ইতিহাসে দুইজন সেনাপতি আছেন যারা জীবনে কোনদিন একটি যুদ্ধেও হারে নি, একজন হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ (রা) [মুসলিমদের বিরুদ্ধে ও মুসলিমদের সাথে যুদ্ধে] ও আরেক জন তেমুদজিন বা চেংগিস খান [‘খান’ অর্থ রাজা বা শাসনকর্তা]। মঙ্গলদের সাম্রাজ্যের [একটানা] মত এত বড় [৩ কোটি ৩০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার] সাম্রাজ্য পুরো পৃথিবীতে কেউ দখল করতে পারেনি!! অবশ্য ব্রিটিশদের ছিল ৩ কোটি ৩৭ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার, কিন্তু সেটা ভিন্ন ভিন্ন স্থানে একসাথে নয়! মঙ্গলদের সাম্রাজ্য দখলের যাত্রা শুরু হয় ১২০৬ সালে এবং তাদের সাম্রাজ্যের অগ্রগতির শিখরে উঠে ১২৭৬ সালে।
চেংগিস খান ও তার বংশধরেরা মুসলিমদের সাথে যা করেছে তা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। পশ্চিমা ইতিহাসবিদরা বলেন, “তারা পোল্যান্ডে পৌছায়, বুলগেরিয়াতে পৌছায়, মস্কোতে পৌছায় কিন্তু তারা মুসলিমদের সাথে যা করেছে তা নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে অদ্বিতীয়।” যখন তারা বুখারা [উজবেকিস্তানের একটা শহর যেখানে ইমাম বুখারি (র), ইবন্* সিনা প্রমুখ জন্মগ্রহণ করেন] দখল করে তখন তারা সকল মুসলিমদের মসজিদে জড়ো করে এবং হত্যা করে। যখন তারা সমরকান্দ [বর্তমান কাজাকিস্তানের একটি শহর] দখল করে তখন প্রত্যেক মুসলিমকে সমরকান্দের বাইরে নিয়ে আসে এবং প্রত্যেককে হত্যা করে। তারপর তারা তাদের [মুসলিম] মাথা দিয়ে পিরামিড তৈরি করে!! বিখ্যাত ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেন, যখন তারা গুরগাঁও, জুওয়াইনি দখল করে তখন ৫০,০০০ মঙ্গল সৈন্যের প্রত্যেককে ২৪ টি করে মুসলিম হত্যা করতে দেয়া হয়!! মোট ১২,০০,০০০ [বারো লক্ষ!] মুসলিমকে হত্যা করা হয়!!! এরা ছিল জীবন্ত কিলিং মেশিন!! একবার চিন্তা করেন তখন কোন যন্ত্র ছিল না, প্রত্যেককে তরবারি দিয়ে হত্যা করা লেগেছে অবস্থাটা একবার চিন্তা করেন!!
মঙ্গলরা যখন এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল সেটা মূলত ছিল পারস্যতে আর সেখানকার অধিবাসীরা ছিল শিয়া মুসলিম। সেই সময় বাগদাদের সুন্নী মুসলিমরা বলেছিল যে শিয়ারা পাপ করেছে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে তাই আল্লাহ তাদের এই শাস্তি দিয়েছেন!! সুন্নীরা শিয়াদের দূরবস্থাতে মনে মনে কিছুটা খুশিই হয়েছিল!! কিন্তু তাদের খুশি শিঘ্রই চিরদিনের মতই উবে যায় কারণ এরপর যে ঘটনা ঘটবে সেই ইতিহাসে অদৃশ্যপূর্ব!!!
এরপর তারা কোথায় রওনা দিল! বাগদাদ!! বাগদাদ তখন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও সুন্দর শহর!! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ, প্রযুক্তবিদ, স্থাপত্যবিদের মিলন মেলা। সেটি ছিল বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্র!! জ্ঞানের শহর, আলোর শহর!! পৃথিবীর রত্ন!! তখন খলিফা ছিলেন মুসতাসিম। হালাকু খান যখন বাগদাদের কিনারায় আসলো তখন মুসতাসিম তার উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করলো। তার উপদেষ্টারা হালাকু খানের সাথে শান্তিচুক্তির পরামর্শ দিল। হালাকু খান তখন খলিফার কাছে বার্তা পাঠালো যে, যদি বাইরে শান্তি আলোচনার জন্য আসতেই হয় তবে একা না এসে সকল উপদেষ্টদের যেন সাথে নিয়ে আসা হয়!! তাই মুসতাসিম তার সাথে ৭০০ উপদেষ্টা নিয়ে আসলো। হালাকু মুসতাসিমের সাথে ৮০ জনকে তার তাবুতে প্রবেশ করতে দিল আর বাকিদের বাইরে রাখলো এবং প্রত্যেককে হত্যা করলো!!!
এই ৭০০ জন ছিল বাগদাদের “Cream of the Crops” সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবি! আর তারা তাদের প্রত্যককে হত্যা করলো!! আর এখন মুসতাসিম; হালাকু খান, মঙ্গল রাজপুত্রের দরবারে দাড়িয়ে আছে। সেই একই মুসতাসিম যার নিজেরও দরবার আছে যেখানে সে লোকজনকে তিরস্কার করতো ভর্ৎসনা করতো! সেই মুসতাসিম হালাকুর সামনে ভয়ে কাঁপছে!! হালাকু মুসতাসিমকে বললো, “আমি তোমাকে কিছু সময়ের জন্য জীবিত রাখবো।” হালাকু আসলে তাকে জীবিত রাখতে চাচ্ছিল কারন সে তাকে বাগদাদে নিয়ে যাবে এবং তাকে [মুসতাসিম] দিয়ে বাগদাদের মুসলিম সৈন্যদের অস্ত্র রেখে দেয়াবে যেন তারা মঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ না করে!!
মুসতাসিমকে মঙ্গলরা বাগদাদে নিয়ে গেল এবং তার তিন সন্তানকে তার সামনে নিয়ে আসলো এবং সবাইকে হত্যা করলো!! তারপর তারা মুসতাসিমের সামনে তার বোনদের নিয়ে আসলো এবং তার সমনেই প্রত্যেককে হত্যা করলো!! তারপর তারা বাগদাদের সব উলেমাদের একত্রিত করলো এবং সকল সুন্নি উলেমাদের হত্যা করলো!! তারপর হালাকু বললো, “মুসলিমদের রক্ত তোমাদের জন্য হালাল!!” তারপর পরবর্তী ৪০ দিন তারা নির্দয়ভাবে মুসলিমদের হত্যা করতে লাগলো!! তখনকার দিনে কোন মেশিনগান ছিল না, তখন তারা মুসলিমদের লাইনে দাড় করালো এবং যে রকম করে পোলট্রি খামার থেকে মুরগির বাচ্চা বাছাই করা হয় তারা ঠিক সেভাবে বাছাই করে মুসলিমদের হত্যা করতে লাগলো!! টানা ৪০ দিন ধরে এই হত্যাকান্ড চলতে থাকলো!! মুসলিমরা এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, একজন মঙ্গল নারী একটি বাড়িতে ঢুকতো এবং সে বাড়ির প্রত্যেককে হত্যা করতো এবং কেউ তার প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পেত না!!! মঙ্গল নারীরা একদল মুসলিম পুরুষদের যদি বলতো, “এখান থেকে একচুলও নড়বে না” এবং তারা সেখান থেকে নড়তো না!! সে [মঙ্গল নারী] সেই পুরুষদের বাড়িতে যেত এবং তার তরবারি বের করতো এবং সে প্রত্যেককে হত্যা করতো!!!
বর্ণনা অনুসারে, একজন মঙ্গল ৪০ জন শিশুকে হত্যা করতো [তাদের মায়েদের হত্যার পর]!! পুরো বাগদাদ শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ আর সেখানকার অর্ধেক লোককে মঙ্গলরা হত্যা করেছিল!! ইবন্* কাসির তার “বিদায়া ওয়া নিহায়া”-তে বলেন যে, মঙ্গলরা এত মানুষকে হত্যা করেছিল যে তাদের রক্ত রাস্তার উপর দিয়ে পানির মত গড়াবে!! ৪০ দিন পর হালাকু খান বাগদাদে আসলো এবং হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার নির্দেশ দিল। অনেক মুসলিম কবর খুঁড়ে রেখেছিল এবং তারা এই কবরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল!! অনেকে বাঁচার জন্য কুকুর, বিড়াল এমনকি মৃত মানুষ পর্যন্ত খেয়েছিল!!
তারপর হালাকু মুসতাসিমের কাছে আসলো এবং বললো, “তোমার সম্পদ আমার কাছে নিয়ে আস!” সুতরাং সে তার সম্পদ তার কাছে নিয়ে আসলো। হালাকু বললো, “না, প্রাসাদের মাঝে কোটরের মধ্যে যে সম্পদ লুকিয়ে রেখেছো সেগুলো নিয়ে আস!” আর এই কোটরের মধ্যে যে স্বর্ন ছিল তা গত ৫০০ বছর ধরে আব্বাসীয়রা জমা করে রেখেছিল!!! তারপর তারা মুসতাসিমকে বন্দি করলো এবং তাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখলো!! মুসতাসিম খাবারের জন্য বললো এবং হালাকু তাকে প্লেটের উপর স্বর্ণ দিয়ে পাঠালো!! মুসতাসিম বললো, আমি এই স্বর্ণ দিয়ে কি করবো তাই সে সেটা ফেরত পাঠালো। তারপর হালাকু খান তার কাছে গেল এবং বললো, যদি তুমি এটা না-ই খেতে পার তবে কেন এটা জমা করে রেখেছিলে!!! [সুবহানাল্লাহ!! একজন অমুসলিম একজন মুসলিম খলিফাকে এই কথা বলছে!!!] “কেন তুমি এটা তোমার সৈন্যদের এগুলো দিলে না যাতে তারা তোমার পক্ষে লড়াই করতে রাজি হতো, তোমার জন্য জীবন দিতে রাজি হতো?? তারপর সে মুসতাসিমকে বাগদাদের বড় বড় গেটগুলো দেখাতে নিয়ে গেল এবং বললো, এই ধাতব গেটগুলোর কি কাজে লাগবে যদি না সেটা রক্ষা করার জন্য কোন লোক না থাকে? কেন তুমি এই গেটগুলো ভেঙে বর্শা তৈরি করে তোমার লোকজনকে দিলে না?” মুসতাসিম উত্তরে বললো, “এটা কদ্*রুল্লাহ [আল্লাহর শক্তি]!!” হালাকু বললো, “আমি তোমাকে কদ্*রুল্লাহ দেখাচ্ছি!” তারপর তারা তাকে [মুসতাসিম] কার্পেটে মোড়ালো এবং তাকে ঘোড়া দিয়ে পাঁড়িয়ে হত্যা করলো [মঙ্গলরা একটা নীতি মেনে চলতো যে তারা কোন রাজার রক্ত মাটিতে পড়তে দিবে না (মস্তকচ্ছেদ) তাই তারা মুসতাসিমকে তরবারি দিয়ে হত্যার পরিবর্তে কার্পেটে মুড়িয়েছিল যাতে রক্ত মাটিতে না পড়ে!!]!!
দারুল হিকমা [The House of Knowledge] পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি ছিল। কোটি কোটি বই ছিল সেখানে। সেই সময়ে আরবরা বাজারে বই বিক্রি করতো, যখন ইউরোপের আশ্রমে [গবেষণা বা পড়াশোনার কাজ আশ্রমেই বেশি করা হতো] ৪-৫ টি বই থাকলেই বিরাট ব্যাপার ছিল সেখানে মুসলিমরা বাজারে আলু-পটলের মত বই বিক্রি করতো!! মুসলিমরা চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরি পদ্ধতি শিখে এবং সেই প্রযুক্তি অনেক উন্নতি সাধন করে ফলশ্রুতিতে তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সহজেই লিপিবদ্ধ করতে শিখে।
বাগদাদের খলিফা মামুন দারুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করার পর জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে পৃথিবীর যে প্রান্তে যে বই আছে, যে জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো আরবিতে অনুবাদ করতে। তখন অনুবাদ একটা বিশাল অর্থ আয়ের উৎস হয়ে যায়, কারণ অনুবাদ করলেই নগদ দিনার [স্বর্ণমুদ্রা]। মুসলিম, অমুসলিম সবাই যেখান থেকে পারে তারা বই অনুবাদ করা শুরু করে দিল। আগে জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। গ্রিক, ভারতবর্ষ, চীন, মিসরীয় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু মুসলিমরা এসব জ্ঞান একত্রিত করে। তারা গ্রিক, ভারতীয়, চীনা প্রভৃতি সভ্যতার জ্ঞানগুলো সব আরবিতে অনুবাদ করে। আরবদের মাধ্যমেই বিশ্বের সকল জ্ঞান একত্রিত হয়!! ইউরোপে গ্রিকদের বই বা জ্ঞান অনুশীলন করা চার্চ কর্তৃক নিষেধ ছিল। গ্রিকদের বই বা জ্ঞান চর্চা করা ছিল ধর্মবিরোধিতা [Heresy] করার সামিল!!
পশ্চিমারা এরিস্টোটল, টলেমি, প্লেটো, থিওফ্রাসটাস, সক্রেটস্* প্রভৃতিদের সমন্ধে জানলো কাদের মাধ্যমে? এই মুসলিমদের মাধ্যমে! আরবি ছিল তখনার আন্তর্জাতিক ভাষা, ঠিক আজকে যেমনটা ইংরেজি!! তখন খৃষ্টান, ইহুদি, বর্ণ গোত্রের লোকেরা জ্ঞানের জন্য আরবি ভাষা শিখতো। বাগদাদে মুসলিম বিজ্ঞানীর পাশাপাশি ইহুদি, খৃস্টান বিজ্ঞানীরাও ছিল, তারা সবাই একসাথে বিজ্ঞানের চর্চা করতো!! মুসলিমরা উদার ছিল, তারা ইহুদি পন্ডিত ও জ্ঞানীদের কাছে থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞান শিখতো এবং একসাথে কাজ করতো! বাগদাদ ছিল তখনকার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, সেরা জ্ঞানীরা আসতো বাগদাদে!! মুসলিম শাসকদের সাথে ইউরোপের খৃস্টান শাসকদের চুক্তি ছিল তারা যেন তাদের গ্রিক বা রোমানদের বইগুলো দেয় যাতে তারা সেগুলো আরবিতে অনুবাদ করে পুনরায় তাদের ফেরত দিবে! ইউরোপে রেঁনেসার ভিত গেঁথে দিয়েছিল এই বাগদাদ, কারণ বাগদাদ থেকে বই যেত আল-আন্দালুস বা মুসলিম স্পেনে আর স্পেন ছিল “আলোর শহর [The City of Light]” যেখানে ইউরোপের পন্ডতরা জ্ঞানের জন্য আসতো। হায়ারোগ্লিফিক্স [চিত্রের মাধ্যমে লেখা] যেটা পশ্চিমারা মনে করতো যে ১৭৯৯ সালে ফরাসি ভাষাবিদ জ্যঁ ফ্রাসোঁয়া শাম্পিওঁ [Jean-François Champollion] পুনরুদ্ধার করে আসলে আরবরা ১০ম শতাব্দিতেই সেটা করে কিন্তু তারা এটাকে গুরত্বপূর্ন মনে না করায় তারা এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি!! এ বিষয়ে লিংক:
তারা জ্ঞানার্জনের জন্য আরবি ভাষা শিখেছিল এবং আরবের বইগুলো তারা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করে, পরে সেগুলো অন্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ হয় [মাইকেল স্কট আরবি ভাষায় মুসলিম স্পেন থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান শিখে সেগুলো ফ্রান্সে নিয়ে যায় এবং অনুবাদ করে!]!! ইন-শা-আল্লাহ অন্য কোন পোস্টে মুসলিম স্পেন নিয়ে পোস্ট দেয়া হবে।
যাইহোক, এই মঙ্গলরা বাগদাদ দখল করার পর তারা হাজার হাজার বছরের জ্ঞান, দারুল হিকমার বইগুলো সব ধ্বংস করে দিল!! তারা সব বই ফোরাত নদীতে ভাসিয়ে দিল!! এতো পরিমান বই তারা নষ্ট করেছিল যে পুরো ফোরাত নদীর পানি বই-এর কালিতে কালো হয়ে গিয়েছিল!! বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শেষ!! কিন্তু পৃথিবীবাসীর সৌভাগ্য যে বাগদাদের বইগুলো কপি করা হয়েছিল এবং সেগুলো পাঠানো হয়েছিল মুসলিম স্পেন বা আল-আন্দালুসে!! কিন্তু এশিয়ার জ্ঞান শেষ, জ্ঞান চলে গেল ইউরোপে আর সে কারণেই এশিয়া জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে গেল আর ইউরোপ রকেটের গতি জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে গেল, যার পরবর্তী পরিণতি ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি ও ডাচদের উপনিবেশ!!
বাগদাদ মৃত মানুষের শহরে [Necropolis] পরিণত হয়েছিল। লাশের দুর্গন্ধে, খাবার পানির অভাবে অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল! আবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। মঙ্গলরা বাগদাদ ছেড়ে তখন চলে গেল সাথে সাথে শেষ করে দিল আরবের ও এশিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান যেটার প্রতিধ্বনি এখনো আরবে আর এশিয়াতে প্রতিফলিত হচ্ছে!!
যে মঙ্গলরা মুসলিমদের এত ক্ষতি করলো, তার মাত্র ৮০ বছরের ব্যবধানে প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গেল!!! বিশ্বের ইতিহাসে এটা বিরল যে বিজয়ীরা বিজিতদের ধর্ম গ্রহণ করে!! কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল ভিন্ন!! কিভাবে? ইসলামিক দাওয়াতের কারনে, এই দাওয়াত ছিল প্রাকটিকাল দাওয়াত; মুসলিম বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহর দ্বীন মেনে চলতো বা চলা শুরু করলো [কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই তাদের উপর এই ভয়াবহ আজাব এসেছে], তারা আল্লাহর নির্দেশমত জীবন যাপন করতে লাগলো। আর স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর দ্বীন সকল দ্বীনের উপর বিজয় লাভ করবে যেটা আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন সেটাই হলো, মঙ্গলরা ইসলাম কবুল করলো!! আর মুসলিমাহরা [নারী মুসলিম] এক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন তারাই মূলতঃ আল্লাহর দ্বীনকে মঙ্গলদের কাছে তুলে ধরেন!!
“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের [জীবন ব্যাবস্থা] উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।”
[আল-কুরআন, সুরা: আত-তওবা আয়াত: ৩৩]
সেই মঙ্গল যারা মুসলিম সামরকান্দ, বুখারা, গুরগাঁও, জুয়াইনি, বাগদাদে যে ভয়াবহ তান্ডব চালিয়েছে তাদের বংশধরেরাই ভারতবর্ষে মুঘল [আরবিতে মঙ্গলদের বলা হয় “মুঘল”!!] সাম্রাজ্যের সূচনা করে!! মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবুর ছিল তৈমুর লং-এর বংশধর!!!
আরবরা সেই যে তাদের অবস্থান হারালো সেই অবস্থান আর তার ফিরে পায় নি। তারা আল্লাহর দ্বীনকে ঠিকভাবে নেয় নি সেই কারণে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা তাদের কাছ থেকে ইসলামী শক্তির নেতৃত্ব অনারবদের হাতে দিয়ে দিলেন! কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বর্ণনা করেছেন:
“...যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।”
[আল-কুরআন, সুরা: মুহাম্মাদ আয়াত: ৪৮]
ইসলামের পতাকা বহন করতে লাগলো তুর্কিমেনিস্তানে জন্ম নেয়া এক মুসলিম ওসমান বে। যার বংশধরেরা পরবর্তীতে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেন, ইতিহাস যেটাকে উসমানীয় সাম্রাজ্য [Ottoman Empire] বলে চিনে। যেটা ছিল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃত যার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল বর্তমান বিশ্বের ৪৩ টি দেশ!! যার আয়তন [Area] ছিল ৫২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার! ইউরোপের ভিয়েনা পর্যন্ত [অস্ট্রিয়ার রাজধানী] তাদের দখলে চলে এসেছিল!! যদি না আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বৃষ্টি দিতেন [সুলতান সুলাইমানের সময়, যাকে বলা হয় “Suleiman the Magnificent” তার সময়ে ১৫২৯ সালে ভিয়েনা দখলের সময় বৃষ্টির কারণ মুসলিমরা কামান নিয়ে যেতে পারেনি আর সে কারণে ভিয়েনার দূর্গও ভাঙ্গা সম্ভব হয়ে উঠেনি!] তবে জার্মানিসহ পুরো ইউরোপ তাদের অধীনে চলে আসতো!!
আরবরা এখনো তাদের সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি তাই তারা এখনো দুনিয়াতে শোচনীয় অবস্থায় আছে, আমরাও আছি কারণ আমরাও তাদের মতই আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারিনি। যেদিন সেটা করতে পারবো ইন-শা-আল্লাহ আবারও আমরা এই দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত হব।
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।....”
[আল-কুরআন, সুরা: আলে-ইমরান আয়াত:১০৩]
চেংগিস খান ও তার বংশধরেরা মুসলিমদের সাথে যা করেছে তা ইতিহাসে অভূতপূর্ব। পশ্চিমা ইতিহাসবিদরা বলেন, “তারা পোল্যান্ডে পৌছায়, বুলগেরিয়াতে পৌছায়, মস্কোতে পৌছায় কিন্তু তারা মুসলিমদের সাথে যা করেছে তা নিষ্ঠুরতার দিক দিয়ে অদ্বিতীয়।” যখন তারা বুখারা [উজবেকিস্তানের একটা শহর যেখানে ইমাম বুখারি (র), ইবন্* সিনা প্রমুখ জন্মগ্রহণ করেন] দখল করে তখন তারা সকল মুসলিমদের মসজিদে জড়ো করে এবং হত্যা করে। যখন তারা সমরকান্দ [বর্তমান কাজাকিস্তানের একটি শহর] দখল করে তখন প্রত্যেক মুসলিমকে সমরকান্দের বাইরে নিয়ে আসে এবং প্রত্যেককে হত্যা করে। তারপর তারা তাদের [মুসলিম] মাথা দিয়ে পিরামিড তৈরি করে!! বিখ্যাত ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেন, যখন তারা গুরগাঁও, জুওয়াইনি দখল করে তখন ৫০,০০০ মঙ্গল সৈন্যের প্রত্যেককে ২৪ টি করে মুসলিম হত্যা করতে দেয়া হয়!! মোট ১২,০০,০০০ [বারো লক্ষ!] মুসলিমকে হত্যা করা হয়!!! এরা ছিল জীবন্ত কিলিং মেশিন!! একবার চিন্তা করেন তখন কোন যন্ত্র ছিল না, প্রত্যেককে তরবারি দিয়ে হত্যা করা লেগেছে অবস্থাটা একবার চিন্তা করেন!!
মঙ্গলরা যখন এই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল সেটা মূলত ছিল পারস্যতে আর সেখানকার অধিবাসীরা ছিল শিয়া মুসলিম। সেই সময় বাগদাদের সুন্নী মুসলিমরা বলেছিল যে শিয়ারা পাপ করেছে, আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে তাই আল্লাহ তাদের এই শাস্তি দিয়েছেন!! সুন্নীরা শিয়াদের দূরবস্থাতে মনে মনে কিছুটা খুশিই হয়েছিল!! কিন্তু তাদের খুশি শিঘ্রই চিরদিনের মতই উবে যায় কারণ এরপর যে ঘটনা ঘটবে সেই ইতিহাসে অদৃশ্যপূর্ব!!!
এরপর তারা কোথায় রওনা দিল! বাগদাদ!! বাগদাদ তখন বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ও সুন্দর শহর!! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ, প্রযুক্তবিদ, স্থাপত্যবিদের মিলন মেলা। সেটি ছিল বর্তমানের যুক্তরাষ্ট্র!! জ্ঞানের শহর, আলোর শহর!! পৃথিবীর রত্ন!! তখন খলিফা ছিলেন মুসতাসিম। হালাকু খান যখন বাগদাদের কিনারায় আসলো তখন মুসতাসিম তার উপদেষ্টাদের সাথে পরামর্শ করলো। তার উপদেষ্টারা হালাকু খানের সাথে শান্তিচুক্তির পরামর্শ দিল। হালাকু খান তখন খলিফার কাছে বার্তা পাঠালো যে, যদি বাইরে শান্তি আলোচনার জন্য আসতেই হয় তবে একা না এসে সকল উপদেষ্টদের যেন সাথে নিয়ে আসা হয়!! তাই মুসতাসিম তার সাথে ৭০০ উপদেষ্টা নিয়ে আসলো। হালাকু মুসতাসিমের সাথে ৮০ জনকে তার তাবুতে প্রবেশ করতে দিল আর বাকিদের বাইরে রাখলো এবং প্রত্যেককে হত্যা করলো!!!
এই ৭০০ জন ছিল বাগদাদের “Cream of the Crops” সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবি! আর তারা তাদের প্রত্যককে হত্যা করলো!! আর এখন মুসতাসিম; হালাকু খান, মঙ্গল রাজপুত্রের দরবারে দাড়িয়ে আছে। সেই একই মুসতাসিম যার নিজেরও দরবার আছে যেখানে সে লোকজনকে তিরস্কার করতো ভর্ৎসনা করতো! সেই মুসতাসিম হালাকুর সামনে ভয়ে কাঁপছে!! হালাকু মুসতাসিমকে বললো, “আমি তোমাকে কিছু সময়ের জন্য জীবিত রাখবো।” হালাকু আসলে তাকে জীবিত রাখতে চাচ্ছিল কারন সে তাকে বাগদাদে নিয়ে যাবে এবং তাকে [মুসতাসিম] দিয়ে বাগদাদের মুসলিম সৈন্যদের অস্ত্র রেখে দেয়াবে যেন তারা মঙ্গলদের সাথে যুদ্ধ না করে!!
মুসতাসিমকে মঙ্গলরা বাগদাদে নিয়ে গেল এবং তার তিন সন্তানকে তার সামনে নিয়ে আসলো এবং সবাইকে হত্যা করলো!! তারপর তারা মুসতাসিমের সামনে তার বোনদের নিয়ে আসলো এবং তার সমনেই প্রত্যেককে হত্যা করলো!! তারপর তারা বাগদাদের সব উলেমাদের একত্রিত করলো এবং সকল সুন্নি উলেমাদের হত্যা করলো!! তারপর হালাকু বললো, “মুসলিমদের রক্ত তোমাদের জন্য হালাল!!” তারপর পরবর্তী ৪০ দিন তারা নির্দয়ভাবে মুসলিমদের হত্যা করতে লাগলো!! তখনকার দিনে কোন মেশিনগান ছিল না, তখন তারা মুসলিমদের লাইনে দাড় করালো এবং যে রকম করে পোলট্রি খামার থেকে মুরগির বাচ্চা বাছাই করা হয় তারা ঠিক সেভাবে বাছাই করে মুসলিমদের হত্যা করতে লাগলো!! টানা ৪০ দিন ধরে এই হত্যাকান্ড চলতে থাকলো!! মুসলিমরা এতটাই ভীত হয়ে পড়েছিল যে, একজন মঙ্গল নারী একটি বাড়িতে ঢুকতো এবং সে বাড়ির প্রত্যেককে হত্যা করতো এবং কেউ তার প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পেত না!!! মঙ্গল নারীরা একদল মুসলিম পুরুষদের যদি বলতো, “এখান থেকে একচুলও নড়বে না” এবং তারা সেখান থেকে নড়তো না!! সে [মঙ্গল নারী] সেই পুরুষদের বাড়িতে যেত এবং তার তরবারি বের করতো এবং সে প্রত্যেককে হত্যা করতো!!!
বর্ণনা অনুসারে, একজন মঙ্গল ৪০ জন শিশুকে হত্যা করতো [তাদের মায়েদের হত্যার পর]!! পুরো বাগদাদ শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ আর সেখানকার অর্ধেক লোককে মঙ্গলরা হত্যা করেছিল!! ইবন্* কাসির তার “বিদায়া ওয়া নিহায়া”-তে বলেন যে, মঙ্গলরা এত মানুষকে হত্যা করেছিল যে তাদের রক্ত রাস্তার উপর দিয়ে পানির মত গড়াবে!! ৪০ দিন পর হালাকু খান বাগদাদে আসলো এবং হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার নির্দেশ দিল। অনেক মুসলিম কবর খুঁড়ে রেখেছিল এবং তারা এই কবরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল!! অনেকে বাঁচার জন্য কুকুর, বিড়াল এমনকি মৃত মানুষ পর্যন্ত খেয়েছিল!!
তারপর হালাকু মুসতাসিমের কাছে আসলো এবং বললো, “তোমার সম্পদ আমার কাছে নিয়ে আস!” সুতরাং সে তার সম্পদ তার কাছে নিয়ে আসলো। হালাকু বললো, “না, প্রাসাদের মাঝে কোটরের মধ্যে যে সম্পদ লুকিয়ে রেখেছো সেগুলো নিয়ে আস!” আর এই কোটরের মধ্যে যে স্বর্ন ছিল তা গত ৫০০ বছর ধরে আব্বাসীয়রা জমা করে রেখেছিল!!! তারপর তারা মুসতাসিমকে বন্দি করলো এবং তাকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাখলো!! মুসতাসিম খাবারের জন্য বললো এবং হালাকু তাকে প্লেটের উপর স্বর্ণ দিয়ে পাঠালো!! মুসতাসিম বললো, আমি এই স্বর্ণ দিয়ে কি করবো তাই সে সেটা ফেরত পাঠালো। তারপর হালাকু খান তার কাছে গেল এবং বললো, যদি তুমি এটা না-ই খেতে পার তবে কেন এটা জমা করে রেখেছিলে!!! [সুবহানাল্লাহ!! একজন অমুসলিম একজন মুসলিম খলিফাকে এই কথা বলছে!!!] “কেন তুমি এটা তোমার সৈন্যদের এগুলো দিলে না যাতে তারা তোমার পক্ষে লড়াই করতে রাজি হতো, তোমার জন্য জীবন দিতে রাজি হতো?? তারপর সে মুসতাসিমকে বাগদাদের বড় বড় গেটগুলো দেখাতে নিয়ে গেল এবং বললো, এই ধাতব গেটগুলোর কি কাজে লাগবে যদি না সেটা রক্ষা করার জন্য কোন লোক না থাকে? কেন তুমি এই গেটগুলো ভেঙে বর্শা তৈরি করে তোমার লোকজনকে দিলে না?” মুসতাসিম উত্তরে বললো, “এটা কদ্*রুল্লাহ [আল্লাহর শক্তি]!!” হালাকু বললো, “আমি তোমাকে কদ্*রুল্লাহ দেখাচ্ছি!” তারপর তারা তাকে [মুসতাসিম] কার্পেটে মোড়ালো এবং তাকে ঘোড়া দিয়ে পাঁড়িয়ে হত্যা করলো [মঙ্গলরা একটা নীতি মেনে চলতো যে তারা কোন রাজার রক্ত মাটিতে পড়তে দিবে না (মস্তকচ্ছেদ) তাই তারা মুসতাসিমকে তরবারি দিয়ে হত্যার পরিবর্তে কার্পেটে মুড়িয়েছিল যাতে রক্ত মাটিতে না পড়ে!!]!!
দারুল হিকমা [The House of Knowledge] পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি ছিল। কোটি কোটি বই ছিল সেখানে। সেই সময়ে আরবরা বাজারে বই বিক্রি করতো, যখন ইউরোপের আশ্রমে [গবেষণা বা পড়াশোনার কাজ আশ্রমেই বেশি করা হতো] ৪-৫ টি বই থাকলেই বিরাট ব্যাপার ছিল সেখানে মুসলিমরা বাজারে আলু-পটলের মত বই বিক্রি করতো!! মুসলিমরা চীনাদের কাছ থেকে কাগজ তৈরি পদ্ধতি শিখে এবং সেই প্রযুক্তি অনেক উন্নতি সাধন করে ফলশ্রুতিতে তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিষয়গুলো সহজেই লিপিবদ্ধ করতে শিখে।
বাগদাদের খলিফা মামুন দারুল হিকমা প্রতিষ্ঠা করার পর জ্ঞান বিজ্ঞানের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি ঘোষণা করেন যে পৃথিবীর যে প্রান্তে যে বই আছে, যে জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলো আরবিতে অনুবাদ করতে। তখন অনুবাদ একটা বিশাল অর্থ আয়ের উৎস হয়ে যায়, কারণ অনুবাদ করলেই নগদ দিনার [স্বর্ণমুদ্রা]। মুসলিম, অমুসলিম সবাই যেখান থেকে পারে তারা বই অনুবাদ করা শুরু করে দিল। আগে জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। গ্রিক, ভারতবর্ষ, চীন, মিসরীয় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। কিন্তু মুসলিমরা এসব জ্ঞান একত্রিত করে। তারা গ্রিক, ভারতীয়, চীনা প্রভৃতি সভ্যতার জ্ঞানগুলো সব আরবিতে অনুবাদ করে। আরবদের মাধ্যমেই বিশ্বের সকল জ্ঞান একত্রিত হয়!! ইউরোপে গ্রিকদের বই বা জ্ঞান অনুশীলন করা চার্চ কর্তৃক নিষেধ ছিল। গ্রিকদের বই বা জ্ঞান চর্চা করা ছিল ধর্মবিরোধিতা [Heresy] করার সামিল!!
পশ্চিমারা এরিস্টোটল, টলেমি, প্লেটো, থিওফ্রাসটাস, সক্রেটস্* প্রভৃতিদের সমন্ধে জানলো কাদের মাধ্যমে? এই মুসলিমদের মাধ্যমে! আরবি ছিল তখনার আন্তর্জাতিক ভাষা, ঠিক আজকে যেমনটা ইংরেজি!! তখন খৃষ্টান, ইহুদি, বর্ণ গোত্রের লোকেরা জ্ঞানের জন্য আরবি ভাষা শিখতো। বাগদাদে মুসলিম বিজ্ঞানীর পাশাপাশি ইহুদি, খৃস্টান বিজ্ঞানীরাও ছিল, তারা সবাই একসাথে বিজ্ঞানের চর্চা করতো!! মুসলিমরা উদার ছিল, তারা ইহুদি পন্ডিত ও জ্ঞানীদের কাছে থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞান শিখতো এবং একসাথে কাজ করতো! বাগদাদ ছিল তখনকার বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়, সেরা জ্ঞানীরা আসতো বাগদাদে!! মুসলিম শাসকদের সাথে ইউরোপের খৃস্টান শাসকদের চুক্তি ছিল তারা যেন তাদের গ্রিক বা রোমানদের বইগুলো দেয় যাতে তারা সেগুলো আরবিতে অনুবাদ করে পুনরায় তাদের ফেরত দিবে! ইউরোপে রেঁনেসার ভিত গেঁথে দিয়েছিল এই বাগদাদ, কারণ বাগদাদ থেকে বই যেত আল-আন্দালুস বা মুসলিম স্পেনে আর স্পেন ছিল “আলোর শহর [The City of Light]” যেখানে ইউরোপের পন্ডতরা জ্ঞানের জন্য আসতো। হায়ারোগ্লিফিক্স [চিত্রের মাধ্যমে লেখা] যেটা পশ্চিমারা মনে করতো যে ১৭৯৯ সালে ফরাসি ভাষাবিদ জ্যঁ ফ্রাসোঁয়া শাম্পিওঁ [Jean-François Champollion] পুনরুদ্ধার করে আসলে আরবরা ১০ম শতাব্দিতেই সেটা করে কিন্তু তারা এটাকে গুরত্বপূর্ন মনে না করায় তারা এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় নি!! এ বিষয়ে লিংক:
তারা জ্ঞানার্জনের জন্য আরবি ভাষা শিখেছিল এবং আরবের বইগুলো তারা ফরাসী ভাষায় অনুবাদ করে, পরে সেগুলো অন্য ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ হয় [মাইকেল স্কট আরবি ভাষায় মুসলিম স্পেন থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান শিখে সেগুলো ফ্রান্সে নিয়ে যায় এবং অনুবাদ করে!]!! ইন-শা-আল্লাহ অন্য কোন পোস্টে মুসলিম স্পেন নিয়ে পোস্ট দেয়া হবে।
যাইহোক, এই মঙ্গলরা বাগদাদ দখল করার পর তারা হাজার হাজার বছরের জ্ঞান, দারুল হিকমার বইগুলো সব ধ্বংস করে দিল!! তারা সব বই ফোরাত নদীতে ভাসিয়ে দিল!! এতো পরিমান বই তারা নষ্ট করেছিল যে পুরো ফোরাত নদীর পানি বই-এর কালিতে কালো হয়ে গিয়েছিল!! বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্পদ শেষ!! কিন্তু পৃথিবীবাসীর সৌভাগ্য যে বাগদাদের বইগুলো কপি করা হয়েছিল এবং সেগুলো পাঠানো হয়েছিল মুসলিম স্পেন বা আল-আন্দালুসে!! কিন্তু এশিয়ার জ্ঞান শেষ, জ্ঞান চলে গেল ইউরোপে আর সে কারণেই এশিয়া জ্ঞান বিজ্ঞানে পিছিয়ে গেল আর ইউরোপ রকেটের গতি জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে গেল, যার পরবর্তী পরিণতি ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ফরাসি ও ডাচদের উপনিবেশ!!
বাগদাদ মৃত মানুষের শহরে [Necropolis] পরিণত হয়েছিল। লাশের দুর্গন্ধে, খাবার পানির অভাবে অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল! আবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছিল। মঙ্গলরা বাগদাদ ছেড়ে তখন চলে গেল সাথে সাথে শেষ করে দিল আরবের ও এশিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান যেটার প্রতিধ্বনি এখনো আরবে আর এশিয়াতে প্রতিফলিত হচ্ছে!!
যে মঙ্গলরা মুসলিমদের এত ক্ষতি করলো, তার মাত্র ৮০ বছরের ব্যবধানে প্রায় সবাই মুসলিম হয়ে গেল!!! বিশ্বের ইতিহাসে এটা বিরল যে বিজয়ীরা বিজিতদের ধর্ম গ্রহণ করে!! কিন্তু ঘটনা ঘটে গেল ভিন্ন!! কিভাবে? ইসলামিক দাওয়াতের কারনে, এই দাওয়াত ছিল প্রাকটিকাল দাওয়াত; মুসলিম বিশ্বের মুসলিমরা আল্লাহর দ্বীন মেনে চলতো বা চলা শুরু করলো [কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল আল্লাহর দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই তাদের উপর এই ভয়াবহ আজাব এসেছে], তারা আল্লাহর নির্দেশমত জীবন যাপন করতে লাগলো। আর স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহর দ্বীন সকল দ্বীনের উপর বিজয় লাভ করবে যেটা আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন সেটাই হলো, মঙ্গলরা ইসলাম কবুল করলো!! আর মুসলিমাহরা [নারী মুসলিম] এক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখেন তারাই মূলতঃ আল্লাহর দ্বীনকে মঙ্গলদের কাছে তুলে ধরেন!!
“তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের [জীবন ব্যাবস্থা] উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।”
[আল-কুরআন, সুরা: আত-তওবা আয়াত: ৩৩]
সেই মঙ্গল যারা মুসলিম সামরকান্দ, বুখারা, গুরগাঁও, জুয়াইনি, বাগদাদে যে ভয়াবহ তান্ডব চালিয়েছে তাদের বংশধরেরাই ভারতবর্ষে মুঘল [আরবিতে মঙ্গলদের বলা হয় “মুঘল”!!] সাম্রাজ্যের সূচনা করে!! মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবুর ছিল তৈমুর লং-এর বংশধর!!!
আরবরা সেই যে তাদের অবস্থান হারালো সেই অবস্থান আর তার ফিরে পায় নি। তারা আল্লাহর দ্বীনকে ঠিকভাবে নেয় নি সেই কারণে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা তাদের কাছ থেকে ইসলামী শক্তির নেতৃত্ব অনারবদের হাতে দিয়ে দিলেন! কারণ পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বর্ণনা করেছেন:
“...যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের পরিবর্তে অন্য জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন, এরপর তারা তোমাদের মত হবে না।”
[আল-কুরআন, সুরা: মুহাম্মাদ আয়াত: ৪৮]
ইসলামের পতাকা বহন করতে লাগলো তুর্কিমেনিস্তানে জন্ম নেয়া এক মুসলিম ওসমান বে। যার বংশধরেরা পরবর্তীতে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেন, ইতিহাস যেটাকে উসমানীয় সাম্রাজ্য [Ottoman Empire] বলে চিনে। যেটা ছিল এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশে বিস্তৃত যার নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল বর্তমান বিশ্বের ৪৩ টি দেশ!! যার আয়তন [Area] ছিল ৫২ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার! ইউরোপের ভিয়েনা পর্যন্ত [অস্ট্রিয়ার রাজধানী] তাদের দখলে চলে এসেছিল!! যদি না আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা’য়ালা বৃষ্টি দিতেন [সুলতান সুলাইমানের সময়, যাকে বলা হয় “Suleiman the Magnificent” তার সময়ে ১৫২৯ সালে ভিয়েনা দখলের সময় বৃষ্টির কারণ মুসলিমরা কামান নিয়ে যেতে পারেনি আর সে কারণে ভিয়েনার দূর্গও ভাঙ্গা সম্ভব হয়ে উঠেনি!] তবে জার্মানিসহ পুরো ইউরোপ তাদের অধীনে চলে আসতো!!
আরবরা এখনো তাদের সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারেনি তাই তারা এখনো দুনিয়াতে শোচনীয় অবস্থায় আছে, আমরাও আছি কারণ আমরাও তাদের মতই আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারিনি। যেদিন সেটা করতে পারবো ইন-শা-আল্লাহ আবারও আমরা এই দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত হব।
“আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর; পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।....”
[আল-কুরআন, সুরা: আলে-ইমরান আয়াত:১০৩]
Comment