চট্টগ্রাম বিশ্বের সু-প্রাচীন জনপদ সমূহের একটি হিসেবে ঐতিহাসিক ও ভৌগলিকভাবে প্রমাণিত ও স্বীকৃত। এটা বাংলার বাবুল ইসলাম বা ইসলামের প্রবেশ দ্বার হিসাবে খ্যাত। এখানে তিন দিক দিয়ে ইসলামের আগমন ঘটে। প্রথমত: আরব বণিকগণের মাধ্যমে, দ্বিতীয়ত: "দরবেশ- আউলিয়া" তথা মুজাহিদ, দ্বীনের দায়ীদের মাধ্যমে, তৃতীয়ত: বিজেতাদের মাধ্যমে, এখানে উল্লেখিত তিনটি বিষয়ে সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।
আরব বণিকগণ :
আরব ছিলো খাদ্য ঘাটতির দেশ, তাদের বাধ্য হয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে হতো। স্বয়ং রাসূল (সা)ও নিজেই এ রকম বেশ কয়েকটি কাফেলায় শরীক ছিলেন। তৎকালীন আমদানী রপ্তানী বাণিজ্যে আরবদের জুড়ি ছিলোনা। তাদের গ্রীষ্ম ও শীতকালীন বিদেশ যাত্রার কথা কুরআনে কারীমের সূরা কুরাইশে বর্ণিত হয়েছে। আরব ভূ-খন্ড হচ্ছে একটি উপদ্বীপ। তার তিন দিকের স্থল ভাগের অধিকারী ছিল তৎকালীন দুই বৃহৎ পরাশক্তি রোম ও পারস্য, তাদের উপর দিয়ে বাণিজ্য পরিচালনা আরবদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়ে সামুদ্রিক পথকে বেছে নিতে হয়। উজানের পানিতে কীভাবে জাহাজ চালাতে হয় এবং জোয়ার-ভাটায় জাহাজ চালানোর পদ্ধতি বিশ্ববাসী আরবদের থেকে শিখেছেন।
আরবদের এই নৌ বাণিজ্যের সময় বঙ্গোপসাগরে চট্টগাম বন্দর ছিল খুবই সুবিধাজক প্রোতাশ্রয়। আরবরা এখান থেকে সুগন্ধি ও মসল্লাজাত দ্রব্যাদি আমদানি করে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতো। আরবগণ যেমন তাদের বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে চষে বেড়াতো, ঠিক তেমনি চট্টগ্রামও তৎকালীন যুগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি সম্পন্ন ছিলো। চট্টগ্রামের তৎকালীন যুগে নির্মিত জাহাজ অধ্যাবদি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রামের নাবিকগণও তাদের জাহাজ নিয়ে বহিঃসমুদ্রে গমন করতেন। ফলে আরবদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে।
আরবগণ মিশনারী জাতি। যেখানে যেতেন সেখানে বসতি গড়ে তুলতেন। এইভাবে ঐতিহাসিক দলিল ও দস্তাবেজের মাধ্যমে জানা যায় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) এর আগমনের পূর্বেই চট্টগ্রামে আরব বসতি গড়ে উঠে। এমনকি কর্ণফুলী নদীর নামটিও আরবদের দেয়া। আরবীতে করণফুল অর্থ লবঙ্গ। আরবদের লবঙ্গ ভর্তি একটি জাহাজ এই নদীতে নিমজ্জিত হয়েছিল বলেই এ নদীর নাম কর্ণফুলী। আদম (আ) এর নাজিলের স্থান আর হিন্দের প্রতি আরবদের ঝোঁক বরাবরই ছিল। অধিকন্তু তৎকালীন জাহেলী যুগের আরব কবিদের কবিতায় আল হিন্দের কথা এসেছে। কাব ইবনে যোহায়ের ইবনে আবি সালমা যিনি ছিলেন এক আরব কবি এবং পরবর্তীতে আল্লাহর রাসুল (সা) এর একজন সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অরজন করেন। ইসলাম গ্রহনের পূর্বে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে লিখতেন। পরবর্তীতে তওবা করেন এবং নিজেই ইসলাম গ্রহনের জন্য আল্লাহর রাসুল (সা) এর কাছে আসেন। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহন করলেন সেদিন তাঁর পাঠ করা কবিতাটির কয়েক লাইন ছিল এরকম-
" আমি নিজের হাত অকপটে রেখেছি এমন এক ব্যক্তির হাতে, যার রয়েছে প্রতিশোধ গ্রহনের পূর্ণ শক্তি এবং যার কথাই কিনা সবার উপরে। আমাকে বলা হয়েছিল, তোমার নামে এরূপ অরূপ নালিশ রয়েছে আর তোমাকে করা হবে জিজ্ঞাসাবাদ।অথচ নিশ্চয়ই রাসুল (সা) এমন এক নূর, যে নূর থেকে আলো পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহর তলোয়ার সমুহের মধ্যে একখানা হিন্দুস্তানি তলোয়ার।"
এই কবিতাটি আল্লাহর রাসুল (সা) এর জীবনী আর রাহিকুল মাখতুম সহ আরও অসংখ্য জায়গায় এসেছে। সেই সময়ে হিন্দ তথা হিন্দুস্তান তথা ভারত উপমহাদেশের অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ছিল প্রশংসনীয় যেমন- চন্দন কাঠ, মসলা, সূতী কাপড় ইত্যাদি আরবগণ ক্রয় করে নিয়ে যেতেন। হিন্দের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার সুনামের কথাও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। উপরোল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রমাণাদি হতে বুঝা যায় চট্টগ্রাম ও আরব সম্পর্ক বহু প্রাচীন।
দ্রাবিড়দেরকে এ অঞ্চলের প্রাচীন জাতি হিসেবে ধরা হয়। আর্যরা এ অঞ্চলে আসে আফ্রিকান মিশরিয় এলাকা কিনবা গ্রিক বা পারস্য থেকে। এসে এখানকার দ্রাবিড় ও অন্যান্য আদিবাসিদের মেরে কেটে এখানে বাস করা শুরু করে। এক পর্যায়ে এই আর্য তথা হিন্দু পূনর্জাগরণবাদীদের আশুরিক শক্তির দাপটে জৈন ধর্ম বিলুপ্ত প্রায়, বৌদ্ধদের অবস্থা তথৈবচ। ঠিক এই সময় বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে প্রচারিত হয়েছিল সত্য ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম। প্রখ্যাত গবেষক গোপাল হাওলাদার বলেন, “বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে রুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণদের শাস্তি দেয়ার জন্য দেবতা নিযুক্ত করলেন। আর এ দেবতা হচ্ছে মুসলমান। ড. ইবনে গোলাম সামাদের মতে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগীজরা সর্ব প্রথম বাংলায় আসেন। তারা ১৫১৭ সালে চট্টগ্রামে ঘাটি গড়ে তোলেন। পর্তুগীজদের লেখা থেকে আমরা এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক উপাদান পাই। প্রখ্যাত পর্তুগীজ পর্যটক জোয়াওদ্য বারোজ লিখেছেন “পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে আসার প্রায় একশত বছর পূর্বে একজন সম্ভ্রান্ত আরব যুবক তার একুশ অনুচরসহ দক্ষিণ আরবের এডেন বন্দর থেকে চট্টগ্রামে আসেন। তিনি তার দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে কিছু আরব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, উঁচু গন্তাস্থি বক্র এক নাক এবং উপবৃহত্তকার সংকীর্ণ মুখন্ডল তাছাড়াও অনেকেই আরব উপাধি যেমন শেখ, সৈয়দ ইত্যাদি ধারণ করে। অনেক স্থানের নামের সাথেও আরবী নামের মিল পাওয়া যায়। শোকল বহর, বাকলিয়া, আল করনন ইত্যাদি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর আরবী উপসর্গ বিদ্যমান। বিশেষ করে ক্রিয়া পদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহার আরবী প্রভাবের ফল। বহুকাল আগে বহু সংখ্যক আরবী বণিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতের মালাবা, কালিকট ইত্যাদি এলাকায় আগমনের কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। যেমন বর্ণিত আছে যে, দক্ষিণ ভারতের কেরালার মালাবারের রাজা চেরুমল পেরুমল সিংহাসনে আরোহণের বর্ষপূর্তিতে প্রাসাদের ছাদে উঠলে প্রত্যক্ষ করেন যে, চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত হয়ে দুই টুকরা দুই পাহাড়ে পতিত হয়েছে। বিস্মিত রাজা পরে জানতে পারেন যে, আরবে এক নবীর উদ্ভব হয়েছে। অধিবাসিরা তাঁর মুজিজা দেখতে চাইলে তিনি চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত করে দেখান। রাজা বিবরণ শুনে স্বয়ং আরবে গিয়ে ইসলাম গ্রহন করেন এবং পরবর্তিতে তাঁর নাম হয়- তাজউদ্দিন (রা)। হাদিসের কিতাবে এই সাহাবিকে "মালিকুল হিন্দ" তথা "হিন্দুস্তানের রাজা" বলা হয়েছে । এ সময়ে বহু সংখ্যক আরব মালাবারে গমন করেন। তারা প্রায়শই মালাবারের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট কামরূপ হয়ে চীনের ক্যান্টন বন্দরে যাতায়াত করতেন।
ইতিহাসে থেকে দেখা যায় হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পালতোলা জাহাজে করে এদেশে আসত। ওই সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাত্ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এদেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে। এছাড়া বাররুল হিন্দ (ইন্ডিয়ার ভূখন্ড) বা বরেন্দ্র ভূমির কথা তো সর্বজনবিদিত। ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাক-ভারত ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের ব্যাপকভাবে প্রথম ইতিহাস লেখন মওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাদেশকে ‘বাররিন্দ’ বলেছেন। যা পরে ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘বাররিন্দ্র’ বলার কারণ ছিল এই যে, আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানীন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে অনন্দে নেচে উঠে চিত্কার করে বলত ‘বাররি হিন্দ’ অর্থাত্ হিন্দের মাটি, যা পরবর্তীকাল বাররিন্দ বা বরেন্দ্রতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দীতে ইরানের সম্রাট সাইরাস ( অনেক বলেন ইনি ছিলেন যুলকারনাইন। আল্লাহ আলাম) উপমহাদেশে আর্যদের অন্যতম রাজ্য গান্ধারা জয় করেন। এ সময় তার তাওহীদী জীবন দর্শনের ছটা এ অঞ্চলব্যাপী পরিবাহিত হয়েছিল। যার পরোক্ষ প্রভাব পরবর্তীকালে সংঘটিত ব্রাক্ষণ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা হয়।
সাহাবা (রা) গণের চট্টগ্রাম সফরঃ
মহানবী (সা) এর জীবদ্দশায় ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে সাহাবায়ে কেরামের (রা ) একটি দল হাবশা বা আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি হাবশার বাণিজ্য কেন্দ্রটিকে পূর্ণ মাত্রায় দ্বীন প্রচারে ব্যবহার করতেন। সাহাবী হযরত আবি ওয়াককাস রা. কিছু সংখ্যক মুসলমানদের নিয়ে সম্রাট নাজ্জাশীর দেয়া একটি জাহাজে করে পূর্ব দিকে সমুদ্র পথে বের হন। তার সাথে ছিলেন সাহাবী হযরত কায়স ইবনে হুযাইফা রা. উরওয়া রা. আবু কায়স ইবনে হারিস রা. ও অন্যান্যদের নিয়ে তাঁরা চীনের পথে রওয়ানা হন। হযরত আবি ওয়াককাস রা. হযরত আমেনার (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিতা মাতা) আপন চাচাতো ভাই। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারকগণ চীনে অবতরণ করেন। তাদের নির্মিত কেয়াংটাং মসজিদ এবং মসজিদের অদূরেই হযরত আবি ওয়াককাসের কবর এখনো চীনা মুসলামানদের জিয়ারতগাহ। হযরত আবি ওয়াককাসের এ কাফেলা হাবশা হতে চীন আসতে নয় বছর সময় নেয়। পথিমধ্যে অনেক দেশে জাহাজ নোঙ্গর করে। চট্টগ্রাম নিশ্চয় সেই তালিকা হতে বাদ পড়েনি। কারণ এটা জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ ট্রানজিট রুট। ‘মুসলিম জাহান’ পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৩ খ্রিঃ) আরব দেশ হতে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। তাদের কাথাবার্তা, আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করেন। ড. কে.এন ভট্টশালী আরাকানী রাজাদের ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাত জা তু’এ এর নিম্নরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, “কানরা দজাগীর বংশীয় রাজা সত্য ইঙ্গত চন্দয়ত এর আমলে (৭৮৮-৮১০খ্রিঃ) আরকান উপকূলের রণবী দ্বীপের সংগে সংঘর্ষে কয়েকটি কুল বা বিদেশী জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। রাজা জাহাজের মুসলিম আরোহীদের উদ্ধার করে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এ বর্ণনা থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, যারা আরাকানে গিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয় চট্টগ্রাম হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে রংপুরের লালমনির হাট জেলার মসতের পাড় মৌজায় একটি টিলা খননের সময় একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়। যেখানে কিছু ফলকে স্পষ্ট লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ এবং ৬৯হিজরি লেখা এখানো দেখতে পাওয়া যায়। যারা লালমনির হাটে এসেছিলেন নিশ্চয় তাঁরা বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র পথেই এসেছিলেন। বলা হয়ে থাকে এখানকার মসজিদটি সাহাবি (রা) গণই তৈরি করেছেন। তাঁরা চট্রগ্রাম থেকে রংপুর পর্যন্ত সফর করেন তারপর সিলেট, ভারতের আসাম, মনিপুর হয়ে চীনে প্রবেশ করেন এবং চীনে ইসলামের সুচনা করেন।
আরবগণ দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ি দিয়ে চীনের ক্যান্টন বন্দর, বর্তমান চট্টগ্রাম, প্রাচ্যের জাভা, সূমাত্রা প্রভৃতি বন্দরসমূহে বাণিজ্য করতেন। উপরোক্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে আল্লামা জয়নুদ্দীন তাঁর তুহফাতুল মুজাহেদীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ (সা) এর যুগে চট্টগ্রামে ইসলাম আসে। হযরত শাহ জালাল রহ. সিলেট বিজয়ের সময় যে বুরহানুদ্দীন ছিলেন তিনি এই আরবদেরই বংশধর। প্রখ্যাত গবেষক ড. হাসান জামান রচিত ও বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য’ গ্রন্থে রাসূল (সা) এর যুগে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কথা নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন। মাওলানা আব্দুল হাই লৌক্ষভী স্বীয় গ্রন্থ নুযহাতুল খাওয়াতের ও মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. সহ উপমহাদেশের নামকরা ঐতিহাসিকগণ উপরোক্ত মতের সমর্থনে অনেক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিকদের মাঝে যারা চট্টগ্রামে সাহাবাগণের আগমণের স্বীকৃতি দেননি তাঁরা আবার ঠিক কোন সময়ে এদেশে ইসলাম এসেছে তার ব্যাপারেও সঠিক কোন ধারণা দিতে পারেননি।
"দরবেশ-আওলিয়া" তথা মুজাহিদদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার:
চট্টগ্রামে ইসলামের প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ ও ইসলাম প্রচারে এই আউলিয়া তথা মুজাহিদদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁরা অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারা অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে মানুষের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন এবং তাদের সুন্দর ব্যবহার, চরিত্রের মাধুরতা এতই প্রখর ছিলো যে, তাদের সংস্পর্শে এসে দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার দেশ বলা হয়। ১৩৫৩-১৬৬৬ সালকে চট্টগ্রামের ইতিহাসে বার আউলিয়ার যুগ বলা হয়। যদিও বার আউলিয়া বলা হয়, এ অঞ্চলে অলীগণের সংখ্যা অনেক। চট্টগ্রামে দু’টি বার আউলিয়ার দরগাহ পরিলক্ষিত হয়। একটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাক রোডে, অপরটি আরাকান সড়কে পদুয়াতে। কুমিরায় একটি বার আউলিয়ার গ্রাম আছে। যেখানে পাশাপাশি বারটি সমাধিও দেখা যায়।
ড. আব্দুল করীম পটিয়া থেকে উদ্ধারকৃত ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ৪৪পৃষ্টা ব্যাপী একটি আরবী পান্ডুলিপির কথা তার বইতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেখানকার নামগুলো খুবই অগোছালো। সূঘছড়ীর মাওলানা ইসমাইল কাদেরী (মৃত্যু ১৯২৫) তার কবিতা গ্রন্থ ‘গুলশানে ফরজে আবাদী’তে বারজন অলীর নামোল্লেখ করেছেন। কবি মুহাম্মদ খান তার পুথি সাহিত্যে তাঁর মাতৃকূল পিতৃকূলের পরিচয়ে বারজন আউলিয়ার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে কদল খান গাজী ১১জন মিত্র নিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। মোঘল ঐতিহাসিক শাহাবুদ্দীন তালিশ তাঁর গ্রন্থ ‘ফতিয়ায়ে ইব্রিয়া’তে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। আউলিয়াগণ এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বস্তুত তাঁদের মাধ্যমে এ অঞ্চল আবাদ হয়েছে। ড. শিহাবুল হুদা ‘চট্টগ্রামের দরবেশ ও দরগাহ’ শিরোনামে পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। যাতে চট্টগ্রামের আউলিয়াদের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, ইহা একটি মৌলিক দলিল। চট্টগ্রামে ভৌগলিক অবস্থান ইসলাম প্রচারের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। যাতায়াতের দুর্গমিতার কারণে বিজেতাদের আসতে বিলম্ব হলেও সমুদ্র ও পাহাড় বেষ্টিত অত্যন্ত মনোরম এই ভূখন্ডটি দ্বীনের মুবাল্লিগদের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, বনাঞ্চল আবৃত এই ভূখন্ডটি আওলিয়াদের তথা মুজাহিদদের মাধ্যমেই আবাদ হয়। পরবর্তীতে বিজেতাগণ বিজয়ী বেশে আসলে অলীগণ প্রথমত বিজয়ে তাদের সহায়তা করেন এবং বিজয় পরবর্তী নির্বিঘে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলার কাজ করতেন। এ পর্যায়ে কতিপয় প্রসিদ্ধ "অলী" সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনার আশা রাখিঃ
১. ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলামসহ আরো কতিপয় গবেষক ইরানের বিস্তাম শহরের বায়েজীদের চট্টগ্রামে আগমনের কথা উল্লেখ করলেও এর স্বপক্ষে কোন অকাট্য যুক্তি দাড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২. বদর শাহ : চট্টগ্রামের সর্বাধিক আলোচিত অলি হচ্ছেন বদর উদ্দীন বদরে আলম। মিরাটে তাঁর জন্ম।তিনি সিলেটের হযরত শাহজালালের অনুসংগী ছিলেন। সেখানে তরফের রাজা অচেক নারায়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হাজী খলীলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ১৪৪০ সালে ইন্তেকাল করেন। শাহাবুদ্দীন তালিশ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৩৪০ সালে চট্টগ্রামে আসেন। প্রখ্যাত মূর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৬/৪৭ সালে চট্টগ্রামে আসেন। তিনিও তার সফরনামায় বদরের উল্লেখ করেন। চট্টগ্রাম, বিহার, আরাকানসহ বিভিন্ন স্থানে বদরের মোকাম থাকায় আসলে তিনি কোথায় সমাহিত তা নিয়ে মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বেঙ্গল গেজিটিয়ার ও ড. করীসসহ চট্টগ্রামের গবেষকদের ধারণা তিনি চট্টগ্রামেই সমাহিত। কেননা এ দরগাহের নির্মাণশৈলী সুলতানী আমলের। আরবী তুখরা অক্ষরে লিখা একটি শিলালিপি আছে। চাঁটি জ্বালিয়ে তাঁর জ্বীন-পরী তাড়ানো এবং চেরাগী পাহাড় আবাদ ইত্যাদি চমকপ্রদ অনেক জনশ্রুতি আছে, কিন্তু এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিরুপণ করা খুবই দুস্কর। কেননা তিনি যে সময়ে চট্টগ্রামে আসেন তখন চট্টগ্রাম এত অনাবাদী থাকার কথা নয়।
৩. মোহছেন আউলিয়া : আনোয়ারায় সমাহিত। তিনি বদর শাহের ভাগ্নে ছিলেন।
৪. মোল্লা মিছকীন : ১৫৬১ সালে ইন্তেকাল করেন। পিতার নাম শায়খ ছারদু মোগলী, সিপাহদারপুর আদি নিবাস। তিনি বিয়ে শাদি করেননি। মহসিন কলেজের দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের উপর তাঁর মাজার।
৫. শাহ সূফী আমানত খান : বিহারের অধিবাসী, ১৭৮০/১৭৯৩ সালে চট্টগ্রামে আসেন। জর্জকোর্টে পাখা টানার চাকুরি নেন। ১৮৪৪ সালের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।
৬. শাহ গরীবুল্লাহ : প্রকৃত নাম রূহুল্লাহ।সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোহর ভৃত্য ছিলেন। ভাতৃ সংঘাতে দারা পরাজিত ও বন্দী হলে, তাঁর মালিকের দুর্দশা দেখে তার মন বিগলিত হয়, ফলে সরকারী চাকুরী হতে ইস্তেফা দিয়ে চট্টগ্রামে এসে নাসিরাবাদে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যান। এখানে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চট্টগ্রামের কতিপয় অভিভাবক দরবেশের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিলাম। অথচ চট্টগ্রামের প্রতিটি এলাকায় এরকম হাজারো দরবেশ শুয়ে আছেন যারা দ্বীন প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন।
৭. মুসলমানদের চট্টগ্রাম বিজয় : বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের ১৫০ বছর পর সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি কদল খান গাজী উত্তর চট্টগ্রাম মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
৮. ১৩৫৩ সালে চট্টগ্রাম ইলিয়াছ শাহের অধীনে চলে যায়। এ বংশের সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) চীন সম্রাটের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক করেন।
৯. এ সময়ে কয়েকটি চীনা মিশন চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং বাংলার প্রধান বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সুলতান রুকনুদ্দীন বরবক শাহের সেনাপতি রাস্তি খান হাট হাজারী যোবরা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরাগল খান ও তৎপুত্র নসরত খান সুলতান হোসেন শাহের পক্ষে চট্টগ্রামের থানাধার ছিলেন। মীরসরাই থানার পরাগলপুর ও পরাগল খানের বিরাট দিঘী ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।
১০. হাবশীদের অত্যাচারে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন সংকোচিত হয়। কেবলমাত্র তা উত্তর চট্টগ্রামে সীমাদ্ধ ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায়। নসরত খান ত্রিপুরার কবল হতে চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং চট্টগ্রাম শহরের ৮ মাইল দূরে ফতেয়াবাদ রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে তার নামে নসরত শাহদিঘী (বড় দিঘী) এখনো তার স্মৃতি বহন করছে।
১১. গৌড়ে হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪১৩-১৭) ত্রিপুরায় রাজা ধর্ম মানিক্যের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। ত্রিপুরা রাজ তার রাজ্যসীমা আরাকানের অভ্যন্তর পর্যন্ত নিয়ে যান। ধর্ম মানিক্যের মৃত্যুর পর সমগ্র চট্টগ্রাম এবং আরাকানের উত্তরাংশে হোসেন শাহীর কর্তৃত্ব সু-প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পরাগল খান, আমির্জা খান প্রমুখ চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন।
১২. ১৫২২ সালে মহারাজদেব মানিক্য পুনরায় চট্টগ্রাম দখল করেন। আরাকানিরা এত তাড়াতাড়ি পালালো যে, তারা তাদের অর্থ-সম্পদ নিয়ে যেতে পারেনি, ঐ সকল স্থানে কিছু কিছু চিহ্ন রেখে যায়। পরে যখনই সুযোগ আসতো তারা এসে তা খনন করে নিয়ে যেতো। বর্তমানেও অনেক লোভাতুর মানুষকে তাদের রেখে যাওয়া গুপ্তধন খুঁজতে দেখা যায় এবং এদের প্রতারণার ফাঁদে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে যায়। ত্রিপুরা রাজ দু’বছরও অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। সুলতান নসরত শাহ (১৫১৯-৩৩) ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ফতেয়াবাদ। ১৫১৭ সালে চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের আগমন ঘটে। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনাপতি কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় হয়। ১৫৩৮-৮০ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আরাকানীদের শাসন চলে। কিন্তু এ শাসন কোন ক্রমেই অনুক্রমিক ছিল না। চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজ। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলে ত্রিপুরা রাজ চিরদিনের জন্য চট্টগ্রাম হতে বিতাড়িত হন এবং ১৫৮১-১৬৬৬ সাল পর্যন্ত এখানে আরাকানী শাসন চলে। মোগলগণ বাংলায় শাসন ক্ষমতা আয়ত্বে রাখলেও বার বার চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরিশেষে ভ্রাতৃসংঘাতে পরাজিত শাহ সূজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার তাড়া খেয়ে আরাকানে আশ্রয় নিলে আরাকান রাজ বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সূজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ভ্রাতৃশোকার্ত মর্মাহত আওরঙ্গজেব ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঢাকার মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁকে নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে শায়েস্তা খান স্বীয় পুত্র বুজর্গ উমেদ খানকে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ সেনাসহ আরাকানীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। উমেদ খান আরাকানী ও পর্তুগীজদের দ্বন্দের সুযোগে কৌশলে পর্তুগীজদের দলে ভিড়িয়ে তাঁর নৌশক্তি বৃদ্ধি ঘটান এবং উমেদ খানের নৌ সেনাধ্যক্ষ ইবনে হুসাইন কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানীদের উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেন এবং মোগলদের হাতে আরাকানীদের বিখ্যাত চাঁটিগাঁ দূর্গের (আন্দরকিল্লা) পতন ঘটে। এইভাবে চট্টগ্রামে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সম্রাটের নির্দেশে চট্টগ্রামের নাম রাখলেন ইসলামাবাদ যা ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ফেব্রুয়ারি মীর কাসিম কর্তৃক চট্টগ্রাম ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত অব্যহত ছিল। ১৬৬৬-১৭১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানতঃ হাজারী মনসবদারদের হাতেই চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হতেন। কিন্তু ১৭১০ খ্রিস্টাব্দ হতে ফৌজদারদের পরিবর্তে নায়েবরাই চট্টগ্রাম শাসন করতেন। এর পর আরাকানীরা কয়েকবার চট্টগ্রাম উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
তথ্যসূত্র :
১। সৈয়দ সুলাইমান নদভী : আরবৌঁ কি জাহাজরানী
২। ইবনে খুরদাদবিহ : কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক, পৃ.১৬৫
৩। সুলাইমান ইবনে আহমদ : সিলসিলাতুত তাওয়ারিখ, পৃ.৭৫
৪। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী : মাসিক তরজুমানুল কুরআন।
৫। এ.কে.এম মুহিউদ্দীন : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.২৭-২৮
৬। হামীদুল্লাহ খান : তারীখ-ই-হামীদ-১৮৫৩, কলকাতা
৭। ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলামী ঐতিহ্য
৮। ওহিদুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস
৯।অধ্যাপক খালেদ সম্পাদিত : হাজার বছরের চট্টগ্রাম,
১০।ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.৩৬।
১১। মাহবুবুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস পুরানো আমল, পৃ.৮৭-৮৯
১২। তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন - সুরা কামার এর তাফসির
১৩।সুখময় মুখপধ্যায় : বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, পৃ.৮
১৪।আর-রাহিকুল মাখতুম-সফীউর রহমান আল-মুবারকপূরী
আরব বণিকগণ :
আরব ছিলো খাদ্য ঘাটতির দেশ, তাদের বাধ্য হয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে হতো। স্বয়ং রাসূল (সা)ও নিজেই এ রকম বেশ কয়েকটি কাফেলায় শরীক ছিলেন। তৎকালীন আমদানী রপ্তানী বাণিজ্যে আরবদের জুড়ি ছিলোনা। তাদের গ্রীষ্ম ও শীতকালীন বিদেশ যাত্রার কথা কুরআনে কারীমের সূরা কুরাইশে বর্ণিত হয়েছে। আরব ভূ-খন্ড হচ্ছে একটি উপদ্বীপ। তার তিন দিকের স্থল ভাগের অধিকারী ছিল তৎকালীন দুই বৃহৎ পরাশক্তি রোম ও পারস্য, তাদের উপর দিয়ে বাণিজ্য পরিচালনা আরবদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়ে সামুদ্রিক পথকে বেছে নিতে হয়। উজানের পানিতে কীভাবে জাহাজ চালাতে হয় এবং জোয়ার-ভাটায় জাহাজ চালানোর পদ্ধতি বিশ্ববাসী আরবদের থেকে শিখেছেন।
আরবদের এই নৌ বাণিজ্যের সময় বঙ্গোপসাগরে চট্টগাম বন্দর ছিল খুবই সুবিধাজক প্রোতাশ্রয়। আরবরা এখান থেকে সুগন্ধি ও মসল্লাজাত দ্রব্যাদি আমদানি করে ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতো। আরবগণ যেমন তাদের বাণিজ্য জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে চষে বেড়াতো, ঠিক তেমনি চট্টগ্রামও তৎকালীন যুগে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বিশ্ব জুড়ে খ্যাতি সম্পন্ন ছিলো। চট্টগ্রামের তৎকালীন যুগে নির্মিত জাহাজ অধ্যাবদি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। চট্টগ্রামের নাবিকগণও তাদের জাহাজ নিয়ে বহিঃসমুদ্রে গমন করতেন। ফলে আরবদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে।
আরবগণ মিশনারী জাতি। যেখানে যেতেন সেখানে বসতি গড়ে তুলতেন। এইভাবে ঐতিহাসিক দলিল ও দস্তাবেজের মাধ্যমে জানা যায় যে, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) এর আগমনের পূর্বেই চট্টগ্রামে আরব বসতি গড়ে উঠে। এমনকি কর্ণফুলী নদীর নামটিও আরবদের দেয়া। আরবীতে করণফুল অর্থ লবঙ্গ। আরবদের লবঙ্গ ভর্তি একটি জাহাজ এই নদীতে নিমজ্জিত হয়েছিল বলেই এ নদীর নাম কর্ণফুলী। আদম (আ) এর নাজিলের স্থান আর হিন্দের প্রতি আরবদের ঝোঁক বরাবরই ছিল। অধিকন্তু তৎকালীন জাহেলী যুগের আরব কবিদের কবিতায় আল হিন্দের কথা এসেছে। কাব ইবনে যোহায়ের ইবনে আবি সালমা যিনি ছিলেন এক আরব কবি এবং পরবর্তীতে আল্লাহর রাসুল (সা) এর একজন সাহাবি হওয়ার সৌভাগ্য অরজন করেন। ইসলাম গ্রহনের পূর্বে তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে লিখতেন। পরবর্তীতে তওবা করেন এবং নিজেই ইসলাম গ্রহনের জন্য আল্লাহর রাসুল (সা) এর কাছে আসেন। যেদিন তিনি ইসলাম গ্রহন করলেন সেদিন তাঁর পাঠ করা কবিতাটির কয়েক লাইন ছিল এরকম-
" আমি নিজের হাত অকপটে রেখেছি এমন এক ব্যক্তির হাতে, যার রয়েছে প্রতিশোধ গ্রহনের পূর্ণ শক্তি এবং যার কথাই কিনা সবার উপরে। আমাকে বলা হয়েছিল, তোমার নামে এরূপ অরূপ নালিশ রয়েছে আর তোমাকে করা হবে জিজ্ঞাসাবাদ।অথচ নিশ্চয়ই রাসুল (সা) এমন এক নূর, যে নূর থেকে আলো পাওয়া যায়। তিনি আল্লাহর তলোয়ার সমুহের মধ্যে একখানা হিন্দুস্তানি তলোয়ার।"
এই কবিতাটি আল্লাহর রাসুল (সা) এর জীবনী আর রাহিকুল মাখতুম সহ আরও অসংখ্য জায়গায় এসেছে। সেই সময়ে হিন্দ তথা হিন্দুস্তান তথা ভারত উপমহাদেশের অনেক প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ছিল প্রশংসনীয় যেমন- চন্দন কাঠ, মসলা, সূতী কাপড় ইত্যাদি আরবগণ ক্রয় করে নিয়ে যেতেন। হিন্দের প্রাচীন চিকিৎসা ব্যবস্থার সুনামের কথাও ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। উপরোল্লেখিত ঐতিহাসিক প্রমাণাদি হতে বুঝা যায় চট্টগ্রাম ও আরব সম্পর্ক বহু প্রাচীন।
দ্রাবিড়দেরকে এ অঞ্চলের প্রাচীন জাতি হিসেবে ধরা হয়। আর্যরা এ অঞ্চলে আসে আফ্রিকান মিশরিয় এলাকা কিনবা গ্রিক বা পারস্য থেকে। এসে এখানকার দ্রাবিড় ও অন্যান্য আদিবাসিদের মেরে কেটে এখানে বাস করা শুরু করে। এক পর্যায়ে এই আর্য তথা হিন্দু পূনর্জাগরণবাদীদের আশুরিক শক্তির দাপটে জৈন ধর্ম বিলুপ্ত প্রায়, বৌদ্ধদের অবস্থা তথৈবচ। ঠিক এই সময় বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে প্রচারিত হয়েছিল সত্য ও সাম্যের ধর্ম ইসলাম। প্রখ্যাত গবেষক গোপাল হাওলাদার বলেন, “বৌদ্ধদের উপর ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে রুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণদের শাস্তি দেয়ার জন্য দেবতা নিযুক্ত করলেন। আর এ দেবতা হচ্ছে মুসলমান। ড. ইবনে গোলাম সামাদের মতে ইউরোপীয় বণিকদের মধ্যে পর্তুগীজরা সর্ব প্রথম বাংলায় আসেন। তারা ১৫১৭ সালে চট্টগ্রামে ঘাটি গড়ে তোলেন। পর্তুগীজদের লেখা থেকে আমরা এ দেশের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক উপাদান পাই। প্রখ্যাত পর্তুগীজ পর্যটক জোয়াওদ্য বারোজ লিখেছেন “পর্তুগীজদের চট্টগ্রামে আসার প্রায় একশত বছর পূর্বে একজন সম্ভ্রান্ত আরব যুবক তার একুশ অনুচরসহ দক্ষিণ আরবের এডেন বন্দর থেকে চট্টগ্রামে আসেন। তিনি তার দীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। চট্টগ্রামের মুসলমানদের মধ্যে কিছু আরব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন, উঁচু গন্তাস্থি বক্র এক নাক এবং উপবৃহত্তকার সংকীর্ণ মুখন্ডল তাছাড়াও অনেকেই আরব উপাধি যেমন শেখ, সৈয়দ ইত্যাদি ধারণ করে। অনেক স্থানের নামের সাথেও আরবী নামের মিল পাওয়া যায়। শোকল বহর, বাকলিয়া, আল করনন ইত্যাদি, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় প্রচুর আরবী উপসর্গ বিদ্যমান। বিশেষ করে ক্রিয়া পদের পূর্বে ‘না’ সূচক শব্দ ব্যবহার আরবী প্রভাবের ফল। বহুকাল আগে বহু সংখ্যক আরবী বণিক ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতের মালাবা, কালিকট ইত্যাদি এলাকায় আগমনের কথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। যেমন বর্ণিত আছে যে, দক্ষিণ ভারতের কেরালার মালাবারের রাজা চেরুমল পেরুমল সিংহাসনে আরোহণের বর্ষপূর্তিতে প্রাসাদের ছাদে উঠলে প্রত্যক্ষ করেন যে, চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত হয়ে দুই টুকরা দুই পাহাড়ে পতিত হয়েছে। বিস্মিত রাজা পরে জানতে পারেন যে, আরবে এক নবীর উদ্ভব হয়েছে। অধিবাসিরা তাঁর মুজিজা দেখতে চাইলে তিনি চন্দ্র দ্বি-খন্ডিত করে দেখান। রাজা বিবরণ শুনে স্বয়ং আরবে গিয়ে ইসলাম গ্রহন করেন এবং পরবর্তিতে তাঁর নাম হয়- তাজউদ্দিন (রা)। হাদিসের কিতাবে এই সাহাবিকে "মালিকুল হিন্দ" তথা "হিন্দুস্তানের রাজা" বলা হয়েছে । এ সময়ে বহু সংখ্যক আরব মালাবারে গমন করেন। তারা প্রায়শই মালাবারের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম এবং সেখান থেকে সিলেট কামরূপ হয়ে চীনের ক্যান্টন বন্দরে যাতায়াত করতেন।
ইতিহাসে থেকে দেখা যায় হজরত ঈসার (আ.) জন্মের কয়েক হাজার বছর আগেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পালতোলা জাহাজে করে এদেশে আসত। ওই সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণকৃত শহর সাবাউর (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাত্ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এদেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে। এছাড়া বাররুল হিন্দ (ইন্ডিয়ার ভূখন্ড) বা বরেন্দ্র ভূমির কথা তো সর্বজনবিদিত। ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পাক-ভারত ও বাংলাদেশ উপমহাদেশের ব্যাপকভাবে প্রথম ইতিহাস লেখন মওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাদেশকে ‘বাররিন্দ’ বলেছেন। যা পরে ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘বাররিন্দ্র’ বলার কারণ ছিল এই যে, আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানীন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে অনন্দে নেচে উঠে চিত্কার করে বলত ‘বাররি হিন্দ’ অর্থাত্ হিন্দের মাটি, যা পরবর্তীকাল বাররিন্দ বা বরেন্দ্রতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দীতে ইরানের সম্রাট সাইরাস ( অনেক বলেন ইনি ছিলেন যুলকারনাইন। আল্লাহ আলাম) উপমহাদেশে আর্যদের অন্যতম রাজ্য গান্ধারা জয় করেন। এ সময় তার তাওহীদী জীবন দর্শনের ছটা এ অঞ্চলব্যাপী পরিবাহিত হয়েছিল। যার পরোক্ষ প্রভাব পরবর্তীকালে সংঘটিত ব্রাক্ষণ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল বলে ধারণা করা হয়।
সাহাবা (রা) গণের চট্টগ্রাম সফরঃ
মহানবী (সা) এর জীবদ্দশায় ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে সাহাবায়ে কেরামের (রা ) একটি দল হাবশা বা আবিসিনিয়ায় পাঠিয়ে ছিলেন। তিনি হাবশার বাণিজ্য কেন্দ্রটিকে পূর্ণ মাত্রায় দ্বীন প্রচারে ব্যবহার করতেন। সাহাবী হযরত আবি ওয়াককাস রা. কিছু সংখ্যক মুসলমানদের নিয়ে সম্রাট নাজ্জাশীর দেয়া একটি জাহাজে করে পূর্ব দিকে সমুদ্র পথে বের হন। তার সাথে ছিলেন সাহাবী হযরত কায়স ইবনে হুযাইফা রা. উরওয়া রা. আবু কায়স ইবনে হারিস রা. ও অন্যান্যদের নিয়ে তাঁরা চীনের পথে রওয়ানা হন। হযরত আবি ওয়াককাস রা. হযরত আমেনার (মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মানিতা মাতা) আপন চাচাতো ভাই। ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারকগণ চীনে অবতরণ করেন। তাদের নির্মিত কেয়াংটাং মসজিদ এবং মসজিদের অদূরেই হযরত আবি ওয়াককাসের কবর এখনো চীনা মুসলামানদের জিয়ারতগাহ। হযরত আবি ওয়াককাসের এ কাফেলা হাবশা হতে চীন আসতে নয় বছর সময় নেয়। পথিমধ্যে অনেক দেশে জাহাজ নোঙ্গর করে। চট্টগ্রাম নিশ্চয় সেই তালিকা হতে বাদ পড়েনি। কারণ এটা জাহাজ চলাচলের জন্য নিরাপদ ট্রানজিট রুট। ‘মুসলিম জাহান’ পুস্তকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে (৬০৬-৬৪৩ খ্রিঃ) আরব দেশ হতে একটি ছোট্ট প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে আসেন। তাদের কাথাবার্তা, আচার-আচরণে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ ব্যাপকহারে ইসলাম গ্রহণ করেন। ড. কে.এন ভট্টশালী আরাকানী রাজাদের ইতিহাস গ্রন্থ ‘রাত জা তু’এ এর নিম্নরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, “কানরা দজাগীর বংশীয় রাজা সত্য ইঙ্গত চন্দয়ত এর আমলে (৭৮৮-৮১০খ্রিঃ) আরকান উপকূলের রণবী দ্বীপের সংগে সংঘর্ষে কয়েকটি কুল বা বিদেশী জাহাজ বিধ্বস্ত হয়। রাজা জাহাজের মুসলিম আরোহীদের উদ্ধার করে বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এ বর্ণনা থেকেও প্রতীয়মান হয় যে, যারা আরাকানে গিয়েছিলেন তাঁরা নিশ্চয় চট্টগ্রাম হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে রংপুরের লালমনির হাট জেলার মসতের পাড় মৌজায় একটি টিলা খননের সময় একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়। যেখানে কিছু ফলকে স্পষ্ট লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ এবং ৬৯হিজরি লেখা এখানো দেখতে পাওয়া যায়। যারা লালমনির হাটে এসেছিলেন নিশ্চয় তাঁরা বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র পথেই এসেছিলেন। বলা হয়ে থাকে এখানকার মসজিদটি সাহাবি (রা) গণই তৈরি করেছেন। তাঁরা চট্রগ্রাম থেকে রংপুর পর্যন্ত সফর করেন তারপর সিলেট, ভারতের আসাম, মনিপুর হয়ে চীনে প্রবেশ করেন এবং চীনে ইসলামের সুচনা করেন।
আরবগণ দক্ষিণ চীন সাগর পাড়ি দিয়ে চীনের ক্যান্টন বন্দর, বর্তমান চট্টগ্রাম, প্রাচ্যের জাভা, সূমাত্রা প্রভৃতি বন্দরসমূহে বাণিজ্য করতেন। উপরোক্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে আল্লামা জয়নুদ্দীন তাঁর তুহফাতুল মুজাহেদীন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ (সা) এর যুগে চট্টগ্রামে ইসলাম আসে। হযরত শাহ জালাল রহ. সিলেট বিজয়ের সময় যে বুরহানুদ্দীন ছিলেন তিনি এই আরবদেরই বংশধর। প্রখ্যাত গবেষক ড. হাসান জামান রচিত ও বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য’ গ্রন্থে রাসূল (সা) এর যুগে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কথা নির্দ্বিধায় উল্লেখ করেছেন। মাওলানা আব্দুল হাই লৌক্ষভী স্বীয় গ্রন্থ নুযহাতুল খাওয়াতের ও মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. সহ উপমহাদেশের নামকরা ঐতিহাসিকগণ উপরোক্ত মতের সমর্থনে অনেক তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করেছেন। চট্টগ্রামের ঐতিহাসিকদের মাঝে যারা চট্টগ্রামে সাহাবাগণের আগমণের স্বীকৃতি দেননি তাঁরা আবার ঠিক কোন সময়ে এদেশে ইসলাম এসেছে তার ব্যাপারেও সঠিক কোন ধারণা দিতে পারেননি।
"দরবেশ-আওলিয়া" তথা মুজাহিদদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার:
চট্টগ্রামে ইসলামের প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মাণ ও ইসলাম প্রচারে এই আউলিয়া তথা মুজাহিদদের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁরা অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তারা অত্যন্ত সাদাসিধেভাবে মানুষের কাছে ইসলাম প্রচার করতেন এবং তাদের সুন্দর ব্যবহার, চরিত্রের মাধুরতা এতই প্রখর ছিলো যে, তাদের সংস্পর্শে এসে দলে দলে লোক ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। চট্টগ্রামকে বার আউলিয়ার দেশ বলা হয়। ১৩৫৩-১৬৬৬ সালকে চট্টগ্রামের ইতিহাসে বার আউলিয়ার যুগ বলা হয়। যদিও বার আউলিয়া বলা হয়, এ অঞ্চলে অলীগণের সংখ্যা অনেক। চট্টগ্রামে দু’টি বার আউলিয়ার দরগাহ পরিলক্ষিত হয়। একটি ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাক রোডে, অপরটি আরাকান সড়কে পদুয়াতে। কুমিরায় একটি বার আউলিয়ার গ্রাম আছে। যেখানে পাশাপাশি বারটি সমাধিও দেখা যায়।
ড. আব্দুল করীম পটিয়া থেকে উদ্ধারকৃত ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ৪৪পৃষ্টা ব্যাপী একটি আরবী পান্ডুলিপির কথা তার বইতে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেখানকার নামগুলো খুবই অগোছালো। সূঘছড়ীর মাওলানা ইসমাইল কাদেরী (মৃত্যু ১৯২৫) তার কবিতা গ্রন্থ ‘গুলশানে ফরজে আবাদী’তে বারজন অলীর নামোল্লেখ করেছেন। কবি মুহাম্মদ খান তার পুথি সাহিত্যে তাঁর মাতৃকূল পিতৃকূলের পরিচয়ে বারজন আউলিয়ার বিবরণ দিয়েছেন। তাঁর মতে কদল খান গাজী ১১জন মিত্র নিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। মোঘল ঐতিহাসিক শাহাবুদ্দীন তালিশ তাঁর গ্রন্থ ‘ফতিয়ায়ে ইব্রিয়া’তে অনুরূপ মত প্রকাশ করেছেন। আউলিয়াগণ এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বস্তুত তাঁদের মাধ্যমে এ অঞ্চল আবাদ হয়েছে। ড. শিহাবুল হুদা ‘চট্টগ্রামের দরবেশ ও দরগাহ’ শিরোনামে পি.এইচ.ডি অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। যাতে চট্টগ্রামের আউলিয়াদের বিস্তারিত বিবরণ এসেছে, ইহা একটি মৌলিক দলিল। চট্টগ্রামে ভৌগলিক অবস্থান ইসলাম প্রচারের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। যাতায়াতের দুর্গমিতার কারণে বিজেতাদের আসতে বিলম্ব হলেও সমুদ্র ও পাহাড় বেষ্টিত অত্যন্ত মনোরম এই ভূখন্ডটি দ্বীনের মুবাল্লিগদের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে, বনাঞ্চল আবৃত এই ভূখন্ডটি আওলিয়াদের তথা মুজাহিদদের মাধ্যমেই আবাদ হয়। পরবর্তীতে বিজেতাগণ বিজয়ী বেশে আসলে অলীগণ প্রথমত বিজয়ে তাদের সহায়তা করেন এবং বিজয় পরবর্তী নির্বিঘে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠানাদি গড়ে তোলার কাজ করতেন। এ পর্যায়ে কতিপয় প্রসিদ্ধ "অলী" সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনার আশা রাখিঃ
১. ইনসাইক্লোপেডিয়া অব ইসলামসহ আরো কতিপয় গবেষক ইরানের বিস্তাম শহরের বায়েজীদের চট্টগ্রামে আগমনের কথা উল্লেখ করলেও এর স্বপক্ষে কোন অকাট্য যুক্তি দাড় করাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
২. বদর শাহ : চট্টগ্রামের সর্বাধিক আলোচিত অলি হচ্ছেন বদর উদ্দীন বদরে আলম। মিরাটে তাঁর জন্ম।তিনি সিলেটের হযরত শাহজালালের অনুসংগী ছিলেন। সেখানে তরফের রাজা অচেক নারায়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। হাজী খলীলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার করেন। তিনি ১৪৪০ সালে ইন্তেকাল করেন। শাহাবুদ্দীন তালিশ উল্লেখ করেছেন যে, তিনি ১৩৪০ সালে চট্টগ্রামে আসেন। প্রখ্যাত মূর পর্যটক ইবনে বতুতা ১৩৪৬/৪৭ সালে চট্টগ্রামে আসেন। তিনিও তার সফরনামায় বদরের উল্লেখ করেন। চট্টগ্রাম, বিহার, আরাকানসহ বিভিন্ন স্থানে বদরের মোকাম থাকায় আসলে তিনি কোথায় সমাহিত তা নিয়ে মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। বেঙ্গল গেজিটিয়ার ও ড. করীসসহ চট্টগ্রামের গবেষকদের ধারণা তিনি চট্টগ্রামেই সমাহিত। কেননা এ দরগাহের নির্মাণশৈলী সুলতানী আমলের। আরবী তুখরা অক্ষরে লিখা একটি শিলালিপি আছে। চাঁটি জ্বালিয়ে তাঁর জ্বীন-পরী তাড়ানো এবং চেরাগী পাহাড় আবাদ ইত্যাদি চমকপ্রদ অনেক জনশ্রুতি আছে, কিন্তু এর ঐতিহাসিক সত্যতা নিরুপণ করা খুবই দুস্কর। কেননা তিনি যে সময়ে চট্টগ্রামে আসেন তখন চট্টগ্রাম এত অনাবাদী থাকার কথা নয়।
৩. মোহছেন আউলিয়া : আনোয়ারায় সমাহিত। তিনি বদর শাহের ভাগ্নে ছিলেন।
৪. মোল্লা মিছকীন : ১৫৬১ সালে ইন্তেকাল করেন। পিতার নাম শায়খ ছারদু মোগলী, সিপাহদারপুর আদি নিবাস। তিনি বিয়ে শাদি করেননি। মহসিন কলেজের দক্ষিণ পাশে পাহাড়ের উপর তাঁর মাজার।
৫. শাহ সূফী আমানত খান : বিহারের অধিবাসী, ১৭৮০/১৭৯৩ সালে চট্টগ্রামে আসেন। জর্জকোর্টে পাখা টানার চাকুরি নেন। ১৮৪৪ সালের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন।
৬. শাহ গরীবুল্লাহ : প্রকৃত নাম রূহুল্লাহ।সম্রাট শাহজাহানের পুত্র দারাশিকোহর ভৃত্য ছিলেন। ভাতৃ সংঘাতে দারা পরাজিত ও বন্দী হলে, তাঁর মালিকের দুর্দশা দেখে তার মন বিগলিত হয়, ফলে সরকারী চাকুরী হতে ইস্তেফা দিয়ে চট্টগ্রামে এসে নাসিরাবাদে খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যান। এখানে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চট্টগ্রামের কতিপয় অভিভাবক দরবেশের সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি দিলাম। অথচ চট্টগ্রামের প্রতিটি এলাকায় এরকম হাজারো দরবেশ শুয়ে আছেন যারা দ্বীন প্রচারের জন্য এদেশে এসেছিলেন।
৭. মুসলমানদের চট্টগ্রাম বিজয় : বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গ বিজয়ের ১৫০ বছর পর সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি কদল খান গাজী উত্তর চট্টগ্রাম মুসলিম শাসনাধীনে নিয়ে আসেন।
৮. ১৩৫৩ সালে চট্টগ্রাম ইলিয়াছ শাহের অধীনে চলে যায়। এ বংশের সুলতান গিয়াসুদ্দীন আজম শাহ (১৩৮৯-১৪১০) চীন সম্রাটের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক করেন।
৯. এ সময়ে কয়েকটি চীনা মিশন চট্টগ্রামের ভেতর দিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে এবং বাংলার প্রধান বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সুলতান রুকনুদ্দীন বরবক শাহের সেনাপতি রাস্তি খান হাট হাজারী যোবরা গ্রামে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরাগল খান ও তৎপুত্র নসরত খান সুলতান হোসেন শাহের পক্ষে চট্টগ্রামের থানাধার ছিলেন। মীরসরাই থানার পরাগলপুর ও পরাগল খানের বিরাট দিঘী ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এখনো বিদ্যমান।
১০. হাবশীদের অত্যাচারে এক পর্যায়ে চট্টগ্রামে মুসলিম শাসন সংকোচিত হয়। কেবলমাত্র তা উত্তর চট্টগ্রামে সীমাদ্ধ ছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে যায়। নসরত খান ত্রিপুরার কবল হতে চট্টগ্রামকে মুক্ত করতে সক্ষম হন এবং চট্টগ্রাম শহরের ৮ মাইল দূরে ফতেয়াবাদ রাজধানী স্থাপন করেন। সেখানে তার নামে নসরত শাহদিঘী (বড় দিঘী) এখনো তার স্মৃতি বহন করছে।
১১. গৌড়ে হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪১৩-১৭) ত্রিপুরায় রাজা ধর্ম মানিক্যের সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। ত্রিপুরা রাজ তার রাজ্যসীমা আরাকানের অভ্যন্তর পর্যন্ত নিয়ে যান। ধর্ম মানিক্যের মৃত্যুর পর সমগ্র চট্টগ্রাম এবং আরাকানের উত্তরাংশে হোসেন শাহীর কর্তৃত্ব সু-প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন পরাগল খান, আমির্জা খান প্রমুখ চট্টগ্রামের শাসক ছিলেন।
১২. ১৫২২ সালে মহারাজদেব মানিক্য পুনরায় চট্টগ্রাম দখল করেন। আরাকানিরা এত তাড়াতাড়ি পালালো যে, তারা তাদের অর্থ-সম্পদ নিয়ে যেতে পারেনি, ঐ সকল স্থানে কিছু কিছু চিহ্ন রেখে যায়। পরে যখনই সুযোগ আসতো তারা এসে তা খনন করে নিয়ে যেতো। বর্তমানেও অনেক লোভাতুর মানুষকে তাদের রেখে যাওয়া গুপ্তধন খুঁজতে দেখা যায় এবং এদের প্রতারণার ফাঁদে অনেকে সর্বশান্ত হয়ে যায়। ত্রিপুরা রাজ দু’বছরও অধিকার অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। সুলতান নসরত শাহ (১৫১৯-৩৩) ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে সমগ্র চট্টগ্রাম দখল করে নেন। তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন ফতেয়াবাদ। ১৫১৭ সালে চট্টগ্রামে পর্তুগীজদের আগমন ঘটে। ১৫৩৮ সালে শের শাহের সেনাপতি কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজয় হয়। ১৫৩৮-৮০ পর্যন্ত চট্টগ্রামে আরাকানীদের শাসন চলে। কিন্তু এ শাসন কোন ক্রমেই অনুক্রমিক ছিল না। চট্টগ্রামে মুসলমানদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী ছিল ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজ। এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের দখল নিয়ে ত্রিপুরা রাজ ও আরাকান রাজের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলে ত্রিপুরা রাজ চিরদিনের জন্য চট্টগ্রাম হতে বিতাড়িত হন এবং ১৫৮১-১৬৬৬ সাল পর্যন্ত এখানে আরাকানী শাসন চলে। মোগলগণ বাংলায় শাসন ক্ষমতা আয়ত্বে রাখলেও বার বার চট্টগ্রাম দখলের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরিশেষে ভ্রাতৃসংঘাতে পরাজিত শাহ সূজা আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার তাড়া খেয়ে আরাকানে আশ্রয় নিলে আরাকান রাজ বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সূজাকে সপরিবারে হত্যা করে। ভ্রাতৃশোকার্ত মর্মাহত আওরঙ্গজেব ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঢাকার মোঘল সুবেদার শায়েস্তা খাঁকে নির্দেশ দেন। সম্রাটের নির্দেশে শায়েস্তা খান স্বীয় পুত্র বুজর্গ উমেদ খানকে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে নৌ সেনাসহ আরাকানীদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। উমেদ খান আরাকানী ও পর্তুগীজদের দ্বন্দের সুযোগে কৌশলে পর্তুগীজদের দলে ভিড়িয়ে তাঁর নৌশক্তি বৃদ্ধি ঘটান এবং উমেদ খানের নৌ সেনাধ্যক্ষ ইবনে হুসাইন কর্ণফুলী নদীর মোহনায় আরাকানীদের উপর তীব্র আক্রমণ চালিয়ে বিধ্বস্ত করে দেন এবং মোগলদের হাতে আরাকানীদের বিখ্যাত চাঁটিগাঁ দূর্গের (আন্দরকিল্লা) পতন ঘটে। এইভাবে চট্টগ্রামে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সম্রাটের নির্দেশে চট্টগ্রামের নাম রাখলেন ইসলামাবাদ যা ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ফেব্রুয়ারি মীর কাসিম কর্তৃক চট্টগ্রাম ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়া পর্যন্ত অব্যহত ছিল। ১৬৬৬-১৭১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রধানতঃ হাজারী মনসবদারদের হাতেই চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হতেন। কিন্তু ১৭১০ খ্রিস্টাব্দ হতে ফৌজদারদের পরিবর্তে নায়েবরাই চট্টগ্রাম শাসন করতেন। এর পর আরাকানীরা কয়েকবার চট্টগ্রাম উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
তথ্যসূত্র :
১। সৈয়দ সুলাইমান নদভী : আরবৌঁ কি জাহাজরানী
২। ইবনে খুরদাদবিহ : কিতাবুল মাসালিক ওয়াল মামালিক, পৃ.১৬৫
৩। সুলাইমান ইবনে আহমদ : সিলসিলাতুত তাওয়ারিখ, পৃ.৭৫
৪। মাওলানা আব্দুল্লাহিল কাফী : মাসিক তরজুমানুল কুরআন।
৫। এ.কে.এম মুহিউদ্দীন : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.২৭-২৮
৬। হামীদুল্লাহ খান : তারীখ-ই-হামীদ-১৮৫৩, কলকাতা
৭। ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলামী ঐতিহ্য
৮। ওহিদুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস
৯।অধ্যাপক খালেদ সম্পাদিত : হাজার বছরের চট্টগ্রাম,
১০।ড. আব্দুল করীম : চট্টগ্রামে ইসলাম, পৃ.৩৬।
১১। মাহবুবুল আলম : চট্টগ্রামের ইতিহাস পুরানো আমল, পৃ.৮৭-৮৯
১২। তাফসিরে মাআরেফুল কোরআন - সুরা কামার এর তাফসির
১৩।সুখময় মুখপধ্যায় : বাংলার ইতিহাসের দু’শো বছর, পৃ.৮
১৪।আর-রাহিকুল মাখতুম-সফীউর রহমান আল-মুবারকপূরী
Comment