Announcement

Collapse
No announcement yet.

বাংলা এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতি।

Collapse
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • বাংলা এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতি।

    বর্তমানে দেশে ক্ষমতাসীন তাগুত সরকার আর তাদের পাচাটা তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের যখনই যাবতীয় হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে ইসলামের দিকে আহবান করা হয় তখনই তাদেরকে হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে এক নব্য আবিষ্কৃত হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির অজুহাত সামনে নিয়ে আসতে দেখা যায়।তাদের ভাষ্যমতে আগে আমি বাঙালি তারপরে মুসলমান আর তাদের কাছে হাজার বছরের বাঙ্গালী সংস্কৃতি মানে কেবল হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। কিন্তু, ইতিহাস তাদের এ দাবি কতটুকু সমর্থন করে ?

    বাঙ্গালী এবং বাংলা, উভ​য় শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে বাঙ্গালা শব্দ থেকে, যা ছিল ফার্সী ভাষায় এই অঞ্চলের নাম। মুসলমানদের বাংলা অধিকারের পূর্বে এ নাম কেউ ব্যাবহার করে নি।কেননা, বংলা সালতানাতের পূর্বে এ অঞ্চলে কোন স্থায়ী জাতিসত্তা ছিল না, এ অঞ্চল অনেকগুলো জনপদে বিভক্ত ছিলো। মুসলমানরাই সর্বপ্রথম সবগুলো জনপদকে একত্রিত করে বাঙ্গালি জাতীয়তার ভিত্তি রচনা করেন। সেই আলোচনায় পরে আসছি।

    ভারতীয় মূল আদি জনগোষ্ঠী আর্য-দ্রাবিড় জাতিগোষ্ঠী হতে গড়ে উঠলেও বাঙ্গালী জাতির মূল অংশ অাস্ট্রিক জাতি হতে উঠেছে বলে ঐতিহাসিকদের মত। অার্য জাতি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০- ২০০০ অব্দে ইরান হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের ধারনা।ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্যদের আগমনের পর হতেই সেই অঞ্চলের প্রাচীন জনগোষ্ঠী দ্রাবিড়দের সাথে সংঘাতের সুচনা হয় এবং এক পর্যায়ে উত্তর ভারতের ভূমি সন্তান দ্রাবিড়দের উপর আর্যরা বিজয়ী হয়। এ সময় আর্যরা যে ধর্মমত প্রচার করে তাই বৈদিক ধর্ম বা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্ম। তারাই এ সময় ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ বেদ রচনা করেন। এদিকে পরাজিত দ্রাবিড়রা আর্যদের অধীনে লাঞ্ছিত হতে থাকে এবং আর্যদের প্রতিষ্ঠিত জাতিভেদ প্রথার সর্বনিম্ন স্তর শুদ্র স্তরে দ্রাবিড়দের স্থান দেয়া হয়। এ সময় কিছু সংখ্যক দ্রাবিড় অর্যদের অত্যাচারে নিপিড়ীত হয়ে ভারতের পুর্বাঞ্চলে এসে আশ্রয় নেয়।

    এক সময়ে সম্পূর্ণ উত্তর ভারত আর্যদের দ্বারা জোরপূর্বক অধীনতা স্বীকার করে নিলেও ভারেতর পূর্বাঞ্চল তথা এ অঞ্চলের আধিবাসীরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে রুখে দাঁড়ায় এবং আর্যরা কখনও এ অঞ্চল তথা বর্তমান সময়ের বাংলায় প্রবেশ করতে পারে নি। এই সম্পর্কে অধ্যাপক মন্মথমোহন বসু লিখেনঃ“প্রায় সমস্ত উত্তর ভারত যখন বিজয়ী আর্য জাতির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল, বঙ্গবাসীরা তখন সগর্বে মস্তক উত্তোলন করিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিল”। শতপথ ব্রাহ্মণ বলেন, “আর্যদের হোমাগ্নি সরস্বতী তীর হইতে ভাগলপুরের সদানীরা নদীর পশ্চিম তীর পর্যন্ত আসিয়া নিভিয়া গিয়াছিল। অর্থাৎ সদানীরার অপর পারে অবস্থিত বঙ্গদেশের মধ্যে তাঁহারা প্রবেশ করিতে পারেন নাই”। (বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৯, পৃষ্ঠা ২১)।

    এ কারণে হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদে ভারতের পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে রয়েছে নানা ধরনের অবজ্ঞাপ্রসূত উক্তি, এ অঞ্চলের আধিবাসীদের বলা হয়েছে দস্যু এবং এ অঞ্চলে প্রবেশ নিষেধ করা হয়েছে। বিদ্বেষপ্রসূতত অনেকগুলো শ্লোকের মধ্যে একটি শ্লোক,

    "অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রে মগধেহপি চ।
    তীর্থ-যাত্রাং বিনা গচ্ছন পুনঃ সংস্কারমর্হতি"

    অর্থ- অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এমনকি সৌরাষ্ট্রে তীর্থ যাত্রা ব্যাতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে গমন করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

    (এ শ্লোক বেদের বলে দাবি করা হলেও নিরপেক্ষ সূত্রে যাচাই করা সম্ভব হয় নি, তবে বেদে ভারতের পূর্বাঞ্চল সম্পর্কে বিদ্বেষপ্রসূত অনেক শ্লোক বিদ্যমান)

    এর দ্বারা সমগ্র পূর্ব ভারতকে ব্রাহ্মণগণ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্য নিষিদ্ধ করেছেন।এভাবে, দেখা যায় যে, ইতিহাসের সূচনা লগ্ন হতেই এ অঞ্চলের সাথে ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির পরস্পর বিরোধী মনোভাব বিদ্যমান।

    খ্রিস্টপূ্র্ব ৬২৫ অব্দে বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব হলে অত্যাচারী ব্রাহ্মণদের দ্বারা নিগৃহীত পূর্ব ভারতে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

    পরবর্তীতে, অানুমানিক খ্রি.পূর্ব ৩২৮ অব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সাম্রাজ্য মৌর্য সাম্রাজ্যের( খ্রি.পূ.৩২৫ - ১৮৫ অব্দ) উদ্ভব হয়। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী সম্রাটদের দ্বারা গঠিত এ সম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট ছিলেন সম্রাট অশোক ( খ্রি পূ ২৭৩-২৩২ অব্দ)।তিনি সমগ্র পশ্চিম ভারত অধিকার করার পর পূর্ব ভারত অধিকার করতে চাইলে পূর্ব ভারতের কলিঙ্গ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ বৌদ্ধ ধর্মালম্বী লোক নিহত হয়।এ দৃশ্য দেখে সম্রাট অশোক পূর্ব ভারতে আগ্রসন বন্ধ করে নিজেই বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহন করে নেন এবং বৌদ্ধ ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম গোষণা করেন। ফলে, এ সময়ে উত্তর বাংলার কিছু অংশে মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও বৃহত্তর বাংলা তাদের অধীনতার বাইরে ছিল। ফলে, বাংলায় ব্রহ্মণ্যবাদীদের ভিত এ সময়েও রচিত হয় নি।

    এরপর আসে গুপ্ত যুগ( ২৮০-৫৫০ খ্রিস্টাব্দ)। এ যুগকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ইতিহাসের স্বর্ণ যুগ বলা হয়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় এ যুগে তারা সমগ্র ভারত অধিকার করলেও বাংলায় প্রবেশ করে নি বা করতে চাই নি। এ যুগে বাংলার পশ্চিম অংশের কেবল রাঢ় জনপদ তাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল।এসময়েই রাঢ় জনপদে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের শক্ত ভিত রচিত হয়, অন্যান্য জনপদ এদের অায়ত্তের বাইরে ছিল। বাংলায় আর্য ব্রাহ্মণদের আগমন বলতে কেবল এ টুকুই।এজন্যে, আধুনিক কালের ঐতিহাসিকগণ বলে থাকেন, বাংলার হিন্দুরা কখনো পরিপূর্ণ হিন্দু হয়ে উঠতে পারে নি।
    গুপ্ত পরবর্তী সময়ে রাজা শশাঙ্ক সমতট ব্যাতীত বাংলার সবগুলো জনপদকে একত্রিত গৌড় নামে একত্রিত করেন।কিন্তু, ইতিপূর্বে হুনদের আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্য খন্ড-বিখন্ড হয়ে পড়ে।রাজা শশাঙ্কের মৃত্যু পরবর্তী সময়ে বাংলা আবার খন্ড-বিখন্ড হয়ে অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যা ইতিহাসে মৎস্যন্যায় নামে পরিচিত। এ ধারা প্রায় দুইশো বছর পর্যন্ত চলতে থাকে এবং পরবর্তীতে এ অরাজক পরিস্থিতির মধ্য থেকে পাল সাম্রাজ্যের উৎপত্তি হয়।

    পাল সাম্রাজ্য এ অঞ্চলের অধিবাসীদের দ্বারা গঠিত প্রথম সাম্রাজ্য। এসময়-কালকে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির বিকাশের সূচনাপর্ব বলা হয়।বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন 'চর্যাপদ' এ সময়েই রচিত হয়। কিন্তু, পাল সাম্রাজ্যের রাজাগণ এবং এ অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হওয়ায় তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারতভাষী দ্বারা সামজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে পরিত্যাগের স্বীকার হয়। এক্ষেত্রে রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের 'বৃহৎ বঙ্গ' বইয়ে উল্লেখিত উদ্ধৃতিটি হুবহু তুলে ধরা হল-
    "পালরাজাগণ, বিশেষ করিয়া শেষের দিকের পালবংশের কতিপয় রাজা ব্রাহ্মণ-পন্ডিতের প্রতি সশ্রদ্ধ থাকিলেও তাঁহারা বৌদ্ধ ধর্মেরই পরিপোষক ছিলেন, আর্য্যবর্ত্তের ও দক্ষিণাপথের গোঁড়া ব্রাহ্মণের দল এদেশকে অভিশপ্ত মনে করিয়া ত্যাগ করিলেন। পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে - এখানে জনসাধারণ অতি পূর্ব্বকাল হইতেই ব্রাহ্মণ্য বিরোধী ছিল এবং এদেশ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল, সুতরাং যদিও কপিল মুনির আশ্রম এবং প্রাচীন শৈবধর্মসংক্রান্ত অনেক তীর্থ এখানে বিরাজ করিত- তথাপি পালাধিকারে নবোত্থিত ব্রাহ্মণগণ এই দেশকে ব্রাহ্মণদিগের বসবাসের অযোগ্য মনে করিয়া, এদেশের সঙ্গে সমস্ত হিন্দু সমাজের সম্বন্ধ ত্যাগ করাইতে কৃতসংকল্প হইলেন। অপেক্ষাকৃত আধুনিক সময়ে রাঢ় অঞ্চলের ব্রহ্মণেরা যেরূপ পূর্ববঙ্গের কোন কোন স্থানে বৌদ্ধ প্রাধান্য দেখিয়া পদ্মা ও বুড়িগঙ্গাকে গঙ্গার শাখা বলিয়া কুন্ঠিত এবং ভাগীরত-খাত খালের গৌরব বাড়াইয়া ঔ দুইটি বৃহৎ নদীর জাত মারিয়াছেন, তেমনই করিয়া পালাধিকারে ভারতের নবসৃষ্ট ব্রাহ্মণ্য শাসিত হিন্দু সমাজ বঙ্গ ও অপরাপর বৌদ্ধাধিকৃত স্থানসমূহ তাহাদের গন্ডী হইতে বর্জ্জন করিলেন। ফলে, অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, সৌরাষ্ট্র, মগধ বজ্জিত হইল, তীর্থযাত্রা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে এই সকল দেশে আসিলে হিন্দুর প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে, এরূপ বিধি প্রচারিত হইল।সমুদ্রযাত্রা নিষেধ এবং ভারতের বড় বড় বাণিজ্য কেন্দ্রের বর্জ্জন দ্বারা ভারতবর্ষ হইতে বাণিজ্যলক্ষী একরূপ বিতাড়িত হইলেন।"

    অর্থাৎ, পাল রাজারা যদিও হিন্দু ব্রাহ্মণদের সম্মান করতেন তথাপি এ অঞ্চল ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা পরিত্যক্ত এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল।

    এ সংকটময় মুহূর্তে পাল রাজাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আরব মুসলমানগণ। এসময়ে পৃথিবীতে শিক্ষা, বিজ্ঞান, অর্থনীতি আর প্রযুক্তিতে বাগদাদের আব্বাসীয়দের জয় জয়কার। পালদের প্রত্নতত্ত্ব স্থলগুলোতে প্রচুর আব্বসীয় মুদ্রা এবং এ সময়ের প্রখ্যাত আরব ভৌগোলিক সোলাইমান, ইবনে খালদুন, আল ইদ্রিসী, ইবনে খুরদাদবা প্রমুখদের বই সমূহে পাল সাম্রাজ্যের সাথে আরবদের সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগের উল্লেখ এ সংক্রান্ত প্রমাণ বহন করে।

    পাল রাজাদের সাথে আরবদের সরাসরি বাণিজ্যিক এবং কূটনীতিক সুসম্পর্ক থাকায় আরব ইসলাম প্রচারকগণ এ সময়ে বাংলায় সরাসরি ইসলাম প্রচার-প্রসারের সুযোগ পায় এবং ইসলাম প্রচারে স্থানীয় রাজন্যবর্গের সাথে কোনরূপ সংঘর্ষের ইতিহাস কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।এজন্য পাল যুগকে বাংলায় ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক যুগ বলা হয়। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, স্বাধীন এবং স্থিতিশীল রাজ্য হিসেবে এ অঞ্চলের সূচনা পর্ব হতেই ইসলামি সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সাথে এ অঞ্চলের সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল।

    ব্রাহ্মণদের অবরোধ সত্ত্বেও আরবদের সাথে সরাসরি বাণিজ্যিক যোগাযোগের সুবাধে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অর্থনৈতিক এবং সামরিক খাতে একসময় পাল সাস্রাজ্য সমৃদ্ধির শিখরে আরহন করে।ফলে, খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের উত্থান হলেও দশম শতাব্দীর শেষের দিকে দেখা যায় তারা বাংলার সীমা অতিক্রম করে ব্রাহ্মণ্যবাদী পুরো উত্তর ভারত দখল করে নেয়। ফলে, এসময়ে দক্ষিণাত্যে শক্তিশালী ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের বাধার সমুক্ষীন হতে থাকে। একাদশ শতাব্দীর পুরোটা সময় পাল সাম্রাজ্যের সাথে রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা যায়। এসময়ে রাষ্ট্রকূট রাজারা উত্তর ভারতে পাল রাজাদের বার বার পরাজিত করলেও পূর্ব ভারত ছিল তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পূর্ব ভারতে পাল রাজাদের শক্তিশালী অবস্থান থাকায় এসময়ে তাদেরকে পরিপূর্ণ বিপর্যস্ত করা সম্ভব হয় নি এবং উত্তর ভারতে পরজয়ের কিছুদিন পর পরই হারানো রাজ্য উদ্ধারে মনোযোগী হতে দেখা যায় । ফলে, রাষ্ট্রকূটের ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এবার পূর্ব ভারতে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলেন।গুপ্ত যুগের শেষের দিকে গঙ্গা নদীর পথ ধরে একদল হিন্দু জেলে সম্প্রদায় পূর্ব ভারতে আগমন করে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিলেন, এদেরকে বলা হত কৈবর্ত সম্প্রদায়। দ্বাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেখা যায়, রাষ্ট্রকূট ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ মদদে এ হিন্দু সম্রদায় পূর্ব ভারতের অভ্যন্তরে বিদ্রোহ করে এবং এক পর্যায়ে পাল রাজাদের হত্যা করে। এ বিদ্রোহ ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে পরিচিত যা কয়েক প্রজন্মব্যাপী বিস্তৃত ছিল এবং এ বিদ্রোহের ফলে পাল সাম্রাজ্য এতটা দূর্বল হয়ে সুবিশাল পাল সাম্রাজ্য একসময় ভেঙ্গে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের মদদে হিন্দু কৈবর্ত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহে চারশ বছরের পাল সাম্রাজ্য এক সময় ধ্বংস হয়ে যায় এবং এ অঞ্চলের চিরশত্রু দক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ্যবাদী আগ্রসী সেন বংশ এ অঞ্চল দখল করে নেয়।

    সেন বংশ ভারতের দক্ষিণাত্য হতে এ অঞ্চলে আগ্রাসনকারী এবং শাসনকারী একমাত্র হিন্দু রাজবংশ। তারা নিজেদের ব্রাহ্মণক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দিলেও তারা ছিল মূলত ক্ষত্রিয় এবং এ সাম্রাজ্যকে স্বাধীন রাজবংশ মনে করা হলেও তারা ছিলো পরোক্ষভাবে দক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট সামাজ্যের প্রতিনিধিত্বকারী রাজবংশ মাত্র।

    সেন বংশ মাত্র অল্প সময় এ অঞ্চল শাসন করলেও তাদের হিমালয়সম জুলুম -নির্যাতনের জন্য এ শাসন ইতিহাসে অত্যন্ত স্বরণীয়। সেন বংশ দুইশ বছরের অধিক সময় স্থায়ী হলেও অর্ধ শতাব্দীরও কম সময় তারা বাংলা শাসন করতে পেরেছিল, কিন্তু তাদের এ অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ের শাসনামলে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর ত্রাস আর রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো।এ অঞ্চলের মুসলিমদের সাথে প্রথম সংঘাত এ সেন আমলেই শুরু হয়। পাল আমলে ধর্মান্তরিত নওমুসলিম এবং ইসলাম প্রচারে আগত মুসলমান কাফেলার সাথে সেন রাজাদের সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ইতিহাসে উল্লেখিত এরকম অসংখ্য সংঘর্ষের ঘটনার কথা বিদ্যমান।তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হল, বিক্রমপুরে বল্লাল সেন কর্তৃক স্থানীয় মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার এবং হত্যার ঘটনা।বল্লাল সেন কর্তৃক স্থানীয় মুসলমানদের প্রতি অত্যাচারের কথা শুনে আরব দেশ হতে আগত বাবা আদম রহ. স্থানীয় মুসলমানদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।পরে, বাবা আদমসহ তার সাথী সকল মুসলমান বল্লাল সেনের হাতে শহীদ হয়ে যান। মুসলমানদের কথা বাদ দিলে চারশো বছর ধরে এ অঞ্চল শাসনকারী ও এ অঞ্চলের ভূমিপুত্র বৌদ্ধদের মাত্র অর্ধ শতাব্দীর কম সময়ে এ অঞ্চল হতে নিশ্চিহ্ন হওয়া এবং বর্তমানের বার্মার দিকে অভিবাসী হওয়া থেকেই এই সেন রাজাদের অত্যাচার সম্পর্কে আন্দাজ করা যায়। এছাড়া তারা পাল আমলে গড়ে উঠা এ অঞ্চলের ভাষা এবং সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য তারাই দায়ী।তারা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে পাল আমলে বাংলা ব্যাবহৃত হলেও তার স্থলে সংস্কৃতের ব্যাবহার শুরু করেন এবং পাল আমলে নির্মিত অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের জন্য তারাই দায়ী ।যদিও এসব বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের জন্য আধুনিক হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বখতিয়ার খলজিকে দায়ী করেন, কিন্তু ইতিহাস স্বাক্ষী বখতিয়ার খলজি দূর্গ মনে করে ওদন্তপুর বিহার ছাড়া আর কোন বিহার ধ্বংস করে নি এবং পরে নিজের ভূল বুঝতে পেরে ঐ অঞ্চলের নাম রাখেন বিহার শরীফ।

    ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বখতিয়ার খলজিকে পরদেশ আক্রমণকারী এবং এ অঞ্চল ধ্বংসকারী বলে আখ্যা দিলেও , প্রকৃতপক্ষে ১২০৪ সনে বখতিয়ার খলজির বাংলার জয় ছিল সেন রাজাদের দাসত্বের শৃঙ্খল হতে এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মুক্তির পয়গাম। বখতিয়ার খলজি যদি আসলেই সেন রাজাদের মত এ অঞ্চলের অধিবাসীদের উপর নিপিড়ন শুরু করতেন তবে বাংলায় হিন্দুরা কখনোই মুসলমানদের সমকক্ষ হতে পারতেন না, তারাও বৌদ্ধদের মত নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ত।তবে, এখানে লক্ষণীয় বিষয় বখতিয়ার খলজি মাত্র ১৬-১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলেও লক্ষ্মণ সেন কোনরূপ বাধা না দিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান।অথচ, ইতিপূর্বে যারাই এ অঞ্চল আক্রমণের দুঃসাহস দেখিয়েছিলো তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল, স্বয়ং মহামতি আলেকজান্ডার তার বিশ্বজয়ের অভিযান স্থগিত রেখে বিপাশা নদীর পশ্চিম পাড় হতে ফিরে গিয়েছিল। লক্ষ্মণ সেনের যথেষ্ট সৈন্য সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ মসলমানদের বাংলা জয় সম্পর্কে লক্ষ্মণ সেনের ব্রাহ্মণ পন্ডিতদের ভবিষ্যৎবাণীকে দায়ী করেন। তবে এ কারণ বাদ দিলেও মুসলমানদের বিরুদ্ধে লক্ষ্মণ সেনের জয়ের কোন সম্ভাবনা ছিলো না।কেননা, আগ্রাসী শাসক হিসেবে লক্ষ্মণ সেনের এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মাঝে কোন জনসমর্থন ছিলো না, অপরদিকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম জামাতের দ্বারা বিপর্যস্ত বাহিনীর পক্ষে সুসংগঠিত নিয়মিত মুসলমান বাহিনীর মোকাবিলা করার প্রশ্নই আসে না।

    এভাবে দেখা যায় যে, আগ্রসী সেন রাজাদের এ অঞ্চলে আক্রমণের পূর্বেও এ অঞ্চেল মুসলমান ও ইসলামি সংস্কৃতির যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং মুসলমানদের বাংলা অধিকার করার পূর্বে আগ্রাসী সেন রাজাদের নির্যাতনে বিপর্যস্ত এ অঞ্চলের বৌদ্ধ ও মুসলমান অধীবাসীরা মুসলিম শাসকের হস্তক্ষেপের প্রত্যাশী ছিল।

    তথ্যসূত্রঃ
    ১) জর্জ সিরিজ, বাংলাদেশ বিষয়াবলী by ড. শাহনেওয়াজ হোসেন জর্জ।
    ২)বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খন্ড by রায় বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন।
    ৩)ভারতবর্ষের ইতিহাস by রোমিলা থাপার।
    ৪)Essays on Ancient India by Raj kumar.
    ৫) উইকিপিডিয়া।
    ৬)বাংলাপিডিয়া।

  • #2
    ماشاء الله
    جزاك الله خيرل

    Comment


    • #3
      অসাধারণ হয়েছে.... জাযাকুমুল্লাহ... খিলজি-পরবর্তী মুসলিম শাসন সম্পর্কে লিখার আবেদন... আল্লাহ সহজ করুন, আমীন..

      এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়...
      মিডিয়ার সাফল্য অনেকাংশেই তার প্রচারণার উপর নির্ভরশীল।

      Comment


      • #4
        বাঙালিয়া সাংস্কৃতি বলে তারা যা বুঝায় তা যদি তারা বাঙালিদের জীবন যাপনের পদ্ধতিকে বলে থাকে যেমন তাদের খাবার দাবার পোশাক আশাক ইত্যাদি যেমনটিতে অঞ্চল ভেদে ভিন্নতা হয়ে থাকে তাহলে এটাকে সাংস্কৃতিক বলাটা ভুল হবে ।যেহেতু মানুষের চালচলনকে সাংস্কৃতিক বলা হয় না।আর যদি সাংস্কৃতিক বলতে মুজিব পুজা এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে এটা হাজার বছরের সাংস্কৃতি হল কিভাবে এসব তো গত পোরশু দিন আবিস্কৃত হয়ে হয়েছে । তাদের এসব সাংস্কৃতিক সাংস্কৃতিক খেলা হল পুতুল দিয়ে খেলার মত যার কোন বাস্তবতা দুনিয়া আখেরাতে কোথাও নেই বরং ইসলামি আদর্শ একমাত্র আদর্শ যার সূচনা হযরত আদম আঃ থেকে শুরু হয়েছে। এবং যেটি হাজার হাজার বছর যাবৎ চলমান।

        Comment

        Working...
        X