নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পতাকাতলের অশ্বারোহীরা
- হাকিমুল উম্মাহ শাইখ আইমান আয যাওয়াহিরি হাফিজাহুল্লাহ
প্রথম অধ্যায়:
ভেঙ্গে পড়া মূর্তি বনাম উদীয়মান শক্তি
প্রথম পরিচ্ছেদ:
সূচনা
১. মিশরে সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদী আন্দোলনসমূহের বর্তমান পথচলা শুরু হয়েছিল ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৬৫ সালে নাসিরী প্রশাসন যখন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে তাদের কুখ্যাত হামলা চালিয়ে, ইখওয়ানের সত্তুর হাজার সদস্যকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল, এবং সায়্যিদ কুতুব রহ.কে তার দুই সাথীসহ ফাঁসিতে ঝুলানো হয়েছিল। সরকার ধারণা করেছিল, এর মাধ্যমে তারা মিশরে ইসলামের আন্দোলনের কফিনে সর্বশেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন, এ ঘটনাগুলোই মিশরে সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদী আন্দোলনের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হবে।
যদিও ইতিপূর্বে মিশরের ইসলামী আন্দোলন ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের কাজ করেছে, কিন্তু তখন তাদের সাধারণ কর্মপন্থা দেশের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিল না। বরং মৌলিকভাবে এ কর্মকান্ড ছিল বহি:শত্রুর অভিমূখী। জিহাদী আন্দালনের চিন্তা-ভাবনা ও প্রচারণা ছিল যথাসম্ভব দেশের চলমান সরকারপ্রধানের নৈকট্য অর্জন করা এবং তাদেরকে দেশের বৈধ সরকার বলে সম্বোধন করা।
বহি:শত্রু ও তাদের দেশীয় দালালদের মাঝে পার্থক্য করার এই বিপদজনক কৌশল তাদের অনেক ভোগান্তি ও দুর্দশার সম্মুখীন করে। কারণ জিহাদী আন্দোলনের সৈনিকগণ তাদের বুক দিয়ে একদল শত্রুর মোকাবেলা করত, কিন্তু তাদের পিঠকে সেই শত্রুদের দালালদের সামনে উম্মুক্ত রেখে দিত। যেন বুকের রক্ত দিয়ে যাদের সঙ্গে মোকাবেলা করছেন, তাদেরই দালালদের দ্বারা পেছনদিক থেকে আঘাতপ্রাপ্ত হন।
(জামাল) আব্দুন নাসির ও তার সহযোগী কমিউনিজমের বন্ধুরা মিলে শহীদ (আমরা যেমনটা ধারণা করি) উস্তাদ সায়্যিদ কুতুব রহ.এর হত্যায় প্রবৃত্ত হয়। কারণ তিনি ইসলামে তাওহিদের গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলেছিলেন। জোর দিয়ে একথা বলেছিলেন যে, ইসলাম ও তার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ মূলত তাওহিদের আকিদার বিষয়ে যুদ্ধ। শাসনকর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কার হবে সে বিষয়ে যুদ্ধ। আল্লাহর বিধান ও তার শরীয়তের শাসন হবে? নাকি দেশীয় বিধান, প্রথাগত আইন কিংবা ¯স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে মধ্যস্থতার দাবিকারীদের শাসন হবে?
এই দাওয়াহর বিরাট প্রভাব পড়েছিল জিহাদী আন্দোলনের উপর। তাদের শত্রুদের চেনা ও সনাক্ত করার ক্ষেত্রে এবং আভ্যন্তরীণ শত্রুর ভয়াবহতা বহি:শত্রুর চেয়ে কোন অংশে কম নয় - একথা বুঝার ক্ষেত্রে এ দাওয়াহ তাদের সহায়ক হয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে এরা সেই বহি:শত্রু ও গোপন শত্রুদের খেলার গুটি, যারা আড়ালে থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য হামলা পরিচালনা করছে।
সায়্যিদ কুতুব রহ. এর আশপাশে জড়ো হওয়া দলটি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হবে চলমান সরকার। কারণ তারা ইসলামের সাথে শত্রুতাকারী, আল্লাহর দ্বীন থেকে বিচ্যুত এবং আল্লাহর শরীয়ত প্রত্যাখ্যানকারী।
এই দলটির পরিকল্পনা ছিল ব্যাপক। কোন সরকার পরিবর্তন করা বা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটানো তাদের লক্ষ্য ছিল না। তবে যখন সরকার নিজ থেকে মুসলমানদের উপর কোন ন্যাক্কারজনক হামলা চালাত, তখন শুধু আত্মরক্ষা, প্রতিরোধ বা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তারা সরকারের উপর হামলা করতেন।
কিন্তু এই কর্মপন্থার বস্তুগত শক্তি থেকে মনস্তাত্ত্বিক তাৎপর্যটাই ছিল বড়। এর স্পষ্ট অর্থ ছিল এই যে, ইসলামী আন্দোলনের প্রাথমিক নীতিমালা ও গঠনতন্ত্র যদিও একথার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল যে, ইসলামের শত্রু হল শুধু দেশের বাইরের শত্রুরা- যা তাদের কোন কোন সদস্য এখনো মুখে আওড়িয়ে থাকে- কিন্তু এখন তারা ইসলামের শত্রু হিসাবে দেশের সরকারের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ শুরু করেছে।
নাসিরী প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদিও সায়্যিদ কুতুব রহ. এর দলটির উপর আক্রমণ হয়েছে এবং তার সদস্যদের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছে, কিন্তু এতদ্বসত্ত্বেও মুসলিম যুবকদের মাঝে এই দলটির যে বিরাট প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, তার মোকাবেলা করতে এ সব সরকারি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সায়্যিদ কুতুব রহ. এর বিশুদ্ধ তাওহিদের দাওয়াত, আল্লাহর নেতৃত্ব ও ঐশী বিধানের শাসনের নিকট নিরঙ্কুশ আত্মসমর্পণের দাওয়াত অতীতে ও বর্তমানে অব্যাহতভাবে বহির্দেশীয় ও আভ্যন্তরীণ ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে ইসলামী আন্দোলনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে প্রজ্জলিত করছে এবং এখনো তার রক্তাক্ত পর্বগুলো প্রতিদিন নব যৌবন লাভ করছে।
এঈ ইসলামী আন্দোলন প্রতিনিয়ত বিশ্বাসের অবিচলতা, সঠিক কর্মপন্থার নির্ধারণের যোগ্যতা, যুদ্ধের চিরন্তন বৈশিষ্ট্যের উপলব্ধি এবং এই দুর্গম পথ, তথা নবী, রাসূল ও তাদের অনুসারীদের পথের নানা জটিলতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করেই চলেছে। যতক্ষণ না মহান আল্লাহ তা’আলা দুনিয়া ও তার সকল অধিবাসীদের একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী হন।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশেষ করে মিশরে এবং সাধারণভাবে সমস্ত আরব ও মুসলিম দেশসমূহে মুসলিম যুবকদেরকে জিহাদমূখী করে তোলার ক্ষেত্রে উস্তাদ সায়্যিদ কুতুব রহ. এর রচিত এই পথের বিরাট ভূমিকা রয়েছে।
সায়্যিদ কুতুব রহ.কে ফাঁসিতে দেওয়ার মাধ্যমে তার বাণীগুলো সেই বিস্তৃতি লাভ করেছে, যা অন্য অনেক বাণীই লাভ করতে পারেনি। যে বাণীগুলো বক্তার রক্তের কালিতে লেখা হয়েছে, তা মুসলিম যুবকদের অন্তরে এক গৌরবময় দীর্ঘ পথের নিদর্শন হয়ে আছে। আর মুসলিম যুবকদের সামনে সায়্যিদ কুতুব রহ.এর তাওহিদের দাওয়াতের উপর নাসিরী প্রশাসন ও তার কমিউনিষ্ট মিত্রদের অত্যাচারের বীভৎসতার সীমাও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
সায়্যিদ কুতুব রহ. বলতেন:
“যেকোন কথাই অন্যদের অন্তরে প্রবেশ করে অন্তরকে নাড়া দিতে, তাতে বদ্ধমূল হতে এবং তাকে কাজের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে পারে না। তা পারে কেবল সেই কথাই, যা রক্তের ফোটা দিয়ে লেখা হয়। কারণ এমন কথাই মানুষের জীবন্ত হৃদয়ের জন্য খোরাক হয়। যে কথা মানুষের হৃদয়ের খোরাক যোগায়, সেকথাই পৃথিবীতে অমর হয়ে বেচে থাকে। পক্ষান্তরে যে কথা মুখের মধ্যে জন্ম নেয় আর যবান তা বাইরে ছুড়ে ফেলে, তার সাথে জীবন্ত ঐশী উৎস মিলিত হয় না, তা মৃত অবস্থায়ই জন্ম নেয়। তা মানবতাকে এক বিঘতও উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারে না। কেউ তা গ্রহণ করে না। কারণ জন্মেছেই মৃত অবস্থায়। আর মানুষ মৃত বস্তুকে গ্রহণ করে না।”
সায়্যিদ কুতুব রহ. সত্য কথার উপমা এবং সত্যের উপর অটল থাকার আদর্শ পুরুষে পরিণত হয়েছেন। তিনি তাগুতের মুখোমুখি হয়ে সত্য কথা উচ্চারণ করেছেন। এর মূল্য হিসাবে নিজ জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর তার সেই সম্মানজনক অবস্থান তার কথার মূল্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে, যখন তিনি জামাল আব্দুন নাসিরের কাছে ক্ষমার আবেদন করতে অস্বীকার করেছিলেন।
তিনি বলেছেন:
“যে শাহাদাত আঙ্গুল নামাযে আল্লাহর একত্ববাদের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়, তা তাগুতের শাসনকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি অক্ষর লিখতেও রাজি নয়।”
নাসিরী প্রশাসন ধারণা করেছে, সায়্যিদ কুতুব রহ. ও তার সাথীদেরকে হত্যা করার মাধ্যমে এবং ইসলামী আন্দোলনের হাজার হাজার কর্মীকে কারাবন্দী করার দ্বারা ইসলামী আন্দোলনের উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনে ফেলেছে। কিন্তু বাহ্যিক নিরবতার আড়ালে লুকায়িত ছিল সায়্যিদ কুতুব রহ. এর চিন্তা-চেতনা ও দাওয়াতের ব্যাপক কার্যকরী প্রতিক্রিয়া এবং সেই বীজের সূচনা, যা মিশরের বর্তমান জিহাদী আন্দোলনসমূহের ভূমিকা।
এভাবেই অঙ্কুরোদগম হয়েছিল সেই বীজের, যার সাথে এই লেখক নিজেকে সম্পৃক্ত করে।
চলবে ইনশা আল্লাহ...
Comment