গাযওয়ায়ে হিন্দ বিষয়ক হাদীসসমূহ:
সনদ বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ
সনদ বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা
মুফতি আবু আসেম নাবিল হাফিযাহুল্লাহ

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على خاتم النبيين، وعلى آله وصحبه أجمعين، و من تبعهم بإحسان إلى يوم الدين
ভূমিকা
গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কিত হাদীসগুলো সহীহ কি-না, এ-বিষয়ে গত কয়েক বছর থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের পক্ষ থেকে, পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন প্রশ্ন ও মতামত আসছিল। তাই উসূলে হাদীস ও জারহ-তা‘দীলের মূলনীতির আলোকে এ-সম্পর্কিত হাদীসগুলোর মান যাচাই করা এবং সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগক্ষেত্র জানার জন্য কাজ করছিলাম। যাতে গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কিত প্রতিটি হাদীসের বিস্তারিত সনদ-পর্যালোচনা ও প্রকৃত চিত্র সামনে এসে যায়। এই পুস্তিকাটি সে প্রচেষ্টারই প্রাথমিক ফল। সনদ বিশ্লেষণ ও জারহ-তা‘দীল বিষয়ক পর্যালোচনা বোঝা সাধারণ মুসলমান ভাই বোনদের জন্য বেশ কঠিন। তবুও সাধারণের বোধগম্য করে আলোচনাটি পেশ করার চেষ্টা করেছি।
পুস্তিকাটি যেহেতু বেশ লম্বা। তাই মূল বিষয়ে প্রবেশের পূর্বে সমগ্র আলোচনার সংক্ষিপ্ত বিন্যাস ও বিষয়বস্তুর সারসংক্ষেপ প্রথমে তুলে ধরা হল, যাতে পাঠকের জন্য পুরো বিষয়টির অধ্যয়ন সহজবোধ্য হয়।
সংক্ষিপ্ত বিন্যাস: প্রতিটি হাদীস উল্লেখ করার পর মূল মতনের সাথে হাদীসটির হুকুম ও ক্ষেত্র-বিশেষ সনদ কেন্দ্রিক সংক্ষিপ্ত-আলোচনা আরবীতে পেশ করা হয়েছে, যেন ওলামায়ে কেরাম হাদীসটির সামগ্রিক বিষয় প্রথমেই জেনে নিতে পারেন। এরপর সর্বসাধারণের জন্য হাদীসটির সরল তরজমা, সংক্ষিপ্ত হুকুম এবং শেষে বিস্তারিত সনদ-বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কিত হাদীসগুলোর সনদ-তাত্ত্বিক পুরো পর্যালোচনাটিকে তিনটি অংশ ও একটি পরিশিষ্টে ভাগ করা হয়েছে।
প্রথম অংশে গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ এবং সেগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন আপত্তি ও তার জবাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথম অংশের শাখা শিরোনামগুলো যথাক্রমে:
১. প্রথম হাদীস ও সনদ বিশ্লেষণ।
২. একটি আপত্তি ও তার জবাব।
৩. মুহাদ্দিসগণের নিকট ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি মূলনীতির ব্যাখ্যা।
৪. দ্বিতীয় হাদীস ও সনদ বিশ্লেষণ।
৫. একটি আপত্তি ও পর্যালোচনা।
৬. তৃতীয় হাদীস ও সনদ বিশ্লেষণ।
৭. চতুর্থ হাদীসটির সনদ বিশ্লেষণ সম্পর্কে প্রারম্ভিক কথা।
৮. রাবি বাকিয়্যাহ ইবনে ওয়ালীদ সম্পর্কে কিছু তথ্য।
৯. চতুর্থ হাদীস কেন্দ্রিক একটি পর্যালোচনা।
দ্বিতীয় অংশে গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে হযরত সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীসটির সনদদ্বয় এবং সেগুলোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন আপত্তি ও তার জবাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দ্বিতীয় অংশের শাখা শিরোনামগুলো যথাক্রমে:
১. পঞ্চম হাদীস ও সনদ বিশ্লেষণ। (ক) সনদটির প্রথম শাখা বা طَرِيْق
২. একটি আপত্তি ও তার জবাব (টীকা)
৩. (খ) সনদটির দ্বিতীয় শাখা বা طَرِيْق
৪. একটি ভুল সংশোধনী (টীকা)।
৫. হাদীসটির সনদ বিশ্লেষণের সার সংক্ষেপ।
তৃতীয় অংশে দু‘জন তাবিঈ থেকে গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কিত কিছু বর্ণনা এবং তৎসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। তৃতীয় অংশের শাখা শিরোনামগুলো যথাক্রমে:
১. গাযওয়ায়ে হিন্দ কি সংঘটিত হয়ে গেছে, না-কি শেষ জামানায় হবে?
২. বিশিষ্ট তাবিঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা।
৩. কুসতুনতুনিয়া বা কনস্টান্টিনোপল বিজয়: একটি জিজ্ঞাসার জবাব (টীকা)।
৪. তাবিঈ কা’আব আহবার রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা।
৫. ইসলামের প্রাচীন কোনো কোনো ইতিহাস-গ্রন্থে হিন্দুস্তানের যে সকল অভিযানকে ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে, তার আলোকে ‘একটি পর্যালোচনা।’
পরিশিষ্টে নুআইম ইবনে হাম্মাদ ও তাঁর রচিত ‘কিতাবুল ফিতান’ গ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু কথা বলা হয়েছে এবং পাদটীকায় একটি ভুল ধারণার অপনোদন করা হয়।
শেষে একটি উপসংহার যুক্ত করা হয়েছে। অত্র পুস্তিকার হাদীসগুলো একজন মুমিনকে যে সকল বার্তা দেয়, সংক্ষেপে সে বার্তাগুলো ধারাবাহিকভাবে উপসংহারে তুলে ধরা হয়েছে।
সর্বশেষে, এই পুস্তিকা রচনায় যে সকল কিতাব থেকে সহযোগিতা নেওয়া হয়েছে, তার সন ভিত্তিক একটা গ্রন্থপঞ্জি প্রবন্ধের শেষে দেওয়া হয়েছে। যাতে পাঠক প্রয়োজনে মূল কিতাব থেকেও দেখে নিতে পারেন।
বিষয়বস্তুর সার সংক্ষেপ: গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমরা দু’জন সাহাবীর বর্ণনা পেয়েছি। তাঁরা হলেন যথাক্রমে ১. আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) ২. সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু)। এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দু‘জন তাবিঈ থেকেও কিছু বর্ণনা পাওয়া যায়। যেগুলো উক্ত দুই সাহাবীর বর্ণনার ব্যাখ্যাস্বরূপ এবং তাঁদের বর্ণিত বিষয়বস্তুকে একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামো দান করে। সে দু‘জন তাবিঈ হলেন, যথাক্রমে ১. আরতাত ইবনুল মুনযির রহিমাহুল্লাহ ২. কা’ব আল আহবার রহিমাহুল্লাহ।
গাযওয়ায়ে হিন্দ সম্পর্কে আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত হাদীস মূলত একটি। উক্ত হাদীসটি তাঁর থেকে পৃথক তিনটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমটির সনদ সহীহ, অপর দু’টির সনদ দুর্বল। তবে প্রথম হাদীসের কারণে অর্থগত দিক থেকে পরের দুটিও সহীহ। উপরোক্ত তিনটি সূত্রে বর্ণিত হাদীসগুলোর শব্দ প্রায় একই রকম। তাছাড়া আবু হুরায়রাহ (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে অন্য আরেকটি সূত্রে উক্ত বিষয়ে-ই আরো একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যাতে আগের হাদীসগুলোর পুরো বিষয়সহ অতিরিক্ত কিছু তথ্য রয়েছে, যা পূর্বের হাদীসগুলোতে নেই। সে বিষয়গুলো গাযওয়ায়ে হিন্দেরই একটি অংশ; তাতে যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা এবং সেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার ফযিলত বর্ণিত হয়েছে। যা উল্লেখ করা হয়েছে চতুর্থ হাদীস হিসেবে ।
পঞ্চম হাদীসটি সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত। হাদীসটিতে সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণনাকারীদের চতুর্থ স্তর পর্যন্ত সনদের ধারা একটিই। এরপর চতুর্থ স্তর তথা মুহাম্মদ বিন ওয়ালিদ আয-যুবাইদী থেকে তাঁর তিনজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। যথাক্রমে- ১. আব্দুল্লাহ বিন সালেম, ২. আবু বকর বিন ওয়ালিদ, ৩. জাররাহ বিন মালিহ।
আব্দুল্লাহ বিন সালেম ও আবু বকর বিন ওয়ালিদ থেকে বর্ণনা করেছেন বাকিয়্যা বিন ওয়ালিদ এবং জাররাহ বিন মালিহ থেকে বর্ণনা করেছেন, হিশাম বিন আম্মার ও সুলাইমান বিন আব্দুর রহমান। এভাবে একটি সনদ উপর থেকে চতুর্থ স্তরে এসে দুইটি শাখায় রূপান্তরিত হয়েছে। সনদ বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার সুবিধার্থে সনদের দুইটি শাখা (طَرِيْق) পৃথকভাবে ‘ক’ ও ‘খ’ শিরোনামে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বোপরি, উভয় সনদ মিলে হাদীসটি সহীহ লি-গাইরিহী।
সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) থেকে বর্ণিত উল্লিখিত হাদীস; যেখানে বলা হয়েছে, ‘দুটি দলকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম থেকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। একটি দল, যারা হিন্দুস্তানের যুদ্ধে শরিক হবে। আর দ্বিতীয় দল, যারা ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম-এর সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করবে।’ কোনো কোনো গবেষকের ধারণা, ‘এই হাদীসে আলোচিত দুটি দলের মাঝে পারস্পারিক কোনো সম্পর্ক নেই।’ তাদের দৃষ্টিতে ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ উমাইয়া যুগে সংঘটিত হয়ে গেছে। আর দাজ্জালের সাথে ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর বাহিনীর যুদ্ধ শেষ জামানায় ঘটবে।’ এভাবে তারা একই হাদীসে উল্লিখিত দুটি যুদ্ধের সময়কালের মাঝে ব্যাপক পার্থক্য আছে বলে মনে করেন।
ইতিহাস ও তারিখের আলোকে তাদের এ দাবি কতোটুকু যথার্থ বা হাদীসে উল্লিখিত ‘গাযওয়ায়ে হিন্দ’ এখনো সংঘটিত হয়নি বরং শেষ জামানায় সংঘটিত হবে, এবিষয়ে পৃথক একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা পুস্তিকার শেষে (পরিশিষ্টের পূর্বে) যুক্ত করা হয়েছে। তবে বিশিষ্ট তাবিঈ আরতাত রহিমাহুল্লাহ এর বর্ণনা থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, সাওবান (রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু) এর বর্ণিত হাদীসে আলোচিত দুটি যুদ্ধের ঘটনা একই যুগে অর্থাৎ শেষ জামানায় সংঘটিত হবে।
গাযওয়ায়ে হিন্দের বেশ কিছু হাদীস সহীহ সনদ দ্বারা প্রমাণিত। সেগুলো হাদীসের বিভিন্ন ইমামগণ তাঁদের সুপ্রসিদ্ধ হাদীসগ্রন্থসমূহে বর্ণনা করেছেন, যা বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। তবে গাযওয়ায়ে হিন্দ সংশ্লিষ্ট কিছু হাদীস এককভাবে শুধু নুআইম ইবনে হাম্মাদ রচিত ‘কিতাবুল ফিতান’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যদিও সে হাদীসগুলোর কোনো কোনোটির সনদ সহীহ। এবং সেগুলো অন্য কোনো সহীহ হাদীসের বিপরীতও নয়। কিন্তু উক্ত কিতাব সম্পর্কে হাফেয যাহাবি রহিমাহুল্লাহ এর কোনো একটি মন্তব্যের ভিত্তিতে কেউ কেউ সে কিতাবে উল্লিখিত গাযওয়ায়ে হিন্দের সকল হাদীসের উপর আপত্তি উত্থাপনের চেষ্টা করেন। তাই পরিশিষ্টে হাদীস ও জারহ-তা‘দীলের ইমামগণের মতামতের আলোকে নুআইম ইবনে হাম্মাদ ও তাঁর রচিত ‘কিতাবুল ফিতান’ গ্রন্থ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
পরিশেষে আল্লাহ তায়ালার নিকট দুআ করি, তিনি যেন আমাদেরকে সঠিক বিষয় বোঝার এবং সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করেন। আমিন
Collected
(চলবে, ইনশা আল্লাহ)
Comment