রাশিয়ান লাল ফৌজের আতংক,বীর মুজাহিদ কমান্ডার সামির বিন সালেহ খাত্তাব রাহিঃ
চে গুয়েভারা মাওসেতুং বলতেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক!তাজ্জব বনে যাই!! অনেক বড় বিপ্লবী ছিল, বীর ছিল হেন তেন। অথচ হাল যামানায় আমাদের এমন অনেক বীর আছেন যাদের একেকজন ছিলেন, পুরো একটা বাহিনী সমান। যাদের নাম শুনলে শত্রুরা পালানোর পথ খুঁজতো।ভয়ে তাদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত।যাদের মুখোমুখি হলে, তারা দু’চোখে শুধু মৃত্যুই অবলকোন করত। তাদেরই একজন, মূর্তমান আতংক আমির আল খাত্তাব। যিনি রাশিয়ান লাল ফৌজের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন।তাদেরকে খাইয়েছিলেন নাকাচুবানি।পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ ‘চেখে দেখতে’ বাধ্য করেছিলেন তাদেরকে।
সৌদির অন্যান্য পরিবারের মত খাত্তাবের পরিবারেও ছিল দ্বীনদারির সমান গুরুত্ব।তবে অন্যান্য অনেক পরিবার থেকে এই পরিবারে দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি গুরুত্ব ছিল বেশী। ইসলামী বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন এ বাড়িতে নিয়মিত পড়া হত।এগুলো ছিল এমন গুণ সমসাময়িক অন্যান্য অনেক পরিবারের যেগুলো ছিল অনেকটাই অকল্পনীয়। এই কারনেই বলা হয় ‘মহান ব্যাক্তি তৈরীতে পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য’ যেমনটা আমরা খাত্তাব রাহিঃ এর বেলায় দেখতে পাই।
অন্য দশ জন তরুণের মতই তাঁর স্বপ্ন ছিল, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রচুর বেতনের একটা চাকরীর।যার কারণে তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় মনযোগী।ছিলেন মেধাতালিকায় অন্যতম। তাঁর ইচ্ছা ছিল সৌদির উত্তরে জাহরান প্রদেশের এ্যারাবিয়ান-আমেরিকান তেল কোম্পানী ‘আরামকো’তে cbc এর অধীনে লেখাপড়া করে জয়েন হবেন-যেহেতু cbc এর অধীনে লেখাপড়া করলে সহজেই এ্যামেরিকা যাওয়া যায়; তাই খাত্তাবের আশাও ছিল এ্যামেরিকা লেখাপড়া করে ভালো একটা ডিগ্রি হাসিল করার। এরকম উচু মানের চাকরী করা ঐ সময়ের প্রত্যেক যুবকেরই মনের আশা ছিল। যাক, তিনি তার আশা বাস্তবায়ন করতে মাসে ২৫০০ রিয়াল বেতন দিয়ে cbc এর অধীনে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। অর্ধ বৎসর এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যান।তাঁর অমায়িক ব্যবহার এবং উত্তম আচরণের কারনে তিনি ছিলেন ছাত্র উস্তাদ সবার প্রিয়। কিন্তু আফগানিস্তানে রুশ বিরুধী জিহাদ শুরু হলে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জিহাদে যোগ দেন।তাঁর মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ‘আল্লাহ্*র জন্য কেউ কিছু ত্যাগ করলে, আল্লাহ্* তার চেয়েও উত্তম জিনিস দিয়ে তাঁর প্রতিদান দিয়ে দেন’।ফলে, যার আশা ছিল cbc এর অধীনে লেখাপড়া করে উচ্চ ডিগ্রি হাসিলের জন্য এ্যামেরিকায় যাওয়া, কিন্তু এ সব ছেড়ে তিনিই জিহাদের ময়দানে এসে পড়লেন।
আফগানে সোভিয়েতের পতনের পর যখন আরব মুজাহিদরা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো, তখন তিনি একদল প্রশিক্ষিত মুজাহিদদের সাথে করে আফগান থেকে তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্য একই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নতুন হিজরতের পথ ধরলেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সাথে যুক্ত থাকার পর চেচেন মুজাহিদের সাথে যুক্ত হন।
“শত্রু তোমার উপর হামলা করার পূর্বেই তুমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়”
তিনি ১৯৯৫ সালে চেচেনের স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মুখসমরে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে হাতেগোনা মুজাহিদ নিয়ে শক্তিশালী রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়লাভ করেছেন। প্রতিটি ফ্রন্টে তাদেরকে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। রাশিয়ার বৃহৎ বৃহৎ বাহিনীকে যুদ্ধে অপদস্ত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। তাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করতেন। তাদের সমস্ত কূটচাল গুলো বুমেরাং করে দিয়েছিলেন। তাদের এমন নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন যে, দাগেস্তানে তার মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থানাকালে এক কদমও অগ্রসর হবার সাহস পায়নি দখলদার রুশ বাহিনী।
১৯৯৬ সালের ১৬ এপ্রিলের একটি ঘটনা, খাত্তাব রাহিঃ ৫০ জন মুজাহিদ সাথে নিয়ে রুশ সৈন্যদের উপর একটি গুপ্ত হামলা করেন, যা ‘শাতুই’ হামলা নামে প্রশিদ্ধ।রুশ সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে এই হামলায় ২২৩ জন সৈন্য মারা যায়, যাদের মাঝে ২৬ জন ছিলেন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার। ৫০ টি গাড়ি পূর্ণ ধবংস হয়ে যায়। এই হামলার কারনে তিন জন যেনারেল বরখাস্ত হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট বর্লিস ইলেটসন রুশ সংসদে নিজেই এই হামলার কথা স্বীকার করেন। এই হামলাটি ব্যাপক আলোচিত একটি হামলা ছিল, যা ওই সময়ে ইন্টারনেটে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
হামলার ভিডিও লিঙ্ক https://www.youtube.com/watch?v=UwCW-orHXVI
কমান্ডার খাত্তাব দ্বিতীয় বার ব্যাপক আলোচিত হন, যখন তিনি ১৯৯৭ এর ২২ ডিসেম্বর ১০০ জন চেচেন এবং অন্যান্য দেশের মুজাহিদ নিয়ে রাশিয়ার ১০০ কিঃমিঃ ভিতরে ১৩৬ নাম্বার স্বয়ংক্রিয় ব্রিগেডের উপর হামলা করেন।হামলার ফলে, ৩০০ রুশ গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু সৈন্য হতাহত হয়।এ যুদ্ধে দুই জন মুজাহিদ শহীদ হন, যার মাঝে একজন ছিলেন খাত্তাবের বাহিনীর মিসরীয় প্রসিদ্ধ কমান্ডার আবু বকর আকীদা রাহিঃ
১৯৯৮ সালে বন্ধু শামিল বাসায়েভের সাথে মিলে Islamic Peacekeeping Army নামে একটি বাহিনী গড়ে তুলেন। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। কমান্ডার খাত্তাব ও শামিল বাসায়েভের দক্ষ নেতৃত্বে শুরু হয় লাল ফৌজ নিধন। যুদ্ধের শুরুর দিকের একটা ঘটনা। খাত্তাবের ঘাঁটির কাছাকাছি এক পাহাড়ে সৈন্য নামায় লাল ফৌজ। তারমধ্যে ৮৪ জনকেই হত্যা করেন কমান্ডার খাত্তাব। অতঃপর অবশিষ্ট পুরো বাহিনীই পালিয়ে যায়। একের পর এক যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীকে পিছু হটান, পরাজয়ের পর পরাজয়ে রাশিয়ান আর্মি, মুজাহিদ বাহিনীকে থামাতে নিরাশ হয়ে পড়ে।
অগাষ্টে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে একটি বোমা বিস্ফোরন করেন। তাতে প্রায় ১০০‘র উপর মানুষ নিহত হয়। এর জন্য রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা FSB কমান্ডার খাত্তাবকে দায়ী করেন। এর জবাবে খাত্তাব রাশিয়া সংবাদ এজেন্সীকে বলেন- “আমরা তাদের মত নই যারা ঘুমন্ত সাধারন মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করে।”
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ২০০২ সালের মার্চ মাসে কমান্ডার খাত্তাব এক অভিযানে ল্যান্ড মাইন দ্বারা আহত হন। আহত হবার পর কিছুদিনের জন্য বিশ্রামে যান।
তিনি ছিলেন খুবই নরম দিলের মানুষ।কুফফারদের বিরুদ্ধে যতটানা কঠোর ছিলেন, ততটাই নরম ও রহম দিলের ছিলেন অন্যদেরদের প্রতি। একবার তিনি গাড়ি নিয়ে কোথাও যাবার জন্য বের হলেন, কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিনে একটি বিড়াল বসা ছিল যা তিনি দেখেননি। অতঃপর গাড়ি ষ্টার্ট দিলে বিড়ালটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়; এই দৃশ্য দেখে তিনি স্থির থাকতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন,তখন তাঁর দুই সাথী মানসুর এবং মাহের তাঁকে কাঁধে বহন করে নিয়ে আসছিলনে, আর তিনি কাঁদতে কাঁদতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন বিড়ালটি কি মারা গেছে ?! ভাবা যায় কুফফারদের বিরুদ্ধে সিংহ হৃদয় এই ব্যাক্তির একটি বিড়ালের প্রতি কি পরিমান দয়া ছিল, অথচ আজ আমাদের সামনে শত শত মুসলিমকে জবাই করা হচ্ছে, আমরা তাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনছি, কিন্তু আমাদের চোখ থেকে এতটুকু পানিও ঝরেনা!!
আমির খাত্তাবের সাথে তার মায়ের প্রায়শই চিঠিতে কথা হতো। আহত থাকা অবস্থায় আমীর খাত্তাবের মা তার কাছে একটি চিটি লিখেছিলেন। কিন্তু চিঠিটি এক রুশগুপ্তচরের হস্তগত হয়- যে মুজাহিদদের মাঝে ছিল- সে তাতে এক রাসায়নিক বিষ মেখে দেয়। যা শুকার পর যে কেউ আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চিঠিটি কামান্ডার খাত্তাবের হাতে আসে। আমীর খাত্তাব তা পড়ার পর ২০ মার্চ ১৪২৩ হিঃ সফর মাসের শুরুরদিকে মধ্যে রাতে ৩৩ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন। শাহাদাৎ বরণ করেন এক কিংবদতন্তী।পরকালে পাড়ি জমান এক মূর্তমান আতংক। যিনি গুটি কয়েক মুজাহিদ নিয়ে রাশিয়ার মত বিশাল দৈত্যংদেহী বাহীনিকে পরাজিত করেছিলেন। লড়াইয়ের ময়দানে তিনি ছিলেন ইস্পাত দৃঢ়।যিনি প্রথমে আফগানের ময়দানে তারপর তাজিকিস্তান এবং চেচনিয়ার ভূমিতে রুশ ভল্লুকদের পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করিয়েছিলেন। তিনি চেচেনদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছেন শত্রুদের। সময়ের সুপার পাওয়ার রাশিয়া তাকে মারার জন্য কোন বাহীনিই পাঠানোর সাহস করেনি।
খাত্তাব রাহিঃ‘র দখল ছিল ৪ টি ভাষায়; আরবী,রুশ,ইংরেজী আর পশতু। এই চার ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
তার মৃত্যুর পর পুতিন বলেছিল, “যদি তারা তাঁকে সত্যিই হত্যা করে, তাহলে তা হবে সন্ত্রাসবাদের(মুজাহিদদের) উপর একটি কঠিন আঘাত”
আফগান যুদ্ধের শুরুতে বুশ ‘বাত্বালুনা’ খাত্তাব রাহিঃর অতীত ইতিহাস এবং শত্রুর উপর তাঁর আকস্মিক দুঃসাহসীক সব হামলার কথা জেনে তাঁর কাছে আবেদন করেছিল, যাতে তিনি আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহন না করেন।
-
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, চে গুয়েভারাদের আমরা খুব ভালোভাবে চিনি, তাদের বীরত্ব নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাদের ছবি অঙ্কিত জামা গায়ে দিই, অথচ আমাদের এতো বড় বড় বীরদের নামটা পর্যন্ত ভালো করে জানিনা! তাদের বীরত্ব ও উম্মতের প্রতি অসামান্য অবদান সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ধারণাও রাখিনা!!
খাত্তাব রাহিঃ’র কিছু বাণীঃ-
“যে অপদস্থ হয়ে জীবন গুজরান করে সে অপদস্থ হয়েই মৃত্যুবরণ করে,পক্ষান্তরে যে উম্মাহর জন্য, বীর বেশে জীবন গুজরাণ করে তার মৃত্যুও হয় মহান মৃত্যু”
“শত্রু তোমার উপর হামলা করার পূর্বেই তুমি তার উপর হামলা কর,আমাদের উপর আগে হামলার অপেক্ষা করোনা ,যার পরে মহিলাদের মত চিৎকার করতে থাকব; বরং যখন আমরা দেখব, তারা আমাদের উপর হামলার ইচ্ছা করেছে তখন আমাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা থাকলে আমরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।যাতে অন্যান্য মুসলিম ভূখন্ডে হামলা করার মত দুঃসাহস তাদের আর না হয়”
“আমি এমনভাবে মৃত্যু বরণ করাকে ভয় পাই যে , আমার লাশের কোন মূল্য থাকবেনা(স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু বরণ করা) তবে আমার কামনা হল শহীদি মৃত্যু”
“আমাদের মাঝে আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝে পার্থক্য কোথায়, আমরাও মানুষ তারাও মানুষ,আমরাও পানাহার করি, তারাও করতেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন এমন মানুষ, যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, সুতরাং আমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে তাঁদের মত ইতিহাস রচনা করা, যাতে আমরা তাদের সাদৃশ্য গ্রহন করতে পারি; যদিও আমরা তাঁদের মত নই”
“শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আমাদের কাছ রয়েছে দুই ধরণের অস্ত্র; একটি হল, ইমান এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাসের অস্ত্র, আর আরেকটি হল রুশদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনা এবং তাদের থেকে গানীমাহ স্বরুপ প্রাপ্ত অস্ত্র। যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “وجعل رزقي تحت ظل رمحي) আমার রিযিক রাখা হয়েছে আমার বর্শার নিচে”।
ইসলামের মহান এই বীরের চেতনা তার জঝবা আল্লাহ্* আমাদেরকে বুকে ধারন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
وكلانقص عليك من انباء الرسل ما نثبت به فؤادك
“আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্দ্বরা তোমার অন্তরকে আমি মজবুত করছি”।
[সংগৃহীত এবং পরিমার্জিত।এই লিখাটির অধিকাংশই واخيرا ترجل الفارس خطاب নামক প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।]
চে গুয়েভারা মাওসেতুং বলতেই আমরা বিস্ময়ে হতবাক!তাজ্জব বনে যাই!! অনেক বড় বিপ্লবী ছিল, বীর ছিল হেন তেন। অথচ হাল যামানায় আমাদের এমন অনেক বীর আছেন যাদের একেকজন ছিলেন, পুরো একটা বাহিনী সমান। যাদের নাম শুনলে শত্রুরা পালানোর পথ খুঁজতো।ভয়ে তাদের গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যেত।যাদের মুখোমুখি হলে, তারা দু’চোখে শুধু মৃত্যুই অবলকোন করত। তাদেরই একজন, মূর্তমান আতংক আমির আল খাত্তাব। যিনি রাশিয়ান লাল ফৌজের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন।তাদেরকে খাইয়েছিলেন নাকাচুবানি।পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ ‘চেখে দেখতে’ বাধ্য করেছিলেন তাদেরকে।
কে ছিলেন খাত্তাব?
পুরো নাম ছিল সামির বিন সালেহ বিন আব্দুল্লাহ আস-সুয়াইলিম। সবার কাছে কমান্ডার খাত্তাব বা আমির খাত্তাব নামে পরিচিত।১৩৮৯ হিঃ ১৯৬৯ সালে সৌদি আররের উত্তরে আরআর নামক শহরে জন্ম গ্রহন। সীমাহীন ভোগ-বিলাসে থাকা সত্ত্বেও ১৭ বছর বয়সে পরিবার ছেড়ে ১৯৮৭ সালে আফগানিস্তানে হিজরত করেন এবং শাইখুনা আবু আব্দুল্লাহ উসামার রাহিঃ সাথে সাক্ষাত করে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ গ্রহন করেন।সৌদির অন্যান্য পরিবারের মত খাত্তাবের পরিবারেও ছিল দ্বীনদারির সমান গুরুত্ব।তবে অন্যান্য অনেক পরিবার থেকে এই পরিবারে দ্বীনের প্রতি ভালোবাসা এবং দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির প্রতি গুরুত্ব ছিল বেশী। ইসলামী বিভিন্ন পত্রিকা, ম্যাগাজিন এ বাড়িতে নিয়মিত পড়া হত।এগুলো ছিল এমন গুণ সমসাময়িক অন্যান্য অনেক পরিবারের যেগুলো ছিল অনেকটাই অকল্পনীয়। এই কারনেই বলা হয় ‘মহান ব্যাক্তি তৈরীতে পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য’ যেমনটা আমরা খাত্তাব রাহিঃ এর বেলায় দেখতে পাই।
তারুণ্যে খাত্তাব
অন্য দশ জন তরুণের মতই তাঁর স্বপ্ন ছিল, উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন প্রচুর বেতনের একটা চাকরীর।যার কারণে তিনি ছিলেন লেখাপড়ায় মনযোগী।ছিলেন মেধাতালিকায় অন্যতম। তাঁর ইচ্ছা ছিল সৌদির উত্তরে জাহরান প্রদেশের এ্যারাবিয়ান-আমেরিকান তেল কোম্পানী ‘আরামকো’তে cbc এর অধীনে লেখাপড়া করে জয়েন হবেন-যেহেতু cbc এর অধীনে লেখাপড়া করলে সহজেই এ্যামেরিকা যাওয়া যায়; তাই খাত্তাবের আশাও ছিল এ্যামেরিকা লেখাপড়া করে ভালো একটা ডিগ্রি হাসিল করার। এরকম উচু মানের চাকরী করা ঐ সময়ের প্রত্যেক যুবকেরই মনের আশা ছিল। যাক, তিনি তার আশা বাস্তবায়ন করতে মাসে ২৫০০ রিয়াল বেতন দিয়ে cbc এর অধীনে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে লাগলেন। অর্ধ বৎসর এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যান।তাঁর অমায়িক ব্যবহার এবং উত্তম আচরণের কারনে তিনি ছিলেন ছাত্র উস্তাদ সবার প্রিয়। কিন্তু আফগানিস্তানে রুশ বিরুধী জিহাদ শুরু হলে তিনি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে জিহাদে যোগ দেন।তাঁর মনে এই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, ‘আল্লাহ্*র জন্য কেউ কিছু ত্যাগ করলে, আল্লাহ্* তার চেয়েও উত্তম জিনিস দিয়ে তাঁর প্রতিদান দিয়ে দেন’।ফলে, যার আশা ছিল cbc এর অধীনে লেখাপড়া করে উচ্চ ডিগ্রি হাসিলের জন্য এ্যামেরিকায় যাওয়া, কিন্তু এ সব ছেড়ে তিনিই জিহাদের ময়দানে এসে পড়লেন।
আফগানে সোভিয়েতের পতনের পর যখন আরব মুজাহিদরা পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লো, তখন তিনি একদল প্রশিক্ষিত মুজাহিদদের সাথে করে আফগান থেকে তাজিকিস্তানের উদ্দেশ্য একই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নতুন হিজরতের পথ ধরলেন। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাজিকিস্তানের গৃহযুদ্ধের সাথে যুক্ত থাকার পর চেচেন মুজাহিদের সাথে যুক্ত হন।
“শত্রু তোমার উপর হামলা করার পূর্বেই তুমি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়”
তিনি ১৯৯৫ সালে চেচেনের স্বাধীনতাযুদ্ধে সম্মুখসমরে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। বেশ কয়েকটি যুদ্ধে হাতেগোনা মুজাহিদ নিয়ে শক্তিশালী রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়লাভ করেছেন। প্রতিটি ফ্রন্টে তাদেরকে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। রাশিয়ার বৃহৎ বৃহৎ বাহিনীকে যুদ্ধে অপদস্ত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন। তাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করতেন। তাদের সমস্ত কূটচাল গুলো বুমেরাং করে দিয়েছিলেন। তাদের এমন নাকানিচুবানি খাইয়েছিলেন যে, দাগেস্তানে তার মুজাহিদ বাহিনীর অবস্থানাকালে এক কদমও অগ্রসর হবার সাহস পায়নি দখলদার রুশ বাহিনী।
১৯৯৬ সালের ১৬ এপ্রিলের একটি ঘটনা, খাত্তাব রাহিঃ ৫০ জন মুজাহিদ সাথে নিয়ে রুশ সৈন্যদের উপর একটি গুপ্ত হামলা করেন, যা ‘শাতুই’ হামলা নামে প্রশিদ্ধ।রুশ সামরিক বাহিনীর ভাষ্যমতে এই হামলায় ২২৩ জন সৈন্য মারা যায়, যাদের মাঝে ২৬ জন ছিলেন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার। ৫০ টি গাড়ি পূর্ণ ধবংস হয়ে যায়। এই হামলার কারনে তিন জন যেনারেল বরখাস্ত হয়। রুশ প্রেসিডেন্ট বর্লিস ইলেটসন রুশ সংসদে নিজেই এই হামলার কথা স্বীকার করেন। এই হামলাটি ব্যাপক আলোচিত একটি হামলা ছিল, যা ওই সময়ে ইন্টারনেটে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল।
হামলার ভিডিও লিঙ্ক https://www.youtube.com/watch?v=UwCW-orHXVI
কমান্ডার খাত্তাব দ্বিতীয় বার ব্যাপক আলোচিত হন, যখন তিনি ১৯৯৭ এর ২২ ডিসেম্বর ১০০ জন চেচেন এবং অন্যান্য দেশের মুজাহিদ নিয়ে রাশিয়ার ১০০ কিঃমিঃ ভিতরে ১৩৬ নাম্বার স্বয়ংক্রিয় ব্রিগেডের উপর হামলা করেন।হামলার ফলে, ৩০০ রুশ গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বহু সৈন্য হতাহত হয়।এ যুদ্ধে দুই জন মুজাহিদ শহীদ হন, যার মাঝে একজন ছিলেন খাত্তাবের বাহিনীর মিসরীয় প্রসিদ্ধ কমান্ডার আবু বকর আকীদা রাহিঃ
১৯৯৮ সালে বন্ধু শামিল বাসায়েভের সাথে মিলে Islamic Peacekeeping Army নামে একটি বাহিনী গড়ে তুলেন। ১৯৯৯ সালে দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। কমান্ডার খাত্তাব ও শামিল বাসায়েভের দক্ষ নেতৃত্বে শুরু হয় লাল ফৌজ নিধন। যুদ্ধের শুরুর দিকের একটা ঘটনা। খাত্তাবের ঘাঁটির কাছাকাছি এক পাহাড়ে সৈন্য নামায় লাল ফৌজ। তারমধ্যে ৮৪ জনকেই হত্যা করেন কমান্ডার খাত্তাব। অতঃপর অবশিষ্ট পুরো বাহিনীই পালিয়ে যায়। একের পর এক যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীকে পিছু হটান, পরাজয়ের পর পরাজয়ে রাশিয়ান আর্মি, মুজাহিদ বাহিনীকে থামাতে নিরাশ হয়ে পড়ে।
অগাষ্টে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে একটি বোমা বিস্ফোরন করেন। তাতে প্রায় ১০০‘র উপর মানুষ নিহত হয়। এর জন্য রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা FSB কমান্ডার খাত্তাবকে দায়ী করেন। এর জবাবে খাত্তাব রাশিয়া সংবাদ এজেন্সীকে বলেন- “আমরা তাদের মত নই যারা ঘুমন্ত সাধারন মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করে।”
যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ২০০২ সালের মার্চ মাসে কমান্ডার খাত্তাব এক অভিযানে ল্যান্ড মাইন দ্বারা আহত হন। আহত হবার পর কিছুদিনের জন্য বিশ্রামে যান।
তিনি ছিলেন খুবই নরম দিলের মানুষ।কুফফারদের বিরুদ্ধে যতটানা কঠোর ছিলেন, ততটাই নরম ও রহম দিলের ছিলেন অন্যদেরদের প্রতি। একবার তিনি গাড়ি নিয়ে কোথাও যাবার জন্য বের হলেন, কিন্তু গাড়ির ইঞ্জিনে একটি বিড়াল বসা ছিল যা তিনি দেখেননি। অতঃপর গাড়ি ষ্টার্ট দিলে বিড়ালটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়; এই দৃশ্য দেখে তিনি স্থির থাকতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন,তখন তাঁর দুই সাথী মানসুর এবং মাহের তাঁকে কাঁধে বহন করে নিয়ে আসছিলনে, আর তিনি কাঁদতে কাঁদতে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন বিড়ালটি কি মারা গেছে ?! ভাবা যায় কুফফারদের বিরুদ্ধে সিংহ হৃদয় এই ব্যাক্তির একটি বিড়ালের প্রতি কি পরিমান দয়া ছিল, অথচ আজ আমাদের সামনে শত শত মুসলিমকে জবাই করা হচ্ছে, আমরা তাদের মৃত্যুর সংবাদ শুনছি, কিন্তু আমাদের চোখ থেকে এতটুকু পানিও ঝরেনা!!
শাহাদাত
আমির খাত্তাবের সাথে তার মায়ের প্রায়শই চিঠিতে কথা হতো। আহত থাকা অবস্থায় আমীর খাত্তাবের মা তার কাছে একটি চিটি লিখেছিলেন। কিন্তু চিঠিটি এক রুশগুপ্তচরের হস্তগত হয়- যে মুজাহিদদের মাঝে ছিল- সে তাতে এক রাসায়নিক বিষ মেখে দেয়। যা শুকার পর যে কেউ আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
চিঠিটি কামান্ডার খাত্তাবের হাতে আসে। আমীর খাত্তাব তা পড়ার পর ২০ মার্চ ১৪২৩ হিঃ সফর মাসের শুরুরদিকে মধ্যে রাতে ৩৩ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন। শাহাদাৎ বরণ করেন এক কিংবদতন্তী।পরকালে পাড়ি জমান এক মূর্তমান আতংক। যিনি গুটি কয়েক মুজাহিদ নিয়ে রাশিয়ার মত বিশাল দৈত্যংদেহী বাহীনিকে পরাজিত করেছিলেন। লড়াইয়ের ময়দানে তিনি ছিলেন ইস্পাত দৃঢ়।যিনি প্রথমে আফগানের ময়দানে তারপর তাজিকিস্তান এবং চেচনিয়ার ভূমিতে রুশ ভল্লুকদের পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ আস্বাদন করিয়েছিলেন। তিনি চেচেনদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন। ভীতসন্ত্রস্ত করে রেখেছেন শত্রুদের। সময়ের সুপার পাওয়ার রাশিয়া তাকে মারার জন্য কোন বাহীনিই পাঠানোর সাহস করেনি।
খাত্তাব রাহিঃ‘র দখল ছিল ৪ টি ভাষায়; আরবী,রুশ,ইংরেজী আর পশতু। এই চার ভাষায় তিনি অনর্গল কথা বলতে পারতেন।
তার মৃত্যুর পর পুতিন বলেছিল, “যদি তারা তাঁকে সত্যিই হত্যা করে, তাহলে তা হবে সন্ত্রাসবাদের(মুজাহিদদের) উপর একটি কঠিন আঘাত”
আফগান যুদ্ধের শুরুতে বুশ ‘বাত্বালুনা’ খাত্তাব রাহিঃর অতীত ইতিহাস এবং শত্রুর উপর তাঁর আকস্মিক দুঃসাহসীক সব হামলার কথা জেনে তাঁর কাছে আবেদন করেছিল, যাতে তিনি আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহন না করেন।
-
দুঃখের বিষয় হচ্ছে, চে গুয়েভারাদের আমরা খুব ভালোভাবে চিনি, তাদের বীরত্ব নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তাদের ছবি অঙ্কিত জামা গায়ে দিই, অথচ আমাদের এতো বড় বড় বীরদের নামটা পর্যন্ত ভালো করে জানিনা! তাদের বীরত্ব ও উম্মতের প্রতি অসামান্য অবদান সম্পর্কে ছিটেফোঁটা ধারণাও রাখিনা!!
খাত্তাব রাহিঃ’র কিছু বাণীঃ-
“যে অপদস্থ হয়ে জীবন গুজরান করে সে অপদস্থ হয়েই মৃত্যুবরণ করে,পক্ষান্তরে যে উম্মাহর জন্য, বীর বেশে জীবন গুজরাণ করে তার মৃত্যুও হয় মহান মৃত্যু”
“শত্রু তোমার উপর হামলা করার পূর্বেই তুমি তার উপর হামলা কর,আমাদের উপর আগে হামলার অপেক্ষা করোনা ,যার পরে মহিলাদের মত চিৎকার করতে থাকব; বরং যখন আমরা দেখব, তারা আমাদের উপর হামলার ইচ্ছা করেছে তখন আমাদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা থাকলে আমরা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব।যাতে অন্যান্য মুসলিম ভূখন্ডে হামলা করার মত দুঃসাহস তাদের আর না হয়”
“আমি এমনভাবে মৃত্যু বরণ করাকে ভয় পাই যে , আমার লাশের কোন মূল্য থাকবেনা(স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যু বরণ করা) তবে আমার কামনা হল শহীদি মৃত্যু”
“আমাদের মাঝে আর সাহাবায়ে কেরামের মাঝে পার্থক্য কোথায়, আমরাও মানুষ তারাও মানুষ,আমরাও পানাহার করি, তারাও করতেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন এমন মানুষ, যারা ইতিহাস রচনা করেছেন, সুতরাং আমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে তাঁদের মত ইতিহাস রচনা করা, যাতে আমরা তাদের সাদৃশ্য গ্রহন করতে পারি; যদিও আমরা তাঁদের মত নই”
“শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আমাদের কাছ রয়েছে দুই ধরণের অস্ত্র; একটি হল, ইমান এবং আল্লাহর উপর দৃঢ় বিশ্বাসের অস্ত্র, আর আরেকটি হল রুশদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনা এবং তাদের থেকে গানীমাহ স্বরুপ প্রাপ্ত অস্ত্র। যেমনটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “وجعل رزقي تحت ظل رمحي) আমার রিযিক রাখা হয়েছে আমার বর্শার নিচে”।
ইসলামের মহান এই বীরের চেতনা তার জঝবা আল্লাহ্* আমাদেরকে বুকে ধারন করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
وكلانقص عليك من انباء الرسل ما نثبت به فؤادك
“আর আমি রসূলগণের সব বৃত্তান্তই তোমাকে বলছি, যদ্দ্বরা তোমার অন্তরকে আমি মজবুত করছি”।
[সংগৃহীত এবং পরিমার্জিত।এই লিখাটির অধিকাংশই واخيرا ترجل الفارس خطاب নামক প্রবন্ধ থেকে নেয়া হয়েছে।]
Comment