আল্লাহর পথে শহীদ হওয়ার ফযিলত – শায়খ শহীদ আব্দুল্লাহ আযযাম রহঃ
উম্মাহর অস্তিত্ব আলেমের কলমের কালি এবং শহীদদের আত্ন-ত্যাগের সাথে সম্পর্কিত । এর থেকে অধিক উত্তম আর কি হতে পারে, যে উম্মাহর ইতিহাস আলেমের কলমের কালি এবং তাঁদের রক্তে লেখা হচ্ছে। এটি এমনভাবে যে, ইসলামী ইতিহাসের মানচিত্র কালো এবং লাল দুই সারিতে রঞ্জিত হয়েছে। কালোটি হল আলেমগণের কলমের কালি, আর দ্বিতীয়টি হলো শহীদগণের রক্ত। এবং এর চেয়েও সুন্দর হলো, যখন রক্ত ও কলমের কালি একইসূত্র হতে প্রবাহিত হয়, অর্থাৎ আলেমের হাত, যা কলম চালনা করে এবং কালি নিঃসরণ করে, একই হাত যা থেকে রক্ত ঝরে এবং জাতিকে সামনের দিকে পরিচালনা করে। উলামাগনের লাশের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাবে, সে হারে ঘুমন্ত মানুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেদের অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।
অতএব রক্ত ছাড়া ইতিহাস রচিত হয় না। গৌরবের সুউচ্চ ইমারাত খুলি ব্যতীত মাথা উচু করে দাঁড়ায় না। সম্মান এবং মর্যাদা বিকলাঙ্গতা ও লাশের ভিত্তি ছাড়া প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। দৃষ্টান্ত ছাড়া সাম্রাজ্য, আভিজাত্য, রাষ্ট্র এবং সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় না।
শায়খ শহীদ আব্দুল্লাহ ইউসুফ ‘আযযাম রহমতুল্লাহি আলাইহি, হে আমাদের শায়খ! ১৯৮৯ এ আপনাকে গুপ্তহত্যা করার পরও আপনার রক্ত বৃথা যায়নি।
টীকাঃ
শহীদঃ আভিধানিক অর্থে একজন সাক্ষী
শুহাদাঃ শহীদের বহু বচন
শাহাদাহঃ আভিধানিক অর্থে সাক্ষ্য দেয়া
১। শহীদের রক্তের ঘ্রাণ মেশকের মতঃ
“যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, আল্লাহর পথে এমন কেউ আহত হয় না -এবং আল্লাহ ভালো জানেন কে সত্যিকার ভাবে তাঁর পথে আহত হয়েছে- যে (তাঁর ক্ষতস্থান নিয়ে) কিয়ামতের দিন উত্তিত হবে , এবং তা থেকে রক্ত গড়িয়ে পরবে এবং এর রঙ হবে রক্তের মতই, তবে তাঁর ঘ্রাণ হবে মেশকের মত।”
(মুসলিম, আহমাদ)
২। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ফোঁটাঃ
“আল্লাহর নিকট দুটি ফোঁটা এবং দুটি দাগ ব্যতীত সর্বাধিক প্রিয় অন্য কিছুই নাই। অশ্রু ফোঁটা যা আল্লাহর ভয়ে ঝরে থাকে, এবং রক্ত বিন্দু যা আল্লাহর পথে প্রবাহিত হয়। আর দাগসমূহের মধ্য হতে, যে দাগ আল্লাহর পথে হয়ে থাকে এবং একটি দাগ যেটি আল্লাহর ফরয বিষয়সমূহ হতে একটির দরুন হয়ে থাকে।”(হাসান, তিরমিযি বর্ণিত)
‘আল-জিহাদ’ শব্দটি পারিভাষিক ভাবে ‘আল্লাহর পথে’ বাক্যের দিকে সম্বন্ধীয় যেমনটি ইবন হাজর আল-আসকালানি ফাতহুল বারীতে ব্যাখ্যা করেছেন।
ইবন রুশদ ‘জিহাদ’ এর অর্থ দিতে গিয়ে বলেনঃ “জিহাদ শব্দ যখন উচ্চারণ করা হয় এর মানে দাঁড়ায় কাফিরদের বিরুদ্ধে তলোয়ার দ্বারা যুদ্ধ করা যতক্ষণ না সে ইসলাম গ্রহণ করে, অথবা জিযিয়া (ট্যাক্স) প্রদান করার মাধ্যমে রাষ্ট্র হতে নিরাপত্তা লাভ করে।”
৩। শহীদ দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবেঃ
“আল্লাহর কোন বান্দা যে মৃত্যুবরণ করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভ করে, কখনই সে এই দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে না, যদিও দুনিয়া এবং এতে যা কিছু আছে সবই তাঁকে প্রদান করা হয়। তবে একজন শহীদ ব্যতীত, (এর কারণ) শহীদি মৃত্যুর ফযীলত হিসেবে সে যা কিছু অবলোকন করেছে তাঁর জন্য। সুতরাং সে দুনিয়াতে ফিরে পুনরায় নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে”- অন্য বর্ণনায় – “সুতরাং সে শাহাদতের যে ফযিলত ও মর্যাদা দেখেছে এর জন্য সে দশবার নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে।”(বোখারী ও মুসলিম)
শহীদ ব্যক্তিকে ‘শহীদ’ নামকরণ করার কারণ সম্পর্কে উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। আল-আজহারি বলেন, “এর কারণ হল আল্লাহ ও তাঁর রসূল এই ব্যাপারে সাক্ষী যে সে জান্নাতী”। আন-নাদর বলেন, “আশ-শহীদ, হলেন জীবিত, সুতরাং তাঁদের এই নামকরণ করা হয়েছে কারণ তাঁরা তাঁদের রবের সাথে জীবিত অবস্থায় আছেন”।
এটিও বলা হয় “কারণ রহমতের ফিরেশতাগণ তাঁর রূহ গ্রহণ করেন এবং তাঁর ব্যাপারে সাক্ষী থাকেন” এবং “সে তাঁদের মধ্য হতে যে তাঁর জাতির সাক্ষ্য দাতা”, অথবা “বাহ্যিক ভাবে সে তাঁর ঈমান এবং ভাল সমাপ্তির সাক্ষী”, অথবা “এর কারণ শেষ বিচারের দিন তাঁর রক্ত তাঁর জন্য সাক্ষী হবে”।
শায়খ আব্দুল্লাহ ‘আযযাম রহঃ বলেনঃ “তাঁরা এই ব্যাপারে সাক্ষী যে এই দ্বীন জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর মুল্য রক্তের চেয়েও দামী এবং এর মূলনীতি আত্মার চেয়েও মূল্যবান।”
৪। হারিসা জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ শিখরেঃ
উম্ম হারসা বিনত নু’মান বদরের যুদ্ধে তাঁর ছেলে শহীদ হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ সে কোথায়(জান্নাতে না জাহান্নামে)?- নাবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই, সে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ শিখরে অবস্থান করছে”। (আল-বুখারী)
ইমাম বুখারী আরেকটি হাদিস বর্ণনা করেনঃ
“অবশ্যই, জান্নাতে একশটি স্তর রয়েছে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর পথের মুজাহিদীনদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। প্রত্যেকটি স্তরের দূরত্ব হল আকাশ ও জমিনের দুরত্বের সমান। সুতরাং যখন তুমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, তখন ফিরদাউসের জন্য প্রার্থনা কর, এটি হল জান্নাতের কেন্দ্র এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ চূড়া, এবং এর উপরেই রাহমান এর আরশ, আর ফিরদাউস হতেই জান্নাতের নদীসমূহের উত্থান।”
৫। শহীদদের আত্মা থাকবে সবুজ পাখিদের হৃদয়েঃ
“অবশ্যই শহীদদের আত্মা সবুজ পাখিদের হৃদয়ে রাখা হবে, এবং তাঁদের অবস্থান হবে আরশের ছায়াতলে। জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে তাঁরা উড়ে বেড়াবে, অতঃপর তাঁরা তাঁদের অবস্থান স্থলে ফিরে আসবে। সুতরাং তাঁদের রব তাঁদের জিজ্ঞেস করবেনঃ ‘তোমাদের কি কোন কিছুর প্রয়োজন রয়েছে?’ তাঁরা বলবে, ‘আমাদের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে, যখন আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা যাতায়াত করছি?’ এবং তিনি তাঁদের লক্ষ্য করে তিনবার এই প্রশ্ন করবেন। যখন তাঁরা এটা বুঝবে যে তাঁরা প্রশ্ন থেকে ছাড় পাবে না, তখন তাঁরা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা চাই আপনি আমাদের আত্মাকে আমাদের দেহে ফিরিয়ে দেন যাতে আমরা পুনরায় আপনার রাস্তায় নিহত হতে পারি’। যখন এটা পরিস্কার হয়ে যাবে যে তাঁদের কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, তখন তাঁদের একা ছেড়ে দেয়া হবে।”(মুসলিম)
৬। শহীদদের জন্য বিশেষ পুরস্কারঃ
“শহীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট সাতটি বিশেষ পুরস্কার রয়েছেঃ ১) রক্তের ফোঁটা জমিনে পড়ার সাথে সাথেই তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে ও জান্নাতে তার ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়া হবে। ২) তাঁকে ঈমানের চাঁদর পরিয়ে দেয়া হবে। ৩) হুর আল-আইন এর সাথে তাঁর বিবাহ দেয়া হবে। ৪) কবরের আজাব থেকে মুক্তি দান করা হবে। ৫) কেয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা থেকে নিরাপদ রাখা হবে। ৬) তার মাথায় ইজ্জতের তাজ পরানো হবে, যার একেকটি ইয়াকুতের মূল্য দুনিয়া ও তার মাঝে যা রয়েছে তার চেয়ে উত্তম। ৭) তাঁকে ৭২টি হুর আল-আইনের সাথে বিবাহ দেয়া হবে এবং তাঁর আত্মীয়দের মধ্য থেকে ৭০জন এর ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে।”(আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে হিব্বান)
৭। উহুদের শহীদগণঃ
“যখন তোমাদের ভাইয়েরা উহুদে নিহত হন, তখন আল্লাহ তাঁদের আত্মাগুলোকে সবুজ পাখিদের হৃদয়ে স্থাপন করে দেন। তাঁরা জান্নাতের নদীসমূহে ঘোরাঘুরি করেন, এবং এর ফলসমূহ হতে ভক্ষণ করেন, অতঃপর আরশের নিচে তাঁদের বাসগৃহে ফিরে আসেন। যখন তাঁরা তাঁদের খাবার ও পানীয় এবং তাঁদের চমৎকার আলোচনা উপভোগ করতে থাকেন, তখন তাঁরা বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা হয় আমাদের ভাইরা এই সম্পর্কে অবহিত হোক যে আল্লাহ আমাদের জন্য কী প্রস্তুত করে রেখেছেন, তাহলে তাঁরা কখনোই জিহাদ পরিহার করবে না আর না তাঁরা জিহাদ থেকে নিবৃত্ত থাকবে।’ অতঃপর আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে তাঁদের জানিয়ে দিব’। সুতরাং আল্লাহ এই আয়াতটি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করলেনঃ “আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাঁদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না…”(৩:১৬৯)।”(আহমাদ, আবু দাউদ, হাকীম একে সহীহ বলেছেন)
৮। শহীদদের স্থান বারিক্ব নদীর পাশেঃ
“শহীদগণ এর স্থান হবে বারিক্ব নদীর পাশে একটি সবুজ গম্বুজে, জান্নাতের দরজার পাশেই, সেখান হতে তাঁদের নিকট সকালে এবং বিকালে আহার্য আসবে।”(সহীহ আল-জামী)
৯। শহীদগন শহর এবং গ্রাম থেকে উত্তমঃ
“শহর এবং গ্রামের অধিবাসীরা আমার সাথে এসে বসবাস করুক আর আমার কাছে এর চেয়েও উত্তম হল আমি আল্লাহর পথে নিহত হই।”(আহমাদ, শক্ত সনদে বর্ণনা করেছেন)
১০। শহীদ মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করেন নাঃ
“শহীদ মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেন না, তবে একটি সুই এর সামান্য খোঁচার পরিমাণ ব্যতিত।”(আহমাদ, তিরমিযি এবং নাসাঈ এবং সনদ হাসান)
১১। শহীদদের স্তরসমূহঃ
“সবচেয়ে উত্তম শহীদ হলেন তাঁরা যারা সম্মুখ ভাগে যুদ্ধ করেন, এবং যুদ্ধ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন না যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। অতঃপর তাঁদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকামে পৌছে দেয়া হয়, এবং আল্লাহ তাঁদের প্রতি হাসেন। এবং যখন তোমাদের রব কোন বান্দার প্রতি হেসে দেন, তখন তাঁর আর কোন হিসাব থাকে না।”(আহমাদ সহীহ সনদে, সহীহ আল-জামে)
১২- যারা নিহত হয় তাঁরা তিন ধরনেরঃ
“যারা নিহত হয় তাঁরা তিন ধরনের হয়ে থাকে। একজন মু’মিন, যে আল্লাহর পথে তাঁর জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। এই হল শহীদ যে কিনা আল্লাহর আরশের নিচের ছাউনির জন্য কৃতকার্য। নাবীগণ তাঁর চেয়ে উত্তম নন, তবে তাঁদের নবুওতের মর্যাদা ব্যতীত।
এবং একজন মানুষ যে তাঁর আত্মাকে পাপ ও ভ্রান্তি দ্বারা কলুষিত করেছে, অতঃপর সে আল্লাহর পথে তাঁর জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। অতএব এই হল মুমাসমাস্তুন(একজন সংশোধিত), যে কিনা তাঁর পাপসমূহ ও ভ্রান্তিসমূহের কাফফারা আদায় করেছে। অবশ্যই, তলোয়ারের ঝলকানি ভ্রান্তিসমূকে দূরে সরিয়ে দেয়। সুতরাং সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করে। আর নিশ্চয়ই জান্নাতের রয়েছে আটটি দরজা, এবং কিছু (দরজা) অন্যগুলোর চেয়ে উত্তম।
আর অন্যটি হল মুনাফিক ব্যক্তি, যে কিনা জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়, অতঃপর অবশ্যই সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। নিশ্চয়ই, তলোয়ারের ঝলকানি নিফাককে দূর করতে পারে না।”(আহমাদ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন, এবং ইবনে হিব্বান এটিকে সহীহ বলেছেন)
১৩। নিহত ব্যক্তির মধ্যে কে উত্তম?
“নাবী (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হলঃ ‘নিহত ব্যক্তির মধ্যে কে উত্তম?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সেই ব্যক্তি আল্লাহর পথে যার রক্ত প্রবাহিত হয় এবং যার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন করা হয়’।”(আহমাদ, আবু দাউদ এবং সনদ বিশ্বাসযোগ্য)
১৪। শহীদদের নেতাঃ
“শহীদদের নেতা হলেন হামযা ইবন আব্দুল মুত্তালিব, এবং সেই ব্যক্তি যে জালিম শাসকের সামনে দাঁড়ায়, এবং তাঁকে ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করে, আর এই কারণে শাসক তাঁকে হত্যা করে।”(হাসান, আল-হাকীম বর্ণনা করেছেন)
১৫। শহীদের আত্মা জান্নাতের ফলসমূহ হতে ভক্ষণ করেঃ
“নিশ্চয়ই, শহীদদের আত্মা সবুজ পাখির হৃদয়ে অবস্থান করে, আর তাঁরা জান্নাতের ফলসমূহ হতে আহার করে।”(সাহীহ, তিরমিযি কা’ব ইবন মালিক হতে বর্ণনা করেন, এবং এটি সহীহ আল-জামীতেও রয়েছে)
১৬। “(আল্লাহর রাস্তায়) নিহত ব্যক্তিকে সেখানেই দাফন করো যেখানে সে যুদ্ধ করেছে।”(সহীহ, সহীহ আল-জামী)
১৭। “পাঁচ রকমের মৃত্যু যার দরুন একজন ব্যক্তি শহীদঃ ১) যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয় সে শহীদ, ২) যে ব্যক্তি ডুবে মারা যায় সে শহীদ, ৩) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মারা যায় সে শহীদ, ৪) যে ব্যক্তি প্লেগ রোগে মারা যায় সে শহীদ, এবং ৫) যে মহিলা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ।”(সহীহ সনদে নাসাঈ বর্ণনা করেছেন, সহীহ আল-জামী)
১৮। “যে ব্যক্তি খালেশভাবে আল্লাহর নিকট শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করে, আল্লাহ তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদায় উত্থিত করবেন, যদিও সে তাঁর বিছানায় মৃত্যু বরণ করে।”(মুসলিম)
শহীদ হওয়ার কামনা খাসভাবে করার মানে হল এর জন্য তৈরি হওয়া, যেমন আল্লাহ বলেনঃ “আর যদি তাঁরা বের হবার সংকল্প নিতো, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো।”(৯:৪৬)
১৯। “যে ব্যক্তি তাঁর বাহন থেকে পড়ে মারা যায় সে শহীদ।”(আত-তাবারানি সহিহ সনদে, সহীহ আল-জামী)
এছাড়াও, উম্ম হারাম বিনত মিলহান এর হাদীসে আছে, “তিনি তাঁর স্বামী ‘উবাদাহ বিন সামিত রাঃ এর সাথে জিহাদে বের হয়েছিলেন, মুয়াবিয়া রাঃ এর নেতৃত্বে মুসলিমদের প্রথম সামুদ্রিক অভিযানে। যখন তাঁরা তাঁদের অভিযান থেকে বাড়ির দিকে ফিরে আসছিলেন এবং জাহাজ আশ-শামে নোঙ্গর ফেলল, তখন তাঁর পশু তাঁর কাছে আসল অতঃপর তিনি তাঁর উপর চড়তে চাইলেন, কিন্তু তিনি তা থেকে পরে গেলেন এবং মারা গেলেন।”(আল-বোখারী)
এই হাদিস সে বিধান এর একটি প্রমাণ যে, জিহাদ থেকে ফিরে আসা এবং জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার অবস্থা সমান।
২০। “যে ব্যক্তি তাঁর সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে ব্যক্তি আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, এবং যে ব্যক্তি তাঁর পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ।”(সহীহ সনদে আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ এবং আহমাদ সাঈদ বিন যাইদ থেকে। এছাড়াও সহীহ আল-জামীতেও রয়েছে)
ফিকহ এর কিতাবে এটি ‘আক্রমণকারী হতে আত্মরক্ষা’ নামে পরিচিত। একজন ‘আক্রমণকারী’ হচ্ছে সেই, যে সম্মান, জীবন এবং সম্পদ এর উপর হামলা করে।
চার মাযহাবের ইমামগণ এই ব্যাপারে একমত যে আক্রমণকারী শত্রুকে বিতাড়িত করা ফরয যে কিনা মুসলিমদের ভূমিতে হামলা করে। একই ভাবে যদি আক্রমণকারী জীবন ও সম্পত্তির উপর হামলা করে- জমহুর উলামার মতে তাঁকে প্রতিহত করা ফরয, এই মতটি মালিকি এবং শাফেয়ী মাযহাব এর মতের সাথে এক, যদিও আক্রমণকারী মুসলিম হয়।
আল-জাসসাস বলেন, “আমরা এই ব্যাপারে কোন ভিন্নমত আছে কিনা জানিনা, যেখানে একজন লোক অন্য কাউকে কোন অধিকার ব্যতীত হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন একজন মুসলিমের জন্য তাঁকে প্রতিহত করা ফরয”। ইবন তাইমিয়া বলেন, “আক্রমণকারী শত্রু, যে কিনা দ্বীন ও জীবনব্যবস্থার উপর হামলা করতে উদ্যত হয়, তখন ঈমান আনার পর প্রথম যে কাজটি ফরয তা হল সেই ব্যক্তিকে প্রতিহত করা।”
২১। “যে ব্যক্তি জুলুমের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হয় সে একজন শহীদ।”(নাসাঈ, সহীহ আল-জামী)
এছাড়াও আবু হুরায়রা রা. এর হাদিসে এর ব্যাখ্যা রয়েছে যা ইমাম মুসলিম রহঃ বর্ণনা করেছেনঃ একজন ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)এর নিকট আসলো এবং জিজ্ঞেস করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যদি কেউ আমার সম্পত্তি দখল করতে চায় তাহলে আমার কি করা উচিৎ?’ তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার সম্পত্তি তাঁকে দিবে না’। লোকটি আবার বলল, ‘কি হবে যদি সে আমার সাথে লড়াই করে?’ তিনি বললেন, ‘লড়াই তাঁর দিকে ফিরিয়ে দাও’। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হবে যদি সে আমাকে মেরে ফেলে?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি একজন শহীদ হবে’। লোকটি আবার বলল, ‘যদি আমি তাঁকে মেরে ফেলি তাহলে কি হবে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সে জাহান্নামে যাবে’।
২২। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা করাঃ
“সেই রবের কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুমিনদের এমন একটি দল না থাকত, যারা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পছন্দ করে না এবং যাদের সকলকে সওয়ারী দিতে পারব না বলে আশংকা করতাম, তা হলে যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছে, আমি সেই ক্ষুদ্র দলটির সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকতাম না। সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, আমি ভালবাসি যে, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে যাই, অতঃপর জীবিত হই, অতঃপর শহীদ হই আবার জীবিত হই, আবার শহীদ হই অতঃপর জীবিত হই, পুনরাই শহীদ হই।”(বুখারী)
অনুরূপভাবে, শহীদ সম্পর্কে সহীহ সনদে আরেকটি বর্ণনা হল যে শহীদ ‘আকাঙ্ক্ষা করবে দুনিয়াতে ফিরে আসার, এবং সে এর ফযিলত যা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর জন্য দশবার নিহত হওয়ার।”
২৩। “একটি সামুদ্রিক অভিযান স্থল ভাগের দশটি অভিযান থেকেও উত্তম। এবং সাগরে যুদ্ধ করতে গিয়ে মাথায় চক্কর খাওয়া সাওয়াবের দিক দিয়ে এমন যেমন স্থল ভাগের যুদ্ধে কোন ব্যক্তি নিজের রক্তে ভিজে উলট পালট হচ্ছে। আর যে ব্যক্তি সাগর পাড়ি দিল সে যেন জিহাদের পথে সমস্ত উপত্যকা ভ্রমণ করল।”(সহীহ সনদে আল-হাকীম ইবন ‘আমর থেকে বর্ণনা করেছেন।)
২৪। “শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় শুধু ঋণ ব্যতিত।”(মুসলিম)
যেমন আল-কুরতুবি শহীদ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, এই অবস্থায়(ঋণগ্রস্ত) জান্নাতে প্রবেশ করা তাঁর জন্য নিষিদ্ধ, তবে তাঁর আত্মার স্থান হবে বারিক্ব নদীর পাশে একটি সবুজ গম্বুজে, জান্নাতের দরজার পাশেই, সেখান হতে তাঁদের নিকট সকালে এবং বিকালে আহার্য আসবে- এবং এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে যায়ঃ দুইটি ফরজের মধ্যে কোনটি আগে প্রাধান্য পাবে? তাঁর কি আল্লাহর পথে যাওয়া উচিৎ? না কি, সে তাঁর ঋণ আদায় করা পর্যন্ত কাজ করতে থাকবে অতঃপর বের হবে?
এখানে আমরা এই ব্যাপারে বলছি- আল্লাহ আমাদের সামর্থ্য দিনঃ যখন মুসলিমদের এক বিঘত ভূমি শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তখন জিহাদ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয হয়ে যায়। যদ্দ্বারা একজন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁর পাওনাদারের অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যাবে, ছোট বালক তাঁর পিতার অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যাবে, এবং এটি হল এই ব্যাপারে একটি ইজমা যা এই উম্মতের সালাফ এবং খালাফ থেকে পাওয়া যায়।
অনুরূপভাবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি এই অবস্থা বিবেচনা করতে পারে। যদি সে ঋণ আদায় করতে সমর্থ না হয়, তাহলে তাঁর উচিৎ অপেক্ষা না করা এবং বের হয়ে যাওয়া। তবে যদি সে ঋণ আদায়ে সমর্থ হয়, তাহলে তাঁর উচিৎ হবে এই অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করা, এবং সে যদি মনে করে ঋণ আদায়ের পর পাওনাদার এই অর্থ আল্লাহর পথে জিহাদে খরচ করবে, তাহলে তাঁর জন্য ঋণ আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। এর ফলে সে দুটি ফয়দা লাভ করবেঃ একটি হল ঋণ আদায় করার, অপরটি হল জিহাদে সাহায্য করার। আর এটিই ইবন তাইমিয়া তাঁর আল-ফতওয়া আল-কুবরাতে উল্লেখ করেছেন।
ইবন তাইমিয়া আরও বলেছেনঃ “মহিলাদের জন্য ফরয হল তাঁরা যেন তাঁদের মাল দিয়ে জিহাদে শরীক হয় যদি তাঁদের কাছে তা থাকে, এবং অনুরূপভাবে শিশুদের সম্পদ দিয়েও। শত্রু যদি আক্রমণ করে, তাহলে দ্বীন, জীবন ও সম্মানের উপর আঘাতকে প্রতিরোধ করা ইজমার দ্বারা ফরয।”
২৫। শহীদ, যে কখনো আল্লাহকে একটি সাজদাহ দেয়নিঃ
“আবু হুরায়রা রা. বলেনঃ আমর বিন উকায়শ ইসলাম পূর্ব যুগে সুদযুক্ত ঋণ দিতেন; তাই তিনি তা শেষ না করা পর্যন্ত ইসলামকে আলিঙ্গন করা অপছন্দ করতেন। তিনি উহুদের দিন আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ আমার চাচাত ভাই কোথায়? লোকেরা বললঃ উহুদের ময়দানে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ অমুক-অমুক কোথায়? তাঁরা বললঃ উহুদে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ অমুক-অমুক কোথায়? তাঁরা বললঃ উহুদের ময়দানে। তখন তিনি তাঁর যাতায়াতের আচ্ছাদনটি জড়ালেন এবং ঘোড়ায় চরলেন; অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে অগ্রসর হলেন। যখন মুসলিমরা তাঁকে দেখলেন , তাঁরা বললেনঃ দূরে থাক, আমর। তিনি বললেনঃ আমি একজন মুমিন(এই বলে তিনি লড়াই শুরু করলেন)। তিনি লড়াই করতে থাকলেন যতক্ষণ না আহত হলেন। তারপর তাঁকে আহত অবস্থায় তাঁর পরিবারের নিকট পাঠানো হল। এই অবস্থায় সা’দ বিন মু’আয তাঁর বোনের কাছে আসলেন এবং বললেনঃ তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি কি তাঁদের (ঋণ দাতাদের) জন্য ক্রোধান্বিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন না আল্লাহর জন্য? তিনি বললেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য। এরপর তিনি মারা গেলেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করলেন। তিনি আল্লাহর জন্য কোন সালাতও পড়েননি।”(আল-হাফিয আল-ইসাবাহতে বলেন- এর সনদ শক্ত, এটি ইবন ইসহাক হতে একটি দল বর্ণনা করেছেন)
২৬। একজন শহীদ, যে তাঁর নিজের অস্ত্র দ্বারা নিহত হয়ঃ
সালামাহ বিন আল-আকওয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ খায়বার এর দিন, আমার ভাই খুব বেপরোয়া ভাবে লড়াই করছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের তরবারি দ্বারা আঘাত পান এবং নিহত হন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীগণ তাঁর ব্যাপারে সন্দেহে পরে গেলেন এবং বললেন, ‘মানুষটি তাঁর নিজের তরবারির দ্বারা নিহত হল’। (ঘটনা শুনে) রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘সে মারা গেছে যখন সে জিহাদ করছিল, একজন মুজাহিদ হিসেবে’। ইবন শাহাব বলেনঃ পরবর্তীতে আমি সালামাহ বিন আল-আকওয়ার পুত্র কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে তাঁর পিতা থেকে অনুরূপ শুনালেন, তবে এই অংশ ব্যতীতঃ রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তাঁরা মিথ্যা বলছে! সে নিহত হয়েছে যখন সে জিহাদ করছিল, একজন মুজাহিদ হিসেবে, সুতরাং সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে।’(বোখারী, মুসলিম এবং তা সুনান আবু দাউদেও সংক্ষেপে পাওয়া যায়)
২৭। অধ্যায়ঃ অমুক লোক শহীদ এ কথা বলবে না।
এই নামেই ইমাম বোখারী একটি অধ্যায় রচনা করেছেনঃ “রাসূল (সাঃ) সঙ্গীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে কোন মুশরিককে একাকী দেখলেই তাঁর পশ্চাতে ছুটত এবং তাঁকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করত। বর্ণনাকারী বলেন, আজ আমাদের কেউ অমুকের মত যুদ্ধ করতে পারেনি। তা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, সে তো জাহান্নামের অধিবাসী হবে।”
হাদীসের শেষের দিকে দেখা যায় সেই ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।
আল-বোখারীর “অমুক অমুক লোক শহীদ এ কথা বলবে না”, এর ব্যাখ্যায় ইবন হাজর বলেন যে, ‘এর মানে হল, নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না’।
আল-বোখারী ও ইবন হাজার যা বর্ণনা করেছেন এর মানে হল এই যে, যদি কোন ব্যক্তি যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয় তাহলে আমরা নিশ্চিত করে তাঁর ব্যাপারে এই কথা বলতে পারব না যে সে শহীদ হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। এর কারণ হল জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য নিহত ব্যক্তির নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া চাই, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে এই ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। এছাড়াও এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদার অন্তর্ভুক্ত যে, আমরা কারো ব্যাপারে এই কথা বলতে পারব না সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিকে ‘শহীদ’ বলা শহীদদের ব্যাপারে সাধারণ বৈধ বিধানের অন্তর্ভুক্ত, এর ভিত্তি একটি শক্ত কিয়াসের এর উপর দাড়িয়ে আছে, সুতরাং তাঁকে কাফনে আবৃত করা হয় না, গোসল করানো হয় না, তাঁর উপর জানাযা পড়া হয় না, আর (উল্লেখিত)এই বিধানগুলো অধিকাংশ সালাফ এবং খালাফ দ্বারা সমর্থিত।
এইভাবে ইবন হাজার বলেন, “এই সব কারণে, সালাফরা বদর, উহুদ এবং অন্যান্য শহীদদেরকে ‘শুহাদা’ বলে সম্বোধন করতেন, এই অনুসারে বিধানটি একটি শক্ত কিয়াসী ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আছে- এবং আল্লাহ ভালো জানেন।”(ফাতহুল বারী)
তাছাড়া, কিছু মুহাদ্দিসীন, উদাহরণস্বরূপ ইবন কাসির রহঃ ‘ইস্তুশ-হিদা’ (মানে ‘শহীদ হয়েছেন’) শব্দ ব্যবহার করেছেন এমন একজনের উপর যে কিনা যুদ্ধে নিহত হননি। এই কথা তিনি আল ফাযল ইবনুল আব্বাস সম্পর্কে বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে এইভাবে উল্লেখ করেছেনঃ ‘তিনি মহামারী রোগের দরুন ‘ইস্তুশ-হিদা’। একইভাবে, তিনি আল-হারিস বিন হিশাম সম্পর্কে বলেনঃ ‘ইস্তুশ-হিদা বিশ-শাম’(তিনি শামে শহীদ হয়েছেন)।
এছাড়াও ইবন কাসির রহঃ আন-নু’মান বিন মুকরিন আল-মুযানি সম্পর্কে বলেনঃ “(উমার রা.) আল-ফারুক তাঁকে একটি বাহিনীর ইমাম বানিয়ে নাহাওয়ান্দ এ প্রেরণ করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিশাল বিজয় এনে দিলেন, তাঁকে সেই ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তাঁর সেইসব বান্দাদের উপর তাঁকে কর্তৃত্ব দান করলেন, এবং তাঁর সাহায্যে আল্লাহ সেখানকার মুসলিমদের ইয়াউম আত-তুনাদ(কিয়ামতের দিন) পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করে দিলেন, তিনি এই দুনিয়ায় তাঁকে বিজয় দান করলেন এবং সেইদিন যেইদিন সাক্ষীরা শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা শাহাদাতের প্রতি তাঁর নিখাত ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করলেন এবং তাঁকে কবুল করলেন, আর এটি হলো হৃদয়ের পরম কামনার বস্তু। অতঃপর তিনি তাঁদের মধ্যে সামিল হয়ে গেলেন, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সুস্পষ্ট কিতাবে বলেছেন, যেটি হলো সরল পথঃ “নিশ্চয়ই, আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়েছেন তাঁদের জান এবং মাল, জান্নাতের বিনিময়ে”।(আত-তাওবা)
(collected)
উম্মাহর অস্তিত্ব আলেমের কলমের কালি এবং শহীদদের আত্ন-ত্যাগের সাথে সম্পর্কিত । এর থেকে অধিক উত্তম আর কি হতে পারে, যে উম্মাহর ইতিহাস আলেমের কলমের কালি এবং তাঁদের রক্তে লেখা হচ্ছে। এটি এমনভাবে যে, ইসলামী ইতিহাসের মানচিত্র কালো এবং লাল দুই সারিতে রঞ্জিত হয়েছে। কালোটি হল আলেমগণের কলমের কালি, আর দ্বিতীয়টি হলো শহীদগণের রক্ত। এবং এর চেয়েও সুন্দর হলো, যখন রক্ত ও কলমের কালি একইসূত্র হতে প্রবাহিত হয়, অর্থাৎ আলেমের হাত, যা কলম চালনা করে এবং কালি নিঃসরণ করে, একই হাত যা থেকে রক্ত ঝরে এবং জাতিকে সামনের দিকে পরিচালনা করে। উলামাগনের লাশের সংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাবে, সে হারে ঘুমন্ত মানুষের সংখ্যা কমে যাবে এবং তারা ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজেদের অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করবে।
অতএব রক্ত ছাড়া ইতিহাস রচিত হয় না। গৌরবের সুউচ্চ ইমারাত খুলি ব্যতীত মাথা উচু করে দাঁড়ায় না। সম্মান এবং মর্যাদা বিকলাঙ্গতা ও লাশের ভিত্তি ছাড়া প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। দৃষ্টান্ত ছাড়া সাম্রাজ্য, আভিজাত্য, রাষ্ট্র এবং সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় না।
শায়খ শহীদ আব্দুল্লাহ ইউসুফ ‘আযযাম রহমতুল্লাহি আলাইহি, হে আমাদের শায়খ! ১৯৮৯ এ আপনাকে গুপ্তহত্যা করার পরও আপনার রক্ত বৃথা যায়নি।
টীকাঃ
শহীদঃ আভিধানিক অর্থে একজন সাক্ষী
শুহাদাঃ শহীদের বহু বচন
শাহাদাহঃ আভিধানিক অর্থে সাক্ষ্য দেয়া
১। শহীদের রক্তের ঘ্রাণ মেশকের মতঃ
“যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম, আল্লাহর পথে এমন কেউ আহত হয় না -এবং আল্লাহ ভালো জানেন কে সত্যিকার ভাবে তাঁর পথে আহত হয়েছে- যে (তাঁর ক্ষতস্থান নিয়ে) কিয়ামতের দিন উত্তিত হবে , এবং তা থেকে রক্ত গড়িয়ে পরবে এবং এর রঙ হবে রক্তের মতই, তবে তাঁর ঘ্রাণ হবে মেশকের মত।”
(মুসলিম, আহমাদ)
২। আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় ফোঁটাঃ
“আল্লাহর নিকট দুটি ফোঁটা এবং দুটি দাগ ব্যতীত সর্বাধিক প্রিয় অন্য কিছুই নাই। অশ্রু ফোঁটা যা আল্লাহর ভয়ে ঝরে থাকে, এবং রক্ত বিন্দু যা আল্লাহর পথে প্রবাহিত হয়। আর দাগসমূহের মধ্য হতে, যে দাগ আল্লাহর পথে হয়ে থাকে এবং একটি দাগ যেটি আল্লাহর ফরয বিষয়সমূহ হতে একটির দরুন হয়ে থাকে।”(হাসান, তিরমিযি বর্ণিত)
‘আল-জিহাদ’ শব্দটি পারিভাষিক ভাবে ‘আল্লাহর পথে’ বাক্যের দিকে সম্বন্ধীয় যেমনটি ইবন হাজর আল-আসকালানি ফাতহুল বারীতে ব্যাখ্যা করেছেন।
ইবন রুশদ ‘জিহাদ’ এর অর্থ দিতে গিয়ে বলেনঃ “জিহাদ শব্দ যখন উচ্চারণ করা হয় এর মানে দাঁড়ায় কাফিরদের বিরুদ্ধে তলোয়ার দ্বারা যুদ্ধ করা যতক্ষণ না সে ইসলাম গ্রহণ করে, অথবা জিযিয়া (ট্যাক্স) প্রদান করার মাধ্যমে রাষ্ট্র হতে নিরাপত্তা লাভ করে।”
৩। শহীদ দুনিয়াতে পুনরায় ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবেঃ
“আল্লাহর কোন বান্দা যে মৃত্যুবরণ করে এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভ করে, কখনই সে এই দুনিয়াতে ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা করবে না, যদিও দুনিয়া এবং এতে যা কিছু আছে সবই তাঁকে প্রদান করা হয়। তবে একজন শহীদ ব্যতীত, (এর কারণ) শহীদি মৃত্যুর ফযীলত হিসেবে সে যা কিছু অবলোকন করেছে তাঁর জন্য। সুতরাং সে দুনিয়াতে ফিরে পুনরায় নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করবে”- অন্য বর্ণনায় – “সুতরাং সে শাহাদতের যে ফযিলত ও মর্যাদা দেখেছে এর জন্য সে দশবার নিহত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা করবে।”(বোখারী ও মুসলিম)
শহীদ ব্যক্তিকে ‘শহীদ’ নামকরণ করার কারণ সম্পর্কে উলামাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। আল-আজহারি বলেন, “এর কারণ হল আল্লাহ ও তাঁর রসূল এই ব্যাপারে সাক্ষী যে সে জান্নাতী”। আন-নাদর বলেন, “আশ-শহীদ, হলেন জীবিত, সুতরাং তাঁদের এই নামকরণ করা হয়েছে কারণ তাঁরা তাঁদের রবের সাথে জীবিত অবস্থায় আছেন”।
এটিও বলা হয় “কারণ রহমতের ফিরেশতাগণ তাঁর রূহ গ্রহণ করেন এবং তাঁর ব্যাপারে সাক্ষী থাকেন” এবং “সে তাঁদের মধ্য হতে যে তাঁর জাতির সাক্ষ্য দাতা”, অথবা “বাহ্যিক ভাবে সে তাঁর ঈমান এবং ভাল সমাপ্তির সাক্ষী”, অথবা “এর কারণ শেষ বিচারের দিন তাঁর রক্ত তাঁর জন্য সাক্ষী হবে”।
শায়খ আব্দুল্লাহ ‘আযযাম রহঃ বলেনঃ “তাঁরা এই ব্যাপারে সাক্ষী যে এই দ্বীন জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর মুল্য রক্তের চেয়েও দামী এবং এর মূলনীতি আত্মার চেয়েও মূল্যবান।”
৪। হারিসা জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ শিখরেঃ
উম্ম হারসা বিনত নু’মান বদরের যুদ্ধে তাঁর ছেলে শহীদ হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ সে কোথায়(জান্নাতে না জাহান্নামে)?- নাবী (সাঃ) বলেন, “অবশ্যই, সে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুউচ্চ শিখরে অবস্থান করছে”। (আল-বুখারী)
ইমাম বুখারী আরেকটি হাদিস বর্ণনা করেনঃ
“অবশ্যই, জান্নাতে একশটি স্তর রয়েছে যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর পথের মুজাহিদীনদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন। প্রত্যেকটি স্তরের দূরত্ব হল আকাশ ও জমিনের দুরত্বের সমান। সুতরাং যখন তুমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে, তখন ফিরদাউসের জন্য প্রার্থনা কর, এটি হল জান্নাতের কেন্দ্র এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ চূড়া, এবং এর উপরেই রাহমান এর আরশ, আর ফিরদাউস হতেই জান্নাতের নদীসমূহের উত্থান।”
৫। শহীদদের আত্মা থাকবে সবুজ পাখিদের হৃদয়েঃ
“অবশ্যই শহীদদের আত্মা সবুজ পাখিদের হৃদয়ে রাখা হবে, এবং তাঁদের অবস্থান হবে আরশের ছায়াতলে। জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা সেখানে তাঁরা উড়ে বেড়াবে, অতঃপর তাঁরা তাঁদের অবস্থান স্থলে ফিরে আসবে। সুতরাং তাঁদের রব তাঁদের জিজ্ঞেস করবেনঃ ‘তোমাদের কি কোন কিছুর প্রয়োজন রয়েছে?’ তাঁরা বলবে, ‘আমাদের আর কী প্রয়োজন থাকতে পারে, যখন আমরা জান্নাতের যেখানে ইচ্ছা যাতায়াত করছি?’ এবং তিনি তাঁদের লক্ষ্য করে তিনবার এই প্রশ্ন করবেন। যখন তাঁরা এটা বুঝবে যে তাঁরা প্রশ্ন থেকে ছাড় পাবে না, তখন তাঁরা বলবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা চাই আপনি আমাদের আত্মাকে আমাদের দেহে ফিরিয়ে দেন যাতে আমরা পুনরায় আপনার রাস্তায় নিহত হতে পারি’। যখন এটা পরিস্কার হয়ে যাবে যে তাঁদের কোন কিছুর প্রয়োজন নেই, তখন তাঁদের একা ছেড়ে দেয়া হবে।”(মুসলিম)
৬। শহীদদের জন্য বিশেষ পুরস্কারঃ
“শহীদের জন্য আল্লাহ তায়ালার নিকট সাতটি বিশেষ পুরস্কার রয়েছেঃ ১) রক্তের ফোঁটা জমিনে পড়ার সাথে সাথেই তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে ও জান্নাতে তার ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়া হবে। ২) তাঁকে ঈমানের চাঁদর পরিয়ে দেয়া হবে। ৩) হুর আল-আইন এর সাথে তাঁর বিবাহ দেয়া হবে। ৪) কবরের আজাব থেকে মুক্তি দান করা হবে। ৫) কেয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা থেকে নিরাপদ রাখা হবে। ৬) তার মাথায় ইজ্জতের তাজ পরানো হবে, যার একেকটি ইয়াকুতের মূল্য দুনিয়া ও তার মাঝে যা রয়েছে তার চেয়ে উত্তম। ৭) তাঁকে ৭২টি হুর আল-আইনের সাথে বিবাহ দেয়া হবে এবং তাঁর আত্মীয়দের মধ্য থেকে ৭০জন এর ব্যাপারে সুপারিশ করার অনুমতি দেয়া হবে।”(আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে হিব্বান)
৭। উহুদের শহীদগণঃ
“যখন তোমাদের ভাইয়েরা উহুদে নিহত হন, তখন আল্লাহ তাঁদের আত্মাগুলোকে সবুজ পাখিদের হৃদয়ে স্থাপন করে দেন। তাঁরা জান্নাতের নদীসমূহে ঘোরাঘুরি করেন, এবং এর ফলসমূহ হতে ভক্ষণ করেন, অতঃপর আরশের নিচে তাঁদের বাসগৃহে ফিরে আসেন। যখন তাঁরা তাঁদের খাবার ও পানীয় এবং তাঁদের চমৎকার আলোচনা উপভোগ করতে থাকেন, তখন তাঁরা বলেন, ‘আমাদের ইচ্ছা হয় আমাদের ভাইরা এই সম্পর্কে অবহিত হোক যে আল্লাহ আমাদের জন্য কী প্রস্তুত করে রেখেছেন, তাহলে তাঁরা কখনোই জিহাদ পরিহার করবে না আর না তাঁরা জিহাদ থেকে নিবৃত্ত থাকবে।’ অতঃপর আল্লাহ বললেন, ‘আমি তোমাদের ব্যাপারে তাঁদের জানিয়ে দিব’। সুতরাং আল্লাহ এই আয়াতটি তাঁর রাসূলের উপর অবতীর্ণ করলেনঃ “আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাঁদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না…”(৩:১৬৯)।”(আহমাদ, আবু দাউদ, হাকীম একে সহীহ বলেছেন)
৮। শহীদদের স্থান বারিক্ব নদীর পাশেঃ
“শহীদগণ এর স্থান হবে বারিক্ব নদীর পাশে একটি সবুজ গম্বুজে, জান্নাতের দরজার পাশেই, সেখান হতে তাঁদের নিকট সকালে এবং বিকালে আহার্য আসবে।”(সহীহ আল-জামী)
৯। শহীদগন শহর এবং গ্রাম থেকে উত্তমঃ
“শহর এবং গ্রামের অধিবাসীরা আমার সাথে এসে বসবাস করুক আর আমার কাছে এর চেয়েও উত্তম হল আমি আল্লাহর পথে নিহত হই।”(আহমাদ, শক্ত সনদে বর্ণনা করেছেন)
১০। শহীদ মৃত্যুর যন্ত্রণা অনুভব করেন নাঃ
“শহীদ মৃত্যু যন্ত্রণা অনুভব করেন না, তবে একটি সুই এর সামান্য খোঁচার পরিমাণ ব্যতিত।”(আহমাদ, তিরমিযি এবং নাসাঈ এবং সনদ হাসান)
১১। শহীদদের স্তরসমূহঃ
“সবচেয়ে উত্তম শহীদ হলেন তাঁরা যারা সম্মুখ ভাগে যুদ্ধ করেন, এবং যুদ্ধ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন না যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। অতঃপর তাঁদেরকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকামে পৌছে দেয়া হয়, এবং আল্লাহ তাঁদের প্রতি হাসেন। এবং যখন তোমাদের রব কোন বান্দার প্রতি হেসে দেন, তখন তাঁর আর কোন হিসাব থাকে না।”(আহমাদ সহীহ সনদে, সহীহ আল-জামে)
১২- যারা নিহত হয় তাঁরা তিন ধরনেরঃ
“যারা নিহত হয় তাঁরা তিন ধরনের হয়ে থাকে। একজন মু’মিন, যে আল্লাহর পথে তাঁর জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। এই হল শহীদ যে কিনা আল্লাহর আরশের নিচের ছাউনির জন্য কৃতকার্য। নাবীগণ তাঁর চেয়ে উত্তম নন, তবে তাঁদের নবুওতের মর্যাদা ব্যতীত।
এবং একজন মানুষ যে তাঁর আত্মাকে পাপ ও ভ্রান্তি দ্বারা কলুষিত করেছে, অতঃপর সে আল্লাহর পথে তাঁর জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়। অতএব এই হল মুমাসমাস্তুন(একজন সংশোধিত), যে কিনা তাঁর পাপসমূহ ও ভ্রান্তিসমূহের কাফফারা আদায় করেছে। অবশ্যই, তলোয়ারের ঝলকানি ভ্রান্তিসমূকে দূরে সরিয়ে দেয়। সুতরাং সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করে। আর নিশ্চয়ই জান্নাতের রয়েছে আটটি দরজা, এবং কিছু (দরজা) অন্যগুলোর চেয়ে উত্তম।
আর অন্যটি হল মুনাফিক ব্যক্তি, যে কিনা জান ও মাল দিয়ে জিহাদ করে, যতক্ষণ সে শত্রুর সাক্ষাৎ পায় ততক্ষণ তাঁদের সাথে যুদ্ধ করে, যুদ্ধ করতে থাকে যতক্ষণ না মৃত্যু এসে যায়, অতঃপর অবশ্যই সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। নিশ্চয়ই, তলোয়ারের ঝলকানি নিফাককে দূর করতে পারে না।”(আহমাদ হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন, এবং ইবনে হিব্বান এটিকে সহীহ বলেছেন)
১৩। নিহত ব্যক্তির মধ্যে কে উত্তম?
“নাবী (সাঃ) কে প্রশ্ন করা হলঃ ‘নিহত ব্যক্তির মধ্যে কে উত্তম?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সেই ব্যক্তি আল্লাহর পথে যার রক্ত প্রবাহিত হয় এবং যার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন করা হয়’।”(আহমাদ, আবু দাউদ এবং সনদ বিশ্বাসযোগ্য)
১৪। শহীদদের নেতাঃ
“শহীদদের নেতা হলেন হামযা ইবন আব্দুল মুত্তালিব, এবং সেই ব্যক্তি যে জালিম শাসকের সামনে দাঁড়ায়, এবং তাঁকে ভাল কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ করে, আর এই কারণে শাসক তাঁকে হত্যা করে।”(হাসান, আল-হাকীম বর্ণনা করেছেন)
১৫। শহীদের আত্মা জান্নাতের ফলসমূহ হতে ভক্ষণ করেঃ
“নিশ্চয়ই, শহীদদের আত্মা সবুজ পাখির হৃদয়ে অবস্থান করে, আর তাঁরা জান্নাতের ফলসমূহ হতে আহার করে।”(সাহীহ, তিরমিযি কা’ব ইবন মালিক হতে বর্ণনা করেন, এবং এটি সহীহ আল-জামীতেও রয়েছে)
১৬। “(আল্লাহর রাস্তায়) নিহত ব্যক্তিকে সেখানেই দাফন করো যেখানে সে যুদ্ধ করেছে।”(সহীহ, সহীহ আল-জামী)
১৭। “পাঁচ রকমের মৃত্যু যার দরুন একজন ব্যক্তি শহীদঃ ১) যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে নিহত হয় সে শহীদ, ২) যে ব্যক্তি ডুবে মারা যায় সে শহীদ, ৩) যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মারা যায় সে শহীদ, ৪) যে ব্যক্তি প্লেগ রোগে মারা যায় সে শহীদ, এবং ৫) যে মহিলা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ।”(সহীহ সনদে নাসাঈ বর্ণনা করেছেন, সহীহ আল-জামী)
১৮। “যে ব্যক্তি খালেশভাবে আল্লাহর নিকট শাহাদাতের মৃত্যু কামনা করে, আল্লাহ তাঁকে শাহাদাতের মর্যাদায় উত্থিত করবেন, যদিও সে তাঁর বিছানায় মৃত্যু বরণ করে।”(মুসলিম)
শহীদ হওয়ার কামনা খাসভাবে করার মানে হল এর জন্য তৈরি হওয়া, যেমন আল্লাহ বলেনঃ “আর যদি তাঁরা বের হবার সংকল্প নিতো, তবে অবশ্যই কিছু সরঞ্জাম প্রস্তুত করতো।”(৯:৪৬)
১৯। “যে ব্যক্তি তাঁর বাহন থেকে পড়ে মারা যায় সে শহীদ।”(আত-তাবারানি সহিহ সনদে, সহীহ আল-জামী)
এছাড়াও, উম্ম হারাম বিনত মিলহান এর হাদীসে আছে, “তিনি তাঁর স্বামী ‘উবাদাহ বিন সামিত রাঃ এর সাথে জিহাদে বের হয়েছিলেন, মুয়াবিয়া রাঃ এর নেতৃত্বে মুসলিমদের প্রথম সামুদ্রিক অভিযানে। যখন তাঁরা তাঁদের অভিযান থেকে বাড়ির দিকে ফিরে আসছিলেন এবং জাহাজ আশ-শামে নোঙ্গর ফেলল, তখন তাঁর পশু তাঁর কাছে আসল অতঃপর তিনি তাঁর উপর চড়তে চাইলেন, কিন্তু তিনি তা থেকে পরে গেলেন এবং মারা গেলেন।”(আল-বোখারী)
এই হাদিস সে বিধান এর একটি প্রমাণ যে, জিহাদ থেকে ফিরে আসা এবং জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার অবস্থা সমান।
২০। “যে ব্যক্তি তাঁর সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে নিহত হয় সে শহীদ, যে ব্যক্তি আত্মরক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি তাঁর দ্বীনকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ, এবং যে ব্যক্তি তাঁর পরিবারকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহীদ।”(সহীহ সনদে আবু দাউদ, তিরমিযি, নাসাঈ এবং আহমাদ সাঈদ বিন যাইদ থেকে। এছাড়াও সহীহ আল-জামীতেও রয়েছে)
ফিকহ এর কিতাবে এটি ‘আক্রমণকারী হতে আত্মরক্ষা’ নামে পরিচিত। একজন ‘আক্রমণকারী’ হচ্ছে সেই, যে সম্মান, জীবন এবং সম্পদ এর উপর হামলা করে।
চার মাযহাবের ইমামগণ এই ব্যাপারে একমত যে আক্রমণকারী শত্রুকে বিতাড়িত করা ফরয যে কিনা মুসলিমদের ভূমিতে হামলা করে। একই ভাবে যদি আক্রমণকারী জীবন ও সম্পত্তির উপর হামলা করে- জমহুর উলামার মতে তাঁকে প্রতিহত করা ফরয, এই মতটি মালিকি এবং শাফেয়ী মাযহাব এর মতের সাথে এক, যদিও আক্রমণকারী মুসলিম হয়।
আল-জাসসাস বলেন, “আমরা এই ব্যাপারে কোন ভিন্নমত আছে কিনা জানিনা, যেখানে একজন লোক অন্য কাউকে কোন অধিকার ব্যতীত হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন একজন মুসলিমের জন্য তাঁকে প্রতিহত করা ফরয”। ইবন তাইমিয়া বলেন, “আক্রমণকারী শত্রু, যে কিনা দ্বীন ও জীবনব্যবস্থার উপর হামলা করতে উদ্যত হয়, তখন ঈমান আনার পর প্রথম যে কাজটি ফরয তা হল সেই ব্যক্তিকে প্রতিহত করা।”
২১। “যে ব্যক্তি জুলুমের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হয় সে একজন শহীদ।”(নাসাঈ, সহীহ আল-জামী)
এছাড়াও আবু হুরায়রা রা. এর হাদিসে এর ব্যাখ্যা রয়েছে যা ইমাম মুসলিম রহঃ বর্ণনা করেছেনঃ একজন ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)এর নিকট আসলো এবং জিজ্ঞেস করলো, ‘হে আল্লাহর রাসূল, যদি কেউ আমার সম্পত্তি দখল করতে চায় তাহলে আমার কি করা উচিৎ?’ তিনি বললেন, ‘তুমি তোমার সম্পত্তি তাঁকে দিবে না’। লোকটি আবার বলল, ‘কি হবে যদি সে আমার সাথে লড়াই করে?’ তিনি বললেন, ‘লড়াই তাঁর দিকে ফিরিয়ে দাও’। লোকটি আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হবে যদি সে আমাকে মেরে ফেলে?’ তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি একজন শহীদ হবে’। লোকটি আবার বলল, ‘যদি আমি তাঁকে মেরে ফেলি তাহলে কি হবে?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘সে জাহান্নামে যাবে’।
২২। শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা করাঃ
“সেই রবের কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, যদি মুমিনদের এমন একটি দল না থাকত, যারা যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে পছন্দ করে না এবং যাদের সকলকে সওয়ারী দিতে পারব না বলে আশংকা করতাম, তা হলে যারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করছে, আমি সেই ক্ষুদ্র দলটির সঙ্গী হওয়া থেকে বিরত থাকতাম না। সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার প্রাণ, আমি ভালবাসি যে, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে যাই, অতঃপর জীবিত হই, অতঃপর শহীদ হই আবার জীবিত হই, আবার শহীদ হই অতঃপর জীবিত হই, পুনরাই শহীদ হই।”(বুখারী)
অনুরূপভাবে, শহীদ সম্পর্কে সহীহ সনদে আরেকটি বর্ণনা হল যে শহীদ ‘আকাঙ্ক্ষা করবে দুনিয়াতে ফিরে আসার, এবং সে এর ফযিলত যা প্রত্যক্ষ করেছে তাঁর জন্য দশবার নিহত হওয়ার।”
২৩। “একটি সামুদ্রিক অভিযান স্থল ভাগের দশটি অভিযান থেকেও উত্তম। এবং সাগরে যুদ্ধ করতে গিয়ে মাথায় চক্কর খাওয়া সাওয়াবের দিক দিয়ে এমন যেমন স্থল ভাগের যুদ্ধে কোন ব্যক্তি নিজের রক্তে ভিজে উলট পালট হচ্ছে। আর যে ব্যক্তি সাগর পাড়ি দিল সে যেন জিহাদের পথে সমস্ত উপত্যকা ভ্রমণ করল।”(সহীহ সনদে আল-হাকীম ইবন ‘আমর থেকে বর্ণনা করেছেন।)
২৪। “শহীদের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয় শুধু ঋণ ব্যতিত।”(মুসলিম)
যেমন আল-কুরতুবি শহীদ সম্পর্কে মন্তব্য করেন যে, এই অবস্থায়(ঋণগ্রস্ত) জান্নাতে প্রবেশ করা তাঁর জন্য নিষিদ্ধ, তবে তাঁর আত্মার স্থান হবে বারিক্ব নদীর পাশে একটি সবুজ গম্বুজে, জান্নাতের দরজার পাশেই, সেখান হতে তাঁদের নিকট সকালে এবং বিকালে আহার্য আসবে- এবং এ ব্যাপারে আল্লাহই ভালো জানেন।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এসে যায়ঃ দুইটি ফরজের মধ্যে কোনটি আগে প্রাধান্য পাবে? তাঁর কি আল্লাহর পথে যাওয়া উচিৎ? না কি, সে তাঁর ঋণ আদায় করা পর্যন্ত কাজ করতে থাকবে অতঃপর বের হবে?
এখানে আমরা এই ব্যাপারে বলছি- আল্লাহ আমাদের সামর্থ্য দিনঃ যখন মুসলিমদের এক বিঘত ভূমি শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হয়, তখন জিহাদ প্রত্যেক মুসলিমের উপর ফরয হয়ে যায়। যদ্দ্বারা একজন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাঁর পাওনাদারের অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যাবে, ছোট বালক তাঁর পিতার অনুমতি ব্যতীত বের হয়ে যাবে, এবং এটি হল এই ব্যাপারে একটি ইজমা যা এই উম্মতের সালাফ এবং খালাফ থেকে পাওয়া যায়।
অনুরূপভাবে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি এই অবস্থা বিবেচনা করতে পারে। যদি সে ঋণ আদায় করতে সমর্থ না হয়, তাহলে তাঁর উচিৎ অপেক্ষা না করা এবং বের হয়ে যাওয়া। তবে যদি সে ঋণ আদায়ে সমর্থ হয়, তাহলে তাঁর উচিৎ হবে এই অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করা, এবং সে যদি মনে করে ঋণ আদায়ের পর পাওনাদার এই অর্থ আল্লাহর পথে জিহাদে খরচ করবে, তাহলে তাঁর জন্য ঋণ আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে। এর ফলে সে দুটি ফয়দা লাভ করবেঃ একটি হল ঋণ আদায় করার, অপরটি হল জিহাদে সাহায্য করার। আর এটিই ইবন তাইমিয়া তাঁর আল-ফতওয়া আল-কুবরাতে উল্লেখ করেছেন।
ইবন তাইমিয়া আরও বলেছেনঃ “মহিলাদের জন্য ফরয হল তাঁরা যেন তাঁদের মাল দিয়ে জিহাদে শরীক হয় যদি তাঁদের কাছে তা থাকে, এবং অনুরূপভাবে শিশুদের সম্পদ দিয়েও। শত্রু যদি আক্রমণ করে, তাহলে দ্বীন, জীবন ও সম্মানের উপর আঘাতকে প্রতিরোধ করা ইজমার দ্বারা ফরয।”
২৫। শহীদ, যে কখনো আল্লাহকে একটি সাজদাহ দেয়নিঃ
“আবু হুরায়রা রা. বলেনঃ আমর বিন উকায়শ ইসলাম পূর্ব যুগে সুদযুক্ত ঋণ দিতেন; তাই তিনি তা শেষ না করা পর্যন্ত ইসলামকে আলিঙ্গন করা অপছন্দ করতেন। তিনি উহুদের দিন আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেনঃ আমার চাচাত ভাই কোথায়? লোকেরা বললঃ উহুদের ময়দানে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ অমুক-অমুক কোথায়? তাঁরা বললঃ উহুদে। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ অমুক-অমুক কোথায়? তাঁরা বললঃ উহুদের ময়দানে। তখন তিনি তাঁর যাতায়াতের আচ্ছাদনটি জড়ালেন এবং ঘোড়ায় চরলেন; অতঃপর তিনি তাঁদের দিকে অগ্রসর হলেন। যখন মুসলিমরা তাঁকে দেখলেন , তাঁরা বললেনঃ দূরে থাক, আমর। তিনি বললেনঃ আমি একজন মুমিন(এই বলে তিনি লড়াই শুরু করলেন)। তিনি লড়াই করতে থাকলেন যতক্ষণ না আহত হলেন। তারপর তাঁকে আহত অবস্থায় তাঁর পরিবারের নিকট পাঠানো হল। এই অবস্থায় সা’দ বিন মু’আয তাঁর বোনের কাছে আসলেন এবং বললেনঃ তাঁকে জিজ্ঞেস করুন, তিনি কি তাঁদের (ঋণ দাতাদের) জন্য ক্রোধান্বিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন না আল্লাহর জন্য? তিনি বললেনঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের জন্য। এরপর তিনি মারা গেলেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করলেন। তিনি আল্লাহর জন্য কোন সালাতও পড়েননি।”(আল-হাফিয আল-ইসাবাহতে বলেন- এর সনদ শক্ত, এটি ইবন ইসহাক হতে একটি দল বর্ণনা করেছেন)
২৬। একজন শহীদ, যে তাঁর নিজের অস্ত্র দ্বারা নিহত হয়ঃ
সালামাহ বিন আল-আকওয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ খায়বার এর দিন, আমার ভাই খুব বেপরোয়া ভাবে লড়াই করছিলেন, কিন্তু তিনি নিজের তরবারি দ্বারা আঘাত পান এবং নিহত হন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীগণ তাঁর ব্যাপারে সন্দেহে পরে গেলেন এবং বললেন, ‘মানুষটি তাঁর নিজের তরবারির দ্বারা নিহত হল’। (ঘটনা শুনে) রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘সে মারা গেছে যখন সে জিহাদ করছিল, একজন মুজাহিদ হিসেবে’। ইবন শাহাব বলেনঃ পরবর্তীতে আমি সালামাহ বিন আল-আকওয়ার পুত্র কে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমাকে তাঁর পিতা থেকে অনুরূপ শুনালেন, তবে এই অংশ ব্যতীতঃ রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘তাঁরা মিথ্যা বলছে! সে নিহত হয়েছে যখন সে জিহাদ করছিল, একজন মুজাহিদ হিসেবে, সুতরাং সে দ্বিগুণ পুরস্কার পাবে।’(বোখারী, মুসলিম এবং তা সুনান আবু দাউদেও সংক্ষেপে পাওয়া যায়)
২৭। অধ্যায়ঃ অমুক লোক শহীদ এ কথা বলবে না।
এই নামেই ইমাম বোখারী একটি অধ্যায় রচনা করেছেনঃ “রাসূল (সাঃ) সঙ্গীদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে কোন মুশরিককে একাকী দেখলেই তাঁর পশ্চাতে ছুটত এবং তাঁকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করত। বর্ণনাকারী বলেন, আজ আমাদের কেউ অমুকের মত যুদ্ধ করতে পারেনি। তা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, সে তো জাহান্নামের অধিবাসী হবে।”
হাদীসের শেষের দিকে দেখা যায় সেই ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।
আল-বোখারীর “অমুক অমুক লোক শহীদ এ কথা বলবে না”, এর ব্যাখ্যায় ইবন হাজর বলেন যে, ‘এর মানে হল, নিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না’।
আল-বোখারী ও ইবন হাজার যা বর্ণনা করেছেন এর মানে হল এই যে, যদি কোন ব্যক্তি যুদ্ধের ময়দানে নিহত হয় তাহলে আমরা নিশ্চিত করে তাঁর ব্যাপারে এই কথা বলতে পারব না যে সে শহীদ হয়েছে এবং জান্নাতে প্রবেশ করবে। এর কারণ হল জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য নিহত ব্যক্তির নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়া চাই, আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে এই ব্যাপারে কোন জ্ঞান নেই। এছাড়াও এটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকীদার অন্তর্ভুক্ত যে, আমরা কারো ব্যাপারে এই কথা বলতে পারব না সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামে।
যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত ব্যক্তিকে ‘শহীদ’ বলা শহীদদের ব্যাপারে সাধারণ বৈধ বিধানের অন্তর্ভুক্ত, এর ভিত্তি একটি শক্ত কিয়াসের এর উপর দাড়িয়ে আছে, সুতরাং তাঁকে কাফনে আবৃত করা হয় না, গোসল করানো হয় না, তাঁর উপর জানাযা পড়া হয় না, আর (উল্লেখিত)এই বিধানগুলো অধিকাংশ সালাফ এবং খালাফ দ্বারা সমর্থিত।
এইভাবে ইবন হাজার বলেন, “এই সব কারণে, সালাফরা বদর, উহুদ এবং অন্যান্য শহীদদেরকে ‘শুহাদা’ বলে সম্বোধন করতেন, এই অনুসারে বিধানটি একটি শক্ত কিয়াসী ভিত্তির উপর দাড়িয়ে আছে- এবং আল্লাহ ভালো জানেন।”(ফাতহুল বারী)
তাছাড়া, কিছু মুহাদ্দিসীন, উদাহরণস্বরূপ ইবন কাসির রহঃ ‘ইস্তুশ-হিদা’ (মানে ‘শহীদ হয়েছেন’) শব্দ ব্যবহার করেছেন এমন একজনের উপর যে কিনা যুদ্ধে নিহত হননি। এই কথা তিনি আল ফাযল ইবনুল আব্বাস সম্পর্কে বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে এইভাবে উল্লেখ করেছেনঃ ‘তিনি মহামারী রোগের দরুন ‘ইস্তুশ-হিদা’। একইভাবে, তিনি আল-হারিস বিন হিশাম সম্পর্কে বলেনঃ ‘ইস্তুশ-হিদা বিশ-শাম’(তিনি শামে শহীদ হয়েছেন)।
এছাড়াও ইবন কাসির রহঃ আন-নু’মান বিন মুকরিন আল-মুযানি সম্পর্কে বলেনঃ “(উমার রা.) আল-ফারুক তাঁকে একটি বাহিনীর ইমাম বানিয়ে নাহাওয়ান্দ এ প্রেরণ করেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁর দ্বারা বিশাল বিজয় এনে দিলেন, তাঁকে সেই ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করলেন, তাঁর সেইসব বান্দাদের উপর তাঁকে কর্তৃত্ব দান করলেন, এবং তাঁর সাহায্যে আল্লাহ সেখানকার মুসলিমদের ইয়াউম আত-তুনাদ(কিয়ামতের দিন) পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত করে দিলেন, তিনি এই দুনিয়ায় তাঁকে বিজয় দান করলেন এবং সেইদিন যেইদিন সাক্ষীরা শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। তিনি সুবহানাহু ওয়া তাআলা শাহাদাতের প্রতি তাঁর নিখাত ভালোবাসা প্রত্যক্ষ করলেন এবং তাঁকে কবুল করলেন, আর এটি হলো হৃদয়ের পরম কামনার বস্তু। অতঃপর তিনি তাঁদের মধ্যে সামিল হয়ে গেলেন, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর সুস্পষ্ট কিতাবে বলেছেন, যেটি হলো সরল পথঃ “নিশ্চয়ই, আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে ক্রয় করে নিয়েছেন তাঁদের জান এবং মাল, জান্নাতের বিনিময়ে”।(আত-তাওবা)
(collected)
Comment