ইমাম ছাড়া জিহাদ একাধিক সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, চারো মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরাম বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ইমাম ছাড়া জিহাদের অনুমতি প্রদান করেছেন। এ ব্যাপারে পূর্বেও ভাইয়েরা লেখালেখি করেছেন। বিশেষকরে ইলম ও জিহাদ ভাইয়ের লিখিত প্রবন্ধটি এ বিষয়টি প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট। এতে একাধিক সহিহ হাদিসের পাশাপাশি চারো মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরামের বক্তব্যও পেশ করা হয়েছে। নিচের লিংক থেকে লেখাটি পড়ে নিতে পারেন।
তবে, আমি একটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মাসয়ালাটি নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি, তা হলো, ইমাম ছাড়া জিহাদ স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যমানা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত চলমান রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরণের একাধিক জিহাদের ব্যাপারে অবগতি লাভ করেছেন। কিন্তু কোন আপত্তি তুলেননি। তিনি বলেননি যে, আমার অনুমতি নেওয়া ছাড়া তোমাদের জন্য এ ধরণের যুদ্ধ-আক্রমন করা ঠিক হয়নি। তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর থেকে আজ পর্যন্ত ইমাম ছাড়া জিহাদ চলমান রয়েছে। দীর্ঘ বারোশত বছর পর্যন্ত কোন আলেম এর উপর আপত্তি তুলেননি। বরং অনেকেই এধরণের জিহাদের প্রশংসা করেছেন, অনেকে এতে অংশগ্রহণও করেছেন। যা প্রমাণ করে ইমাম ছাড়া জিহাদ বৈধ হওয়া উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাস বা যুগ যুগ ধরে চলমান নিরবিচ্ছিন্ন কর্মধারা। হাঁ, ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে যখন মুসলিমরা ওয়াহান আক্রান্ত হয়ে যায়, জিহাদ ও শাহাদাহর প্রতি তাদের অন্তরে ভয়-ভীতি বেড়ে যায়, তখন তারা জিহাদ থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য জিহাদের জন্য এধরণের মনগড়া শর্ত আরোপ করতে শুরু করে। এ প্রবন্ধে আমরা ইনশাআল্লাহ ধারাবাহিকভাবে যুগে যুগে ইমাম ছাড়া জিহাদের ঘটনাবলী তুলে ধরবো। আল্লাহ আমাদের কাজ সহজ করে দিন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যমানায় ইমামের অনুমতি ছাড়া জিহাদের একাধিক ঘটনা ঘটেছে, এরমধ্যে অন্যতম হলো, মহান সাহাবী আবু বাসীর ও তার সাথীদের ঘটনা যা উল্লিখিত প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। আরেকটি হলো, বিখ্যাত সাহাবী সালামা বিন আকওয়া রাযি. এর ঘটনা। এ ব্যাপারে ইনশা্আল্লাহ আগামীতে আলোচনা করবো। আজকে রাসূলের যুগের তৃতীয় আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করছি, তা হলো সাহাবী ফিরোজ দাইলামী কর্তৃক ইয়ামানের ভন্ড নবী আসওয়াদ আনসীকে হত্যার ঘটনা।
হাফেয ইবনে হাযার রহ সহিহ বুখারীর বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেন,
وروى يعقوب بن سفيان والبيهقي في "الدلائل" من طريقه من حديث النعمان بن بزرج بضم الموحدة وسكون الزاي ثم راء مضمومة ثم جيم قال: خرج الأسود الكذاب وهو من بني عنس يعني بسكون النون وكان معه شيطانان يقال لأحدهما سحيق بمهملتين وقاف مصغر والآخر شقيق بمعجمة وقافين مصغر، وكانا يخبرانه بكل شيء يحدث من أمور الناس، وكان باذان عامل النبي صلى الله عليه وسلم بصنعاء فمات، فجاء شيطان الأسود فأخبره، فخرج في قومه حتى ملك صنعاء وتزوج المرزبانة زوجة باذان ، فذكر القصة في مواعدتها دادويه وفيروز وغيرهما حتى دخلوا على الأسود ليلا؛ وقد سقته المرزبانة الخمر صرفا حتى سكر، وكان على بابه ألف حارس. فنقب فيروز ومن معه الجدار حتى دخلوا فقتله فيروز واحتز رأسه، وأخرجوا المرأة وما أحبوا من متاع البيت، وأرسلوا الخبر إلى المدينة فوافى بذلك عند وفاة النبي صلى الله عليه وسلم. قال أبو الأسود عن عروة: أصيب الأسود قبل وفاة النبي صلى الله عليه وسلم بيوم وليلة، فأتاه الوحي فأخبر به أصحابه، ثم جاء الخبر إلى أبي بكر رضي الله عنه. (فتح الباري: 8/93 ط. دار الفكر)
“হাফেয ইয়াকুব বিন সুফিয়ান ও বাইহাকী তার ‘দালায়িলুন নুবুওয়্যাহ’ গ্রন্থে নোমান বিন বুযরুজের সূত্রে বর্ণনা করেন, “মিথ্যাবাদী আসওয়াদ নবী হওয়ার দাবী করে। সে ছিল আনস গোত্রের। তার সাথে দুটো শয়তান ছিল, একটার নাম সুহাইক অপরটার নাম শুকাইক। তারা আসওয়াদকে চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে অবগত করতো। ইয়ামানের সানআ নগরীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পক্ষ হতে নিযুক্ত গভর্ণর ‘বাজান’ মৃত্যুবরণ করলে শয়তান এসে আসওয়াদকে এ সংবাদ জানায়। তখন সে তার গোত্রের লোকদের নিয়ে সনআ দখল করে নেয় এবং ‘বাজানে’র স্ত্রীকে বিয়ে করে।
তখন বাজানের স্ত্রী আসওয়াদকে হত্যা করার জন্য দাদাওয়াইহ, ফিরোয ও অন্যদের সাথে পরিকল্পনা করে। একদিকে বাজানের স্ত্রী আসওয়াদকে খালেস শরাব পান করিয়ে মাতাল করে রাখে অপরদিকে ফিরোয ও তার সাথীরা আসওয়াদকে হত্যা করার জন্য তার ঘরে আসে। তবে আসওয়াদের ঘরের দুয়ারে একহাজার সৈন্য পাহারা দিচ্ছিল, তাই তারা দেয়াল ছিদ্র করে আসওয়াদের ঘরে প্রবেশ করে। এরপর ফিরোয আসওয়াদকে হত্যা করে তার মাথা কেটে নেন এবং বাজানের স্ত্রী ও পছন্দনীয় মালামাল সহ ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। তারা এই সুসংবাদ রাসুলের নিকট প্রেরণ করেন, রাসুলের মৃত্যুর সময় যা মদীনায় পৌঁছে।” আবুল আসওয়াদ উরওয়া রহ. এর থেকে বর্ণনা করেন, “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের একদিন একরাত পূর্বে আসওয়াদকে হত্যা করা হয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওহীর মাধ্যমে তা অবগত হয়ে সাহাবীদেরকে এ সুসংবাদ প্রদান করেন। রাসূলের ইন্তিকালের পরে খলীফা আবু বকরের নিকট এ সংবাদ পৌঁছে। -ফাতহুল বারী, ৮/৯৩
ইমাম নাসায়ী তহাবী ও তবরানী রহ. বর্ণনা করেন, “ফিরোয দাইলামী আসওয়াদ আনসীর কর্তিত মস্তক নিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আগমন করেন।” হাফেয ইবনুল কাত্তান ও হাফেয হাইসামী রহ. হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। হাফেয ইবনে হাযার হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, “হাদিসের এ অর্থ হতে পারে যে, ফিরোয রাসূলকে সুসংবাদ দেওয়ার জন্য আগমন করেন, কিন্তু তিনি নবীজির নিকট পৌঁছার পূর্বেই তার ইন্তেকাল হয়ে যায়।” -আসসুনানুল কুবরা, নাসায়ী, ৮৬১৯ শরহু মুশকিলুল আছার, ২৯৬০ আলমু’জামুল কাবীর, তবরানী, ৮৪৮ মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাইসামী ৯৬৯৩ আততালখীসুল হাবীর, ইবনে হাযার, ৪/২৮৭ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ।
এখানে লক্ষ্যনীয়:-
ক. উরওয়া রহ. এর বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে এ সংবাদ প্রদান করেছেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে বলেননি যে, আমার অনুমতি ছাড়া তাদের এ জিহাদ সঠিক হয়নি। তারা চরম অন্যায় করেছে, যদি তারা এ আক্রমনের সময় নিহত হতো তবে তারা জান্নাতী না হয়ে জাহান্নামী হতো। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন, আজ কিছু কিছু পোশাকী আলেম-শায়েখ এধরণের কথাই বলছেন, তারা ইমাম ছাড়া জিহাদকে শুধু হারামই বলছেন না, বরং যারা তা করবে তাদেরকে জাহান্নামীও বলে দিচ্ছেন, এটা আল্লাহ তায়ালার ব্যাপারে কত বড় আস্পর্ধা, মুমিন যতই অন্যায় করুক আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন, তাহলে এরা কেন (তাদের ধারণা অনুযায়ী) ইমাম ছাড়া জিহাদকারী অপরাধী মুমিনদের (?) ব্যাপারে জাহান্নামের ফয়সালা করে দিচ্ছে। এটা কি আল্লাহর ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ নয়? আসলে এ ধরণের ফতোয়া তাদেরকে শয়তান ও তার দোসররা শিখিয়েছে, আমেরিকার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক র*্যান্ড কর্পোরেশন তাদের এক গবেষণায় মুসলামানদের জিহাদ থেকে বিমুখ করার জন্য আমেরিকাকে কিছু পরামর্শ দিয়েছে, যার একটা হলো, আলেমদের মাধ্যমে ইস্তেশহাদী হামলাকে আত্মহত্যা বলা ও হামলাকারীদের জাহান্নামী হওয়ার ফতোয়া প্রচার করা। (দেখুন, আলজিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ, শুবুহাত ও রুদুদ, রশাদ ইবরাহীম, পৃ: ৪ বইটির লিংক, https://my.pcloud.com/publink/show?c...RDfmIGM4TYW06y)
খ. আসওয়াদ আনসীকে হত্যার সংবাদ রাসূলের জীবদ্দশায় পৌঁছাক বা তার ইন্তেকালের পর, আবু বকর রাযি, এর নিকট যে এ সংবাদ পৌঁচেছে এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু না আবু বকর রাযি. এর উপর কোন আপত্তি তুলেছেন, না অন্য কোন সাহাবী। এতে প্রমাণ হয় ইমাম ছাড়া জিহাদের বৈধতা সাহাবীদের সর্বসম্মত মত। আর বাস্তবতাও এমনই, জিহাদের জন্য এ ধরণের শর্ত সাহাবীদের কল্পনাজগতেও কখনো উদয় হয়নি। এটা তো জিহাদ বিরোধী আলেম ও শায়েখরা পিঠ বাচানোর জন্য আবিষ্কার করেছে।
গ. আমাদের আলোচ্য ঘটনাটি লোন উলফ হামলা ও টার্গেট কিলিং অপ্সের সাথে কতই না সাদৃশ্যপূর্ণ। এর দ্বারা কত সহজে কত বড় ফিৎনা নির্মুল হয়ে যায়। অথচ যদি মুজাহিদ বাহিনী পাঠিয়ে নিয়মতান্ত্রিক যুদ্ধের মাধ্যমে এ ফিৎনা নির্মূল করার চেষ্টা করা হতো তাহলে হয়তো কত রক্তপাতই না হতো। যা আমরা আসওয়াদের মতই আরেক ভন্ড নবী মুসাইলামার ফিৎনা নির্মূল করার ক্ষেত্রে দেখেছি। মুসাইলামার বিপক্ষে যুদ্ধে এত অধিক পরিমান কারী শহিদ হন যে, উমর রাযি. কুরআন হারিয়ে যাওয়ার আশংকা করেন এবং আবু বকর রাযি. কে কুরআন সংকলনের পরামর্শ দেন। -দেখুন, সহিহ বুখারী, ৪৯৮৬
Comment