ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহ. হক্বের প্রশ্নে অনমনীয় এক জীবন
ইসলামি খেলাফতের কেন্দ্রে তখন আব্বাসি খলীফা মামুন অধিষ্টিত। তিনি স্বীয় শিক্ষক আবুল হুযাইল আল্লাফের মুতাযিলি মতে দীক্ষিত হয়েছেন। মুতাযিলাদের ‘খালকে কুরআন’ মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে তার ভূমিকাই উল্লেখযোগ্য। খলীফা মামুন বাগদাদের সমকালীন অনেক আলিমকে একত্রিত করে খালকে কুরআন বিষয়ক তার মত সবাইকে মেনে নিতে বললেন। উপস্থিত আলিমদের মধ্যে ইমাম ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলও ছিলেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়পদ। বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন- এ বিদআত মেনে নেওয়া যায় না। ফলে তাকে কারাগারে কাটাতে হল দীর্ঘ আড়াই বছর। সাথে নির্মম নির্যাতন।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বিখ্যাত হাদিস বিশারদ এবং হাম্বলি মাযহাব প্রণেতা। ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, আমি বাগদাদ ছেড়ে আসার সময় আহমদ ইবনে হাম্বল থেকে অধিক পরহেযগার এবং ফকীহ কাউকে দেখিনি। আলী ইবনুল মাদিনী রহ. বলেন, আমি আহমদ ইবনে হাম্বলকে আমার এবং আল্লাহর মাঝে ‘হুজ্জত’ হিসেবে গ্রহণ করেছি।
ইমাম যাহাবি রহ. উল্লেখ করেন, সকল মুসলমান এক শ্রেণিভূক্ত ছিল। খলীফা আবু বকর রাযি. এবং উমর রাযি.-এর যামানা পর্যন্ত দ্বীন পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অতঃপর উমর রাযি.-এর শাহাদতের পর যে ফিতনার দ্বার উন্মুক্ত হলো। সেই ফিতনার বলি হয়ে খলীফা উসমান রাযি. এবং আলী রাযি. শাহাদত বরণ করলেন। একে একে খারেজি, রাফেযি এবং নাসেবিসহ নতুন নতুন ভ্রান্ত দলের সৃষ্টি হলো। দুইশ’ হিজরী পর্যন্ত সময়ে জাহমিয়্যাহ, মুজাসসামাহ, কাদরিয়্যাহ এবং মুতাযিলা মতের উদ্ভব হলো। আব্বাসি খলীফা মামুনের পৃষ্ঠপোষকতায় সে সময় মুতাযিলারা তখন পূর্ণ শক্তি অর্জন করে নিল এবং কুরআনকে ‘মাখলুক’ বলে তাদের মতের ব্যাপক প্রচার শুরু করল।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা হলো, কুরআন আল্লাহর কালাম। এটা মাখলুক নয়। বরং আল্লাহর ইলমের অংশ এবং এটা অনাদী, চিরন্তন।
আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-এর মতো সর্বজনমান্যেয় প্রখ্যাত ধর্মতাত্ত্বিক যখন খলীফা মামুনের দরবারে তার মুতাযিলি মতের বিরুদ্ধে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এ আকিদার কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন খলীফার তখন শোচনীয় অবস্থা। অবশ্য মুহাম্মদ ইবনে নুহ, কাওয়ারেরি, সাজ্জাদাহ ছাড়া উপস্থিত সবাই খলীফার মতই মেনে নিয়েছিল। কয়েকদিনের যুলুমের মাথায় সাজ্জাদাহ এবং কাওয়ারেরিও তাদের মজবুত অবস্থান থেকে টলতে বাধ্য হন। যুলুমের ধকল সইতে না পেরে মুহাম্মদ বিন নুহ শাহাদাত বরণ করেন। খলীফার বিদআতি মতের বিরোধিতা করায় কারাগারে নির্যাতিত হচ্ছিলেন তখন কেবল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.।
অনেকের সমর্থন সত্ত্বেও ‘খালকে কুরআন’ মাসআলায় এক আহমদ ইবনে হাম্বলের বিরুদ্ধ অবস্থান খলীফা মামুনের কাছে অনেক শক্ত ছিল। তাই আহমদ ইবনে হাম্বলকে বশে আনার জন্য নানারকম প্রস্তাব এবং কারাগারে ভয়ঙ্কর রকমের সব শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। ইমাম তাবারী রহ. উল্লেখ করেন, শক্ত রশি দিয়ে তাকে বেধে রাখা হতো, উত্তপ্ত লোহা দিয়ে তাকে ছ্যাকা দেওয়া হতো, রাতে গলায় বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হতো। সময়ে-অসময়েই তাকে করা হতো বেত্রাঘাত। ইতোমধ্যে খলীফা মামুনের মৃত্যু হলো। মৃত্যুর সময় পরবর্তী খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহকে নির্যাতন জারি রাখার নির্দেশ দিয়ে গেল মামুন। ফলে একই রকম জুলুম জারি থাকল আরো অনেকদিন।
ছালেহ ইবনে আহমদ বলেন, ‘খলীফা মামুনের মৃত্যুতে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। বাবার মুক্তির ব্যাপারে আমাদের আশা জেগেছিল। কিন্তু পরবর্তী খলীফা মামুন থেকে ভিন্ন ছিল না।
খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহর শাসনকালে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.কে শাস্তির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। বেত্রাঘাতের আঘাতে তিনি কখনো বেহুঁশ হয়ে যেতেন। তখন তরবারি দিয়ে খুঁচিয়ে তার হুঁশ ফেরানো হতো। খলীফা মু’তাসিম বিল্লাহ তার শাসনকালের শেষের দিকে আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.কে কারামুক্ত করে দেন।
দীর্ঘ আড়াই বছর পর নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন ইমাম আহমদ রহ.। বাড়িতে ফিরলেও দীর্ঘ কারাভোগ এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি চলাফেরার শক্তিই হারিয়ে ফেললেন। হাদিসের দরসও নতুন করে শুরু করতে পারলেন না।
ইতোমধ্যে খলীফা মু‘তাসিমেরও মৃত্যু হল। ক্ষমতায় অধিষ্টিত হলেন খলীফা ওয়াসিক বিল্লাহ। ততদিনে ইমাম আহমদ রহ. সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কারামুক্ত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের দরস এবং নির্বিঘ্ন চলাফেরা খলীফা ওয়াসিক বিল্লাহকে শঙ্কিত করে তুলল। ফলে নতুন ফরমান জারি করা হলো। কেউ ইমাম আহমদ রহ.-এর সাথে সাক্ষাত করতে পারবে না। দরসে হাদিসেরও অনুমতি নেই।
খলীফা ওয়াসিক বিল্লাহর আশঙ্কা ছিল- ইমাম আহমদ রহ.কে ফের কারাবন্দী করে নির্যাতন করা হলে তার মর্যাদা আরও প্রতিষ্ঠিত হবে। অতঃপর ক্ষমতায় এলেন খলীফা মুতাওয়াক্কিল। তিনি ছিলেন আহলে সুন্নাহর অনুসারী। ইমাম আহমদ রহ.কে তিনি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিলেন। বাগদাদে আবার শুরু হল হাদিসের দরস।
ইবরাহিম ইবনে মুহাম্মদ তাইমি রহ. বলেন, তিনজন খলীফাকে তাদের অমর তিনটি কীর্তির জন্য ইসলামের ইতিহাসে বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হয়। ১. ইরতেদাদের ফিতনা নির্মূলের জন্য খলীফা আবু বকর রাযি.কে। ২. উমাইয়্যাদের যুলুমের ধারা বন্ধ করার জন্য খলীফা উমর ইবনে আবদুল আযিয রহ.কে। ৩. খালকে কুরআন সংক্রান্ত বিদআত নির্মূলের জন্য খলীফা মুতাওয়াক্কিলকে।
শত যুলুমের মোকাবেলায় ইমাম আহমদ রহ. যে দৃঢ়তা এবং সবরের পরিচয় দিয়েছেন, ইতিহাসে তা বিরল। হকের প্রশ্নে অনমনীয় এক জীবন তিনি যাপন করে গেছে।
ইমাম আহমদ রহ.কে একবার জিজ্ঞেস করা হলো, হকের প্রশ্নে এমন অবিচল থাকার এমন ধৈর্য ধরার শক্তি এবং হিম্মত আপনি কোত্থেকে লাভ করলেন? উত্তরে ইমাম আহমদ রহ. জানান, আমাকে উদ্দেশ্য করে এক বেদুইন আরব একবার বলেছিলেন, ‘হে আহমদ, হয় শাহাদাতের মৃত্যু বা বেঁচে থাকলে সম্মানের সাথে বেঁচে থেকো।’
‘বেদুইনের এই অমর বাণীটিই আমাকে হকের প্রশ্নে অনমনীয় থাকার সাহস, শক্তি এবং প্রেরণা যুগিয়েছে’।
তথ্যসূত্র: সিয়ারু আলামিন নুবালা, মানাকিবে ইবনে হাম্বল, বিদায়া নিহায়াহ।
******************
সংগ্রহীত পোস্ট
সংগ্রহীত পোস্ট
Comment