আমরা মুসলমান। নবী-রসূলগণের সরদার হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নবী। সকল বিষয়ে তিনিই আমাদের আদর্শ। দ্বীনের ছোট বড় প্রতিটি বিষয়ে তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন উত্তম আদর্শ-উসওয়ায়ে হাসানা। তাই আমাদের উচিত, দ্বীনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর আদর্শ কী, তা জানা এবং সে মোতাবেক আমল করা।
মাহে রমযান কীভাবে কাটাব? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব, আমরা আমাদের রমযান ঠিক ওভাবেই কাটাব যেভাবে কাটিয়েছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা যদি তাঁর পবিত্র জীবন থেকে রমযানের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরতে পারি তাহলে খুব সহজেই ‘রমযান কীভাবে কাটাব’? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
আমরা আমাদের আলোচনাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করব।
এক. মাহে রমযান সম্পর্কে নববী নির্দেশনা ও আমল।
দুই. মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব?
তিন. মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব না?
বিভিন্ন হাদিসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মাহে রমযান সম্পর্কে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি নিজেও ওগুলোর ওপর আমল করে আমাদের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। আমরা প্রথমে তাঁর দেয়া সেই দিকনির্দেশনাগুলো উল্লেখ করছি। তারপর আমরা তাঁর পবিত্র জীবন থেকে সেগুলোর বাস্তব অনুশীলন দেখব ইনশাআল্লাহ।
মাহে রমযান সম্পর্কে নববী নির্দেশনা
মাহে রমযান সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে আমরা যে নির্দেশনাগুলো পাই সেগুলো নিন্মরূপ –
ক. এটি এমন এক মাস যে মাসের একেকটি নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরয ইবাদতের সমান। আর একেকটি ফরয সত্তরটি ফরযের সমান।
খ. এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চাইতেও বেশি মর্যাদাপূর্ণ।
গ. এ মাসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদেরকে বন্দি করে রাখা হয়।
ঘ. এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়।
ঙ. এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয়।
চ. যারা এ মাসের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, তারা সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।
ছ. যারা এ মাসে নিজেদের গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারবে না, তাদের জন্য হযরত জিবরাইল আ. বদদোয়া করেছেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বদদোয়ার উপর আমীন বলেছেন।
জ. এ মাসটি হল সবরের মাস। আর সবরের পুরষ্কার হল জান্নাত।
ঝ. এ মাসটি হল পরস্পর সহমর্মিতার মাস।
ঞ. এ মাসে মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
ট. এ মাসে কেউ কোন রোযাদারকে ইফতার করালে সে ওই রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করে। এতে রোযাদারের সওয়াব একটুও কমে না। কেউ একটি মাত্র খেজুর কিংবা সামান্য দুধ বা পানি দিয়ে ইফতার করালেও এ সওয়াব লাভ করে।
ঠ. এ মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা বিরাট মর্যাদা পূর্ণ আমল। ইতেকাফরত ব্যক্তি সকল গুনাহ থেকে দূরে থাকে। তাকে ওই সব নেক আমলের পুরস্কার দেওয়া হয়, যা সে ইতেকাফে থাকার কারণে করতে পারছে না।
ড. যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একদিন ইতেকাফ করে, আল্লাহ তাআলা তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। প্রতি খন্দকের দূরত্ব আসমান-যমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান।
এমন আরও বহু নির্দেশনার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে মাহে রমযানের মর্যাদা ও ফযিলত তুলে ধরেছেন, যাতে আমরা যথাযথভাবে এ মাসের হক আদায় করতে পারি এবং ইহকালের সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে পরকালের চিরস্থায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানানো নির্দেশনাগুলোর ওপর যথাযথভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
রমযান বিষয়ক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কীভাবে রমযান কাটাব, তাও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখিয়ে দিয়েছেন। এবার আমরা তাঁর পবিত্র জীবন থেকে তাঁর রমযানের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি।
নবী-জীবনের কয়েকটি রমযান
বদরের যুদ্ধ
দ্বিতীয় হিজরিতে বছর সর্ব প্রথম রোযা রাখার বিধান নাযিল হয়। ইবনে কাসীর রহ., ইমাম তাবারী রহ.র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রমযানের ফরয রোযার বিধান নাযিল হয়। হযরত সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, শাবানের শেষ দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন,
أيها الناسُ قد أظلَّكُم شهرٌ عظيمٌ شهرٌ مُباركٌ، شهرٌ فيهِ ليلةٌ خيرٌ من ألفِ شهرٍ، جعل اللهُ صيامَهُ فريضةً وقيامَ ليلِه تطوعًا، من تقربَ فيهِ بخَصلةٍ من الخيرِ كان كمن أدّى فريضةً فيما سواهُ، ومن أدّى فيهِ فريضةً كان كمنْ أدّى سبعينَ فريضةً فيما سواهُ.
হে লোক সকল! তোমাদের নিকট একটি মহামূল্যবান ও বরকতময় মাস সমাগত। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ তাআলা এ মাসে দিনের বেলা রোযা রাখা ফরয করেছেন এবং রাতের বেলা নামায পড়া নফল সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল। (আত তারগীব : ২/১১৫)
এমনিতেই মাহে রমযান হল কুরআন নাযিলের মাস। তার ওপর এ মাসেই অতি মূল্যবান একটি ইবাদত তথা রোযার সূচনা হয়। ফলে দ্বিতীয় হিজরীর রমযান ছিল মুসলমানদের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রমযানের শুরুর দিকেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খবর আসে, কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা প্রচুর মালপত্র নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে ফিরে যাচ্ছে। কাফেলার সদস্য সংখ্যা মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন। তাদের সাথে মালবোঝাই উটের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশটির মতো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের সূচনালগ্নে এর মূল্যবান সময়গুলোকে সবচেয়ে দামী কাজে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেন। তিনি আল্লাহর দুশমন কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফেলার ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের পিছনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল, যেমন,
এক. মক্কায় রেখে আসা মুহাজিরদের সম্পদের কিছু অংশ হলেও ফিরিয়ে নেয়া।
দুই. মুশরিকদের যাতায়াত পথটিকে অনিরাপদ করে তোলা, যেন তারা এ পথে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে না পারে।
তিন. মক্কার মুশরিকদের অহংকার চূর্ণ করা এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া।
যেহেতু আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ব্যবসায়ী কাফেলা, যেখানে যুদ্ধ বাঁধার তেমন কোন সম্ভাবনা ছিল না, তাই তাতে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি ছিল ঐচ্ছিক। কেউ চাইলে অংশগ্রহণ করতে পারবে, চাইলে নাও পারবে।
কিন্তু মক্কার মুশরিকরা যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অগ্রসর হওয়ার খবর পেল, তখন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এ খবর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছলে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে তিনিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
প্রিয় পাঠক লক্ষ করুন, রোযা ফরয হওয়ার পর এটিই ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম রমযান, বছরের সর্বশেষ্ঠ মাস, সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে দামী সময়। এ সময়ে করার জন্য যে আমলটি নির্বাচন করা হল তা হল, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ। ১২ই রমযান মদিনা ছেড়ে, মসজিদে নববী ছেড়ে সবাই রওনা হলে গেলেন মরু প্রান্তরের উদ্দেশ্য। ১৭ই রমযান সংগঠিত হল ইসলামের ইতিহাসে ঈমান-কুফুরের প্রথম লড়াই। যে লড়াইয়ে ঈমানের প্রশ্নে বাবা সন্তানকে ছাড় দেয়নি, ছেলেও বাবাকে ছাড় দেয়নি। সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার এ মাসে দ্বীনের খাতিরে নিজের তরবারি দিয়ে নিজের আপনজনকে হত্যা করেন। সেই লড়াইয়ে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেন। রমযানের শেষ পর্যন্ত থাকে সেই বিজয় ও সফলতার পবিত্র আমেজ। আল্লাহ আমাদেরকেও এমন রমযান নসীব করেন।
টানা ত্রিশ দিন ইতিকাফ
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাযি. থেকে বর্ণিত সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে মদীনায় কাটানো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি রমযানের বিবরণ এসেছে। তিনি বলেন,
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوَّلَ مِنْ رَمَضَانَ ثُمَّ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ فِي قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ عَلَى سُدَّتِهَا حَصِيرٌ – قَالَ – فَأَخَذَ الْحَصِيرَ بِيَدِهِ فَنَحَّاهَا فِي نَاحِيَةِ الْقُبَّةِ ثُمَّ أَطْلَعَ رَأْسَهُ فَكَلَّمَ النَّاسَ فَدَنَوْا مِنْهُ فَقَالَ ” إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِي إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ” . فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ قَالَ ” وَإِنِّي أُرِيتُهَا لَيْلَةَ وِتْرٍ وَأَنِّي أَسْجُدُ صَبِيحَتَهَا فِي طِينٍ وَمَاءٍ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেন। এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেন। তিনি একটি তুর্কি তাবুতে ইতিকাফ করছিলেন, যার সামনে চাটাইয়ের আড়াল ছিল। (বিশ দিন পার হওয়ার পর) তিনি চাটাইটি ধরে তাবুর এক পাশে সরিয়ে রাখেন। এরপর মাথা বের করে লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। সবাই তাঁর কাছাকাছি গেলে বললেন, কদরের রাতটি তালাশ করার জন্যই আমি প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেছি, এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেছি। এরপর আমাকে জানানো হয়েছে যে, তা শেষ দশকে রয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে কেউ ই’তিকাফ করতে চাইলে সে যেন (এখন) ই’তিকাফ করে। তখন সাহাবিরা তাঁর সাথে ই’তিকাফ করলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে দেখানো হয়েছে, তা বেজোড় রাতে, যে রাতের পরের সকালে (বৃষ্টি হওয়ার কারণে) আমি কাদা-পানিতে সেজদা করছি ………..। (সহী মুসলিম : ২৬৪৫)
এ হাদীসে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি রমযান দেখতে পেলাম। প্রথমে তাঁকে শুধু এটুকু জানানো হয়েছিল যে, এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কিন্তু তা কোনটি তা বলা হয়নি। তিনি সেই রাতটি খুঁজে পাওয়ার জন্য কী পরিমাণ হন্যে হয়ে তালাশ করে চলেছেন! যেন তিনি নিজেও সেই রাতের ফযিলত লাভ করতে পারেন, পাশাপাশি উম্মতও যেন লাভ করতে পারে।
এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে দশ দিন এরপর আরও দশ দিন ইতিকাফ করেন। সব শেষে আরও দশ দিন মিলিয়ে মোট ত্রিশ দিন ইতিকাফ করেন। একটি মাত্র রাতের জন্য টানা ত্রিশ দিন ইতিকাফ করেছেন। অথচ তাঁর পূর্বাপর সব কিছুই ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।
এখন আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের অবস্থা নিয়ে একটু ভাবা, বর্তমানে আমরা আমাদের রমযান কীভাবে কাটাচ্ছি? রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে আমরা কোন কাজে ব্যয় করছি? এ মহামূল্যবান মাস এবং এর মাঝে থাকা মহামূল্যবান রাতটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য আমরা কতটুকু চেষ্টা করি? কতটুকু কষ্ট করি?
মক্কা বিজয়
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও একটি রমযানের চিত্র আমরা দেখব অষ্টম হিজরিতে। অষ্টম হিজরীর শাবান মাসের শেষ দিকে তিনি মক্কা বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। রমযানের দশ তারিখে (কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী রমযানের দুই তারিখে) দশ-এগার হাজার সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। মুহাজির ও আনসারদের প্রায় সবাই এ সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
ইমাম বায়হাকীর বর্ণনা অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের দুই দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মক্কা সফরের কথা ঘোষণা করেন। আর তিনি নিজে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রোযা অবস্থায় মক্কার উদ্দেশে রওনা হই। যখন ‘কাদীদ’ নামক স্থানে পৌঁছি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে রোযা ভাঙ্গার নির্দেশ দেন। তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ভেঙ্গে ফেলেন, কেউ কেউ ভাংগেননি। এরপর যখন আমরা ওই স্থানে পৌঁছলাম যেখানে শত্রুর মুখোমুখী হব, তখন সবাইকে রোযা ভাঙ্গার নির্দেশ দেয়া হলে সবাই রোযা ভেঙ্গে ফেলেন।
ইবনে কাসীর রহ. মুসনাদে আবু দাঊদ তায়ালিসীর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর রোযা অবস্থায় সফর শুরু করেন। যেহেতু তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ ছিলেন পদাতিক, আর কেউ কেউ আরোহী, আর সফরটা ছিল রমযান মাসে তাই তাঁরা যখন ‘কুরাউল গামীম’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন তাঁরা (তাঁকে লক্ষ্য করে) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! লোকদের জন্য রোযা রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, আপনি কী করেন, দেখার জন্য। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পানি ভর্তি পাত্র আনতে বললেন। আনার পর পাত্রটি উপরে তুলে ধরে সবাইকে দেখিয়ে পানি পান করেন। এতে অনেকেই রোযা ভেঙ্গে ফেলল। তবে কিছু লোক তখনও রোযা ভাঙ্গল না। তাদের কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলে তিনি বললেন, ওরাই হচ্ছে অবাধ্য।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে ‘মাররুয যাহরান’ নামক স্থানে অবস্থান করে বিভিন্ন উপায়ে মক্কার মুশরিকদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে থাকেন। এরপর বিশ বা তেইশ রমযান তেমন কোন সংঘাত ছাড়াই বিজয়ী বেশে মক্কা প্রবেশ করেন। প্রবেশের সময় কিছু কিছু মুশরিককে হত্যা করা হয় আর কারো কারো ব্যাপারে হত্যার হুকুম জারি করা হয়। তাদের কারো কারো ব্যাপারে এ নির্দেশও দেয়া হয় যে, তারা যদি কাবার গিলাফও আঁকড়ে ধরে থাকে তবুও তাদেরকে হত্যা করা হবে। মক্কায় প্রবেশ করার সময় তিনি সূরা ফাতাহ তিলাওয়াত করতে ছিলেন। তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর মাথা নুয়ে ছিল। তিনি বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করেন। কাবার ভেতরে প্রবেশ করেন। যমযমের পানি পান করেন। এ সময় তাঁর মুখে জারি ছিল-
الحمد لله الذي صدق وعده، ونصر عبده، وهزم الأحزاب وحده
সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার, যিনি নিজ ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
ইবনে হিশামের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে কাসীর রহ. উল্লেখ করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে ওখানে থাকা ফেরেশতাদের ছবি এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ছবিসহ সব ধরনের ছবি মুছে ফেলতে বলেন। তখন তিনি তিলাওয়াত করতে থাকেন,
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
ইব্রাহীম ইহুদি ছিলেন না এবং খ্রিস্টানও ছিলেন না, তিনি ছিলেন `হানীফ’ অর্থাৎ, সকল মিথ্যা ধর্ম থেকে বিমুখ এবং আত্নসমর্পণকারী এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না। সূরা আলে ইমরাম (৩) : ৬৭
মুসনাদে আহমাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে কাসীর রহ. উল্লেখ করেছেন, হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি কাপড় ভিজিয়ে সবগুলো ছবি মুছে ফেলেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। তখন সেখানে আর কোন ছবি ছিল না।
সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা প্রবেশ করেন তখন বাইতুল্লাহর চারদিকে তিন শত ষাটটি মূর্তি রাখা ছিল। তিনি হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে আঘাত করছিলেন আর তিলাওয়াত করছিলেন-
قُلْ جَاء الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيدُ
বলুন, সত্য আগমন করেছে এবং অসত্য না পারে নতুন কিছু সৃজন করতে এবং না পারে পূনঃ প্রত্যাবর্তিত হতে। সূরা সাবা (৩৪) : ৪৯
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে-
وَقُلْ جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
বলুন, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সূরা বনি ইসরাঈল (১৭): ৮১
ইবনে কাসীর রহ. দালাইলুন নুবুওয়াহ’র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদেরকে ক্ষেপানোর জন্য বেলাল রাযি.কে কাবা ঘরের ছাদে উঠে আযান দিতে বলেন।
সে বছর মাহে রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মক্কা নগরীতে কুফর ও শিরকের নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করে সেখানে আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চ করার কাজে ব্যয় করেন।
ইমাম ইবনে কাসীরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের অবশিষ্ট দিনগুলো মক্কাতেই কাটান। তখন তাঁর রোযা রাখারও সুযোগ হয়নি। এ সময় তিনি আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতে জিহাদের কাফেলা পাঠাতে থাকেন। এর পাশাপাশি জিহাদের ওপর বাইআত নেয়াও অব্যাহত ছিল।
এই ছিল রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও একটি রমযান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কী অনুপম কুদরত! দ্বিতীয় হিজরির রমযান মাসে সাহাবায়ে কেরামের ক্ষুদ্র একটি কাফেলার আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইসলামের বিজয়ের সূচনা হয়। আর এর ক’বছর পর ঠিক রমযান মাসেই সাহাবায়ে কেরামের এক বিশাল বাহিনীর হাতে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আল্লাহু আকবার।
যেন পবিত্র মাহে রমযানই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মতো অতিমূল্যবান আমলের মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ের সূচনা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও এমন রমযান নসীব করুন, আমরাও যেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর হারানো বিজয়কে পুনঃরুদ্ধার করতে পারি।
রমযানের আরও দুটি আমল
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে রমযানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও দুটি আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমযানে যখন জিবরাঈল আ.এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হত তখন তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। জিবরাঈল আ. রমযানের প্রতি রাতে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন, রমযান শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকত। তাঁরা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। আর তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবল বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। (সহী বুখারী : ৬)
এ হাদীস থেকে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও দুটি আমলের কথা জানলাম। একটি হল, কুরআন তেলাওয়াত। অপরটি হল, দানশীলতা।
মাহে রমযান সম্পর্কে ওপরে উল্লেখিত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকনির্দেশনা এবং তাঁর ও তাঁর সাহাবিদের কয়েকটি রমযানের আলোকে এখন আমরা ঠিক করব, আমরা আমাদের রমযান কীভাবে কাটাব? রমযানে আমরা কী কী কাজ করব আর কী কী কাজ করব না?
মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব?
এক. মাহে রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস তাই এ মাসে আমরা কুরআন তিলাওয়াত অনেক বেশি করে করব। এক বসায় বেশি পরিমাণ তিলাওয়াত করা কষ্টকর হলে দিন রাতের বিভিন্ন সময়ে তিলাওয়াত করব। তিলাওয়াত করতে না জানলে কারো কাছ থেকে শিখার চেষ্টা করব।
দুই. সাহরীর আগে পরের সময়টাতে অবশ্যই তাহাজ্জুদ পড়ব। বিশেষ করে আমরা যারা বছরের অন্য সময় তাহাজ্জুদ পড়তে পারি না, তারা এ সময় খুব গুরুত্ব সহকারে তাহাজ্জুদ পড়ব। এক মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে এমন অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করব, যেন পরেও আর তাহাজ্জুদ না ছুটে।
তিন. খুব গুরুত্ব সহকারে জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড়ব। তারাবীতে কুরআন তেলাওয়াত যেন তারতীলের সাথে হয়। ধীরে ধীরে এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণে। রুকু-সেজদাগুলোও যেন ধীরে সুস্থিরে আদায় করা হয়। এ নামায রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েছেন। তাঁর যুগে এবং হযরত আবু বকর রাযি.র যুগে সাহাবিগণও পড়েছেন। তবে তখন এ নামায একাকী পড়া হত। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফতকালে জামাতের সাথে পড়ার ব্যবস্থা করেন।
চার. শেষ দশ দিন ইতিকাফ করার চেষ্টা করব। নিজের প্রয়োজনগুলো আগে পরে পূরণ করে এ দশটি দিন সম্পূর্ণ অবসর থাকার চেষ্টা করব।
পাঁচ. শেষ দশকে আমরা নিজেরা এবং আমাদের পরিবারের সবাই রাত জেগে ইবাদত করার চেষ্টা করব। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন করতেন।
ছয়. কোন কারণে ইতিকাফ করতে না পারলে, কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলো মসজিদে কাটানোর চেষ্টা করব।
সাত. ইফতারের বেশ কিছুক্ষণ আগ থেকে ইফতার সামনে নিয়ে দোয়া ও যিকির-আযকারে মশগুল থাকব।
আট. অন্যদেরকে ইফতার করানোর চেষ্টা করব। তেমন সামর্থ্য না থাকলে কম খরচে হলেও ইফতার করানোর চেষ্টা করব।
নয়. আমাদের উপর অর্পিত সব ধরনের ফরয আদায় করার প্রতি যত্নবান হবো। আমাদের থেকে কোন ফরয দায়িত্ব ছুটে যাচ্ছে কি না, এ বিষয়টির প্রতি নজর দেয়ার জন্য মাহে রমযানই হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
দশ. আমাদের ওপর কারো কোন হক থাকলে যথাযথভাবে তা আদায় করে দেব।
এগার. নেক আমলের যতগুলো ধরণ আছে, সবগুলোর ওপরই যেন কিছু না কিছু অনুশীলন হয়ে যায় রমযানে আমরা সে চেষ্টা করব। ছোট থেকে ছোট কোন আমলও যেন আমাদের থেকে একদম ছুটে না যায়।
বার. বেশি বেশি ইস্তেগফার করব। ইস্তেগফারের জন্য বিশেষ কোন সময়ের অপেক্ষায় না থেকে সব সময়ই করার চেষ্টা করব। হাদীসে বর্ণিত ইস্তেগফারের শব্দগুলো জানা থাকলে সেগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেব।
মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব না?
এক. মাহে রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে অহেতুক কাজে নষ্ট করব না।
দুই. রমযানের মুস্তাহাব কিংবা নফল ফযিলতগুলো অর্জন করার জন্য কোনোভাবেই কোন ফরয আমল তরক করব না।
তিন. ইফতারের জন্য এমন কোন আয়োজন করব না, যার ফলে ইফতারের আগে দোয়ায় ব্যঘাত ঘটতে পারে কিংবা আয়োজকদের মধ্যে কারো কোন ফরয ছুটে যেতে পারে অথবা আমাদের বোনদের পর্দায় সমস্যা হতে পারে।
চার. বিধর্মী কিংবা বেনামাযী বা হারাম উপার্জনকারীদের ইফতার মাহফিলে অথবা লোকদেখানো কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আয়োজন করা ইফতার মাহফিলে একদমই আংশগ্রহণ করব না।
পাঁচ. ইফতারের আগে অযথা কথা বলে দোয়া কবুলের মূল্যবান সময়টি নষ্ট করব না। সাহরীর আগে পরের সময়গুলোও কোনোভাবেই নষ্ট করব না।
ছয়. রমযানে কারো সাথে বকাঝকা করা, গালিগালাজ করা, ঝগড়া করা ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকব। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসলেও এড়িয়ে যাব।
সাত. টিভি দেখা, গান শোনা, কাউকে ধোকা দেওয়া, মিথ্যা বলা, পরনিন্দা করা, এ ধরনের ছোট বড় কোন পাপ কাজ করে আমরা আমাদের রমযানের বরকতগুলোকে নষ্ট করব না।
আট. কখনো কোন কারণে আমল করার মতো মানসিকতা না থাকলে একাকী চুপচাপ সময় কাটাব, তবুও কোন পাপ কাজে কিংবা অহেতুক কথাবার্তা বা খেল তামাশায় সময় নষ্ট করব না।
নয়. আয়োজনমূলক দোয়া মুনাজাতের চেয়ে একান্ত দোয়া মুনাজাতের প্রতি বেশি মনোযোগ দেব। আনুষ্ঠানিকতার পেছনে নিজের মূল্যবান সময়, মেধা ও টাকা কোনোটাই নষ্ট করব না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র মাহে রমযানের হক যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।
মাহে রমযান কীভাবে কাটাব? এ প্রশ্নের উত্তরে বলব, আমরা আমাদের রমযান ঠিক ওভাবেই কাটাব যেভাবে কাটিয়েছেন আমাদের প্রাণপ্রিয় রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আমরা যদি তাঁর পবিত্র জীবন থেকে রমযানের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরতে পারি তাহলে খুব সহজেই ‘রমযান কীভাবে কাটাব’? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা পেয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।
আমরা আমাদের আলোচনাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করব।
এক. মাহে রমযান সম্পর্কে নববী নির্দেশনা ও আমল।
দুই. মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব?
তিন. মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব না?
বিভিন্ন হাদিসে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে মাহে রমযান সম্পর্কে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর পাশাপাশি তিনি নিজেও ওগুলোর ওপর আমল করে আমাদের সামনে বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। আমরা প্রথমে তাঁর দেয়া সেই দিকনির্দেশনাগুলো উল্লেখ করছি। তারপর আমরা তাঁর পবিত্র জীবন থেকে সেগুলোর বাস্তব অনুশীলন দেখব ইনশাআল্লাহ।
মাহে রমযান সম্পর্কে নববী নির্দেশনা
মাহে রমযান সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছ থেকে আমরা যে নির্দেশনাগুলো পাই সেগুলো নিন্মরূপ –
ক. এটি এমন এক মাস যে মাসের একেকটি নফল ইবাদত অন্যান্য মাসের ফরয ইবাদতের সমান। আর একেকটি ফরয সত্তরটি ফরযের সমান।
খ. এ মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চাইতেও বেশি মর্যাদাপূর্ণ।
গ. এ মাসে শয়তান ও অবাধ্য জিনদেরকে বন্দি করে রাখা হয়।
ঘ. এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয়।
ঙ. এ মাসে জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হয়।
চ. যারা এ মাসের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, তারা সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে।
ছ. যারা এ মাসে নিজেদের গুনাহ মাফ করিয়ে নিতে পারবে না, তাদের জন্য হযরত জিবরাইল আ. বদদোয়া করেছেন এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বদদোয়ার উপর আমীন বলেছেন।
জ. এ মাসটি হল সবরের মাস। আর সবরের পুরষ্কার হল জান্নাত।
ঝ. এ মাসটি হল পরস্পর সহমর্মিতার মাস।
ঞ. এ মাসে মুমিনের রিযিক বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
ট. এ মাসে কেউ কোন রোযাদারকে ইফতার করালে সে ওই রোযাদারের সমপরিমাণ সওয়াব লাভ করে। এতে রোযাদারের সওয়াব একটুও কমে না। কেউ একটি মাত্র খেজুর কিংবা সামান্য দুধ বা পানি দিয়ে ইফতার করালেও এ সওয়াব লাভ করে।
ঠ. এ মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা বিরাট মর্যাদা পূর্ণ আমল। ইতেকাফরত ব্যক্তি সকল গুনাহ থেকে দূরে থাকে। তাকে ওই সব নেক আমলের পুরস্কার দেওয়া হয়, যা সে ইতেকাফে থাকার কারণে করতে পারছে না।
ড. যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে একদিন ইতেকাফ করে, আল্লাহ তাআলা তার মাঝে এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। প্রতি খন্দকের দূরত্ব আসমান-যমিনের মধ্যবর্তী দূরত্বের সমান।
এমন আরও বহু নির্দেশনার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে মাহে রমযানের মর্যাদা ও ফযিলত তুলে ধরেছেন, যাতে আমরা যথাযথভাবে এ মাসের হক আদায় করতে পারি এবং ইহকালের সামান্য ত্যাগের বিনিময়ে পরকালের চিরস্থায়ী প্রতিদান লাভ করতে পারি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানানো নির্দেশনাগুলোর ওপর যথাযথভাবে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
রমযান বিষয়ক নির্দেশনা দেয়ার পাশাপাশি সেই নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কীভাবে রমযান কাটাব, তাও রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দেখিয়ে দিয়েছেন। এবার আমরা তাঁর পবিত্র জীবন থেকে তাঁর রমযানের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি।
নবী-জীবনের কয়েকটি রমযান
বদরের যুদ্ধ
দ্বিতীয় হিজরিতে বছর সর্ব প্রথম রোযা রাখার বিধান নাযিল হয়। ইবনে কাসীর রহ., ইমাম তাবারী রহ.র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় হিজরীর শাবান মাসে রমযানের ফরয রোযার বিধান নাযিল হয়। হযরত সালমান ফারেসী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, শাবানের শেষ দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে লক্ষ করে বললেন,
أيها الناسُ قد أظلَّكُم شهرٌ عظيمٌ شهرٌ مُباركٌ، شهرٌ فيهِ ليلةٌ خيرٌ من ألفِ شهرٍ، جعل اللهُ صيامَهُ فريضةً وقيامَ ليلِه تطوعًا، من تقربَ فيهِ بخَصلةٍ من الخيرِ كان كمن أدّى فريضةً فيما سواهُ، ومن أدّى فيهِ فريضةً كان كمنْ أدّى سبعينَ فريضةً فيما سواهُ.
হে লোক সকল! তোমাদের নিকট একটি মহামূল্যবান ও বরকতময় মাস সমাগত। এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ তাআলা এ মাসে দিনের বেলা রোযা রাখা ফরয করেছেন এবং রাতের বেলা নামায পড়া নফল সাব্যস্ত করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আদায় করল সে যেন অন্য মাসে একটি ফরয আদায় করল। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করল সে যেন অন্য মাসে সত্তরটি ফরয আদায় করল। (আত তারগীব : ২/১১৫)
এমনিতেই মাহে রমযান হল কুরআন নাযিলের মাস। তার ওপর এ মাসেই অতি মূল্যবান একটি ইবাদত তথা রোযার সূচনা হয়। ফলে দ্বিতীয় হিজরীর রমযান ছিল মুসলমানদের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রমযানের শুরুর দিকেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খবর আসে, কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা প্রচুর মালপত্র নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার দিকে ফিরে যাচ্ছে। কাফেলার সদস্য সংখ্যা মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন। তাদের সাথে মালবোঝাই উটের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশটির মতো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের সূচনালগ্নে এর মূল্যবান সময়গুলোকে সবচেয়ে দামী কাজে ব্যয় করার পরিকল্পনা করেন। তিনি আল্লাহর দুশমন কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফেলার ওপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্তের পিছনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল, যেমন,
এক. মক্কায় রেখে আসা মুহাজিরদের সম্পদের কিছু অংশ হলেও ফিরিয়ে নেয়া।
দুই. মুশরিকদের যাতায়াত পথটিকে অনিরাপদ করে তোলা, যেন তারা এ পথে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে না পারে।
তিন. মক্কার মুশরিকদের অহংকার চূর্ণ করা এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া।
যেহেতু আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ব্যবসায়ী কাফেলা, যেখানে যুদ্ধ বাঁধার তেমন কোন সম্ভাবনা ছিল না, তাই তাতে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি ছিল ঐচ্ছিক। কেউ চাইলে অংশগ্রহণ করতে পারবে, চাইলে নাও পারবে।
কিন্তু মক্কার মুশরিকরা যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অগ্রসর হওয়ার খবর পেল, তখন যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এ খবর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট পৌঁছলে সাহাবিদের সাথে পরামর্শ করে তিনিও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান।
প্রিয় পাঠক লক্ষ করুন, রোযা ফরয হওয়ার পর এটিই ছিল মুসলমানদের জন্য প্রথম রমযান, বছরের সর্বশেষ্ঠ মাস, সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে দামী সময়। এ সময়ে করার জন্য যে আমলটি নির্বাচন করা হল তা হল, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ। ১২ই রমযান মদিনা ছেড়ে, মসজিদে নববী ছেড়ে সবাই রওনা হলে গেলেন মরু প্রান্তরের উদ্দেশ্য। ১৭ই রমযান সংগঠিত হল ইসলামের ইতিহাসে ঈমান-কুফুরের প্রথম লড়াই। যে লড়াইয়ে ঈমানের প্রশ্নে বাবা সন্তানকে ছাড় দেয়নি, ছেলেও বাবাকে ছাড় দেয়নি। সৌহার্দ্য ও সহমর্মিতার এ মাসে দ্বীনের খাতিরে নিজের তরবারি দিয়ে নিজের আপনজনকে হত্যা করেন। সেই লড়াইয়ে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে সুস্পষ্ট বিজয় দান করেন। রমযানের শেষ পর্যন্ত থাকে সেই বিজয় ও সফলতার পবিত্র আমেজ। আল্লাহ আমাদেরকেও এমন রমযান নসীব করেন।
টানা ত্রিশ দিন ইতিকাফ
হযরত আবু সাঈদ খুদরি রাযি. থেকে বর্ণিত সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে মদীনায় কাটানো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি রমযানের বিবরণ এসেছে। তিনি বলেন,
إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوَّلَ مِنْ رَمَضَانَ ثُمَّ اعْتَكَفَ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ فِي قُبَّةٍ تُرْكِيَّةٍ عَلَى سُدَّتِهَا حَصِيرٌ – قَالَ – فَأَخَذَ الْحَصِيرَ بِيَدِهِ فَنَحَّاهَا فِي نَاحِيَةِ الْقُبَّةِ ثُمَّ أَطْلَعَ رَأْسَهُ فَكَلَّمَ النَّاسَ فَدَنَوْا مِنْهُ فَقَالَ ” إِنِّي اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوَّلَ أَلْتَمِسُ هَذِهِ اللَّيْلَةَ ثُمَّ اعْتَكَفْتُ الْعَشْرَ الأَوْسَطَ ثُمَّ أُتِيتُ فَقِيلَ لِي إِنَّهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ فَمَنْ أَحَبَّ مِنْكُمْ أَنْ يَعْتَكِفَ فَلْيَعْتَكِفْ ” . فَاعْتَكَفَ النَّاسُ مَعَهُ قَالَ ” وَإِنِّي أُرِيتُهَا لَيْلَةَ وِتْرٍ وَأَنِّي أَسْجُدُ صَبِيحَتَهَا فِي طِينٍ وَمَاءٍ
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেন। এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেন। তিনি একটি তুর্কি তাবুতে ইতিকাফ করছিলেন, যার সামনে চাটাইয়ের আড়াল ছিল। (বিশ দিন পার হওয়ার পর) তিনি চাটাইটি ধরে তাবুর এক পাশে সরিয়ে রাখেন। এরপর মাথা বের করে লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। সবাই তাঁর কাছাকাছি গেলে বললেন, কদরের রাতটি তালাশ করার জন্যই আমি প্রথম দশ দিন ই’তিকাফ করেছি, এরপর মাঝের দশ দিনও ই’তিকাফ করেছি। এরপর আমাকে জানানো হয়েছে যে, তা শেষ দশকে রয়েছে। অতএব তোমাদের মধ্যে কেউ ই’তিকাফ করতে চাইলে সে যেন (এখন) ই’তিকাফ করে। তখন সাহাবিরা তাঁর সাথে ই’তিকাফ করলেন। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমাকে দেখানো হয়েছে, তা বেজোড় রাতে, যে রাতের পরের সকালে (বৃষ্টি হওয়ার কারণে) আমি কাদা-পানিতে সেজদা করছি ………..। (সহী মুসলিম : ২৬৪৫)
এ হাদীসে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি রমযান দেখতে পেলাম। প্রথমে তাঁকে শুধু এটুকু জানানো হয়েছিল যে, এ মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। কিন্তু তা কোনটি তা বলা হয়নি। তিনি সেই রাতটি খুঁজে পাওয়ার জন্য কী পরিমাণ হন্যে হয়ে তালাশ করে চলেছেন! যেন তিনি নিজেও সেই রাতের ফযিলত লাভ করতে পারেন, পাশাপাশি উম্মতও যেন লাভ করতে পারে।
এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রথমে দশ দিন এরপর আরও দশ দিন ইতিকাফ করেন। সব শেষে আরও দশ দিন মিলিয়ে মোট ত্রিশ দিন ইতিকাফ করেন। একটি মাত্র রাতের জন্য টানা ত্রিশ দিন ইতিকাফ করেছেন। অথচ তাঁর পূর্বাপর সব কিছুই ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।
এখন আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজেদের অবস্থা নিয়ে একটু ভাবা, বর্তমানে আমরা আমাদের রমযান কীভাবে কাটাচ্ছি? রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে আমরা কোন কাজে ব্যয় করছি? এ মহামূল্যবান মাস এবং এর মাঝে থাকা মহামূল্যবান রাতটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর জন্য আমরা কতটুকু চেষ্টা করি? কতটুকু কষ্ট করি?
মক্কা বিজয়
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও একটি রমযানের চিত্র আমরা দেখব অষ্টম হিজরিতে। অষ্টম হিজরীর শাবান মাসের শেষ দিকে তিনি মক্কা বিজয়ের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। রমযানের দশ তারিখে (কোন কোন বর্ণনা অনুযায়ী রমযানের দুই তারিখে) দশ-এগার হাজার সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। মুহাজির ও আনসারদের প্রায় সবাই এ সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন।
ইমাম বায়হাকীর বর্ণনা অনুযায়ী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের দুই দিন অতিবাহিত হওয়ার পর সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মক্কা সফরের কথা ঘোষণা করেন। আর তিনি নিজে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমরা রোযা অবস্থায় মক্কার উদ্দেশে রওনা হই। যখন ‘কাদীদ’ নামক স্থানে পৌঁছি তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে রোযা ভাঙ্গার নির্দেশ দেন। তখন উপস্থিত লোকদের মধ্যে কেউ কেউ ভেঙ্গে ফেলেন, কেউ কেউ ভাংগেননি। এরপর যখন আমরা ওই স্থানে পৌঁছলাম যেখানে শত্রুর মুখোমুখী হব, তখন সবাইকে রোযা ভাঙ্গার নির্দেশ দেয়া হলে সবাই রোযা ভেঙ্গে ফেলেন।
ইবনে কাসীর রহ. মুসনাদে আবু দাঊদ তায়ালিসীর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর রোযা অবস্থায় সফর শুরু করেন। যেহেতু তাঁর সঙ্গীদের কেউ কেউ ছিলেন পদাতিক, আর কেউ কেউ আরোহী, আর সফরটা ছিল রমযান মাসে তাই তাঁরা যখন ‘কুরাউল গামীম’ নামক স্থানে পৌঁছেন তখন তাঁরা (তাঁকে লক্ষ্য করে) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! লোকদের জন্য রোযা রাখা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আপনার দিকে তাকিয়ে আছে, আপনি কী করেন, দেখার জন্য। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি পানি ভর্তি পাত্র আনতে বললেন। আনার পর পাত্রটি উপরে তুলে ধরে সবাইকে দেখিয়ে পানি পান করেন। এতে অনেকেই রোযা ভেঙ্গে ফেলল। তবে কিছু লোক তখনও রোযা ভাঙ্গল না। তাদের কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হলে তিনি বললেন, ওরাই হচ্ছে অবাধ্য।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে ‘মাররুয যাহরান’ নামক স্থানে অবস্থান করে বিভিন্ন উপায়ে মক্কার মুশরিকদেরকে ভীতসন্ত্রস্ত করতে থাকেন। এরপর বিশ বা তেইশ রমযান তেমন কোন সংঘাত ছাড়াই বিজয়ী বেশে মক্কা প্রবেশ করেন। প্রবেশের সময় কিছু কিছু মুশরিককে হত্যা করা হয় আর কারো কারো ব্যাপারে হত্যার হুকুম জারি করা হয়। তাদের কারো কারো ব্যাপারে এ নির্দেশও দেয়া হয় যে, তারা যদি কাবার গিলাফও আঁকড়ে ধরে থাকে তবুও তাদেরকে হত্যা করা হবে। মক্কায় প্রবেশ করার সময় তিনি সূরা ফাতাহ তিলাওয়াত করতে ছিলেন। তখন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর মাথা নুয়ে ছিল। তিনি বাইতুল্লাহ শরীফ তাওয়াফ করেন। কাবার ভেতরে প্রবেশ করেন। যমযমের পানি পান করেন। এ সময় তাঁর মুখে জারি ছিল-
الحمد لله الذي صدق وعده، ونصر عبده، وهزم الأحزاب وحده
সকল প্রশংসা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার, যিনি নিজ ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, নিজ বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং একাই শত্রুবাহিনীকে পরাজিত করেছেন।
ইবনে হিশামের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে কাসীর রহ. উল্লেখ করেছেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরে প্রবেশ করে ওখানে থাকা ফেরেশতাদের ছবি এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ছবিসহ সব ধরনের ছবি মুছে ফেলতে বলেন। তখন তিনি তিলাওয়াত করতে থাকেন,
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
ইব্রাহীম ইহুদি ছিলেন না এবং খ্রিস্টানও ছিলেন না, তিনি ছিলেন `হানীফ’ অর্থাৎ, সকল মিথ্যা ধর্ম থেকে বিমুখ এবং আত্নসমর্পণকারী এবং তিনি মুশরিক ছিলেন না। সূরা আলে ইমরাম (৩) : ৬৭
মুসনাদে আহমাদের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে কাসীর রহ. উল্লেখ করেছেন, হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু একটি কাপড় ভিজিয়ে সবগুলো ছবি মুছে ফেলেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেন। তখন সেখানে আর কোন ছবি ছিল না।
সহীহ বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাযিয়াল্লাহ আনহু বলেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন যখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা প্রবেশ করেন তখন বাইতুল্লাহর চারদিকে তিন শত ষাটটি মূর্তি রাখা ছিল। তিনি হাতে থাকা লাঠি দিয়ে মূর্তিগুলোকে আঘাত করছিলেন আর তিলাওয়াত করছিলেন-
قُلْ جَاء الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيدُ
বলুন, সত্য আগমন করেছে এবং অসত্য না পারে নতুন কিছু সৃজন করতে এবং না পারে পূনঃ প্রত্যাবর্তিত হতে। সূরা সাবা (৩৪) : ৪৯
কোন কোন বর্ণনায় এসেছে-
وَقُلْ جَاء الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا
বলুন, সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। সূরা বনি ইসরাঈল (১৭): ৮১
ইবনে কাসীর রহ. দালাইলুন নুবুওয়াহ’র উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন, মক্কা বিজয়ের দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুশরিকদেরকে ক্ষেপানোর জন্য বেলাল রাযি.কে কাবা ঘরের ছাদে উঠে আযান দিতে বলেন।
সে বছর মাহে রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্র মক্কা নগরীতে কুফর ও শিরকের নাম-নিশানা নিশ্চিহ্ন করে সেখানে আল্লাহর কালিমাকে সুউচ্চ করার কাজে ব্যয় করেন।
ইমাম ইবনে কাসীরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের অবশিষ্ট দিনগুলো মক্কাতেই কাটান। তখন তাঁর রোযা রাখারও সুযোগ হয়নি। এ সময় তিনি আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতে জিহাদের কাফেলা পাঠাতে থাকেন। এর পাশাপাশি জিহাদের ওপর বাইআত নেয়াও অব্যাহত ছিল।
এই ছিল রাসূলে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও একটি রমযান। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কী অনুপম কুদরত! দ্বিতীয় হিজরির রমযান মাসে সাহাবায়ে কেরামের ক্ষুদ্র একটি কাফেলার আত্মত্যাগের বিনিময়ে ইসলামের বিজয়ের সূচনা হয়। আর এর ক’বছর পর ঠিক রমযান মাসেই সাহাবায়ে কেরামের এক বিশাল বাহিনীর হাতে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আল্লাহু আকবার।
যেন পবিত্র মাহে রমযানই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মতো অতিমূল্যবান আমলের মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ের সূচনা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও এমন রমযান নসীব করুন, আমরাও যেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মাধ্যমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর হারানো বিজয়কে পুনঃরুদ্ধার করতে পারি।
রমযানের আরও দুটি আমল
হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে রমযানে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও দুটি আমলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে বেশি দানশীল ছিলেন। রমযানে যখন জিবরাঈল আ.এর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হত তখন তিনি আরও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। জিবরাঈল আ. রমযানের প্রতি রাতে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন, রমযান শেষ হওয়া পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকত। তাঁরা একে অপরকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। আর তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রবল বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। (সহী বুখারী : ৬)
এ হাদীস থেকে আমরা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরও দুটি আমলের কথা জানলাম। একটি হল, কুরআন তেলাওয়াত। অপরটি হল, দানশীলতা।
মাহে রমযান সম্পর্কে ওপরে উল্লেখিত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকনির্দেশনা এবং তাঁর ও তাঁর সাহাবিদের কয়েকটি রমযানের আলোকে এখন আমরা ঠিক করব, আমরা আমাদের রমযান কীভাবে কাটাব? রমযানে আমরা কী কী কাজ করব আর কী কী কাজ করব না?
মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব?
এক. মাহে রমযান যেহেতু কুরআন নাযিলের মাস তাই এ মাসে আমরা কুরআন তিলাওয়াত অনেক বেশি করে করব। এক বসায় বেশি পরিমাণ তিলাওয়াত করা কষ্টকর হলে দিন রাতের বিভিন্ন সময়ে তিলাওয়াত করব। তিলাওয়াত করতে না জানলে কারো কাছ থেকে শিখার চেষ্টা করব।
দুই. সাহরীর আগে পরের সময়টাতে অবশ্যই তাহাজ্জুদ পড়ব। বিশেষ করে আমরা যারা বছরের অন্য সময় তাহাজ্জুদ পড়তে পারি না, তারা এ সময় খুব গুরুত্ব সহকারে তাহাজ্জুদ পড়ব। এক মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে এমন অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করব, যেন পরেও আর তাহাজ্জুদ না ছুটে।
তিন. খুব গুরুত্ব সহকারে জামাতের সাথে তারাবীর নামায পড়ব। তারাবীতে কুরআন তেলাওয়াত যেন তারতীলের সাথে হয়। ধীরে ধীরে এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণে। রুকু-সেজদাগুলোও যেন ধীরে সুস্থিরে আদায় করা হয়। এ নামায রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েছেন। তাঁর যুগে এবং হযরত আবু বকর রাযি.র যুগে সাহাবিগণও পড়েছেন। তবে তখন এ নামায একাকী পড়া হত। হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু তাঁর খেলাফতকালে জামাতের সাথে পড়ার ব্যবস্থা করেন।
চার. শেষ দশ দিন ইতিকাফ করার চেষ্টা করব। নিজের প্রয়োজনগুলো আগে পরে পূরণ করে এ দশটি দিন সম্পূর্ণ অবসর থাকার চেষ্টা করব।
পাঁচ. শেষ দশকে আমরা নিজেরা এবং আমাদের পরিবারের সবাই রাত জেগে ইবাদত করার চেষ্টা করব। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন করতেন।
ছয়. কোন কারণে ইতিকাফ করতে না পারলে, কমপক্ষে বেজোড় রাতগুলো মসজিদে কাটানোর চেষ্টা করব।
সাত. ইফতারের বেশ কিছুক্ষণ আগ থেকে ইফতার সামনে নিয়ে দোয়া ও যিকির-আযকারে মশগুল থাকব।
আট. অন্যদেরকে ইফতার করানোর চেষ্টা করব। তেমন সামর্থ্য না থাকলে কম খরচে হলেও ইফতার করানোর চেষ্টা করব।
নয়. আমাদের উপর অর্পিত সব ধরনের ফরয আদায় করার প্রতি যত্নবান হবো। আমাদের থেকে কোন ফরয দায়িত্ব ছুটে যাচ্ছে কি না, এ বিষয়টির প্রতি নজর দেয়ার জন্য মাহে রমযানই হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
দশ. আমাদের ওপর কারো কোন হক থাকলে যথাযথভাবে তা আদায় করে দেব।
এগার. নেক আমলের যতগুলো ধরণ আছে, সবগুলোর ওপরই যেন কিছু না কিছু অনুশীলন হয়ে যায় রমযানে আমরা সে চেষ্টা করব। ছোট থেকে ছোট কোন আমলও যেন আমাদের থেকে একদম ছুটে না যায়।
বার. বেশি বেশি ইস্তেগফার করব। ইস্তেগফারের জন্য বিশেষ কোন সময়ের অপেক্ষায় না থেকে সব সময়ই করার চেষ্টা করব। হাদীসে বর্ণিত ইস্তেগফারের শব্দগুলো জানা থাকলে সেগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেব।
মাহে রমযানে আমরা কী কী কাজ করব না?
এক. মাহে রমযানের মূল্যবান সময়গুলোকে অহেতুক কাজে নষ্ট করব না।
দুই. রমযানের মুস্তাহাব কিংবা নফল ফযিলতগুলো অর্জন করার জন্য কোনোভাবেই কোন ফরয আমল তরক করব না।
তিন. ইফতারের জন্য এমন কোন আয়োজন করব না, যার ফলে ইফতারের আগে দোয়ায় ব্যঘাত ঘটতে পারে কিংবা আয়োজকদের মধ্যে কারো কোন ফরয ছুটে যেতে পারে অথবা আমাদের বোনদের পর্দায় সমস্যা হতে পারে।
চার. বিধর্মী কিংবা বেনামাযী বা হারাম উপার্জনকারীদের ইফতার মাহফিলে অথবা লোকদেখানো কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আয়োজন করা ইফতার মাহফিলে একদমই আংশগ্রহণ করব না।
পাঁচ. ইফতারের আগে অযথা কথা বলে দোয়া কবুলের মূল্যবান সময়টি নষ্ট করব না। সাহরীর আগে পরের সময়গুলোও কোনোভাবেই নষ্ট করব না।
ছয়. রমযানে কারো সাথে বকাঝকা করা, গালিগালাজ করা, ঝগড়া করা ইত্যাদি থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকব। কেউ গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে আসলেও এড়িয়ে যাব।
সাত. টিভি দেখা, গান শোনা, কাউকে ধোকা দেওয়া, মিথ্যা বলা, পরনিন্দা করা, এ ধরনের ছোট বড় কোন পাপ কাজ করে আমরা আমাদের রমযানের বরকতগুলোকে নষ্ট করব না।
আট. কখনো কোন কারণে আমল করার মতো মানসিকতা না থাকলে একাকী চুপচাপ সময় কাটাব, তবুও কোন পাপ কাজে কিংবা অহেতুক কথাবার্তা বা খেল তামাশায় সময় নষ্ট করব না।
নয়. আয়োজনমূলক দোয়া মুনাজাতের চেয়ে একান্ত দোয়া মুনাজাতের প্রতি বেশি মনোযোগ দেব। আনুষ্ঠানিকতার পেছনে নিজের মূল্যবান সময়, মেধা ও টাকা কোনোটাই নষ্ট করব না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পবিত্র মাহে রমযানের হক যথাযথভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাব্বাল আলামীন।
Comment