আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে বান্দাদেরকে ফযিলতপূর্ণ বিভিন্ন দিবস ও রজনী দান করেছেন। বছরের কোনো কোনো মাসকে, কোনো কোনো দিন বা রাতকে ফযিলতপূর্ণ ও বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। যাতে এগুলোকে কাজে লাগিয়ে বান্দা ক্ষমা লাভ করতে পারে, নেক আমলে সমৃদ্ধ হতে পারে এবং আল্লাহর প্রিয় হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হল যিলহজ্ব মাস।
এ মাসের প্রথম দশককে আল্লাহ তাআলা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। এ দিনগুলোতেই হজ্বের মৌলিক আমল সম্পাদিত হয়। ১০ই যিলহজ্ব সারা বিশ্বের মুসলিমগণ কুরবানী করেন। এ দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয়। হাদীসে আসেছে,
مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.
আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৯৬৮
যিলহজ্বের ১ম দশ দিন
যিলহজ্ব মাস আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত চার মাসের মধ্যে অন্যতম। আবার এ মাসের প্রথম দশক এতটাই ফযিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, আল্লাহ তাআলা এ দশ রাতের কসম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ.
শপথ ফযরের, শপথ দশ রাত্রির। -সূরা ফাজর (৮৯) : ১-২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.-সহ অনেক সাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫
অন্য এক হাদিসে এ দশককে 'দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন' বলা হয়েছে। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَفْضَلُ أَيّامِ الدّنْيَا أَيّامُ الْعَشْرِ، عَشْرِ ذِي الْحِجّةِ، قَالَ: وَلَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: لَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ عَفّرَ وَجْهَهُ فِي التّرَابِ.
দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিনগুলো হল, যিলহজ্বের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ওই ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে। -মুসনাদে বাযযার, হাদীস ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২০১০; মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮; (قال الهيثمي : إسناده حسن ورجاله ثقات)
গুনাহের মাধ্যমে এ মাসের সম্মান নষ্ট না করি
মুমিন তো আল্লাহর দেওয়া বিভিন্ন সুযোগকে গনীমত মনে করে কাজে লাগায়। এসকল ফযিলতপূর্ণ মওসুমে নেক আমলের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে তার আমলনামা। কিন্তু কখনো কখনো কারো দ্বারা এমন হয়ে যেতে পারে যে, নেক আমলের তো তাওফীক হল না; কিন্তু গুনাহের কালিমায় কলুষিত হল আমলনামা। এমনটি কখনোই কাম্য নয়। এক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-
قوت نيکی نداری بد مکن
নেক আমল করতে যদি নাও পার, গুনাহে লিপ্ত হয়ো না।
নেক আমল যতটুকু করতে পারি-না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি। এর মাধ্যমে তো আমি নিজেকেই অসম্মানিত করছি।
ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. লাতাইফুল মাআরিফে যিলহজ্বের আলোচনায় বলেন-
احذروا المعاصي فإنها تحرم المغفرة في مواسم الرحمة.
রহমতের মওসুমসমূহে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে। -লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ৩৭৯
আর যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত ঘোষণা করেছেন সে আয়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ
(...তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত) ...সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
আল্লাহর নাফরমানী করা নিজের উপর সবচেয়ে বড় যুলুম। কারণ, এর ক্ষতি তো নিজের উপরই আপতিত হবে। সুতরাং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের প্রথম কাজ, সাথে সাথে নেক আমলের প্রতিও যত্মবান হওয়া জরুরি।
নেক আমলের মাধ্যমে এ দশকের হক আদায় করি
হাদীস শরীফে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ দশকের হক আদায়ের পথ ও পদ্ধতি শিখিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন আমল বলে দিয়েছেন। ফযিলত বলার মাধ্যমে আমলগুলোর উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং হাদীস শরীফে বর্ণিত আমলের মাধ্যমেই আমরা এ দশকের হক আদায় করতে পারি। এ দশকের কয়েকটি আমল;
১। যিকির-তাসবীহ
যিকির আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় আমল। এ দশকের আমল হিসেবে বিশেষভাবে যিকিরের কথা এসেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ أَيّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنّ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ وَالتّحْمِيدِ.
আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫৩৪
২। নখ-চুল না কাটা
ইহরাম করার পর হাজ্বী সাহেবদের জন্য নখ-চুল কাটাসহ আরো কিছু বিষয় নিষেধ। কিন্তু যারা হজ্বে যাননি তাদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ-চুল না কাটার মাধ্যমে অন্যরাও সাদৃশ্য অবলম্বন করতে পারে হাজ্বী সাহেবদের সাথে এবং লাভ করতে পারে বিশেষ ফযীলত। হাদীস শরীফে এ আমলের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ.
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন যিলহজ্বের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩
এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তাই যিলকদ মাসেই চুল-নখ কেটে যিলহজ্বের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা চাই। যাতে তা বেশি লম্বা হয়ে না যায়, যা সুন্নতের খেলাফ।
আর যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি না- এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, এ হুকুম কেবলমাত্র কুরবানীকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের দলীল পূর্বোক্ত হাদীস। আর কেউ কেউ বলেন, কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও এ আমল রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ لِرَجُلٍ: أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلّ لِهَذِهِ الْأُمّةِ، فَقَالَ الرّجُلُ: أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ، وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ، وَتَقُصّ شَارِبَكَ، وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ، فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللهِ عَزّ وَجَلّ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে, যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করব? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫
এই হাদীসে যেহেতু কুরবানীর দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়।
হযরত ওলীদ বিন মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ. বলেছেন-
أَنّ ابْنَ عُمَرَ، مَرّ بِامْرَأَةٍ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِ ابْنِهَا فِي أَيّامِ الْعَشْرِ فَقَالَ: لَوْ أَخّرْتِيهِ إِلَى يَوْمِ النّحْرِ كَانَ أَحْسَنَ.
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫২০
৩। প্রথম নয় দিন রোযা রাখা
অধিকাংশ ফকীহগণ এই নয় দিন রোযা রাখা উত্তম বলেছেন। কারো পক্ষে সম্ভব হলে সে পুরো নয় দিনই রোযা রাখল। কারণ, যিলহজ্বের পুরো দশকের আমলই আল্লাহর কাছে প্রিয়। এ দশককে আমলে প্রাণবন্ত রাখার জন্য রোযার বিকল্প কোনো আমল নেই। কারণ, রোযা আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয় আমল। সুতরাং আমাদের যাদের জন্য সম্ভব যিলহজ্বের প্রথম দশক তথা নয় যিলহজ্ব পর্যন্ত রোযা রাখতে চেষ্টা করি। হাদীস শরীফে এসেছে-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয়টি দিবস রোযা রাখতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৩৪; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৮৩৯৩
হযরত হাফসা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন-
أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صِيَامَ عَاشُورَاءَ، وَالْعَشْرَ، وَثَلَاثَةَ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْغَدَاةِ.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪১৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭০৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৩৩৯
বিশেষ ভাবে ৯ই যিলহজ্ব রোযা রাখা
কারো পক্ষে যদি পুরো নয় দিনই রোযা রাখা সম্ভব হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরো নয় দিন যদি সম্ভব না হয়, নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলত থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। কারণ, এ দিনের রোযার ফযীলত সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.
আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
প্রকাশ থাকে যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহজ্বের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজ্বীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ أُمِّ الْفَضْلِ بِنْتِ الْحَارِثِ،أَنّ نَاسًا تَمَارَوْا عِنْدَهَا يَوْمَ عَرَفَةَ، فِي صِيَامِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: هُوَ صَائِمٌ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: لَيْسَ بِصَائِمٍ، فَأَرْسَلْتُ إِلَيْهِ بِقَدَحِ لَبَنٍ، وَهُوَ وَاقِفٌ عَلَى بَعِيرِهِ بِعَرَفَةَ، فَشَرِبَهُ.
উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ বলেন, তার নিকট কতক লোক ইয়াওমে আরাফায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোযার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিল। কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা আছেন। আর কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা নেই। উম্মুল ফযল একটি পেয়ালাতে দুধ পাঠালেন। নবীজী তখন উটের উপর ছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১২৩
আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফকীহগণ হাজ্বীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা.-এর হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল, আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সেদিনই রোযা রাখা হবে। সৌদির হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য, তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহজ্বই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমলও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার, জানুয়ারি ২০১৩ ঈ. (দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর : ইয়াওমে আরাফার রোযা ও কুরবানীর সাথে আকীকা)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন
সূত্র, মাসিক আল কাউসার (সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত)
এ মাসের প্রথম দশককে আল্লাহ তাআলা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছেন। এ দিনগুলোতেই হজ্বের মৌলিক আমল সম্পাদিত হয়। ১০ই যিলহজ্ব সারা বিশ্বের মুসলিমগণ কুরবানী করেন। এ দিনগুলোর নেক আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয়। হাদীসে আসেছে,
مَا مِنْ أَيّامٍ الْعَمَلُ الصّالِحُ فِيهَا أَحَبّ إِلَى اللهِ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ يَعْنِي أَيّامَ الْعَشْرِ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: وَلَا الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ، فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَيْءٍ.
আল্লাহর নিকট যিলহজ্বের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জান-মাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে। অতপর কোনো কিছু নিয়ে ঘরে ফিরে আসেনি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৮; সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৯; জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ১৭২৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৯৬৮
যিলহজ্বের ১ম দশ দিন
যিলহজ্ব মাস আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত চার মাসের মধ্যে অন্যতম। আবার এ মাসের প্রথম দশক এতটাই ফযিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত যে, আল্লাহ তাআলা এ দশ রাতের কসম করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ الْفَجْرِ، وَ لَیَالٍ عَشْرٍ.
শপথ ফযরের, শপথ দশ রাত্রির। -সূরা ফাজর (৮৯) : ১-২
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও মুজাহিদ রাহ.-সহ অনেক সাহাবী, তাবেঈ ও মুফাসসিরগণ বলেন, এখানে ‘দশ রাত্রি’ দ্বারা যিলহজ্বের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৫৩৫
অন্য এক হাদিসে এ দশককে 'দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিন' বলা হয়েছে। হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
أَفْضَلُ أَيّامِ الدّنْيَا أَيّامُ الْعَشْرِ، عَشْرِ ذِي الْحِجّةِ، قَالَ: وَلَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ؟ قَالَ: لَا مِثْلُهُنّ فِي سَبِيلِ اللهِ، إِلّا رَجُلٌ عَفّرَ وَجْهَهُ فِي التّرَابِ.
দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দিনগুলো হল, যিলহজ্বের দশদিন। জিজ্ঞাসা করা হল, আল্লাহর রাস্তায়ও কি তার সমতুল্য নেই? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায়ও তার সমতুল্য নেই। তবে ওই ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ শাহাদাত লাভ করেছে। -মুসনাদে বাযযার, হাদীস ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ২০১০; মাজমাউল যাওয়াইদ ৪/৮; (قال الهيثمي : إسناده حسن ورجاله ثقات)
গুনাহের মাধ্যমে এ মাসের সম্মান নষ্ট না করি
মুমিন তো আল্লাহর দেওয়া বিভিন্ন সুযোগকে গনীমত মনে করে কাজে লাগায়। এসকল ফযিলতপূর্ণ মওসুমে নেক আমলের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করে তার আমলনামা। কিন্তু কখনো কখনো কারো দ্বারা এমন হয়ে যেতে পারে যে, নেক আমলের তো তাওফীক হল না; কিন্তু গুনাহের কালিমায় কলুষিত হল আমলনামা। এমনটি কখনোই কাম্য নয়। এক কবি বড় সুন্দর বলেছেন-
قوت نيکی نداری بد مکن
নেক আমল করতে যদি নাও পার, গুনাহে লিপ্ত হয়ো না।
নেক আমল যতটুকু করতে পারি-না পারি; গুনাহের মাধ্যমে যেন এ সম্মানিত দিনগুলোর অসম্মান না করি। এর মাধ্যমে তো আমি নিজেকেই অসম্মানিত করছি।
ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. লাতাইফুল মাআরিফে যিলহজ্বের আলোচনায় বলেন-
احذروا المعاصي فإنها تحرم المغفرة في مواسم الرحمة.
রহমতের মওসুমসমূহে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তা ক্ষমা থেকে বঞ্চিত করে। -লাতায়েফুল মাআরেফ, পৃ. ৩৭৯
আর যে আয়াতে আল্লাহ তাআলা চারটি মাসকে সম্মানিত ঘোষণা করেছেন সে আয়াতের শেষে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُمْ
(...তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত) ...সুতরাং এ মাসসমূহে তোমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করো না। -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬
আল্লাহর নাফরমানী করা নিজের উপর সবচেয়ে বড় যুলুম। কারণ, এর ক্ষতি তো নিজের উপরই আপতিত হবে। সুতরাং গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা এ মাসের প্রথম কাজ, সাথে সাথে নেক আমলের প্রতিও যত্মবান হওয়া জরুরি।
নেক আমলের মাধ্যমে এ দশকের হক আদায় করি
হাদীস শরীফে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে এ দশকের হক আদায়ের পথ ও পদ্ধতি শিখিয়েছেন। তিনি আমাদেরকে বিভিন্ন আমল বলে দিয়েছেন। ফযিলত বলার মাধ্যমে আমলগুলোর উৎসাহিত করেছেন। সুতরাং হাদীস শরীফে বর্ণিত আমলের মাধ্যমেই আমরা এ দশকের হক আদায় করতে পারি। এ দশকের কয়েকটি আমল;
১। যিকির-তাসবীহ
যিকির আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক প্রিয় আমল। এ দশকের আমল হিসেবে বিশেষভাবে যিকিরের কথা এসেছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
مَا مِنْ أَيّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللهِ وَلَا أَحَبّ إِلَيْهِ الْعَمَلُ فِيهِنّ مِنْ هَذِهِ الْأَيّامِ الْعَشْرِ، فَأَكْثِرُوا فِيهِنّ مِنَ التّهْلِيلِ وَالتّكْبِيرِ وَالتّحْمِيدِ.
আল্লাহ তাআলার নিকট আশারায়ে যিলহজ্বের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এই দিনগুলোতে বেশি বেশি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পড়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫৪৪৬; আদদাআওয়াতুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৫৩৪
২। নখ-চুল না কাটা
ইহরাম করার পর হাজ্বী সাহেবদের জন্য নখ-চুল কাটাসহ আরো কিছু বিষয় নিষেধ। কিন্তু যারা হজ্বে যাননি তাদের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে যিলহজ্বের প্রথম দশকে নখ-চুল না কাটার মাধ্যমে অন্যরাও সাদৃশ্য অবলম্বন করতে পারে হাজ্বী সাহেবদের সাথে এবং লাভ করতে পারে বিশেষ ফযীলত। হাদীস শরীফে এ আমলের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ، أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ: إِذَا رَأَيْتُمْ هِلَالَ ذِي الْحِجّةِ، وَأَرَادَ أَحَدُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ، فَلْيُمْسِكْ عَنْ شَعْرِهِ وَأَظْفَارِهِ.
উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যখন যিলহজ্বের দশক শুরু হবে তখন তোমাদের মধ্যে যে কুরবানী করবে সে যেন তার চুল নখ না কাটে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২৩
এই হাদীসের উপর ভিত্তি করে ফকীহগণ কুরবানীকারীর জন্য নখ-চুল না কাটাকে মুস্তাহাব বলেছেন। তাই যিলকদ মাসেই চুল-নখ কেটে যিলহজ্বের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা চাই। যাতে তা বেশি লম্বা হয়ে না যায়, যা সুন্নতের খেলাফ।
আর যে ব্যক্তি কুরবানী করবে না তার জন্য এ হুকুম প্রযোজ্য কি না- এ ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, এ হুকুম কেবলমাত্র কুরবানীকারীদের জন্য প্রযোজ্য। তাদের দলীল পূর্বোক্ত হাদীস। আর কেউ কেউ বলেন, কুরবানী যারা করবে না তাদের জন্যও এ আমল রয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত-
أَنّ رَسُولَ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ قَالَ لِرَجُلٍ: أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللهُ عَزَّ وَجَلّ لِهَذِهِ الْأُمّةِ، فَقَالَ الرّجُلُ: أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلّا مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا؟ قَالَ: لَا، وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ، وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ، وَتَقُصّ شَارِبَكَ، وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ، فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَّتِكَ عِنْدَ اللهِ عَزّ وَجَلّ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমাকে কুরবানীর দিবসে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে, যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন। এক সাহাবী আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানীহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেওয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী) আমি কি তা কুরবানী করব? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, তবে তুমি চুল, নখ ও মোঁচ কাটবে এবং নাভীর নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কুরবানী বলে গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫
এই হাদীসে যেহেতু কুরবানীর দিন চুল-নখ কাটার কথা আছে তাহলে এর আগে না কাটার দিকে ইঙ্গিত বুঝা যায়।
হযরত ওলীদ বিন মুসলিম বলেন, আমি মুহাম্মাদ বিন আজলানকে যিলহজ্বের দশকে চুল কাটা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তখন তিনি বললেন, আমাকে নাফে রাহ. বলেছেন-
أَنّ ابْنَ عُمَرَ، مَرّ بِامْرَأَةٍ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِ ابْنِهَا فِي أَيّامِ الْعَشْرِ فَقَالَ: لَوْ أَخّرْتِيهِ إِلَى يَوْمِ النّحْرِ كَانَ أَحْسَنَ.
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এক নারীর নিকট দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। মহিলাটি যিলহজ্বের দশকের ভেতর তার সন্তানের চুল কেটে দিচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, যদি ঈদের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে তবে বড় ভাল হত। -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫২০
৩। প্রথম নয় দিন রোযা রাখা
অধিকাংশ ফকীহগণ এই নয় দিন রোযা রাখা উত্তম বলেছেন। কারো পক্ষে সম্ভব হলে সে পুরো নয় দিনই রোযা রাখল। কারণ, যিলহজ্বের পুরো দশকের আমলই আল্লাহর কাছে প্রিয়। এ দশককে আমলে প্রাণবন্ত রাখার জন্য রোযার বিকল্প কোনো আমল নেই। কারণ, রোযা আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয় আমল। সুতরাং আমাদের যাদের জন্য সম্ভব যিলহজ্বের প্রথম দশক তথা নয় যিলহজ্ব পর্যন্ত রোযা রাখতে চেষ্টা করি। হাদীস শরীফে এসেছে-
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয়টি দিবস রোযা রাখতেন। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩৩৪; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ৮৩৯৩
হযরত হাফসা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন-
أَرْبَعٌ لَمْ يَكُنْ يَدَعُهُنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صِيَامَ عَاشُورَاءَ، وَالْعَشْرَ، وَثَلَاثَةَ أَيّامٍ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَكْعَتَيْنِ قَبْلَ الْغَدَاةِ.
চারটি আমল নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোযা, যিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোযা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামায। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৪১৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৪২২; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭০৪২; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬৩৩৯
বিশেষ ভাবে ৯ই যিলহজ্ব রোযা রাখা
কারো পক্ষে যদি পুরো নয় দিনই রোযা রাখা সম্ভব হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু পুরো নয় দিন যদি সম্ভব না হয়, নয় যিলহজ্বের রোযার ফযীলত থেকে যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। কারণ, এ দিনের রোযার ফযীলত সম্পর্কে আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ، وَالسّنَةَ الّتِي بَعْدَهُ.
আরাফার দিনের (নয় যিলহজ্বের) রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
প্রকাশ থাকে যে, উক্ত হাদীসে বর্ণিত ইয়াওমে আরাফা দ্বারা যিলহজ্বের নয় তারিখ উদ্দেশ্য। এই তারিখের পারিভাষিক নাম হচ্ছে ইয়াওমে আরাফা। কেননা এই রোযা আরাফার ময়দানের আমল নয় বরং আরাফার দিন তো হাজ্বীদের জন্য রোযা না রাখাই মুস্তাহাব। হাদীস শরীফে এসেছে-
عَنْ أُمِّ الْفَضْلِ بِنْتِ الْحَارِثِ،أَنّ نَاسًا تَمَارَوْا عِنْدَهَا يَوْمَ عَرَفَةَ، فِي صِيَامِ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ، فَقَالَ بَعْضُهُمْ: هُوَ صَائِمٌ، وَقَالَ بَعْضُهُمْ: لَيْسَ بِصَائِمٍ، فَأَرْسَلْتُ إِلَيْهِ بِقَدَحِ لَبَنٍ، وَهُوَ وَاقِفٌ عَلَى بَعِيرِهِ بِعَرَفَةَ، فَشَرِبَهُ.
উম্মুল ফযল বিনতে হারেছ বলেন, তার নিকট কতক লোক ইয়াওমে আরাফায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রোযার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করছিল। কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা আছেন। আর কেউ কেউ বলছিল, তিনি রোযা নেই। উম্মুল ফযল একটি পেয়ালাতে দুধ পাঠালেন। নবীজী তখন উটের উপর ছিলেন। তিনি দুধ পান করলেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১২৩
আরাফার দিন আল্লাহর রাসূল রোযা রাখেননি। একারণে ফকীহগণ হাজ্বীদের জন্য আরাফার দিন রোযা না রাখা উত্তম বলেছেন। আবু কাতাদা রা.-এর হাদীস দ্বারা ইয়াওমে আরাফায় রোযা রাখা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। সুতরাং বুঝা গেল, আবু কাতাদাহ রা.-এর হাদীসে ‘ইয়াওমে আরাফা’ দ্বারা নয় যিলহজ্ব অর্থাৎ ঈদের আগের দিনই উদ্দেশ্য। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন নয় তারিখ হয় সেদিনই রোযা রাখা হবে। সৌদির হিসাবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। উল্লেখ্য, তাকবীরে তাশরীক সংক্রান্ত হাদীসেও ইয়াওমে আরাফা দ্বারা নয় যিলহজ্বই উদ্দেশ্য। কেননা এ আমলও আরাফার সাথে নির্দিষ্ট কোনো আমল নয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, মাসিক আলকাউসার, জানুয়ারি ২০১৩ ঈ. (দুটি প্রশ্ন ও তার উত্তর : ইয়াওমে আরাফার রোযা ও কুরবানীর সাথে আকীকা)
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমীন
সূত্র, মাসিক আল কাউসার (সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত)
Comment