আমার দেখা তালেবানের সোনালী শাসন
শাইখ আবু মুনজির আস-সায়িদি হাফি.
শাইখ আবু মুনজির আস-সায়িদি হাফি.
আরবের প্রসিদ্ধ মুজাহিদ আলেম শাইখ আবু মুনজির আস-সায়িদি ইমারাতে ইসলামিয়া আফগানিস্তান (১৯৯৬-২০০১) বসবাসের পর নিজের উপলব্ধিগুলো এভাবে শেয়ার করেন:
আমি ইউরোপেও বসবাস করেছি, আফগানিস্তানেও বসবাস করেছি। কিন্তু আমার এতদুভয়ের মাঝে বিশাল পার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওখানে সন্ত্রাসী, হত্যা ও লুটপাট ব্যাপক, যখন কাবুলের সড়কসমূহে মানি চেঞ্জার নিজের ভাঙ্গা টেবিলের ওপর কারেন্সিগুলো সাজিয়ে বসে আছেন। সে এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করছে না।
বাস্তবতা হল, আমাদের জীবনে এই প্রথম এমন এক রাষ্ট্র দেখলাম যা আমাদের ইচ্ছা ও আকাঙ্খাগুলোর ধারক বাহক ছিল। আমরা এই রাষ্ট্রের ছায়াতলে সম্মান, শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করেছিলাম। যেখানে আমরা নিজেদের দায়িত্বশীল ও আমিরুল মুমিনিনের আনুগত্য করতাম এবং তালেবানদের সঙ্গে একসাথে ইমারাতে ইসলামিয়াকে দৃঢ় করার চেষ্টা করতাম।
এখানে আমি এমন কিছু পরিস্থিতির শিকার হয়েছি যার কারণে ইমারাতে ইসলামিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক আারও দৃঢ় হয়েছে। ইমারাত এই আধুনিক যুগে এত সুন্দরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে যার মাধ্যমে পুরো মুসলিম বিশ্বের প্রাণে শক্তির সঞ্চার হয়েছে। আমি দেখেছি, দ্বীনদার ও মুত্তাকি আলিমগণ রাষ্ট্র পরিচালনা করলে সে রাষ্ট্রের রূপ কেমন হয়। আমি এখানে সাদামাটা কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি:
একদা জনৈক উর্ধ্বতন মাসউল (জিম্মাদার)-এর পক্ষ থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। ফলে আক্রান্ত লোকেরা তার অফিসে এসে অনেক কঠিন ভাষায় তাকে সম্বোধন করে কথা বলল। আমি তখন সেখানেই ছিলাম। ঐ মাসউল বললেন,“আমার ভুল এবং আমার ব্যাপারে যত অভিযোগ আছে তা জমা করে সামরিক আদালতে উপস্থাপন করুন। আমি কাজির ফয়সালা দেয়া যে কোন শাস্তি গ্রহণে প্রস্তুত। কারণ, আমি এব্যাপারে প্রস্তুত নই যে, কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হবো তখন আমার মাথার ওপর জুলুমের এই বোঝা থাকবে।” তখন মজলুম দাবিদার তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন এবং এই ওজরখাহির ওপরই তা সমাপ্ত করে দিলেন। কিছু দিন পর সেই মাসউলের নায়েব অভিযোগকারীদের ঘরে গেল যে, তারা আবার অসন্তুষ্ট হয়ে আছে কিনা! বর্তমানে আমদের জন্য পুরো মুসলিম বিশ্বকে এটির সাথে তুলনা করা উচিত। কারণ, বিপরীত জিনিস দ্বারা বস্তুর বাস্তবতা সামনে চলে আসে।
ইমারাতে ইসলামিয়ার সামরিক আদালতের ক্ষমতা অনেক ব্যাপক ছিল। যার কারণে অনেক মন্ত্রী এবং মাসউলদেরকেও শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। আমি নিজেই এমন অনেকগুলো ঘটনা দেখেছি যে,তাদেরকে কোনো ধরণের সম্পর্ক এই শরয়ী আদালতের গ্রেফতারি থেকে রক্ষা করতে পারতো না।
আমি এক মন্ত্রীর দরবারে উপস্থিত হলাম। সেখানে তার জন্য কিছু হাদিয়া এসেছিল। তিনি এসব হাদিয়া উপস্থিত লোকদের মাঝে বণ্টন করা শুরু করলেন। আমি উপস্থিত এক লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, মন্ত্রী সাহেব নিজের জন্য কিছুই রাখলেন না? মন্ত্রী সাহেব আমার কথা শুনে বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, আমিরুল মুমিনিন আমাদেরকে হাদিয়া গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, মন্ত্রী বা নেতৃস্থানীয় লোকদের হাদিয়া এক ধরণের ঘুষের অন্তর্ভুক্ত যা হারাম।
শাইখ আবুল লাইস রহ. মোল্লা মুহাম্মাদ রব্বানী রহ.-এর মৃত্যুর স্থানে আমিরুল মুমিনের সাথে তার সাক্ষাতের অবস্থা আমার কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমিরুল মুমিনিন মসজিদে লোকদেরকে আসর সালাত পড়িয়ে মসজিদের বাহিরে চলে আসলেন এবং মাটিতে নিজের চাদর বিছিয়ে বসে গেলেন। লোকজন এসে তার কাছে সমবেদনা প্রকাশ করতে লাগল। তিনি আমার কাছে সে মজলিসের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এসব সমবেদনা প্রকাশকারীরা জানতো না যে, আমি আমিরুল মুমিনিন। যখন তাদেরকে বলা হল যে, তিনিই আমিরুল মুমিনিন তখন তারা বলল, আল্লাহর শপথ! তার সাদাসিধা অবস্থা দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে কেমন যেন একজন টেক্সি ড্রাইভার।
কান্দাহারের মাইওয়ান্দ এলাকার কমান্ডার জনৈক সন্দেহভাজন লোককে গ্রেফতার করলেন। যখন সে সামনে আসল তখন কমান্ডার তাকে পকেটের সব কিছু বের করতে আদেশ দিলেন। লোকটি পকেট থেকে কিছু কাগজ আর কিছু টাকা বের করল। কমান্ডার টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বলল, নিজের টাকা নিয়ে নাও। এরপর তিনি কাগজগুলোসহ লোকটিকে নিয়ে পাশের রুমে বসালেন। তিনি আমাকে বললেন, কাগজগুলো একটু দেখে নিতে। অবশেষে যখন কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না তখন সাথে সাথে লোকটিকে ছেড়ে দিল। যেন সে নিজের বাড়ি ফিরে যেতে পারে। সেই লোকটি আমাকে বলল, তালেবানের আগে যখন সে নিজের পাসপোর্ট সাথে নিয়ে সফর করতো তখন সে-ই গৃহযুদ্ধকালীন যদি আমি মুজাহিদ দাবীদার সেসব অপরাধীদের হাতে বন্দী হতাম তখন যে, আমার ওপর দিয়ে কি কিয়ামত বয়ে যেত!!!
এধরণের আরও বহু দৃষ্টান্ত আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে। যখনই আমার এসব কাহিনী স্মরণ হয় তখনই আমার চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে থাকে। ক্রুসেডীয় আগ্রাসন এই ইমারাতের ওপর ঝাপিয়ে পড়েছে। এটি সেই ইমারাত যার ছায়াতলে আমি জীবন যাপন করেছি। আমি একারণে এটি বলছি যে, যখন ইমারাতের পতন হয়েছে তখন আল্লাহই জানেন তার কী অবস্থা হয়েছে...? আমি এই জাতিকে ভালোবাসি এবং আমার কাছে এটি অনেক বড় এক ক্ষতি মনে হয়েছে। ( আল-হামদুল্লিাহ আজ ইমারাতে ইসলামিয়া আবার ফিরে এসেছে।)
أجد الملامة في هواك لذيذة
حبا لذكرك فليلمنى اللوم
“তোমার ভালোবাসা আমাকে করা ভর্ৎসনাকে সুস্বাদু করে দেয়। সুতরাং হে তিরস্কার! তুমিও আমাকে তিরস্কার করো, যেন আমার প্রিয়ার স্মরণ তাজা থাকে।”
حبا لذكرك فليلمنى اللوم
“তোমার ভালোবাসা আমাকে করা ভর্ৎসনাকে সুস্বাদু করে দেয়। সুতরাং হে তিরস্কার! তুমিও আমাকে তিরস্কার করো, যেন আমার প্রিয়ার স্মরণ তাজা থাকে।”
হে পাঠক! আমার এই দুর্বলতা ও আলোচনার কারণে তুমি আমাকে ভর্ৎসনা করো না। আমাকে ভালোবাসাপূর্ণ সেই মুহুর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করতে দাও। আমি নিজের হৃদয়কে সেই দিনগুলো ফিরে আসার শান্তনা দিচ্ছি। আর আল্লাহর জন্য এটি কঠিন কোন বিষয় নয়। হয়ত আমরা খুব দ্রুতই তালেবান বা তাদের চেয়ে উত্তম লোকদেরকে দেখতে পাবো। সর্বশেষ আমি আপনাদেরকে বলছি, আপনারা নিজেদের সব চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহ রাখুন; যাতে আল্লাহর দ্বীনের বিজয় দেখা যায়। যদিও আমেরিকা, কাফির এবং সমস্ত কাফিরদের কাছে এটি অপছন্দ হয়, ইনশাআল্লাহ। জিহাদ ও কিতালের সফর বাকি রাখুন। আজ আবার ক্রুসেড যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ময়দান সজ্জিত হচ্ছে। মুজাহিদদের পবিত্র রক্তে ইসলামের জমিনসমূহে পানি সিঞ্চনকারী নদিসমূহ আজ ফালুজা থেকে ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিন থেকে কাবুল পর্যন্ত জারি রয়েছে। দ্বিতীয়বার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কাল যদি হালাকু খানের সঙ্গ দেওয়া নিজেদের লোক হয়ে থাকে তাহলে আজও কিছু শাসক আমাদের খেয়ে পরে তাদের আজকের হালাকুদের সঙ্গ দিচ্ছে। তাই হে উম্মাতে মুসলিমাহ! ফয়সালা করে নাও! আপনি কি হালাকু খানের সঙ্গ দেবেন নাকি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোলামদের সঙ্গ দেবেন?
(নাওয়ায়ে গাজওয়ায়ে হিন্দ—এপ্রিল সংখ্যা থেকে অনূদিত)
Comment