আহলে হাদিসদের সংশয়; গাযওয়াতুল হিন্দ হয়ে গেছে!
গাযওয়াতুল হিন্দ নিয়ে বর্তমান সমাজে একটি অনর্থক বিতর্ক রয়েছে। জিহাদ সমর্থক অনেক ভাই মনে করেন, হাদিসে বর্ণিত প্রতিশ্রুত গাযওয়ায়ে হিন্দ এখনো হয়নি, ভবিষ্যতে হবে। আর একে খণ্ডন করার জন্য হাদিস অনুসরণের দাবীদার কিছু লোক দাবী করে, গাযওয়ায়ে হিন্দ হয়ে গেছে। এটাই নাকি সত্যনিষ্ঠ আলেমদের মত। (লিংক কমেন্টে) এমনকি বর্তমান আহলে হাদিসদের অন্যতম ‘মান্যবর’ ডক্টর মঞ্জুরে ইলাহি একধাপ আগে বেড়ে দাবী করে বসেছে, “গাযওয়ায়ে হিন্দের ব্যাপারে কোনো সহিহ হাদিস নেই, এ ব্যাপারে কিছু যয়ীফ হাদিসের সমাহার দেখা যায়। সুতরাং এ নিয়ে কনফিউজড হওয়ার কিছু নেই।” এই ধরণের ব্যক্তির ব্যাপারে কি-ইবা করা যাবে? এই লোক তো সার্থসিদ্ধির জন্য দীনের স্বতঃসিদ্ধ ইজমায়ী সিদ্ধান্তকেও পাল্টে ফেলতে দ্বিধা করছে না। তাগুত হাসিনা যখন পর্দা নিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলে, “এ কেমন জীবন্ত ট্যান্ট (তাঁবু) হয়ে ঘুরে বেড়ানো!” তখন মঞ্জুরে ইলাহি শেখ হাসিনাকে কুফরী থেকে বাঁচানোর জন্য বলে উঠে, “শরিয়তের কোনো বিধান নিয়ে উপহাস করা কবিরা গুনাহ, কুফর নয়। কুফর হলো, শরিয়তের কোনো বিধান অস্বীকার করা।” অথচ কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় বলছে, শরিয়তের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা করা কুফরি। ইরশাদ হয়েছে,
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ
“তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তবে তারা অবশ্যই বলবে, আমরা তো হাসি-তামাশা ও ফূর্তি করছিলাম। বলো, তোমরা কি আল্লাহ, আল্লাহর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে নিয়ে ফূর্তি করছিলে? অজুহাত দেখিও না। তোমরা ইমান আনার পর কুফরীতে লিপ্ত হয়েছো।” -সূরা তাওবা, ৬৫-৬৬
শুধু তাই নয়, উলামায়ে কেরামের এ ব্যাপারে ঐকমত্যও রয়েছে যে, কেউ শরিয়তের কোনো বিধান নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করলে সে মুরতাদ হয়ে যাবে। ‘মওসুয়্যাহ ফিকহিয়্যাহ’য় চারো মাযহাবের প্রসিদ্ধ কিতাবাদীর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,
أجمع أهل العلم على كفر من أنكر نبوة نبي من الأنبياء، أو رسالة أحد من الرسل عليهم الصلاة والسلام، أو كذبه، أو سبه، أو استخف به، أو سخر منه، أو استهزأ بسنة رسولنا عليه الصلاة والسلام (الموسوعة الفقهية الكويتية 22/210 ط. وزارة الأوقاف والشئون الإسلامية - الكويت)
“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, কোন ব্যক্তি কোন একজন নবীর নবুওয়্যাতকে অস্বীকার করলে, তাকে মিথ্যাবাদী বললে, গালি দিলে, উপহাস করলে কিংবা আমাদের রাসূলের সুন্নাহ নিয়ে ঠাট্টা করলে সে কাফের হয়ে যাবে।” -মওসুয়্যাহ ফিকহিয়্যাহ, ২২/২১০
ভাবার বিষয় হলো, ইসলামী শরিয়তের এরকম সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরও কেন তারা মুরতাদ শাসকদের বাঁচানোর জন্য দীনের অকাট্য বিধান পরিবর্তন করার পাঁয়তারা করে? এর উত্তর সেটাই যা আলোচ্য বক্তা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে আরোপ করেছে। সে বলেছে, “কিছু মানুষ শাসকদের তাকফির করে থাকে, তাদেরকে কাফের প্রমাণ করার চেষ্টা করে, যেন এর মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভ করা যায়।” অথচ, বাহ্যত জ্ঞানী সেজে থাকা এই বোকা লোকটিও ভালো করেই জানে, শাসকদের কাফের বলে কেউ কোনো সুযোগ-সুবিধা পায় না। বরং শাসকদের কাফের বললে তো ওদের রোষানলে পড়তে হয়। হাদিসের সুস্পষ্টভাষ্য অনুযায়ী মুরতাদ হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করা ওয়াজিব হয়ে যায়। সুযোগ-সুবিধা কিছু পেলে তো এই নামস্বর্বস্ব ডক্টর ও শায়খরাই লাভ করে। অন্যথায় শাসকদের হাজারো কুফরী প্রকাশ পাওয়ার পরও তারা কোনো অবস্থাতেই ওদের তাকফীর করতে চায় না কেন? কারণ তো এটাই, যেন ওদের রোষানলে পুড়ে মরতে না হয়। রুটি-রোজগারের কোনো অভাব না হয়। শায়খ হামদ বিন নাসের আলফাহাদ ফাক্কাল্লাহু আসরাহু কতই না সুন্দর বলেছেন,
“শুনে রাখুন আমার মুসলিম ভাইয়েরা, অধিকাংশ আলিমরা দুঃখজনকভাবে তাকফিরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মূলনীতি এতোদিন জানতেন না, তা হল যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করে যা তাকে ইসলামের গণ্ডী থেকে বের করে দেয় – সে কখনো শাসকদের একজন হতে পারে না। কারণ শাসকরা যে কুফর বা শিরকই করুক না কেন, তাদের তাকফির করা হলে আকাশ ভেঙ্গে পড়া এবং পর্বতমালা ধ্বসে পড়ার মতো অবস্থা হবে।
যাই হোক, গাযওয়ায়ে হিন্দের হাদিসের তাহকীক পূর্বেও পেশ করা হয়েছে, আর সব আহলে হাদিস মঞ্জুরে ইলাহির মত বেপরোয়াও না। অধিকাংশ আহলে হাদিস আলেমরাই বলেন, গাযওয়ায়ে হিন্দের হাদিস সহিহ, তবে তা হয়ে গেছে। তাই আজকে এ ব্যাপারটাই সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চাচ্ছি ইনশাআল্লাহ।
আসলে যারা মনে করেন গাযওয়াতুল হিন্দ হয়ে গেছে আর যারা মনে করেন তা এখনো হয়নি, এই দুই শ্রেণীই ভুল ধারণার শিকার। কারণ, হাদিসের শব্দ থেকে এটাই স্পষ্ট যে, হিন্দের কাফের-মুশরিকদের সাথে যত যুদ্ধ হবে সবই গাযওয়ায়ে হিন্দের অন্তর্ভুক্ত। হাদিসের শব্দ লক্ষ্য করুন,
عن ثوبان مولى رسول الله، صلى الله عليه وسلم قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: «عصابتان من أمتي أحرزهما الله من النار: عصابة تغزو الهند، وعصابة تكون مع عيسى ابن مريم عليهما السلام». أخرجه النسائي: (3175) وأحمد: (22396)
ছাওবান রাযি. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমার উম্মতের দুটি দলকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম হতে মুক্তিদান করেছেন। তাদের একটি দল হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের সাথে যুদ্ধ করবে। অপর দল ঈসা আলাইহিস সালামের সাথে যুদ্ধ করবে।” -সুনানে নাসায়ী, ৩১৭৫ মুসনাদে আহমদ, ২২৩৯৬
عن أبي هريرة، قال: «وعدنا رسول الله صلى الله عليه وسلم غزوة الهند، فإن أدركتها أنفق فيها نفسي ومالي، وإن قتلت كنت أفضل الشهداء، وإن رجعت فأنا أبو هريرة المحرر». رواه النسائي: (3174) وأحمد (7128)
আবু হুরাইরা বলেন, “রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হিন্দুস্তানের যুদ্ধের ওয়াদা করেছেন, যদি আমি (সেই যুদ্ধে) শহিদ হই তাহলে আমি হবো সর্বোত্তম শহিদদের একজন। আর যদি আমি (সেই যুদ্ধ থেকে জীবিত অবস্থায়) ফিরে আসতে পারি তাহলে আমি হবো (জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত।” -মুসনাদে আহমদ: ৭১২৮ সুনানে নাসায়ী, ৩১৭৪)
দেখুন, হাদিসের সব আম বা ব্যাপক। সুতরাং তাকে নির্দিষ্ট কোনো দলের সাথে খাস করার কোনই যুক্তি নেই। পূর্ববর্তী আলেমগণও হাদিসের এই ব্যাপক অর্থই বুঝেছেন। তাদের বুঝ নিশ্চয়ই আমাদের বুঝের চেয়ে উত্তম। ইমাম বাইহাকী ‘আসসুনানুল কুবরা’য় আবু হুরাইরা রাযি. এর হাদিসটি বর্ণনা করার পরে ইমাম আবু ইসহাক ফাযারীর বক্তব্য নকল করেছেন। আবু ইসহাক ফাযারী বলেন,
وددت أني شهدت ما ربد بكل غزوة غزوتها في بلاد الروم. (السنن الكبرى للبيهقي: 9 : 297 ط. دار الكتب العلمية: 1424 هـ).
“আমার আকাঙ্ক্ষা জাগে, আমি রোমে যত যুদ্ধ করেছি এর পরিবর্তে যদি (হিন্দুস্তানের) মারবাদে যুদ্ধ করতাম।” -আসসুনানুল কুবরা, বাইহাকী, ৯/২৯৭
আবু ইসহাক ফাযারী (মৃ: ১৮৬ হি.) হলেন ইমাম আওযায়ীর খাস শাগরেদ, তিনি ইমাম আওযায়ী থেকে বর্ণিত জিহাদের বিধিবিধান সংকলন করেছেন। ইমাম যাহাবী তাঁর প্রশংসা করে বলেছেন,
لم يصنف أحد في السير مثل كتاب أبي إسحاق. وقال أبو حاتم: اتفق العلماء على أن أبا إسحاق الفزاري إمام يقتدى به، بلا مدافعة (سير أعلام النبلاء 16/ 69)
“জিহাদের বিধিবিধানের ব্যাপারে আবু ইসহাক ফাযারীর কিতাবের মত কোন কিতাব কেউ সংকলন করতে পারেনি। আবু হাতেম রাযী. রহ. বলেন, আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, আবু ইসহাক ফাযারী অনুসরণীয় ইমাম।” –সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১৬/৬৯
লক্ষ করুন, আবু ইসহাক ফাযারী রহ এই হাদিসের কারণে রুমে যত যুদ্ধ করেছেন সেগুলোর পরিবর্তে হিন্দুস্তানে যুদ্ধ করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, যা থেকে বুঝা যায়; তিনি হিন্দুস্তানের কাফেরদের সাথে সংঘটিত সব যুদ্ধকেই এই হাদিসের মেসদাক-উদ্দেশ্য মনে করছেন। কেননা এই হাদিসের উদ্দেশ্য যদি শুধু সাহাবীদের যমানায় সংঘটিত প্রথম যুদ্ধই হতো, তবে তার এই আকাঙ্ক্ষার কোন অর্থই হতো না।
ইমাম ইবনে কাসীর রহ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের দলিলস্বরুপে সেসকল হাদিস একত্রিত করেছেন যে হাদিসগুলোতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন এবং তা অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় তিনি গাযওয়াতুল হিন্দের হাদিসও উল্লেখ করেছেন, এরপর গাযওয়াতুল হিন্দের ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী কিভাবে সত্য হয়েছে তার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন,
وقد غزا المسلمون الهند في سنة أربع وأربعين في إمارة معاوية بن أبي سفيان رضي الله عنه فجرت هناك أمور فذكرناها مبسوطة، وقد غزاها الملك الكبير السعيد المحمود بن سبكتكين صاحب بلاد غزنة وما والاها في حدود أربعمائة ففعل هنالك أفعالا مشهورة وأمورا مشكورة وكسر الصنم الأعظم المسمى بسومنات وأخذ قلائده وسيوفه ورجع إلى بلاده سالما غانما (النهاية في الفتن: 1/18 دار الجيل، 1408 ه)
“মুসলমানরা মুয়াবিয়া রাযি. এর শাসনামলে তেতাল্লিশ হিজরিতে হিন্দুস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। এরপর গজনীর অধিপতি মহান বাদশাহ মাহমুদ বিন সবুক্তগীন চারশো হিজরির দিকে হিন্দুস্তান ও তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তিনি সেখানে মহান কারনামা আঞ্জাম দিয়েছেন, প্রশংসাযোগ্য অনেক কাজ করেছেন। সোমনাথ মন্দিরের সবচেয়ে বড় মূর্তি ভেঙ্গেছেন এবং তার ভিতরে রক্ষিত হিরা-জহরত নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।” -আননিহায়া ফিল ফিতান, ১/১৮
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইবনে কাসীর রহ. মুয়াবিয়া রাযি. এর আমলে সংঘটিত যুদ্ধ এবং মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান সবগুলোকেই গাযওয়াতুল হিন্দের ব্যাপারে বর্ণিত হাদিসের মেসদাক ধরছেন। এ থেকে প্রমাণ হয়, তিনি গাযওয়াতুল হিন্দকে নির্দিষ্ট কোনো যুদ্ধ মনে করতেন না।
চলবে ইনশাআল্লাহ
Comment