ইসলামের তারকাগণ | ৮ম পর্বঃ হযরত ইকরামা ইবনে আবু জাহল রাদিয়াল্লাহু আনহু (৩)
ইসলাম গ্রহণের সময় ইকরিমা যে ওয়াদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে করেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার জন্য তিনি ভীষণ কঠোর ও দৃঢ় ছিলেন। তাঁর ইসলাম গ্রহণের পর যতগুলো যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী অংশগ্রহণ করেছে, তার প্রতিটিতেই ইকরামা ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রথম সারির অকুতোভয় যোদ্ধা।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে সময় দিকে দিকে ইরতিদাদের (ধর্মত্যাগের) ফিতনা ছড়িয়ে পড়ে। কোমল হৃদয়ের অধিকারী আবু বকর আল্লাহর অশেষ রহমতে তা অসাধারণভাবে কঠোর হাতে দমন করেন। এ সময় আরবের অধিকাংশ অঞ্চলে মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইকরিমা ছিলেন মুসলিম সেনাদলের অন্যতম সমরবিদ ও যোদ্ধা। আবু বকরের পর উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফত শুরু হল। এককালের প্রবল পরাক্রান্ত রোমান আর পারসিয়ান সাম্রাজ্য তখন মুসলিমদের হাতে নাস্তানাবুদ অবস্থা। সে সময় রোমান সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিমদের এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয়; ইতিহাসে তা ইয়ারমুকের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে ইকরিমা রাদিয়াল্লাহু আনহুর কৃতিত্ব বর্ণনা করার আগে যুদ্ধটির ঐতিহাসিক কিছু প্রেক্ষাপট আলোচনা করা জরুরী।
নব্বই দশক পর্যন্ত যেমন পৃথিবী আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন- এ দুটি সুপার পাওয়ারে বিভক্ত ছিল, ঠিক তেমনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ পৃথিবীতে ইসলামের বার্তা নিয়ে আসেন তখন রোমান এবং পারস্য নামে দুটি সাম্রাজ্যের সুপার পাওয়ারে এ পৃথিবী বিভক্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময়ে সিরিয়াসহ বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত এক ভূখণ্ডকে বলা হতো শাম। ঐ শাম ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীন, আর ইরাকের কিছু অংশ এবং ইরান ও এর সংলগ্ন এলাকাগুলো ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অধীন। এ দুটি শক্তি দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধ করে যাচ্ছিল এবং পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ এ দুটি সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। সম্পদ, মর্যাদা, সামরিক শক্তি, ক্ষমতা সবদিক থেকে এ জাতি দুটো ছিলো সবার চেয়ে অগ্রগামী। এ দুটি সাম্রাজ্যের শাসিত অঞ্চলগুলো ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে অতুলনীয়।
আরব জাতি ছিলো ভৌগলিকভাবে এ দুটো জাতিরই প্রতিবেশী। রোমান এবং পারসিকরা আরব জাতিকে অসভ্য একটি জাতি হিসাবে জানতো। আরবীয়দের সাথে তারা মিশতে চাইতো না। আর, তাদের রাজসভায় আরবীয়দের প্রবেশাধিকার অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত ছিল। আরবীয়রাও এ দুটি সাম্রাজ্যের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের ক্ষমতাকে অত্যন্ত সমীহ করে চলতো। আরবীয় কয়েকটি গোষ্ঠীর রাজা এবং স্থানীয় শাসকবর্গ রোমান অথবা পারসিকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তাদের শাসন মেনে কর দিয়ে চলতো। এমন অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ঘটল এ পৃথিবীতে। ইসলামের প্রচারের প্রথমদিকে তিনি মানুষকে আল্লাহর দিকে ডেকে ডেকে বলতেন, “তোমরা ইসলামের ছায়াতলে এসে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে নাও। আল্লাহর শপথ, একদিন পারসিক ও রোমানদের সম্পদ আল্লাহ্ তোমাদের হাতে তুলে দেবেন।”। তাঁর কথা শুনে কাফেররা হাসতো, আরবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী লোকটি কেন এমন কথা বলছেন তা ভেবে আবার কেউ কেউ বিস্মিত হতো।
***
ধীরে ধীরে ইসলামের আলো বিকশিত হতে লাগল, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দূত পাঠিয়ে সকলের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে লাগলেন। এভাবে একদিন রোমান এবং পারসিক সম্রাটের কাছেও তাঁর দূত পৌঁছে গেলো। তবে ক্ষমতার মোহে অন্ধ দাম্ভিক সম্রাটরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আহ্বানে সাড়া দেয়নি।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু খিলাফতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁর খিলাফতকালে মুসলিম মুজাহিদরা মাজলুমদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যুগপতভাবে পারস্য ও রোম সাম্রাজ্যে আক্রমণ শুরু করেন। প্রথমদিকে পারস্য অঞ্চলের যুদ্ধে মুসলিমবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু। এরপর তিনি মুসান্না ইবন্ হারিসার হাতে মুসলিম বাহিনীর কমান্ড ন্যস্ত করে চলে আসেন রোমানদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এবং সেখানে তাঁর কাছ থেকে মুসলিম বাহিনীর কমান্ড গ্রহণ করেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররা রাদিয়াল্লাহু আনহু। একের পর এক যুদ্ধ হতে লাগল। আর যৎসামান্য রসদ, ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়েও মুসলিমরা এ দুটি সাম্রাজ্যের অধীন রাষ্ট্রগুলো জয় করতে থাকেন। পারস্য সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তার নাম কাদেসিয়ার যুদ্ধ এবং রোমানদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ভয়ংকরতম যুদ্ধটি ছিল ইতিহাস বিখ্যাত ইয়ারমুকের যুদ্ধ।
ইয়ারমুকের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হবার আগে মুসলিম সেনাদল রোমানদের রাজ্যগুলো একের পর এক জয় করছিলেন। ইসলামের এ বিজয় যখন আর রোধ করা যাচ্ছে না, তখন সুবিশাল রোমান সাম্রাজ্যের সকল অংশ থেকে সেনাদল নিয়ে এসে জড়ো করা হল ইয়ারমুকের প্রান্তরে। প্রায় দেড় লাখ তৎকালীন সর্বোৎকৃষ্ট অস্ত্র সজ্জিত রোমান সেনা মাত্র তেত্রিশ হাজার মুসলিমের এক ক্ষুদ্র বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য হাজির হল। ইসলামের ইতিহাসে কঠিনতম সে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্য বীর মুসলিম মুজাহিদ কমান্ডার খালিদ ইবন্ ওয়ালিদ কমান্ড গ্রহণ করলেন আবু উবায়দা ইবনুল জাররার কাছ থেকে।
ইকরিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু এ যুদ্ধে ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একজন কমান্ডার। মরুভূমিতে পানিবিহীন পথচলার পর পথিক যেভাবে পানির জন্য ক্ষিপ্র হয়ে ছুটে চলে, এ যুদ্ধে ইকরিমাও তেমনি বার বার তাঁর সেনাদল নিয়ে রোমানদের উপর আক্রমণ করে যাচ্ছিলেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে রোমান সেনাদল আক্রমণ করে মুসলিম বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ইকরিমা সিদ্ধান্ত নিলেন, সুরক্ষিত রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে প্রবেশ করবেন এবং নিজের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতি করবেন। ইকরিমার এ সংকল্পের কথা শুনে খালিদ দ্রুত তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন,
“এ কাজ তুমি করো না ইকরিমা, তোমার মৃত্যু হবে মুসলিমদের জন্য একটা বড় আঘাত”।
ইকরিমা বললেন,
”আমাকে যেতে দাও খালিদ, আল্লাহর রাসূলের সাথে থাকার এবং তাঁর সাথে যুদ্ধ করার সুযোগ তুমি পেয়েছো। আমার বাবা আর আমি ছিলাম তাঁর সবচেয়ে ঘৃণ্য শত্রু। যে পাপ আমি করেছি তার শোধ দেবার সুযোগ তুমি আমাকে দাও। আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে আমি অনেকগুলো যুদ্ধ করেছি, আর আজ আমি এ রোমানদের দেখে পালিয়ে যাব তা কিছুতেই হতে দেয়া যায় না।”
ইকরিমা তখন বাহিনীর লোকদের ডেকে বললেন, “মৃত্যুর জন্য আমার হাতে বায়াত করবে এমন কে কে আছো?”। তাঁর এই আহ্বানে হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া-সহ চারশো মুজাহিদ তাকবীর ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এলেন। অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এ দলটি সবাইকে ছাড়িয়ে রোমান বাহিনীর একেবারে ভেতরে ঢুকে পড়লেন এবং শাহাদাতবরণের পূর্ব পর্যন্ত এ দলের প্রত্যেকে বীরের মত যুদ্ধ করলেন। এ দলটি রোমান বাহিনীর যে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত করেছিলেন তা আর কাফের রোমান বাহিনী কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সেদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর দেখা গেল, মুসলিমদের মধ্যে যাঁরা শাহাদাতবরণ করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনজন মুমূর্ষু অবস্থায় কাতরাচ্ছেন। এই তিনজন ছিলেন হারিস ইবন্ হিশাম, আইয়াশ ইবন্ রাবিয়া এবং ইকরিমা ইবন্ আবু জাহল। ইকরিমার খোঁজ পেয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ তাঁর মাথা নিজ কোলে তুলে নিলেন। তাঁর দুচোখ বেয়ে ক্রমাগত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিলো। ইকরিমা এবং হারিস পানির জন্য ডাকছিলেন। তাঁদের জন্য দ্রুত পানির ব্যবস্থা করা হলো। পানি আনার পর আইয়াশ তাঁদের দিকে তাকালেন। তাঁরা বললেন, “এ পানি আইয়াশকে দাও।” আইয়াশের কাছে পানি নিয়ে যাবার পর দেখা গেলো তিনি ততক্ষণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে রবের সাক্ষাতে চলে গেছেন। আবার পানি যখন ইকরিমা এবং হারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো, ততক্ষণে তাঁরা দুজনও শাহাদাতের অমীয় সুধা পানে ধন্য হয়ে *দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
উপস্থিত মুসলিমদের চোখ আবেগে অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। তাঁদের মনে পড়লো ইকরামার অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের কথা। একদিন যে লোকটির হাত আল্লাহর বাণীকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য রক্ত ঝরাতো, আজ তাঁর দেহের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে গেছেন আল্লাহর জন্য।
ইয়ারমুকের ময়দান ছিল ইসলামের ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইয়ারমুকের বিজয় ইসলামের শত্রুদের পরাজয়ের দ্বার খুলে দিয়েছিল। সে সময়ের কথিত সুপার পাওয়ার বাহিনীর পরাজয় ইসলামের অন্যান্য শত্রুদের কোমড় ভেঙ্গে দিয়েছিল। সে বিজয়ের ধারাবাহিকতায় মুসলিমগণ সমগ্র সিরিয়া বিজয় করে নিয়েছিলেন। এমনকি তাঁরা দক্ষিণ আফ্রিকাকেও ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন করেছিলেন।
তথ্যসূত্র
আস সিরাতুন নবুবিয়্যাহ ইবনে হিশাম
সিয়ারে আলামুন নুবালা/ আয যাহাবী
আল কামেল ফিত তারিখ/ ইবনে আসীর
সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা/ আব্দুর রহমান রাফাত পাশা
সূত্র: https://alfirdaws.org/2019/12/09/29466/
Comment