মুসলিম উম্মাহর দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। প্রায় ১৫ শত বছর আমরা পার করেছি। এত বছরের পথ চলা সহজ ছিল না। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা এখানে এলাম। অসংখ্য ফিতনা, বিপদ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে উম্মতকে আক্রান্ত করেছে। ফিতনা, ফ্যাসাদ ও বিপদ বিপর্যয়ের ঢেউ একের পর এক এসে আমাদের পরীক্ষা নিয়েছে। এরকম একটি মহা বিপদ ছিল মঙ্গোলদের আক্রমণ। বিপদ বিভিন্ন রকমের ছিল, কখনো তা আক্রান্ত করত রাজনৈতিক ভাবে কখনো বা আদর্শিক ভাবে। আদর্শিক ভাবে মুতাজিলা, জাহমিয়া, কাদেরিয়া, খারেজিয়া, মুরজিয়া, রাফেজিয়া প্রভৃতি এবং রাজনৈতিক ভাবে বাতেনি ফাতেমিয় খিলাফত, কারামাতি, ক্রসেড ও মোঙ্গল ইত্যাদি ফিতনা আমাদের চরম ভাবে আক্রান্ত করেছিল। যদি প্রশ্ন করা হয়, এই ১৫ শত বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় কোন সময়ে হয়েছিল? কোন বিপদ উম্মাহর জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল?
স্বাভাবিক ভাবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলবেন তাতারী ফিতনাটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ক্রুসেড ফিতনাকেও ভয়াবহ বলতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি বর্তমান ঐতিহাসিকদের ভাবা উচিত, এই প্রশ্নের উত্তর দূর ইতিহাসে না খুঁজে হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দীর) ইতিহাসে খুজতে হবে। অবশ্যই বিংশ শতাব্দী এবং এর পরবর্তী সময় গুলোই হল মুসলিম উম্মাহর ১৫ শত বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়। ইবনে কাসির, ইবনে আসির, ইবনে খালদুন, ইবনু তাবারী (রহিমাহুমুল্লাহ) ঐতিহাসিকগণ হিজরির চতুর্দশ শতাব্দীর ইতিহাস দেখেন নি, দেখলে তারা অবশ্যই এই সময়কে সবচেয়ে ভয়াবহ, ভয়ঙ্কর মহাবিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করতেন।ঐতিহাসিকগণ প্রায় একমত হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ছিল কঠিন ভয়াবহ সময় এবং এর পরের শতাব্দীতে তাতারিদের আগমন হয়েছিল। এই কয়েকশ বছর যত ফিতনা ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন মুসলিম উম্মাহ হয়েছিল তা আর কোনো সময়ে হয় নি। এই সময়ে কারামতিদের উত্থান হয় তারা মক্কায় আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ পাথর লুন্ঠন করে নিয়ে যায়, কাবার গিলাফ কেটে কেটে টূকরো করে,
অসংখ্য হাজীদের হত্যা করে, এই সময়ে উম্মাহর খিলাফত কার্যত বাগদাদের শাহী মহলে সীমাবদ্ধ হয়ে পরে, মিসরে ওবায়দীয় বাতেনিদের হত্যা ও লুন্ঠনের শাসন চলে, বুয়াইহীরা বাগদাদ দখল করে খালিফাকেও হত্যা করে, মুসলিম শাসকগণ কাফিরদের মদদ নিয়ে অন্য মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নানান ফিতনা ও বিদ'আত সমাজে সয়লাব করে, এই সময়ে ক্রসেডারদের আক্রমণ শুরু হয় এবং শাম ও মিসরের বিভিন্ন শহর তারা দখল করে, বিশেষ করে বায়তুল মাকদিস তারা দখল করে এবং হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন শহরের মসজিদ ধ্বংস করা হয়, আযানে নতুন এক লাইন যুক্ত করা হয়। ইলম ও উলামারাও এই সময়ে ফিতনা থেকে মুক্ত ছিলেন না। উলামাদের মধ্যে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বাহাস লেগেই থাকত। ৭ম শতাব্দীতে তাতারিরা বাগদাদে আক্রমণ করে প্রায় ২০ লক্ষ্য মুসলিমকে হত্যা করা, পুরো খোরাসান, খাওরাজাম সাম্রাজ্য, ইরাক, ইরান, বাগদাদ, দামেস্ক, আলাপ্পো সহ বিভিন্ন বড় বড় শহর ও অঞ্ছল দখল করে কোটি মুসলিমকে হত্যা করে। এই সময় মুসলিম উম্মাহকে এরকম নানান বিপর্যয় ও ফিতনা এক এক করে ঘায়েল করছিল। অবশ্যই এই বিপদ গুলো রাজনৈতিক এবং আদর্শিক উভয় ভাবে আক্রান্ত করেছিল কিন্তু এক সাথে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভাবে উম্মাহকে পরাজিত করতে পারেনি।যখন আমরা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতাম তখন আদর্শিক শক্তি ও প্রজ্ঞা আমাদেরকে উদ্ধার করত। যখন আমরা আদর্শিক ফিতনার সম্মুখীন হতাম রাজনৈতিক শক্তি আমাদের পথ চলা সহজ করত। কখনো এগিয়ে আসতেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আমিরগণ আবার কখনো এগিয়ে আসতেন যুগের ইমামগণ। একে অপরকে পরিশুদ্ধ সংশোধন করে বাঁকা পথ থেকে সোজা পথে নিয়ে আসতেন তারা।
এই সময়ে সেলজুক শাসন তৈরি হয়। এই সময়ে নুরুদ্দিন জঙ্গি, সালাহুদ্দিন আইয়ুবি জন্মেছিলেন। এই সময়ে সুলতান মাহমুদ গাজনাভি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক একটি রাজনৈতিক বিপর্যয়কে তারা এক এক জন মোকাবেলা করেছেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর অনুসারী বিশাল শ্রেণীর আলেমগন তখনো ছিলেন। তারা আদর্শিক ভাবে উম্মাহকে বাঁকা পথ থেকে সোজা পথে নিয়ে আসতেন। সকল ধরনের ফিতনা তারা দূর করতেন। তারা বিভিন্ন শাসকদের ইসলাহ করতেন। পূর্ণ ইসলামের বাস্তবায়ন ও বাতিলের ধ্বংস করার জন্য উজ্জীবিত করতেন।
এভাবে এক এক করে বিভিন্ন ফিতনা ধ্বংস হয়ে যায়। তারা সাধারণ মানুষের কাছে হক ও বাতিল স্পস্ট করে দিতেন। বাতিলকে স্পস্ট ভাবে গুমরাহ ও কুফুরি বলে ঘোষণা করতেন। মুসলিমদের মধ্যে দ্বীনের প্রাথমিক জ্ঞান ছিল। তারা আল্লাহর বিধান মানত, ফরজ পালন করত, হারাম থেকে বেঁচে থাকত। আল্লাহর দেয়া বিধানে বিচার মিমাংসা করত। বিচারের কাজ ন্যস্ত থাকত আলেমদের অধীনে। শাসকগণ শতধাবিভক্ত হলেও বিচারকের বিচারে বাঁধা দিতেন না, অধিকাংশ সময় সাধারণ মানুষের বিচার ব্যবস্থা ছিল স্বাধীন।
ক্রুসেড যখন শুরু হল উম্মাহ জানত তাদের কি করা উচিত, যখন বায়তুল মাকদিস দখল হয়ে গেল উম্মাহ জানত কি করা উচিত, তারা তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিত সংগ্রামী লড়াইতে কিন্তু শাসকগণ প্রতারনা করে জিহাদের জন্য আদায় করা অর্থ ভোগ করত। জিহাদের আওয়াজ তুলে টালবাহানা করে দমে যেত। সাধারণ মুসলিমগণ করণীয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, ওলামারাও যথা সাধ্যে চেষ্টা করতেন শাসকদের উজ্জীবিত করার। শুধু কিছু ব্যক্তি বিশেষ শাসক ও তাদের ক্ষুদ্র অনুসারিদের জন্য বিপদের মোকাবেলা কঠিন হয়ে পরত। শাসকদের অবহেলার কারনে সাধারণ মানুষ হয়ে পরত অলস। কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল আগুনে নিভু নিভু ছাই এর মতন, একটু বাতাসেই জ্বলে উঠত। এভাবে তারা ক্রুসেডারদের হত্যা করল, মোঙ্গলদের পরাজিত করল। সকল বাতেনি ফিতনাকে মাটিতে দাফন করে দিল।রাজনৈতিক পরাজয়
আজ মুসলিমরা রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ পরাভূত। পুরো বিশ্বে মুসলিমের রক্ত ঝড়ছে, হাত দিয়ে প্রতিরোধ করার শক্তিতো দূরের কথা মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করার শক্তিও নেই আমাদের। মিয়ানমার, কাশ্মির, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন সহ যেখানেই মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় তার বিরুদ্ধে কিছু মিছিল মিটিং ছাড়া শক্ত প্রতিবাদের করার মত আমাদের রাজনৈতিক কোনো শক্তি আজ বিদ্যমান নেই। এর মধ্যে কখনো কোনো তাগুতের গোলাম, ফাসিক, যালিম শাসক পরোক্ষ ভাবে প্রতিবাদ জানালে মুসলিমরা উক্ত শাসককে সাথে সাথে খলিফা, সুলতান, আমির মনে করে মাথায় বসিয়ে নেয়।এই হল বর্তমান অবস্থা। একটি উদাহরণ দেই- ‘এক মুসলিমের কাফির বন্ধু অসংখ্য মুসলিমকে হত্যা করল, কিন্তু ঐ মুসলিম চেয়ে চেয়ে দেখল। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন মুসলিমকে ছেঁড়ে দেয়ার জন্য সে তার কাফির বন্ধুকে সম্মত করালো। এখন মুসলিমরা ঐ কাফিরের বন্ধুকে যুগের সালাহুদ্দিন আইয়ুবি উপাধিতে ভূষিত করল।’ অন্ধরা জানত না সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রহিমাহুল্লাহ’র সময়েও অনেক মুসলিম শাসক কাফিরদের মদদ করত, কাফিরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহন করেছিল। কাফিরদের সাথে জোট করে মুসলিম সালাহুদ্দিন আইয়ুবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কাফির ক্রুসেডাররা মুসলিমদের হত্যা করলে তারা কিছু বলত না, হ্যাঁ মাঝে মধ্যে দুয়েকজন মুসলিমকে ছেঁড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করত (এরা হল আমাদের যুগের তথাকথিত সালাহুদ্দিন)। অন্যদিকে মহান সুলতান সালাহুদ্দিন ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই করার আগে এই সব মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং এদের পরাস্ত করে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন।
পূর্ব থেকে পশ্চিমে কোনো ভূখণ্ডে আল্লাহর হাকিমিয়াত প্রতিষ্ঠা নেই
হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুসলিম ভূখণ্ড অনেক ছোট ছোট অঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, ঐক্য নস্ট হয়ে গেলেও, খলিফার সাময়িক পতন হয়ে গেলেও, প্রায় সকল ভূখণ্ড ছিল কোনো না কোনো মুসলিম সুলতান, আমির, নবাবের নিয়ন্ত্রণে আর সেখানে ইসলামি বিধান কার্যকর ছিল। শাসকগণ ব্যক্তিবিশেষের জন্য আইনে হস্তক্ষেপ করলেও সাধারন ভাবে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হাকিমিয়াত কায়েম ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন খলিফা ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেল, তখন শুধু খলিফা ব্যবস্থা ভাঙ্গে নি সাথে সাথে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হাকিমিয়াত উঠে গেল। আজ মাগরিগ থেকে মাশরিক। উত্তর থেকে দক্ষিণ। মিশর থেকে ফিলিপাইন বা ব্রাজিল থেকে জাপান, অস্ট্রেলিয়া থেকে আলস্কা কোথাও আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা নেই। আমরা কি এত টুকু বুঝি না। আমরা কি করে এই যামানাকে অতিতের ইতিহাসের সাথে মিলাচ্ছি। কি করে ভুলে গেলাম এমন পরাজয় আমাদের ইতিহাসে কখনোই হয় নি। পূর্বকার ইতিহাসবিদগণও এমন পরাজয় বা মহা বিপর্যয়ের কথা কখনো কল্পনা করেন নি।সামরিক পরাজয়
মুসলিমরা পূর্বেও অমুসলিমদের থেকে সামরিক ফিল্ডে পিছিয়ে ছিল। অস্ত্রে, সংখ্যায়, কলাকৌশলে, অভিজ্ঞতায়, অর্থ বিনিয়োগে, সময় উপযোগিতায় কিন্তু মুসলিমরা কখনো এই পিছিয়ে পড়াকে দুর্বলতা মনে করত না। তাদের ঈমান দিপ্ত সাহস ও চেতনা, জীবন বিলিয়ে দেয়ার মনোভাব অস্ত্রে ও সংখ্যায় স্বল্পতার চাহিদা পূরণ করে দিত। হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুসলিমরা অনেক ক্ষমতাধর ছিল। হুজুগে জাতি ছাড়া বুদ্ধিমান কোনো জাতি বা সাম্রাজ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে বা মুসলিম ভূখণ্ডে কোনো প্রকার সামরিক আগ্রাসনের চিন্তাও করত না। তাই তো ক্রুসেডাররা মিথ্যা কিছু ধর্মীয় আবেগ তৈরি করে আর তাতারি ডাকাতদের বুদ্ধিহীনতাকে পুঁজি করে তারা মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমন চালিয়ে ত্রাস কায়েম করেছিল।
সাংস্কৃতিক পরাজয়
রাষ্ট্র বা জাতিকে অস্ত্রের বলে বেশি দিন পরাজিত করে রাখা যায় না। সামরিক পরাজয় অস্থায়ী বিজয় এনে দেয় স্থায়ী বিজয় আনতে পারে না। স্থায়ীভাবে পরাজিত শক্তিকে দাবিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের। সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক, রাজনৈতিক সিস্টেমের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে একটি জাতিকে পরাজিত করে রাখা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে পুরো বিংশ শতাব্দী পশ্চিমা সেকুলার নাস্তিক সভ্যতা মুসলিম বিশ্বকে প্রথমে সামরিক ভাবে এবং পরে সাংস্কৃতিক ভাবে আগ্রাসন চালিয়ে গ্রাস করেছে। ধ্বংস করে দিয়েছে।যে ফিলিস্তিনের জন্য আমরা কান্না করি। যে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা পশ্চিমা সাংস্কৃতির অনুসরণকারী। তারা সাংস্কৃতিক ভাবে অনেক আগেই পশ্চিমাদের কাছে পরাজিত হয়েছে। এই পরাজিতরা কখনোই সামরিক বিজয় পাবে না। একই অবস্থা হল প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রের ও জাতির।
ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে চারটি সভ্যতার চরম ভাবে পরাজয় ঘটে-তথা রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য/পারসিয়ান সাম্রাজ্য, মিশর ও ভারতীয় সভ্যতার। ইসলামের বিস্তারে এ চারটি সভ্যতার, জাতিয়তাবাদের, সংস্কৃতির পরাজয় ঘটে। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সকল প্রথা, পদ্ধতি, অভ্যাস, কলা, সংস্কৃতির পতন ঘটে। যুগে যুগে ইসলামের উপর আঘাত আসে, কিন্তু তারা মুসলিমকে বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ভাবে পরাজিত করতে পারে নি, তাই কয়েকযুগ পরেই মুসলিমরা আবার জেগে উঠত। অবশেষে, যুদ্ধের পদ্ধতিতে পরিবর্তন হল। তারা বুঝলো, সাম্রাজ্যে বা শাসকের মহলে আঘাত নয় আঘাত দিতে হবে বিশ্বাস ও প্রথা পদ্ধতিতে। ব্রিটিশের উত্থান হল। ঐতিহাসিকগণ বলেন, তাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ভূমি দখল করল। প্রায় পুরো বিশ্বের শাসক তাদের নিকট মাথানত করেছিল। কিন্তু এই সব তাদের কোনো অর্জন নয়। অর্জন হল তারা পুরো বিশ্বকে তাদের কার্বনকোপি বানিয়ে দিল, তাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, যুক্তি, শিক্ষা মুসলিমসহ সকল দেশের সভ্যতাকে পরাজিত করল। মানব ইতিহাসের সব চেয়ে বড় পরাজয় ছিল এটা। একটি ভূখণ্ড, তার অর্থ তথা স্ট্যালিং পাউন্ড, তার শিক্ষা, তার আইন, তার বিশ্বাস, তার সংস্কৃতি, তার মিডিয়া, তার ব্যাংকিং সিস্টেম দিয়ে সকল মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করল, এবং নিয়ন্তা রাস্ট্রের আসনে আসিন হল।
মুসলিমদের সকল স্তরে, বৃদ্ধ থেকে শিশু, পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতী সবাই চাল-চলনে, কথাবার্তায়, পোশাক-আশাকে, শিক্ষা-দিক্ষায়, খাদ্যাভ্যাসে, অনুসরণ-অনুকরণে অন্ধ ভাবে পশ্চিমা সভ্যতা বা বিজাতির সংস্কৃতি পালন করছে। এমন আগ্রাসনে ভয়ানক ভাবে পরাজয় বরণ করা সত্ত্বেও আমার ইতিহাসের বিপর্যয় হিসেবে তাতার, ক্রুসেড খুজতেছি?অর্থনৈতিক বিপর্যয়
তখন ছিল স্বর্ণ ও রূপ্য মুদ্রা। প্রয়োজনে সোনা রূপা সহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হত। মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারত না। কিন্তু এই শতাব্দীতে ডলার নামক মিথ্যা কারেন্সি ব্যবস্থা চালু হয়, মুসলিমদের কাছে স্বর্ণের খনী (তেল) থাকা সত্ত্বেও তারা গরীব, তাদের মুদ্রার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমেরিকা যখন চাইবে তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারবে। যেসব মুসলিম দেশকে ধনী বলা হয়, সেসকল দেশেই সবচেয়ে নিম্ন কর্মচারী হল অন্য দেশের মুসলিমরা। এক মুসলিমের কাঁধে পা দিয়ে অন্য মুসলিম উচ্চস্থান দখল করেছে। আবার অন্যদিকে আফ্রিকায় মুসলিমরাই না খেয়ে মরছে। সামরিক ভাবে যেমন আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জাপানের চামচামি করছি অর্থনৈতিক ভাবেও পশ্চিমা কুফফারদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। মুসলিম ইতিহাসে কোনো কালেই এমন হয় নাই, মুসলিম ঐতিহাসিকগণকে যদি বলা হত অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র কুফফারদের ছুঁড়ে ফেলা অন্ন ও অর্থের জন্য দিন রাত তাদের নিকট তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছে, তাহলে তারা বিশ্বাস করতেন না।
ইসলামিক ইলম ও আমলের বেহাল অবস্থা
বর্তমানে ইসলাম ও মুসলমান শুধু নাম হিসেবেই পরিগনিত হয়। ইসলামকে ব্যক্তিজীবনে আটকে রাখা হয়েছে। সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, ইসলাম যে শুধু ব্যক্তি জীবনে নয় বরং সামগ্রিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য এসেছে তা আমরা ভুলে গেছি। আজকের অধিকাংশ মুসলিমরা দ্বীনের সাধারণ ও প্রাথমিক জ্ঞান রাখে না। তারা নামাজ, রোজার মত ফরজ বিধানের নিয়ম পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ। কুর’আনের অর্থ জানা ও হাদিস বোঝার জন্য আমাদের কাছে সময় নেই। সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কি আমরা তা জানি না। উম্মাত তাওহীদ ও শিরক বিষয়ে বেখবর। ঈমান ও কুফুরের পার্থক্য নির্ণয় করতে অপারগ। তাওহিদের স্বীকৃতি দিচ্ছি কিন্তু তাওহীদের সংজ্ঞা আমাদের জানা নেই।
সুদ, ঘুষ, যিনাহ ব্যাভিচার, অশ্লীলতা, নাচ গান-মিউজিক, গেমস, কুফর, শিরক সহ বিভিন্ন বদআমলীতে ডুবে আছে অধিকাংশ মুসলিম সমাজ। যুবকরা নারী ও নেশায় মাতাল হয়ে আছে।
পূর্বে আরবী ভাষায় দক্ষ ও কুর’আন হাদিসের শিক্ষায় শিক্ষিতকে মুসলিম সমাজ জ্ঞানী বলে মনে করা হত, এবং আজকে আরবী ভাষা নয় কুর’আন হাদিস নয়, এমনকি এই সব জানা শাইখরাও ইংলিশ না জানলে তাকে মুসলিম সমাজ মূর্খ মনে করে। যাইহোক, আমাদের মূর্খতা কতটুকু সেটা পরিমাপ করার মত ইলমও আমাদের নেই। ফুটবল খেলার আগে সুরাহ ফাতিহা পাঠ ও দুয়া হচ্ছে, গোল দেয়ার পরে সিজদাহ হচ্ছে। ইং সা আল্লাহ বলে হারাম ফিল্ম রিলিজ হচ্ছে। এই হল আমাদের ইলমের হাল। আমার ওয়ালে অনেক পোস্ট আছে। এই বিষয়ে লিখতে গেলেও হাত থেমে যায় ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। এখন লিখতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।
ইসলামের অসংখ্য পরিভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে।দার, দারুল হারাব, দারুল ইসলাম, তাকফির, খারাজ, জিজিয়া, গনিমত, হিজরত, খিলাফা, খলিফা, আমির, জিহাদ, ফি সাবিলিল্লাহ ইত্যাদি শব্দ গুলো আজ যাদুঘরে চলে গেছে। আজকের মুসলিমদের সাথে এই সকল শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু শব্দ এখনো থাকলেও পারিভাষিক অর্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং মুসলিম মননে অদ্ভুত সব আভিধানিক অর্থ স্থান করে নিয়েছে। অথচ পূর্বে মুসলিমরা এগুলোর প্রকৃত অর্থ জানত। তারা জানত তারা কোথায় আছে দারুল কুফরে না ইসলামে, তারা জানত তাদের হিজরত করতে হবে কি না, তারা জানত গনিমত কি, তারা জানত ফি সাবিলিল্লাহ' শব্দের প্রকৃত অর্থ , তারা জানত খলিফা না থাকলে কি হবে, তারা জানত কিভাবে খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তারা জানত কিভাবে একজন মুসলিম কাফির হয়ে যেতে পারে।
জাতীয়তাবাদ
ইসলামিক জাতীয়তাবাদ ব্যতীত অন্য কোনো জাতীয়তাবাদের ব্যানারে মুসলিম ভাগ হলে মুসলিমরা চরম ভাবে বিপর্যয়ের শিকার হত। পূর্বে মুহাজির-আনসার। বনু খাজরাজ-বনু আউস। আব্বাসি-উমাইয়াহ। আরবী-আজমী। শামী-ইয়ামানী। এসবে কিছুটা জাতিয়তাবাদের উত্থান দেখা যেত। আন্দালুসিয়ায় সুন্দর গোছানো মুসলিম রাজত্ব একাধিকবার তছনছ হয়েছিলে এই গোত্রবাদ ও গোত্রপ্রীতির কারণে। খিলাফত বনু উমাইইয়া ও আব্বাসীর দণ্ডেও অনেক রক্ত ঝড়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন ছোট ছোট গোত্রের মাঝে লড়াই হত এমন হাজারো ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু এই গোত্রপ্রীতির রাজনীতি শুধু শাসকের আসন দখলকে কেন্দ্র করেই ঘটত, ব্যক্তি জীবনে কোনো প্রকারের প্রভাব বিস্তার করত না। সাধারণ মানুষ ছিল এসব থেকে বহু দূরে। আচার-আচরনে চিন্তা চেতনায় প্রভাব পড়ত না। গোত্রপ্রীতি বা জাতির চেতনা শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ হত না। মুসলিম মুসলিম মাত্রই ভাই ভাই সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু বর্তমানে। বর্তমানে জাতীয়তাবাদের কালগ্রাস কতটা গভিরে আছর করেছে তা বুঝতে হলে আল্লামা ইকবালের ওয়াতিনিয়াত কবিতাটিই যথেষ্ট। তিনি রাষ্ট্র তথা দেশ তথা জাতীয়তাবাদকে নব্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। হিন্দুরা তাদের উপাস্যের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোক পাঠ করে, তাই তারা মুশরিক। মুশরিকদের মত করে, ওয়াতানিয়াত নামক নতুন খোদার সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াতিনিয়াতের পূজারীরা ওয়াতানিয়াত কর্তৃক নির্ধারিত স্লোক পাঠ করছে। পতকাকে বানিয়েছে দেবতা, জাতীয় সঙ্গীতকে হল ধর্মীয় স্লোক। খালি পায়ে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম করে পুরো ব্যবস্থাকে করেছে হিন্দুর পূজামণ্ডপ। তিনি উদ্বুদ্ধ করে বলছেন- হে মুসলিম ভেঙ্গে ফেল এই নতুন উপাস্যকে। তিনি কবিতায় বলতে চেয়েছেন-"যুগ বদলেছে বদলেছে যুগের মানুষ। মুসলিমরা আলাদা কাবা গড়েছে। নয়া যুগের আযররা (ইব্রাহীম (আ) এর পিতা'র অনুসারীরা) নতুন খোদা বানিয়েছে। নতুন এই খোদা গুলোর মধ্যে দেশ অর্থাৎ রাষ্ট্র হল বর্তমানে সব চেয়ে বড় খোদা। এই খোদার সমাজে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আধুনিক সভ্যতার এই নতুন খোদা ইসলামের কাঠামোকে চুরি করেই গড়া হয়েছে। কেননা ইসলাম শুধু একটি মাজহাব (ধর্মীয় বিধি নিষেধ) নয়। ইসলাম হল একটি দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা)। জাতীয়তাবাদের এই ধারনা ইসলামের ভিতর থেকে চুরি করে পশ্চিমারা আবিষ্কার করেছে এবং ধর্মকে বাহিরে রেখে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম (অর্থাৎ রাষ্ট্র) তৈরি করেছে। মুসলিমরা সীমানা বা পতাকার মাঝে একত্র হয় না বরং কালেমার পতাকার নিচে ঐক্য হয়। ইসলাম হল মুসলিমের দেশ, কেননা তারা রাসুল (সা) এর অনুসারী। বাতিল সকল খোদাকে উপড়ে ফেলাতে মুসলিমরা অভ্যস্ত। তাই মুসলিমদের উচিত এই বাতিল ধ্বংস করে ফেলা।" কাওমিয়াত কবিতায় তিনি আরো বুঝিয়েছেন-
"রাষ্ট্র, বিভিন্ন দেশ, সীমানা মানুষকে বিভক্ত করে ফেলেছে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে পৃথক দেশ নামে বিভক্ত করে ফেলেছে। মুসলিম ভূমি বিধর্মীদের দ্বারা দখল হলে এক সময় দেখা যেত মুসলিমরা আবার জেগে উঠত, আর পুনরায় দখল করত। তাই ইসলামের শত্রুরা বুঝতে পারলো, মুসলিমদের উপর স্থায়ী ভাবে শাসন করার দুটি পথ রয়েছে। এক, দখলকৃত অঞ্চলে বসবাসকারী সকল মুসলিমকে হত্যা করতে হবে বা নির্বাসন করতে হবে (যেমনটা আন্দালুসিয়ায় হয়েছিল), দ্বিতীয় পদ্ধতি হল বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করে ফেলা। তাই তিনি বললেন, ইসলামী রাষ্ট্রের গোঁড়াকেই কেটে ফেলেছে এটা।" জাতীয়তাবাদী আজকের মুসলিমদের তিনি প্রশ্ন করছেন- তুমি নিজের পরিচয় দাও তুমি সাইয়্যাদ, তুমি মীর্জা, তুমি আফগান- সব কিছুই তো আছ তুমি, বল আছো কি তুমি মুসলিম?
'জাতীয়তাবাদ' কতটুকু পার্থক্য করে তা আমরা আসলে বুঝি না। একটি উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে ইং সা আল্লাহ। ধরুন ভারত দিনাজপুর অঞ্চলে আক্রমন করে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তখন আমরা বলব, 'আমাদের দেশে' আক্রমণ করা হয়েছে। ধরুন ইজরাইল ফিলিস্তিনে আক্রমণ করে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তখন আমরা বলব 'ফিলিস্তিনে' আক্রমণ করা হয়েছে। এখানে পার্থক্য শুধু 'আমাদের' শব্দে নয় বরং আমাদের মনের আবেগে বিশ্বাসে। যদি বলা হত দিনাজপুরের মুসলিমের উপর আক্রমণ হয়েছে, এবং ফিলিস্তিনের মুসলিমের উপর আক্রমণ হয়েছে। তখন মুসলিম জাতীয়তাবাদ উঠে আসত এবং আমাদের (দিনাজপুর ও ফিলিস্তিনবাসী উভয়ের প্রতি) আবেগে কোনো তফাত থাকত না, পুরো দুনিয়ার মুসলিমের জন্যই আমাদের আবেগ অভিন্ন হত। কিন্তু যদি রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলা হয় তবে আপন রাষ্ট্রের প্রতি আবেগ আসবে পর রাষ্ট্রের প্রতি আবেগ আসবে না। এটাই হল জাহিলিয়াতের জাতীয়তাবাদ। মুসলিম জাতীয়তাবাদ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্ছল বা দেশ কেন্দ্রিক নয় বরং তা পুরো বিশ্ব কেন্দ্রিক। তাই কবি ইকবাল বলেন,
"চীন ও আরাব হামারা হিন্দুস্তা হামারা
মুসলিম হ্যাঁয় হাম ওয়াতান হ্যাঁয় সারা জাহা হামারা"।জাতীয়তাবাদ আজ আমাদের গ্রাস করেছে। একটি শিশুও আজ শত্রু-মিত্র বাছাই করছে জাতীয়তাবাদের আয়ানায়। এটা একটি জাহিলিয়াত চেতনা। ইতিহাসে এমন অবস্থা ভাবাও কঠিন ছিল।
বুদ্ধি ও চিন্তাভিত্তিক দৈনতা
এটা যেন এমন হল মুত'আ যুদ্ধে মুসলিমরা দেখল সারি সারি অসংখ্য রোমান সেনা উন্নত অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অশ্বারোহী বর্ম পরিধান করে আছে, তাদের সকলের পুরো দেহ বর্মে ঢাকা, মাথায় রয়েছে হ্যাট, খুরধার চকচকে তালোয়ার, রয়েছে অসংখ্য ঘোড়া, উন্নত উট ও উটের জিন। তাদের কাছে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার আছে, আছে সুন্দর পোশাক। তাদের আমিরের তাবু দেখতে বিশাল অট্টলিকার মতন। এই সব দেখে মুসলিমরা বলছে আমরা কি করে তাদের সাথে পারব? তারাই তো বিশ্ব শাসন করবে আমরা হব পরাভূত। তারা প্রযুক্তি, অর্থনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতি সব কিছুতে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে তাই আমাদের উচিত আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তি উন্নত করা তাহলে আমরা অবশ্যই বিশ্ব শাসন করতে পারব। আমরা অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজে যাব তাদের থেকে শিক্ষা নিব, আমাদের সামাজিক কালচার তাদের মত গড়ব তাদের মত সভ্য হব এভাবে একদিন নিশ্চয় আমরা তাদেরকে পরাস্ত করতে পারব।
দুঃখজনক হলেও সাহাবাগন এমন ভাবেন নি তারা কখনো বিপদে পড়লে কুর'আন ও সুন্নাহর সাহায্যে উপায় খুজতেন। কিন্তু আজ আমাদের তথাকথিত অধিকাংশ ইসলামি চিন্তাবিদগণ কুর'আন সুন্নাহ ভুলে ক্যামব্রিজ অক্সফোর্ডের মাধ্যমে উপায় খুজেন। তারা বলেন আমরা জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সামাজিকতায়, অর্থনীতিতে পশ্চিমাদের থেকে পিছিয়ে আছি তাই আমরা আমাদের অবস্থান হাড়িয়েছি। তারা এটা বুঝে না আমরা কুর'আন ও সুন্নাহ থেকে দূরে যাওয়ার ফলেই আজ আমাদের এই দশা। তারা বলে আমাদেরকে উন্নত হতে হবে, তাদের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে ব্যাংক হয়েছে তো এর বিরোধিতা না করে ইসলামিক ব্যাংক বানাতে হবে। গণতন্ত্রের বিপরিতে ইসলামিক গণতন্ত্র। বামীর স্থলে ইসলামিক বামী, হারাম মদের স্থলে হালাল মদ। আমাদের নারীরাও পিছিয়ে নেই তাই সবাইকে ঘর থেকে বের করে অফিসে নিতে হবে। দাঁড়ি অসভ্যের প্রতিক তাই সভ্য হওয়ার জন্য দাঁড়িকে ছোট করলে প্রবলেম নেই। ইসলাম বেশ স্ট্রিক্ট তাই একে শান্তি শান্তি শান্তি বলে প্রচার করতে হবে। সভ্য হতে হলে ইংলিশ শিখতে হবে, পূর্বের মুসলিমগণ মাতৃভাষা বাদে এরাবিক শিখতেন আর এখন আমরা ইংলিশ শিখি। আর অবাক করা বিষয় হল, মুসলিমরাই ইংলিশ শিখতে সবচেয়ে বেশি তৎপর অন্য দেশ বা জাতি গুলো যেমন চাইনিজ, জাপানিজ, স্প্যানিশ, ড্যানিস, জার্মান, রাশান ইত্যাদি ইংলিশ শিখতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। কনসারভেটিজম বা মডারনিজম আগে ছিল না। কোনো এমন শাইখ ছিল না যারা ইসলামের সাথে অন্য ধর্মের সহাবস্থান মেনে নিতেন। ইসলামকে কাটছাঁট করার প্রজন্ম কোনো কালেই ছিল না।মডারেট শ্রেণীর মেজরিটি মুসলিম শিরকি নিজামকেই খিলাফাত মনে করে। ভোট পেয়ে জয়ী হওয়া, সেকুলারের শপথ গ্রহণকারীদের নব্য খলিফা মনে করে। এদের খলিফা হল ব্যক্তিজীবনে ধর্ম মাননে ওয়ালা মুসলিম। রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে ইসলাম বাস্তবায়ন বিষয়ে তারা কিছু জানে না। এরা ফুটবল খেলায় গোল দিয়ে সিজদা করা মুসলিমদের দেখে ভাবে ইসলাম জিন্দা হচ্ছে। কাকে কি স্থান দেয়া হচ্ছে খবর নেই। এরা ক্ষমতাই আসা মানে শুধু এটাই হল যে তাদের স্থলে আরো খারাপ, আরো মন্দ আরো সেকুলার, আরো মডারনিস্ট, আরো আমেরিকা-ন্যাটো-রাশিয়ার পা চাটা গোলামরা আসে নাই। উল্লেখ্য এখানে তাদের মধ্যে পার্থক্য হল শুধু ‘আরো’ শব্দটি। গনতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যদিও সেকুলার ইসলামের সাথে কাটছাঁট করে ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া বানিয়েছে। আরও বানিয়েছে ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান। এটা হল চরম পর্যায়ে বুদ্ধিভিত্তিক পরাজয়। আল্লাহ পানাহ।
একাল ও সেকাল
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরে মুসলিমরা এক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না তখন উম্মাহর এমন এক জামায়াত দুনিয়াতে অবস্থান করছিল, যারা যে কোনো বিপদ ও ফিতনাকে কেটে ফেলতে পারতেন। তাদের এক এক জনকে আল্লাহ এতটা মজবুত ঈমান দিয়েছিলেন যে, ঈমানের নূর হয়ে পুরো দুনিয়াকে আলোকিত করার জন্য তারা যথেষ্ট ছিলেন। এর পরের জামায়াত ছিল তাবেই ও তাবে তাবেঈ’র। এই সময়ের কারবালা ও হাররার ঘটনা ঘটে। হযরত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কতল করা হয়। পরের বছরে মদিনায় লুটপাত, ১০ হাজার মুসলিমকে হত্যা ও হাজারো মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এর পরে ইয়াজিদের মৃত্যু হল। মৃত্যুর খবর পেয়ে- আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদের সৈন্যদের বলেন, “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ‘তাগূত’-কে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” ইয়াজিদের প্রতি সাহাবী তাগূত শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যদি আজকের যুগে তারা থাকতেন তাহলে দেখতেন মুসলিম নামধারী অসংখ্য প্রকৃত ‘তাগূত’ শাসকের আসনে আসিন রয়েছে। এরপর এল ক্রুসেড ও তাতারি ফিতনা তারা কোটি মুসলিমকে হত্যা করেছিল, সাময়িক ভাবে মুসলিমরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম হত্যা করে মুসলিমের পরাজয় কখনো হয় নি, বরং মুসলিমের মধ্যে আদর্শিক ভাবে মিথ্যা বিশ্বাস ও চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেই তারা পরাজিত হয়। তখন যদি ২০ লক্ষ নিহত হয়ে থাকে, তাহলে বিংশ শতাব্দীতেও কোটি কোটি মুসলিম নিহত হয়েছে। সে কালে খোরাসান, সেন্ট্রাল এশিয়া, শাম, ইরান, মুসলিমদের বেদখল হয়েছিল, আন্দুলুসিয়া মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছিল। আর বিংশ শতাব্দীতে পুরো দুনিয়ার সকল মুসলিম ভূখণ্ড, সকল শহর মুসলিমদের হাতাছাড়া হল। কোলোনিয়াল পুতুল সরকার দিয়ে যুগ যুগ ধরে কাফিরা মুসলিমদের শাসন করতে লাগল। কোনটা বড় পরাজয়? কি করে আমরা বর্তমানকে পূর্বের তাতারী, ক্রুসেড, আন্দুলুসিয়া, মুরতাদি, বা কারবালা ও হাররার ঘটনার সাথে মিলাতে পারি?পরিশেষে.....
এ হল বর্তমান মুসলিম উম্মাহর হাল। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক সহ সকল ক্ষেত্রে আজ মুসলিম উম্মাহ চরম ভাবে পরাজিত, মহাসংকটে, মহা বিপর্যস্ত। কিন্তু আমরা যখন তথাকথিত মুসলিম ও তাদের শুয়ুখদের দিকে তাকাই, তাদের শাসকদের দিকে তাকাই তখন দেখি তারা বেশ আরামে আছেন। তারা উম্মাহর করুণ বাস্তবতা সম্পর্কে বেখবর। এযুগের বাস্তবতা তারা দেখতে পায় না, তারা আত্নিক অন্ধত্বের শিকার। অবশ্যই উম্মাহর পূর্বের বিভিন্ন বিপদ ও সংকট নিয়ে তারা চিন্তা করে, তাহকিক করে, যেমন তাতার ও ক্রুসেডার নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। ইঞ্জেকশন দিয়ে ফুলানো মোটা গরুর অবস্থা আর এসি রুমে বসা মডারেট শাইখের মুখে বর্তমান মুসলিমদের হাল জানা আমার কাছে একই মনে হয়। তারা এক মিথ্যা ইসলাম ও মিথ্যা মুসলিমের অবস্থা গিলাচ্ছে, বাস্তবতার সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে যারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝেন তারা তা স্বীকার করতে অপারগ। কি করে আমরা বর্তমান বিপর্যস্ত মুসলিম উম্মাহর অবস্থাকে নজর আন্দাজ করতে পারি? কেন আমরা তাতার ক্রুসেড সংকট নিয়ে চিন্তা করি কিন্তু আজকের মুসলিম উম্মাহর উত্তরণের পথ নিয়ে চিন্তা করছি না? কেন উম্মাহর বেহাল অবস্থার কথা বললে আমাদেরকে অতিতের বিপদ দেখিয়ে বলা হয় এর চেয়ে বড় বড় বিপদ এসেছিল? কেন বলা হয় এখন দুনিয়ার অবস্থা খুব স্বাভাবিক?
এই যামানার উদাহরণ অন্য যামানায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যামানাকে নতুন করে চিনতে হবে, কুর’আনে হাদিসের আলোকে চিনতে হবে, ইতিহাসের পাতায় নয়। চোখ থাকতেও আমরা অন্ধত্বের শিকার হয়েছি। যদি বাস্তবতাকে সঠিক ভাবে না বুঝতে পারি তাহলে কি করে করণীয় নির্ধারণ করব। আমরা সমস্যাকে সমস্যাই মনে করছি না, বিপদকে বিপদ মনে করছি না। যেন জেলের কয়েদী ভুলে গেছে সে একজন কয়েদী, যেন একজন দাস ভাবছে সে স্বাধীন। দাজ্জালী চক্রান্ত এমন ব্রেইন ওয়াস করিয়েছে যে নিজের সঠিক অবস্থানও সনাক্ত করতে পারছে না। অন্ধকার গহ্বরের তলানিতে নিপতিত হয়েও ভাবছে পাহাড়ের চূড়ায় তার অবস্থান। এ যেন দাজ্জালী সভ্যতার নিকট ইসলামি সভ্যতার এক মহাপরাজয়!!
اللَهُمَّ أَرِنَا الاَشْيَاءَ كَمَا هِي*َ،
‘’হে আল্লাহ আমাদের প্রত্যেক জিনিসের আসল রূপ দেখাও যাতে বাহিরটা দেখে প্রতারিত না হই’’
اللهُمَّ أَرِنَا الحَقَّ حَقّاً وَارْزُقْنَا التِبَاعَةَ وَأَرِنَا البَاطِلَ بَاطِلاً وَارْزُقْنَا اجْتِنَابَهُ
“হে আল্লাহ, আমাকে সত্যকে সত্য বুঝার, ও এর ওপর আমল করার তৌফিক দাও এবং মন্দ ও খারাপকে খারাপ করে দেখাও, এর থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দাও।”
স্বাভাবিক ভাবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক বলবেন তাতারী ফিতনাটিই সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল। কোনো কোনো ঐতিহাসিক ক্রুসেড ফিতনাকেও ভয়াবহ বলতে পারেন। কিন্তু আমি মনে করি বর্তমান ঐতিহাসিকদের ভাবা উচিত, এই প্রশ্নের উত্তর দূর ইতিহাসে না খুঁজে হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর (বিংশ শতাব্দীর) ইতিহাসে খুজতে হবে। অবশ্যই বিংশ শতাব্দী এবং এর পরবর্তী সময় গুলোই হল মুসলিম উম্মাহর ১৫ শত বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সময়। ইবনে কাসির, ইবনে আসির, ইবনে খালদুন, ইবনু তাবারী (রহিমাহুমুল্লাহ) ঐতিহাসিকগণ হিজরির চতুর্দশ শতাব্দীর ইতিহাস দেখেন নি, দেখলে তারা অবশ্যই এই সময়কে সবচেয়ে ভয়াবহ, ভয়ঙ্কর মহাবিপর্যয় বলে আখ্যায়িত করতেন।ঐতিহাসিকগণ প্রায় একমত হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ছিল কঠিন ভয়াবহ সময় এবং এর পরের শতাব্দীতে তাতারিদের আগমন হয়েছিল। এই কয়েকশ বছর যত ফিতনা ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন মুসলিম উম্মাহ হয়েছিল তা আর কোনো সময়ে হয় নি। এই সময়ে কারামতিদের উত্থান হয় তারা মক্কায় আক্রমণ করে হাজরে আসওয়াদ পাথর লুন্ঠন করে নিয়ে যায়, কাবার গিলাফ কেটে কেটে টূকরো করে,
অসংখ্য হাজীদের হত্যা করে, এই সময়ে উম্মাহর খিলাফত কার্যত বাগদাদের শাহী মহলে সীমাবদ্ধ হয়ে পরে, মিসরে ওবায়দীয় বাতেনিদের হত্যা ও লুন্ঠনের শাসন চলে, বুয়াইহীরা বাগদাদ দখল করে খালিফাকেও হত্যা করে, মুসলিম শাসকগণ কাফিরদের মদদ নিয়ে অন্য মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নানান ফিতনা ও বিদ'আত সমাজে সয়লাব করে, এই সময়ে ক্রসেডারদের আক্রমণ শুরু হয় এবং শাম ও মিসরের বিভিন্ন শহর তারা দখল করে, বিশেষ করে বায়তুল মাকদিস তারা দখল করে এবং হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন শহরের মসজিদ ধ্বংস করা হয়, আযানে নতুন এক লাইন যুক্ত করা হয়। ইলম ও উলামারাও এই সময়ে ফিতনা থেকে মুক্ত ছিলেন না। উলামাদের মধ্যে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে বাহাস লেগেই থাকত। ৭ম শতাব্দীতে তাতারিরা বাগদাদে আক্রমণ করে প্রায় ২০ লক্ষ্য মুসলিমকে হত্যা করা, পুরো খোরাসান, খাওরাজাম সাম্রাজ্য, ইরাক, ইরান, বাগদাদ, দামেস্ক, আলাপ্পো সহ বিভিন্ন বড় বড় শহর ও অঞ্ছল দখল করে কোটি মুসলিমকে হত্যা করে। এই সময় মুসলিম উম্মাহকে এরকম নানান বিপর্যয় ও ফিতনা এক এক করে ঘায়েল করছিল। অবশ্যই এই বিপদ গুলো রাজনৈতিক এবং আদর্শিক উভয় ভাবে আক্রান্ত করেছিল কিন্তু এক সাথে রাজনৈতিক ও আদর্শিক ভাবে উম্মাহকে পরাজিত করতে পারেনি।যখন আমরা রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতাম তখন আদর্শিক শক্তি ও প্রজ্ঞা আমাদেরকে উদ্ধার করত। যখন আমরা আদর্শিক ফিতনার সম্মুখীন হতাম রাজনৈতিক শক্তি আমাদের পথ চলা সহজ করত। কখনো এগিয়ে আসতেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও আমিরগণ আবার কখনো এগিয়ে আসতেন যুগের ইমামগণ। একে অপরকে পরিশুদ্ধ সংশোধন করে বাঁকা পথ থেকে সোজা পথে নিয়ে আসতেন তারা।
এই সময়ে সেলজুক শাসন তৈরি হয়। এই সময়ে নুরুদ্দিন জঙ্গি, সালাহুদ্দিন আইয়ুবি জন্মেছিলেন। এই সময়ে সুলতান মাহমুদ গাজনাভি শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এক একটি রাজনৈতিক বিপর্যয়কে তারা এক এক জন মোকাবেলা করেছেন। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াহ এর অনুসারী বিশাল শ্রেণীর আলেমগন তখনো ছিলেন। তারা আদর্শিক ভাবে উম্মাহকে বাঁকা পথ থেকে সোজা পথে নিয়ে আসতেন। সকল ধরনের ফিতনা তারা দূর করতেন। তারা বিভিন্ন শাসকদের ইসলাহ করতেন। পূর্ণ ইসলামের বাস্তবায়ন ও বাতিলের ধ্বংস করার জন্য উজ্জীবিত করতেন।
এভাবে এক এক করে বিভিন্ন ফিতনা ধ্বংস হয়ে যায়। তারা সাধারণ মানুষের কাছে হক ও বাতিল স্পস্ট করে দিতেন। বাতিলকে স্পস্ট ভাবে গুমরাহ ও কুফুরি বলে ঘোষণা করতেন। মুসলিমদের মধ্যে দ্বীনের প্রাথমিক জ্ঞান ছিল। তারা আল্লাহর বিধান মানত, ফরজ পালন করত, হারাম থেকে বেঁচে থাকত। আল্লাহর দেয়া বিধানে বিচার মিমাংসা করত। বিচারের কাজ ন্যস্ত থাকত আলেমদের অধীনে। শাসকগণ শতধাবিভক্ত হলেও বিচারকের বিচারে বাঁধা দিতেন না, অধিকাংশ সময় সাধারণ মানুষের বিচার ব্যবস্থা ছিল স্বাধীন।
ক্রুসেড যখন শুরু হল উম্মাহ জানত তাদের কি করা উচিত, যখন বায়তুল মাকদিস দখল হয়ে গেল উম্মাহ জানত কি করা উচিত, তারা তাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিত সংগ্রামী লড়াইতে কিন্তু শাসকগণ প্রতারনা করে জিহাদের জন্য আদায় করা অর্থ ভোগ করত। জিহাদের আওয়াজ তুলে টালবাহানা করে দমে যেত। সাধারণ মুসলিমগণ করণীয় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন, ওলামারাও যথা সাধ্যে চেষ্টা করতেন শাসকদের উজ্জীবিত করার। শুধু কিছু ব্যক্তি বিশেষ শাসক ও তাদের ক্ষুদ্র অনুসারিদের জন্য বিপদের মোকাবেলা কঠিন হয়ে পরত। শাসকদের অবহেলার কারনে সাধারণ মানুষ হয়ে পরত অলস। কিন্তু সাধারণ মানুষ ছিল আগুনে নিভু নিভু ছাই এর মতন, একটু বাতাসেই জ্বলে উঠত। এভাবে তারা ক্রুসেডারদের হত্যা করল, মোঙ্গলদের পরাজিত করল। সকল বাতেনি ফিতনাকে মাটিতে দাফন করে দিল।রাজনৈতিক পরাজয়
আজ মুসলিমরা রাজনৈতিক ভাবে সম্পূর্ণ পরাভূত। পুরো বিশ্বে মুসলিমের রক্ত ঝড়ছে, হাত দিয়ে প্রতিরোধ করার শক্তিতো দূরের কথা মুখ দিয়ে প্রতিবাদ করার শক্তিও নেই আমাদের। মিয়ানমার, কাশ্মির, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন সহ যেখানেই মুসলিমদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় তার বিরুদ্ধে কিছু মিছিল মিটিং ছাড়া শক্ত প্রতিবাদের করার মত আমাদের রাজনৈতিক কোনো শক্তি আজ বিদ্যমান নেই। এর মধ্যে কখনো কোনো তাগুতের গোলাম, ফাসিক, যালিম শাসক পরোক্ষ ভাবে প্রতিবাদ জানালে মুসলিমরা উক্ত শাসককে সাথে সাথে খলিফা, সুলতান, আমির মনে করে মাথায় বসিয়ে নেয়।এই হল বর্তমান অবস্থা। একটি উদাহরণ দেই- ‘এক মুসলিমের কাফির বন্ধু অসংখ্য মুসলিমকে হত্যা করল, কিন্তু ঐ মুসলিম চেয়ে চেয়ে দেখল। মাঝে মধ্যে দুয়েকজন মুসলিমকে ছেঁড়ে দেয়ার জন্য সে তার কাফির বন্ধুকে সম্মত করালো। এখন মুসলিমরা ঐ কাফিরের বন্ধুকে যুগের সালাহুদ্দিন আইয়ুবি উপাধিতে ভূষিত করল।’ অন্ধরা জানত না সালাহুদ্দিন আইয়ুবি রহিমাহুল্লাহ’র সময়েও অনেক মুসলিম শাসক কাফিরদের মদদ করত, কাফিরদেরকে বন্ধু রূপে গ্রহন করেছিল। কাফিরদের সাথে জোট করে মুসলিম সালাহুদ্দিন আইয়ুবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। কাফির ক্রুসেডাররা মুসলিমদের হত্যা করলে তারা কিছু বলত না, হ্যাঁ মাঝে মধ্যে দুয়েকজন মুসলিমকে ছেঁড়ে দেয়ার জন্য অনুরোধ করত (এরা হল আমাদের যুগের তথাকথিত সালাহুদ্দিন)। অন্যদিকে মহান সুলতান সালাহুদ্দিন ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই করার আগে এই সব মুনাফিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং এদের পরাস্ত করে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিলেন।
পূর্ব থেকে পশ্চিমে কোনো ভূখণ্ডে আল্লাহর হাকিমিয়াত প্রতিষ্ঠা নেই
হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুসলিম ভূখণ্ড অনেক ছোট ছোট অঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, ঐক্য নস্ট হয়ে গেলেও, খলিফার সাময়িক পতন হয়ে গেলেও, প্রায় সকল ভূখণ্ড ছিল কোনো না কোনো মুসলিম সুলতান, আমির, নবাবের নিয়ন্ত্রণে আর সেখানে ইসলামি বিধান কার্যকর ছিল। শাসকগণ ব্যক্তিবিশেষের জন্য আইনে হস্তক্ষেপ করলেও সাধারন ভাবে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হাকিমিয়াত কায়েম ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যখন খলিফা ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেল, তখন শুধু খলিফা ব্যবস্থা ভাঙ্গে নি সাথে সাথে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হাকিমিয়াত উঠে গেল। আজ মাগরিগ থেকে মাশরিক। উত্তর থেকে দক্ষিণ। মিশর থেকে ফিলিপাইন বা ব্রাজিল থেকে জাপান, অস্ট্রেলিয়া থেকে আলস্কা কোথাও আল্লাহর বিধানের প্রতিষ্ঠা নেই। আমরা কি এত টুকু বুঝি না। আমরা কি করে এই যামানাকে অতিতের ইতিহাসের সাথে মিলাচ্ছি। কি করে ভুলে গেলাম এমন পরাজয় আমাদের ইতিহাসে কখনোই হয় নি। পূর্বকার ইতিহাসবিদগণও এমন পরাজয় বা মহা বিপর্যয়ের কথা কখনো কল্পনা করেন নি।সামরিক পরাজয়
মুসলিমরা পূর্বেও অমুসলিমদের থেকে সামরিক ফিল্ডে পিছিয়ে ছিল। অস্ত্রে, সংখ্যায়, কলাকৌশলে, অভিজ্ঞতায়, অর্থ বিনিয়োগে, সময় উপযোগিতায় কিন্তু মুসলিমরা কখনো এই পিছিয়ে পড়াকে দুর্বলতা মনে করত না। তাদের ঈমান দিপ্ত সাহস ও চেতনা, জীবন বিলিয়ে দেয়ার মনোভাব অস্ত্রে ও সংখ্যায় স্বল্পতার চাহিদা পূরণ করে দিত। হিজরি চতুর্থ শতাব্দি থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীতে মুসলিমরা অনেক ক্ষমতাধর ছিল। হুজুগে জাতি ছাড়া বুদ্ধিমান কোনো জাতি বা সাম্রাজ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে বা মুসলিম ভূখণ্ডে কোনো প্রকার সামরিক আগ্রাসনের চিন্তাও করত না। তাই তো ক্রুসেডাররা মিথ্যা কিছু ধর্মীয় আবেগ তৈরি করে আর তাতারি ডাকাতদের বুদ্ধিহীনতাকে পুঁজি করে তারা মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমন চালিয়ে ত্রাস কায়েম করেছিল।
সাংস্কৃতিক পরাজয়
রাষ্ট্র বা জাতিকে অস্ত্রের বলে বেশি দিন পরাজিত করে রাখা যায় না। সামরিক পরাজয় অস্থায়ী বিজয় এনে দেয় স্থায়ী বিজয় আনতে পারে না। স্থায়ীভাবে পরাজিত শক্তিকে দাবিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের। সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক, রাজনৈতিক সিস্টেমের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে একটি জাতিকে পরাজিত করে রাখা যায়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে পুরো বিংশ শতাব্দী পশ্চিমা সেকুলার নাস্তিক সভ্যতা মুসলিম বিশ্বকে প্রথমে সামরিক ভাবে এবং পরে সাংস্কৃতিক ভাবে আগ্রাসন চালিয়ে গ্রাস করেছে। ধ্বংস করে দিয়েছে।যে ফিলিস্তিনের জন্য আমরা কান্না করি। যে ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তারা পশ্চিমা সাংস্কৃতির অনুসরণকারী। তারা সাংস্কৃতিক ভাবে অনেক আগেই পশ্চিমাদের কাছে পরাজিত হয়েছে। এই পরাজিতরা কখনোই সামরিক বিজয় পাবে না। একই অবস্থা হল প্রায় সকল মুসলিম রাষ্ট্রের ও জাতির।
ইসলামের উত্থানের সাথে সাথে চারটি সভ্যতার চরম ভাবে পরাজয় ঘটে-তথা রোমান সাম্রাজ্য, পারস্য/পারসিয়ান সাম্রাজ্য, মিশর ও ভারতীয় সভ্যতার। ইসলামের বিস্তারে এ চারটি সভ্যতার, জাতিয়তাবাদের, সংস্কৃতির পরাজয় ঘটে। ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক সকল প্রথা, পদ্ধতি, অভ্যাস, কলা, সংস্কৃতির পতন ঘটে। যুগে যুগে ইসলামের উপর আঘাত আসে, কিন্তু তারা মুসলিমকে বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ভাবে পরাজিত করতে পারে নি, তাই কয়েকযুগ পরেই মুসলিমরা আবার জেগে উঠত। অবশেষে, যুদ্ধের পদ্ধতিতে পরিবর্তন হল। তারা বুঝলো, সাম্রাজ্যে বা শাসকের মহলে আঘাত নয় আঘাত দিতে হবে বিশ্বাস ও প্রথা পদ্ধতিতে। ব্রিটিশের উত্থান হল। ঐতিহাসিকগণ বলেন, তাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, তারা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ভূমি দখল করল। প্রায় পুরো বিশ্বের শাসক তাদের নিকট মাথানত করেছিল। কিন্তু এই সব তাদের কোনো অর্জন নয়। অর্জন হল তারা পুরো বিশ্বকে তাদের কার্বনকোপি বানিয়ে দিল, তাদের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, যুক্তি, শিক্ষা মুসলিমসহ সকল দেশের সভ্যতাকে পরাজিত করল। মানব ইতিহাসের সব চেয়ে বড় পরাজয় ছিল এটা। একটি ভূখণ্ড, তার অর্থ তথা স্ট্যালিং পাউন্ড, তার শিক্ষা, তার আইন, তার বিশ্বাস, তার সংস্কৃতি, তার মিডিয়া, তার ব্যাংকিং সিস্টেম দিয়ে সকল মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করল, এবং নিয়ন্তা রাস্ট্রের আসনে আসিন হল।
মুসলিমদের সকল স্তরে, বৃদ্ধ থেকে শিশু, পুরুষ-নারী, যুবক-যুবতী সবাই চাল-চলনে, কথাবার্তায়, পোশাক-আশাকে, শিক্ষা-দিক্ষায়, খাদ্যাভ্যাসে, অনুসরণ-অনুকরণে অন্ধ ভাবে পশ্চিমা সভ্যতা বা বিজাতির সংস্কৃতি পালন করছে। এমন আগ্রাসনে ভয়ানক ভাবে পরাজয় বরণ করা সত্ত্বেও আমার ইতিহাসের বিপর্যয় হিসেবে তাতার, ক্রুসেড খুজতেছি?অর্থনৈতিক বিপর্যয়
তখন ছিল স্বর্ণ ও রূপ্য মুদ্রা। প্রয়োজনে সোনা রূপা সহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হত। মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারত না। কিন্তু এই শতাব্দীতে ডলার নামক মিথ্যা কারেন্সি ব্যবস্থা চালু হয়, মুসলিমদের কাছে স্বর্ণের খনী (তেল) থাকা সত্ত্বেও তারা গরীব, তাদের মুদ্রার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। আমেরিকা যখন চাইবে তখনই হস্তক্ষেপ করতে পারবে। যেসব মুসলিম দেশকে ধনী বলা হয়, সেসকল দেশেই সবচেয়ে নিম্ন কর্মচারী হল অন্য দেশের মুসলিমরা। এক মুসলিমের কাঁধে পা দিয়ে অন্য মুসলিম উচ্চস্থান দখল করেছে। আবার অন্যদিকে আফ্রিকায় মুসলিমরাই না খেয়ে মরছে। সামরিক ভাবে যেমন আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জাপানের চামচামি করছি অর্থনৈতিক ভাবেও পশ্চিমা কুফফারদের কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি। মুসলিম ইতিহাসে কোনো কালেই এমন হয় নাই, মুসলিম ঐতিহাসিকগণকে যদি বলা হত অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র কুফফারদের ছুঁড়ে ফেলা অন্ন ও অর্থের জন্য দিন রাত তাদের নিকট তাকিয়ে থেকে অপেক্ষা করছে, তাহলে তারা বিশ্বাস করতেন না।
ইসলামিক ইলম ও আমলের বেহাল অবস্থা
বর্তমানে ইসলাম ও মুসলমান শুধু নাম হিসেবেই পরিগনিত হয়। ইসলামকে ব্যক্তিজীবনে আটকে রাখা হয়েছে। সমাজে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, ইসলাম যে শুধু ব্যক্তি জীবনে নয় বরং সামগ্রিক ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা হওয়ার জন্য এসেছে তা আমরা ভুলে গেছি। আজকের অধিকাংশ মুসলিমরা দ্বীনের সাধারণ ও প্রাথমিক জ্ঞান রাখে না। তারা নামাজ, রোজার মত ফরজ বিধানের নিয়ম পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ। কুর’আনের অর্থ জানা ও হাদিস বোঝার জন্য আমাদের কাছে সময় নেই। সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কি আমরা তা জানি না। উম্মাত তাওহীদ ও শিরক বিষয়ে বেখবর। ঈমান ও কুফুরের পার্থক্য নির্ণয় করতে অপারগ। তাওহিদের স্বীকৃতি দিচ্ছি কিন্তু তাওহীদের সংজ্ঞা আমাদের জানা নেই।
সুদ, ঘুষ, যিনাহ ব্যাভিচার, অশ্লীলতা, নাচ গান-মিউজিক, গেমস, কুফর, শিরক সহ বিভিন্ন বদআমলীতে ডুবে আছে অধিকাংশ মুসলিম সমাজ। যুবকরা নারী ও নেশায় মাতাল হয়ে আছে।
পূর্বে আরবী ভাষায় দক্ষ ও কুর’আন হাদিসের শিক্ষায় শিক্ষিতকে মুসলিম সমাজ জ্ঞানী বলে মনে করা হত, এবং আজকে আরবী ভাষা নয় কুর’আন হাদিস নয়, এমনকি এই সব জানা শাইখরাও ইংলিশ না জানলে তাকে মুসলিম সমাজ মূর্খ মনে করে। যাইহোক, আমাদের মূর্খতা কতটুকু সেটা পরিমাপ করার মত ইলমও আমাদের নেই। ফুটবল খেলার আগে সুরাহ ফাতিহা পাঠ ও দুয়া হচ্ছে, গোল দেয়ার পরে সিজদাহ হচ্ছে। ইং সা আল্লাহ বলে হারাম ফিল্ম রিলিজ হচ্ছে। এই হল আমাদের ইলমের হাল। আমার ওয়ালে অনেক পোস্ট আছে। এই বিষয়ে লিখতে গেলেও হাত থেমে যায় ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। এখন লিখতেও আমার লজ্জা হচ্ছে।
ইসলামের অসংখ্য পরিভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাদুঘরে স্থান করে নিয়েছে।দার, দারুল হারাব, দারুল ইসলাম, তাকফির, খারাজ, জিজিয়া, গনিমত, হিজরত, খিলাফা, খলিফা, আমির, জিহাদ, ফি সাবিলিল্লাহ ইত্যাদি শব্দ গুলো আজ যাদুঘরে চলে গেছে। আজকের মুসলিমদের সাথে এই সকল শব্দের কোনো সম্পর্ক নেই। কিছু শব্দ এখনো থাকলেও পারিভাষিক অর্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, এবং মুসলিম মননে অদ্ভুত সব আভিধানিক অর্থ স্থান করে নিয়েছে। অথচ পূর্বে মুসলিমরা এগুলোর প্রকৃত অর্থ জানত। তারা জানত তারা কোথায় আছে দারুল কুফরে না ইসলামে, তারা জানত তাদের হিজরত করতে হবে কি না, তারা জানত গনিমত কি, তারা জানত ফি সাবিলিল্লাহ' শব্দের প্রকৃত অর্থ , তারা জানত খলিফা না থাকলে কি হবে, তারা জানত কিভাবে খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করতে হবে, তারা জানত কিভাবে একজন মুসলিম কাফির হয়ে যেতে পারে।
জাতীয়তাবাদ
ইসলামিক জাতীয়তাবাদ ব্যতীত অন্য কোনো জাতীয়তাবাদের ব্যানারে মুসলিম ভাগ হলে মুসলিমরা চরম ভাবে বিপর্যয়ের শিকার হত। পূর্বে মুহাজির-আনসার। বনু খাজরাজ-বনু আউস। আব্বাসি-উমাইয়াহ। আরবী-আজমী। শামী-ইয়ামানী। এসবে কিছুটা জাতিয়তাবাদের উত্থান দেখা যেত। আন্দালুসিয়ায় সুন্দর গোছানো মুসলিম রাজত্ব একাধিকবার তছনছ হয়েছিলে এই গোত্রবাদ ও গোত্রপ্রীতির কারণে। খিলাফত বনু উমাইইয়া ও আব্বাসীর দণ্ডেও অনেক রক্ত ঝড়েছিল। এছাড়া বিভিন্ন ছোট ছোট গোত্রের মাঝে লড়াই হত এমন হাজারো ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। কিন্তু এই গোত্রপ্রীতির রাজনীতি শুধু শাসকের আসন দখলকে কেন্দ্র করেই ঘটত, ব্যক্তি জীবনে কোনো প্রকারের প্রভাব বিস্তার করত না। সাধারণ মানুষ ছিল এসব থেকে বহু দূরে। আচার-আচরনে চিন্তা চেতনায় প্রভাব পড়ত না। গোত্রপ্রীতি বা জাতির চেতনা শত্রু মিত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ হত না। মুসলিম মুসলিম মাত্রই ভাই ভাই সম্পর্ক ছিল।
কিন্তু বর্তমানে। বর্তমানে জাতীয়তাবাদের কালগ্রাস কতটা গভিরে আছর করেছে তা বুঝতে হলে আল্লামা ইকবালের ওয়াতিনিয়াত কবিতাটিই যথেষ্ট। তিনি রাষ্ট্র তথা দেশ তথা জাতীয়তাবাদকে নব্য দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দেবতা বলে উল্লেখ করেছেন। হিন্দুরা তাদের উপাস্যের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোক পাঠ করে, তাই তারা মুশরিক। মুশরিকদের মত করে, ওয়াতানিয়াত নামক নতুন খোদার সামনে দাঁড়িয়ে ওয়াতিনিয়াতের পূজারীরা ওয়াতানিয়াত কর্তৃক নির্ধারিত স্লোক পাঠ করছে। পতকাকে বানিয়েছে দেবতা, জাতীয় সঙ্গীতকে হল ধর্মীয় স্লোক। খালি পায়ে পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম করে পুরো ব্যবস্থাকে করেছে হিন্দুর পূজামণ্ডপ। তিনি উদ্বুদ্ধ করে বলছেন- হে মুসলিম ভেঙ্গে ফেল এই নতুন উপাস্যকে। তিনি কবিতায় বলতে চেয়েছেন-"যুগ বদলেছে বদলেছে যুগের মানুষ। মুসলিমরা আলাদা কাবা গড়েছে। নয়া যুগের আযররা (ইব্রাহীম (আ) এর পিতা'র অনুসারীরা) নতুন খোদা বানিয়েছে। নতুন এই খোদা গুলোর মধ্যে দেশ অর্থাৎ রাষ্ট্র হল বর্তমানে সব চেয়ে বড় খোদা। এই খোদার সমাজে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আধুনিক সভ্যতার এই নতুন খোদা ইসলামের কাঠামোকে চুরি করেই গড়া হয়েছে। কেননা ইসলাম শুধু একটি মাজহাব (ধর্মীয় বিধি নিষেধ) নয়। ইসলাম হল একটি দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা)। জাতীয়তাবাদের এই ধারনা ইসলামের ভিতর থেকে চুরি করে পশ্চিমারা আবিষ্কার করেছে এবং ধর্মকে বাহিরে রেখে ভিন্ন ভিন্ন জাতীয়তাবাদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম (অর্থাৎ রাষ্ট্র) তৈরি করেছে। মুসলিমরা সীমানা বা পতাকার মাঝে একত্র হয় না বরং কালেমার পতাকার নিচে ঐক্য হয়। ইসলাম হল মুসলিমের দেশ, কেননা তারা রাসুল (সা) এর অনুসারী। বাতিল সকল খোদাকে উপড়ে ফেলাতে মুসলিমরা অভ্যস্ত। তাই মুসলিমদের উচিত এই বাতিল ধ্বংস করে ফেলা।" কাওমিয়াত কবিতায় তিনি আরো বুঝিয়েছেন-
"রাষ্ট্র, বিভিন্ন দেশ, সীমানা মানুষকে বিভক্ত করে ফেলেছে। আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি অর্থাৎ আশরাফুল মাখলুকাত মানুষকে পৃথক দেশ নামে বিভক্ত করে ফেলেছে। মুসলিম ভূমি বিধর্মীদের দ্বারা দখল হলে এক সময় দেখা যেত মুসলিমরা আবার জেগে উঠত, আর পুনরায় দখল করত। তাই ইসলামের শত্রুরা বুঝতে পারলো, মুসলিমদের উপর স্থায়ী ভাবে শাসন করার দুটি পথ রয়েছে। এক, দখলকৃত অঞ্চলে বসবাসকারী সকল মুসলিমকে হত্যা করতে হবে বা নির্বাসন করতে হবে (যেমনটা আন্দালুসিয়ায় হয়েছিল), দ্বিতীয় পদ্ধতি হল বিভিন্ন রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদে বিভক্ত করে ফেলা। তাই তিনি বললেন, ইসলামী রাষ্ট্রের গোঁড়াকেই কেটে ফেলেছে এটা।" জাতীয়তাবাদী আজকের মুসলিমদের তিনি প্রশ্ন করছেন- তুমি নিজের পরিচয় দাও তুমি সাইয়্যাদ, তুমি মীর্জা, তুমি আফগান- সব কিছুই তো আছ তুমি, বল আছো কি তুমি মুসলিম?
'জাতীয়তাবাদ' কতটুকু পার্থক্য করে তা আমরা আসলে বুঝি না। একটি উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে ইং সা আল্লাহ। ধরুন ভারত দিনাজপুর অঞ্চলে আক্রমন করে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তখন আমরা বলব, 'আমাদের দেশে' আক্রমণ করা হয়েছে। ধরুন ইজরাইল ফিলিস্তিনে আক্রমণ করে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে। তখন আমরা বলব 'ফিলিস্তিনে' আক্রমণ করা হয়েছে। এখানে পার্থক্য শুধু 'আমাদের' শব্দে নয় বরং আমাদের মনের আবেগে বিশ্বাসে। যদি বলা হত দিনাজপুরের মুসলিমের উপর আক্রমণ হয়েছে, এবং ফিলিস্তিনের মুসলিমের উপর আক্রমণ হয়েছে। তখন মুসলিম জাতীয়তাবাদ উঠে আসত এবং আমাদের (দিনাজপুর ও ফিলিস্তিনবাসী উভয়ের প্রতি) আবেগে কোনো তফাত থাকত না, পুরো দুনিয়ার মুসলিমের জন্যই আমাদের আবেগ অভিন্ন হত। কিন্তু যদি রাষ্ট্রে ভাগ করে ফেলা হয় তবে আপন রাষ্ট্রের প্রতি আবেগ আসবে পর রাষ্ট্রের প্রতি আবেগ আসবে না। এটাই হল জাহিলিয়াতের জাতীয়তাবাদ। মুসলিম জাতীয়তাবাদ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্ছল বা দেশ কেন্দ্রিক নয় বরং তা পুরো বিশ্ব কেন্দ্রিক। তাই কবি ইকবাল বলেন,
"চীন ও আরাব হামারা হিন্দুস্তা হামারা
মুসলিম হ্যাঁয় হাম ওয়াতান হ্যাঁয় সারা জাহা হামারা"।জাতীয়তাবাদ আজ আমাদের গ্রাস করেছে। একটি শিশুও আজ শত্রু-মিত্র বাছাই করছে জাতীয়তাবাদের আয়ানায়। এটা একটি জাহিলিয়াত চেতনা। ইতিহাসে এমন অবস্থা ভাবাও কঠিন ছিল।
বুদ্ধি ও চিন্তাভিত্তিক দৈনতা
এটা যেন এমন হল মুত'আ যুদ্ধে মুসলিমরা দেখল সারি সারি অসংখ্য রোমান সেনা উন্নত অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের অশ্বারোহী বর্ম পরিধান করে আছে, তাদের সকলের পুরো দেহ বর্মে ঢাকা, মাথায় রয়েছে হ্যাট, খুরধার চকচকে তালোয়ার, রয়েছে অসংখ্য ঘোড়া, উন্নত উট ও উটের জিন। তাদের কাছে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার আছে, আছে সুন্দর পোশাক। তাদের আমিরের তাবু দেখতে বিশাল অট্টলিকার মতন। এই সব দেখে মুসলিমরা বলছে আমরা কি করে তাদের সাথে পারব? তারাই তো বিশ্ব শাসন করবে আমরা হব পরাভূত। তারা প্রযুক্তি, অর্থনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতি সব কিছুতে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে তাই আমাদের উচিত আমাদের অর্থনীতি, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তি উন্নত করা তাহলে আমরা অবশ্যই বিশ্ব শাসন করতে পারব। আমরা অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজে যাব তাদের থেকে শিক্ষা নিব, আমাদের সামাজিক কালচার তাদের মত গড়ব তাদের মত সভ্য হব এভাবে একদিন নিশ্চয় আমরা তাদেরকে পরাস্ত করতে পারব।
দুঃখজনক হলেও সাহাবাগন এমন ভাবেন নি তারা কখনো বিপদে পড়লে কুর'আন ও সুন্নাহর সাহায্যে উপায় খুজতেন। কিন্তু আজ আমাদের তথাকথিত অধিকাংশ ইসলামি চিন্তাবিদগণ কুর'আন সুন্নাহ ভুলে ক্যামব্রিজ অক্সফোর্ডের মাধ্যমে উপায় খুজেন। তারা বলেন আমরা জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, সামাজিকতায়, অর্থনীতিতে পশ্চিমাদের থেকে পিছিয়ে আছি তাই আমরা আমাদের অবস্থান হাড়িয়েছি। তারা এটা বুঝে না আমরা কুর'আন ও সুন্নাহ থেকে দূরে যাওয়ার ফলেই আজ আমাদের এই দশা। তারা বলে আমাদেরকে উন্নত হতে হবে, তাদের সাথে খাপ খাওয়াতে হবে ব্যাংক হয়েছে তো এর বিরোধিতা না করে ইসলামিক ব্যাংক বানাতে হবে। গণতন্ত্রের বিপরিতে ইসলামিক গণতন্ত্র। বামীর স্থলে ইসলামিক বামী, হারাম মদের স্থলে হালাল মদ। আমাদের নারীরাও পিছিয়ে নেই তাই সবাইকে ঘর থেকে বের করে অফিসে নিতে হবে। দাঁড়ি অসভ্যের প্রতিক তাই সভ্য হওয়ার জন্য দাঁড়িকে ছোট করলে প্রবলেম নেই। ইসলাম বেশ স্ট্রিক্ট তাই একে শান্তি শান্তি শান্তি বলে প্রচার করতে হবে। সভ্য হতে হলে ইংলিশ শিখতে হবে, পূর্বের মুসলিমগণ মাতৃভাষা বাদে এরাবিক শিখতেন আর এখন আমরা ইংলিশ শিখি। আর অবাক করা বিষয় হল, মুসলিমরাই ইংলিশ শিখতে সবচেয়ে বেশি তৎপর অন্য দেশ বা জাতি গুলো যেমন চাইনিজ, জাপানিজ, স্প্যানিশ, ড্যানিস, জার্মান, রাশান ইত্যাদি ইংলিশ শিখতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। কনসারভেটিজম বা মডারনিজম আগে ছিল না। কোনো এমন শাইখ ছিল না যারা ইসলামের সাথে অন্য ধর্মের সহাবস্থান মেনে নিতেন। ইসলামকে কাটছাঁট করার প্রজন্ম কোনো কালেই ছিল না।মডারেট শ্রেণীর মেজরিটি মুসলিম শিরকি নিজামকেই খিলাফাত মনে করে। ভোট পেয়ে জয়ী হওয়া, সেকুলারের শপথ গ্রহণকারীদের নব্য খলিফা মনে করে। এদের খলিফা হল ব্যক্তিজীবনে ধর্ম মাননে ওয়ালা মুসলিম। রাষ্ট্রসহ সর্বক্ষেত্রে ইসলাম বাস্তবায়ন বিষয়ে তারা কিছু জানে না। এরা ফুটবল খেলায় গোল দিয়ে সিজদা করা মুসলিমদের দেখে ভাবে ইসলাম জিন্দা হচ্ছে। কাকে কি স্থান দেয়া হচ্ছে খবর নেই। এরা ক্ষমতাই আসা মানে শুধু এটাই হল যে তাদের স্থলে আরো খারাপ, আরো মন্দ আরো সেকুলার, আরো মডারনিস্ট, আরো আমেরিকা-ন্যাটো-রাশিয়ার পা চাটা গোলামরা আসে নাই। উল্লেখ্য এখানে তাদের মধ্যে পার্থক্য হল শুধু ‘আরো’ শব্দটি। গনতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র ইত্যাদি ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক। যদিও সেকুলার ইসলামের সাথে কাটছাঁট করে ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া বানিয়েছে। আরও বানিয়েছে ইসলামিক রিপাবলিক অফ ইরান। এটা হল চরম পর্যায়ে বুদ্ধিভিত্তিক পরাজয়। আল্লাহ পানাহ।
একাল ও সেকাল
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পরে মুসলিমরা এক বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছিল কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না তখন উম্মাহর এমন এক জামায়াত দুনিয়াতে অবস্থান করছিল, যারা যে কোনো বিপদ ও ফিতনাকে কেটে ফেলতে পারতেন। তাদের এক এক জনকে আল্লাহ এতটা মজবুত ঈমান দিয়েছিলেন যে, ঈমানের নূর হয়ে পুরো দুনিয়াকে আলোকিত করার জন্য তারা যথেষ্ট ছিলেন। এর পরের জামায়াত ছিল তাবেই ও তাবে তাবেঈ’র। এই সময়ের কারবালা ও হাররার ঘটনা ঘটে। হযরত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুকে কতল করা হয়। পরের বছরে মদিনায় লুটপাত, ১০ হাজার মুসলিমকে হত্যা ও হাজারো মুসলিম নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছিল। এর পরে ইয়াজিদের মৃত্যু হল। মৃত্যুর খবর পেয়ে- আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু ইয়াযিদের সৈন্যদের বলেন, “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ‘তাগূত’-কে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” ইয়াজিদের প্রতি সাহাবী তাগূত শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যদি আজকের যুগে তারা থাকতেন তাহলে দেখতেন মুসলিম নামধারী অসংখ্য প্রকৃত ‘তাগূত’ শাসকের আসনে আসিন রয়েছে। এরপর এল ক্রুসেড ও তাতারি ফিতনা তারা কোটি মুসলিমকে হত্যা করেছিল, সাময়িক ভাবে মুসলিমরা হতাশ হয়ে গিয়েছিল। মুসলিম হত্যা করে মুসলিমের পরাজয় কখনো হয় নি, বরং মুসলিমের মধ্যে আদর্শিক ভাবে মিথ্যা বিশ্বাস ও চিন্তা ঢুকিয়ে দিলেই তারা পরাজিত হয়। তখন যদি ২০ লক্ষ নিহত হয়ে থাকে, তাহলে বিংশ শতাব্দীতেও কোটি কোটি মুসলিম নিহত হয়েছে। সে কালে খোরাসান, সেন্ট্রাল এশিয়া, শাম, ইরান, মুসলিমদের বেদখল হয়েছিল, আন্দুলুসিয়া মুসলিমদের হাতছাড়া হয়েছিল। আর বিংশ শতাব্দীতে পুরো দুনিয়ার সকল মুসলিম ভূখণ্ড, সকল শহর মুসলিমদের হাতাছাড়া হল। কোলোনিয়াল পুতুল সরকার দিয়ে যুগ যুগ ধরে কাফিরা মুসলিমদের শাসন করতে লাগল। কোনটা বড় পরাজয়? কি করে আমরা বর্তমানকে পূর্বের তাতারী, ক্রুসেড, আন্দুলুসিয়া, মুরতাদি, বা কারবালা ও হাররার ঘটনার সাথে মিলাতে পারি?পরিশেষে.....
এ হল বর্তমান মুসলিম উম্মাহর হাল। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক সহ সকল ক্ষেত্রে আজ মুসলিম উম্মাহ চরম ভাবে পরাজিত, মহাসংকটে, মহা বিপর্যস্ত। কিন্তু আমরা যখন তথাকথিত মুসলিম ও তাদের শুয়ুখদের দিকে তাকাই, তাদের শাসকদের দিকে তাকাই তখন দেখি তারা বেশ আরামে আছেন। তারা উম্মাহর করুণ বাস্তবতা সম্পর্কে বেখবর। এযুগের বাস্তবতা তারা দেখতে পায় না, তারা আত্নিক অন্ধত্বের শিকার। অবশ্যই উম্মাহর পূর্বের বিভিন্ন বিপদ ও সংকট নিয়ে তারা চিন্তা করে, তাহকিক করে, যেমন তাতার ও ক্রুসেডার নিয়ে তাদের গবেষণার অন্ত নেই। ইঞ্জেকশন দিয়ে ফুলানো মোটা গরুর অবস্থা আর এসি রুমে বসা মডারেট শাইখের মুখে বর্তমান মুসলিমদের হাল জানা আমার কাছে একই মনে হয়। তারা এক মিথ্যা ইসলাম ও মিথ্যা মুসলিমের অবস্থা গিলাচ্ছে, বাস্তবতার সাথে যার কোনো সম্পর্ক নেই। অন্যদিকে যারা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝেন তারা তা স্বীকার করতে অপারগ। কি করে আমরা বর্তমান বিপর্যস্ত মুসলিম উম্মাহর অবস্থাকে নজর আন্দাজ করতে পারি? কেন আমরা তাতার ক্রুসেড সংকট নিয়ে চিন্তা করি কিন্তু আজকের মুসলিম উম্মাহর উত্তরণের পথ নিয়ে চিন্তা করছি না? কেন উম্মাহর বেহাল অবস্থার কথা বললে আমাদেরকে অতিতের বিপদ দেখিয়ে বলা হয় এর চেয়ে বড় বড় বিপদ এসেছিল? কেন বলা হয় এখন দুনিয়ার অবস্থা খুব স্বাভাবিক?
এই যামানার উদাহরণ অন্য যামানায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যামানাকে নতুন করে চিনতে হবে, কুর’আনে হাদিসের আলোকে চিনতে হবে, ইতিহাসের পাতায় নয়। চোখ থাকতেও আমরা অন্ধত্বের শিকার হয়েছি। যদি বাস্তবতাকে সঠিক ভাবে না বুঝতে পারি তাহলে কি করে করণীয় নির্ধারণ করব। আমরা সমস্যাকে সমস্যাই মনে করছি না, বিপদকে বিপদ মনে করছি না। যেন জেলের কয়েদী ভুলে গেছে সে একজন কয়েদী, যেন একজন দাস ভাবছে সে স্বাধীন। দাজ্জালী চক্রান্ত এমন ব্রেইন ওয়াস করিয়েছে যে নিজের সঠিক অবস্থানও সনাক্ত করতে পারছে না। অন্ধকার গহ্বরের তলানিতে নিপতিত হয়েও ভাবছে পাহাড়ের চূড়ায় তার অবস্থান। এ যেন দাজ্জালী সভ্যতার নিকট ইসলামি সভ্যতার এক মহাপরাজয়!!
اللَهُمَّ أَرِنَا الاَشْيَاءَ كَمَا هِي*َ،
‘’হে আল্লাহ আমাদের প্রত্যেক জিনিসের আসল রূপ দেখাও যাতে বাহিরটা দেখে প্রতারিত না হই’’
اللهُمَّ أَرِنَا الحَقَّ حَقّاً وَارْزُقْنَا التِبَاعَةَ وَأَرِنَا البَاطِلَ بَاطِلاً وَارْزُقْنَا اجْتِنَابَهُ
“হে আল্লাহ, আমাকে সত্যকে সত্য বুঝার, ও এর ওপর আমল করার তৌফিক দাও এবং মন্দ ও খারাপকে খারাপ করে দেখাও, এর থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দাও।”
Comment