✅ "আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই
আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিম বর্ণনা করে" ✅
➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
[সুরা-হাশর, শেষ চার আয়াতের ব্যাখ্যা]
--------------------------------------------------------
'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,
-------------------------------------------
মহিমান্বিত আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
-
"আর আমি যদি এ কুরআন,
পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহলে তুমি তাকে দেখতে আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
মানুষের জন্য আমি এসব দৃষ্টান্ত এজন্য বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা করে। [২১]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ, তিঁনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিঁনি অসীম দয়াময়, পরম দয়ালু। [২২]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ; যিঁনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিঁনিই বাদশাহ, মহাপবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত, তারা যা শরীক করে তা হতে আল্লাহ পবিত্র মহান। [২৩]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকারী, রুপদাতা, তাঁর জন্যই আছে সুন্দর সুন্দর নাম।
আসমানে ও জমীনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা-মহিমা বর্ণনা করে। তিঁনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" [২৪]
_____[সুরা-হাশর, আয়াত-২১-২৪]_____
~~~
২১-২৪ নং আয়াতের সংক্ষেপকৃত তাফসীর:
~~~
আল্লাহ্ তা'আলা কুরআন কারীমের বুযুর্গী ও মাহাত্মের বর্ণনা দিচ্ছেন যে,
এই পবিত্র কুরআন প্রকৃতপক্ষে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব।
এর সামনে অন্তর ঝুঁকে পড়ে, লোম খাড়া হয়ে যায়, কলিজা কেঁপে ওঠে।
এর সত্য ওয়াদা ও ভীতি প্রদর্শন প্রত্যেককে কাঁপিয়ে তোলে এবং আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত করে।
~~~
মহান আল্লাহ বলেন যদি আমি এই কুরআন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম তবে অবশ্যই দেখা যেতো যে,
ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
অর্থাৎ যদি মহামহিমান্বিত আল্লাহ এই কুরআনকে কোন কঠিন ও উঁচু পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতেন,
এবং ওকে চিন্তা ও অনুভূতি শক্তি দান করতেন তবে ওটাও তাঁর ভয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো।
তাহলে মানুষের অন্তরে তো এটা আরো অধিক ক্রিয়াশীল হওয়া উচিত।
কেননা, পর্বতের তুলনায় মানুষের অন্তর বহুগুণে নরম ও ক্ষুদ্র এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় বোধ ও অনুভূতি শক্তি রয়েছে।
মানুষ যেন চিন্তা-গবেষণা করে এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা মানুষের সামনে এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন।
উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা ও বিনীত হওয়া।
~~~
মুতাওয়াতির হাদীসে রয়েছে যে,
মিম্বর নির্মিত হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিতেন।
অতঃপর যখন মিম্বর তৈরী হয়ে গেল ও বিছিয়ে দেয়া হলো তখন তিনি তার উপর দাঁড়িয়েই খুতবাহ দিতে লাগলেন
এবং ঐ খুঁড়িটিকে সরিয়ে দেয়া হলো।
ঐ সময় ঐ গুঁড়ি হতে কান্নার শব্দ আসতে লাগলো।
শিশুর মত ওটা ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।
কারণ এই যে, ওকে আল্লাহর যিকির ও অহী কিছুটা দূর থেকে শুনতে হচ্ছে।
-
হযরত ইমাম বসরী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলতেনঃ
“হে লোক সকল!
খেজুর গাছের একটি গুড়ি যদি আল্লাহর রাসূল (সঃ) -এর প্রতি এতো আসক্ত হতে পারে,
তবে তো তোমাদের তার প্রতি ওর চেয়ে বহুগুণ বেশী আসক্তি থাকা উচিত। অনুরূপভাবে এই আয়াতটি যে,
যদি একটি পাহাড়ের এই অবস্থা হয় তবে এই অবস্থায় তোমাদের এর চেয়ে অগ্রগামী হওয়া উচিত।
কারণ তোমরা তো শুনছো ও বুঝছো?”
~~~
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
“যদি কোন কুরআন এরূপ হতো যে, ওর কারণে পর্বতরাজিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অথবা যমীনকে কেটে দেয়া হবে কিংবা মৃতকে কথা বলানো হবে (তবে এর যোগ্য একমাত্র এই কুরআনই ছিল, আর তখনো কিন্তু এই কাফিররা ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য লাভ করতো না)।”
(১৩ সুরা-রাদ: ৩১)
~~~
অন্য এক জায়গায় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেছেনঃ (আরবী)অর্থাৎ “পাথরও কতক এমন যে, ওটা হতে নদী-নালা প্রবাহিত হয় এবং কতক এই রূপ যে,
বিদীর্ণ হওয়ার পর ওটা হতে পানি নির্গত হয়, আবার কতক এমন যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।”
(২ সুরা বাকারা: ৭৪)
~~~
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ
"আল্লাহ্ ছাড়া না কোন পালনকর্তা রয়েছে, না তার সত্তা ছাড়া এমন কোন সত্তা রয়েছে যে, কেউ তার কোন প্রকারের ইবাদত করতে পারে।
আল্লাহ্ ছাড়া মানুষ যাদের ইবাদত করে সেগুলো সবই বাতিল। তিনি সারা বিশ্বের দৃশ্যের ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা।
প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুই তাঁর কাছে পূর্ণভাবে প্রকাশমান।
তিঁনি এমন বড় ও প্রশস্ত রহমতের অধিকারী যে,
তাঁর রহমত সমস্ত মাখলুকের উপর পূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে রহমানও বটে এবং রাহীমও বটে।"
~~~
আমাদের তাফসীরের শুরুতে এ দু’টি নামের পুরো তাফসীর গত হয়েছে। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
“আমার রহমত সমস্ত জিনিসকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।”
(৭ সুরা আরাফ : ১৫৬)
~~~
অন্য জায়গায় আছেঃ
“তোমাদের প্রতিপালক তাঁর নিজের উপর রহমত লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।”
(৬ সুরা-আনআম: ৫৪)
~~~
আল্লাহ্ তা'আলা আরো বলেনঃ
“আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার প্রতিই তাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, তাদের জমাকৃত জিনিস হতে এটাই উত্তম।”
(১০ সুরা-ইউনুস: ৫৮)
~~~
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
তিঁনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। সমস্ত জিনিসের একক মালিক তিঁনিই।
তিঁনিই সবকিছুকে হেরফেরকারী। সব কিছুরই অধিকর্তা ও অধিপতি তিনিই। তিনিই সব কিছুরই ব্যবস্থাপক।
কেউই এমন নেই যে তাঁর কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বা তাঁকে তাঁর কার্যসম্পাদন করা হতে বিরত রাখতে পারে।
তিঁনিই পবিত্র। অর্থাৎ তিনিই প্রকাশমান ও কল্যাণময়। সত্তাগত ও গুণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র।
সমস্ত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতা এবং অন্যান্য সবই তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণায় সর্বদা রত।
তিঁনিই অতীব মহিমান্বিত। তার কোন কাজ হিকমতশূন্য নয়।
তাঁর সমুদয় কাজকর্মেও তিনি সর্বপ্রকারের দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্র।
তিঁনিই নিরাপত্তা বিধায়ক। অর্থাৎ তিনি সমস্ত মাখলুককে এ ব্যাপারে নিরাপত্তা দান করেছেন যে,
তাদের উপর তার পক্ষ হতে কখনো কোন প্রকারের অত্যাচার হবে না।
তিঁনি যে সত্য কথা বলেছেন,
এ কথা বলে তিঁনি সকলকে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন। তিঁনি তাঁর মুমিন বান্দাদের ঈমানের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
~~~
তিঁনিই রক্ষক অর্থাৎ তিনি তাঁর সমস্ত মাখলকের সমস্ত আমল সদা প্রত্যক্ষ ও রক্ষাকারী।
যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
“আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে রক্ষক।”
(৮৫ সুরা-বুরুজ: ৯)
~~~
আর এক জায়গায় বলেনঃ
“আল্লাহ তাদের সমস্ত আমলের উপর সাক্ষী।”
(১০ সুরা-ইউনুস: ৪৬)
~~~
তিঁনিই পরাক্রমশালী। প্রত্যেক জিনিস তাঁর আদেশ পালনে বাধ্য। প্রত্যেক মাখলুকের উপর তিনি বিজয়ী।
সুতরাং তার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তিমত্তা এবং বড়ত্ব দেখে কেউই তাঁর মুকাবিলা করতে পারে না।
তিঁনিই প্রবল এবং তিঁনিই মহিমান্বিত। শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব প্রকাশ করা শুধু তাঁরই জন্যে শোভনীয়।
অহংকার করা শুধু তারই সাজে।
যেমন সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে,
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
“বড়াই করা আমার ইযার এবং অহংকার করা আমার চাদর।
সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু'টোর যে কোন একটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, আমি তাকে শাস্তি প্রদান করবো।”
~~~
সমস্ত কাজের সংস্কার ও সংশোধন তাঁরই হাতে।
তিঁনি প্রত্যেক কুকর্মকে ঘৃণাকারী। যারা নির্বুদ্ধিতার কারণে অন্যদেরকে আল্লাহর শরীক স্থাপন করে, আল্লাহ তা হতে পবিত্র ও মহান।
তিঁনিই আল্লাহ সৃজনকর্তা, তিঁনিই উদ্ভাবনকর্তা। অর্থাৎ তিঁনিই ভাগ্য নির্ধারণকারী এবং তিঁনিই ওটাকে জারী ও প্রকাশকারী।
তিঁনি যা চান তাই নির্ধারণ করেন। কেউই এমন নেই যে, ভাগ্য নির্ধারণ ও ওটাকে চালু এ দু'টোই করতে পারে।
তিঁনি নিজের ইচ্ছামত ভাগ্য নির্ধারণ করেন, অতঃপর ওটা অনুযায়ী ওকে চালিয়েও থাকেন।
কখনো তিঁনি এতে পার্থক্য সৃষ্টি হতে দেন না।
বহু পরিমাণ ও পরিমাপকারী এবং বিন্যাসকারী রয়েছে যারা পরিমাণ ও পরিমাপ করার পর,
ওটাকে জারী করতে এবং ওটা অনুযায়ী চালু করতে সক্ষম নয়।
পরিমাণ ও পরিমাপ করার সাথে সাথে তফীযের উপরও যিঁনি ক্ষমতা রাখেন তিঁনিই আল্লাহ্।
সুতরাং (আরবী) দ্বারা (আরবী) এবং (আরবী) দ্বারা (আরবী) উদ্দেশ্য। আরবে এই শব্দগুলো এই অর্থে বরাবরই দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করার প্রচলন রয়েছে।
~~~
আল্লাহ্ তা'আলার শান বা মাহাত্ম্য এই যে, যে জিনিসকে তিঁনি যখন যেভাবে করার ইচ্ছা করেন,
তখন শুধু 'হও' বলে দেন, আর তখনই তা ঐ ভাবেই এবং ঐ আকারেই হয়ে যায়।
~~~
যেমন তিঁনি বলেনঃ
“যেই আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।”
(৮২ সুরা-ইনফিতার: ৮)
এজন্যেই এখানে বলেনঃ
"তিঁনি রূপদাতা। অর্থাৎ যাকে তিনি যেভাবে গঠন করার ইচ্ছা করেন সেভাবেই করে থাকেন।"
~~~
সকল উত্তম নাম তাঁরই।
সূরায়ে আ'রাফে এই বাক্যটির তাফসীর গত হয়েছে।
তাছাড়া ঐ হাদীসটিও বর্ণিত হয়েছে যেটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে।
তা এই যে,
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ
“আল্লাহ্ তা'আলার নিরানব্বইটি অর্থাৎ এক কম একশ’টি নাম রয়েছে।
যে ব্যক্তি ওগুলো গণনা করবে ও স্মরণ রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তিঁনি (আল্লাহ) বে-জোড় অর্থাৎ তিনি একক এবং বে-জোড়কে অর্থাৎ একাকীকে ভালবাসেন।”
(সুনানে ইবনে মাজাহতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এবং তাতে কিছু আগা-পিছা এবং কম-বেশীও রয়েছে)
~~~
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
"আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।"
~~~
যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)অর্থাৎ
“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং,
এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না।
কিন্তু ওদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। তিঁনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।”
(১৭ বণী-ইসরাইল: ৪৪)
~~~
তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ তিনি তাঁর শরীয়তের আহকামের ব্যাপারে অতীব জ্ঞানী ও বিজ্ঞানময়।
~~~
হযরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে,
নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি সকালে (আরবী) পড়ার পর সূরায়ে হাশরের শেষ তিনটি আয়াত পাঠ করে,
তার জন্যে আল্লাহ্ তা'আলা সত্তর হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপর রহমত বর্ষণ করতে থাকেন।
যদি ঐ দিনে তার মৃত্যু হয়ে যায় তবে তাকে শহীদের মর্যাদা দান করা হয়।
আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এগুলো পাঠ করে সেও অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে থাকে।”
(এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। জামি তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে)
_______[তফসীর ইবনে কাসির]_______
আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিম বর্ণনা করে" ✅
➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖➖
[সুরা-হাশর, শেষ চার আয়াতের ব্যাখ্যা]
--------------------------------------------------------
'বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম,
-------------------------------------------
মহিমান্বিত আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
-
"আর আমি যদি এ কুরআন,
পাহাড়ের উপর নাযিল করতাম, তাহলে তুমি তাকে দেখতে আল্লাহর ভয়ে বিনীত ও বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
মানুষের জন্য আমি এসব দৃষ্টান্ত এজন্য বর্ণনা করি, যাতে তারা চিন্তা করে। [২১]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ, তিঁনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা, তিঁনি অসীম দয়াময়, পরম দয়ালু। [২২]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ; যিঁনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিঁনিই বাদশাহ, মহাপবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত, তারা যা শরীক করে তা হতে আল্লাহ পবিত্র মহান। [২৩]
~~~
তিঁনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকারী, রুপদাতা, তাঁর জন্যই আছে সুন্দর সুন্দর নাম।
আসমানে ও জমীনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর পবিত্রতা-মহিমা বর্ণনা করে। তিঁনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" [২৪]
_____[সুরা-হাশর, আয়াত-২১-২৪]_____
~~~
২১-২৪ নং আয়াতের সংক্ষেপকৃত তাফসীর:
~~~
আল্লাহ্ তা'আলা কুরআন কারীমের বুযুর্গী ও মাহাত্মের বর্ণনা দিচ্ছেন যে,
এই পবিত্র কুরআন প্রকৃতপক্ষে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব।
এর সামনে অন্তর ঝুঁকে পড়ে, লোম খাড়া হয়ে যায়, কলিজা কেঁপে ওঠে।
এর সত্য ওয়াদা ও ভীতি প্রদর্শন প্রত্যেককে কাঁপিয়ে তোলে এবং আল্লাহর দরবারে সিজদায় পতিত করে।
~~~
মহান আল্লাহ বলেন যদি আমি এই কুরআন পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম তবে অবশ্যই দেখা যেতো যে,
ওটা আল্লাহর ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ হয়ে গেছে।
অর্থাৎ যদি মহামহিমান্বিত আল্লাহ এই কুরআনকে কোন কঠিন ও উঁচু পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতেন,
এবং ওকে চিন্তা ও অনুভূতি শক্তি দান করতেন তবে ওটাও তাঁর ভয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতো।
তাহলে মানুষের অন্তরে তো এটা আরো অধিক ক্রিয়াশীল হওয়া উচিত।
কেননা, পর্বতের তুলনায় মানুষের অন্তর বহুগুণে নরম ও ক্ষুদ্র এবং তাতে পূর্ণমাত্রায় বোধ ও অনুভূতি শক্তি রয়েছে।
মানুষ যেন চিন্তা-গবেষণা করে এ জন্যেই আল্লাহ তাআলা মানুষের সামনে এসব দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন।
উদ্দেশ্য এই যে, মানুষের উচিত আল্লাহকে ভয় করা ও বিনীত হওয়া।
~~~
মুতাওয়াতির হাদীসে রয়েছে যে,
মিম্বর নির্মিত হওয়ার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) একটি খেজুর গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে খুতবাহ দিতেন।
অতঃপর যখন মিম্বর তৈরী হয়ে গেল ও বিছিয়ে দেয়া হলো তখন তিনি তার উপর দাঁড়িয়েই খুতবাহ দিতে লাগলেন
এবং ঐ খুঁড়িটিকে সরিয়ে দেয়া হলো।
ঐ সময় ঐ গুঁড়ি হতে কান্নার শব্দ আসতে লাগলো।
শিশুর মত ওটা ফুপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো।
কারণ এই যে, ওকে আল্লাহর যিকির ও অহী কিছুটা দূর থেকে শুনতে হচ্ছে।
-
হযরত ইমাম বসরী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করে বলতেনঃ
“হে লোক সকল!
খেজুর গাছের একটি গুড়ি যদি আল্লাহর রাসূল (সঃ) -এর প্রতি এতো আসক্ত হতে পারে,
তবে তো তোমাদের তার প্রতি ওর চেয়ে বহুগুণ বেশী আসক্তি থাকা উচিত। অনুরূপভাবে এই আয়াতটি যে,
যদি একটি পাহাড়ের এই অবস্থা হয় তবে এই অবস্থায় তোমাদের এর চেয়ে অগ্রগামী হওয়া উচিত।
কারণ তোমরা তো শুনছো ও বুঝছো?”
~~~
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ
“যদি কোন কুরআন এরূপ হতো যে, ওর কারণে পর্বতরাজিকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে অথবা যমীনকে কেটে দেয়া হবে কিংবা মৃতকে কথা বলানো হবে (তবে এর যোগ্য একমাত্র এই কুরআনই ছিল, আর তখনো কিন্তু এই কাফিররা ঈমান আনয়নের সৌভাগ্য লাভ করতো না)।”
(১৩ সুরা-রাদ: ৩১)
~~~
অন্য এক জায়গায় আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেছেনঃ (আরবী)অর্থাৎ “পাথরও কতক এমন যে, ওটা হতে নদী-নালা প্রবাহিত হয় এবং কতক এই রূপ যে,
বিদীর্ণ হওয়ার পর ওটা হতে পানি নির্গত হয়, আবার কতক এমন যা আল্লাহর ভয়ে ধ্বসে পড়ে।”
(২ সুরা বাকারা: ৭৪)
~~~
এরপর ইরশাদ হচ্ছেঃ
"আল্লাহ্ ছাড়া না কোন পালনকর্তা রয়েছে, না তার সত্তা ছাড়া এমন কোন সত্তা রয়েছে যে, কেউ তার কোন প্রকারের ইবাদত করতে পারে।
আল্লাহ্ ছাড়া মানুষ যাদের ইবাদত করে সেগুলো সবই বাতিল। তিনি সারা বিশ্বের দৃশ্যের ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা।
প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব কিছুই তাঁর কাছে পূর্ণভাবে প্রকাশমান।
তিঁনি এমন বড় ও প্রশস্ত রহমতের অধিকারী যে,
তাঁর রহমত সমস্ত মাখলুকের উপর পূর্ণভাবে বিদ্যমান রয়েছে। তিনি দুনিয়া ও আখিরাতে রহমানও বটে এবং রাহীমও বটে।"
~~~
আমাদের তাফসীরের শুরুতে এ দু’টি নামের পুরো তাফসীর গত হয়েছে। কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
“আমার রহমত সমস্ত জিনিসকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে।”
(৭ সুরা আরাফ : ১৫৬)
~~~
অন্য জায়গায় আছেঃ
“তোমাদের প্রতিপালক তাঁর নিজের উপর রহমত লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।”
(৬ সুরা-আনআম: ৫৪)
~~~
আল্লাহ্ তা'আলা আরো বলেনঃ
“আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার প্রতিই তাদের সন্তুষ্ট হওয়া উচিত, তাদের জমাকৃত জিনিস হতে এটাই উত্তম।”
(১০ সুরা-ইউনুস: ৫৮)
~~~
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
তিঁনিই আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। সমস্ত জিনিসের একক মালিক তিঁনিই।
তিঁনিই সবকিছুকে হেরফেরকারী। সব কিছুরই অধিকর্তা ও অধিপতি তিনিই। তিনিই সব কিছুরই ব্যবস্থাপক।
কেউই এমন নেই যে তাঁর কাজে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে বা তাঁকে তাঁর কার্যসম্পাদন করা হতে বিরত রাখতে পারে।
তিঁনিই পবিত্র। অর্থাৎ তিনিই প্রকাশমান ও কল্যাণময়। সত্তাগত ও গুণগত ত্রুটি-বিচ্যুতি হতে তিনি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র।
সমস্ত উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ফেরেশতা এবং অন্যান্য সবই তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণায় সর্বদা রত।
তিঁনিই অতীব মহিমান্বিত। তার কোন কাজ হিকমতশূন্য নয়।
তাঁর সমুদয় কাজকর্মেও তিনি সর্বপ্রকারের দোষ-ত্রুটি হতে পবিত্র।
তিঁনিই নিরাপত্তা বিধায়ক। অর্থাৎ তিনি সমস্ত মাখলুককে এ ব্যাপারে নিরাপত্তা দান করেছেন যে,
তাদের উপর তার পক্ষ হতে কখনো কোন প্রকারের অত্যাচার হবে না।
তিঁনি যে সত্য কথা বলেছেন,
এ কথা বলে তিঁনি সকলকে নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন। তিঁনি তাঁর মুমিন বান্দাদের ঈমানের সত্যতা স্বীকার করেছেন।
~~~
তিঁনিই রক্ষক অর্থাৎ তিনি তাঁর সমস্ত মাখলকের সমস্ত আমল সদা প্রত্যক্ষ ও রক্ষাকারী।
যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ
“আল্লাহ্ সর্ববিষয়ে রক্ষক।”
(৮৫ সুরা-বুরুজ: ৯)
~~~
আর এক জায়গায় বলেনঃ
“আল্লাহ তাদের সমস্ত আমলের উপর সাক্ষী।”
(১০ সুরা-ইউনুস: ৪৬)
~~~
তিঁনিই পরাক্রমশালী। প্রত্যেক জিনিস তাঁর আদেশ পালনে বাধ্য। প্রত্যেক মাখলুকের উপর তিনি বিজয়ী।
সুতরাং তার মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব, শক্তিমত্তা এবং বড়ত্ব দেখে কেউই তাঁর মুকাবিলা করতে পারে না।
তিঁনিই প্রবল এবং তিঁনিই মহিমান্বিত। শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব প্রকাশ করা শুধু তাঁরই জন্যে শোভনীয়।
অহংকার করা শুধু তারই সাজে।
যেমন সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে,
আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ
“বড়াই করা আমার ইযার এবং অহংকার করা আমার চাদর।
সুতরাং যে ব্যক্তি এ দু'টোর যে কোন একটি নিয়ে আমার সাথে টানাটানি করবে, আমি তাকে শাস্তি প্রদান করবো।”
~~~
সমস্ত কাজের সংস্কার ও সংশোধন তাঁরই হাতে।
তিঁনি প্রত্যেক কুকর্মকে ঘৃণাকারী। যারা নির্বুদ্ধিতার কারণে অন্যদেরকে আল্লাহর শরীক স্থাপন করে, আল্লাহ তা হতে পবিত্র ও মহান।
তিঁনিই আল্লাহ সৃজনকর্তা, তিঁনিই উদ্ভাবনকর্তা। অর্থাৎ তিঁনিই ভাগ্য নির্ধারণকারী এবং তিঁনিই ওটাকে জারী ও প্রকাশকারী।
তিঁনি যা চান তাই নির্ধারণ করেন। কেউই এমন নেই যে, ভাগ্য নির্ধারণ ও ওটাকে চালু এ দু'টোই করতে পারে।
তিঁনি নিজের ইচ্ছামত ভাগ্য নির্ধারণ করেন, অতঃপর ওটা অনুযায়ী ওকে চালিয়েও থাকেন।
কখনো তিঁনি এতে পার্থক্য সৃষ্টি হতে দেন না।
বহু পরিমাণ ও পরিমাপকারী এবং বিন্যাসকারী রয়েছে যারা পরিমাণ ও পরিমাপ করার পর,
ওটাকে জারী করতে এবং ওটা অনুযায়ী চালু করতে সক্ষম নয়।
পরিমাণ ও পরিমাপ করার সাথে সাথে তফীযের উপরও যিঁনি ক্ষমতা রাখেন তিঁনিই আল্লাহ্।
সুতরাং (আরবী) দ্বারা (আরবী) এবং (আরবী) দ্বারা (আরবী) উদ্দেশ্য। আরবে এই শব্দগুলো এই অর্থে বরাবরই দৃষ্টান্ত স্বরূপ পেশ করার প্রচলন রয়েছে।
~~~
আল্লাহ্ তা'আলার শান বা মাহাত্ম্য এই যে, যে জিনিসকে তিঁনি যখন যেভাবে করার ইচ্ছা করেন,
তখন শুধু 'হও' বলে দেন, আর তখনই তা ঐ ভাবেই এবং ঐ আকারেই হয়ে যায়।
~~~
যেমন তিঁনি বলেনঃ
“যেই আকৃতিতে চেয়েছেন, তিনি তোমাকে গঠন করেছেন।”
(৮২ সুরা-ইনফিতার: ৮)
এজন্যেই এখানে বলেনঃ
"তিঁনি রূপদাতা। অর্থাৎ যাকে তিনি যেভাবে গঠন করার ইচ্ছা করেন সেভাবেই করে থাকেন।"
~~~
সকল উত্তম নাম তাঁরই।
সূরায়ে আ'রাফে এই বাক্যটির তাফসীর গত হয়েছে।
তাছাড়া ঐ হাদীসটিও বর্ণিত হয়েছে যেটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণনা করা হয়েছে।
তা এই যে,
রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ
“আল্লাহ্ তা'আলার নিরানব্বইটি অর্থাৎ এক কম একশ’টি নাম রয়েছে।
যে ব্যক্তি ওগুলো গণনা করবে ও স্মরণ রাখবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
তিঁনি (আল্লাহ) বে-জোড় অর্থাৎ তিনি একক এবং বে-জোড়কে অর্থাৎ একাকীকে ভালবাসেন।”
(সুনানে ইবনে মাজাহতেও এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এবং তাতে কিছু আগা-পিছা এবং কম-বেশীও রয়েছে)
~~~
মহান আল্লাহ্ বলেনঃ
"আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সমস্তই তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে।"
~~~
যেমন তিনি অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী)অর্থাৎ
“সপ্ত আকাশ, পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সব কিছু তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং,
এমন কিছু নেই যা তাঁর সপ্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে না।
কিন্তু ওদের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা তোমরা অনুধাবন করতে পার না। তিঁনি সহনশীল, ক্ষমাপরায়ণ।”
(১৭ বণী-ইসরাইল: ৪৪)
~~~
তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। অর্থাৎ তিনি তাঁর শরীয়তের আহকামের ব্যাপারে অতীব জ্ঞানী ও বিজ্ঞানময়।
~~~
হযরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে,
নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি সকালে (আরবী) পড়ার পর সূরায়ে হাশরের শেষ তিনটি আয়াত পাঠ করে,
তার জন্যে আল্লাহ্ তা'আলা সত্তর হাজার ফেরেশতা নিযুক্ত করে দেন যারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার উপর রহমত বর্ষণ করতে থাকেন।
যদি ঐ দিনে তার মৃত্যু হয়ে যায় তবে তাকে শহীদের মর্যাদা দান করা হয়।
আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এগুলো পাঠ করে সেও অনুরূপ মর্যাদা লাভ করে থাকে।”
(এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। জামি তিরমিযীতেও এ হাদীসটি রয়েছে)
_______[তফসীর ইবনে কাসির]_______