বিষয়টির প্রতিই ঈঙ্গিত করেছেন। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য না থাকলে তার থেকে ঋণের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় না। ঋণ মাফ হয়ে যায় না। ঋণের দায়িত্ব তার উপর থেকেই যাবে। পরিশোধ তাকে করতেই হবে। তবে সামর্থ্য না থাকার কারণে আপাতত তাকে চাপ দেয়া হবে না। কিন্তু তার উপর ফরয হবে ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ উপার্জন করা। সামর্থ্য নেই অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।
তদ্রূপ, জিহাদের সামর্থ্য না থাকলে জিহাদের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় না। জিহাদ মাফ হয়ে যায় না। জিহাদ ফরয থেকেই যাবে। আদায় করতেই হবে। তবে সামর্থ্য না থাকার কারণে এক্ষুনি জিহাদে নেমে যাওয়া ফরয থাকবে না। কিন্তু জিহাদ আদায় করার জন্য ই’দাদ-জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ফরয হবে। সামর্থ্য নেই অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।
মোটকথা, ঋণ আদায়ে অক্ষম ব্যক্তির উপর যেমন উপার্জন ফরয, জিহাদের সামর্থ্য না থাকলেও তদ্রূপ ই’দাদ ফরয।
বি.দ্র: যখন ইকদামী তথা আক্রমণাত্নক জিহাদের জন্যই ই’দাদ ফরয, তখন দিফায়ী তথা প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের জন্য ই’দাদ ফরয হওয়ার ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে!! কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম ভূমি কাফেরদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, প্রতিটি ভূমিতে মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হতে থাকা সত্ত্বেও আলেম উলামারা বলে বেড়াচ্ছে, জিহাদ ই’দাদ কোনটাই ফরয নয়। তারা না ইকদামী জিহাদকে ফরয বলছে, না দিফায়ী জিহাদকে ফরয বলছে, না কোনটার জন্য ই’দাদকে ফরয বলছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!
শামসুল আইম্মা সারাখসী রহ. বলেন,
وإن قالوا للمسلمين: وادعونا على أن لا نقاتلكم ولا تقاتلونا فليس ينبغي للمسلمين أن يعطوهم ذلك لقوله تعالى: {ولا تهنوا ولا تحزنوا وأنتم الأعلون} [آل عمران: 139] . ولأن الجهاد فرض، فإنما طلبوا الموادعة على أن تترك فريضة، ولا يجوز إجابتهم إلى مثل هذه الموادعة، كما لو طلبوا الموادعة على أن لا يصلوا ولا يصوموا، إلا أن يكون لهم شوكة شديدة لا يقوى عليهم المسلمون، فحينئذ لا بأس بأن يوادعهم إلى أن يظهر للمسلمين قوة ثم ينبذ إليهم.
قال الله تعالى: {وإن جنحوا للسلم فاجنح لها} [الأنفال: 61] . وصالح رسول الله - صلى الله عليه وسلم - أهل مكة عام الحديبية على أن يضع الحرب بينه وبينهم عشر سنين، ولأن حقيقة الجهاد في حفظ المسلمين قوة أنفسهم أولا، ثم في قهر المشركين وكسر شوكتهم، فإذا كانوا عاجزين عن كسر شوكتهم كان عليهم أن يحفظوا قوة أنفسهم بالموادعة إلى أن يظهر لهم قوة كسر شوكتهم، فحينئذ ينبذون إليهم ويقاتلونهم، وهو بمنزلة إنظار المعسر إلى الميسرة، كما قال الله تعالى: {وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة} [البقرة: 280] .اهـ
“তারা যদি মুসলমানদের কাছে প্রস্তাব পেশ করে যে, তোমরা আমাদের সাথে এই শর্তে চুক্তিবদ্ধ হও যে, আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না, তোমরাও আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না; তাহলে মুসলমানদে জন্য এই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া জায়েয হবে না। কেননা,
(১). আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
“তোমরা হীনবল হয়ো না, চিন্তিতও হয়ো না (যে, ভয় ও হীনমন্যতার কারণে কাফেরদের সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি করে বসবে)। প্রকৃত মু’মিন হলে তোমরাই বিজয়ী হবে।” [আলে ইমরান: ১৩৯]
(২). তাছাড়া (আরেকটি কারণ হচ্ছে,) জিহাদ ফরজ। তারা চাইছে আমরা আমাদের একটি ফরয পরিত্যাগ করার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হই। অথচ এ ধরণের চুক্তিতে সম্মত হওয়া জায়েয নয়। যেমন জায়েয নয় এই চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যে, মুসলমানরা নামায পড়তে পারবে না, রোযা রাখতে পারবে না। তবে যদি তাদের শক্তি সামর্থ্য এত বেশি থেকে থাকে যদ্দরুণ মুসলমানরা তাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না, তাহলে ভিন্ন কথা। তখন তাদের সাথে ততদিনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হওয়া জায়েয আছে যতদিন না মুসলামনদের শক্তি সামর্থ্য অর্জন হয়। শক্তি সামর্থ্য অর্জন হলে তখন তাদেরকে অবগত করিয়ে পূর্বকৃত চুক্তি রহিত করে দেবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
(৩). (আরেকটি দলীল হচ্ছে,) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার সময় মক্কাবাসীর সাথে দশ বছরের যুদ্ধ বিরতির চুক্তি করেছিলেন।
(৪). তাছাড়া (আরোও একটি কারণ হচ্ছে,) জিহাদের হাকিকত হল, প্রথমত মুসলমানদের নিজেদের শক্তি হিফাযত করা, তারপর কাফেরদের উপর আধিপত্য বিস্তার করা এবং তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া। যখন তারা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি চূর্ণ করতে অক্ষম তখন তাদের কর্তব্য হবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করার সামর্থ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিরতিতে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেদের শক্তি হিফাযত করা। সামর্থ্য অর্জন হলে তখন তাদেরকে অবগত করিয়ে পূর্বকৃত চুক্তি রহিত করে দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কিতাল করবে। (সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির) এই অবকাশ প্রদান, ঋণ পরিশোধে অক্ষম গরীব ব্যক্তিকে পরিশোধের সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত অবকাশ প্রদানের অনুরূপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
{وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة}
(আর যদি সে অস্বচ্ছল হয় তাহলে স্বচ্ছলতা আসা পর্যন্ত তার অবকাশ রয়েছে।) [বাকারা: ২৮০]”
((শরহুস সিয়ারিল কাবীর: ১/১৯০-১৯১))
***
লক্ষ্যনীয়:
১. আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
এখানে বলা হয়েছে, কাফেররা যদি নিজে থেকে স্বেচ্ছায় মুসলমানদেরকে চুক্তির প্রস্তাব পেশ করে তাহলে প্রয়োজন বোধ হলে মুসলমানরা তাতে সম্মত হতে পারবে। কাজেই, বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত মুসলমানরাই আগে আগে নিজেদের থেকে কাফেরদেরকে চুক্তির প্রস্তাব দিতে পারবে না। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন,
فلا تهنوا وتدعوا إلى السلم وأنتم الأعلون والله معكم
(অতএব, তোমরা হীনবল হয়ো না এবং চুক্তির প্রতি আহ্বান জানিও না। তোমরাই বিজয়ী হবে। আল্লাহ তোমাদের সাথে আছেন।) [মুহাম্মাদ: ৩৫]
২. আল্লাহ তাআলার বাণী,
وَإِنْ جَنَحُوا لِلسَّلْمِ فَاجْنَحْ لَهَا
(আর তারা যদি সন্ধির প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করে তাহলে আপনিও সেদিকেই আগ্রহ প্রকাশ করুন।) [আনফাল: ৬১]
এটি কেবল ঐ অবস্থার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যখন মুসলমানরা দুর্বলতার কারণে জিহাদ করতে সমর্থ্য না হয়। জিহাদের সামর্থ্য থাকা অবস্থায় এই আয়াত প্রযোজ্য। কাজেই, কেউ যদি এই আয়াত দিয়ে দলীল পেশ করে যে, সর্বাবস্থায় চুক্তি জায়েয, তাহলে তা গলদ হবে।
ইমাম জাসসাস রহ. বলেন:
فالحال التي أمر فيها بالمسألة هي حال قلة عدد المسلمين وكثرة عدوهم والحال التي أمر فيها بقتل المشركين وبقتال أهل الكتاب حتى يعطوا الجزية هي حال كثرة المسلمين وقوتهم على عدوهم.اهـ
“সন্ধির আদেশ দেয়া হয়েছে ঐ অবস্থায় যখন মুসলমানগণ সংখ্যায় থাকে অল্প আর শত্রু সংখ্যা অনেক। আর মুশরেকদেরকে কতল করা এবং আহলে কিতাবের বিরুদ্ধে জিযিয়া প্রদানে সম্মত হওয়া পর্যন্ত কিতাল করে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে যখন মুসলমানরা সংখ্যায় হয় অনেক এবং শত্রুদের উপর হয় ক্ষমতাবন।” [আহকামুল কুরআন: ৩/৯০]
৩. যুদ্ধের সামর্থ্য না থাকলে ই’দাদ-জিহাদের প্রস্তুতি ফরয। যেমনটা আল্লাহ তাআলা আদেশ করেছেন,
وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ وَمِنْ رِبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ وَآخَرِينَ مِنْ دُونِهِمْ لَا تَعْلَمُونَهُمُ اللّهُ يَعْلَمُهُمْ
“আর তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত কর, যার দ্বারা তোমরা আল্লাহর দুশমন ও তোমাদের নিজেদের দুশমনদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত্র রাখবে এবং ঐ সব দুশনমনকেও যাদেরকে তোমরা জাননা কিন্তু আল্লাহ জানেন।” [আনফাল: ৬০]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন:
يجب الاستعداد للجهاد بإعداد القوة ورباط الخيل في وقت سقوطه للعجز فإن ما لا يتم الواجب إلا به فهو واجب.اهـ
“সামর্থ্য না থাকার কারণে জিহাদ করা সম্ভব না হলে, শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত করার মাধ্যমে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ফরয হবে। কেননা, যে জিনিস ব্যতীত ফরয আদায় করা সম্ভব না হয় সেটাও ফরয হয়ে থাকে।” [মাজমুউল ফাতাওয়া: ২৮/২৫৯]
ইমাম সারাখসী রহ. তাঁর বক্তব্য-
وهو بمنزلة إنظار المعسر إلى الميسرة، كما قال الله تعالى: {وإن كان ذو عسرة فنظرة إلى ميسرة} [البقرة: 280] .اهـ
“(সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি চুক্তির) এই অবকাশ প্রদান, ঋণ পরিশোধে অক্ষম গরীব ব্যক্তিকে পরিশোধের সামর্থ্য অর্জন হওয়া পর্যন্ত অবকাশ প্রদানের অনুরূপ।”
তাঁর এই বক্তব্যে তিনি এ বিষয়টির প্রতিই ঈঙ্গিত করেছেন। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য না থাকলে তার থেকে ঋণের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় না। ঋণ মাফ হয়ে যায় না। ঋণের দায়িত্ব তার উপর থেকেই যাবে। পরিশোধ তাকে করতেই হবে। তবে সামর্থ্য না থাকার কারণে আপাতত তাকে চাপ দেয়া হবে না। কিন্তু তার উপর ফরয হবে ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থ উপার্জন করা। সামর্থ্য নেই অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।
তদ্রূপ, জিহাদের সামর্থ্য না থাকলে জিহাদের দায়িত্ব রহিত হয়ে যায় না। জিহাদ মাফ হয়ে যায় না। জিহাদ ফরয থেকেই যাবে। আদায় করতেই হবে। তবে সামর্থ্য না থাকার কারণে এক্ষুনি জিহাদে নেমে যাওয়া ফরয থাকবে না। কিন্তু জিহাদ আদায় করার জন্য ই’দাদ-জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ ফরয হবে। সামর্থ্য নেই অজুহাত দেখিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই।
মোটকথা, ঋণ আদায়ে অক্ষম ব্যক্তির উপর যেমন উপার্জন ফরয, জিহাদের সামর্থ্য না থাকলেও তদ্রূপ ই’দাদ ফরয।
বি.দ্র: যখন ইকদামী তথা আক্রমণাত্নক জিহাদের জন্যই ই’দাদ ফরয, তখন দিফায়ী তথা প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের জন্য ই’দাদ ফরয হওয়ার ব্যাপারে কি সন্দেহ থাকতে পারে!! কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয়, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মুসলিম ভূমি কাফেরদের হাতে থাকা সত্ত্বেও, প্রতিটি ভূমিতে মুসলমানরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হতে থাকা সত্ত্বেও আলেম উলামারা বলে বেড়াচ্ছে, জিহাদ ই’দাদ কোনটাই ফরয নয়। তারা না ইকদামী জিহাদকে ফরয বলছে, না দিফায়ী জিহাদকে ফরয বলছে, না কোনটার জন্য ই’দাদকে ফরয বলছে। ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন!
Comment