‘তারবিয়াহ’ একটি আরবি শব্দ যার ভাষাগত অর্থ হচ্ছে বৃদ্ধি করা, জন্মানো, উন্নতি ইত্যাদি। প্রচলিত অর্থে, তারবিয়াহ’ মানে হচ্ছে মানুষকে বিভিন্ন উপায়ে উন্নত করা ও প্রশিক্ষণ দান । তাকওয়া, ইলম অর্জন, অন্যদের ইসলাম সম্পর্কে শিক্ষা দান এগুলো সবই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তারবিয়াহ’র অন্তর্ভুক্ত তবুও কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ে মুসলিমদের মানসিকতা উন্নয়ন কিংবা ‘তারবিয়াহ’র বিষয়টি হয়তো সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হচ্ছে কিংবা সচেতনভাবে বাদ দেয়া হচ্ছে। এমন একটি ভুলে যাওয়া বিষয় হচ্ছে, কিভাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর অনুসারীদের মাঝে একটি বিজয়ী মন মানসিকতা রেখে গিয়েছিলেন, তাদের মাঝে তিনি এই বিজয়ী মানসিকতার লালন ও বৃদ্ধি শিখিয়েছেন। বর্তমান সময়ের মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিজয়ী মানসিকতা কিংবা এর লালন, বৃদ্ধি করা এগুলো নেই, অনুপস্থিত।
● সারা দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের আজ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা, নির্যাতন, নিপীড়নের এক অভিন্ন চিত্র সবখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ কারণে এই কঠিন সময়ে এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, মুসলিমদের সেই বিজয়ী মন মানসিকতা আর নেই, বরং তাদেরকে গ্রাস করেছে একটি বিপরীত পরাজিত ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতা। আর এটা যুলুম নির্যাতনের একটি সহজাত ও অনিবার্য ফলাফল। যত বেশি আপনি যুলুম নির্যাতনের ভিকটিম হবেন, তত বেশি আপনার মাঝে তৈরি হবে ভিকটিম মানসিকতা বা পরাজিত মানসিকতা, ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব, কিছু হলেই আপনি ভাবতে শুরু করবেন কিভাবে নিজেকে যুলুমের হাত থেকে রক্ষা করবেন, কুফফারদের থেকে নিজের পিঠ বাঁচাতে কি অজুহাত প্রদর্শন করবেন -এই মানসিকতা। এই পরাজিত অজুহাত প্রদর্শনকারী ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হচ্ছে, নিজের অবস্থানের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা, তা থেকে উত্তরণে অপারগতা প্রকাশ করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা । অতিরিক্ত রয়েছে হতাশা ও নিষ্কর্ম মনোভাব এর জন্মলাভ।
● এটা সেই পরাজিত মানসিকতা যা উম্মাহকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং সমাজ বা আমাদের পরিবেশকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থা থেকে উন্নত করে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদারদের থেকে আমাদের মুসলিম ভূমিকে মুক্ত করা, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, দীন কায়েম করা কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতুল ফিরদাউস অর্জন – এগুলোর পথে বড় বাধা আমাদের পরাজিত মানসিকতা।
●●► অনাকাংক্ষিতভাবে, এই পরাজিত মানসিকতা নিজেই একটি অভিশাপ। যত বেশি আপনি অজুহাত প্রদর্শনকারী পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হবেন, এটা আপনাকে আরও পেঁচিয়ে ধরবে, এরপর তা আরও বাড়তে থাকবে, এটা থেকে কোন মুক্তি নেই, চক্রাকারে কেবল আপনাকে নিচের দিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাবে। যারা সত্যিকারের ভিকটিম, তাদের সমবেদনা প্রাপ্য; কিন্তু অধিকাংশ সময়েই যারা নিজেরা পরাজিত মানসিকতার শিকার তাদের দুরবস্থার জন্য সমব্যথা অনুভব করাটাও কঠিন। এমনকি তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে কারণ তারা এমনভাবে কথা বলে, আচরণ করে বা বিশ্বাস করে যে, যেন তারা একটি ক্রমিক ক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে !
●●► অথচ আমরা যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে মনোযোগী হই, আমরা দেখতে পাই যে তিনি এবং তাঁর সাথীরা সম্মুখীন হয়েছিল এরচেয়েও অনেক কঠিন অত্যাচার-নির্যাতনের। এত কিছুর পরেও তারা নিজেদের মানসিকতার পরাজয় ঘটতে দেননি। বরং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মাঝে যে মানসিকতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ও লালন করেছিলেন তাতে তাঁরা শিখেছিলেন ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন যে তারাই সেই সকল লোক যারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করছেন আর জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসেবে ইসলাম চূড়ান্তভাবে বিজয় ও সফলতা লাভ করবে। তাদের প্রতি হুমকি আর যুলুম যত বেশি কঠিন হতো, তাঁরা তাদের মন মানসিকতাকে তার চেয়েও বেশি ইতিবাচক করে নিতেন।
উদাহরণস্বরূপ, খাববাব ইবন আল-আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবীরা একবার আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তাদের উপর চলমান অত্যাচার নির্যাতনের কথা তুলে ধরে অনুযোগ অভিযোগ পেশ করলেন। তাঁরা চাইলেন, তিনি যেন তাদের জন্য মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করেন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন।
বুখারী ৩৫৭৩ ৬ষ্ঠ খণ্ড হতে, “…আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা গৃহের ছায়ার বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, আপনি কি (আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার)জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত মাংস ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে বের করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করতে পারতো না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাঁদের দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন,ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না”। রাবী (র) আরো অতিরিক্ত বর্ণনা করেন “এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না”।
এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি সাহাবাদেরকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের উপর চলমান নিপীড়ন তো কেবল স্বল্প একটি সময়ের জন্য আর অচিরেই ইসলাম হবে বিজয়ী। তিনি সাহাবাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার উপর দুঃখ অনুভব, সমবেদনা করতে নিষেধ করে দিলেন, বরং তাদের কষ্টকে তুলনা করলেন পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা ঈমান আনার কারণে যে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই অবস্থার সাথে যেন তারা এই অত্যাচার নিপীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, আর এটাও জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে, চূড়ান্ত বিজয় হবে ইসলামের।
●●► মদীনার পথে হিজরতকালে, একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহর নবীকে ধরিয়ে দিলে ১০০ উট পুরষ্কার দেয়া হবে, এ লোভে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্ধান করতে এক ব্যক্তি বের হল, সে সুরাকা বিন মালিক। একসময় সে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হল। এই ভয়াবহ বিপদের মুহুর্তে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উলটো সুরাকা বিন মালিকের জন্য একটি নিরাপত্তা পত্র লিখে দিলেন ! বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিপদের কারণ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দিয়েছিলেন ! তদুপরি তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাকে একটি সোনার বালা উপহার দিতেও রাজি হলেন, তাও কিনা পারস্য সম্রাটের রাজকোষ হতে! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও সুরাকার অবস্থান হতে চিন্তা করলে, জীবন রক্ষার্থে উটের পিঠে চড়ে আপন জন্মভূমি হতে নির্বাসিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম কিছু লাভ করা শুধ অচিন্তনীয় নয়, বরং এক নিশ্চিত অসম্ভব ব্যাপার। অথচ, এরকম এক বিপর্যস্ত সময়ে এহেন সুমহান প্রতিশ্রুতি প্রদান শুধু আবু বকর সিদ্দিকের নিরাপদে মদীনায় গমনের আত্মবিশ্বাসকেই বৃদ্ধি করলো না বরং ইসলাম যে বিজয় লাভ করবে তার প্রতিও বিশ্বাস বৃদ্ধি হল। আর অবশ্যই, যখন পারস্য বিজয় হয়েছিল, সেই সোনার বালা ও খসরুর (পারস্য সম্রাট) মুকুট আনা হল হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট, তিনি সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে পাঠালেন ও সেই রাজপোশাক পরিধান করিয়ে দিলেন।
●●► এমনকি জিহাদে রণাঙ্গনের কঠিন সময়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে উজ্জীবিত করার একটি আশ্চর্য সক্ষমতা ছিল, এমনকি যদি মনে হতো অনিবার্য পরাজয় সামনে তবুও তিনি তা করতে পারতেন। উহুদ যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন, যেখানে কিছু মুসলিম তীরন্দাজের ভুল ও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ অমান্য করার কারণে মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিল, যার ফলে অনেক মুসলিম শহীদ হলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মারাত্মক আহত হলেন। এমনি একটি পরিস্থিতিতে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুসলিমেরা যুদ্ধের শেষে উহুদ পাহাড়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, কুফফারদের কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিজয়ের উদযাপনসূচক ভংগীতে বলে উঠল, “হুবাল (আরবদের মূর্তি) এর জয় হোক”। এটা ছিল বিজয়ের উদযাপনের ভংগীতে বলা এবং মুসলিমদের প্রতি একটি বিদ্রুপ, যারা ময়দানের আকস্মিক পট পরিবর্তনের কারণে দুর্বলতা অনুভব করছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তায়ালা মহান এবং সর্ব শক্তিমান।
মুসলিমদের পক্ষে জবাব দিচ্ছিলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু।
একথা শুনে আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে ওযযা আছে, তোমাদের ওযযা নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, ‘আল্লাহু মাওলানা ওয়া-লা মাওলা লাকুম’– “আল্লাহ তায়ালা আমাদের অভিভাবক, আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই”।
● এরপর আবু সুফিয়ান যে উক্তিটি করেছিল তা থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিমদের ইতিবাচক মনোভাব দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল এবং সে বুঝতে পারল যে কথায় সে নীচু হয়ে যাচ্ছে, তাই সে কথার লড়াইয়ে সমতা আনার জন্য বলল, “দিনের বদলা দিন। তোমাদের জন্য বদর ছিল, আর আমাদের জন্য উহুদ…আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বালতি”।
হযরত উমার আবু সুফিয়ানের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, “ না, সমান নয়। আমাদের যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন আর তোমাদের যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে”।
মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা করতে এই কথাগুলো দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রাখল আর তারা ঘোষণা করলেন, বিজয় হয়েছে মুসলিমদেরই, ময়দানে কি হয়েছে তাতে কিছুই আসে যায় না।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল ফাঁকা বুলি আওড়ানো মানুষ ছিলেন না।
উহুদের বিপর্যয়ের পরদিনের ঘটনা দেখুন, যখন অধিকাংশ মুসলিম ক্লান্ত ও আহত, তিনি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যারা লড়াই করেছিলেন তাদের সবাইকে আদেশ দিলেন যে তাঁরা তাদের লৌহবর্ম পড়ে নেয় ও হামরা আল-আসাদ পর্যন্ত যেন কুফফারদের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে তাড়া করে যায়। এটি ছিল এমন একটি সময়, যখন সাহাবাগণ শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক থেকে চরমভাবে পরিশ্রান্ত ছিলেন, আহত মন ও দেহ, ব্যথায় অনেকে কাতরাচ্ছেন; এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের আদেশ কেবলমাত্র সেই নেতার কাছ থেকেই আসতে পারে যিনি দূরদর্শী ও অত্যন্ত কুশলী। কুরাইশরা, মক্কায় ফেরার পথে, তারাও চিন্তা করল মদীনায় ফিরে বাকি মুসলিমদের একেবারে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে কেননা এখন তারা দুর্বল, এমন সময়ে উলটো তারাই খবর পেল যে, হামরা আল-আসাদের দিকে মুসলিমরা রওনা দিয়েছে, এরপর তারা তড়িঘড়ি করে মক্কার পথে ছুটে পালাল ও আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা মন থেকে বিদায় করে দিল। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদে তিনি দিন পর্যন্ত অবস্থান করলেন মদীনায় ফেরত আসার পূর্বে; এবারে সমস্ত বাহিনী একেবারে চাঙ্গা ও খোশ মেজাজে ফিরে এলেন, বিজয়ের উদযাপনের আমেজ মন-মেজাজে চলে এল। সপ্তাহ খানেক আগের শারিরীক পরাজয়- বদলে গেল বিজয়ে।
আমাদের জন্যে আরও উদাহরণ হয়েছে খন্দকের যুদ্ধে
যখন মদীনার মুসলিমদের ঘিরে ফেলেছিল ১০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল শক্তিশালী বাহিনী, যাদের মধ্যে ছিল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র। মুসলিমদের ছিল মাত্র ৩০০০ জন, উপরন্তু এত বড় বাহিনী তাঁরা কখনো দেখেননি। তখন মদীনায় ছিল দুর্ভিক্ষ, তারা পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা দূর করার চেষ্টা করতেন, আর চরম বৈরী আবহাওয়ার মাঝে নিজেদের রক্ষার্থে একটানা কাজ করে চললেন ও পরিখা খনন করলেন। যদি এই অবস্থা যথেষ্ট ভীতিকর বলে প্রতীয়মান না হয়, তবে জেনে রাখুন সেই কঠিন পরিস্থিতিতে খবর এল, মদীনার ভেতরকার ইহুদীরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভংগ করেছে ও শহরের পিছন দিক থেকে আক্রমণের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তদুপরি, মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে এই কষ্টকর সংগ্রাম ত্যাগ করল ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রুপ,কটাক্ষ করা শুরু করল। মুসলিমরা এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুর’আনে এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “…এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে”।
(আহযাব ১০)
এটা ছিল এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি, অথচ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা বিরাট শক্তিধর তৎকালীন ‘সুপার পাওয়ার’ পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয় করবেন, আর বাকি আরব্য উপদ্বীপ তো বিজয় হবেই। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পেল ও চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। আল্লাহ বর্ণণা করছেন, এরপর কিভাবে তারা সেই সম্মিলিত কুফফার সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে তাকালো ও আল্লাহকে স্মরণ করলো, তিনি বলেন, “যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্নসমর্পণই বৃদ্ধি পেল”।(আহযাব ২২)
মানসিকতার পরিবর্তনের প্রভাব ছিল ব্যাপক, এবং এটা ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। তিনি আদেশ করেছিলেন যেন তারা পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। যদি তারা পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হতেন, হীনমন হয়ে থাকতেন, তারা সেই সুবিশাল শত্রুবাহিনীর সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতেন।
অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, এবারও তারাই বিজয়ী হলেন।
সীরাহ(জীবনী)গ্রন্থগুলো এমন ঘটনার বর্ণনায় ভরপুর।
যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে কৌশলগত কারণে মদীনার দিকে পিছু হটে নিয়ে এলেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুতার সেই ময়দানে রোমান সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কাছে মুসলিমদের ক্ষুদ্র বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার কোন তুলনাই হয় না। ফিরতি পথে, অনেকে খালিদ বিন ওয়ালিদকে ‘ইয়া ফাররার’ (হে পলায়নকারী) বলে বিদ্রুপ করছিলেন। এই কথাগুলো খালিদকে মনোবল হারা করে দিতে পারতো, এমনকি তা মুসলিম সেনাবাহিনীর মাঝেও দুর্বলতা ছড়িয়ে দিতে পারতো, অথচ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চাঙ্গা করে দিলেন ও শত্রুদের বিদ্রুপাত্মক কথাকে পালটে দিলেন, তিনি তাদের আদেশ করলেন যেন তারা বলেন, ‘ইয়া কাররার’(হে অগ্রগামী)। এতে তারা বুঝতে পারলেন, কৌশলগত কারণে পিছু হটা আর পলায়ন করা এক নয়। এটা খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাহস শক্তি বৃদ্ধি করল আর তাঁরা এতে এরপর ডজনখানেক যুদ্ধে রোমান ও পারস্য বাহিনীকে পরাভূত করলেন।
●●►বিজয়ী মানসিকতা লালন করা ও তা ধরে রাখা, বৃদ্ধি করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরেও সাহাবীরা জিহাদ চালিয়ে গেলেন ও ইসলামের বিজয় আনতে লাগলেন। উদাহরণ দেখুন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন উসামা বিন যায়িদ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে অস্বীকার করেছিলেন তখন তিনি কি বলেছিলেন? অথচ সেই বাহিনী প্রেরণের দিনকয়েক পরেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন। এত বড় মানসিক আঘাত ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরবের গোত্রগুলো পরিকল্পনা করছিল মদীনা আক্রমণের, একারণে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে বাহিনী প্রেরণ করা উচিত হবে না। আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে কুকুর টেনে নিয়ে যাও তারপরও আমি এই বাহিনী প্রেরণ করবো, আর যদি মদীনায় আমি ছাড়া আর কেউ নাও থাকে তারপরও আমি এই বাহিনী পাঠাব কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন”!
তিনি কিছুতেই সেই বাহিনীকে ফেরত আনতে চাননি, যারা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে বের হয়েছিলেন। আর যখন উসামার বাহিনী সামনে এগিয়ে চলল, শত্রুভাবাপন্ন আরব গোত্রগুলো লা-জওয়াব হয়ে গেল, তারা ভেবে পেল না, আল্লাহর নবীর মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে কিভাবে এই বাহিনী জিহাদের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এটা সাক্ষ্য দেয়, বিপদের মুখে অবিচল ও অটল থাকার এই মানসিকতার কারণে শত্রুদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি হল ও তারা মদীনা আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা বাদ দিল।
সাহাবারা অনুধাবন করেছিলেন, মুসলিম হিসেবে যদি টিকে থাকতে হয়, যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে হয় তাহলে তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে নানা রকম ফিতনা ও পরীক্ষা, সম্মুখীন হতে হবে যুলুম,নির্যাতন ও যন্ত্রণার। কিন্তু তারা জানতেন, দুনিয়া কিংবা আখিরাতে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই। তারা আরও জানতেন যে, ইসলামের বিজয় হবেই সেটা তাদের জীবদ্দশাতে না হলেও পরবর্তী সময়ে হবে। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি যিনি আমাদেরকে কুর’আন ও হাদীসের বহু স্থানে অবগত করেছেন যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চলমান লড়াইয়ে মুসলিমরাই হবে চূড়ান্ত বিজয়ী আর ইসলাম টিকে থাকবে।
আমাদের অবশ্যই উচিত হল এই পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা পরিত্যাগ করা, যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার কারণে, এগুলো ঝেড়ে ফেলে আমাদের উচিত একিন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া কারণ বিজয় মুমিন ও মুসলিমদেরই। ফলে আমরা আমাদের বর্তমান অপমানজনক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হব ইনশা আল্লাহ, অথচ আজ আমরা যুলুম ও বাতিলের মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্যদের সাহায্য ও সমবেদনার দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। যদি আমাদের মত করে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমও নিজেদেরকে খোলসের ভেতর গুটিয়ে নিতেন, নিজেদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব পোষণ করতেন, নিজেদের উপর চাপ অনুভব করতেন কিংবা অন্যদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতেন, তাহলে আজ আমরা যেভাবে তাদের নাম ও খ্যাতির কথা জানি তা জানতাম না, এটা নিশ্চিত। একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মত ও পথে, তাঁর দেখানো পদ্ধতিতেই সর্বোত্তম উদাহরণ রয়েছে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে, আমরা কি পারি না নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে সেই পদ্ধতিতেই উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে ?
আমরা কি পারি না নিজেদেরকে সেই সুনিশ্চিত বিজয়ের অংশ করতে, যার আগমন নিয়ে কোন সন্দেহ নেই?
● সারা দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের আজ দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা, নির্যাতন, নিপীড়নের এক অভিন্ন চিত্র সবখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। এ কারণে এই কঠিন সময়ে এটা কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে, মুসলিমদের সেই বিজয়ী মন মানসিকতা আর নেই, বরং তাদেরকে গ্রাস করেছে একটি বিপরীত পরাজিত ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতা। আর এটা যুলুম নির্যাতনের একটি সহজাত ও অনিবার্য ফলাফল। যত বেশি আপনি যুলুম নির্যাতনের ভিকটিম হবেন, তত বেশি আপনার মাঝে তৈরি হবে ভিকটিম মানসিকতা বা পরাজিত মানসিকতা, ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব, কিছু হলেই আপনি ভাবতে শুরু করবেন কিভাবে নিজেকে যুলুমের হাত থেকে রক্ষা করবেন, কুফফারদের থেকে নিজের পিঠ বাঁচাতে কি অজুহাত প্রদর্শন করবেন -এই মানসিকতা। এই পরাজিত অজুহাত প্রদর্শনকারী ক্ষমাপ্রার্থী মানসিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ হচ্ছে, নিজের অবস্থানের উপর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা, তা থেকে উত্তরণে অপারগতা প্রকাশ করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা । অতিরিক্ত রয়েছে হতাশা ও নিষ্কর্ম মনোভাব এর জন্মলাভ।
● এটা সেই পরাজিত মানসিকতা যা উম্মাহকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং সমাজ বা আমাদের পরিবেশকে বর্তমান শোচনীয় অবস্থা থেকে উন্নত করে এগিয়ে নিয়ে যাবার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদারদের থেকে আমাদের মুসলিম ভূমিকে মুক্ত করা, ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা, দীন কায়েম করা কিংবা চূড়ান্ত লক্ষ্য জান্নাতুল ফিরদাউস অর্জন – এগুলোর পথে বড় বাধা আমাদের পরাজিত মানসিকতা।
●●► অনাকাংক্ষিতভাবে, এই পরাজিত মানসিকতা নিজেই একটি অভিশাপ। যত বেশি আপনি অজুহাত প্রদর্শনকারী পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হবেন, এটা আপনাকে আরও পেঁচিয়ে ধরবে, এরপর তা আরও বাড়তে থাকবে, এটা থেকে কোন মুক্তি নেই, চক্রাকারে কেবল আপনাকে নিচের দিকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যাবে। যারা সত্যিকারের ভিকটিম, তাদের সমবেদনা প্রাপ্য; কিন্তু অধিকাংশ সময়েই যারা নিজেরা পরাজিত মানসিকতার শিকার তাদের দুরবস্থার জন্য সমব্যথা অনুভব করাটাও কঠিন। এমনকি তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে কারণ তারা এমনভাবে কথা বলে, আচরণ করে বা বিশ্বাস করে যে, যেন তারা একটি ক্রমিক ক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে !
●●► অথচ আমরা যখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনের দিকে মনোযোগী হই, আমরা দেখতে পাই যে তিনি এবং তাঁর সাথীরা সম্মুখীন হয়েছিল এরচেয়েও অনেক কঠিন অত্যাচার-নির্যাতনের। এত কিছুর পরেও তারা নিজেদের মানসিকতার পরাজয় ঘটতে দেননি। বরং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মাঝে যে মানসিকতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছিলেন ও লালন করেছিলেন তাতে তাঁরা শিখেছিলেন ও মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন যে তারাই সেই সকল লোক যারা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা লাভ করছেন আর জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসেবে ইসলাম চূড়ান্তভাবে বিজয় ও সফলতা লাভ করবে। তাদের প্রতি হুমকি আর যুলুম যত বেশি কঠিন হতো, তাঁরা তাদের মন মানসিকতাকে তার চেয়েও বেশি ইতিবাচক করে নিতেন।
উদাহরণস্বরূপ, খাববাব ইবন আল-আরাত রাদিয়াল্লাহু আনহু ও অন্যান্য সাহাবীরা একবার আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে তাদের উপর চলমান অত্যাচার নির্যাতনের কথা তুলে ধরে অনুযোগ অভিযোগ পেশ করলেন। তাঁরা চাইলেন, তিনি যেন তাদের জন্য মুশরিকদের বিরুদ্ধে দুয়া করেন ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন।
বুখারী ৩৫৭৩ ৬ষ্ঠ খণ্ড হতে, “…আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খেদমতে হাযির হলাম। তখন তিনি তাঁর নিজের চাদরকে বালিশ বানিয়ে কা’বা গৃহের ছায়ার বসে বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন। আমরা মুশরিকদের পক্ষ থেকে কঠিন নির্যাতন ভোগ করছিলাম। তাই আমি বললাম, আপনি কি (আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তার)জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন না? তখন তিনি উঠে বসলেন এবং তাঁর চেহারা রক্তিম বর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি বললেন, তোমাদের পূর্ববর্তী ঈমানদারদের মধ্যে কারো কারো শরীরের হাড় পর্যন্ত সমস্ত মাংস ও শিরা উপশিরাগুলি লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ে বের করে ফেলা হত। কিন্তু এসব নির্যাতনও তাদেরকে দীন থেকে বিমুখ করতে পারতো না। তাঁদের মধ্যে কারো মাথার মধ্যবর্তী স্থানে করাত স্থাপন করে তাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হত। কিন্তু এ নির্যাতনও তাঁদেরকে তাঁদের দীন থেকে ফিরাতে পারতো না। আল্লাহর কসম, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই এ দীনকে পরিপূর্ণ করবেন,ফলে একজন উষ্ট্রারোহী সান’আ থেকে হাযারামাউত পর্যন্ত একাকী ভ্রমণ করবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সে ভয় করবে না”। রাবী (র) আরো অতিরিক্ত বর্ণনা করেন “এবং তার মেষ পালের উপর নেকড়ে বাঘের আক্রমণে সে ভয় করবে না”।
এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়ার কারণ ছিল এই যে, তিনি সাহাবাদেরকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের উপর চলমান নিপীড়ন তো কেবল স্বল্প একটি সময়ের জন্য আর অচিরেই ইসলাম হবে বিজয়ী। তিনি সাহাবাদেরকে তাদের নিজেদের অবস্থার উপর দুঃখ অনুভব, সমবেদনা করতে নিষেধ করে দিলেন, বরং তাদের কষ্টকে তুলনা করলেন পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা ঈমান আনার কারণে যে কষ্টের সম্মুখীন হয়েছিলেন সেই অবস্থার সাথে যেন তারা এই অত্যাচার নিপীড়নকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন, আর এটাও জানিয়ে আশ্বস্ত করলেন যে, চূড়ান্ত বিজয় হবে ইসলামের।
●●► মদীনার পথে হিজরতকালে, একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। আল্লাহর নবীকে ধরিয়ে দিলে ১০০ উট পুরষ্কার দেয়া হবে, এ লোভে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সন্ধান করতে এক ব্যক্তি বের হল, সে সুরাকা বিন মালিক। একসময় সে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান সনাক্ত করতে সক্ষম হল। এই ভয়াবহ বিপদের মুহুর্তে, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উলটো সুরাকা বিন মালিকের জন্য একটি নিরাপত্তা পত্র লিখে দিলেন ! বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি বিপদের কারণ ব্যক্তিকে নিরাপত্তা পত্র লিখে দিয়েছিলেন ! তদুপরি তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাকে একটি সোনার বালা উপহার দিতেও রাজি হলেন, তাও কিনা পারস্য সম্রাটের রাজকোষ হতে! আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও সুরাকার অবস্থান হতে চিন্তা করলে, জীবন রক্ষার্থে উটের পিঠে চড়ে আপন জন্মভূমি হতে নির্বাসিত একজন ব্যক্তির কাছ থেকে এরকম কিছু লাভ করা শুধ অচিন্তনীয় নয়, বরং এক নিশ্চিত অসম্ভব ব্যাপার। অথচ, এরকম এক বিপর্যস্ত সময়ে এহেন সুমহান প্রতিশ্রুতি প্রদান শুধু আবু বকর সিদ্দিকের নিরাপদে মদীনায় গমনের আত্মবিশ্বাসকেই বৃদ্ধি করলো না বরং ইসলাম যে বিজয় লাভ করবে তার প্রতিও বিশ্বাস বৃদ্ধি হল। আর অবশ্যই, যখন পারস্য বিজয় হয়েছিল, সেই সোনার বালা ও খসরুর (পারস্য সম্রাট) মুকুট আনা হল হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এর নিকট, তিনি সুরাকা ইবন মালিককে ডেকে পাঠালেন ও সেই রাজপোশাক পরিধান করিয়ে দিলেন।
●●► এমনকি জিহাদে রণাঙ্গনের কঠিন সময়েও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমকে উজ্জীবিত করার একটি আশ্চর্য সক্ষমতা ছিল, এমনকি যদি মনে হতো অনিবার্য পরাজয় সামনে তবুও তিনি তা করতে পারতেন। উহুদ যুদ্ধের কথা স্মরণ করুন, যেখানে কিছু মুসলিম তীরন্দাজের ভুল ও আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশ অমান্য করার কারণে মুসলিমদের মাঝে ব্যাপক বিশৃংখলা দেখা দিল, যার ফলে অনেক মুসলিম শহীদ হলেন, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও মারাত্মক আহত হলেন। এমনি একটি পরিস্থিতিতে, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুসলিমেরা যুদ্ধের শেষে উহুদ পাহাড়ের উপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, কুফফারদের কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান বিজয়ের উদযাপনসূচক ভংগীতে বলে উঠল, “হুবাল (আরবদের মূর্তি) এর জয় হোক”। এটা ছিল বিজয়ের উদযাপনের ভংগীতে বলা এবং মুসলিমদের প্রতি একটি বিদ্রুপ, যারা ময়দানের আকস্মিক পট পরিবর্তনের কারণে দুর্বলতা অনুভব করছিলেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, আল্লাহ তায়ালা মহান এবং সর্ব শক্তিমান।
মুসলিমদের পক্ষে জবাব দিচ্ছিলেন, হযরত উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু।
একথা শুনে আবু সুফিয়ান উচ্চস্বরে বললো, আমাদের জন্যে ওযযা আছে, তোমাদের ওযযা নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা জবাব দিচ্ছো না কেন?
সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আমরা কি জবাব দিব?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো, ‘আল্লাহু মাওলানা ওয়া-লা মাওলা লাকুম’– “আল্লাহ তায়ালা আমাদের অভিভাবক, আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই”।
● এরপর আবু সুফিয়ান যে উক্তিটি করেছিল তা থেকে বোঝা যায় যে, মুসলিমদের ইতিবাচক মনোভাব দেখে সে আশ্চর্য হয়েছিল এবং সে বুঝতে পারল যে কথায় সে নীচু হয়ে যাচ্ছে, তাই সে কথার লড়াইয়ে সমতা আনার জন্য বলল, “দিনের বদলা দিন। তোমাদের জন্য বদর ছিল, আর আমাদের জন্য উহুদ…আজ বদরের যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের দিন। যুদ্ধ হচ্ছে একটা বালতি”।
হযরত উমার আবু সুফিয়ানের মনোবল ভেঙ্গে দিয়ে বললেন, “ না, সমান নয়। আমাদের যারা নিহত হয়েছেন, তারা জান্নাতে রয়েছেন আর তোমাদের যারা নিহত হয়েছে, তারা জাহান্নামে রয়েছে”।
মুসলিমদের আত্মবিশ্বাস ও মনোবল চাঙ্গা করতে এই কথাগুলো দারুণ কার্যকরী ভূমিকা রাখল আর তারা ঘোষণা করলেন, বিজয় হয়েছে মুসলিমদেরই, ময়দানে কি হয়েছে তাতে কিছুই আসে যায় না।
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবল ফাঁকা বুলি আওড়ানো মানুষ ছিলেন না।
উহুদের বিপর্যয়ের পরদিনের ঘটনা দেখুন, যখন অধিকাংশ মুসলিম ক্লান্ত ও আহত, তিনি সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যারা লড়াই করেছিলেন তাদের সবাইকে আদেশ দিলেন যে তাঁরা তাদের লৌহবর্ম পড়ে নেয় ও হামরা আল-আসাদ পর্যন্ত যেন কুফফারদের সাথে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে তাড়া করে যায়। এটি ছিল এমন একটি সময়, যখন সাহাবাগণ শারিরীক ও মানসিক উভয় দিক থেকে চরমভাবে পরিশ্রান্ত ছিলেন, আহত মন ও দেহ, ব্যথায় অনেকে কাতরাচ্ছেন; এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের আদেশ কেবলমাত্র সেই নেতার কাছ থেকেই আসতে পারে যিনি দূরদর্শী ও অত্যন্ত কুশলী। কুরাইশরা, মক্কায় ফেরার পথে, তারাও চিন্তা করল মদীনায় ফিরে বাকি মুসলিমদের একেবারে চিরদিনের জন্য বিদায় করে দিতে কেননা এখন তারা দুর্বল, এমন সময়ে উলটো তারাই খবর পেল যে, হামরা আল-আসাদের দিকে মুসলিমরা রওনা দিয়েছে, এরপর তারা তড়িঘড়ি করে মক্কার পথে ছুটে পালাল ও আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা মন থেকে বিদায় করে দিল। মুসলিমরা হামরা আল-আসাদে তিনি দিন পর্যন্ত অবস্থান করলেন মদীনায় ফেরত আসার পূর্বে; এবারে সমস্ত বাহিনী একেবারে চাঙ্গা ও খোশ মেজাজে ফিরে এলেন, বিজয়ের উদযাপনের আমেজ মন-মেজাজে চলে এল। সপ্তাহ খানেক আগের শারিরীক পরাজয়- বদলে গেল বিজয়ে।
আমাদের জন্যে আরও উদাহরণ হয়েছে খন্দকের যুদ্ধে
যখন মদীনার মুসলিমদের ঘিরে ফেলেছিল ১০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল শক্তিশালী বাহিনী, যাদের মধ্যে ছিল কুরাইশ ও অন্যান্য গোত্র। মুসলিমদের ছিল মাত্র ৩০০০ জন, উপরন্তু এত বড় বাহিনী তাঁরা কখনো দেখেননি। তখন মদীনায় ছিল দুর্ভিক্ষ, তারা পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধা দূর করার চেষ্টা করতেন, আর চরম বৈরী আবহাওয়ার মাঝে নিজেদের রক্ষার্থে একটানা কাজ করে চললেন ও পরিখা খনন করলেন। যদি এই অবস্থা যথেষ্ট ভীতিকর বলে প্রতীয়মান না হয়, তবে জেনে রাখুন সেই কঠিন পরিস্থিতিতে খবর এল, মদীনার ভেতরকার ইহুদীরা মুসলিমদের সাথে চুক্তি ভংগ করেছে ও শহরের পিছন দিক থেকে আক্রমণের রাস্তা উন্মুক্ত করে দিয়েছে। তদুপরি, মুনাফিকরা মুসলিমদের সাথে এই কষ্টকর সংগ্রাম ত্যাগ করল ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিদ্রুপ,কটাক্ষ করা শুরু করল। মুসলিমরা এত কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুর’আনে এ অবস্থাকে বর্ণনা করেছেন “…এবং যখন তোমাদের দৃষ্টিভ্রম হচ্ছিল, প্রাণ কন্ঠাগত হয়েছিল এবং তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানা বিরূপ ধারণা পোষণ করতে শুরু করছিলে”।
(আহযাব ১০)
এটা ছিল এক প্রাণান্তকর পরিস্থিতি, অথচ তখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাদের সুসংবাদ দিলেন যে, তারা বিরাট শক্তিধর তৎকালীন ‘সুপার পাওয়ার’ পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্য বিজয় করবেন, আর বাকি আরব্য উপদ্বীপ তো বিজয় হবেই। এতে তাদের মনোবল বৃদ্ধি পেল ও চূড়ান্ত বিজয়ের সংবাদে আত্মবিশ্বাস ফিরে এল। আল্লাহ বর্ণণা করছেন, এরপর কিভাবে তারা সেই সম্মিলিত কুফফার সেনাবাহিনীর দিকে ফিরে তাকালো ও আল্লাহকে স্মরণ করলো, তিনি বলেন, “যখন মুমিনরা শক্রবাহিনীকে দেখল, তখন বলল, আল্লাহ ও তাঁর রসূল এরই ওয়াদা আমাদেরকে দিয়েছিলেন এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূল সত্য বলেছেন। এতে তাদের ঈমান ও আত্নসমর্পণই বৃদ্ধি পেল”।(আহযাব ২২)
মানসিকতার পরিবর্তনের প্রভাব ছিল ব্যাপক, এবং এটা ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপদেশ। তিনি আদেশ করেছিলেন যেন তারা পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। যদি তারা পরাজিত মানসিকতার অধিকারী হতেন, হীনমন হয়ে থাকতেন, তারা সেই সুবিশাল শত্রুবাহিনীর সামনে নিঃশেষ হয়ে যেতেন।
অথচ, ইতিহাস সাক্ষী, এবারও তারাই বিজয়ী হলেন।
সীরাহ(জীবনী)গ্রন্থগুলো এমন ঘটনার বর্ণনায় ভরপুর।
যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর বাহিনীকে কৌশলগত কারণে মদীনার দিকে পিছু হটে নিয়ে এলেন, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মুতার সেই ময়দানে রোমান সৈন্যদের সংখ্যাধিক্যের কাছে মুসলিমদের ক্ষুদ্র বাহিনীর সৈন্যসংখ্যার কোন তুলনাই হয় না। ফিরতি পথে, অনেকে খালিদ বিন ওয়ালিদকে ‘ইয়া ফাররার’ (হে পলায়নকারী) বলে বিদ্রুপ করছিলেন। এই কথাগুলো খালিদকে মনোবল হারা করে দিতে পারতো, এমনকি তা মুসলিম সেনাবাহিনীর মাঝেও দুর্বলতা ছড়িয়ে দিতে পারতো, অথচ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে চাঙ্গা করে দিলেন ও শত্রুদের বিদ্রুপাত্মক কথাকে পালটে দিলেন, তিনি তাদের আদেশ করলেন যেন তারা বলেন, ‘ইয়া কাররার’(হে অগ্রগামী)। এতে তারা বুঝতে পারলেন, কৌশলগত কারণে পিছু হটা আর পলায়ন করা এক নয়। এটা খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সাহস শক্তি বৃদ্ধি করল আর তাঁরা এতে এরপর ডজনখানেক যুদ্ধে রোমান ও পারস্য বাহিনীকে পরাভূত করলেন।
●●►বিজয়ী মানসিকতা লালন করা ও তা ধরে রাখা, বৃদ্ধি করা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে,
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পরেও সাহাবীরা জিহাদ চালিয়ে গেলেন ও ইসলামের বিজয় আনতে লাগলেন। উদাহরণ দেখুন, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন উসামা বিন যায়িদ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর বাহিনীকে ফিরিয়ে আনতে অস্বীকার করেছিলেন তখন তিনি কি বলেছিলেন? অথচ সেই বাহিনী প্রেরণের দিনকয়েক পরেই আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্যু বরণ করেন। এত বড় মানসিক আঘাত ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আরবের গোত্রগুলো পরিকল্পনা করছিল মদীনা আক্রমণের, একারণে অনেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন এই পরিস্থিতিতে বাহিনী প্রেরণ করা উচিত হবে না। আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন, “যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রীদের পায়ের গোড়ালি কামড়ে ধরে কুকুর টেনে নিয়ে যাও তারপরও আমি এই বাহিনী প্রেরণ করবো, আর যদি মদীনায় আমি ছাড়া আর কেউ নাও থাকে তারপরও আমি এই বাহিনী পাঠাব কারণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ দিয়েছেন”!
তিনি কিছুতেই সেই বাহিনীকে ফেরত আনতে চাননি, যারা আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশে বের হয়েছিলেন। আর যখন উসামার বাহিনী সামনে এগিয়ে চলল, শত্রুভাবাপন্ন আরব গোত্রগুলো লা-জওয়াব হয়ে গেল, তারা ভেবে পেল না, আল্লাহর নবীর মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে কিভাবে এই বাহিনী জিহাদের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। এটা সাক্ষ্য দেয়, বিপদের মুখে অবিচল ও অটল থাকার এই মানসিকতার কারণে শত্রুদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি হল ও তারা মদীনা আক্রমণের যাবতীয় কল্পনা বাদ দিল।
সাহাবারা অনুধাবন করেছিলেন, মুসলিম হিসেবে যদি টিকে থাকতে হয়, যদি সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে হয় তাহলে তাদেরকে অতিক্রম করতে হবে নানা রকম ফিতনা ও পরীক্ষা, সম্মুখীন হতে হবে যুলুম,নির্যাতন ও যন্ত্রণার। কিন্তু তারা জানতেন, দুনিয়া কিংবা আখিরাতে চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই। তারা আরও জানতেন যে, ইসলামের বিজয় হবেই সেটা তাদের জীবদ্দশাতে না হলেও পরবর্তী সময়ে হবে। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি যিনি আমাদেরকে কুর’আন ও হাদীসের বহু স্থানে অবগত করেছেন যে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চলমান লড়াইয়ে মুসলিমরাই হবে চূড়ান্ত বিজয়ী আর ইসলাম টিকে থাকবে।
আমাদের অবশ্যই উচিত হল এই পরাজিত ভিকটিম মানসিকতা পরিত্যাগ করা, যাতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমাদের দৈনন্দিন দুঃখ দুর্দশার কারণে, এগুলো ঝেড়ে ফেলে আমাদের উচিত একিন তথা দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়া কারণ বিজয় মুমিন ও মুসলিমদেরই। ফলে আমরা আমাদের বর্তমান অপমানজনক অবস্থা থেকে মুক্ত হতে সক্ষম হব ইনশা আল্লাহ, অথচ আজ আমরা যুলুম ও বাতিলের মোকাবিলা করতে গিয়ে অন্যদের সাহায্য ও সমবেদনার দিকে মুখাপেক্ষী হয়ে থাকি। যদি আমাদের মত করে সাহাবা রাদিয়াল্লাহু আনহুমও নিজেদেরকে খোলসের ভেতর গুটিয়ে নিতেন, নিজেদের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী মনোভাব পোষণ করতেন, নিজেদের উপর চাপ অনুভব করতেন কিংবা অন্যদের কাছে সাহায্যের আবেদন করতেন, তাহলে আজ আমরা যেভাবে তাদের নাম ও খ্যাতির কথা জানি তা জানতাম না, এটা নিশ্চিত। একমাত্র আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মত ও পথে, তাঁর দেখানো পদ্ধতিতেই সর্বোত্তম উদাহরণ রয়েছে আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে, আমরা কি পারি না নিজেদের সম্মান ও মর্যাদাকে সেই পদ্ধতিতেই উদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে ?
আমরা কি পারি না নিজেদেরকে সেই সুনিশ্চিত বিজয়ের অংশ করতে, যার আগমন নিয়ে কোন সন্দেহ নেই?
Comment