যেমন প্রজা, তেমন রাজা
এক দরবেশ এবং তার কম বয়সী এক চেলাকে নিয়ে দূরবর্তী কোনো জঙ্গলে বসবাস করতেন। দরবেশ সব সময় আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকতেন। আর তার কম বয়সী চেলাটি নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা করে দরবেশের খেদমত করতেন।
দরবেশ ছিলেন একজন মানবদরদী মানুষ। তিনি সকাল-সন্ধ্যায় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এই দুআ করতেন:
“আমার পরওয়ারদেগার! আমি এক সহায় সম্বলহীন মানুষ। তোমার বান্দাদের জন্য কোনো খেদমত করতে পারছি না। কিন্তু যদি তুমি আমাকে বাদশাহ বানিয়ে দাও তাহলে আমার জিন্দেগীর প্রতিটি শ্বাস ক্ষুধার্ত,অসহায় মানুষের সেবায় ওয়াকফ করে দেবো। এতিম, বিধবা এবং দরিদ্র মানুষের দেখাশোনা করবো। অসহায়দের জন্য আমি লঙ্গরখানা চালু করবো। ন্যায় ও ইনসাফের বাণী সমুন্নত করবো। ঘুষখোর ও অসাধু কর্মকর্তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবো। মজলুম আমাকে নিজের জন্য ঢাল মনে করবে এবং জালিম আমার নামে কেঁপে উঠবে। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার অভিশাপকে ধ্বংস করে দেবো। নেক ও কল্যাণের ফরমান জারি করবো। জুয়ার আড্ডা ধ্বংস করে দিয়ে ইবাদাতখানা এবং মাদরাসা নির্মাণ করবো।”
কম বয়সী চেলার এই বিশ্বাস ছিল যে, কোনো একদিন তার মোরশেদের দুআ অবশ্যই কবুল হবে। তখন তার দিন পাল্টিয়ে যাবে। কিন্তু সময় বয়ে চলল। চেলা জওয়ান হল। আর নেককার দরবেশের চেহারায় বার্ধ্যক্যের ছাপ ফুটে উঠল। ধীরে ধীরে চেলার বিশ্বাসে পার্থক্য আসতে লাগল। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, দরবেশ হাত উঠালে সে তার নিকটে বসার পরিবর্তে কয়েক কদম দূরে গিয়ে বসত এবং নিচু আওয়াজে এই দুআ করতো:
“হে আমার রব! আমার মোরশেদ এখন বুড়া হয়ে গেছে। তার চুল সাদা হয়ে গেছে এবং দাঁত খসে পড়ছে, আর দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন আমার কাছে তাকে সিংহাসনের তুলনায় কবরের অধিক নিকটবর্তী মনে হচ্ছে। যদি আপনার কাছে একজন নেককার মানুষের বাদশাহ হওয়া পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে বাদশাহ বানিয়ে দিন। আমি এই অঙ্গীকার করছি যে, আমার সব কাজ আমার মোরশেদের চাহিদার বিপরীত করবো। আমি সত্য দিলে এই অঙ্গীকার করছি যে, আমি দরিদ্রদেরকে আরও বেশি দরিদ্র, অসহায়দেরকে আরও বেশি অসহায় এবং মজলুমদেরকে আরও বেশি মজলুম বানানোর চেষ্টা করবো। আমি চোর-ডাকাতদের দেখা-শোনা করবো, সম্মানিদেরকে অসম্মানের আসনে এবং অসম্মানিদেরকে সম্মানিদের আসনে বসাবো। আমি ঘুষখোর ও অসাধু কর্মকর্তাদেরকে পুরস্কৃত করবো। মসজিদ ও মাদরাসায় তালা ঝুলিয়ে দেবো এবং জায়গায় জায়গায় অশ্লীলতার আড্ডাখানা চালু করবো।”
শুরুর দিকে চেলা চুপে চুপে এই দুআ করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তার দুঃসাহস বেড়ে গেল। কিছু দিন পর তার এই অবস্থা হল, যখন মোরশেদ দুআর জন্য হাত উঠাতো তখন সে তার কাছেই বসে জোর আওয়াজে নিজের দুআ শুরু করে দিত। দরবেশ নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বলতেন, যদি বাদশাহ হতে পারো তাহলে ন্যায় ও ইনসাফের বাণী সমুন্নত করবে। চেলা অট্টহাসি দিয়ে বলতো, যদি আমি বাদশাহ হয়ে যাই তাহলে জুলুম ও অন্যায়ের ঝান্ডা উড্ডয়ন করবো। দরবেশ বলতেন, আমার ভান্ডার থেকে অক্ষম ও দরিদ্র লোকদেরকে বেতন দেয়া হবে। আর চেলা বলত, আমি এদের ওপর জরিমানা আরোপ করবো। দরবেশ তাকে অনেক ধমকাতেন এবং অনেক সময় বেত্রাঘাতও করতেন। কিন্তু চেলা তার ঐতিহ্যবাহী কাজের সাথে সাথে নিজের অবস্থানে অবিচল রইল।
এরপর তাই ঘটল যা আগের যুগে ঘটত। অর্থাৎ দেশের বাদশাহ মারা গেলে কয়েকজন মিলে দেশের সিংহাসনের দাবি করে বসল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে তরবারি উন্মুক্ত করে ময়দানে বের হয়ে আসল। বিচক্ষণ উজির রাতারাতি তাদের সবাইকে একত্রিত করে বললেন, দেশকে এখন গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষার একটিই উপায় বাকি আছে। রাতের বেলা শহরের সকল গেইট বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর সকালবেলা সর্বপ্রথম যে লোক পূর্ব গেইট দিয়ে প্রবেশ করবে তাকেই বাদশাহি প্রদান করা হবে।
তার এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। এরপর এই ঘটনা ঘটল। নেককার দরবেশের সেই চেলা আজ ছোট খাটো কোনো বস্তিতে যাওয়ার পরিবর্তে দেশের রাজধানীর দিকে রওয়ানা শুরু করল। ঘটনাক্রমে সে পূর্ব গেইট দিয়ে গিয়ে উঁকি মারল। প্রহরী গেইট খুলে তাকে সালাম জানালো এবং আমিরগণ জরুরী বৈঠকের উদ্দেশ্যে তাকে শাহি মহলে নিয়ে গেল।
নতুন বাদশাহ সিংহাসনে বসেই এই আদেশ জারি করলেন যে, আমার সাম্রাজ্যে যত দরবেশ, ফকির ও সাধু আছে তাদেরকে কোন বিলম্ব ছাড়াই গ্রেফতার করা হোক। আদেশ মানা হল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদশাহর মোরশেদ কোনোভাবে এই সংবাদ পেলেন যে, চেলার দুআ কবুল হয়ে গেছে। ফলে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে চলে গেলেন।
এরপর যা ঘটেছে তা কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। নতুন বাদশাহ পূর্ণ দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে নিজের সমস্ত অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। ঝর্ণার পানি বন্দ করে দিয়েছেন, কূপ ও পুকুরগুলো নাপাকি দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন। চোর ও ডাকাতদেরকে জেল থেকে বের করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছেন। নেককার ও আল্লাহভীরু লোকদেরকে ইবাদাতখানা থেকে বের করে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
মোটকথা, ঐসব জ্ঞানীদের দেশে মাথা ঠুকার মতো কোনো জায়গা রইল না যারা দেশের কল্যাণে এক ভিক্ষুককে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। নতুন বাদশাহর জুলুম যখন চূড়ান্তরূপ ধারণ করল তখন সাধারণ নেতারা তার বংশ পরিচয় অবগত হওয়া জরুরী মনে করলেন। সাবেক প্রধান উজিরের নেতৃত্বে একটি দল বহু অনুসন্ধানের পর বাদশাহর মোরশেদের খেদমতে হাজির হয়ে তার কাছে আবেদন করল যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে এই মহা বিপদ থেকে মুক্তি দিন।
শেষ বয়সী এই দরবেশ নিজের চেলার সামনে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিনিধি দলের করুন অবস্থায় প্রভাবিত হয়ে নিজের আশঙ্কাকে পদদলিত করলেন। যখন তিনি রাজদরবারে উপস্থিত হলেন তখন বাদশাহ নিজের মোরশেদকে দেখতেই পিছনের সব কিছু স্মরণ হয়ে গেল। বাদশাহ মোরশেদকে দেখে ভীত হয়ে গেলেন এবং বললেন:
“পীর ও মোরশেদ! বলুন, আমি আপনার কী খেদমত করতে পারি?”
দরবেশ উত্তর দিলেন:
“আমি নিজের জন্য কিছুই চাচ্ছি না। আমি শুধু তোমার প্রজাদের ব্যাপারে আপিল নিয়ে এসেছি। তুমি সম্মানের সিংহাসনে বসে ঐ সময়ের কথা ভুলে গেছ যখন তুমি ভিক্ষা করতে। এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। যদি পারো তাহলে মৃত্যুর আগে কোনো নেক কাজ করে নাও।”
বাদশাহ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন:
“দেখুন কেবলা! আপনি আমার সহ্যশক্তির পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এটি আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি আমার মোরশেদ এবং আমি আপনার গায়ে হাত দিতে ভয় পাচ্ছি। আপনি আমাকে সারা জীবন গালি দিতে পারেন। কিন্তু এই লোকগুলোর সাথে ভালো আচরণের পরামর্শ দেবেন না। আপনার কি স্মরণ আছে যে, আমরা একই সময়ে দুআ করতাম। তারপরেও এর পিছনে কী কারণ যে, আপনার দুআ কবুল হল না এবং আল্লাহ আমাকেই বাদশাহ বানিয়ে দিলেন? যদি এই লোকদের কাজকর্ম ঠিক হত এবং আল্লাহ এদের কল্যাণ চাইতেন তাহলে আপনি এদের বাদশাহ হতেন। কিন্তু এরা ছিল বদবখত। এরা ভালো মন্দের পার্থক্য করতো না। আল্লাহ তাআলা এদের বদ আমলের শাস্তি দিতেই আমাকে বাদশাহ বানিয়েছেন। এখন আমি মৃত্যু পর্যন্ত নিজের প্রোগ্রাম পূর্ণ করবো। যদি এদের করুণ অবস্থার প্রতি আল্লাহ তাআলার দয়া হয় এবং আমার জিন্দেগীর দিন শেষ হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। অন্যথায় এব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে কোনো ত্রæটি হবে না।”
নেককার দরবেশ জবাব দিলেন:
“খুব ভালো কথা! তুমি ঠিকই বলেছো। যদি এরা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ভালো পুরস্কারের যোগ্য হত তাহলে আমার সারা জীবনের দুআ ব্যর্থ হত না। এরা যারা আমার পরিবর্তে তোমার মাথায় মুকুট রেখেছে তারা এর যোগ্য নয় যে, তাদের প্রতি দয়া করা হবে। তুমি সানন্দের সাথে নিজ কাজ করতে থাকো।”
এক দরবেশ এবং তার কম বয়সী এক চেলাকে নিয়ে দূরবর্তী কোনো জঙ্গলে বসবাস করতেন। দরবেশ সব সময় আল্লাহর স্মরণে ব্যস্ত থাকতেন। আর তার কম বয়সী চেলাটি নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে ভিক্ষা করে দরবেশের খেদমত করতেন।
দরবেশ ছিলেন একজন মানবদরদী মানুষ। তিনি সকাল-সন্ধ্যায় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে এই দুআ করতেন:
“আমার পরওয়ারদেগার! আমি এক সহায় সম্বলহীন মানুষ। তোমার বান্দাদের জন্য কোনো খেদমত করতে পারছি না। কিন্তু যদি তুমি আমাকে বাদশাহ বানিয়ে দাও তাহলে আমার জিন্দেগীর প্রতিটি শ্বাস ক্ষুধার্ত,অসহায় মানুষের সেবায় ওয়াকফ করে দেবো। এতিম, বিধবা এবং দরিদ্র মানুষের দেখাশোনা করবো। অসহায়দের জন্য আমি লঙ্গরখানা চালু করবো। ন্যায় ও ইনসাফের বাণী সমুন্নত করবো। ঘুষখোর ও অসাধু কর্মকর্তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবো। মজলুম আমাকে নিজের জন্য ঢাল মনে করবে এবং জালিম আমার নামে কেঁপে উঠবে। অশ্লীলতা ও নির্লজ্জতার অভিশাপকে ধ্বংস করে দেবো। নেক ও কল্যাণের ফরমান জারি করবো। জুয়ার আড্ডা ধ্বংস করে দিয়ে ইবাদাতখানা এবং মাদরাসা নির্মাণ করবো।”
কম বয়সী চেলার এই বিশ্বাস ছিল যে, কোনো একদিন তার মোরশেদের দুআ অবশ্যই কবুল হবে। তখন তার দিন পাল্টিয়ে যাবে। কিন্তু সময় বয়ে চলল। চেলা জওয়ান হল। আর নেককার দরবেশের চেহারায় বার্ধ্যক্যের ছাপ ফুটে উঠল। ধীরে ধীরে চেলার বিশ্বাসে পার্থক্য আসতে লাগল। এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, দরবেশ হাত উঠালে সে তার নিকটে বসার পরিবর্তে কয়েক কদম দূরে গিয়ে বসত এবং নিচু আওয়াজে এই দুআ করতো:
“হে আমার রব! আমার মোরশেদ এখন বুড়া হয়ে গেছে। তার চুল সাদা হয়ে গেছে এবং দাঁত খসে পড়ছে, আর দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে আসছে। এখন আমার কাছে তাকে সিংহাসনের তুলনায় কবরের অধিক নিকটবর্তী মনে হচ্ছে। যদি আপনার কাছে একজন নেককার মানুষের বাদশাহ হওয়া পছন্দ না হয় তাহলে আমাকে বাদশাহ বানিয়ে দিন। আমি এই অঙ্গীকার করছি যে, আমার সব কাজ আমার মোরশেদের চাহিদার বিপরীত করবো। আমি সত্য দিলে এই অঙ্গীকার করছি যে, আমি দরিদ্রদেরকে আরও বেশি দরিদ্র, অসহায়দেরকে আরও বেশি অসহায় এবং মজলুমদেরকে আরও বেশি মজলুম বানানোর চেষ্টা করবো। আমি চোর-ডাকাতদের দেখা-শোনা করবো, সম্মানিদেরকে অসম্মানের আসনে এবং অসম্মানিদেরকে সম্মানিদের আসনে বসাবো। আমি ঘুষখোর ও অসাধু কর্মকর্তাদেরকে পুরস্কৃত করবো। মসজিদ ও মাদরাসায় তালা ঝুলিয়ে দেবো এবং জায়গায় জায়গায় অশ্লীলতার আড্ডাখানা চালু করবো।”
শুরুর দিকে চেলা চুপে চুপে এই দুআ করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তার দুঃসাহস বেড়ে গেল। কিছু দিন পর তার এই অবস্থা হল, যখন মোরশেদ দুআর জন্য হাত উঠাতো তখন সে তার কাছেই বসে জোর আওয়াজে নিজের দুআ শুরু করে দিত। দরবেশ নিজের চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বলতেন, যদি বাদশাহ হতে পারো তাহলে ন্যায় ও ইনসাফের বাণী সমুন্নত করবে। চেলা অট্টহাসি দিয়ে বলতো, যদি আমি বাদশাহ হয়ে যাই তাহলে জুলুম ও অন্যায়ের ঝান্ডা উড্ডয়ন করবো। দরবেশ বলতেন, আমার ভান্ডার থেকে অক্ষম ও দরিদ্র লোকদেরকে বেতন দেয়া হবে। আর চেলা বলত, আমি এদের ওপর জরিমানা আরোপ করবো। দরবেশ তাকে অনেক ধমকাতেন এবং অনেক সময় বেত্রাঘাতও করতেন। কিন্তু চেলা তার ঐতিহ্যবাহী কাজের সাথে সাথে নিজের অবস্থানে অবিচল রইল।
এরপর তাই ঘটল যা আগের যুগে ঘটত। অর্থাৎ দেশের বাদশাহ মারা গেলে কয়েকজন মিলে দেশের সিংহাসনের দাবি করে বসল। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে তরবারি উন্মুক্ত করে ময়দানে বের হয়ে আসল। বিচক্ষণ উজির রাতারাতি তাদের সবাইকে একত্রিত করে বললেন, দেশকে এখন গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষার একটিই উপায় বাকি আছে। রাতের বেলা শহরের সকল গেইট বন্ধ করে দিতে হবে। তারপর সকালবেলা সর্বপ্রথম যে লোক পূর্ব গেইট দিয়ে প্রবেশ করবে তাকেই বাদশাহি প্রদান করা হবে।
তার এই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। এরপর এই ঘটনা ঘটল। নেককার দরবেশের সেই চেলা আজ ছোট খাটো কোনো বস্তিতে যাওয়ার পরিবর্তে দেশের রাজধানীর দিকে রওয়ানা শুরু করল। ঘটনাক্রমে সে পূর্ব গেইট দিয়ে গিয়ে উঁকি মারল। প্রহরী গেইট খুলে তাকে সালাম জানালো এবং আমিরগণ জরুরী বৈঠকের উদ্দেশ্যে তাকে শাহি মহলে নিয়ে গেল।
নতুন বাদশাহ সিংহাসনে বসেই এই আদেশ জারি করলেন যে, আমার সাম্রাজ্যে যত দরবেশ, ফকির ও সাধু আছে তাদেরকে কোন বিলম্ব ছাড়াই গ্রেফতার করা হোক। আদেশ মানা হল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাদশাহর মোরশেদ কোনোভাবে এই সংবাদ পেলেন যে, চেলার দুআ কবুল হয়ে গেছে। ফলে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশে চলে গেলেন।
এরপর যা ঘটেছে তা কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। নতুন বাদশাহ পূর্ণ দক্ষতা ও যোগ্যতার সাথে নিজের সমস্ত অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। ঝর্ণার পানি বন্দ করে দিয়েছেন, কূপ ও পুকুরগুলো নাপাকি দ্বারা পূর্ণ করে দিয়েছেন। চোর ও ডাকাতদেরকে জেল থেকে বের করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ দিয়েছেন। নেককার ও আল্লাহভীরু লোকদেরকে ইবাদাতখানা থেকে বের করে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
মোটকথা, ঐসব জ্ঞানীদের দেশে মাথা ঠুকার মতো কোনো জায়গা রইল না যারা দেশের কল্যাণে এক ভিক্ষুককে সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছেন। নতুন বাদশাহর জুলুম যখন চূড়ান্তরূপ ধারণ করল তখন সাধারণ নেতারা তার বংশ পরিচয় অবগত হওয়া জরুরী মনে করলেন। সাবেক প্রধান উজিরের নেতৃত্বে একটি দল বহু অনুসন্ধানের পর বাদশাহর মোরশেদের খেদমতে হাজির হয়ে তার কাছে আবেদন করল যে, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদেরকে এই মহা বিপদ থেকে মুক্তি দিন।
শেষ বয়সী এই দরবেশ নিজের চেলার সামনে যেতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু প্রতিনিধি দলের করুন অবস্থায় প্রভাবিত হয়ে নিজের আশঙ্কাকে পদদলিত করলেন। যখন তিনি রাজদরবারে উপস্থিত হলেন তখন বাদশাহ নিজের মোরশেদকে দেখতেই পিছনের সব কিছু স্মরণ হয়ে গেল। বাদশাহ মোরশেদকে দেখে ভীত হয়ে গেলেন এবং বললেন:
“পীর ও মোরশেদ! বলুন, আমি আপনার কী খেদমত করতে পারি?”
দরবেশ উত্তর দিলেন:
“আমি নিজের জন্য কিছুই চাচ্ছি না। আমি শুধু তোমার প্রজাদের ব্যাপারে আপিল নিয়ে এসেছি। তুমি সম্মানের সিংহাসনে বসে ঐ সময়ের কথা ভুলে গেছ যখন তুমি ভিক্ষা করতে। এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। যদি পারো তাহলে মৃত্যুর আগে কোনো নেক কাজ করে নাও।”
বাদশাহ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলেন:
“দেখুন কেবলা! আপনি আমার সহ্যশক্তির পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না। এটি আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি আমার মোরশেদ এবং আমি আপনার গায়ে হাত দিতে ভয় পাচ্ছি। আপনি আমাকে সারা জীবন গালি দিতে পারেন। কিন্তু এই লোকগুলোর সাথে ভালো আচরণের পরামর্শ দেবেন না। আপনার কি স্মরণ আছে যে, আমরা একই সময়ে দুআ করতাম। তারপরেও এর পিছনে কী কারণ যে, আপনার দুআ কবুল হল না এবং আল্লাহ আমাকেই বাদশাহ বানিয়ে দিলেন? যদি এই লোকদের কাজকর্ম ঠিক হত এবং আল্লাহ এদের কল্যাণ চাইতেন তাহলে আপনি এদের বাদশাহ হতেন। কিন্তু এরা ছিল বদবখত। এরা ভালো মন্দের পার্থক্য করতো না। আল্লাহ তাআলা এদের বদ আমলের শাস্তি দিতেই আমাকে বাদশাহ বানিয়েছেন। এখন আমি মৃত্যু পর্যন্ত নিজের প্রোগ্রাম পূর্ণ করবো। যদি এদের করুণ অবস্থার প্রতি আল্লাহ তাআলার দয়া হয় এবং আমার জিন্দেগীর দিন শেষ হয়ে যায় তাহলে ভিন্ন কথা। অন্যথায় এব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে কোনো ত্রæটি হবে না।”
নেককার দরবেশ জবাব দিলেন:
“খুব ভালো কথা! তুমি ঠিকই বলেছো। যদি এরা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ভালো পুরস্কারের যোগ্য হত তাহলে আমার সারা জীবনের দুআ ব্যর্থ হত না। এরা যারা আমার পরিবর্তে তোমার মাথায় মুকুট রেখেছে তারা এর যোগ্য নয় যে, তাদের প্রতি দয়া করা হবে। তুমি সানন্দের সাথে নিজ কাজ করতে থাকো।”
Comment