৯ হিজরীতে খলিফা উমার ইবন্* আল খাত্তাবের সময় রোমানদের [ইস্টার্ন বিজেন্টিন রোমান এম্পায়ার (Eastern Byzantine Roman Empire)- (আরবীতে ‘আর-রুম’)] সাথে যুদ্ধের সময় কিছু মুসলিম তাদের হাতে ধরা পড়ে। যখন রোমক রাজা হেরাক্লিয়াস [Heraclius] যখন শুনলো যে যুদ্ধবন্দী বা [Prisoners of War (POW)]-দের মধ্যে একজন সাহাবী (রা) আছেন সে খুব খুশি হয়েগেল। সে বললো, তাঁকে আন আমি তাঁর সাথে দেখা করতে চায়। সাহাবাদের (রা) সম্পর্কে ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বে অনেক Legend ছড়িয়ে গিয়েছে, অনেক খবর ছড়িয়ে গিয়েছে তাঁদের Specialty-র ব্যাপারে! তাই তারা খুব মনোঃমু্দ্ধ হয়ে গিয়েছিল, তারা একজন সাহাবীকে (রা) নিজের চোখে দেখতে চাচ্ছিল। সে কারণেই রোমক রাজা, হেরাক্লিয়াস সাহাবীকে (রা) তার কাছে আনতে বললো। কারণ সাহাবারা (রা) একজনই একটা পুরা উম্মত!! উদহারণ স্বরূপ বলা যায়, একবার রোমান [শাম (বর্তমান সিরিয়া,জর্ডান, ইসরাইল (দখলকৃত ফিলিস্তিন), ফিলিস্তিন, লেবানন)] রাজা ইয়ারমুকের যুদ্ধের সময় মুসলিম সৈন্যদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল যে, এরা কেমন? উত্তরে লোকজন তাকে জবাব দিয়েছিল, এরা দিনের বেলা সিংহের মত হিংস্র [যুদ্ধের সময় নিজের জান-প্রাণ দিয়ে কোন পিছুটান ছাড়াই যুদ্ধ করতো, বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতো, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা ছাড়া কাউকে ভয় পেতনা!] আর রাতের বেলা সন্যাসীর [ইবাদতে সারা রাত বা রাতের বেশিরভাগ সময়ই মশগুল থাকতো, আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালার কাছে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে থাকতো!] মত!! এগুলোই ছিল রসুলুল্লাহর (স) Product!!
তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা আস সাহমিকে (রা) রাজার সামনে নিয়ে আসলো। রাজা চিন্তা করছে, কিভাবে এই সাহাবীকে (রা) কাজে লাগানো যায়, তাঁর কাছে থেকে সর্বোচ্চ আদায় করে নেয়া যায়। তাই সে বললো, আমি চাই তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে কর [আসলে সে মনে করতো সাহাবাদের (রা) Gene-এর কিছু বিশেষত্ব আছে! সে চাচ্ছিল যে সেই Gene যেন তার বংশধারা মধ্যে চলে আসে! সে মনে করছিল যে, তার মেয়ে এ সাহাবীকে (রা) বিয়ে করবে এবং তাদের সন্তানগুলো হবে ‘সুপারম্যান’ টাইপের কিছু!]। কিন্তু রাজা তার মেয়েকে তাঁর সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য একটা শর্ত দিয়ে দিল, আর সেটা হলো তাঁকে খৃস্টান হতে হবে! কিন্ত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন।
রাজা আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফাকে (রা) বললেন, শোন তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে কর আমি তোমাকে আমার রাজত্বের অর্ধেক দিয়ে দেব! আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) বললেন, কোন ভাবেই না, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো না [একটু চিন্তা করে দেখেন, অর্ধেক রাজত্ব!! কিছু মুসলমানরা নিজেদের বিক্রি করে দিচ্ছে সামান্য কিছু টাকার জন্য! তার পুরা মুসলিম উম্মাহকে প্রতারিত করছে, মুসলিমদের উপর গোয়েন্দাগিরি করছে, তারা ইহুদি ও খৃস্টানদের পক্ষে কথা বলছে, দৈনিকগুলোতে কলাম লিখছে, টকশোগুলোতে আলোচনা করছে আর আমাদের দেশে, ভারতের হয়ে দালালি করছে! আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা এদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা তাদের দ্বীনকে খুবই কম মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে! তারা ইসলাম ত্যাগ করছে- রিদ্দা! এই সাহাবীকে (রা) বিজেন্টিন রোমান সাম্রাজ্যের অর্ধেক অফার করা হয়েছে, আর তিনি বলেছেন, না!! যদি কেউ এই সকল লোকদের না বলে তারা এটা সহ্য করতে পারেনা! মনেমনে ভাবে, আমি একজন রাজা, কেই আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেনি, না বলেনি এবং আমি কাউকে আমার কন্যাকে অফার করিনি, আর তুমি কিনা আমাকে না বলছো!! তারপর আমি তোমাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দিতে চাচ্ছি আর তুমি বলছো না!! যারা শুধু দুনিয়া নিয়েই চিন্তা করে তারা দুনিয়া পাওয়ার জন্য কত কিছু করে, যখন তারা দেখে কোন ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি বিমুখ সেটা তাদেরকে উন্মাদ করে দেয়, তারা সেটা মেনে নিতে পারে না! যারা দুনিয়া বিমুখ তাদের কাছে এটার মানে এই যে অন্যরা তাদের সারা জীবন ভুল জিনিসের প্রতি ছুটেছে!]।
তাই রাজা বললো, আল-বাকারা [গরুর আকৃতির বড় পাত্র] নিয়ে এসো। এটার মধ্যে মানুষ জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, তারা এটা পুরো তেলে ভর্তি করে এবং তারপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ ধরে তেল আগুনে রেখে উতপ্ত করা হয় যেন তেল ফুটতে শুরু করে! তারপর তারা তার মধ্যে *একজন মুসলিম যুদ্ধবন্দীকে ছুড়ে মারলো! বর্ণনাকারী বললো, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাড়গুলো বের হয়ে চলে আসলো!! তেল এতই গরম ছিল যে তার মাংস ভাজি হয়ে গেল এবং হাড় বেরিয়ে আসলো!! উদহারণ স্বরূপ, আপনি যদি চিকেন উত্তপ্ত তেলের মধ্যে দেন তখন দেখা যায় যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাড়গুলো বের হয়ে আসে! কারণ মাংস সংকুচিত হয়, এটি এর ভিতরকার সব পানি (জলীয়বাষ্পরুপে) হারিয়ে যায় ফলশ্রুতিতে সংকুচিত হয়ে যায় এবং হাড় বেরিয়ে আসে! মুসলিম বন্দীর ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছিল! আর এই ঘটনা ঘটছিল আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) সামনে! তাই সেই রাজা তাঁকে বললো, তুমি কি এখন তোমার ধর্ম পরিত্যাগ করতে চাও? না হলে আমরা তোমাকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেব! হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) বললেন, না, আমি আমার ধর্ম পরিত্যাগ করবো না! তখন রাজা বললো, ওকে ছুড়ে ফেলে দাও।
তারা তাঁকে উপরে তুললো, আবদুল্লাহ (রা) কাঁদতে শুরু করলেন! তারা [সৈন্যরা] রাজার কাছে গেল এবং বললো, সে কাঁদছে। রাজা বললেন, তাঁকে ফেরত আন[সে কাঁদছে, সুতরাং সে দুর্বল হয়ে গেছে, আমরা তাকে পাকড়াও করে ফেলেছি! সুতরাং তাকে নিয়ে এস!]। তারপর রাজা আবদুল্লাহকে (রা) বললেন, তুমি কি তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে এখন রাজী আছো? আবদুল্লাহ বললেন, মনে করবেন না যে আমি মৃত্যু ভয়ে কাঁদছিলাম! আমি যে কারণে কাঁদছিলাম সেটা হল, আমার শুধুমাত্র একটা জীবন আছে এবং আমরা জীবন এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি কাঁদছি এই কারণে যে আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’য়ালা যেন আমাকে ১০০ টি জীবন দেন এবং আমি যেন আমার ১০০ টি জীবনই আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দিতে পারি। আমি যেন ১০০ বারই শহীদ হতে পারি!! কোন কোন বর্ণনায় আছে, যে তিনি বলেছিলেন যে তার শরীরে যতগুলো লোম আছে ততগুলো জীবন যদি আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’য়ালা দেন তবে তিনি তার সবগুলোই আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত আছেন! একটার পর একটা তিনি আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে শহীদ হবেন! আমার মনে হয়, তাঁদের [সাহাবা (রা)] যে ঈমান সেটা আমাদের বোঝার ক্ষমতারও বাইরে!!
আল্লাহু আকবার!
ভাই/বোন আসলে আমাদের এই ধর্ম শুধু বাগাড়ম্বরের ধর্ম নয়, এটা এরকম ধর্ম নয় যে লোকজনকে দেখানো যে আমার বা আপনার কত জ্ঞান আছে, এই ধর্ম/দ্বীন হল -আপনি/আমি আল্লাহ তা’য়ালার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারি! আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা আস সাহমি (রা) তাঁর ঈমান সেই নির্দিষ্ট সময়ে প্রমাণ করেছিলেন। এটাই আসলে সময় যখন দেখানো হয় আপনি কে। আরামের সময় সবাই একই, পার্থক্য করা যায় না, আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না কার কি অবস্থা, কিন্তু যখন পরীক্ষা হয় তখনিই অন্তর থেকে সত্য বের হয়ে আসে! যখন পরীক্ষা দেওয়ার সময় আসলো তখন সত্যিকারের আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) প্রকাশ পেলেন! কেউ জানতো না এমনকি উমার ইবনুল খাত্তাবও (রা) জানতেন না, আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) কে ছিলেন! তাঁরা তাঁকে একজন সাহাবী হিসেবে জানতেন কিন্তু তাঁর কোয়ালিটি সম্পর্কে তাঁরা কেউ জানতেন না। কিন্তু এই কঠিন সময়ে বাস্তবতা প্রকাশ পেয়ে গেল, তাঁর জীবন একটার পর একটা আল্লাহর রাস্তায় দেয়ার যে আকাঙ্খা সেটা প্রকাশ পেয়ে গেল! এটাই ছিল সাহাবাদের (রা) বৈশিষ্ট্য, তাঁদের এই বৈশিষ্টগুলোই তাঁদের চারপাশের লোকজনও বুঝতে পারতো না! উদহারণ স্বরূপ: কুররার প্রতিনিধিরা যাদেরকে রসুলুল্লাহ (স) নাজদ্*-এ পাঠিয়েছিলেন, তাঁদেরকে প্রতারিত করা হয়েছিল। যখন একজন সাহাবা (রা) তাদের গোত্র প্রধানের সাথে দেখা করতে আসলেন তখন তাদের গোত্র প্রধান একজনকে ইশারা করাতে সে পিছন দিক থেকে বর্শা দিয়ে একজন সাহাবাকে (রা) আঘাত করে এফোড় ওফোড় করে দিলেন! একবার সাহাবীর (রা) অবস্থা চিন্তা করুন, তিনি কল্পনাও করেন নি যে তাকে কেউ হত্যা করবে! এটা পুরোটাই তাঁর কাছে বিস্ময়কর ছিল। তারপর তিন দেখছেন তাঁর পেট ভেদ করে বর্শার ফলা বের হয়ে সামনে চলে এসেছে! এটা দেখে তিনি কি বললেন? তাঁর মুখে হাসি বের হলো এবং তিনি হাসিমুখেই বললেন, আল্লাহর নামে, আমি জিতে গিয়েছি, আমি জিতে গিয়েছি!! একজন দর্শক [ঐ গোত্রের] যে ঐসময় উপস্থিত ছিল সে বললো, “আমি এই ঘটনা জীবনে কোন দিনও ভুলবো না, একজন মারা যাচ্ছে অথচ সে কিনা বলছে যে সে জিতে যাচ্ছে!!” সে অবাক হয়ে গেলাম!
যেহেতু সেই ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতো না তাই সে ইসলাম সমন্ধে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। আর তার এই ঘটনার কারণেই সে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলো (সুবহানাল্লাহ!)। দেখুন, সাহাবারা (রা) মরণের সময়ও দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন!!
সুতরাং রোমান রাজা যখন আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কাছ থেকে যখন এরকম দৃঢ়তা দেখতে পেল তখন সে বিব্রত হয়ে গেল। আসলে সে আবদুল্লাহর (রা) কাছে থেকে কিছু চাচ্ছিল, সে সহজেই আবদুল্লাহ কে (রা) মারতে পারে, কিন্তু সে ভাবলো যে তার অহংবোধে আবদুল্লাহ (রা) আঘাত করেছে। তাই রাজার কাছে আবদুল্লাহকে (রা) হত্যা করা কোন ইস্যু নয় বরং তাঁর কাছে থেকে কিছু আদায় করাটাই তার জন্য ইস্যু!! তাঁকে রাজাকে কিছু না কিছু দিতেই হবে!! রাজা তাঁর কাছে থেকে কিছু না কিছু নিয়েই ছাড়বে! তাই সে আবদুল্লাহকে (রা) বললো, তুমি যদি আমার কপালে চুমু খাও তাহলে আমি তোমাকে ও তোমার সাথে *১০০ জন মুসলিম যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেব! দেখুন, একজন রোমান রাজা কতটা বেপরওয়া হয়ে গেছে একজন সাহাবীর কাছে থেকে কিছু পাওয়ার জন্য!! বল এখন রাজার কোর্টে নেই বরং এটা এখন আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কোর্টে [সত্যিকারের মুসলিম হলে বল সবসময় আমাদের কোর্টেই থাকবে-ইন-শা-আল্লাহ]। রাজা আবদুল্লাহর (রা) কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে, আমাকে কিছু দাও, কপালে একটা চুমুই দাও!!
এই হলো তাঁদের কোয়ালিটি যেটা হয়তো আমার আপনার বোঝার সাধ্যেরও বাইরে, তাঁদের ঈমান কতটা শক্তিশালী তা আমার আপনার বোঝারও ক্ষমতার বাইরে আর এই কারণেই তাঁরা এত বেশি সম্মানী!
অনেকক্ষণ চিন্তার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) রাজী হলেন এবং রাজার কপালে চুমু খেলেন। তারপর তিনি মুসলিম বন্দীদের নিয়ে মদীনাতে আসলেন। ইতোমধ্যেই হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফরা কাহিনী মদিনাতে পৌছে গেছে। খলিফা আমিরুল মু’মিনিন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ঘোষণা দিলেন, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এটা বাধ্যতামূলক [কারণ তিনি মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করেছিলেন] যে তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কপালে চুমু খাবে, আর আমি সে দিক থেকে প্রথমেই তা করছি, এই বলে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কপালে চুমু খেলে এরপর অন্যান্য সাহাবী ও মুসলিমরা তাঁর অনুসরণ করলেন।
এটাতো কেবল মাত্র একজন সাহাবীর (রা) দৃষ্টান্ত এরকম অনেক দৃষ্টান্ত ইসলামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!!
এরকমই ছিল রসুলুল্লাহর (স) প্রডাক্ট, তিনি এরকম বিশ্বাসী তৈরি করে দিয়ে যেতে পেরেছিল, আর এই কারণেই সাহাবাদের (রা) সম্মান এত বেশি!! আমাদের উচিৎ তাঁদের পথ অনুসরণ করা কারণ তাঁরা রসুলুল্লাহর (স) আনিত পথের উপর দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা আস সাহমিকে (রা) রাজার সামনে নিয়ে আসলো। রাজা চিন্তা করছে, কিভাবে এই সাহাবীকে (রা) কাজে লাগানো যায়, তাঁর কাছে থেকে সর্বোচ্চ আদায় করে নেয়া যায়। তাই সে বললো, আমি চাই তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে কর [আসলে সে মনে করতো সাহাবাদের (রা) Gene-এর কিছু বিশেষত্ব আছে! সে চাচ্ছিল যে সেই Gene যেন তার বংশধারা মধ্যে চলে আসে! সে মনে করছিল যে, তার মেয়ে এ সাহাবীকে (রা) বিয়ে করবে এবং তাদের সন্তানগুলো হবে ‘সুপারম্যান’ টাইপের কিছু!]। কিন্তু রাজা তার মেয়েকে তাঁর সাথে বিয়ে দেয়ার জন্য একটা শর্ত দিয়ে দিল, আর সেটা হলো তাঁকে খৃস্টান হতে হবে! কিন্ত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন।
রাজা আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফাকে (রা) বললেন, শোন তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে কর আমি তোমাকে আমার রাজত্বের অর্ধেক দিয়ে দেব! আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) বললেন, কোন ভাবেই না, আমি আমার ধর্ম ত্যাগ করবো না [একটু চিন্তা করে দেখেন, অর্ধেক রাজত্ব!! কিছু মুসলমানরা নিজেদের বিক্রি করে দিচ্ছে সামান্য কিছু টাকার জন্য! তার পুরা মুসলিম উম্মাহকে প্রতারিত করছে, মুসলিমদের উপর গোয়েন্দাগিরি করছে, তারা ইহুদি ও খৃস্টানদের পক্ষে কথা বলছে, দৈনিকগুলোতে কলাম লিখছে, টকশোগুলোতে আলোচনা করছে আর আমাদের দেশে, ভারতের হয়ে দালালি করছে! আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা এদের সম্পর্কে বলেছেন, তারা তাদের দ্বীনকে খুবই কম মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছে! তারা ইসলাম ত্যাগ করছে- রিদ্দা! এই সাহাবীকে (রা) বিজেন্টিন রোমান সাম্রাজ্যের অর্ধেক অফার করা হয়েছে, আর তিনি বলেছেন, না!! যদি কেউ এই সকল লোকদের না বলে তারা এটা সহ্য করতে পারেনা! মনেমনে ভাবে, আমি একজন রাজা, কেই আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেনি, না বলেনি এবং আমি কাউকে আমার কন্যাকে অফার করিনি, আর তুমি কিনা আমাকে না বলছো!! তারপর আমি তোমাকে আমার অর্ধেক রাজ্য দিতে চাচ্ছি আর তুমি বলছো না!! যারা শুধু দুনিয়া নিয়েই চিন্তা করে তারা দুনিয়া পাওয়ার জন্য কত কিছু করে, যখন তারা দেখে কোন ব্যক্তি দুনিয়ার প্রতি বিমুখ সেটা তাদেরকে উন্মাদ করে দেয়, তারা সেটা মেনে নিতে পারে না! যারা দুনিয়া বিমুখ তাদের কাছে এটার মানে এই যে অন্যরা তাদের সারা জীবন ভুল জিনিসের প্রতি ছুটেছে!]।
তাই রাজা বললো, আল-বাকারা [গরুর আকৃতির বড় পাত্র] নিয়ে এসো। এটার মধ্যে মানুষ জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, তারা এটা পুরো তেলে ভর্তি করে এবং তারপর তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ ধরে তেল আগুনে রেখে উতপ্ত করা হয় যেন তেল ফুটতে শুরু করে! তারপর তারা তার মধ্যে *একজন মুসলিম যুদ্ধবন্দীকে ছুড়ে মারলো! বর্ণনাকারী বললো, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাড়গুলো বের হয়ে চলে আসলো!! তেল এতই গরম ছিল যে তার মাংস ভাজি হয়ে গেল এবং হাড় বেরিয়ে আসলো!! উদহারণ স্বরূপ, আপনি যদি চিকেন উত্তপ্ত তেলের মধ্যে দেন তখন দেখা যায় যে কিছুক্ষণের মধ্যেই হাড়গুলো বের হয়ে আসে! কারণ মাংস সংকুচিত হয়, এটি এর ভিতরকার সব পানি (জলীয়বাষ্পরুপে) হারিয়ে যায় ফলশ্রুতিতে সংকুচিত হয়ে যায় এবং হাড় বেরিয়ে আসে! মুসলিম বন্দীর ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছিল! আর এই ঘটনা ঘটছিল আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) সামনে! তাই সেই রাজা তাঁকে বললো, তুমি কি এখন তোমার ধর্ম পরিত্যাগ করতে চাও? না হলে আমরা তোমাকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেব! হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) বললেন, না, আমি আমার ধর্ম পরিত্যাগ করবো না! তখন রাজা বললো, ওকে ছুড়ে ফেলে দাও।
তারা তাঁকে উপরে তুললো, আবদুল্লাহ (রা) কাঁদতে শুরু করলেন! তারা [সৈন্যরা] রাজার কাছে গেল এবং বললো, সে কাঁদছে। রাজা বললেন, তাঁকে ফেরত আন[সে কাঁদছে, সুতরাং সে দুর্বল হয়ে গেছে, আমরা তাকে পাকড়াও করে ফেলেছি! সুতরাং তাকে নিয়ে এস!]। তারপর রাজা আবদুল্লাহকে (রা) বললেন, তুমি কি তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে এখন রাজী আছো? আবদুল্লাহ বললেন, মনে করবেন না যে আমি মৃত্যু ভয়ে কাঁদছিলাম! আমি যে কারণে কাঁদছিলাম সেটা হল, আমার শুধুমাত্র একটা জীবন আছে এবং আমরা জীবন এখন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি কাঁদছি এই কারণে যে আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’য়ালা যেন আমাকে ১০০ টি জীবন দেন এবং আমি যেন আমার ১০০ টি জীবনই আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে দিতে পারি। আমি যেন ১০০ বারই শহীদ হতে পারি!! কোন কোন বর্ণনায় আছে, যে তিনি বলেছিলেন যে তার শরীরে যতগুলো লোম আছে ততগুলো জীবন যদি আল্লাহ সুবহানাহুয়া তা’য়ালা দেন তবে তিনি তার সবগুলোই আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত আছেন! একটার পর একটা তিনি আল্লাহর রাস্তায় দিয়ে শহীদ হবেন! আমার মনে হয়, তাঁদের [সাহাবা (রা)] যে ঈমান সেটা আমাদের বোঝার ক্ষমতারও বাইরে!!
আল্লাহু আকবার!
ভাই/বোন আসলে আমাদের এই ধর্ম শুধু বাগাড়ম্বরের ধর্ম নয়, এটা এরকম ধর্ম নয় যে লোকজনকে দেখানো যে আমার বা আপনার কত জ্ঞান আছে, এই ধর্ম/দ্বীন হল -আপনি/আমি আল্লাহ তা’য়ালার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারি! আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা আস সাহমি (রা) তাঁর ঈমান সেই নির্দিষ্ট সময়ে প্রমাণ করেছিলেন। এটাই আসলে সময় যখন দেখানো হয় আপনি কে। আরামের সময় সবাই একই, পার্থক্য করা যায় না, আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না কার কি অবস্থা, কিন্তু যখন পরীক্ষা হয় তখনিই অন্তর থেকে সত্য বের হয়ে আসে! যখন পরীক্ষা দেওয়ার সময় আসলো তখন সত্যিকারের আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) প্রকাশ পেলেন! কেউ জানতো না এমনকি উমার ইবনুল খাত্তাবও (রা) জানতেন না, আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) কে ছিলেন! তাঁরা তাঁকে একজন সাহাবী হিসেবে জানতেন কিন্তু তাঁর কোয়ালিটি সম্পর্কে তাঁরা কেউ জানতেন না। কিন্তু এই কঠিন সময়ে বাস্তবতা প্রকাশ পেয়ে গেল, তাঁর জীবন একটার পর একটা আল্লাহর রাস্তায় দেয়ার যে আকাঙ্খা সেটা প্রকাশ পেয়ে গেল! এটাই ছিল সাহাবাদের (রা) বৈশিষ্ট্য, তাঁদের এই বৈশিষ্টগুলোই তাঁদের চারপাশের লোকজনও বুঝতে পারতো না! উদহারণ স্বরূপ: কুররার প্রতিনিধিরা যাদেরকে রসুলুল্লাহ (স) নাজদ্*-এ পাঠিয়েছিলেন, তাঁদেরকে প্রতারিত করা হয়েছিল। যখন একজন সাহাবা (রা) তাদের গোত্র প্রধানের সাথে দেখা করতে আসলেন তখন তাদের গোত্র প্রধান একজনকে ইশারা করাতে সে পিছন দিক থেকে বর্শা দিয়ে একজন সাহাবাকে (রা) আঘাত করে এফোড় ওফোড় করে দিলেন! একবার সাহাবীর (রা) অবস্থা চিন্তা করুন, তিনি কল্পনাও করেন নি যে তাকে কেউ হত্যা করবে! এটা পুরোটাই তাঁর কাছে বিস্ময়কর ছিল। তারপর তিন দেখছেন তাঁর পেট ভেদ করে বর্শার ফলা বের হয়ে সামনে চলে এসেছে! এটা দেখে তিনি কি বললেন? তাঁর মুখে হাসি বের হলো এবং তিনি হাসিমুখেই বললেন, আল্লাহর নামে, আমি জিতে গিয়েছি, আমি জিতে গিয়েছি!! একজন দর্শক [ঐ গোত্রের] যে ঐসময় উপস্থিত ছিল সে বললো, “আমি এই ঘটনা জীবনে কোন দিনও ভুলবো না, একজন মারা যাচ্ছে অথচ সে কিনা বলছে যে সে জিতে যাচ্ছে!!” সে অবাক হয়ে গেলাম!
যেহেতু সেই ব্যক্তি ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতো না তাই সে ইসলাম সমন্ধে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো। আর তার এই ঘটনার কারণেই সে পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করলো (সুবহানাল্লাহ!)। দেখুন, সাহাবারা (রা) মরণের সময়ও দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন!!
সুতরাং রোমান রাজা যখন আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কাছ থেকে যখন এরকম দৃঢ়তা দেখতে পেল তখন সে বিব্রত হয়ে গেল। আসলে সে আবদুল্লাহর (রা) কাছে থেকে কিছু চাচ্ছিল, সে সহজেই আবদুল্লাহ কে (রা) মারতে পারে, কিন্তু সে ভাবলো যে তার অহংবোধে আবদুল্লাহ (রা) আঘাত করেছে। তাই রাজার কাছে আবদুল্লাহকে (রা) হত্যা করা কোন ইস্যু নয় বরং তাঁর কাছে থেকে কিছু আদায় করাটাই তার জন্য ইস্যু!! তাঁকে রাজাকে কিছু না কিছু দিতেই হবে!! রাজা তাঁর কাছে থেকে কিছু না কিছু নিয়েই ছাড়বে! তাই সে আবদুল্লাহকে (রা) বললো, তুমি যদি আমার কপালে চুমু খাও তাহলে আমি তোমাকে ও তোমার সাথে *১০০ জন মুসলিম যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেব! দেখুন, একজন রোমান রাজা কতটা বেপরওয়া হয়ে গেছে একজন সাহাবীর কাছে থেকে কিছু পাওয়ার জন্য!! বল এখন রাজার কোর্টে নেই বরং এটা এখন আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কোর্টে [সত্যিকারের মুসলিম হলে বল সবসময় আমাদের কোর্টেই থাকবে-ইন-শা-আল্লাহ]। রাজা আবদুল্লাহর (রা) কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে, আমাকে কিছু দাও, কপালে একটা চুমুই দাও!!
এই হলো তাঁদের কোয়ালিটি যেটা হয়তো আমার আপনার বোঝার সাধ্যেরও বাইরে, তাঁদের ঈমান কতটা শক্তিশালী তা আমার আপনার বোঝারও ক্ষমতার বাইরে আর এই কারণেই তাঁরা এত বেশি সম্মানী!
অনেকক্ষণ চিন্তার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফা (রা) রাজী হলেন এবং রাজার কপালে চুমু খেলেন। তারপর তিনি মুসলিম বন্দীদের নিয়ে মদীনাতে আসলেন। ইতোমধ্যেই হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফরা কাহিনী মদিনাতে পৌছে গেছে। খলিফা আমিরুল মু’মিনিন হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) ঘোষণা দিলেন, প্রত্যেক মুসলিমের জন্য এটা বাধ্যতামূলক [কারণ তিনি মুসলিম যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করেছিলেন] যে তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কপালে চুমু খাবে, আর আমি সে দিক থেকে প্রথমেই তা করছি, এই বলে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবন্* হুদাফার (রা) কপালে চুমু খেলে এরপর অন্যান্য সাহাবী ও মুসলিমরা তাঁর অনুসরণ করলেন।
এটাতো কেবল মাত্র একজন সাহাবীর (রা) দৃষ্টান্ত এরকম অনেক দৃষ্টান্ত ইসলামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে!!
এরকমই ছিল রসুলুল্লাহর (স) প্রডাক্ট, তিনি এরকম বিশ্বাসী তৈরি করে দিয়ে যেতে পেরেছিল, আর এই কারণেই সাহাবাদের (রা) সম্মান এত বেশি!! আমাদের উচিৎ তাঁদের পথ অনুসরণ করা কারণ তাঁরা রসুলুল্লাহর (স) আনিত পথের উপর দৃঢ়ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
Comment