ইসলামের তারকাগণ।।পর্ব-২৩।। দাগিস্তানের সিংহ ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ (শেষ কিস্তি)
নতুন জার ও নতুন পরিকল্পনা:
১৮৫৫ সাল চলছে। ইমাম শামিল দাগিস্তানের তৃতীয় ইমাম নির্বাচিত হয়েছেন থেকে ২৩ বছর আগে। ২৩ বছরের এই যুদ্ধে তিনি রাশিয়াকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন একাধিকবার। ককেশাস বিজয়ের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল প্রথম জার নিকোলাসের। কিন্তু ভাগ্য তার সঙ্গ দেয়নি।
১৮৫৫ সালের ২রা মার্চ জার নিকোলাসের মৃত্যু হয়। ককেশাস বিজয়ের অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই তাকে দুনিয়া ছাড়তে হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাশিয়ার সম্রাট নিযুক্ত হয় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। সে ক্ষমতায় এসেই ককেশাস যুদ্ধের প্রতি মনোনিবেশ করে। চিহ্নিত করার চেষ্টা করে এতদিন পর্যন্ত লড়াই করেও সেখানে আমাদের সেনাবাহিনী বিজয় অর্জন করতে পারছে না কেনো? রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিদের সাথে সে এই বিষয়ে মতবিনিময় করে।
একেকজন একেক ধরনের কারণ উল্লেখ করতে থাকে। কোনটাই তার মনপুত হয়নি৷অবশেষে সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী ককেশাসে রুশ বাহিনী পরাজিত হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে। সেই সাথে ভবিষ্যতের কিছু পরিকল্পনাও পেশ করে-
১। ককেশাসের গোত্রপতিদের আমাদের দলে ভিড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে সোনা-রুপা খরচ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে তাদেরকে শামিলের থেকে আলাদা করতে হবে৷
২৷ কঠোরতার পরিবর্তে আমাদেরকে ক্ষমা ও নম্রতার পথ অবলম্বন করতে হবে। বিজিত অঞ্চলগুলোতে মানুষের বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার জ্বালিয়ে দেওয়ার নীতি বর্জন করতে হবে৷ আমাদের আচার-আচরণে তাদেরকে এই আশ্বাস দিতে হবে যে, তারা যদি আমাদের আনুগত্য মেনে নেয় তাহলে তারা লাভবান হবে।
৩৷ আমাদের এই দীর্ঘমেয়াদী ব্যর্থতার নেপথ্য কারণগুলোর অন্যতম হলো, আমরা গতানুগতিক পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে আসছি। সেখানকার মানুষগুলো আমাদের যতটা না বিরোধিতা করছে, এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিরোধিতা করছে সেখানকার গাছগাছালি আর পাহাড়-পর্বত।
অতীতের সেনাপতিগণ এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেনি। আমাদের না গোলাবারুদের ঘাটতি আছে আর না ঘাটতি আছে জনশক্তির। তাই সর্বপ্রথম আমাদের বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বত পরিষ্কার করতে হবে। তাহলেই ইমাম শামিলের প্রতিরোধ যুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়বে। বেরিয়া তানস্কীর এই প্রস্তাব জার আলেকজান্ডারের মনপুত হয়। তাই সে বেরিয়া তানস্কীকে ককেশাসের সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ককেশাস পাঠিয়ে দেয়।
শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ:
১৮৫৮ সালের জুন মাস। কয়েক হাজার রুশ সিপাহী গাছ কাটার অভিযানে লিপ্ত।বড় বড় তোপের গর্জনে ককেশাসের বন-জঙ্গল থরথর করে কাপছে। স্বাধীনতাকামীরা দেশের বন-জঙ্গলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জীবন বাজী রেখে লড়াই করে যাচ্ছে।
তারাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, এই বন-জঙ্গল আর পাহাড়-পর্বত না থাকলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারব না। ইমাম শামিল পায়ে পায়ে মোকাবিলা করার কৌশল পরিবর্তন করে দুশমনের উপর কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করার সম্ভাবনা যাচাইয়ের কাজে ব্যস্ত। অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে।
ইমাম দারগীন থেকে দূরের এক স্থানে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। চেচনিয়া ও দাগিস্তানে সমানভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। ইমামের পুত্র গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী জিহাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দাগিস্তানের রণক্ষেত্র ইতিপূর্বে কখনোই এত উত্তপ্ত হয়নি।কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি মুজাহিদদের অনুকূলে নয়।
সব ময়দান থেকে শুধু হতাশার সংবাদই আসছে প্রতিনিয়ত। রুশ সেনারা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মাধ্যমে জঙ্গল পরিষ্কার করছে। ডিনামাইট ব্যবহার করে বড় বড় পাহাড় ধ্বংস করে দিচ্ছে। গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য জঙ্গল আর পাহাড় অত্যন্ত জরুরী। খোলা মাঠে মুখোমুখি লড়াই করার মত সামর্থ মুজাহিদদের নেই। ধীরে ধীরে গেরিলা আক্রমণের পরিধিও সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
প্রতিদিন যতটুকু করে জঙ্গল পরিষ্কার হচ্ছে মুজাহিদদরা ততটুকু এলাকা ছেড়ে পিছনে সরে আসছে। ইমাম অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। এক ময়দান থেকে অপর ময়দানে পাগলের ন্যায় ছুটে বেড়ান। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান বহির্বিশ্বের কোথাও থেকে সাহায্য লাভ করা যায় কিনা।
সালতানাতে উসমানিয়া থেকে তিনি তোপ-কামান সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে, যদি কয়েকটা তোপের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে যুদ্ধের মোড় মুহূর্তের মধ্যেই ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। এরই মধ্যে গাজী মুহাম্মাদ তার কয়েকশ মুজাহিদ নিয়ে এক জঙ্গলে রুশ সেনাদের ঘেরাওয়ে আটকা পড়ে যান। সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী ইমাম শামিলকে যতটা না ভয় পায় তারচেয়েও বেশি ভয় পায় গাজী মুহাম্মাদকে৷
কারণ, ইমাম শামিল এখন বৃদ্ধ। কিন্তু গাজী মুহাম্মাদ টগবগে তরুণ। তাই গাজী মুহাম্মাদকে ঘেরাও করে চতুর্দিক থেকে জঙ্গল কাটতে কাটতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছায় এমন কঠিন ঘেরাও ভেদ করে তিনি বেরিয়ে যান। তবে আহত হন মারাত্মকভাবে। সুস্থ হতে সময় লেগে যায় বেশ কয়েকদিন।
সালতানাতে উসমানিয়ার কাছে বারবার সাহায্যের আবেদন জানিয়েও কেন ব্যর্থ হলেন ইমাম শামিল?
বাস্তবতা হল, দাগিস্তান ও চেচনিয়াতে ইমাম শামিল যখন শক্তিশালী প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সালতানাতে উসমানিয়ার কাছে বারবার সাহায্যের আবেদন করছেন তখন সালতানাতে উসমানিয়া ভেতর ও বাহিরের ষড়যন্ত্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত৷
রাশিয়া,ফ্রান্স ও বৃটেনসহ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সালতানাতের মানচিত্র ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তৎকালীন উসমানী সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল মাজীদকে (রাজত্বকাল-১৮৩৯-১৮৬১) একসঙ্গে সবগুলো শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বহিঃশক্তিগুলো যখন সালতানাতকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তখন আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহও তুঙ্গে।
১৮৫৮ সালে ক্রেট, সার্বিয়া, মোন্টিনেগরো, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা ও বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হচ্ছিল।তাছাড়া রাশিয়ার সাথে সালতানাতের দ্বন্দ্ব আরও অনেক পুরনো। জার নিকোলাসের মৃত্যুর পর জার আলেকজান্ডার তার সমুদয় শক্তি ককেশাসে নিয়ে আসে। পূর্ব থেকে সালতানাতের সঙ্গে চলতে থাকা যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় জার আলেকজান্ডার।
এমতাবস্থায় ইমাম শামিলের সাহায্যের আবেদন যখন সুলতান আব্দুল মাজীদের কাছে পৌঁছে তখন দরবারে জেঁকে বসা দালাল-গোষ্ঠী সুলতানকে এই বলে সাহায্য পাঠাতে বারণ করে যে, রাশিয়া এখন আমাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করেছে। ইমাম শামিলকে সাহায্য করার সংবাদ যদি রাশিয়া জেনে যায় তাহলে রাশিয়া পুনরায় সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান শুরু করবে।
জেনে-বুঝে রাশিয়ার শত্রুতা ক্রয় করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। মোটকথা, ইমাম শামিল সালতানাতে উসমানিয়া থেকে সাহায্য পান নি। পরবর্তীতে ইমাম নিজেই যখন সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তখন বলেছিলেন: আপনারা যদি আমাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতেন তাহলে শুধু রাশিয়ার জারদেরই না; এরূপ আরও দশ বিশটা সম্রাটের দেমাগ আমি চিরতরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারতাম।
শেষ যুদ্ধ:
১৮৫৯ সাল শুরু হয়ে গেছে। ইমাম যখন সালতানাতে উসমানিয়া থেকে সাহায্য পাবেন না মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন তখন তিনি নিজের যতটুকু সামর্থ আছে ততটুকু দিয়েই শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন। প্রতিদিন যে হারে জঙ্গল পরিষ্কার হচ্ছে তাতে তিনি বুঝে যান প্রতিরোধ যুদ্ধ বেশিদিন চালানো যাবে না।
কারণ, প্রতিদিন অসংখ্য মুজাহিদ শহীদ হচ্ছে। বেরিয়া তানস্কীর সৈন্যের অভাব নেই। একজন নিহত হলে তার স্থান পূরণ করছে আরও দশজন এসে। কিন্তু একজন মুজাহিদ শহীদ হলে তার স্থান অপূরণীয়-ই থেকে যাচ্ছে।সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইমাম নিজের ঘাঁটি দারগীন থেকে সরিয়ে নেন। উঁচু উঁচু গাছপালা বেষ্টিত একটি উঁচু পাহাড়কে তিনি ঘাঁটি হিসেবে নির্বাচন করেন। তাঁর ধারণা ছিল, এই গাছগুলি তারা কাটতে পারবে না।
কিন্তু রুশ বাহিনী বিস্ফোরক দ্রেব্য ও ডিনামাইটের মাধ্যমে সেই গাছগুলিও কেটে ফেলে। তিনি বুঝতে পারেন, এখানেও যুদ্ধ করা যাবে না৷ এবার তিনি সর্বশেষ ঘাঁটি নির্বাচন করার জন্য মনস্থির করলেন। নায়েব সুরখাই খানকে ডেকে বললেন, শাহাদাতের তামান্না পূর্ণ হওয়ার সময় অতি নিকটে। আমি আমার পৈতৃক মাটিতেই শহীদ হতে চাই। তুমি তাড়াতাড়ি গানীবের উঁচু এলাকাটা ক্রয় করো। নায়েব সুরখাই খান চারশত স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে উক্ত স্থানটি ক্রয় করে এবং সেখানে মোর্চা তৈরির জন্য চারশত মুজাহিদ কাজ শুরু করে।
ইমামের সাথে সর্বসাকুল্যে তখন ৮০০ মুজাহিদ ছিল। তিনি মুজাহিদদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে চারশ নিজের কাছে রাখলেন আর চারশ পাঠিয়ে দিলেন রাস্তায়৷ তাদেরকে বলে দিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুশ বাহিনী গানীব ঘেরাও করবে তখন তোমরা পেছন থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালাবে। কিন্তু বেরিয়া তানস্কীর বিতীর্ণ অর্থের মোহে পড়ে গ্রামবাসী অনেক পূর্বেই নিজেদের স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়ার কাছে। ইমাম শামিলের জানা ছিল না সেই তথ্য। ফলে তাঁর পাঠানো চারশ মুজাহিদকে ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসী।
১৮৫৯ সালের ২৫-শে আগস্ট ইমাম শামিলের সাথে রুশ বাহিনীর ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইমামের সাথে আছে মাত্র চারশত মুজাহিদ আর শত্রুবাহিনী লাখ লাখ। কোন একজন মুজাহিদও কমপক্ষে দশ বিশজন শত্রুকে হত্যা না করে জীবন দিচ্ছে না। দুপুর পর্যন্ত স্থায়ী হয় রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ। এরপর সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী তার বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। মহিলা, শিশু ও খাদেমসহ ইমামের সাথে তখন ছিল মাত্র ১০০ জন। যুদ্ধ বন্ধ। বেরিয়া তানস্কী আক্রমণ করছে না।
সন্ধি স্থাপন:
জার আলেকজান্ডার বেরিয়া তানস্কীকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যে, শামিলকে যেনো হত্যা না করা হয়৷ যে কোনো মূল্যে তাকে জীবিত রাখতে হবে৷ রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে ইমামের কাছে সন্ধির প্রস্তাব আসে। বলা হয়, আপনি যদি যুদ্ধ বন্ধ করেন তাহলে আপনাকে আমরা একজন সম্মানিত মেহমানের মর্যাদা দেব। ইমাম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জানিয়ে দেন, তোমরা আক্রমণ চালাও, আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাব।
তোমাদের মত বিশ্বাসঘাতকদের সাথে কোন সন্ধি নেই। দূত ফিরে যায়। ইমাম সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা যদি চাও তাহলে সন্ধি করে জীবন বাঁচাতে পারো। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ কিন্তু আমি সন্ধি করব না। সঙ্গীদের মধ্যেও কেউ সন্ধি করে জীবন বাঁচাতে রাজী নন। সকলেই শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
এভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে দূত আসতে থাকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। ইমাম বরাবরই তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন যে, তুমি তোমার সেনাপতিকে আক্রমণ করতে বল, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।অবশেষে একদিন সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী নিজেই আসে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাকেও তিনি একই কথা শুনিয়ে দেন।
রুশ সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, এখন আমরা আর আক্রমণ করব না। আপনাকে শাহী গাড়ীতে বসিয়ে রাশিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। এটাই মহামান্য জারের নির্দেশ। তবে আপনার কোন প্রস্তাব থাকলে বলতে পারেন। আমরা তা রক্ষা করার চেষ্টা করব।
ইমাম শামিল বললেন, আমি যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে মক্কা চলে যেতে চাই। বেরিয়া তানস্কী বলল, আপনার এই প্রস্তাবও গ্রহণ করা হবে। তবে আপনাকেও জারের একটা দরখাস্ত কবুল করতে হবে। তিনি জানতে চাইলেন, কী সেটা? তানস্কী বলল, আপনি কিছুদিনের জন্য হলেও রাশিয়ায় জারের মেহমান হবেন। এরপর রাশিয়াতে থাকতে না চাইলে আপনি যা চাইবেন তাই হবে। ইমাম শামিল এখন অপারগ। রুশ সেনারা যদি আক্রমণ না করে তাহলে প্রতিরোধ যুদ্ধ তিনি কীভাবে করবেন আর শাহাদাতের তামান্নাই বা কীভাবে পূরণ করবেন? তিনি এখন পরাজিত। তার ইচ্ছার কোন মূল্য নেই এখন। রুশ সেনাপতি যা চাইবে তাই তাকে করতে হবে৷ তাই তিনি উপায়ান্তর না দেখে তিনটি শর্তসাপেক্ষে জারের দরখাস্ত কবুল করতে সম্মত হন।
এক. আমি তোমাদের উপর কোন ধরনের আক্রমণ করব না- এই নিশ্চয়তা তোমাদেরকে দিচ্ছি। তোমাদেরও আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, আমার ও আমার সঙ্গীদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেবে না। আমাদের অস্ত্র আমাদের সাথেই থাকবে৷
দুই. আমার ও আমার সঙ্গীদের কারও সাথেই বন্দীদের মত আচরণ করা যাবে না। তোমাদের আচরণে যদি কখনো বুঝতে পারি যে, তোমরা আমাদের সাথে বন্দীদের মত আচরণ করছ তাহলে আমাদের অস্ত্র কাউকেই পরোয়া করবে না।
তিন. আমি যখন চাইব তখন আমাকে মক্কা চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।সেনাপতি ইমামের সকল শর্ত মেনে নেয় এবং রাজকীয় অতিথির সম্মান দিয়ে তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে দেয়। তার সাথে তখন ছিল স্ত্রী সোয়ানাত, ছেলে গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী আর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ নায়েব। এই বেদনাদায়ক ইতিহাস যেদিন রচিত হচ্ছিল সে দিনটি ছিল ৬-এ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দ।
ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার না করে এই রাজকীয় সম্মান কেন দেওয়া হয়েছিল?
অনেকগুলো কারণেই ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার না করে এভাবে রাজকীয় অতিথির সম্মান দিয়ে জারের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে একরকম বাধ্য করা হয়। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল:
১। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছে যে, কোহেস্তানীদের হৃদয়ে ইমাম শামিলের প্রতি যে অগাধ ও অকৃত্রিম ভক্তি-শ্রদ্ধা দানা বেঁধে আছে, যদি ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার করা হয় তাহলে এই ক্ষোভ কোহেস্তানীরা কখনোই ভুলে যাবে না। আর এই ক্ষোভ পরবর্তীতে রাশিয়ার জন্য ককেশাস শাসন করার পথে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভ যে কোন সময় বিদ্রোহের রূপ নিতে পারে।
২। ইমাম শামিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাশিয়ার প্রতিটি মানুষ তাঁর বীরত্বের কথা জানে এবং তাকে ভক্তিভরে স্মরণ করে। সবার দিলের আকুতি ছিল দাগিস্তানের সিংহকে এক পলক দেখে নিজেকে ধন্য করা। এমন সাহসী ও নির্ভীক মানুষটিকে একবার দেখার আকাঙ্খা স্বয়ং জারেরও ছিল, যে এতগুলি বছর ধরে রাশিয়ার ঘুম হারাম করে রেখেছে।
৩। এছাড়া জারের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল, ইমাম শামিলের সাথে তার দুই ছেলেও আছে। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখলে এবং রাজকীয় আতিথেয়তার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে পারলে পরবর্তীতে তাদেরকেই জারের পক্ষ থেকে দাগিস্তান ও চেচনিয়ার ভাইস-রয় করে পাঠানো যাবে৷ কারণ, কোহেস্তানী আর চেচেনরা ইমাম-পুত্রদ্বয়ের নেতৃত্ব নির্দ্বিধায় মেনে নেবে-এতে কোন সন্দেহ নেই।
রাশিয়ার মেহমান ইমাম শামিল:
ইমাম শামিল ও তাঁর সঙ্গীদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়েই রাশিয়া অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হয়৷ রাস্তার দুপাশে জনতার ভিড় জমে যায় শেরে দাগিস্তানকে এক পলক দেখার জন্য৷ তিনি আল্লাহর সিন্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট। নিজের চেষ্টায় তিনি কোনোরূপ ত্রুটি করেন নি৷ এখন তাঁর সাথে যা হচ্ছে তা নিয়তি। মেনে না নেওয়ার কোন বিকল্প নেই৷ তিনিও মুগ্ধ নয়নে প্রত্যক্ষ করছেন জনতার ঢল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ট্রেনে৷ ইতিপূর্বে তিনি কখনোই ট্রেন দেখেন নি৷ যে স্টেশনেই ট্রেন থামছিল সেখানেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। এভাবেই তিনি রাশিয়া পৌঁছেন। সেখানেও তিনি পেয়েছেন জনতার ভালোবাসা৷ ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত দাগিস্তানের সিংহ দেখতে চলে আসত। রাশিয়াতে এভাবেই তার দশটি বছর কেটে যায়৷ এই দশ বছরে তাঁর সাথে আসা অনেক সাথীই মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বারবার মক্কা যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু নানান অজুহাতে তাঁকে বারণ করা হচ্ছিল। এই জাতিকে তিনি অনেক আগে থেকেই চিনেন। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে থাকেন৷
অবশেষে ১৮৬৯ সালে যখন হজ্জের মৌসুম আসে তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে হিজায যাওয়ার অনুমতি পান। তবে তাঁর ছেলেদ্বয় ও নায়েবদের থাকতে হবে রাশিয়াতেই। পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি তাতে রাজী হন। রাশিয়াতে থেকে যায় তাঁর পুত্রদ্বয় ও নায়েবগণ।
রবের সঙ্গে মুলাকাত:
তিনি প্রথমেই মক্কা না গিয়ে যান উসমানী সালতানাতের প্রাণকেন্দ্র তুরষ্কে৷ সেখানে তৎকালীন সুলতান প্রথম আব্দুল আজীজের (রাজত্বকাল, ১৮৬১-১৮৭৬) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতানও তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফীও পালিয়ে চলে আসেন তুরষ্কে। এখানে এসে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আর গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী সালতানাতের অধীন হয়ে পুনরায় ঝাপিয়ে পড়েন জিহাদের ময়দানে।ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহু তুরষ্ক থেকে বের হয়ে সোজা মক্কার পথ ধরেন৷
১৮৭০ সালে তিনি বাইতুল্লাহর হজ্জ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা সফর করেন। পবিত্র মদীনাতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে নিজের দরবারে ডেকে নেন।
১৮৭১ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারী মোতাবেক ১২৮৭ হিজরীর ২৫-শে জিলক্বদ তিনি আপন রবের সান্নিধ্যে ইহকাল ত্যাগ করে চিরস্থায়ী জান্নাতে পারি জমান। সাহাবী-তাবেঈদের পরশ-ধন্য জান্নাতুল বাকীতে তাঁর দাফন হয়৷ রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা রাহমাতান ওয়াসি’আহ!
ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ যদিও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর আযাদী-আন্দোলন ও জিহাদী চেতনা এখনো দীপ্তি ছড়াচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে। উম্মতে মুসলিমাহ আজও তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে৷ তাঁর অসমাপ্ত আযাদী-আন্দোলন থেমে থাকেনি। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুসলিমরা যুগে যুগে অস্ত্র ধরেছে আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে। গতিশীল করেছে আযাদী-আন্দোলনকে। ইনশাআল্লাহ এ ধারা ততদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে যতদিন না আমরা আমাদের প্রতি ইঞ্চি মাটি কাফেরদের নাপাক আধিপত্য থেকে মুক্ত করে পুনরায় ইসলামী শাসনের অধীন করব!!
লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্র:
(১) https://tinyurl.com/ypuc473s
(২) https://tinyurl.com/bdf5net7
(৩) https://tinyurl.com/ycy5tmep
(৪) যুলফিকার।
(৫) রাব্বানিয়্যাহ লা রাহবানিয়্যাহ।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
প্রথম কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/06/12/57525/
দ্বিতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/08/57940/
তৃতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/16/58004/
শেষ কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/08/07/58411/
(সংক্ষিপ্ত পরিচিতি) ইমাম শামিল- একটি নাম নয়, একটি ইতিহাস। ১৮৩৪ সাল থেকে ১৮৫৯ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া এক লড়াকু যোদ্ধার নাম ইমাম শামিল। আগ্রাসী রাশিয়ার অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্রও অকেজো হয়ে পড়েছিল যে মহান বীরের নগন্য ও আদিযুগের যুদ্ধাস্ত্রের সামনে, তিনিই হলেন ইমাম শামিল। রাশিয়ার রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে অজপাড়া গাঁয়ের কুঁড়েঘর পর্যন্ত সবার কাছেই যিনি “শেরে দাগিস্তান” বা দাগিস্তানের সিংহ নামে পরিচিত, তিনিই ইমাম শামিল। ইতিহাসে আজও তিনি আযাদীর শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার হিসেবেই প্রসিদ্ধ। আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের জনক মনে করা হয় তাকে। যুগের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও অভিনব রণকৌশল মুখ থুবড়ে পড়েছিল এই মহান বীরের সামনে। সন্ত্রাসী রাশিয়ার এমন কেউ ছিল না, যে ইমাম শামিলকে ভয় করত না। রাশিয়ার সৈনিকদের জন্য তিনি ছিলেন সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। রাশিয়ার মায়েরা নিজ সন্তানদের ঘুম পাড়াত ইমাম শামিলের নাম শুনিয়ে।
পূর্ব প্রকাশের পর থেকে…নতুন জার ও নতুন পরিকল্পনা:
১৮৫৫ সাল চলছে। ইমাম শামিল দাগিস্তানের তৃতীয় ইমাম নির্বাচিত হয়েছেন থেকে ২৩ বছর আগে। ২৩ বছরের এই যুদ্ধে তিনি রাশিয়াকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন একাধিকবার। ককেশাস বিজয়ের অনেক বড় স্বপ্ন ছিল প্রথম জার নিকোলাসের। কিন্তু ভাগ্য তার সঙ্গ দেয়নি।
১৮৫৫ সালের ২রা মার্চ জার নিকোলাসের মৃত্যু হয়। ককেশাস বিজয়ের অপূর্ণ স্বপ্ন নিয়েই তাকে দুনিয়া ছাড়তে হয়। তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে রাশিয়ার সম্রাট নিযুক্ত হয় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। সে ক্ষমতায় এসেই ককেশাস যুদ্ধের প্রতি মনোনিবেশ করে। চিহ্নিত করার চেষ্টা করে এতদিন পর্যন্ত লড়াই করেও সেখানে আমাদের সেনাবাহিনী বিজয় অর্জন করতে পারছে না কেনো? রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিদের সাথে সে এই বিষয়ে মতবিনিময় করে।
একেকজন একেক ধরনের কারণ উল্লেখ করতে থাকে। কোনটাই তার মনপুত হয়নি৷অবশেষে সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী ককেশাসে রুশ বাহিনী পরাজিত হওয়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে। সেই সাথে ভবিষ্যতের কিছু পরিকল্পনাও পেশ করে-
১। ককেশাসের গোত্রপতিদের আমাদের দলে ভিড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণে সোনা-রুপা খরচ করতে হবে। যে কোনো মূল্যে তাদেরকে শামিলের থেকে আলাদা করতে হবে৷
২৷ কঠোরতার পরিবর্তে আমাদেরকে ক্ষমা ও নম্রতার পথ অবলম্বন করতে হবে। বিজিত অঞ্চলগুলোতে মানুষের বাড়ি-ঘর, ক্ষেত-খামার জ্বালিয়ে দেওয়ার নীতি বর্জন করতে হবে৷ আমাদের আচার-আচরণে তাদেরকে এই আশ্বাস দিতে হবে যে, তারা যদি আমাদের আনুগত্য মেনে নেয় তাহলে তারা লাভবান হবে।
৩৷ আমাদের এই দীর্ঘমেয়াদী ব্যর্থতার নেপথ্য কারণগুলোর অন্যতম হলো, আমরা গতানুগতিক পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে আসছি। সেখানকার মানুষগুলো আমাদের যতটা না বিরোধিতা করছে, এরচেয়ে কয়েকগুণ বেশি বিরোধিতা করছে সেখানকার গাছগাছালি আর পাহাড়-পর্বত।
অতীতের সেনাপতিগণ এই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেনি। আমাদের না গোলাবারুদের ঘাটতি আছে আর না ঘাটতি আছে জনশক্তির। তাই সর্বপ্রথম আমাদের বন-জঙ্গল ও পাহাড়-পর্বত পরিষ্কার করতে হবে। তাহলেই ইমাম শামিলের প্রতিরোধ যুদ্ধ মুখ থুবড়ে পড়বে। বেরিয়া তানস্কীর এই প্রস্তাব জার আলেকজান্ডারের মনপুত হয়। তাই সে বেরিয়া তানস্কীকে ককেশাসের সেনাপ্রধান নিযুক্ত করে ইমাম শামিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ককেশাস পাঠিয়ে দেয়।
শুরু হল ভয়াবহ যুদ্ধ:
১৮৫৮ সালের জুন মাস। কয়েক হাজার রুশ সিপাহী গাছ কাটার অভিযানে লিপ্ত।বড় বড় তোপের গর্জনে ককেশাসের বন-জঙ্গল থরথর করে কাপছে। স্বাধীনতাকামীরা দেশের বন-জঙ্গলকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য জীবন বাজী রেখে লড়াই করে যাচ্ছে।
তারাও নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, এই বন-জঙ্গল আর পাহাড়-পর্বত না থাকলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারব না। ইমাম শামিল পায়ে পায়ে মোকাবিলা করার কৌশল পরিবর্তন করে দুশমনের উপর কমান্ডো আক্রমণ পরিচালনা করার সম্ভাবনা যাচাইয়ের কাজে ব্যস্ত। অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে।
ইমাম দারগীন থেকে দূরের এক স্থানে বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। চেচনিয়া ও দাগিস্তানে সমানভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। ইমামের পুত্র গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী জিহাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দাগিস্তানের রণক্ষেত্র ইতিপূর্বে কখনোই এত উত্তপ্ত হয়নি।কিন্তু যুদ্ধের পরিস্থিতি মুজাহিদদের অনুকূলে নয়।
সব ময়দান থেকে শুধু হতাশার সংবাদই আসছে প্রতিনিয়ত। রুশ সেনারা প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের মাধ্যমে জঙ্গল পরিষ্কার করছে। ডিনামাইট ব্যবহার করে বড় বড় পাহাড় ধ্বংস করে দিচ্ছে। গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য জঙ্গল আর পাহাড় অত্যন্ত জরুরী। খোলা মাঠে মুখোমুখি লড়াই করার মত সামর্থ মুজাহিদদের নেই। ধীরে ধীরে গেরিলা আক্রমণের পরিধিও সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
প্রতিদিন যতটুকু করে জঙ্গল পরিষ্কার হচ্ছে মুজাহিদদরা ততটুকু এলাকা ছেড়ে পিছনে সরে আসছে। ইমাম অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন। এক ময়দান থেকে অপর ময়দানে পাগলের ন্যায় ছুটে বেড়ান। তিনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান বহির্বিশ্বের কোথাও থেকে সাহায্য লাভ করা যায় কিনা।
সালতানাতে উসমানিয়া থেকে তিনি তোপ-কামান সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে, যদি কয়েকটা তোপের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে যুদ্ধের মোড় মুহূর্তের মধ্যেই ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। এরই মধ্যে গাজী মুহাম্মাদ তার কয়েকশ মুজাহিদ নিয়ে এক জঙ্গলে রুশ সেনাদের ঘেরাওয়ে আটকা পড়ে যান। সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী ইমাম শামিলকে যতটা না ভয় পায় তারচেয়েও বেশি ভয় পায় গাজী মুহাম্মাদকে৷
কারণ, ইমাম শামিল এখন বৃদ্ধ। কিন্তু গাজী মুহাম্মাদ টগবগে তরুণ। তাই গাজী মুহাম্মাদকে ঘেরাও করে চতুর্দিক থেকে জঙ্গল কাটতে কাটতে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। আল্লাহর ইচ্ছায় এমন কঠিন ঘেরাও ভেদ করে তিনি বেরিয়ে যান। তবে আহত হন মারাত্মকভাবে। সুস্থ হতে সময় লেগে যায় বেশ কয়েকদিন।
সালতানাতে উসমানিয়ার কাছে বারবার সাহায্যের আবেদন জানিয়েও কেন ব্যর্থ হলেন ইমাম শামিল?
বাস্তবতা হল, দাগিস্তান ও চেচনিয়াতে ইমাম শামিল যখন শক্তিশালী প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন এবং সালতানাতে উসমানিয়ার কাছে বারবার সাহায্যের আবেদন করছেন তখন সালতানাতে উসমানিয়া ভেতর ও বাহিরের ষড়যন্ত্রে আকণ্ঠ নিমজ্জিত৷
রাশিয়া,ফ্রান্স ও বৃটেনসহ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সালতানাতের মানচিত্র ভাগাভাগি করে নিয়েছে। তৎকালীন উসমানী সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল মাজীদকে (রাজত্বকাল-১৮৩৯-১৮৬১) একসঙ্গে সবগুলো শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বহিঃশক্তিগুলো যখন সালতানাতকে একটু একটু করে গ্রাস করে নিচ্ছে তখন আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহও তুঙ্গে।
১৮৫৮ সালে ক্রেট, সার্বিয়া, মোন্টিনেগরো, বসনিয়া, হার্জেগোভিনা ও বুলগেরিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হচ্ছিল।তাছাড়া রাশিয়ার সাথে সালতানাতের দ্বন্দ্ব আরও অনেক পুরনো। জার নিকোলাসের মৃত্যুর পর জার আলেকজান্ডার তার সমুদয় শক্তি ককেশাসে নিয়ে আসে। পূর্ব থেকে সালতানাতের সঙ্গে চলতে থাকা যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় জার আলেকজান্ডার।
এমতাবস্থায় ইমাম শামিলের সাহায্যের আবেদন যখন সুলতান আব্দুল মাজীদের কাছে পৌঁছে তখন দরবারে জেঁকে বসা দালাল-গোষ্ঠী সুলতানকে এই বলে সাহায্য পাঠাতে বারণ করে যে, রাশিয়া এখন আমাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করেছে। ইমাম শামিলকে সাহায্য করার সংবাদ যদি রাশিয়া জেনে যায় তাহলে রাশিয়া পুনরায় সালতানাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান শুরু করবে।
জেনে-বুঝে রাশিয়ার শত্রুতা ক্রয় করা যুক্তিসঙ্গত হবে না। মোটকথা, ইমাম শামিল সালতানাতে উসমানিয়া থেকে সাহায্য পান নি। পরবর্তীতে ইমাম নিজেই যখন সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তখন বলেছিলেন: আপনারা যদি আমাকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতেন তাহলে শুধু রাশিয়ার জারদেরই না; এরূপ আরও দশ বিশটা সম্রাটের দেমাগ আমি চিরতরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারতাম।
শেষ যুদ্ধ:
১৮৫৯ সাল শুরু হয়ে গেছে। ইমাম যখন সালতানাতে উসমানিয়া থেকে সাহায্য পাবেন না মর্মে নিশ্চিত হয়েছেন তখন তিনি নিজের যতটুকু সামর্থ আছে ততটুকু দিয়েই শেষ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হন। প্রতিদিন যে হারে জঙ্গল পরিষ্কার হচ্ছে তাতে তিনি বুঝে যান প্রতিরোধ যুদ্ধ বেশিদিন চালানো যাবে না।
কারণ, প্রতিদিন অসংখ্য মুজাহিদ শহীদ হচ্ছে। বেরিয়া তানস্কীর সৈন্যের অভাব নেই। একজন নিহত হলে তার স্থান পূরণ করছে আরও দশজন এসে। কিন্তু একজন মুজাহিদ শহীদ হলে তার স্থান অপূরণীয়-ই থেকে যাচ্ছে।সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে ইমাম নিজের ঘাঁটি দারগীন থেকে সরিয়ে নেন। উঁচু উঁচু গাছপালা বেষ্টিত একটি উঁচু পাহাড়কে তিনি ঘাঁটি হিসেবে নির্বাচন করেন। তাঁর ধারণা ছিল, এই গাছগুলি তারা কাটতে পারবে না।
কিন্তু রুশ বাহিনী বিস্ফোরক দ্রেব্য ও ডিনামাইটের মাধ্যমে সেই গাছগুলিও কেটে ফেলে। তিনি বুঝতে পারেন, এখানেও যুদ্ধ করা যাবে না৷ এবার তিনি সর্বশেষ ঘাঁটি নির্বাচন করার জন্য মনস্থির করলেন। নায়েব সুরখাই খানকে ডেকে বললেন, শাহাদাতের তামান্না পূর্ণ হওয়ার সময় অতি নিকটে। আমি আমার পৈতৃক মাটিতেই শহীদ হতে চাই। তুমি তাড়াতাড়ি গানীবের উঁচু এলাকাটা ক্রয় করো। নায়েব সুরখাই খান চারশত স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে উক্ত স্থানটি ক্রয় করে এবং সেখানে মোর্চা তৈরির জন্য চারশত মুজাহিদ কাজ শুরু করে।
ইমামের সাথে সর্বসাকুল্যে তখন ৮০০ মুজাহিদ ছিল। তিনি মুজাহিদদেরকে দুটি ভাগে বিভক্ত করে চারশ নিজের কাছে রাখলেন আর চারশ পাঠিয়ে দিলেন রাস্তায়৷ তাদেরকে বলে দিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুশ বাহিনী গানীব ঘেরাও করবে তখন তোমরা পেছন থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালাবে। কিন্তু বেরিয়া তানস্কীর বিতীর্ণ অর্থের মোহে পড়ে গ্রামবাসী অনেক পূর্বেই নিজেদের স্বাধীনতা বিক্রি করে দিয়েছিল রাশিয়ার কাছে। ইমাম শামিলের জানা ছিল না সেই তথ্য। ফলে তাঁর পাঠানো চারশ মুজাহিদকে ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসী।
১৮৫৯ সালের ২৫-শে আগস্ট ইমাম শামিলের সাথে রুশ বাহিনীর ভয়াবহ এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইমামের সাথে আছে মাত্র চারশত মুজাহিদ আর শত্রুবাহিনী লাখ লাখ। কোন একজন মুজাহিদও কমপক্ষে দশ বিশজন শত্রুকে হত্যা না করে জীবন দিচ্ছে না। দুপুর পর্যন্ত স্থায়ী হয় রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ। এরপর সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী তার বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। মহিলা, শিশু ও খাদেমসহ ইমামের সাথে তখন ছিল মাত্র ১০০ জন। যুদ্ধ বন্ধ। বেরিয়া তানস্কী আক্রমণ করছে না।
সন্ধি স্থাপন:
জার আলেকজান্ডার বেরিয়া তানস্কীকে এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যে, শামিলকে যেনো হত্যা না করা হয়৷ যে কোনো মূল্যে তাকে জীবিত রাখতে হবে৷ রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে ইমামের কাছে সন্ধির প্রস্তাব আসে। বলা হয়, আপনি যদি যুদ্ধ বন্ধ করেন তাহলে আপনাকে আমরা একজন সম্মানিত মেহমানের মর্যাদা দেব। ইমাম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। জানিয়ে দেন, তোমরা আক্রমণ চালাও, আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে যাব।
তোমাদের মত বিশ্বাসঘাতকদের সাথে কোন সন্ধি নেই। দূত ফিরে যায়। ইমাম সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমরা যদি চাও তাহলে সন্ধি করে জীবন বাঁচাতে পারো। আমার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ কিন্তু আমি সন্ধি করব না। সঙ্গীদের মধ্যেও কেউ সন্ধি করে জীবন বাঁচাতে রাজী নন। সকলেই শহীদ হওয়ার জন্য প্রস্তুত।
এভাবে কয়েকদিন পর্যন্ত রুশ বাহিনীর পক্ষ থেকে দূত আসতে থাকে সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। ইমাম বরাবরই তাকে এই বলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন যে, তুমি তোমার সেনাপতিকে আক্রমণ করতে বল, আমরা শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।অবশেষে একদিন সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী নিজেই আসে ইমামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাকেও তিনি একই কথা শুনিয়ে দেন।
রুশ সেনাপতি বেরিয়া তানস্কী স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে, এখন আমরা আর আক্রমণ করব না। আপনাকে শাহী গাড়ীতে বসিয়ে রাশিয়া নিয়ে যাওয়া হবে। এটাই মহামান্য জারের নির্দেশ। তবে আপনার কোন প্রস্তাব থাকলে বলতে পারেন। আমরা তা রক্ষা করার চেষ্টা করব।
ইমাম শামিল বললেন, আমি যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণা দিয়ে মক্কা চলে যেতে চাই। বেরিয়া তানস্কী বলল, আপনার এই প্রস্তাবও গ্রহণ করা হবে। তবে আপনাকেও জারের একটা দরখাস্ত কবুল করতে হবে। তিনি জানতে চাইলেন, কী সেটা? তানস্কী বলল, আপনি কিছুদিনের জন্য হলেও রাশিয়ায় জারের মেহমান হবেন। এরপর রাশিয়াতে থাকতে না চাইলে আপনি যা চাইবেন তাই হবে। ইমাম শামিল এখন অপারগ। রুশ সেনারা যদি আক্রমণ না করে তাহলে প্রতিরোধ যুদ্ধ তিনি কীভাবে করবেন আর শাহাদাতের তামান্নাই বা কীভাবে পূরণ করবেন? তিনি এখন পরাজিত। তার ইচ্ছার কোন মূল্য নেই এখন। রুশ সেনাপতি যা চাইবে তাই তাকে করতে হবে৷ তাই তিনি উপায়ান্তর না দেখে তিনটি শর্তসাপেক্ষে জারের দরখাস্ত কবুল করতে সম্মত হন।
এক. আমি তোমাদের উপর কোন ধরনের আক্রমণ করব না- এই নিশ্চয়তা তোমাদেরকে দিচ্ছি। তোমাদেরও আমাকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, আমার ও আমার সঙ্গীদের থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেবে না। আমাদের অস্ত্র আমাদের সাথেই থাকবে৷
দুই. আমার ও আমার সঙ্গীদের কারও সাথেই বন্দীদের মত আচরণ করা যাবে না। তোমাদের আচরণে যদি কখনো বুঝতে পারি যে, তোমরা আমাদের সাথে বন্দীদের মত আচরণ করছ তাহলে আমাদের অস্ত্র কাউকেই পরোয়া করবে না।
তিন. আমি যখন চাইব তখন আমাকে মক্কা চলে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে।সেনাপতি ইমামের সকল শর্ত মেনে নেয় এবং রাজকীয় অতিথির সম্মান দিয়ে তাকে ও তার সঙ্গীদেরকে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে দেয়। তার সাথে তখন ছিল স্ত্রী সোয়ানাত, ছেলে গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী আর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ নায়েব। এই বেদনাদায়ক ইতিহাস যেদিন রচিত হচ্ছিল সে দিনটি ছিল ৬-এ সেপ্টেম্বর ১৮৫৯ খৃষ্টাব্দ।
ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার না করে এই রাজকীয় সম্মান কেন দেওয়া হয়েছিল?
অনেকগুলো কারণেই ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার না করে এভাবে রাজকীয় অতিথির সম্মান দিয়ে জারের আতিথেয়তা গ্রহণ করতে একরকম বাধ্য করা হয়। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হল:
১। জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অনেক চিন্তাভাবনা করে দেখেছে যে, কোহেস্তানীদের হৃদয়ে ইমাম শামিলের প্রতি যে অগাধ ও অকৃত্রিম ভক্তি-শ্রদ্ধা দানা বেঁধে আছে, যদি ইমাম শামিলকে হত্যা বা গ্রেফতার করা হয় তাহলে এই ক্ষোভ কোহেস্তানীরা কখনোই ভুলে যাবে না। আর এই ক্ষোভ পরবর্তীতে রাশিয়ার জন্য ককেশাস শাসন করার পথে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভ যে কোন সময় বিদ্রোহের রূপ নিতে পারে।
২। ইমাম শামিল একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। রাশিয়ার প্রতিটি মানুষ তাঁর বীরত্বের কথা জানে এবং তাকে ভক্তিভরে স্মরণ করে। সবার দিলের আকুতি ছিল দাগিস্তানের সিংহকে এক পলক দেখে নিজেকে ধন্য করা। এমন সাহসী ও নির্ভীক মানুষটিকে একবার দেখার আকাঙ্খা স্বয়ং জারেরও ছিল, যে এতগুলি বছর ধরে রাশিয়ার ঘুম হারাম করে রেখেছে।
৩। এছাড়া জারের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল, ইমাম শামিলের সাথে তার দুই ছেলেও আছে। তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখলে এবং রাজকীয় আতিথেয়তার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করতে পারলে পরবর্তীতে তাদেরকেই জারের পক্ষ থেকে দাগিস্তান ও চেচনিয়ার ভাইস-রয় করে পাঠানো যাবে৷ কারণ, কোহেস্তানী আর চেচেনরা ইমাম-পুত্রদ্বয়ের নেতৃত্ব নির্দ্বিধায় মেনে নেবে-এতে কোন সন্দেহ নেই।
রাশিয়ার মেহমান ইমাম শামিল:
ইমাম শামিল ও তাঁর সঙ্গীদেরকে যথোপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা দিয়েই রাশিয়া অভিমুখে নিয়ে যাওয়া হয়৷ রাস্তার দুপাশে জনতার ভিড় জমে যায় শেরে দাগিস্তানকে এক পলক দেখার জন্য৷ তিনি আল্লাহর সিন্ধান্তের উপর সন্তুষ্ট। নিজের চেষ্টায় তিনি কোনোরূপ ত্রুটি করেন নি৷ এখন তাঁর সাথে যা হচ্ছে তা নিয়তি। মেনে না নেওয়ার কোন বিকল্প নেই৷ তিনিও মুগ্ধ নয়নে প্রত্যক্ষ করছেন জনতার ঢল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ট্রেনে৷ ইতিপূর্বে তিনি কখনোই ট্রেন দেখেন নি৷ যে স্টেশনেই ট্রেন থামছিল সেখানেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। এভাবেই তিনি রাশিয়া পৌঁছেন। সেখানেও তিনি পেয়েছেন জনতার ভালোবাসা৷ ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত দাগিস্তানের সিংহ দেখতে চলে আসত। রাশিয়াতে এভাবেই তার দশটি বছর কেটে যায়৷ এই দশ বছরে তাঁর সাথে আসা অনেক সাথীই মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বারবার মক্কা যেতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু নানান অজুহাতে তাঁকে বারণ করা হচ্ছিল। এই জাতিকে তিনি অনেক আগে থেকেই চিনেন। তাই তিনি আল্লাহর দরবারে কায়মনোবাক্যে দোয়া করতে থাকেন৷
অবশেষে ১৮৬৯ সালে যখন হজ্জের মৌসুম আসে তখন তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে হিজায যাওয়ার অনুমতি পান। তবে তাঁর ছেলেদ্বয় ও নায়েবদের থাকতে হবে রাশিয়াতেই। পরামর্শের ভিত্তিতে তিনি তাতে রাজী হন। রাশিয়াতে থেকে যায় তাঁর পুত্রদ্বয় ও নায়েবগণ।
রবের সঙ্গে মুলাকাত:
তিনি প্রথমেই মক্কা না গিয়ে যান উসমানী সালতানাতের প্রাণকেন্দ্র তুরষ্কে৷ সেখানে তৎকালীন সুলতান প্রথম আব্দুল আজীজের (রাজত্বকাল, ১৮৬১-১৮৭৬) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সুলতানও তাকে যথেষ্ট সম্মান করেন। অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফীও পালিয়ে চলে আসেন তুরষ্কে। এখানে এসে পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আর গাজী মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদ শফী সালতানাতের অধীন হয়ে পুনরায় ঝাপিয়ে পড়েন জিহাদের ময়দানে।ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহু তুরষ্ক থেকে বের হয়ে সোজা মক্কার পথ ধরেন৷
১৮৭০ সালে তিনি বাইতুল্লাহর হজ্জ সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওজা মুবারক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনা সফর করেন। পবিত্র মদীনাতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর এই প্রিয় বান্দাকে নিজের দরবারে ডেকে নেন।
১৮৭১ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারী মোতাবেক ১২৮৭ হিজরীর ২৫-শে জিলক্বদ তিনি আপন রবের সান্নিধ্যে ইহকাল ত্যাগ করে চিরস্থায়ী জান্নাতে পারি জমান। সাহাবী-তাবেঈদের পরশ-ধন্য জান্নাতুল বাকীতে তাঁর দাফন হয়৷ রাহিমাহুল্লাহু তায়ালা রাহমাতান ওয়াসি’আহ!
ইমাম শামিল রাহিমাহুল্লাহ যদিও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর আযাদী-আন্দোলন ও জিহাদী চেতনা এখনো দীপ্তি ছড়াচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে। উম্মতে মুসলিমাহ আজও তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধাভরে৷ তাঁর অসমাপ্ত আযাদী-আন্দোলন থেমে থাকেনি। তাঁর আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে মুসলিমরা যুগে যুগে অস্ত্র ধরেছে আগ্রাসী রাশিয়ার বিরুদ্ধে। গতিশীল করেছে আযাদী-আন্দোলনকে। ইনশাআল্লাহ এ ধারা ততদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে যতদিন না আমরা আমাদের প্রতি ইঞ্চি মাটি কাফেরদের নাপাক আধিপত্য থেকে মুক্ত করে পুনরায় ইসলামী শাসনের অধীন করব!!
লেখক : মুফতি আব্দুল্লাহ মুনতাসির
তথ্যসূত্র:
(১) https://tinyurl.com/ypuc473s
(২) https://tinyurl.com/bdf5net7
(৩) https://tinyurl.com/ycy5tmep
(৪) যুলফিকার।
(৫) রাব্বানিয়্যাহ লা রাহবানিয়্যাহ।
পড়ুন আগের পর্বগুলো-
প্রথম কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/06/12/57525/
দ্বিতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/08/57940/
তৃতীয় কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/07/16/58004/
শেষ কিস্তি: https://alfirdaws.org/2022/08/07/58411/