Announcement

Collapse
No announcement yet.

মাদরাসা-মকতবের ইতিহাস ।। পর্ব-২ ।। ড. উবাইদুর রহমান আল-মুরাবিত হাফিযাহুল্লাহ

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • মাদরাসা-মকতবের ইতিহাস ।। পর্ব-২ ।। ড. উবাইদুর রহমান আল-মুরাবিত হাফিযাহুল্লাহ


    মাদরাসা-মকতবের ইতিহাস


    ড. উবাইদুর রহমান আল-মুরাবিত হাফিযাহুল্লাহ

    পর্ব-২

    (পূর্বে প্রকাশিত শিক্ষা সম্পর্কিত প্রবন্ধের সাথে সম্পৃক্ত)
    দ্বিতীয় অধ্যায়: পারিবারিক শিক্ষা ও পিতা-মাতার কর্তব্য


    কুরআনে বর্ণিত শিক্ষার আলোচনা শেষে আমরা আলোচনা করব ইসলামের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে, অর্থাৎ পারিবারিক শিক্ষা ও পিতা-মাতার কর্তব্য সম্পর্কে৷ মাওলানা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ মিয়া রহ. তাঁর কিতাব 'তরিকায়ে তালীম' এ বলেন
    "ইসলামী শরীয়তে ছেলে-মেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া ও তরবিয়াহ শিক্ষা দেওয়া স্বয়ং পিতা-মাতার কর্তব্য৷ তাদের নিজেদের ওপর যেমন নামাজ পড়া, রোজা রাখা এবং নিজেদের চরিত্র পরিশুদ্ধ করা ফরজ, তেমনই নিজ বাচ্চাদের নামাজ শিক্ষা দেওয়া এবং নামাজ রোজায় অভ্যস্ত করে তোলা ফরজ, তাদের আকীদা-বিশ্বাস ঠিক করা, তাদের আখলাক পরিশুদ্ধ করা ফরজ৷"
    এর স্বপক্ষে তিনি কুরআন ও হাদিসের নিন্মোক্ত প্রমাণাদী বর্ণনা করেন-
    আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেন:
    يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَّا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ﴿٦﴾
    "হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদের ও পরিবার পরিজনদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর৷ এতে নিয়োজিত আছে কঠোরস্বভাব ও কঠিন হৃদয়ের ফেরেশতাগণ, যারা আল্লাহর হুকুমের অবাধ্যতা করে না, তাদের যা আদেশ করা হয়, তারা তাই সম্পাদন করে৷" (সূরা আত-তাহরীম: ০৬)
    তিনি আরো ইরশাদ করেন:
    وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا ۖ لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا ۖ نَّحْنُ نَرْزُقُكَ ۗ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَىٰ﴿١٣٢﴾
    "নিজ পরিবার-পরিজনকে নামাযের আদেশ দাও, তার ওপর অটল থাকো৷ তোমার কাছে আমি রিজিক চাচ্ছি না বরং আমিই তোমাকে রিযিক প্রদান করে থাকি৷ আর শেষ পরিণাম তো মুত্তাকিদের জন্যই৷"
    এ ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন:
    )أَلَا كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، فَالْأَمِيرُ الَّذِي عَلَى النَّاسِ رَاعٍ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ عَلَى أَهْلِ بَيْتِهِ، وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُمْ، وَالْمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ عَلَى بَيْتِ بَعْلِهَا وَوَلَدِهِ، وَهِيَ مَسْئُولَةٌ عَنْهُمْ، وَالْعَبْدُ رَاعٍ عَلَى مَالِ سَيِّدِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْهُ، أَلَا فَكُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ).
    জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে৷ অতএব ইমাম যিনি জনগনের দায়িত্বশীলতিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন৷ পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীলসে তার অধিনস্তদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে৷ নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীলসে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে৷ কোন ব্যক্তির দাস স্বীয় মনিবের সম্পদের দায়িত্বশীলসে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে৷ অতএব জেনে রাখ! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে৷ (বুখারী)
    তিনি আরো ইরশাদ করেন:
    مُرُوا أولادَكم بالصلاةِ وهم أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، واضْرِبُوهُمْ عليها، وهم أَبْنَاءُ عَشْرٍ، وفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ في المَضَاجِعِ.
    "তোমরা তোমাদের সন্তান-সন্ততিদের নামাজের আদেশ দাও; যখন তারা সাত বছরে উপনীত হয়, তাদেরকে (নামাজ না পড়ার কারণে) শাস্তি প্রদান করো; যখন তারা দশ বছর বয়সে উপনীত হয়; এবং তাদের বিছানা আলাদা করে দাও৷” (সুনানে আবু দাউদ)
    তিনি আরো ইরশাদ করেন:
    " مَا نَحَلَ وَالِدٌ وَلَدَهُ أَفْضَلَ مِنْ أَدَبٍ حَسَنٍ "
    "কোন পিতা তার সন্তানকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়ার চেয়ে বেশি উত্তম কোন জিনিস (পুরস্কার) দিতে পারে না৷" (তিরমিযী)
    অতঃপর মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া রহ. বলেন, কুরআন-হাদিস দ্বারা আমাদের উপর যা ফরয করা হয়েছে, তার সর্বোত্তম পন্থা হলো, নিজেরাই নিজেদের বাচ্চাদেরকে পড়ানো৷ ইসলামের আহকাম ও শিষ্টাচারের উপর নিজেরাও অভ্যস্ত হওয়া এবং বাচ্চাদেরকেও অভ্যস্ত করে তোলা৷ যদি আমরা সকাল-সন্ধ্যা বিশ্রামের সময়ে শুধু এক ঘণ্টা বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য নির্দিষ্ট করে নিই, পাশাপাশি পাড়া-পড়শীর সন্তানদেরকেও শিক্ষা-দীক্ষার হালাকায় অন্তর্ভুক্ত করে নিই, তাহলে প্রত্যেক শিক্ষিত পরিবার দ্বীনি শিক্ষা-দীক্ষার এক একটি মক্তবে পরিণত হবে। অর্থ ছাড়া সেসব কাজ সম্পাদন হয়ে যাবে, যা অর্জনের জন্য কোটি কোটি টাকার প্রয়োজন।" কার্যতালিকা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "নিজ দায়িত্বের শিক্ষা-দীক্ষার পারিবারিক মক্তব নিজের জ্ঞানীগুণী স্ত্রী-সন্তানদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত রাখবে।"
    ড. আব্বাস মাহজূব; যিনি জামিয়া ইসলামিয়া মদীনাহ ইউনিভার্সিটির দাওয়াহ বিভাগের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, তিনি তার প্রবন্ধে (তরবিয়াহ: ইসলামের আগে ও ইসলামে) হযরত ওমর রাযি. এর একটি প্রসিদ্ধ বাণী বর্ণনা করেন, " নিজ সন্তারদেরকে সাতার ও ঘোড়দৌড় শেখাও। তাদেরকে নাসীহাহমূলক প্রবাদবাক্য সর্বোত্তম কবিতা মুখস্থ করাও। তারপর তিনি বলেন, " হযরত ওমর রাযি. এর উক্ত বাণী থেকে বুঝা যায়, ইলামের সূচনালগ্নে শিক্ষা-দীক্ষার নির্ধারিত কোনো নিয়ম-নীতি ছিল না। বরং মা-বাবারা নিজেই নিজ সন্তানদের লেখাপড়া শেখাত। " অন্য এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেন, ইসলামের সূচনালগ্নে মক্তব তেমন বেশি ছিল না। কারণ, তখন লেখাপড়ার দায়িত্ব মা-বাবা ও নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষকের উপর ছিল। এ জন্য হযরত ওমর রাযি. এর নাসীহায় "নিজ সন্তারদের" শব্দ এসেছে।"
    ইসলামি সমাজে পারিবারিক শিক্ষার আরেকটি দৃশ্য তরবিয়াহদানকারী শিক্ষকের (মুআদ্দিবের) আকৃতিতে দেখতে পাই। এই বিশেষ শব্দটি ঐ সমস্ত শিক্ষকের জন্য ব্যবহৃত হতো, যাদেরকে খুলাফায়ে ইসলাম, আমীর-উমারা ও ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের সন্তানদের পড়ানোর জন্য বিশেষভাবে নিজেদের ঘরে নিয়োগ দিতেন। আবার সময় সময় বাচ্চাকে তাদের হাতেও তুলে দেওয়া হতো। যেমনটি শাইখ মুহাম্মদ শিরবীনি ( যিনি জামিয়া ইসলামিয়া মদীনাহর সুদক্ষ শিক্ষক) তিনি তার প্রবন্ধে (বর্তমানে শিক্ষা ও ইসলামি তরবিয়াহ) উমবী খেলাফতকালের শিক্ষকদের সম্পর্কে লিখেছেন,
    "ইউরোপীয়রা জীবনের অন্যান্য সেক্টরের কাজের মতো শিক্ষার মতো পবিত্র কাজকেও তারা একটি পেশা (ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবে নিয়েছে। দুনিয়াবি সফলতা অর্জনকে তারা লেখাপড়ার লক্ষ্য বানিয়েছে। যে কারণে পশ্চিমা সমাজে দ্বীন তো দূরে থাক, আখলাক শিষ্টাচারের বালি কণাও বিলুপ্তির পথে। তাদেরকে আজ তাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হচ্ছে। এ নোংরা সমাজের মা-বাবা যাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ আখলাকের সুবাস বাকি আছে, তারা নিজেদের সন্তানকে অনৈতিক কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য পারিবারিক শিক্ষার নিয়মকে পুনরায় গ্রহণ করেছে। সময়ের আগে বাচ্চা বালেগ হওয়া, বরং বালেগ (পূর্ণ বয়স্ক) হওয়ার আগে যৌনকর্ম থেকে বাঁচানোর জন্য, নববালেগা মেয়েদেরকে গর্ভপাত থেকে বাঁচানোর জন্য তারা শেষমেশ এই পথটিই খোঁজে পেয়েছে।
    পশ্চিমাদের এই জাহান্নামি সভ্যতার আগুনে এখন মুসলিম সমাজও জ্বলছে। পাকিস্তানের অসংখ্য পরিবার, মা-বাবা এই পথ অবলম্বন করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন কিছু মধ্যবিত্ত ও মন্ত্রীদের পরিবার সম্পর্কে জানি, যারা শিশুদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা নিজেদের ঘরেই করেছে। যদি আমরা চারিত্রিকভাবে ধ্বংস থেকে শুধুমাত্র পথভ্রষ্টতা উদ্দেশ্য নিই, তদ্বারা অন্যান্য ধ্বংসাত্মক পচন বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। মা-বাবার অবাধ্যতা ও দ্বীন-ধর্মের বিরোধিতা তো একদম সুস্পষ্ট। কিন্তু যখন অধঃপতনের এই সম্মান-সম্ভ্রম পর্যন্ত পৌঁছে গেলো, তখন মুষ্টিময় কিছু মানুষের বোধদয় হল। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার বিপরীতে আমরা যদি ইসলামি আহকাম এবং ইসলামি খেলাফতকালের সমাজকে দেখি, তখন আমাদের পারিবারিক শিক্ষাই একমাত্র নিরাপদ পন্থা হিসেবে চোখে পড়ে। যদি কোনো মুসলিম পরিবার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে, তাহলে তাদের জন্য মুসলমানেরা ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালিয়ে গেছে। যেমনটা আমরা সামনে মক্তব-মাদরাসার ইতিহাসে উল্লেখ করবো ইনশা আল্লাহ।
    نظام الحكومة الإسلامية المسمي التراتيب الإداريةআত-তারাতীবুল ইদারিয়্যাহর লেখক শাইখ সাইয়্যিদ মুহাম্মদ আব্দুল হাই কাত্তানী লিখেছেন, শাইখ মুখতার কিনতী এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, " হযরত ওমর রাযি. এর খেলাফতপূর্ব আমলে সাহাবায়ে কেরামগণ নিজেরা নিজেদের সন্তান-সন্ততি ও ভাই-বোনদের পড়াতেন। যখন ইসলামের বিজয় বৃদ্ধি পেলো। বিভিন্ন ভূখণ্ড ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হতে লাগলো। আরব-অনারব ও গ্রাম্যরা মুসলিম হলো এবং মুসলিম শিশুদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলো, তখন হযরত ওমর রাযি. মক্তবের জন্য বিশেষ বিল্ডিং নির্মাণের আদেশ দেন। বাচ্চাদের লেখাপড়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু মানুষকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন।"

    পারিবারিক শিক্ষা ও নারী জাতি


    পারিবারিক শিক্ষার গুরুত্ব এই একটি দিক বিবেচনায়ও ফুটে উঠে যে, ইসলামে নারী জাতির শিক্ষার জন্য ঘরই বুনিয়াদী শিক্ষাকেন্দ্র। পবিত্র কুরআনে উম্মাহাতুল মুমিনীনদের সম্বোধনের মাধ্যমে সমস্ত নারীকুলকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
    وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ وَلَا تَبَرَّجْنَ تَبَرُّجَ الْجَاهِلِيَّةِ الْأُولَىٰ ۖ وَأَقِمْنَ الصَّلَاةَ وَآتِينَ الزَّكَاةَ وَأَطِعْنَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ ۚ إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ﴿٣٣﴾‏ وَاذْكُرْنَ مَا يُتْلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ مِنْ آيَاتِ اللَّهِ وَالْحِكْمَةِ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ﴿٣٤﴾
    “তোমরা গৃহাভ্যন্তরে অবস্থান করবেমূর্খতা যুগের অনুরূপ নিজেদেরকে প্রদর্শন করবে না। নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে। হে নবী পরিবারের সদস্যবর্গ। আল্লাহ কেবল চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে। আল্লাহর আয়াত ও জ্ঞানগর্ভ কথা, যা তোমাদের গৃহে পঠিত হয় তোমরা সেগুলো স্মরণ করবে। নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্নদর্শী, সর্ববিষয়ে খবর রাখেন।” (সূরা আহযাব: ৩৩-৩৪)
    আল্লামা আলূসী রহ. রুহুল মাআনিতে উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন,
    "আল্লাহ তাআলা উম্মাহাতুল মুমিনিনকে ঘরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্ত নারী সমাজ এই আদেশের অন্তর্ভুক্ত।" অতপর তিরমিজির একটি হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, মেয়েরা ঘরে থাকায় সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। কারণ যখনই তারা বাইরে বের হয়, তখন শয়তান তাদেরকে ভ্রষ্ট করার জন্যে সুযোগ সন্ধান করে। মেয়েরা ঘরে থাকা অবস্থায়ই নিজ রবের রহমতের খুব নিকটবর্তী থাকে।" তারপর আল্লামা আলূসী রহ. বলেন, "হতে পারে, মেয়েদের জন্য ঘরের বাইরে বের হওয়াটা হারাম। কবীরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত।" এবং শরীয়ত কিছু শর্তের ভিত্তিতে তাদেরকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রদান করেযা ফিকহের কিতাবাদীতে বর্ণিত রয়েছে। (তোমাদের বাড়িতে কুরআন থেকে যা তিলাওয়াত করা হয়) আয়াতে কর্তাকে উল্লেখ না করার ফায়েদা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, যাতে জিবরাইল আলাইহিস সালাম, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উম্মাহাতুল মুমিনীনসহ অন্যান্যদের তিলাওয়াত তালিম তাআল্লুমের আওতাভুক্ত হয়ে যায় (এজন্য উক্ত আয়াতে কর্তাকে উল্লেখ করা হয়নি।)
    নিজেদের বউ-বাচ্চাদেরকে বাড়িতে শিক্ষা দেওয়ার গুরুত্ব আমরা আবু দাউদের এই রেওয়ায়েতে দেখতে পাই। হযরত শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ রাযি. বলেন, আমি হাফসা রাযি. এর ঘরে ছিলাম, এমতবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে আসেন এবং আমাকে সম্বোধন করে বলেন, "তুমি কি তাকে(হযরত হাফসা রাযি. কে) 'নমলার' ঝাড়ফুঁক শিখাওনি, যেভাবে তাকে লেখা শিখিয়েছো।" হাদিস ব্যাখ্যাকারগণ স্ত্রীদেরকে লেখাপড়া শেখানোর উপর উক্ত হাদিসকে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তারিখে দিমাশকে ইবনে আসাকির রহ. বর্ণনা করেন, আব্দে রব্বিহ ইবনে সুলাইমান রহ. বলেন,“ হযরত উম্মে দারদা রাযি. আমাকে পড়াতেন। একদা তিনি আমার স্লেটে লিখেছিলেন, ‘ছোটবেলায় জ্ঞান অর্জন করো, বড় হয়ে যাতে তার উপর আমল করতে পারো। কারণ, ফসল কর্তনকারী শুধুমাত্র ঐ ফসলই কাটতে পারবে, যা সে রোপন করেছে। ভালো হোক বা মন্দ।'
    ডাক্তার মুহাম্মদ মুনীর সাদুদ্দীন তাঁর প্রবন্ধে (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে মসজিদ মাদ্রাসার গুরুত্ব) বর্ণনা করেন, কাজী ঈসা ইবনে মিসকিন সম্পর্কে কাজী ইয়ায রহ. বলেন, তিনি বিচার থেকে অবসর হয়ে কুরআন তিলাওয়াতে লেগে যেতেন। ছাত্রদেরকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে আসর পর্যন্ত বসে থাকতেন। আসরের পর নিজ মেয়েদের ও ভাতিজীদেরকে কুরআন ও অন্যান্য জ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ডাকতেন।


    তৃতীয় অধ্যায়: মক্তব

    ভূমিকাঃ শিক্ষার প্রথম সিড়ি


    কুরআন হাদিসে যে জ্ঞান অর্জনের হুকুম করা হয়েছে, তা থেকে শুধুমাত্র শরয়ী জ্ঞানই উদ্দেশ্য। সুতরাং তা অর্জনের মাধ্যমসমূহ জেনে নেওয়া জরুরি। সীরাতুর রাসূল-পাঠের সময় যদি এই বিষয়টি লক্ষ্য করি, তাহলে অনেক কিছু পাই। যেমন, জিবরাইল আলাইহিস সালাম যেভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ওহির শিক্ষা দিয়েছেন। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই শব্দমালাকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন, এটাই হচ্ছে শেখার প্রথম মাধ্যম। অর্থাৎ, শিক্ষাদান করা আর গ্রহণ করা। তবে এই দরস-তাদরীসকে আরও মজবুত করার জন্য হিফজ করা, লেখা, পরস্পরে আলোচনা করা, ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা ইত্যাদি মাধ্যম গ্রহণ করা হয়। কুরআনের আয়াত ও রাসূলের হাদিস যার প্রকৃত সাক্ষী। এই সমস্ত মাধ্যমসমূহের ব্যাপারে আমরা নূসূস উল্লেখ করতে পারি, (যেভাবে উপরে কয়েকটি বর্ণনা করা হয়েছে) কিন্তু কথা সংক্ষিপ্ত করার লক্ষ্যে আমরা সে-সব নিয়েই বেশি আলোচনা করবো, যা আমাদের উদ্দেশ্য। যদ্দরুন আমাদের বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
    এই পাঠদান পদ্ধতি প্রথম শিক্ষক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মক্কায় দারুল আরকামে শুরু হয়। মদীনার মসজিদে নববীর বারান্দা সুফ্ফা পর্যন্ত তা অব্যহত ছিলো। যেহেতু ছাত্ররা মসজিদে নিজ নিজ শিক্ষকের চারপাশে গোলাকার হালাকা হয়ে বসতেন, তাই এই আমল (ইলমি হালাকা নামে প্রসিদ্ধ, যা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বরকতে আজ চলমান। আর এই ইলমি হালাকাসমূহ চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দিতে মাদ্রাসায় রূপ ধারণ করে। যার বিস্তারিত বিবরণ সামনে আসবে ইনশা আল্লাহ।
    আকরম বিন যিয়া ওমরি রহ. তাঁর কিতাব ‘আসরুল খিলাফাতির রাশিদা’য় বলেন, মক্কায় যখন মুসলমান কম ছিলো, আরকাম রাযি. এর ঘর তাদের জমায়েত হওয়ার স্থান ছিলো। তারা মক্কার কাফেরদের ভয়ে তাতে খুব সতর্কতার সাথে আসতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে সেখানে সাক্ষাৎ করতেন। তাঁর কাছ থেকে দ্বীনি শিক্ষা ও কুরআনে কারীম শিখতেন।
    লেখাপড়ার ক্ষেত্রে জাহিলি যুগে অন্যান্যদের মতো আরবরাও হস্তলিপি শিখতেন এবং লিপিকর বানাতেন। যেখানে হস্তলিপি শেখানো হয়, তাকে কুত্তাব বলা হয়। আর উর্দু ভাষায় তাকে মকতব বলা হয়। ইহুদি-খ্রিস্টানদের বর্ণনা অনুসারে দেখা যায়, তাদের মধ্যেও এ রকম মকতবসমূহ ছিলো। ইতিহাস সাক্ষী, লেখা আরব-অনারব সবার কাছে প্রসিদ্ধ একটি শিক্ষা পদ্ধতি ছিলো। ইতিহাসবিদরা জাহেলি যুগের এমন কতক মানুষের নাম উল্লেখ করেন, যারা আরবের মকতবসমূহে শিক্ষক ছিলেন। যেমন, বিশর ইবনে আব্দুল মালিক সুকূনী, দাওমাতুল জান্দালের সরদার উকাইদারের ভাই, আবু কাইস ইবনে আব্দে মানাফ, আমর বিন যুরারাহ, গিলান বিন সালমা সাকফী যাদেরকে লিপিকরও বলা হয়।
    শাইখ মুহাম্মদ শিরবীনী রহ. নিজ প্রবন্ধে লিখেন,
    “মকতব শিক্ষার সিড়িসমূহ থেকে প্রথম সিড়ি। আরবের উচ্চবিত্তরা তো নিজ সন্তারদেরকে পড়াতেন, তবে সাধারণ জনগণও তা থেকে নিবৃত থাকত না। ছোটদের মকতবগুলোতে লেখাপড়া শেখানো হতো। শিক্ষক ছিলেন নির্দিষ্ট এক গোষ্ঠী। পাঠদানের জন্যও ছিলো আলাদা পদ্ধতি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদার যুগে নিয়মিত মকতব চালু ছিলো। যেখানে মুসলিম-শিশুরা লেখাপড়া করতো। অতঃপর যতই মুসলিম সৈন্যদের বিজয়াভিযান বাড়লো, ততই কুরআন-শিক্ষাকেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেলো।”
    ড. আব্বাস মাহজূবও এ ব্যাপারে বলেন,
    প্রথমিক লেখাপড়া মকতব থেকেই শুরু হতো যেমন- ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, “আমি আমার মায়ের কোলে এতিম ছিলাম। ছোটবেলায় তিনি আমাকে মকতবে দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে শিক্ষককে দেওয়ার মতো কোন মাল-সম্পদ ছিলো না। তাই শিক্ষক তাঁর কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আমাকে গ্রহণ করেছিলেন যে, তাঁর পরে আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবো। অতঃপর যখন আমি কুরআন শেষ করি, তখন মসজিদে প্রবেশ করি এবং উলামায়ে কেরামের মজলিসে শরীক হই।”
    অতঃপর তিনি বলেন,
    “এ-থেকে বুঝা যায়, মুসলিম শিশুদেরকে তৎকালীন সময়ে মসজিদের ভেতরে লেখাপড়া করার সুযোগ দেওয়া হতো না। কারণ শিশুরা মসজিদের মর্যাদা-সম্মানের খেয়াল রাখতে পারবে না। আলবত মসজিদে বড়দের লেখাপড়ার হালাকা বিদ্যমান ছিলো।”
    বুঝা যায়, মুসলিম শিশুদের লেখাপড়ার জন্য পারিবারিক শিক্ষাব্যবস্থা অথবা মকতবের ব্যবস্থা ছিলো। বড়দের মসজিদ আর ছোটদের জন্য পারিবারিক শিক্ষাকেন্দ্র বা মকতব উভয় স্থানেই কিন্তু একমাত্র কুরআন-সুন্নাহর ইলমই শিক্ষা দেওয়া হতো। আর মকতবে যদিওবা হস্তলিপির প্রতি বেশি জোর দেওয়া হতো, কিন্তু খাইরুল কুরূনে হস্তলিপির ক্ষেত্রেও কুরআনকেই সামনে রাখা হতো। অতঃপর মকতবে শুধুমাত্র হস্তলিপি শেখানোর উপর সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং বড়দের যেমন কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলো, তেমনই শিশুদেরকেও নিয়মিত পাঠদানের মাধ্যমে কুরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। যেরকম আজও কুরআন নাজেরা হিফজ করা হয়।


    পরিচ্ছেদ: ০১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খুলাফায়ে রাশেদার সোনালী যুগে মকতবের আলোচনা

    নবী যুগে মকতবের অস্তিত্ব


    একথা তো স্বতসিদ্ধ যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে মকতব বা শিক্ষাকেন্দ্র বিদ্যমান ছিলো যেমন- সহিহ বুখারীতে কিতাবুদ দিয়্যাতে একটি বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে, “উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালমা রাযি. মকতবের শিক্ষককে এই বলে খবর পাঠালেন, আমার কাছে উঁকুন পরিষ্কার করার জন্য কিছু গোলাম পাঠান, আযাদ কাউকে পাঠাবেন না
    ইমাম বুখারী রহ. তাঁর কিতাব আদাবুল মুফরাদে বাচ্চাদের সালাম দেওয়ার অধ্যায়ে একটি সহিহ রেওয়ায়ত বর্ণনা করেন, হযরত ঈসা ইবনে ইউনুস বলেন,
    তারা ইবনে ওমর রাযি. কে দেখেছেন যে, তিনি বাচ্চাদের সালাম দিচ্ছেন।”
    মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বার এক বর্ণনায় এসেছে,
    হযরত আবু হুরাইরা রাযি. যখন কোনো মকতবের পাশ দিয়ে যেতেন, তখন মকতবের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বলতেন; আপনারা ছাত্রদেরকে একটু একত্রিত করুন। যখন তাদেরকে একত্রিত করা হতো, তখন তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলতেন, হে আমার ভাতিজারা, তোমাদেরকে যা বলছি, তা তোমরা বুঝ! তোমাদের মধ্যে যারাই ঈসা ইবনে মারয়ামকে পাবে, যিনি উজ্জ্বল লাল বর্ণের চেহারার অধিকারী হবেন, তাকে আমার পক্ষ থেকে সালাম বলবে।”

    হস্তলিপি শিখতে রাসূলের গুরুত্ব ও সাহাবাদের মকতবে পড়াশোনা


    শুধু এতটুকু নয়, বরং হস্তলিপি শেখার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। যেমন- ইমাম মুকরীজী রহ. তার কিতাব আমতাউল আসমা‘ এর মধ্যে "বদরের বন্দীদের সাথে রাসূলের আচরণের" অধ্যায়ে বর্ণনা করেন,
    কুরাইশের বন্দীদের মধ্যে কতক বন্দী এমনও ছিলো, হস্তলিপিতে যাদের দক্ষতা ছিলো। যখন আনসারদের মধ্যে তেমন কোনো দক্ষ লিপিকর ছিলো না। তাদের কিছু বন্দী এমন ছিলেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য যাদের সামর্থ্য ছিলো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে এই শর্তে মুক্তি দিলেন, প্রত্যেকে দশজন দশজন ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবে। তখন হযরত যায়দ বিন সাবিত রাযি. আনসার শিশুদের একটি দলের সাথে মিলে হস্তলিপি শিখেছেন।”
    অতঃপর ইমাম আহমদ রহ. ইবনে আব্বাস রাযি. এর একটি রেওয়ায়ত বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,
    বদর যুদ্ধের বন্দীদের মধ্যে এমন কতক বন্দী ছিলো, যাদের মুক্তিপণের জন্য কোনো কিছু ছিলো না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর এই ফিদিয়া ধার্য করলেন যে, তারা আনসরদের বাচ্চাদেরকে লেখা শেখাবে। হযরত ইবনে আব্বাস বলেন, একদা তন্মধ্যে একজন শিশু ক্রন্দন করতে করতে নিজ পিতার কাছে আসল। পিতা ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে শিশুটি বলল, আমার শিক্ষক আমাকে প্রহার করেছে। পিতা বলল, দুষ্কর্মা লোক, সে কি বদরের প্রতিশোধ তোমার থেকে নিচ্ছে। আল্লাহর শপথ, তুমি তার কাছে আর কখনো যেও না।”
    এরকম আমের শাবী রহ. বলেন,
    বদর-বন্দীদের মুক্তিপণ হিসেবে চল্লিশ ওকিয়া ধার্য করা হয়। যার যার কাছে এই পরিমাণ অর্থ থাকতো না, প্রত্যেকে দশজন দশজন মুসলিমকে লেখাপড়া শেখাতেন। আর হযরত যায়দ বিন সাবিত রাযি. তাদের মধ্য থেকে একজন, যাদেরকে বদরের বন্দীরা শিক্ষা দিয়েছেন।”
    হযরত যায়দ বিন সাবিত রাযি. এর শিক্ষার ব্যাপারে মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে মাসউদ রাযি. এর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়। তিনি বলেন,
    “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সরাসরি সত্তরটি সূরা শিখেছি। যখন যায়দ বিন সাবিত রাযি. মকতবে লেখাপড়া করতেন এবং তাঁর চুলগুলো বাধা ছিল
    খতীবে বাগদাদী তার কিতাব "জামে`" এর মধ্যে এ হাদিসটি এই শব্দে বর্ণিত হয়েছে, "যখন যায়দ মক্তবে যেতো।" মুসনাদে আহমদের মুহাক্কিক শাইখ শুয়াইব বিন আরনাউত রহ. উক্ত হাদিসকে সহিহ বলেছেন।
    এরকম হযরত আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ বিন আস রাযি. কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তিনি লেখকদেরকে হস্তলিপি শেখায়, যেহেতু তিনি জাহেলি যুগ থেকে লিপিকর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
    আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উবাদা ইবনে সামেত রাযি. বলেন,
    “আমি সুফ্ফাবাসীর কয়েকজনকে কুরআন এবং লেখাপড়া শিখিয়েছি।” শাইখ আলবানী রহ. এই হাদিসটি সহিহ বলেছেন।


    খুলাফায়ে রাশেদার যুগে মকতব


    খিলাফতের যুগেও বরাবর মক্তব চালু ছিলো। আস্তে আস্তে তার কিছু নির্দিষ্ট উসূল ও শিষ্টাচারও প্রসিদ্ধ হলো। যেমন- আল্লামা ইবনে সাহনূন তাঁর কিতাব ‘আদাবুল মুআল্লিমীন’এর মধ্যে বলেন,
    “যখন হযরত আনাস বিন মালিক রাযি. (৯৩ হিজরী) এর কাছে আয়িম্মায়ে ইসলাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি., ওমর ফারুক রাযি., ওসমান রাযি. এবং আলী রাযি. এর যুগে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল, সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি বলেন, "শিক্ষকের কাছে একটি পাত্র থাকতো। ছেলেরা নিয়মিত পালাক্রমে নিজের সাথে নিয়ে আসা পবিত্র পানি তাতে রাখতো। সেই পবিত্র পানি দ্বারা ছেলেরা নিজেদের স্লেট মুছতো। ব্যবহৃত পানি ফেলার জন্য জমিনে একটি গর্ত খনন করা হতো। যাতে পানিগুলো গর্তে শুকিয়ে যায়।" এ-থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তৎকালীন সময়ে মক্তবে শিক্ষার প্রধান উৎস ছিলো কুরআন। আর কুরআন-লিপি বুঝানোর জন্যে পবিত্রতার এতটুকু খেয়াল রাখা হতো।”
    কানযুল উম্মাল ও ইবনে আসাকিরের তারীখে দিমাশকের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। হযরত ওয়াযীন ইবনে আতা রাযি. বলেন,
    "মদীনায় শিশুদের লেখাপড়ার করানোর জন্য তিনজন শিক্ষক ছিলেন। ওমর ফারুক রাযি. এর পক্ষ থেকে যাদেরকে মাসিক পনেরো দিরহাম করে ভাতা দেওয়া হতো।"
    যেমনটি পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে ‘আত-তারাতিবুল ইদারিয়্যাহ’র মুসান্নিফ শাইখ মুখতার কিনতী রহ. থেকে বর্ণনা করেন,
    "হযরত ওমর রাযি. এর খেলাফত-পূর্ব যুগে সাহাবারা নিজেরা নিজেদের ছেলে-মেয়েদের ও ভাই-বোনদের পড়াতেন। যখন ইসলামের বিজয় সুবিস্তৃত হলো, অনারব ও গ্রাম্যলোক মুসলিম হতে লাগলো, মুসলিম শিশুর সংখ্যাও বেড়ে গেলো, তখন ওমর রাযি. মক্তবের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের আদেশ দেন। শিশুদের তালিম-তারবিয়াহর জন্য নির্দিষ্ট কিছু উস্তাদ ঠিক করেন।"


    পরিচ্ছেদ: ০২. বিভিন্ন ইসলামি শাসনামলে মক্তবের হালচিত্র


    শাইখ মুহাম্মদ শির বীনি রহ. তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন,
    "উমবী খেলাফত-যুগে মক্তবে চার ধরনের শিক্ষক থাকতেন।
    ১) সাধারণ মক্তবের শিক্ষকবৃন্দ, যারা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পড়াতেন।
    ২) উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের শিক্ষকবৃন্দ, যাদেরকে মুআদ্দিব বলা হতো।
    ৩) বড় বড় মনীষী মুআদ্দিববৃন্দ। যাদের দীর্ঘ পড়াশোনা ও বিভিন্ন শাস্ত্রে বুৎপত্তির কারণে তারা বড় শ্রেণীর ছাত্রদের দরস দিতেন। তন্মধ্যে রয়েছে, ফিকহের চার ইমাম, ভাষাবিদ ইমাম সিবওয়াইহ, কাসাঈ এবং আসমাঈর মতো বড় বড় মনীষী।
    ৪) গ্রাম্য উলামায়ে কেরাম; যারা বিশুদ্ধভাষী এবং আরব-গোত্রের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন। এঁরা মুআল্লিম, মুআদ্দিব ও বড় বড় মনীষীদের সাথে মেলামেশা করতেন। পরবর্তী যুগে এই মক্তবসমূহের আকৃতি আরও বৃদ্ধি পায়। "
    শিরবীনি রহ. এর শেষোক্ত দুই প্রকারের আলেমদেরকে মক্তবের শিক্ষক গণনা করাতে আমার দ্বিমত রয়েছে। তবে হ্যাঁ, তারা ইলমি হালাকার শিক্ষক হিসেবে গণ্য হবেন। কারণ মক্তবের প্রকৃত শিক্ষক হলেন প্রথম প্রকারের শিক্ষকবৃন্দ। যাদের জন্য মুআল্লিম শব্দ ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় প্রকারের আলেমরা তো ঐ সব বিশেষ মুআল্লিম, যাদেরকে খলীফা, উমারা ও মন্ত্রীদের সন্তানদেরকে পড়ানোর জন্য তাদের নিজেদের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। মোটকথা, মক্তবের পড়াশোনার এই ধারাবাহিকতা সময়ের পরিক্রমায় বিস্তৃত হয়েছে। যেহেতু এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্যে মক্তবের ইতিহাস বর্ণনাও আছে, তাই আমরা ঈষৎ বিস্তারিতভাবে তার হালচিত্র নিয়ে আলোচনা করেছি।

    মকতবের বিষয়বস্তু


    ডাক্তার আব্বাস মাহজূব লিখেছেন,
    এই প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষার প্রধান উৎস ছিলো কুরআন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস, কিছু ফিকহি আহকাম আর কিছু কবিতা।
    যেমন ইবনে খালদূন রহ. বলেন, "কুরআন যেহেতু দ্বীনের মূল ভিত্তি ও স্তম্ভ, তাই কুরআনকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হতো। শিক্ষার মূল ছিলো কুরআনকে কেন্দ্র করে যেহেতু পরবর্তীতে অর্জিত অন্যান্য জ্ঞানের ভিত্তি ছিল কুরআন।"
    তিনি আরেক জায়গায় বলেন, "মক্তবের মধ্যে শুধুমাত্র লেখাপড়া শেখানো হতো।"
    আরেক জায়গায় ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বাণী বর্ণনা করেন,
    "আমি আমার মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় এতিম ছিলাম। তিনি আমাকে মক্তবে দিয়েছিলেন। যখন আমি কুরআন শেষ করি, তখন মসজিদে যাওয়া শুরু করি এবং বড় বড় উলামায়ে কেরামের সান্নিধ্য গ্রহণ করি, তাদের মজলিসে হাজির হই।"
    ডাক্তার মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন,
    "অধিকাংশ গবেষণাকারী উলামায়ে কেরামের মতামত হলো, ইসলামে সূচনালগ্নে এক ধরণেরই মক্তব(প্রতিষ্ঠান) ছিলো, যেখানে লেখাপড়া শেখানো হতো। কুরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। উলূমে দ্বীন শিক্ষা দেওয়া হতো। অতঃপর বলেন, "যদিও অন্যান্য মক্তবও ছিলো, তবুও যা প্রসিদ্ধ ও বিস্তৃত হয়েছে, তা একমাত্র কুরআন ও দ্বীন শিক্ষার মক্তবই ছিলো। কারণ মুসলিমদের কুরআনের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিলো। তারপর বলেন, " যখন কোনো শিশু কুরআন হিফজ, তার লিখন ও পঠন পদ্ধতি শেখা শেষ করতো, তখন শিক্ষক তাকে দ্বীনের মৌলিক আহকাম এবং ভাষা শিক্ষা দিতো। তাদেরকে কুরআন, হাদিস, আদব-আখলাক, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা, ব্যাকরণ, সাহিত্য ও কবিতা ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করানো হতো।"
    শাইখ মুহাম্মদ শির বীনি রহ. তাঁর প্রবন্ধে লিখেন, এই সমস্ত শিক্ষাকেন্দ্রে তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষা পরিকল্পনা ছিলো।
    ১) অধিকাংশ ইসলামিক রাষ্ট্রে কুরআনে কারীম হিফজ করার নিয়ম ছিলো। যেখানে প্রথমে কুরআনের নাজেরা (দেখে দেখে পড়া) পড়ানো হতো, তারপর হিফজ করানো হতো। পরিপূর্ণ হিফজ করুক বা না করুকএটাই ছিলো হিফজ করার পদ্ধতি। মুআল্লিম কিছু কিছু আয়াতের সংক্ষিপ্তাকারে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও ইরাব বর্ণণা করে দিতেন এবং আয়াতগুলোর তারতীল ও তাজবীদ শিক্ষা দিতেন। এরপরে বাচ্চাদেরকে সেসব ইলম শিক্ষা দেওয়া হতো, যা কুরআন বুঝতে সহায়ক। তারপরে তাহাজ্জী, বানানচর্চা, সুন্দর হস্তলিপি ও উচ্চারণরীতি শিক্ষা দিতেন। এমনিভাবে অযু, নামাজের নিয়ম পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। তাদের পাঠদানের প্রধান লক্ষ্য ছিলো কুরআনকে ঘিরে। তা নিয়েই তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা ও সিস্টেমে শিশুদের শিক্ষা দিতেন। এই কুরআনকে ঘিরেই তারা অন্যান্য ইলম অর্জন করতো
    ২) পশ্চিম ইসলামি রাষ্ট্রগুলোতে শুধুমাত্র কুরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। পাশাপাশি আর কোনো কিছু শেখানো হতো না। হাদিস, ফিকহ, কবিতা, সাহিত্য কিছুই শেখানো হতো না। যাতে শিশু কুরআনে দক্ষ হয়ে যায়।
    ৩) স্পেনের মুসলিমরা শিশুদেরকে প্রথমে আরবি ভাষা, কবিতা, সাহিত্য শেখাতেন। ছাত্ররা এ বিষয়াবলীতে দক্ষ হলে তারপর কুরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। তাদের কথা ছিলো, এভাবে পড়লে ছাত্রদের কুরআন ভালোভাবে বুঝে আসবে। কিন্তু এই পরিকল্পনাটি সঠিক নয়। কারণ আমরা জানি, ছোট বেলায় কুরআন শিখা ও হিফজ করা সহজ। যা সমস্ত ইলমের মূল।
    সাধারণত সবার মতামত এমনই, যেভাবে অধিকাংশ ইসলামিক রাষ্ট্রে পাঠদান করা হতো। অর্থাৎ কুরআনে কারিমের তিলাওয়াত, তাজবিদ ও হিফজের সাথে সাথে আরবি ভাষা, সাহিত্য, সরফ ও নাহবেরও পাঠদান করা হতো। অন্যান্য শাস্ত্র থেকেও কিছু কিছু পড়ানো হতো, যা ছাত্রদের জীবন চলার পথে পাথেয় হবে। উজ্জীবিত করার জন্য সহায়ক হবে।”
    ড. লায়লা বেওমী তাঁর প্রবন্ধে (ইসলামি ব্যক্তিত্বের হিফাজতে মক্তবের অবদান) লিখেন,
    মক্তব (যেখানে তাহফিযুল কুরআনের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হতো) মুসলিম জাতির মননে কুরআনি ও ইসলামি ব্যক্তিত্ব গঠনে যুগ যুগ ধরে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। অবশ্য কতিপয় ঈর্ষান্বিত ব্যক্তি বিভিন্ন অভিসন্ধির মাধ্যমে এই মক্তবগুলোর অসামান্য কৃতিত্ব-অবদানসমূহকে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা চালিয়েছে। ফলশ্রুতিতে সেই তেজোদ্দীপ্ত মক্তব এখন নিভু নিভু অবস্থায় বরং নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কুরআন মজিদ ও সহিহ-শুদ্ধ আরবি ভাষার পরিবর্তে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের মননে গান-বাজনা ও বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনি মুখস্থ হয়ে আছে।
    যেমন- আজকে শিশু-শ্রেণীসমূহতে নিয়মিত (ইংলিশ মিডিয়ামে) অনর্থক গান-বাজনা (যার অর্থ তারা বুঝে না) মুখস্থ করানো হয়। পক্ষান্তরে কুরআনের মতো এতো উঁচু মকামের বাণী, আল্লাহ তাআলার বাণী মুখস্থ করাকে তারা অনর্থক ও ভুল মনে করে।


    আদাবুল মুআশারাত শিক্ষা


    ড. মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন,
    ছাত্রদেরকে পড়ালেখা করানোর পাশাপাশি শিক্ষক-মুআল্লিমের জন্য তাদেরকে শিষ্টাচার ও আদব শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। ছাত্রদেরকে সৎ কাজের তরবিয়াহ দেওয়া, সৎ কাজের উপর অভ্যস্ত করে তুলা। মানুষকে কিভাবে সম্মান করবে, সামাজিক পরিবেশে কার সাথে কি রকম আচরণ করতে হবে, মানুষের মাঝে কিভাবে আচার-আচরণে পার্থক্য করবে, তা শিক্ষা দেওয়া। কারও পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সালাম করা। মা-বাবার সাথে সৎব্যবহার করা। তাদের আদেশ মান্য করা, তাদেরকে সালাম করা। মা-বাবা তাদের কাছে আসলে তাদের হাতে চুমু খাওয়া অভদ্রতা, অসভ্যতা, গালি-গালাজ ও শরীয়াহ বিরোধী সমস্ত কার্যকলাপের কারণে ছাত্রদের শাস্তি দেওয়া।
    তিনি আরও বলেন,
    মক্তব-শিশুদের সাথে মুআশারাতের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেমনটি ইবনে সাহনূন রহ. বলেন, “যদি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইমাম সালাতুল ইস্তিসকা আদায়ের উদ্দেশে বের হয়, তখন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদেরও সাথে নিবে, যারা সালাত পড়তে জানে। যেন তারাও দু‘আ করে এবং তাঁর দিকে মনোনিবেশ করে। কেননা আমার কাছে এই রিওয়ায়াত পৌঁছেছে, ইউনুস আলাইহিস সালাম এর জাতি যখন আজাবকে প্রত্যক্ষ করল, তখন তারা সন্তান-সন্ততি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আল্লাহর কাছে তাদের মাধ্যমে দু‘আ করে।
    মক্তবের সুস্থ ও মনোরম পরিবেশ সম্পর্কে মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন,
    “যদি ছাত্ররা অসুস্থতার কথা বলে, (যেমন, পেট ব্যথা, মাথা ব্যাথা, জ্বর ইত্যাদি) আর শিক্ষক যাচাই-বাছাই করার পর দেখেছে ছাত্রটি সত্য বলেছে, তখন তাকে বসিয়ে না রেখে ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো। শিক্ষকরা মক্তবের সামনে হকার দেখলে তাদের কাছ থেকে জিনিস পত্র নিজেরাই কিনতেন, কারণ বাচ্চারা কিনতে গেলে তাদের চারিত্রিক সমস্যার আশংকা আছে।
    আরেক জায়গায় লিখেছেন,
    মক্তবে প্রতি মাসে আতর-সুগন্ধি নিয়ে আসা হতো।

    শিক্ষক হওয়ার জন্য শর্তাবলী ও মকতবের জিম্মাদারি


    শাইখ মুহাম্মদ শির বীনি রহ. লিখেন,
    ইসলামিক মক্তবের শিক্ষকদের জন্য নির্দিষ্ট কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন, পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত হওয়া। শিশুদেরকে তরবিয়াহ দেওয়ার নিয়ম-পদ্ধতি জানা থাকা। তাদের মন- মেজাজ বুঝতে পারা। দ্বীনদার পরহেজগার হওয়া। বিবাহিত হওয়া। যুবকদেরকে শিশুদের শিক্ষকতা করতে দেওয়া হতো না।
    ড. মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন, “মক্তবের শিক্ষকের জন্য কিছু গুণাবলী আবশ্যক ছিলো। শিক্ষক হিসেবে শুধুমাত্র তাকেই নির্বাচন করা হতো, যার চরিত্র সম্পর্কে পূর্ণ নিশ্চিয়তা অর্জন হয়। প্রজ্ঞাময়, নিজ কর্মে দক্ষ, চারিত্রিকভাবে পবিত্র ও বিশ্বাসযোগ্য হবে। সাথে সাথে কুরআনে কারিম এবং অন্যান্য ইলমের উপর বুৎপত্তি থাকবে
    ইমাম ক্বাবিছি রহ. বলেন, শিক্ষককে অবশ্যই ভীতিজনক (যাকে দেখলে ছাত্ররা ভয় পায়) হতে হবে, কিন্তু কঠোর না। এরকম বদমেজাজি হওয়া যাবে না, যে সব সময় চোখ লাল থাকে। হাসি-ঠাট্টায় অভ্যস্তও হওয়া যাবে না। ছাত্রদের সাথে কোমল আচরণ করবে, (তবে আদর করে মাথায় তোলে নিবে না, অপরাধের ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দিবে না।) শিক্ষক ছাত্রদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিবে।
    তিনি আরো লিখেছেন, মক্তব দেখভালের জিম্মাদারী তত্ত্বাবধায়ক এর উপর থাকত। শিক্ষক যাকে রাখা হয়েছে, সে নিম্নোক্ত গুণে গুণান্বিত কি না? তা যাচাই-বাছাই করাও তত্ত্বাবধায়কেরই জিম্মাদারী ছিল শিক্ষক নেককার-সৎ, চারিত্রিকভাবে পবিত্র, আমানতদার, কুরআনে হাফেজ, সুন্দর হস্তলিপির অধিকারী এবং যিনি শরীরচর্চা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখে। বিবাহিত হলে উত্তম, অন্যথায় কমচেকম দ্বীনদার বুজুর্গ হতে হবে। উক্ত বিশেষণে বিশেষিত না হলে মক্তব চালু করার অনুমতি দেওয়া যাবে না। শিক্ষকের দ্বীনদারি ও সুখ্যাতি প্রসিদ্ধ হতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষক এ কাজের জন্য উপযুক্ত ও যোগ্য কি না এবং তার কাজকর্মের উপর মনপুত সাক্ষী পাওয়া না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না।”

    মকতবের সংখ্যা, আয়তন, স্থান এবং আসবাবপত্র


    ড. আব্বাস মাহজূব বলেন,
    ইসলামের সূচনালগ্নে মক্তব তেমন স্বাভাবিক সাধারণ ছিল না। কারণ, মা-বাবা ও নির্দিষ্ট কিছু উস্তাদের উপর শিক্ষার মূল জিম্মাদারী ছিল।”
    পরবর্তী সময় সম্পর্কে ড. মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন বলেন,
    মক্তব সংখ্যা, আয়তনের দিক থেকে বড় ছোট থাকত। আবু কাসেম বলখী রহ. এর মক্তবে তিন হাজারের মতো ছাত্র পড়াশোনা করত। ইয়াকূতের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই মক্তব মসজিদ থেকে আলাদা ছিল, আয়তনের দিক থেকে অনেক প্রশস্ত ছিল, যেখানে তিন হাজার ছাত্রের জায়গার সংকুলান হতো। এ জন্যে উস্তাদ বলখী রহ. ছাত্রদের বিভিন্ন গ্রুপে গাঁধার উপর চড়ে যেতেন।
    ড. আব্বাস মাহজূব লিখেন, “শিশুদেরকে মসজিদে পড়ানো তারা অপছন্দ করতেন। বরং তাদেরকে মক্তবে দিয়ে দেওয়া হতো। মক্তব মসজিদের পাশে হোক বা মসজিদের সাথে লাগানো।
    অতঃপর ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বাণী বর্ণনা করেন,
    আমি ছোট বেলায় আমার মায়ের কোলে এতিম ছিলাম। তিনি আমাকে মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। (ছোট বেলার প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য) অতঃপর যখন আমি কুরআন শেষ করি, তখন আমি মসজিদে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। এবং উলামায়ে কেরামের মজলিসে শরীক হই।উপরোক্ত বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, মুসলিম শিশুদের মসজিদে পড়ানো হতো না। কারণ শিশুরা মসজিদের আদবের যথাযথ খেয়াল রাখতে পারবে না। তবে বড়দের দরস ও তাদরীস মসজিদে অনুষ্ঠিত হতো।
    ডাক্তার মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন মক্তবের আসবাব পত্রের কথায় উল্লেখ করেন, “বেশিরভাগ মক্তবে চাটাই বিছানো থাকতো। ছাত্ররা শিক্ষকের চারপাশে গোলাকার হয়ে ঐ চাটাইগুলোর উপর বসত। পড়ালেখার জন্য কুরআনে কারিম, স্লেট, কলম ও দোয়াত থাকত। অধিকাংশ সময় শিক্ষক বসার জন্য আলাদা চেয়ার ও চৌকি থাকত।”
    মকতবে শিক্ষা গ্রহনের বয়স


    ডাক্তার মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন,
    মক্তবে শিক্ষা গ্রহনের বয়স সম্পর্কে বলা যায়, সাধারণত ছোট বেলা থেকে সন্তানদের পাঠানো হতো। অর্থাৎ, পাঁচ-সাত বছর বয়সে। এই শিক্ষাধারা অব্যাহত থাকত পূর্ণ কুরআনের হিফজ সম্পন্ন করা পর্যন্ত (বর্তমান যুগের হিফজখানা) অথবা কুরআনের কিছু অংশ মুখস্থ করার পাশাপাশি কিছু লেখা-পড়া, নাহব-সরফ, শরীরচর্চা ও অন্যান্য শাস্ত্রের পাঠদান করা হতো। অর্থাৎ কুরআনের ঐ সমস্ত ইলমও শিক্ষা দেওয়া হতো, দ্বীন বুঝার জন্য মানুষ যা প্রয়োজন মনে করতেন।
    যেহেতু ছোট বেলায় সন্তানরা মক্তবে যেতো, তাই তাদেরকে নিরাপদে আনা-নেওয়া করার দায়িত্ব পরিবারের উপর ছিল। নিরাপদে সন্তানদের আনা-নেওয়ার জন্যে তারা একজন মানুষ পাঠাত, যাকে তৎকালীন সময়ে সায়েক বলা হতো। বর্তমানে ছোট সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়াকারী ড্রাইভারের মতোই। সেই ড্রাইভারের জন্য কিছু গুণাবলী আবশ্যক ছিলো, যেমন, তাকে আমানতদার ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কেননা, ছাত্ররা আসা-যাওয়ার পথে কমচে-কম দুবার ড্রাইভারের দায়িত্বে থাকে, যে সময় তারা ভয়ানক রাস্তা পাড়ি দেওয়ার সম্ভাবনাও আছে। আর এ সময় তারা ছাত্রদের পরিবারের মহিলাদের সামনা-সামনি হওয়ারও সম্ভাবনা আছে।চিন্তা করে দেখুন, কেবল শিক্ষকের জন্য নয়, বরং মক্তবের অন্যান্য কর্মচারীদের জন্য তাদের কতো সুন্দর নির্দেশিকা ছিল।
    'আত-তারাতীবুল ইদারিয়্যাহ' কিতাবে শাইখ সাইয়্যিদ আব্দুল হাই কাত্তানী ছোট বাচ্চাদের শিক্ষার বয়স এর ব্যাপারে সালাফদের অনেক রেওয়ায়াত বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি সেই রেওয়ায়াত সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের মতামতও তিনি উল্লেখ করেছেন। নিচে তা নিয়ে আলোকপাত করা হলো:
    • শাইখ আলী মুত্তাকী ইবনে হিন্দি মক্কি রহ. কে জিজ্ঞেস করা হলো যে, এখানকার অধিকাংশ জায়গার রীতি হলো- যখন শিশু চার বছর চার মাস চার দিনে উপনীত হয়, তখন তাকে কুরআনে কারিম পড়ানো শুরু করা হয় তো আপনার জানা মতে এ সম্পর্কে কোনো হাদিস বা সালাফের কোনো রেওয়ায়েত কি বর্ণিত হয়েছে? তিনি উত্তরে লিখেন, এ সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো বর্ণনা আমি পাইনি। তবে কিছু উলামা থেকে শুনেছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সিনাচাক(বক্ষ বিদারণ) এই বয়সে হয়েছিল এবং তাঁকে ইক্বরা তথা পড়ো’র আদেশ দেওয়া হয়েছিল যদিও এই রেওয়ায়েত নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে, তবে সঠিক ধরে নিয়ে হয়তো এই হাদিস থেকে মাসআলাটি উদঘাটন করা হয়েছে। ইমাম যারকাশী রহ. এ সম্পর্কে বর্ণনা করেন, “এই হাদিসটি প্রসিদ্ধ হাদিসসমূহের বিপরীত।
    • ইমাম বুখারী রহ. কিতাবুয যাকাতে একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাসান রাযি. এর মুখ থেকে সাদাকার খেজুর বের করে ফেলেছেন। এই অধ্যায়ের শিরোনামের ব্যাখ্যায় ইমাম দামামীনি রহ. বর্ণনা করেন, শিশুদেরকে কোনো কিছু থেকে বারণ করতে হলে তখন বিষয়টি এমনভাবে বলো যেনো তারা বুঝে যায় কেনো তাদেরকে বারণ করা হল। ছোট বেলায় এ পন্থা অবলম্বন করার উদ্দেশ্য হলো, যখন তারা বালেগ-পূর্ণবয়স্ক হবে, তখন যেনো তারা শরীয়তের হুকুম সম্পর্কে পূর্ব থেকে জ্ঞাত হয়।"
    • অতঃপর ইমাম দামামীনি রহ. ইমাম মালেক রহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেন, "ইমাম মালেক রহ. এর কাছে একদম ছোট বয়সে কুরআন শিক্ষা দেওয়া অপছন্দনীয় ছিলো। বর্ণিত আছে, একদা তাঁকে এমন এক শিশু সম্পর্কে অবগত করানো হলো, যে সাত বছর বয়সে হাফেজে কুরআন হয়েছে, তখন তিনি তা অপছন্দ করেছেন।” কিন্তু ইমাম দামামীনি রহ. এই কথার ব্যাখ্যা এভাবে বর্ণনা করেন, "আমার মতামত হলো আল্লাহ ভালো জানেনইমাম মালেক রহ. এজন্য তা অপছন্দ করেছেন যে, বাচ্চাটি তিলাওয়াতে ভুল করবে অথবা হরফগুলোকে তার সঠিক মাখরাজ থেকে উচ্চারণ করতে পারবে না। তাছাড়া বাচ্চাদেরকে ছোট বেলা থেকে পড়ানোর উদ্দেশ্যে হলো, তাদেরকে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখা, অথচ তার শারীরিক গঠন বাড়ার জন্য হৃষ্টপুষ্ট হওয়ার জন্য খেলাধুলা জরুরি। আর এর মাধ্যমে বাচ্চার প্রফুল্লতা অর্জন হয়। ইমাম বুখারীর এই অধ্যায় আনার উদ্দেশ্য হলো, বাচ্চাকে তরবিয়াহ দেওয়ার ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বন জরুরি। "
    • 'কাশফুল গিম্মাহ' কিতাবে ইমাম শারানী রহ. লিখেন, " রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুমায়্যিজ (পার্থক্য শক্তি অর্জন হলে) ছেলের ইমামতির অনুমতি দিয়েছেন। বিশেষকরে যখন সে সর্বাধিক কুরআন জানবে।" হযরত আমর বিন আবি সালামা রাযি. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যামানায় নিজ গোত্রের ইমামতি করতেন, অথচ তখন তার বয়স ছিল ছয়, সাত বা আট বছর। "
    'আত-তারাতীবুল ইদারিয়্যাহর' লেখক লিখেন, "ইমাম শারানী রহ. আমর ইবনে আবি সালমার যে ঘটনা উল্লেখ করেছেন, 'ইসাবাহ' কিতাবে ইবনে হাজর আসকালানী রহ. আমর রাযি. এর জীবনচরিত বর্ণনায় এ ঘটনার দিকে ইশারাহ করেছেন এবং বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম আমর ইবনে আবি সালমা রাযি. কে বয়সে ছোট হওয়ার পরও ইমাম বানিয়েছেন। কারণ তিনি ছিলেন তার গোত্রে সর্বাধিক কুরআনের ইলমের অধিকারী। অতঃপর নিজের মতামত জানান দিতে গিয়ে বলেন, "এর দ্বারা বুঝা যায়, সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা করানো হতো। " এই রেওয়ায়াতসমূহ "কম বয়সে ইমামতি বৈধ কি না" এই ফিকহি মাসআলার জন্য উল্লেখ করেননি, বরং তিনি এটি জানান দিতে উল্লেখ করেন যে, সাহাবায়ে কেরামকে ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনা করানো হতো।
    • ইমাম মাজ্জাজী রহ. মুখতাসার ইবনে আবি জুমরার ব্যাখ্যায় ইবনুল হাজএর কিতাব আল মাদখাল থেকে বর্ণনা করেন, সালাফে সালেহীন নিজেদের শিশুদেরকে সাত বছর বয়স থেকে কুরআন পড়ানো শুরু করতেন। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের সন্তারদেরকে খুব ছোট অবস্থায় কুরআন শেখানো শুরু করত, তবে এটা ফায়েদাহীন বুঝা। ইমাম ক্বাসতাল্লানী রহ. তালিমুস সিবয়ান আল-কুরআন( ছোটদের কুরআন শিক্ষা দেওয়া) অধ্যায়ে উল্লেখ করেন, "হযরত সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রহ. মাত্র চার বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হয়েছেন। " 'ফাওয়াতিহুর রহমূত ফি মুসাল্লামুস সুবূত কিতাবে' এসেছে," ইমাম শাফেয়ী রহ. মুআত্তা মালেক মাত্র পাঁচ বছর বয়সে হিফজ সম্পন্ন করেছেন। " 'আত-তারাতীব' কিতাবের লেখক নিজের মুতালাআর হাওলায় লিখেন, "আমার মুতালাআর সময় অনেক ঘটনা আমাকে বেশ আশ্চর্যান্বিত করেছে। তন্মধ্যে একটি ঐ ঘটনা যা السلم কিতাবের ব্যাখ্যাগ্রন্থ صبان এর টীকায় পড়েছি। তা হলো- ইবনে মারযাক রহ. খূনজীর কবিতা মাত্র ছয় বছর বয়সে সাজিয়েছেন। যেমনটা তিনি নিজেই এ কথা ব্যক্ত করেছেন। অনেকে আবার এ কথা ইবনে হাজেব রহ. সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। আর যে সাহারায়ে শানক্বিত ” (যা বর্তমানে আফ্রিকা মহাদেশের মুরতানিয়ায় অবস্থিত, যেখানকার উলামায়ে কেরাম স্মরণশক্তির দিক থেকে পুরো পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ ও খ্যাত।) এর জনগণের সাথে উঠাবসা করেছে, তার কাছে এটা কোনো আশ্চর্যের বিষয় নয়।"
    অতঃপর আত-তারাতীবুল ইদারিয়্যাহর লেখক শাইখ সাইয়্যিদ আব্দুল হাই কাত্তানী রহ. উপসংহাররূপে লিখেন," এ ব্যাপারে শেষ কথা এটা হতে পারেবয়সের মুআমালা স্মরণশক্তি ও সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে ভিন্ন হতে পারে। কাশফুল গিম্মাহর বর্ণনায় এই কথা সরাসরি উল্লেখ নেই যে, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ছোট বেলাতেই পুরো কুরআন হিফজ করেছেন। তবে হ্যাঁ, কিছু না কিছু তো অবশ্যই হিফজ করেছেন। এবং ঐ রকমও নয়, যা ইমাম মালেক রহ. অপছন্দ করেছেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
    তারপর তিনি লিখেন,
    "এই অধ্যায়ের সারকথা হলো যেমনটি ‘আতবিয়্যহ’ কিতাবে উল্লেখ রয়েছে, ইমাম মালেক রহ. এর কাছে এমন একজন শিশুর কথা আলোচনা করা হলো, যে সাত বছর বয়সে কুরআনের হাফেজ হয়েছে। তখন তিনি বলেন, "এ ব্যাপারে আমার খেয়াল হলো এমনটা না করা।" ইবনে রুশদ আল-বয়ান ওয়াত-তাহসীল কিতাবে লিখেছেন, ইমাম মালেক রহ. অপছন্দ করার প্রকৃত কারণ হলো, বাচ্চা এই বয়সে চাপ সৃষ্টি করা ব্যতিত এতটুকু কুরআন হিফজ করা অসম্ভবপ্রায়। অথচ তার বয়স অনেক কম। আমার খেয়াল মতে এমতাবস্থায় শিশুদের সাথে কোমল আচরণ করা জরুরি। যেমন হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, "আল্লাহ কোমলময়ী, তিনি প্রত্যেক কাজে কোমলতাকে পছন্দ করেন।"

    মকতবের সময়


    ড. মুহাম্মদ মুনির সাদুদ্দীন লিখেন যে, মক্তবের সময় পৃথিবীর প্রাকৃতিক নিয়মের অনুকূল ছিল। দিন বড় হোক বা ছোটসূর্য উদয়ের পর থেকে আসরের নামায পর্যন্ত মক্তবের তা‘লীম (শিক্ষা-দীক্ষা) জারি থাকতো। ইবনুল হাজ্ব আবদারী সাপ্তাহিক ছুটির সম্পর্কে বলেন, ছুটি তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই হাদিসের ভিত্তি করে মুস্তাহাব।
    রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
    روحوا القلوب ساعة بعد ساعة
    "অন্তরকে ঘণ্টা পরপর বিশ্রাম নিতে দাও।"
    সুতরাং ছোট ছেলে-মেয়েরা যদি সপ্তাহে দুদিন ছুটি পায়, তাহলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলো প্রফুল্লতায় কাটবে।
    হাদিসটি কানজুল উম্মালের মধ্যে এসেছে, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বার বর্ণনা হলো,
    روحوا القلوب تعي الذكر
    "অন্তরকে বিশ্রাম নিতে দাও, যাতে যিকির বুঝে আসে।"
    সহিহ মুসলিম ও তিরমিজিতে একটি হাদিস এসেছে, হযরত হানজালা ইবনে রবী আসদী (যিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওহীর লেখক ছিলেন) একদা হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাযি. এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। আবু বকর রাযি. তার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। হানজালা রাযি. বলেন, হানজালা তো মুনাফিক হয়ে গেছে। তার কথায় আবু বকর সিদ্দিক রাযি. আশ্চর্যান্বিত হয়ে বলেন, সুবহানাল্লাহ! এসব কী বলছেন? হযরত হানজালা রাযি. বলেন, যখন আমরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরবারে থাকি, তখন তিনি আমাদেরকে জান্নাত জাহান্নামের আলোচনা করেন। আমাদেরও এমন মনে হয় যেন আমরা স্বচক্ষে তা প্রত্যক্ষ করছি। অতঃপর যখন আমি সেখান থেকে বের হই, তখন স্ত্রী সন্তান ও ধনসম্পদ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং অনেক কিছু ভুলে যাই। তখন আবু বকর সিদ্দিক রাযি. বলেন, এ রকম তো আমারও হয়! অতঃপর তারা উভয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে হাজির হয়ে পূর্ণ ঘটনার বৃত্তান্ত পেশ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার কাছে তোমরা যে অবস্থায় থাক, সে অবস্থায় যদি তোমরা সব সময় থাক, এবং সবসময় যিকিরে লিপ্ত থাক, তাহলে ফেরেশতারা তোমাদের বিছানায়, রাস্তায় এসে তোমাদের সালাম করত। অতঃপর তিনি তিনবার এই কথা বলেন-
    ولَكِنْ يا حَنظَلَةُ ساعةً وساعةً
    কিন্তু হে হানযালা এক ঘণ্টা (আল্লাহর যিকিরে) আর এক ঘণ্টা (দুনিয়াবি কাজে ব্যয় করবে)।
    খতীবে বাগদাদী রহ. আল-জামে লি আখলাকির রাবীর মধ্যে হযরত আলী রাযি. এর একটি বাণী বর্ণনা করেন,
    روحوا القلوب واطلبوا لها طرف الحكمة فإنها تمل كما تمل الأبدان
    "অন্তরকে বিশ্রাম দাও, (শরীরের মতো অন্তরও ক্লান্ত হয়ে যায়) অন্তরের জন্য হিকমাহপূর্ণ হালকা কিছু বাণী নির্বাচন করুন, কারণ শরীরের মতো অন্তরও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে যায়।"
    এ রকম তিনি ইমাম যুহরী রহ. থেকে রেওয়ায়াত করেন, একজন ব্যক্তি সাহাবায়ে কেরামের সাথে তাদের মজলিসে শরিক থাকতেন। তাদের পড়াশোনায় লিপ্ত থাকতেন। যখন তার কাছে এ সমস্ত কথাবার্তা কঠিন লাগত, তখন বলতেন,
    إن الأذن مجاجة و إن القلوب حمضة فهاتوا من أشعاركم وأحاديثكم.
    “আমার কান ভারী হয়ে গেছে, অন্তর পরিশ্রান্ত হয়ে গেছে। চলুন, কিছু কিছু কবিতা ও গল্পগুজব হয়ে যাক।"
    আত-তারাতীবুল ইদারিয়্যাহর লেখক বলেন, শাইখ মুখতার কানতী থেকে প্রশ্ন করা হলো, বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মক্তবের শিক্ষকবৃন্দ শিশুদেরকে কেনো পড়ায় না? তিনি প্রতুত্তরে বললেন, শিশুরা পুরো সপ্তাহ কুরআন পড়ত। অতঃপর হযরত ওমর রাযি. যখন শাম বিজয় করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন, তখন মদীনাবাসীরা নিজেদের সন্তারদেরসহ তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে বের হয়েছিলেন। আর দিনটি ছিল বুধবার। মদীনাবাসীরা বাচ্চাসহ জুমাবার সকাল পর্যন্ত ওমর রাযি. এর সাথে কাটায়। হযরত ওমর রাযি. এরপর থেকে এই সময়গুলো মক্তবের ছাত্রদের জন্য বিশ্রামের জন্য নির্ধারণ করলেন। এ রকম আমরা দেখি, আজ পর্যন্ত আমাদের যত ছুটির দিন রয়েছে, সালাফরা তার যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছেন।

    মকতব সংক্রান্ত শরয়ী হুকুম


    ফোরকানিয়া মক্তবের সাথে মুসলিম উম্মাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার কারণে ফিকহের বিভিন্ন কিতাবে নির্দিষ্ট অধ্যায়ে ফোরকানিয়া মক্তব সম্পর্কে মাসআলা- মাসায়েল আলোচনা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে কয়েকটি আলোচনা পেশ করছি-
    ১) শিক্ষকের উপর জরিমানা অর্থাৎ, উস্তাদ কর্তৃক শিশুদের উপর মাত্রাতিরিক্ত কঠোরতা করার কারণে কোন ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হলে তাঁর উপর জরিমানা। যেমন, মুনতাকা শরহে মুয়াত্বায় (শিক্ষক ছাত্রকে মারা) এ ব্যাপারে লিখেছেন, “ফোরকানিয়া মক্তব হোক বা অন্য কোনো শিক্ষাকেন্দ্র; যদি শিক্ষক শিষ্টাচারমূলক স্বাভাবিকভাবে ছাত্রকে প্রহার করে, তাহলে কোনো জরিমানা নেই। শিক্ষকের জন্য তো শাস্তি দেওয়ার বৈধতা আছে। যদি শিক্ষক অতিরিক্ত প্রহার করে বা শিষ্টাচারের জন্য প্রহার করেনি,(রাগের বশীভূত হয়ে প্রহার করে) অথবা শিষ্টাচারের জন্য মারার সময় অতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলে তার উপর "ভুলে হত্যা করার" বিধান পতিত হবে। সুতরাং যদি তা দিয়্যতের এক তৃতীয়াংশের চেয়ে কম হয়, তাহলে শিক্ষক নিজ থেকে আদায় করবে। আর যদি তা এক তৃতীয়াংশের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তা শিক্ষকের নিকটস্থ আত্মীয়রা আদায় করবে। বেতনভুক্ত চাকরি হোক বা আল্লাহর ওয়াস্তে, উভয় অবস্থায় এ বিধান প্রযোজ্য।”
    ইমাম শাফেয়ী রহ. "শিক্ষকের অপরাধ" নামে স্বতন্ত্র একটি কিতাব লিখেছেন। অর্থাৎ, শিক্ষকের শাস্তি কখন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে আর কখন গণ্য হবে না এ বিষয়ে।
    ২) শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ করা। এ মাসআলাটি কুরআন "শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ" এর ক্ষেত্রে খুব প্রসিদ্ধ। এই মাসআলা সম্পর্কে পূর্বেও আলোচনা করা হয়েছে। ডাক্তার আব্বাস মাহজূব রহ. ইমাম শাফেয়ী রহ. এর একটি উক্তি বর্ণনা করেন, "যখন আমি আমার মায়ের কোলে এতিম ছিলাম। তখন তিনি আমাকে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় দিয়েছিলেন। সে সময় আমার মায়ের কাছে শিক্ষককে দেওয়ার মতো কিছু ছিলো না। এ জন্য তিনি আম্মুর কাছ থেকে এ শর্ত মঞ্জুর করে নিলেন যে, তাঁর পরে আমি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবো।"
    ৩) তালাকের সময় বাচ্চার তরবিয়তের জিম্মাদারি। ইমাম নববী রহ. তাঁর কিতাব আল মাজমূ শরহে মুহাযযাবেবর্ণনা করেন, যদি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে, যখন বাচ্চার বয়স মাত্র সাত-আট বছর আর সন্তান তার মায়ের সাথে থাকে, তখন পিতার জন্য কর্তব্য হলো, সকালে তার মায়ের কাছ থেকে তাকে নিয়ে এসে ফোরকানিয়া মাদ্রাসা বা কোনো পেশা-শিক্ষাকেন্দ্রে দিয়ে যাবে, আর বিকেলে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসবে। কারণ বাচ্চার কল্যাণই প্রধান উদ্দেশ্য। আর এতে রয়েছে বাচ্চার কল্যাণ।
    ফিকহে হানাফি অনুযায়ীছেলে যখন বুদ্ধিমান হয়, তখন তার লালন-পালনের দায়িত্ব পিতার উপর অর্পিত হয়। মেয়ে যখন সাবালেগা হয়, তখন তার লালনপালনের দায়িত্ব পিতার উপর অর্পিত হয়। (উপরোক্ত মাসআলায়) বুদ্ধিমান থেকে উদ্দেশ্য হলো, ছেলে নিজ হাতে খেতে পারা, পান করতে পারা, নিজে নিজে অজু-ইস্তিঞ্জা করতে পারা। ছেলে বুদ্ধিমান আর মেয়ে সাবালেগা হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের লালন পালনের দায়িত্ব মায়ের উপর। (বাদায়েউস সানায়ে)


    চলবে...ইনশা আল্লাহ
    সূত্র: নাওয়ায়ে গাজওয়ায়ে হিন্দ ম্যাগাজিন থেকে অনূদিত
    অনুবাদক:
    husam
    জুনিয়র মেম্বার, দাওয়াহ ইলাল্লাহু ফোরাম


    আইডি লিঙ্ক: https://82.221.139.217/member/32761-husam
    Last edited by Munshi Abdur Rahman; 03-02-2022, 03:03 PM.
    “ধৈর্যশীল সতর্ক ব্যক্তিরাই লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত।”-শাইখ উসামা বিন লাদেন রহ.

  • #2
    যাজাকুমুল্লাহ।
    মুহতারাম ভাই পিডিএফ বানিয়ে নিচে লিংক দিয়ে দিলে ভাল হবে মনে হয়।আর সাথে আগের পর্বের লিংকও এড করে দেয়া যেতে পারে ইনশাআল্লাহ।

    Comment


    • #3
      মাশাল্লাহ আখি।
      আল্লাহ আপনার মেহনত কে কবুল করুক আমিন। আর ইলম বৃদ্ধি করুক

      Comment


      • #5
        জাযাকাল্লাহু খায়রান ফিদ দারাইন💞

        Comment

        Working...
        X