তিন কথার দাওয়াত ও তিন দিনের আমানঃ প্রকৃত নবীওয়ালা ও সাহাবীওয়ালা কাজ/তাবলীগ
মুহাম্মাদ রহ., তালহা রহ., আমর রহ. ও যিয়াদ রহ. আপন আপন সনদে বর্ণনা করেছেন যে, সা'দ (রা.) লোক পাঠিয়ে মুগীরা ইবনে শো'বা (রা.) সহ অন্যান্য সাহাবাদের (রা.) একটা জামাতকে ডাকলেন এবং বললেন,
-
'আমি তোমাদেরকে রুস্তম ও তার লোকদের নিকট পাঠাতে চাই। এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি?'
-
তারা সকলে বললেন, 'আপনি যে কোন হুকুম করবেন আমরা তার অনুসরণ করব এবং তা পূর্ণ করব। আর সেখানে যাওয়ার পর যদি এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হই যার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে কোন ফয়সালা না হয়ে থাকে তবে সে বিষয়ে চিন্তা-ফিকির করে যা অধিক উত্তম হবে এবং লোকদের জন্য অধিক উপকারী হবে আমরা তাই তাদেরকে বলব।'
-
সা'দ (রা.) বললেন, 'বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোকেরা এরূপই করে থাকে। তোমরা যাও এবং সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।'
-
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) বললেন, 'অনারব লোকদের নিজস্ব নিয়ম-পদ্ধতি ও আদব-কায়দা রয়েছে। আমরা এত লোক একসাথে যখন তাদের নিকট যাব তখন তারা মনে করবে আমরা তাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি। অতএব আপনি তাদের নিকট একজনের অধিক পাঠাবেন না।'
সকলেই রিবঈ ইবনে আমের (রা.) এর রায়কে সমর্থন করল। তারপর রিবঈ (রা.) বললেন, 'আপনাদের সকলের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিন।' সুতরাং সা'দ (রা.) তাকে পাঠানোর ফয়সালা করে দিলেন।
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) রুস্তমের সেনা ছাউনীতে তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পুলের উপর মোতায়েন সিপাহী রিবঈ ইবনে আমের (রা.) কে থামাল এবং তার আগমনের সংবাদ দিয়ে রুস্তমের নিকট লোক পাঠাল।
-
রুস্তম পারস্যের বড় বড় সর্দারদের সাথে পরামর্শ করল এবং বলল, 'তোমাদের কি রায়? আমরা কি শুধু আমাদের সংখ্যাধিক্যের উপর গর্ব করব, না আমাদের জাঁকজমক, শান শওকত দেখিয়ে আরবদেরকে প্রভাবিত করব এবং তাদের তুচ্ছতা প্রকাশ করব?'
-
তারা সকলে একমত হল যে, শাহী জাঁকজমকের প্রদর্শনী দ্বারা তাদের তুচ্ছতা প্রকাশ করা হোক। অতএব শাহী কোষাগার থেকে সাজসজ্জার জিনিসপত্র বের করে সাজিয়ে ফেলল। চারদিকে মূল্যবান গদি, বিছানা ও গালিচা বিছাল। কোষাগারের কিছুই অবশিষ্ট রাখল না। রুস্তমের জন্য সোনার সিংহাসন রাখা হল এবং তাকে মূল্যবান কাপড় দ্বারা সাজানো হল, দামী দামী গালিচা বিছানো হল, সোনার তার দ্বারা বুনানো বালিশ রাখা হল।
-
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) কে পুলের উপর মোতায়েন সিপাহী সামনে যাওয়ার অনুমতি দিলে তিনি নিজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওয়ানা হলেন। তার ঘোড়া অধিক চুলওয়ালা ও খাট ছিল। আর তার নিকট কাপড় দ্বারা পেঁচানো একটি অত্যন্ত চকচকে তরবারি ছিল এবং তার বর্শার সাথে চামড়ার ফিতা লাগানো ছিল। তার নিকট গরুর চামড়া নির্মিত একটি ঢাল ছিল, তার উপর রুটির ন্যায় গোল লাল রঙের চামড়া লাগানো ছিল। আর তার সাথে নিজের তীর-ধনুকও ছিল। তিনি যখন সে শাহী দরবারের নিকটবর্তী হলেন তখন প্রথম গালিচার নিকট পৌঁছুতেই সেখানকার লোকেরা বলল, ঘোড়া থেকে নীচে নামুন। কিন্তু তিনি ঘোড়াকে গালিচার উপর উঠিয়ে দিলেন। ঘোড়া সম্পূর্ণরূপে গালিচার উপর উঠার পর তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন। অতঃপর দুটি বালিশ ছিঁড়ে তার ভিতর ঘোড়ার লাগাম প্রবেশ করিয়ে তার সাথে বাঁধলেন। তার এ কাজে তাকে কেউ কোনরূপ বাঁধা দিতে সাহস পেল না।
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) দেখতেই তাদের উদ্দেশ্য বুঝে গিয়েছিলেন যে, তারা শাহী জাঁকজমক দেখিয়ে আমাদেরকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। এ কারণে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ কাজ করলেন যাতে তারা বুঝতে পারে যে, এ সমস্ত জাঁকজমকের দ্বারা তিনি কোনরূপ প্রভাবিত হন নি। তিনি একটি বর্ম পরিধান করেছিলেন যা দেখতে একটি হাউজের ন্যায় লম্বা চওড়া ছিল। তিনি উটের পিঠে হাওদার নীচে* যে ছালার চট বিছানো হয় তাকে মাঝখান দিয়ে ছিড়ে আলখেল্লা স্বরূপ পরিধান করেছিলেন এবং ছালের রশি দ্বারা মাঝখানে কোমরবন্ধ হিসেবে বেঁধে নিয়েছিলেন। মাথায় পাগড়ি বেঁধে রেখেছিলেন। আর তার পাগড়ী ছিল উটের চামড়ার লাগাম! তিনি আরবের মধ্যে সর্বাধিক চুলওয়ালা ছিলেন এবং মাথায় চারটি চুলের ঝুটি ছিল, যা পাহাড়ি বকরির শিংয়ের ন্যায় খাড়া হয়ে ছিল। দরবারের লোকেরা বলল, আপনি এখানে আপনার অস্ত্র-শস্ত্র খুলে রাখুন। তিনি বললেন, আমি তোমাদের নিকট নিজ প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় আসি নি যে, তোমাদের কথায় অস্ত্র নামিয়ে রাখব। তোমরাই আমাকে ডেকেছ। আমি যেমনভাবে চাইব তেমনভাবে যদি আসতে দাও তবে ঠিক আছে, নতুবা আমি ফিরে যাচ্ছি! লোকেরা রুস্তমকে এ সংবাদ দিলে রুস্তম বলল, তাকে এভাবেই আসতে দাও। সে তো একজনই মাত্র।
রিবঈ ইবনে আমেরের (রাঃ) বর্শার মাথায় ধারালো ফাল লাগানো ছিল। তিনি ছোট কদমে বর্শার উপর ভর দিয়ে চলতে লাগলেন। এভাবে তিনি সমস্ত গালিচা ও বিছানাকে ছিঁড়ে নষ্ট করে দিলেন। তিনি যখন রুস্তমের নিকট পৌঁছলেন তখন প্রহরীগণ তাকে ঘিরে নিল। আর তিনি বিছানার উপর বর্শা গেড়ে স্বয়ং মাটির উপর বসে পড়লেন। তারা জিজ্ঞেস করল, আপনি এরূপ কেন করলেন? তিনি উত্তর দিলেন, তোমাদের সাজসজ্জার এ সমস্ত জিনিসের উপর আমরা বসতে চাই না।
অতঃপর রুস্তম কথা বলতে আরম্ভ করল এবং বলল, আপনারা আরব দেশ থেকে কেন এখানে এসেছেন? রিবঈ (রাঃ) বললেন,
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। আর তিনি আমাদেরকে এখানে এজন্য নিয়ে এসেছেন যেন তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে আমার বান্দগণের বন্দেগী থেকে বের করে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে বের করে তার প্রশস্ততার দিকে ও সমস্ত ধর্মের জুলুম অত্যাচার থেকে বের করে দ্বীনে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে আসি।...
রুস্তম তার কাওমের সর্দারদেরকে বলল, 'তোমাদের নাশ হোক! তোমরা তার কাপড় দেখিও না, বরং তার বুদ্ধিমত্তা ও কথা এবং তার আচার-আচরণ ও জীবন পদ্ধতিকে দেখ! আরবের লোকেরা (মুসলিমরা) কাপড় চোপড় ও খাওয়া দাওয়াকে বিশেষ কোন গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু বংশগত গুনাবলীকে অতি যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে। তারা লেবাস পোশাকে তোমাদের মত নয়, তোমরা যেরূপ গুরুত্ব দাও তারা সেরূপ গুরুত্বই দেয় না।' অতঃপর তারা রিবঈ ইবনে আমের রাঃ এর অস্ত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে লাগল এবং তাকে মামুলী ও অতি নিকৃষ্ট বলতে লাগল। রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) বললেন, তোমরা তোমাদের যুদ্ধ পারদর্শিতা আমাকে দেখাও, আর আমিও তোমাদের দেখাই। এ বলে তিনি নেকড়ার ভিতর থেকে নিজের তরবারি বের করলেন যেন একটি অগ্নিশিখা। তারা বলল, তরবারি আবৃত করে রাখ। তিনি তা নেকড়া দ্বারা আবৃত করে ফেললেন। তারপর রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) তাদের ঢালের উপর তীর নিক্ষেপ করলে তা ফেটে গেল। আর তারা রিবঈ (রাঃ) এর ঢালের উপর তীর নিক্ষেপ করল, কিন্তু তা ফাটল না। বরং যেমন ছিল তেমনি রইল। অতঃপর রিবঈ (রাঃ) বললেন, হে পারস্যবাসী, তোমরা খাওয়া, পান করা ও লেবাস পোশাককে বড় জিনিস মনে কর, আর আমরা তাকে নগণ্য জিনিস মনে করি। তারপর রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) তাকে চিন্তা করার জন্য তিন দিন সময় দিয়ে ফিরে আসলেন।
-
পরদিন রুস্তম পয়গাম পাঠাল যে, পূর্ব ব্যাক্তিকে পুণরায় পাঠাও। সা'দ (রাঃ) হুযাইফা ইবনে মেহসানকে (রাঃ) পাঠালেন। তিনিও রিবঈ (রাঃ)* এর ন্যায় সাধারণ পোশাকে এবং সাদাসিধে অবস্থায় রওয়ানা হলেন। যখন প্রথম গালিচার নিকট পৌঁছলেন তখন সেখানকার লোকেরা বলল, আপনি সওয়ারী থেকে নীচে নামুন। তিনি বললেন, আমি যদি নিজ প্রয়োজনে আসতাম তবে নামতাম। তোমরা তোমাদের বাদশাহকে জিজ্ঞেস কর, আমি কি তার প্রয়োজনে এসেছি, না আমার নিজের প্রয়োজনে এসেছি?* যদি বলে, আমার প্রয়োজনে এসেছি তবে সে ভুল বলেছে। আমি তোমাদের ছেড়ে ফিরে চলে যাব। আর যদি বলে, তার প্রয়োজনে এসেছি তবে আমি যেভাবে চাইব সেভাবে তোমাদের নিকট আসব। রুস্তম শুনে বলল, তাকে ছেড়ে দাও, যেভাবে আসতে চায় আসতে দাও।
হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) সামনে অগ্রসর হলেন এবং রুস্তমের নিকট গিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। রুস্তম তার সিংহাসনে বসে ছিল। সে বলল, সওয়ারী থেকে নীচে নামুন। হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন, আমি নীচে নামব না। তিনি যখন নামতে অস্বীকার করলেন তখন রুস্তম জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, আজ আপনি আসলেন, গতকাল যিনি আমাদের নিকট এসেছিলেন, তিনি আসলেন না কেন? হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন, আমাদের আমীর (সা'দ রাঃ) কঠিন ও নরম সর্বাবস্থায় আমাদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা পছন্দ করেন। এজন্য গতকাল তার পালা ছিল আর আজ আমার পালা।
রুস্তম বলল, আপনারা কেন এসেছেন? হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন,
আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে আপন দ্বীন দান করে আমাদের উপর দয়া করেছেন, আমাদেরকে আপন কুদরতের নিদর্শনসমূহ এমনভাবে দেখিয়েছেন যে, আমরা তা বুঝতে পেরেছি, অথচ ইতিপূর্বে আমরা এ বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন আমরা সমস্ত মানুষকে তিন বিষয়ের যে কোন একটি গ্রহণ করার আহ্বান জানাই। তারা যে কোনটি গ্রহণ করবে আমরা তাকে মেনে নেব। প্রথম হলঃ ইসলাম গ্রহণ কর। যদি ইসলাম গ্রহণ কর তবে আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে চলে যাব। দ্বিতীয় বিষয় হলঃ যদি ইসলাম গ্রহণ না কর তবে জিজিয়া প্রদান কর। যদি জিজিয়া প্রদান কর তবে তোমাদের প্রয়োজন হলে আমরা তোমাদেরকে দুশমনের হাত থেকে থেকে হেফাজত করব। তৃতীয় বিষয় হলঃ যদি এ দুটির একটিও গ্রহণ না কর তবে যুদ্ধ ও মোকাবিলা হবে। রুস্তম বলল, কিছু দিনের জন্য কি সন্ধি হতে পারে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিন দিনের জন্য হতে পারে। তবে গতকাল থেকে সেই তিন দিন গণ্য হবে।
রুস্তম যখন হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) থেকে সে একই উত্তর পেল যা সে রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) থেকে পেয়েছিল তখন হুযাইফা ইবনে মেহসানকে (রাঃ) ফেরত পাঠিয়ে দিল এবং নিজ সাথীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলল, 'তোমাদের নাশ হোক! তোমরা আমার মতামতকে কেন বুঝতে পারছ না? গতকাল এক ব্যাক্তি আমাদের নিকট আসল এবং আমাদের জমিনে আমাদের উপর জয়ী হয়ে গেল, আমাদের মূল্যবান জিনিসপত্রকে তুচ্ছ গণ্য করে দেখাল। মূল্যবান জিনিসের উপর সে তার ঘোড়া উঠিয়ে খাড়া করল, আর আমাদের মূল্যবান বালিশের সাথে ঘোড়া বাঁধল। সে এটা দ্বারা পূর্বাভাস গ্রহণ করে আমাদের জমিন ও তাতে যা কিছু আছে সমস্তই তার সাথীদের নিকট নিয়ে চলে গেল। উপরন্তু সে অত্যন্ত বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তি ছিল। আজ এ দ্বিতীয় ব্যাক্তি আমাদের নিকট আসল এবং আমাদের মাথার উপর এসে দাঁড়াল। সেও পূর্বাভাস নিয়ে গেল। সে তো আমাদেরকে বের করে দিয়ে আমাদের জমিন দখল করে নিবে।'
রুস্তমের সাথীগণও তাকে কঠোর ভাষায় উত্তর দিল এবং এভাবে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে থেকে একপর্যায়ে রুস্তম রাগান্বিত হয়ে গেল এবং তার সাথীগনও রাগান্বিত হয়ে গেল।
-
পরের দিন রুস্তম পয়গাম পাঠাল যে, আমাদের নিকট একজন লোক পাঠাও। সুতরাং মুসলমানগন মুগীরা ইবনে শো'বাকে (রাঃ) পাঠাল। আবু উসমান নাহদী রহ. বলেন, মুগীরা ইবনে শো'বা (রাঃ) পুলের উপর পৌঁছলেন এবং পুল পার হয়ে পারস্যবাসীদের নিকট যেতে চাইলে পাহারাদারগণ তাকে আটকাল এবং রুস্তমের নিকট তার ব্যাপারে অনুমতি চাইল। তারা সাহাবাদের (রাঃ) প্রভাবিত করার জন্য যে সকল শাহী ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছিল সমস্ত কিছুই বহাল ছিল, কোন পরিবর্তন করে নি। তারা মাথার মুকুট ও সোনার তার দ্বারা বুনানো কাপড় পরিধান করেছিল। তীর নিক্ষেপ করলে যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত গালিচা বিছিয়ে রেখেছিল। বাদশাহ পর্যন্ত পৌঁছুতে তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত আর কোন উপায় ছিল না।
রুস্তম অনুমতি দিলে মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) সেখান থেকে অগ্রসর হলেন। তার চুলে চারটি বেণি ছিল। তিনি চলতে চলতে রুস্তমের সিংহাসন ও গদীর উপর গিয়ে বসে গেলেন। এতে তারা সকলে মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। অবশেষে তাকে সিংহাসন থেকে নীচে নামিয়ে দিল। মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) বললেন, 'আমাদের নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছিল যে, তোমরা নাকি অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক, কিন্তু আমি তো তোমাদের ন্যায় বোকা ও মূর্খ লোক আর দেখিনি! আমরা আরবের লোকেরা(মুসলিমরা) সকলেই সমান। আমাদের মধ্য থেকে কেউ কাউকে গোলাম বানায় না, হ্যাঁ, যদি কারো সাথে যুদ্ধ হয় তবে ভিন্ন কথা। আমার ধারণা ছিল, তোমরাও বোধ হয় আমাদের মতই পরস্পর সমতা বজায় রেখে চল। তোমরা যা করেছ তা অপেক্ষা উত্তম এটা ছিল যে, আমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিতে যে, তোমরা পরস্পর সমান নও, বরং একে অপরের রব। রুস্তমের সাথে এক আসনে বসা যদি তোমাদের মতে ঠিক না হয়ে থাকে তবে আগামীতে আমরা এরূপ করব না। তোমাদের নিকট আমি নিজ প্রয়োজনে আসি নি। তোমরা ডেকেছ বলে এসেছি। আজ আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমাদের শাসনক্ষমতা দূর্বল হয়ে গেছে এবং তোমরা পরাজিত হবে। এ ধরনের নীতি ও জ্ঞানবুদ্ধির উপর কোন রাজত্ব টিকে থাকতে পারে না।'
সাধারণ লোকেরা মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর কথা শুনে বলল, খোদার কসম, এ আরবী সঠিক ও সত্য কথা বলেছে। আর তার মাতব্বরগণ বলল, খোদার কসম, এ ব্যক্তি তো এমন এক কথার তীর নিক্ষেপ করেছে যদ্দরুণ আমাদের গোলামরা সর্বদা আমাদেরকে তাদের দিকে টানতে থাকবে। আমাদের খোদা আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে নিপাত করুন! তারা কেমন আহম্মক ছিল যে, এ সমস্ত আরবদের বিষয়কে মামুলী ও সাধারণ জ্ঞান করেছে! আর আজ তারা কি পরিমাণ শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আত্নপ্রকাশ করেছে। শুরুতেই তাদের মূল উৎপাটন করে দেয়া উচিত ছিল। বর্ণনাকারী অতঃপর হাদীসের বাকী অংশ উল্লেখ করেছেন, যাতে রুস্তমের বিভিন্ন প্রশ্ন ও মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর উত্তর উল্লিখিত হয়েছে।
Note:
Ibn Jareer, volume 3, page: 33,36
হায়াতুস সাহাবাহ (রা)- হযরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী রহ.
রুস্তমের সাথে সাক্ষাতের কাহিনী
মুহাম্মাদ রহ., তালহা রহ., আমর রহ. ও যিয়াদ রহ. আপন আপন সনদে বর্ণনা করেছেন যে, সা'দ (রা.) লোক পাঠিয়ে মুগীরা ইবনে শো'বা (রা.) সহ অন্যান্য সাহাবাদের (রা.) একটা জামাতকে ডাকলেন এবং বললেন,
-
'আমি তোমাদেরকে রুস্তম ও তার লোকদের নিকট পাঠাতে চাই। এ ব্যাপারে তোমাদের মতামত কি?'
-
তারা সকলে বললেন, 'আপনি যে কোন হুকুম করবেন আমরা তার অনুসরণ করব এবং তা পূর্ণ করব। আর সেখানে যাওয়ার পর যদি এমন কোন বিষয়ের সম্মুখীন হই যার ব্যাপারে আপনার পক্ষ থেকে কোন ফয়সালা না হয়ে থাকে তবে সে বিষয়ে চিন্তা-ফিকির করে যা অধিক উত্তম হবে এবং লোকদের জন্য অধিক উপকারী হবে আমরা তাই তাদেরকে বলব।'
-
সা'দ (রা.) বললেন, 'বুদ্ধিমান ও অভিজ্ঞ লোকেরা এরূপই করে থাকে। তোমরা যাও এবং সেখানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।'
-
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) বললেন, 'অনারব লোকদের নিজস্ব নিয়ম-পদ্ধতি ও আদব-কায়দা রয়েছে। আমরা এত লোক একসাথে যখন তাদের নিকট যাব তখন তারা মনে করবে আমরা তাদেরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছি। অতএব আপনি তাদের নিকট একজনের অধিক পাঠাবেন না।'
সকলেই রিবঈ ইবনে আমের (রা.) এর রায়কে সমর্থন করল। তারপর রিবঈ (রা.) বললেন, 'আপনাদের সকলের পক্ষ থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিন।' সুতরাং সা'দ (রা.) তাকে পাঠানোর ফয়সালা করে দিলেন।
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) রুস্তমের সেনা ছাউনীতে তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পুলের উপর মোতায়েন সিপাহী রিবঈ ইবনে আমের (রা.) কে থামাল এবং তার আগমনের সংবাদ দিয়ে রুস্তমের নিকট লোক পাঠাল।
-
রুস্তম পারস্যের বড় বড় সর্দারদের সাথে পরামর্শ করল এবং বলল, 'তোমাদের কি রায়? আমরা কি শুধু আমাদের সংখ্যাধিক্যের উপর গর্ব করব, না আমাদের জাঁকজমক, শান শওকত দেখিয়ে আরবদেরকে প্রভাবিত করব এবং তাদের তুচ্ছতা প্রকাশ করব?'
-
তারা সকলে একমত হল যে, শাহী জাঁকজমকের প্রদর্শনী দ্বারা তাদের তুচ্ছতা প্রকাশ করা হোক। অতএব শাহী কোষাগার থেকে সাজসজ্জার জিনিসপত্র বের করে সাজিয়ে ফেলল। চারদিকে মূল্যবান গদি, বিছানা ও গালিচা বিছাল। কোষাগারের কিছুই অবশিষ্ট রাখল না। রুস্তমের জন্য সোনার সিংহাসন রাখা হল এবং তাকে মূল্যবান কাপড় দ্বারা সাজানো হল, দামী দামী গালিচা বিছানো হল, সোনার তার দ্বারা বুনানো বালিশ রাখা হল।
-
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) কে পুলের উপর মোতায়েন সিপাহী সামনে যাওয়ার অনুমতি দিলে তিনি নিজ ঘোড়ার পিঠে চড়ে রওয়ানা হলেন। তার ঘোড়া অধিক চুলওয়ালা ও খাট ছিল। আর তার নিকট কাপড় দ্বারা পেঁচানো একটি অত্যন্ত চকচকে তরবারি ছিল এবং তার বর্শার সাথে চামড়ার ফিতা লাগানো ছিল। তার নিকট গরুর চামড়া নির্মিত একটি ঢাল ছিল, তার উপর রুটির ন্যায় গোল লাল রঙের চামড়া লাগানো ছিল। আর তার সাথে নিজের তীর-ধনুকও ছিল। তিনি যখন সে শাহী দরবারের নিকটবর্তী হলেন তখন প্রথম গালিচার নিকট পৌঁছুতেই সেখানকার লোকেরা বলল, ঘোড়া থেকে নীচে নামুন। কিন্তু তিনি ঘোড়াকে গালিচার উপর উঠিয়ে দিলেন। ঘোড়া সম্পূর্ণরূপে গালিচার উপর উঠার পর তিনি ঘোড়া থেকে নামলেন। অতঃপর দুটি বালিশ ছিঁড়ে তার ভিতর ঘোড়ার লাগাম প্রবেশ করিয়ে তার সাথে বাঁধলেন। তার এ কাজে তাকে কেউ কোনরূপ বাঁধা দিতে সাহস পেল না।
রিবঈ ইবনে আমের (রা.) দেখতেই তাদের উদ্দেশ্য বুঝে গিয়েছিলেন যে, তারা শাহী জাঁকজমক দেখিয়ে আমাদেরকে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। এ কারণে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ কাজ করলেন যাতে তারা বুঝতে পারে যে, এ সমস্ত জাঁকজমকের দ্বারা তিনি কোনরূপ প্রভাবিত হন নি। তিনি একটি বর্ম পরিধান করেছিলেন যা দেখতে একটি হাউজের ন্যায় লম্বা চওড়া ছিল। তিনি উটের পিঠে হাওদার নীচে* যে ছালার চট বিছানো হয় তাকে মাঝখান দিয়ে ছিড়ে আলখেল্লা স্বরূপ পরিধান করেছিলেন এবং ছালের রশি দ্বারা মাঝখানে কোমরবন্ধ হিসেবে বেঁধে নিয়েছিলেন। মাথায় পাগড়ি বেঁধে রেখেছিলেন। আর তার পাগড়ী ছিল উটের চামড়ার লাগাম! তিনি আরবের মধ্যে সর্বাধিক চুলওয়ালা ছিলেন এবং মাথায় চারটি চুলের ঝুটি ছিল, যা পাহাড়ি বকরির শিংয়ের ন্যায় খাড়া হয়ে ছিল। দরবারের লোকেরা বলল, আপনি এখানে আপনার অস্ত্র-শস্ত্র খুলে রাখুন। তিনি বললেন, আমি তোমাদের নিকট নিজ প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় আসি নি যে, তোমাদের কথায় অস্ত্র নামিয়ে রাখব। তোমরাই আমাকে ডেকেছ। আমি যেমনভাবে চাইব তেমনভাবে যদি আসতে দাও তবে ঠিক আছে, নতুবা আমি ফিরে যাচ্ছি! লোকেরা রুস্তমকে এ সংবাদ দিলে রুস্তম বলল, তাকে এভাবেই আসতে দাও। সে তো একজনই মাত্র।
রিবঈ ইবনে আমেরের (রাঃ) বর্শার মাথায় ধারালো ফাল লাগানো ছিল। তিনি ছোট কদমে বর্শার উপর ভর দিয়ে চলতে লাগলেন। এভাবে তিনি সমস্ত গালিচা ও বিছানাকে ছিঁড়ে নষ্ট করে দিলেন। তিনি যখন রুস্তমের নিকট পৌঁছলেন তখন প্রহরীগণ তাকে ঘিরে নিল। আর তিনি বিছানার উপর বর্শা গেড়ে স্বয়ং মাটির উপর বসে পড়লেন। তারা জিজ্ঞেস করল, আপনি এরূপ কেন করলেন? তিনি উত্তর দিলেন, তোমাদের সাজসজ্জার এ সমস্ত জিনিসের উপর আমরা বসতে চাই না।
অতঃপর রুস্তম কথা বলতে আরম্ভ করল এবং বলল, আপনারা আরব দেশ থেকে কেন এখানে এসেছেন? রিবঈ (রাঃ) বললেন,
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন। আর তিনি আমাদেরকে এখানে এজন্য নিয়ে এসেছেন যেন তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে আমার বান্দগণের বন্দেগী থেকে বের করে আল্লাহর বন্দেগীর দিকে, দুনিয়ার সংকীর্ণতা থেকে বের করে তার প্রশস্ততার দিকে ও সমস্ত ধর্মের জুলুম অত্যাচার থেকে বের করে দ্বীনে ইসলামের ইনসাফের দিকে নিয়ে আসি।...
রুস্তম তার কাওমের সর্দারদেরকে বলল, 'তোমাদের নাশ হোক! তোমরা তার কাপড় দেখিও না, বরং তার বুদ্ধিমত্তা ও কথা এবং তার আচার-আচরণ ও জীবন পদ্ধতিকে দেখ! আরবের লোকেরা (মুসলিমরা) কাপড় চোপড় ও খাওয়া দাওয়াকে বিশেষ কোন গুরুত্ব দেয় না, কিন্তু বংশগত গুনাবলীকে অতি যত্নসহকারে সংরক্ষণ করে। তারা লেবাস পোশাকে তোমাদের মত নয়, তোমরা যেরূপ গুরুত্ব দাও তারা সেরূপ গুরুত্বই দেয় না।' অতঃপর তারা রিবঈ ইবনে আমের রাঃ এর অস্ত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে লাগল এবং তাকে মামুলী ও অতি নিকৃষ্ট বলতে লাগল। রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) বললেন, তোমরা তোমাদের যুদ্ধ পারদর্শিতা আমাকে দেখাও, আর আমিও তোমাদের দেখাই। এ বলে তিনি নেকড়ার ভিতর থেকে নিজের তরবারি বের করলেন যেন একটি অগ্নিশিখা। তারা বলল, তরবারি আবৃত করে রাখ। তিনি তা নেকড়া দ্বারা আবৃত করে ফেললেন। তারপর রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) তাদের ঢালের উপর তীর নিক্ষেপ করলে তা ফেটে গেল। আর তারা রিবঈ (রাঃ) এর ঢালের উপর তীর নিক্ষেপ করল, কিন্তু তা ফাটল না। বরং যেমন ছিল তেমনি রইল। অতঃপর রিবঈ (রাঃ) বললেন, হে পারস্যবাসী, তোমরা খাওয়া, পান করা ও লেবাস পোশাককে বড় জিনিস মনে কর, আর আমরা তাকে নগণ্য জিনিস মনে করি। তারপর রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) তাকে চিন্তা করার জন্য তিন দিন সময় দিয়ে ফিরে আসলেন।
-
পরদিন রুস্তম পয়গাম পাঠাল যে, পূর্ব ব্যাক্তিকে পুণরায় পাঠাও। সা'দ (রাঃ) হুযাইফা ইবনে মেহসানকে (রাঃ) পাঠালেন। তিনিও রিবঈ (রাঃ)* এর ন্যায় সাধারণ পোশাকে এবং সাদাসিধে অবস্থায় রওয়ানা হলেন। যখন প্রথম গালিচার নিকট পৌঁছলেন তখন সেখানকার লোকেরা বলল, আপনি সওয়ারী থেকে নীচে নামুন। তিনি বললেন, আমি যদি নিজ প্রয়োজনে আসতাম তবে নামতাম। তোমরা তোমাদের বাদশাহকে জিজ্ঞেস কর, আমি কি তার প্রয়োজনে এসেছি, না আমার নিজের প্রয়োজনে এসেছি?* যদি বলে, আমার প্রয়োজনে এসেছি তবে সে ভুল বলেছে। আমি তোমাদের ছেড়ে ফিরে চলে যাব। আর যদি বলে, তার প্রয়োজনে এসেছি তবে আমি যেভাবে চাইব সেভাবে তোমাদের নিকট আসব। রুস্তম শুনে বলল, তাকে ছেড়ে দাও, যেভাবে আসতে চায় আসতে দাও।
হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) সামনে অগ্রসর হলেন এবং রুস্তমের নিকট গিয়ে দাড়িয়ে গেলেন। রুস্তম তার সিংহাসনে বসে ছিল। সে বলল, সওয়ারী থেকে নীচে নামুন। হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন, আমি নীচে নামব না। তিনি যখন নামতে অস্বীকার করলেন তখন রুস্তম জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার, আজ আপনি আসলেন, গতকাল যিনি আমাদের নিকট এসেছিলেন, তিনি আসলেন না কেন? হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন, আমাদের আমীর (সা'দ রাঃ) কঠিন ও নরম সর্বাবস্থায় আমাদের মধ্যে সমতা রক্ষা করা পছন্দ করেন। এজন্য গতকাল তার পালা ছিল আর আজ আমার পালা।
রুস্তম বলল, আপনারা কেন এসেছেন? হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) বললেন,
আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে আপন দ্বীন দান করে আমাদের উপর দয়া করেছেন, আমাদেরকে আপন কুদরতের নিদর্শনসমূহ এমনভাবে দেখিয়েছেন যে, আমরা তা বুঝতে পেরেছি, অথচ ইতিপূর্বে আমরা এ বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ তাআ'লা আমাদেরকে আদেশ করেছেন যেন আমরা সমস্ত মানুষকে তিন বিষয়ের যে কোন একটি গ্রহণ করার আহ্বান জানাই। তারা যে কোনটি গ্রহণ করবে আমরা তাকে মেনে নেব। প্রথম হলঃ ইসলাম গ্রহণ কর। যদি ইসলাম গ্রহণ কর তবে আমরা তোমাদেরকে ছেড়ে চলে যাব। দ্বিতীয় বিষয় হলঃ যদি ইসলাম গ্রহণ না কর তবে জিজিয়া প্রদান কর। যদি জিজিয়া প্রদান কর তবে তোমাদের প্রয়োজন হলে আমরা তোমাদেরকে দুশমনের হাত থেকে থেকে হেফাজত করব। তৃতীয় বিষয় হলঃ যদি এ দুটির একটিও গ্রহণ না কর তবে যুদ্ধ ও মোকাবিলা হবে। রুস্তম বলল, কিছু দিনের জন্য কি সন্ধি হতে পারে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, তিন দিনের জন্য হতে পারে। তবে গতকাল থেকে সেই তিন দিন গণ্য হবে।
রুস্তম যখন হুযাইফা ইবনে মেহসান (রাঃ) থেকে সে একই উত্তর পেল যা সে রিবঈ ইবনে আমের (রাঃ) থেকে পেয়েছিল তখন হুযাইফা ইবনে মেহসানকে (রাঃ) ফেরত পাঠিয়ে দিল এবং নিজ সাথীদের প্রতি লক্ষ্য করে বলল, 'তোমাদের নাশ হোক! তোমরা আমার মতামতকে কেন বুঝতে পারছ না? গতকাল এক ব্যাক্তি আমাদের নিকট আসল এবং আমাদের জমিনে আমাদের উপর জয়ী হয়ে গেল, আমাদের মূল্যবান জিনিসপত্রকে তুচ্ছ গণ্য করে দেখাল। মূল্যবান জিনিসের উপর সে তার ঘোড়া উঠিয়ে খাড়া করল, আর আমাদের মূল্যবান বালিশের সাথে ঘোড়া বাঁধল। সে এটা দ্বারা পূর্বাভাস গ্রহণ করে আমাদের জমিন ও তাতে যা কিছু আছে সমস্তই তার সাথীদের নিকট নিয়ে চলে গেল। উপরন্তু সে অত্যন্ত বুদ্ধিজ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তি ছিল। আজ এ দ্বিতীয় ব্যাক্তি আমাদের নিকট আসল এবং আমাদের মাথার উপর এসে দাঁড়াল। সেও পূর্বাভাস নিয়ে গেল। সে তো আমাদেরকে বের করে দিয়ে আমাদের জমিন দখল করে নিবে।'
রুস্তমের সাথীগণও তাকে কঠোর ভাষায় উত্তর দিল এবং এভাবে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে থেকে একপর্যায়ে রুস্তম রাগান্বিত হয়ে গেল এবং তার সাথীগনও রাগান্বিত হয়ে গেল।
-
পরের দিন রুস্তম পয়গাম পাঠাল যে, আমাদের নিকট একজন লোক পাঠাও। সুতরাং মুসলমানগন মুগীরা ইবনে শো'বাকে (রাঃ) পাঠাল। আবু উসমান নাহদী রহ. বলেন, মুগীরা ইবনে শো'বা (রাঃ) পুলের উপর পৌঁছলেন এবং পুল পার হয়ে পারস্যবাসীদের নিকট যেতে চাইলে পাহারাদারগণ তাকে আটকাল এবং রুস্তমের নিকট তার ব্যাপারে অনুমতি চাইল। তারা সাহাবাদের (রাঃ) প্রভাবিত করার জন্য যে সকল শাহী ব্যাবস্থা গ্রহণ করেছিল সমস্ত কিছুই বহাল ছিল, কোন পরিবর্তন করে নি। তারা মাথার মুকুট ও সোনার তার দ্বারা বুনানো কাপড় পরিধান করেছিল। তীর নিক্ষেপ করলে যতদূর যায় ততদূর পর্যন্ত গালিচা বিছিয়ে রেখেছিল। বাদশাহ পর্যন্ত পৌঁছুতে তার উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ব্যতীত আর কোন উপায় ছিল না।
রুস্তম অনুমতি দিলে মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) সেখান থেকে অগ্রসর হলেন। তার চুলে চারটি বেণি ছিল। তিনি চলতে চলতে রুস্তমের সিংহাসন ও গদীর উপর গিয়ে বসে গেলেন। এতে তারা সকলে মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং তাকে ধরে ঝাঁকাতে লাগল। অবশেষে তাকে সিংহাসন থেকে নীচে নামিয়ে দিল। মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) বললেন, 'আমাদের নিকট এ সংবাদ পৌঁছেছিল যে, তোমরা নাকি অনেক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান লোক, কিন্তু আমি তো তোমাদের ন্যায় বোকা ও মূর্খ লোক আর দেখিনি! আমরা আরবের লোকেরা(মুসলিমরা) সকলেই সমান। আমাদের মধ্য থেকে কেউ কাউকে গোলাম বানায় না, হ্যাঁ, যদি কারো সাথে যুদ্ধ হয় তবে ভিন্ন কথা। আমার ধারণা ছিল, তোমরাও বোধ হয় আমাদের মতই পরস্পর সমতা বজায় রেখে চল। তোমরা যা করেছ তা অপেক্ষা উত্তম এটা ছিল যে, আমাকে পূর্বেই জানিয়ে দিতে যে, তোমরা পরস্পর সমান নও, বরং একে অপরের রব। রুস্তমের সাথে এক আসনে বসা যদি তোমাদের মতে ঠিক না হয়ে থাকে তবে আগামীতে আমরা এরূপ করব না। তোমাদের নিকট আমি নিজ প্রয়োজনে আসি নি। তোমরা ডেকেছ বলে এসেছি। আজ আমি বুঝতে পেরেছি যে, তোমাদের শাসনক্ষমতা দূর্বল হয়ে গেছে এবং তোমরা পরাজিত হবে। এ ধরনের নীতি ও জ্ঞানবুদ্ধির উপর কোন রাজত্ব টিকে থাকতে পারে না।'
সাধারণ লোকেরা মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর কথা শুনে বলল, খোদার কসম, এ আরবী সঠিক ও সত্য কথা বলেছে। আর তার মাতব্বরগণ বলল, খোদার কসম, এ ব্যক্তি তো এমন এক কথার তীর নিক্ষেপ করেছে যদ্দরুণ আমাদের গোলামরা সর্বদা আমাদেরকে তাদের দিকে টানতে থাকবে। আমাদের খোদা আমাদের পূর্ববর্তীদেরকে নিপাত করুন! তারা কেমন আহম্মক ছিল যে, এ সমস্ত আরবদের বিষয়কে মামুলী ও সাধারণ জ্ঞান করেছে! আর আজ তারা কি পরিমাণ শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে আত্নপ্রকাশ করেছে। শুরুতেই তাদের মূল উৎপাটন করে দেয়া উচিত ছিল। বর্ণনাকারী অতঃপর হাদীসের বাকী অংশ উল্লেখ করেছেন, যাতে রুস্তমের বিভিন্ন প্রশ্ন ও মুগীরাহ ইবনে শো'বা (রাঃ) এর উত্তর উল্লিখিত হয়েছে।
Note:
Ibn Jareer, volume 3, page: 33,36
হায়াতুস সাহাবাহ (রা)- হযরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভী রহ.
Comment