Announcement

Collapse
No announcement yet.

হায়দারাবাদ:ভূলে যাওয়া ইতিহাস

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • হায়দারাবাদ:ভূলে যাওয়া ইতিহাস

    ১৯৪৮ সালের এইদিনে ভারতের কাছে স্বাধীনতা হারিয়েছিল মুসলিম হায়দারাবাদ



    মুঘল সেনাবাহিনীর একজন প্রভাবশালী সেনাপতি ছিলেন মীর কমরউদ্দিন খান আসফজাহ। তুর্কি বংশোদ্ভূত এই সেনাপতি হায়দ্রাবাদ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন।

    বিখ্যাত মুঘল সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেব ১৭১৩ খৃষ্টাব্দে মীর কমরউদ্দিন খান আসফজাহকে নিজামুল মুলক উপাধি দেন এবং তাকে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত করেন। আরো পরে ১৭২৪ খৃষ্টাব্দে তিনি হায়দারাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং হায়দারাবাদ একটি স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা লাভ করে। ৮২,৬৯৮ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে সুবিশাল এই রাজ্যের শাসককে নিজাম বলে সম্বোধন করা হত।

    হায়দ্রাবাদের প্রথম নিজাম মীর কমরউদ্দিন খান আসফজাহের মৃত্যুর পর তার মেয়ের ঘরের নাতি (খায়রুন্নেসা বেগমের পুত্র) মুজাফফর জঙ্গ এবং তার পুত্র নাসির জঙ্গের (১৭৪৮–৫০) মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদ হয়।

    ঠিক সে সময়ে ভারতবর্ষে বহিরাগত ফরাসী ও ইংরেজ ব্যবসায়ীদের ভিতরে পরষ্পর প্রাধান্য বিস্তারের লড়াই চলছে।

    সে সময় ইংরেজ ব্যবসায়ীরা নিজামের পুত্র নাসির জঙ্গের পক্ষ নেন আর ফরাসীরা পক্ষ নেন নিজামের নাতি মুজাফফর জঙ্গের ।

    বিবাদ যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়। মুজাফফর জঙ্গ পরাজিত হয়ে মামার সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হন। কিন্তু দুই বছরের মাথায় আততায়ীরা নাসির জঙ্গকে হত্যা করে।

    তখন মুজাফফর জঙ্গ নিজেকে স্বাধীন নিজাম ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করেন। ফরাসী গভর্ণর ডুপলিক্সকে তিনি রাজ্যের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। রাজপরিবারের অন্তর্দন্দের সুযোগ নিয়ে হায়দ্রাবাদের শাসন ক্ষমতায় এভাবেই প্রথমবারের মতো বিদেশীদের প্রভুত্ব এবং প্রভাব অনুপ্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়।


    ইংরেজরাও বসে ছিলনা। ফরাসীদের অনুগত মোজাফফর জঙ্গের বিরূদ্ধে ইংরেজরা (প্রথম নিজাম আসফজাহের চতুর্থ পুত্র) মীর নিজাম আলি খানকে (১৭৬২–১৮০৩) হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে বসতে সহায়তা করে। তার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ শেরে মহিশূর টিপু সুলতানের সাথে যখন ইংরেজদের যুদ্ধ হল সে যুদ্ধে হায়দ্রাবাদের এই মীর নিজাম আলী টিপু সুলতানের বিরূদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করেন। এ ঘটনার পর ভারতের স্বাধীনতাকামী মানুষ “বিশ্বাসঘাতক” নিজাম ও হায়দ্রাবাদের উপর এতটাই ক্ষুব্ধ হন যে, ১৯৮৪ সালে যখন ইন্ডিয়া হায়দ্রাবাদকে দখল করে নিলো সে সময়ে অনেক মানুষ ছিলেন যারা হায়দ্রাবাদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখান নি।

    ভারতের স্বাধীনতার সিদ্ধান্ত যখন চূড়ান্ত হয়ে গেল তখন ভারতে ৫৬২ টি দেশীয় রাজ্য ছিল, যেগুলি ব্রিটিশ সরকারের সাথে বিশেষ চুক্তি বা ব্যবস্থাধীনে পরিচালিত হত। স্বাধীনতার পর দেশ বিভক্ত হলে দেশীয় রাজ্যগুলির ভবিষ্যৎ কি হবে, তা একটি বড় প্রশ্ন হয়ে উঠল।

    ১৯৪৭ সালে প্রণীত ভারত স্বাধীনতা আইনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল:

    ১৯৪৭–এর ১৪ আগস্টের পর দেশীয় রাজ্যগুলির উপর থেকে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ অবসানের পর এই রাজ্যগুলো নিজেদের ইচ্ছামত ভারত বা পাকিস্তান যেকোনো ডোমিনিয়নে যোগ দিতে পারবে অথবা যদি তারা চায় তাহলে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকতে পারবে।

    ১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীনতা আইনের এই নীতি অত্যন্ত ন্যায়ানুগ ও বাস্তবসম্মত ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষ করে নেহেরুর বন্ধু এবং কংগ্রেসের চিন্তার সংগে একাত্ন স্বয়ং ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেনের ষড়যন্ত্রে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

    ১৯৪৭ এর ২৫ জুলাই মাউন্ট ব্যাটেন দেশীয় রাজাদের একটি বৈঠক আহবান করেন সেখানে তিনি দেশীয় রাজাদের সরাসরি মুখের উপর ভারতে যোগ দিতে বলে দেন। মাউন্ট ব্যাটেনের হুমকিতে দেশীয় রাজাদের অধিকাংশই ১৫ আগস্টের পূর্বেই ভারতভুক্তির দলিলে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

    যারা স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেন তাদের জন্য ভিন্নপথ অবলম্বন করা হয়। যেমন, ত্রিবাঙ্কুর, যোধপুর, ভূপাল (যার নবাব ছিলেন মুসলমান) ভারতে যোগ দিতে অসম্মতি জানায় তখন কংগ্রেস ঐ সমস্ত রাজ্যে তাদের কর্মীদের দ্বারা গোলযোগ তৈরী করে রাজ্যগুলোক ভারতে মিশে যেতে বাধ্য করে। ফলে ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্টের পূর্বেই হায়দারাবাদ, জুনাগর ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের প্রত্যাশিত সকল রাজ্যই ভারতে অন্তর্ভূক্ত হতে বাধ্য হয়।

    জুনাগরের নবাব ছিলেন মুসলমান কিন্তু জনগণের বেশীরভাগ ছিলেন হিন্দু ও কংগ্রেস সমর্থক। ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট জুনাগরের নবাব পাকিস্তানে যোগদানের কথা ঘোষণা করার সাথে সাথেই কংগ্রেস কর্মীরা দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরী করে এবং ভারতীয় সৈন্যরা জুনাগর ঘেরাও করে ফেলে। নভেম্বরে ভারতীয় সৈন্য জুনাগরে প্রবেশ করে এবং দেশটি দখল করে নেয়। পাকিস্তানে যোগদানকারী কোনো রাজ্যে সেনা সমাবেশ ঘটিয়ে রাজ্য দখল করে নেওয়ার সেটাই ছিল ভারতের প্রথম পদক্ষেপ। জুনাগর দখলে ভারতের অজুহাত ছিল, সেখানকার বেশীরভাগ জনগণ হিন্দু এবং তারা ভারতে যোগ দেওয়ার পক্ষপাতি কিন্তু কাশ্মীরের বেলায় ভারত সেই অজুহাত মানতে রাজি হয়নি।

    কাশ্মীরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয় যে, কাশ্মীরের জনগণ গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে তারা পাকিস্তানে না ভারতে থাকবে।

    ১৯৪৭ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “গণভোটের যে শর্তে কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ভারত অবশ্যই সে শর্ত পূরণ করবে।”

    এর আগে ১৯৪৭ সালের ৩১ অক্টোবর জওহরলাল নেহেরু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রেরীত এক বার্তায় বলেছিলেন, “আমাদের এই প্রতিশ্রুতি শুধু আপনার সরকারের কাছে প্রদত্ত ওয়াদা মাত্র নয়, বরঞ্চ এটা কাশ্মীরের জনসাধারণ এবং সেটা সারা দুনিয়ার প্রতি আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।”

    কিন্তু গণভোট আর হয়নি। কাশ্মীরকে জোর করে ভারত দখল করে নেয়।

    এরপর বাকি ছিল কেবল হায়দ্রাবাদ। রাজ্যটি ছিল আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও বড়। শুধু আয়তনের দিক থেকে নয়, সম্পদ, সমৃদ্ধি সামর্থের দিক থেকেও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার সকল সম্ভাবনাই হায়দ্রাবাদের ছিল। হায়দ্রাবাদের নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ছিল। নিজস্ব মুদ্রা ব্যবস্থা ছিল। সেনাবাহিনী ছিল। আইন আদালত ছিল। বিচার ব্যবস্থা ছিল। হাইকোর্ট ছিল। শুল্ক বিভাগ ছিল। নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, পতাকা, ভাষা, জাতীয় সঙ্গীত, বিভিন্ন দেশে নিজেদের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসঙ্ঘে নিজস্ব প্রতিনিধি ছিল।

    ১৯৩৫ সালের গভর্নমেন্ট অব ইনডিয়া এ্যক্টে হায়দ্রাবাদকে স্বাধীন মর্যাদা দিয়ে বলা হয়েছিল, দেশীয় রাজ্যগুলির পদমর্যাদা ও স্বাভাবিক কার্যাবলী রাজ্যগুলোর অনুমতি ব্যতীরেকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না।

    ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের নয় তারিখে হায়াদ্রাবাদের নিজাম মাউন্ট ব্যটেনকে লেখা এক পত্রে বলেন, “ব্রিটিশ সরকার ও হায়দ্রাবাদের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী হায়দ্রাবাদ স্বাধীন থাকতে চায়। আমরা ভারত বা পাকিস্তান কারো সাথেই যোগ দেবনা।”

    মাউন্ট ব্যাটেন পত্রটি ব্রিটিশ রাজের কাছে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চিঠিটি আর ব্রিটেনকে পাঠান নি।

    ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষিত হল। ১৫ আগস্ট মাউন্ট ব্যাটেনকে গভর্ণর জেনারেল রেখেই ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা ঘোষিত হল। সে দিনই হায়দ্রাবাদ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।

    ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ইন্ডিয়ার সাথে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে তা নির্ধারণের আগ পর্যন্ত ইন্ডিয়া ও হায়দ্রাবাদের মাঝে একটি নিষ্ক্রিয়তামূলক চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

    হায়দ্রাবাদে কিছু হিন্দু সংগঠন ছিল এরা ভারতের মূল হিন্দু সংগঠনের শাখা। তাদের অর্থ ও নির্দেশনা সীমান্তের অপার থেকে আসত। আর ছিল কিছু চরমপন্থী বাম হিন্দু সংগঠন।

    হায়দ্রাবাদে অরাজক পরিস্থিতি তৈরী করতে ইন্ডিয়ার পরিকল্পনায় এই সংগঠনগুলো ভূমিকা রাখে। সংগঠনগুলোর আশ্রয়ে সীমান্তের অপার থেকে হাজার হাজার লোক হায়দারাবাদে অনুপ্রবেশ করে।

    এরা রাজনৈতিক নেতাদের গুপ্তহত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযেোগ এবং সীমান্ত রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

    পরিস্থিতি ক্রমেই হায়দ্রাবাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যায়। পরিস্থিতির নাযুকতা বুঝতে পেরে সাধারণ মুসলমানগণ শেষ সময়ে এসে কিছু করার প্রয়োজন উপলব্ধি করেন। প্রথমে বাহাদুর ইয়ার জং এবং তার মৃত্যুর পর কাসিম রিজভির নেতৃত্বে ইত্তেহাদুল মুসলিমিন গঠিত হয়। অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন ব্যর্থ হয় কিন্তু অল্প সময়ের ভিতরে ইত্তেহাদের স্বেচ্ছাসেবকরা হায়দ্রাবাদে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনেন।

    তবে ভারতীয় মিডিয়া বিশেষ করে হিন্দুস্তান টাইমস ইত্তেহাদের পদক্ষেপগুলোকে সাম্প্রদায়িক বলে প্রচার করতে থাকে। হিন্দু বামপন্থী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর বিরূদ্ধে যে ব্যবস্থাগুলো নেওয়া হত সেগুলোকে হিন্দুদের উপর জুলুম–নির্যাতনের সাম্প্রদায়িক কাহিনী বানিয়ে সমস্ত পত্রিকাগুলো প্রপাগান্ডা শুরু করে।

    অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোককে ভারতে আনিয়ে তাদেরকে শরণার্থী সাজানো হয়। প্রচার করা হয়, হায়দ্রাবাদে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছে যে সেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আর বসবাস করতে পারছে না। এই সাজানো শরণার্থীদের পুঁজি করে আরো প্রপাগান্ডা চালানো হয় যে হায়দ্রাবাদে হিন্দুদের জান–মালের কোনো নিরাপত্তা নেই।

    কিন্তু ইত্তেহাদের প্রতিরোধের প্রভাবে ইন্ডিয়া শেষ পর্যন্ত হায়দরাবাদের সাথে একটা স্ট্যান্ডস্টীল চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তিতে তারা হায়দারাবাদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়। বিনিময়ে ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে শর্ত দেওয়া হয় যে, আগামী এক বছর হায়দ্রাবাদ তার সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারবে না এবং পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে না।



    ৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরে রিজার্ভ ব্যাংকের অংশ হিসাবে ইন্ডিয়ার নিকট পাকিস্তানের ৫০ কোটি টাকা পাওনা ছিল। দেশ ভাগের পর এই টাকা দিতে ভারত অস্বীকার করে। ফলে সদ্যোসৃষ্ট পাকিস্তান অর্থ সংকটে পরে অস্তিত্ব হারাতে বসে। পাকিস্তানের সেই দুঃসময়ে হায়দ্রাবাদ পাকিস্তানকে ২০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে সাহায্য করে। পাকিস্তানকে ঋণ দানের এই ঘটনাকে ভারত চুক্তি খেলাপের অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে হায়দারাবাদের বিরূদ্ধে অবরোধ আরোপ করে।

    জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, আমরা যখন প্রয়োজন মনে করব তখনই হায়দারাবাদের বিরূদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করব।”

    সে সময় নেহেরুর এই উক্তিকে হিটলারের মানসিকতার অনুরূপ বলে মন্তব্য করেছিলেন উইনস্টন চার্চিল।

    কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলি জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মৃত্যু বরণ করেন। এর দু’দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর ইন্ডিয়া প্রথমে প্রকাশ করে যে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হায়দ্রাবাদের প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে তারা হায়দ্রাবাদে কিছু পুলিশের সদস্য পাঠাচ্ছে। পুলিশের কথা বলে ৩৫ হাজার প্রশিক্ষিত সেনার একটি বহর পাঠানো হয়। সেনা বাহিনী আর্টিলারি, এয়ার সাপোর্ট এবং আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আচমকা হায়দ্রাবাদ আক্রমণ করে। ভারতীয় জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। জেনারেল জয়ন্ত নাথের দাদার বাড়ি বাংলাদেশের পাবনা জেলায়। অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন পোলো।

    মাত্র ২৪০০০ সেনা যার মধ্যে মাত্র ছয় হাজার সেনা ছিল ছিল পুরাতন আমলের অস্ত্রে সজ্জিত। এই সেনাবাহিনী নিয়ে হায়দ্রাবাদ ইন্ডিয়ার বিরূদ্ধে এক অসম প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে।

    সপ্তম নিজাম মীর উসমান আলি খান আসফজাহ ছিলেন হায়দ্রাবাদের শেষ নিজাম। টাইম ম্যাগাজিনের মতে সে সময়ে বিশ্বের শীর্ষ এই ধনী শাসকের রাজ্যে নিজস্ব এয়ারলাইনস, রেল ও নৌ ব্যবস্থা ছিল। অপারেশনের শুরুতেই নিজামকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে ভারতীয় বাহিনী ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের আশ্রয় নেয়। নিরপেক্ষ জরিপে মাত্র পাঁচদিনে দুই লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

    সুন্দরলালের নেতৃত্বে কংগ্রেসের যে কমিটিকে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু হায়দ্রাবাদে ইন্ডিয়ান সেনা বাহিনীর গণহত্যা তদন্তের জন্য পাঠিয়েছিলেন সে কমিটি ৪০ হাজার মুসলমানকে হত্যার কথা উল্লেখ করেছে। তারা বলেছে পুরুষদের প্রথমে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত এবং ঘরে ঘরে যেয়ে মহিলাদের গণ ধর্ষণ করে তাদেরও হত্যা করা হত। তবে রিপোর্টটি ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।

    ১৯৪৮ সালের ২৬ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলকে এক নোট লিখে বলেছিলেন, “তিনি হায়দ্রাবাদে এত বেশি মুসলিম হত্যার বিবরণ পাচ্ছেন যে, তাতে তার ধারণার ভিত কেঁপে গেছে। সেখানে মুসলিমদের সম্পদহানীর খবরও ভয়াবহ।”

    হায়দ্রাবাদের নিজাম পাকিস্তান, আমেরিকা এবং জাতিসংঘের নিকট সাহায্যের জন্য আবেদন জানান। কিন্তু তিনি কোনো সাড়া পাননি। অবশেষে ব্যাপক সম্পদ ও জীবনহানি এড়ানোর জন্য ছয়দিনের মাথায় তিনি আত্নসমর্পণ করতে বাধ্য হন।

    ১৯৪৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর হায়দ্রাবাদের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল আল ইদরুস (যার বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন আছে) ভারতীয় বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধূরীর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। এরপর জাতিসংঘে ভারতের বিরূদ্ধে যে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল তাও হায়দারাবাদ প্রত্যাহার করে নেয়।


    আত্নসমর্পণের পর ইন্ডিয়া হায়দ্রাবাদ রাজ্যকে ভেঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যের সাথে মিশে দেয়।

    বিশ্লেষকরা মনে করেন ইন্ডিয়ার রাজ্য দখলের তৃষ্ণা হায়দ্রাবাদেই সমাপ্ত হয়ে যায়নি। কারণ কংগ্রেস কখনো দেশ বিভাগকে মেনে নেয়নি। প্রশান্ত মহাসাগর থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চল ইন্ডিয়ার একচ্ছত্র দখলে নিয়ে আসা হল নেহেরুর ডকট্রিন। নেহেরুর এই ডকট্রিনে ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল বিশ্বাস করে।

    “মহাত্না” গান্ধী বলেছিলেন, “যতই রক্তপাত হোক এক ইঞ্চি পাকিস্তানও আমি সমর্থন করবো না। তিনি বলতেন: “If india leads a blood bath, she shall have it.”

    ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলতেন, “আজ হোক কাল হোক আমরা আবার এক হব এবং বৃহৎ ভারতের প্রতি আনুগত্য দেখাব।”

    ভারতের কোনো কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবীর মন্তব্যে বোঝা যায় ভারতের হিন্দু মানষ সামাজিক বৈচিত্র্যে বিশ্বাস করে না । বৈচিত্রহীন এক রঙ্গের গেরুয়া হিন্দু সমাজ প্রতিষ্ঠা করাই হল ভারতের চূড়ান্ত গন্তব্য।

    রবার্ট নারায়ন তার দ্য স্টেটসম্যান অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন, “বাল গঙ্গাধর তিলক বলেন, ‘এই উপমহাদেশের মুসলমান অধিবাসীরা হল বিদেশী দখলদার, কাজেই তাদের শারীরিক ভাবেই নির্মূল করতে হবে”।

    রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শক, হুন, পাঠান, মোগলকে “এক দেহে” লীন করার সাম্প্রদায়িক প্রস্তাব দিয়েছেন।

    কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য্য কৃপালণী বলেছিলেন, “কংগ্রেস অথবা সমগ্র ভারতীয় জাতি কখনোই অখণ্ড ভারতের দাবী পরিত্যাগ করবে না।”

    কংগ্রেসের ইচ্ছা ছিলো ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর তারা একচ্ছত্র ভাবে মুসলমানদের শাসন করার অধিকার পাবে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়াতে কংগ্রেসের এই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। গান্ধী ও অন্যান্য হিন্দু নেতা সম্পর্কে মোহাম্মাদ আলি জিন্নাহ বলতেন, “গ্রেট ব্রিটেন ইন্ডিয়া শাসন করতে চায়। মি. গান্ধী ও তার কংগ্রেস মুসলমানদের শাসন করতে চায়। আমরা বলি, ব্রিটিশ অথবা মি. গান্ধী কাউকেই মুসলমানদের উপর শাসন করতে দিবো না।”

    বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোনো ভাবেই অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে না, আজ হোক কাল হোক আমাদের সাথে তাকে মিলতেই হবে।”

    বিশেষত পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার পরে এবং সাম্প্রতিক আসামের বাংলাভাষি মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল এবং তাদেরকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যাপারে আলোচনা ওঠার পর সর্ব ভারতীয় হিন্দু নেতা সাভারকারের একটি মন্তব্য সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের ৫ এপ্রিল হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে তারকেশ্বরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক হিন্দু সম্মেলনে সাভারকর বলেছিলেন, “প্রথমত: পশ্চিমবঙ্গে একটি হিন্দু প্রদেশ করতে হবে। দ্বিতীয়ত: আসামে বসবাসকারী সমস্ত মুসলিমকে আসাম থেকে বিতাড়ন করতে হবে। এরপর পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশকে) দুই হিন্দু প্রদেশের মাঝে ফেলে পিষে মারতে হবে।

    দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশি দেশগুলো সম্পর্কে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির গূঢ়তত্ত্ব বুঝতে আরো একটা তথ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

    পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কে ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক পরামর্শক কৈটিল্যের কিছু উপদেশ আছে। ভারতে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তাদের নিকট ভারতের হিন্দু রাজাদের প্রাচীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা কৈটিল্যের উপদেশগুলো ঐশ্বরিক বাণীর মত অনুসরণীয়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র সম্পর্কে তার কয়েকটি পরামর্শ হল:

    ‘সকল সীমান্তবর্তী রাজ্যকে শত্রু মনে করবে।’

    ‘ক্ষমতার লোভ এবং অন্য দেশ বিজয়ের আকাঙ্ক্ষাকে কখনো মন থেকে মুছে যেতে দিবেনা।’

    ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে।’

    ‘সারা পৃথিবী চাইলেও তুমি নিজে শান্তির কথা চিন্তাও করতে পারবে না।’

    ইনসাফ টোয়েন্টিফোর ডটকম |
Working...
X