১১ই সেপ্টেম্বরের ফেদায়ী অভিযানে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি শাইখ আইমান আয্-যাওয়াহিরী(হাফিজাহুল্লাহ)এর মূল্যবান কিছু নসিহত
শহীদি অভিযানে বের হওয়া প্রত্যেক ভাইয়ের খেদমতে এই হেদায়েতনামা অধম বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র একটি হাদিয়া, যা রবের জান্নাতের দিকে সফরের শেষ স্তরেও তার জন্য পাথেয় হিসেবে কাজে আসবে। ইনশাআল্লাহ তার জন্য দৃঢ়পদ থাকারও মাধ্যম হবে। আমি এই হাদিয়ার বিনিময়ে আমার ফেদায়ী ভাইদের কাছ থেকে কিছুই চাই না। শুধু তাদের অন্তরের গভীরতা থেকে দোয়া চাই, যা আমার মাগফেরাতেরও কারণ হবে। অতএব অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এই হেদায়েতনামা পড়বে। আল্লাহ তা’য়ালা যেন আমাদের অন্তরকে ঈমান দ্বারা ভরপুর করে দেন, শাহাদাতের তামান্না অন্তরে প্রজ্জ্বলিত করে দেন ও খাতেমা বিল খাইর নসিব করেন।
প্রথম মারহালা:
১) মৃত্যুর উপর বাই’আত করবে এবং নিজের অন্তরে ঐ বাই’আতকে নবায়ন করতে থাকবে।
২) উদ্দিষ্ট বিষয়গুলো প্রত্যেক দিক থেকে ভালো করে বুঝে নিবে এবং শত্রুদের পক্ষ থেকে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের আশংকাও রাখবে।
৩) সূরায়ে তাওবা ও সূরায়ে আনফাল পড়বে এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা ফিকির করবে। বিশেষ করে এ বিষয়টি ফিকির করবে যে, আল্লাহ তা’য়ালা শহীদদের জন্য কত স্থায়ী নেয়ামতরাজি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
৪) এই মোবারক কাজের সকল স্তরে শোনা ও মানা তথা আমীরের আনুগত্যকে মজবুতির সাথে আঁকড়ে থাকার কথা ঐ রাতে নিজেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে। কারণ শীঘ্রই তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, যেখানে শতভাগ আনুগত্য থাকা আবশ্যক। সুতরাং তুমি নিজেকে আমীরের কথা শোনা ও মানার জন্য প্রস্তুত রাখবে এবং এই মহান ফরজ বিধান আদায়ের প্রেরণা নিজের মাঝে জাগ্রত রাখবে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন:
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿سورۃ الانفال ٤٦﴾
অর্থ: “আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করো এবং পরস্পর ঝগড়া কোরো না। তাহলে তোমরা (বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে) সাহস হারিয়ে ফেলবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চই আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরাঃ আনফাল-৪৬)
৫) ক্বিয়ামুললাইলের ইহতেমাম করবে এবং খুব চোখের পানি ফেলে রোনাজারীর সাথে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সাহায্য ও মজবুতি চাইবে। স্পষ্ট বিজয় প্রার্থনা করবে এবং কাজের মাঝে সহজতা তলব করবে। এই দোয়া করবে আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদের উপর পর্দা দিয়ে রাখেন।
৬) বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করবে। জেনে রাখো, উত্তম যিকির হলো কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত। আমার জানা মতে এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের ইজমাও রয়েছে। আর আমাদের জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা আসমান-জমিনের স্রষ্টার কালাম। তিনি তো ঐ স্রষ্টা, যার সাক্ষাতের জন্য তোমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছো।
৭) নিজের অন্তরকে পরিষ্কার করে নিবে। সব ধরনের ভেজাল থেকে একে পবিত্র রাখবে। দুনিয়া নামক যা কিছুই আসুক না কেন, তা ভুলে যাবে ও ভুলিয়ে দিবে! খেলার সময় পার হয়ে গেছে। সত্য প্রতিশ্রুতির সময় এসেছে। আমরা জীবনের কত সময় নষ্ট করে ফেলেছি! এখন কিছু সময় আল্লাহর নৈকট্য ও আনুগত্যের জন্য কেন ব্যয় করব না?
৮) পূর্ণ স্বচ্ছ আত্মা নিয়ে এই কাজে অগ্রসর হবে। কারণ এখন তোমার ও তোমার সামনের পবিত্র জীবনের মাঝে মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধান। হৃদয়গ্রাহী এক পবিত্র জীবনের সূচনা করতে চলেছো। শীঘ্রই তুমি সার্বক্ষণিক নেয়ামতরাজি এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম, সিদ্দিকীন, শহীদগণ ও নেককারদের সান্নিধ্য পাবে। আর এ কথা নিশ্চিত যে, তাঁদের চেয়ে উত্তম সাথী-সঙ্গী আর কেউ নেই। আমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তাঁর এই অনুগ্রহের প্রার্থনা করি। সুতরাং তুমি প্রত্যেক কাজে সুধারণা রাখবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক কাজে সুধারণা রাখা পছন্দ করতেন।
৯) কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে কী করবে, কীভাবে দৃঢ়পদ থাকবে এবং কীভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে–এ বিষয়টিও ভালো করে হৃদয়ে গেঁথে নাও। মনে রাখবে! যা কিছু তোমার কাছে পৌঁছার, তা থেকে তুমি বাঁচতে পারবে না। আর যা থেকে তুমি বেঁচে গেছো, তা কিছুতেই তোমার কাছে পৌঁছার ছিল না। আর এই বিশ্বাস রাখো যে, পরীক্ষা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেই হয়। এর মাধ্যমে তিনি তোমার মর্যাদা সমুন্নত করেন ও তোমাদের গুনাহ মুছে দেন। অতঃপর এই বিশ্বাসও রাখো যে, এটা তো কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তারপর এই মসিবত আল্লাহর হুকুমে সরে যাবে। সুতরাং সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে মহা প্রতিদানের উপযুক্ত হয়। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা:
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿ سورۃ آل عمران – ١٤٢﴾
তোমরা কি ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে ফেলবে? অথচ তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে ও কারা ধৈর্যশীল, তা এখনও আল্লাহ পরখ করেননি। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪২)
১০) আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
وَلَقَدْ كُنتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِن قَبْلِ أَن تَلْقَوْهُ فَقَدْ رَأَيْتُمُوهُ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٤٣﴾
তোমরা তো মৃত্যু আসার আগে (হক্ব পথে) মৃত্যু কামনা করছিলে। তা এখন তোমাদের সম্মুখে, যা তোমরা স্বচক্ষে দেখছো। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪৩)
এবং এই ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿سورۃ البقرۃ – ٢٤٩
অর্থ: আল্লাহর হুকুমে বহু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর জয়যুক্ত হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন। সূরাঃ বাক্বারাহ-২৪৯)
এবং এই মোবারক ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
إِن يَنصُرْكُمُ اللَّهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمْ ۖ وَإِن يَخْذُلْكُمْ فَمَن ذَا الَّذِي يَنصُرُكُم مِّن بَعْدِهِ ۗ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٦٠﴾
অর্থ: যদি আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেন, তবে কোনো শক্তি তোমাদের উপর বিজয়ী হওয়ার নেই। আর যদি তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করা ছেড়ে দেন, তবে তিনি ছাড়া কে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? সুতরাং যে প্রকৃত মুমিন, তার উচিৎ আল্লাহর উপরই ভরসা করা। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৬০)
১১) মাসনূন দোয়ার উপর নিয়মিত আমল করার বিষয়টি তুমি নিজেকে ও নিজের সাথীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে। যেমন- সকাল-সন্ধ্যার আযকার, নতুন শহরে প্রবেশের দোয়া, নতুন জায়গায় নামার দোয়া, শত্রুর মোকাবেলার সময়ের দোয়া ইত্যাদি। আর ঐ দোয়াসমূহের অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার প্রতি গুরুত্বারোপ করবে।
১২) ঝাড়-ফুঁকের প্রতি গুরুত্ব দিবে। নিজের উপর, নিজের আসবাবের উপর, নিজের পোশাকের উপর, ছুরির উপর, যন্ত্রপাতি বা অস্ত্রের উপর, নিজের আইডি কার্ডের উপর, পাসপোর্ট, ভিসা, মোট কথা সমস্ত কাগজপত্রের উপর ঝাড়ফুঁক করবে।
১৩) রওয়ানা হওয়ার আগে নিজের অস্ত্রগুলো ভালো করে দেখে নিবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে জবাই করবে, সে যেন নিজের ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেয়। আর নিজের জবাইকৃত জিনিসকে যেন সে কষ্ট না দেয়।”
১৪) নিজের কাপড়-চোপড় ভালোভাবে গুছিয়ে নিবে। কারণ এটা আমাদের পূর্বসূরী নেককারদের তরিকা (আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন)। তাঁরা যুদ্ধের পূর্বে নিজেদের পোশাক ভালোভাবে গুছিয়ে নিতেন।
১৫) ফজরের নামায জামাতের সাথে পড়বে এবং তার প্রতিদান নিয়েও চিন্তা-ফিকির করবে। তারপর যিকিরের এহতেমাম করবে এবং অযু অবস্থায় নিজের রুম থেকে বের হবে।
দ্বিতীয় মারহালা:
ট্যাক্সিতে করে এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার সময় বেশি পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে। যেমন- আরোহণের দোয়া, নতুন এলাকার দোয়া ইত্যাদি।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নামার সময় নতুন জায়গায় অবতরণের দোয়া পড়বে। তারপর যেখানে যেখানে যাবে, সেখানেও এই দোয়াগুলো পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিবে। হাস্যোজ্জ্বল থাকবে। আর এ ব্যাপারে আশ্বস্ত থাকবে যে, আল্লাহ তা’য়ালা ঈমানদারদের সাথে আছেন। তুমি টের না পেলেও ফেরেশতাগণ তোমার হেফাজত করছেন। অতঃপর এই দোয়াগুলো পড়বে
اللہ اعز من خلقہ
اللھم اکفنیھم بما شئت
اللھم انا ندرئ بک فی نحورھم ونعوذ بک من شرورھم
اللھم اجعل لنا من بین ایدیھم سدا امن خلفھم سدا فاغشیناھم فھم لایبصرون
حسبنااللہ ونعم الوکیل
আর এটা পড়ার সময় আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণা অন্তরে রাখবে
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٣﴾
অর্থাৎ: যাদেরকে লোকেরা বলেছে, “তোমাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার জন্য কাফিরদের) বড় দলসমূহ একত্রিত হয়েছে। তাদেরকে ভয় করো।” ফলে এ কথা শুনে তাদের (মুমিনদের) ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা এই উত্তর দিয়েছে, “আমাদের জন্য আল্লাহ-ই যথেষ্ট আর তিনি কতই না উত্তম কর্ম বিধায়ক।”
এই যিকিরসমূহ পড়ার পর দেখবে যে, তোমার কাজ কীভাবে সহজ হয়ে যায়। কারণ আল্লাহ তা’য়ালার ওয়াদা আছে যে, তাঁর যেই বান্দা এই যিকির বলবে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে তিনটি জিনিস দিবেন। যথা:
১. সে আল্লাহ তা’য়ালার নেয়ামত ও অনুগ্রহের সাথে প্রত্যাবর্তন করবে।
২. তার কোনো ক্ষতি হবে না।
৩. সে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির পথে চলবে।
আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা:
فَانقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٣
অর্থ: সুতরাং তার (ঈমান ও ইয়াক্বিন, সততা ও ইখলাসের) ফলে সে আল্লাহর (পক্ষ থেকে) পাওয়া বড় নেয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসলো যে, কোনো (কষ্ট) খারাবী তাকে স্পর্শও করেনি, এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণের মর্যাদাও লাভ করেছে আর আল্লাহ তা’য়ালা মহা অনুগ্রহের অধিকারী। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৩)
মনে রাখবে! শত্রুদের মেশিনারি, অস্ত্র-শস্ত্র, সিকিওরিটি সিস্টেম আর প্রযুক্তি আল্লাহর হুকুম ছাড়া না কোনো উপকারে আসবে, না কোনো ক্ষতি করবে। এজন্যই প্রকৃত ঈমানদারগণ এগুলোকে ভয় পান না। এদেরকে তো আসলে ভয় পায় শয়তানের সঙ্গীরা। এটি শয়তানকে ভয় করারই নামান্তর। শয়তানের সঙ্গী হওয়া থেকে আল্লাহই আমাদের নিজ আশ্রয়ে রাখেন।
আরো মনে রাখবে যে, ভয়-ভীতি হলো বড় এক ইবাদত। এই ইবাদত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই হওয়া চাই। কারণ তিনিই এর মৌলিক হকদার। উল্লেখিত আয়াতসমূহের পর আল্লাহ বলেন:
إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٤﴾
অর্থ: (এখন তোমাদের জানা হয়ে গেছে যে,) প্রকৃতপক্ষে শয়তানই তার বন্ধুদের ব্যাপারে তোমাদেরকে ভয় দেখায়। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৪)
শয়তানের বন্ধু প্রকৃত পক্ষে পশ্চিমা আদর্শ বা কালচারের অনুসারী ঐ সকল ব্যক্তি, যাদের বক্ষে ঐ নাপাক আদর্শের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা জমে আছে। তাদের মন-মস্তিষ্কে ঐ আদর্শের মিছে জাঁকজমকের ভয় ছেয়ে গেছে। আল্লাহ তা’য়ালা তো এই ঘোষণা করেছেন:
فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٤﴾
অর্থ: সুতরাং (ভবিষ্যতে) তোমরা তাদেরকে সামান্য পরিমাণও ভয় করবে না। আর আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা (প্রকৃত পক্ষে) মুমিন হও। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৪)
সুতরাং এ কথা হৃদয়ে ভালোভাবে গেঁথে নিবে যে, ভয়-ভীতি বড় একটি ইবাদত। আর আল্লাহ তা’য়ালার নিকটতম ওলী ও মুমিন বান্দাগণ নিজেদের এক ও একক রব আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত অন্য কাউকে এই ইবাদতের উপযুক্ত মনে করেন না। তাঁর হাতেই তো সকল বস্তুর ধনভাণ্ডার! প্রকৃত ইমানদারগণ এ কথার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন যে, আল্লাহ তা’য়ালা কাফেরদের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে অকেজো করে দিবেন। কারণ আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা আছে:
ذَٰلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ الانفال – ١٨﴾
অর্থ: এই তো গেল মুমিনদের কথা। (আর কাফেরদের ব্যাপারে কথা হলো) আল্লাহ তা’য়ালা কাফেরদের সব ষড়যন্ত্র দুর্বল করে দেন। (সূরাঃ আনফাল-১৮)
এমনিভাবে তোমার জন্য আবশ্যক হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যিকিরের ইহতেমাম করা। উত্তম যিকিরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই যিকিরের ফযিলত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, “যেই ব্যক্তি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” কিন্তু কেউ যেন দেখে বুঝতে না পারে যে, তুমি যিকির করছো। এটা খেয়াল রাখবে।
এ ছাড়াও এই যিকিরেরর ফযিলত বুঝার জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে, এই বাক্যটি তাওহীদ বিশ্বাসের সারাংশ। এমন তাওহীদ, যার দাওয়াতকে সমুন্নত করা ও যার পতাকাতলে ক্বিতাল ও জিহাদ করার জন্য তুমি আপন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছো। এই সেই তাওহীদ, যার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর অনুসারীগণ জিহাদ করেছেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত করতে থাকবে। হাসি-খুশি থাকবে, প্রশস্ততা ও আত্মতৃপ্তির সাথে প্রত্যেক কদম উঠাবে। কারণ তুমি এমন এক কাজে মগ্ন আছো, যা আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। আর এ জন্যই আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশা রাখি যে, এটা এমন এক বরকতময় দিন, যার সন্ধ্যা হবে তোমার জান্নাতে দৃষ্টিনন্দন হুরদের সাথে।
হে যুবক! মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে হাসতে থাকো। কারণ তুমি চিরস্থায়ী জান্নাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছো।
তৃতীয় মারহালা:
বিমানে প্রথম কদম রাখার পূর্বেই আযকার ও দোয়ার ইহতেমাম করবে। হৃদয়ে এ বিষয়টি জাগরুক রাখবে যে, তুমি জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহর একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশ করছো । রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বা এক বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তার চেয়েও উত্তম।”
বিমানে ঢুকে নিজের আসনে বসেও পূর্বে উল্লেখিত দোয়া ও যিকিরগুলো করতে থাকবে। তারপর যখন বিমান ধীরে ধীরে চলতে শুরু করবে, তখন সফরের দোয়া পড়বে। কারণ এখন তোমার প্রকৃত মালিকের দিকে তোমার সফর শুরু হয়ে গেছে। এই বরকতময় সফরের ব্যাপারে তো কিছু বলাই বাহুল্য!
তারপর বিমান যখন আকাশে উঠে নিজস্ব গতিতে চলা শুরু করবে, তখন বুঝে নিবে যে, কাতার ডিঙ্গানোর সময় এসে গেছে। অতএব তখন আল্লাহ তা’য়ালার কিতাবে উল্লেখিত এই দোয়া পড়বে:
رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ البقرۃ – ٢٥٠﴾
অর্থ: “হে আমাদের রব! আমাদেরকে সবরের তাওফীক দান করুন, এবং আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন ও কাফের দলগুলোর উপর আমাদেরকে বিজয় দান করুন।” (সূরাঃ বাক্বারাহ-২৫০)
আর নিম্নের বরকতময় আয়াতে উল্লেখিত দোয়াও ঠোঁটে জারী রাখবে:
وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَن قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٤٧﴾
অর্থ: তাদের মুখ থেকে এ কথাই বেরিয়েছিল, “হে আমাদের রব! আমাদের ভুল-ত্রুটি মা’ফ করে দিন। আমাদের কাজে যা কিছু সীমালঙ্ঘন করেছি, তা ক্ষমা করে দিন। আর আমাদেরকে দৃঢ় পদ রাখুন এবং কাফেরদের মোকাবেলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন।” (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪৭)
তা ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো এই দোয়াও পড়বে:
اللهم منزل الكتاب مجري السحاب هازم الاحزاب اهزمهم وانصرنا عليهم اللهم اهزمهم وزلزلهم
অর্থ: “হে আল্লাহ! হে কিতাব অবতরণকারী, মেঘ-বৃষ্টি সঞ্চালনকারী, দলসমূহকে পরাজিতকারী! তাদেরকে পরাজিত করুন, আমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করুন, হে আল্লাহ! তাদেরকে পরাজিত করুন এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিন।”
এক্ষেত্রে এসে নিজের জন্য ও স্বীয় সাথী-সঙ্গীদের জন্য বিজয়, সাহায্য ও দৃঢ়তার দোয়া করবে। এই দোয়া করবে যে, তোমার টার্গেট যেন সঠিক লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছে এবং শত্রুর গায়ে মারাত্মক আঘাত লাগে। আল্লাহর কাছে এমন শাহাদাত কামনা কর, যেন শাহাদাতের সময় তুমি সম্মুখপানে অগ্রসরমান থাকো, পিছপা হওয়া লোকদের মধ্যে যেন গণ্য না হও, ধৈর্যের সাথে প্রতিদানের নিয়তে শাহাদাতের দিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে থাকো।
তারপর তোমাদের প্রত্যেকেই যেন নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকে। আর এই দায়িত্ব এমন উত্তম পন্থায় আদায় করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে, যেন আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।
এই সময়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে ধরবে, যেমনটি আমাদের পূর্বসূরীগণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে করতেন। অতঃপর যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, সাহসিকতার সাথে বীরের মতো আঘাত করবে। ঐ সকল বীরপুরুষদের মতো সামনে অগ্রসর হবে, যারা দুনিয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চায় না। আর উঁচু আওয়াজে “আল্লাহু আকবার” তাকবীর বলবে। কারণ তাকবীর ধ্বনি কাফেরদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি করে। অতপর আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণার উপর আমল করবে:
فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ ﴿سورۃ آل عمران – ١٢﴾
অর্থ: “সুতরাং তোমরা আঘাত করো তাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে ঘাড়ে এবং জোড়ায় জোড়ায়।” (সূরাঃ আনফাল-১২)
যেই কাফেরকেই হত্যা করবে, তার মাল নিয়ে নিবে। কারণ এটা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্নাত। তবে হ্যাঁ, মাল সংগ্রহ করতে গিয়ে যেন শত্রুদের পাল্টা আক্রমণের ব্যাপারে বেখেয়াল না হয়ে পড়ো।
আর ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কিছু করবে না। বরং নিজের প্রত্যেকটি আঘাত ও প্রত্যেকটি কদম একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করে নিবে। অতঃপর কাফেরদেরকে বন্দী করার সুন্নাতের উপর আমল করবে। তাদেরকে বন্দীও করবে, হত্যাও করবে। যেমনটি আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন:
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُ أَسْرَىٰ حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ ۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ﴿سورۃ الانفال – ٦٧﴾
অর্থ: “জমিনে শত্রুদের রক্ত ব্যাপকভাবে প্রবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো নবীর কাছে যুদ্ধবন্দী থাকাটা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়। তোমরা দুনিয়ার ফায়দা (মাল) চাইছো, অথচ আল্লাহ তা’য়ালা (তোমাদের জন্য) আখেরাত চান।” (সূরাঃ আনফাল-৬৭)
গনিমতের মাল গ্রহণ করতে কিছুতেই ভুলবে না, চাই তা এক কাপ পানি পরিমাণই হোক না কেন। সুযোগ মতো তা নিজেও পান করবে এবং নিজ সাথীদেরকেও পান করাবে।
অতপর যখন সত্য প্রতিশ্রুত সময় এবং তোমার প্রতীক্ষিত মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে, তখন নিজের জামা ছিঁড়ে আল্লাহর রাস্তার এই মৃত্যুর সংবর্ধনায় বক্ষ উন্মুক্ত করে দিবে। আর জবানকে আল্লাহর যিকিরে তরতাজা রাখবে। আর যদি তুমি তোমার কাজের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে টার্গেট অতিক্রম করার বা পূর্ণ হওয়ার কিছু সময় পূর্বে নামায শুরু করে দাও এবং খাতেমাটাও এই অবস্থায় হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! আর এ বিষয়টার প্রতি গুরুত্ব অবশ্যই দিবে, যাতে তোমার শেষ কথা বা বাক্য হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
আশা করা যায় এরপর ইন’শাআল্লাহ আল্লাহর রহমতের ছায়া তলে জান্নাতুল ফেরদাউসে সাক্ষাৎ হবে।
-
‘নাওয়ায়ে আফগান’ ম্যাগাজিন সেপ্টেম্বর-২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত
معرکہ گیارہ ستمبر کے فدائیوں کو امرائے جہاد کا ہدایت نامہ
এর বাংলা অনুবাদ
শহীদি অভিযানে বের হওয়া প্রত্যেক ভাইয়ের খেদমতে এই হেদায়েতনামা অধম বান্দার পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র একটি হাদিয়া, যা রবের জান্নাতের দিকে সফরের শেষ স্তরেও তার জন্য পাথেয় হিসেবে কাজে আসবে। ইনশাআল্লাহ তার জন্য দৃঢ়পদ থাকারও মাধ্যম হবে। আমি এই হাদিয়ার বিনিময়ে আমার ফেদায়ী ভাইদের কাছ থেকে কিছুই চাই না। শুধু তাদের অন্তরের গভীরতা থেকে দোয়া চাই, যা আমার মাগফেরাতেরও কারণ হবে। অতএব অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে এই হেদায়েতনামা পড়বে। আল্লাহ তা’য়ালা যেন আমাদের অন্তরকে ঈমান দ্বারা ভরপুর করে দেন, শাহাদাতের তামান্না অন্তরে প্রজ্জ্বলিত করে দেন ও খাতেমা বিল খাইর নসিব করেন।
প্রথম মারহালা:
১) মৃত্যুর উপর বাই’আত করবে এবং নিজের অন্তরে ঐ বাই’আতকে নবায়ন করতে থাকবে।
২) উদ্দিষ্ট বিষয়গুলো প্রত্যেক দিক থেকে ভালো করে বুঝে নিবে এবং শত্রুদের পক্ষ থেকে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধের আশংকাও রাখবে।
৩) সূরায়ে তাওবা ও সূরায়ে আনফাল পড়বে এবং তার অর্থ নিয়ে চিন্তা ফিকির করবে। বিশেষ করে এ বিষয়টি ফিকির করবে যে, আল্লাহ তা’য়ালা শহীদদের জন্য কত স্থায়ী নেয়ামতরাজি প্রস্তুত করে রেখেছেন।
৪) এই মোবারক কাজের সকল স্তরে শোনা ও মানা তথা আমীরের আনুগত্যকে মজবুতির সাথে আঁকড়ে থাকার কথা ঐ রাতে নিজেই নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে। কারণ শীঘ্রই তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে, যেখানে শতভাগ আনুগত্য থাকা আবশ্যক। সুতরাং তুমি নিজেকে আমীরের কথা শোনা ও মানার জন্য প্রস্তুত রাখবে এবং এই মহান ফরজ বিধান আদায়ের প্রেরণা নিজের মাঝে জাগ্রত রাখবে। আল্লাহ তা’য়ালা ইরশাদ করেন:
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَرَسُولَهُ وَلَا تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ ۖ وَاصْبِرُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿سورۃ الانفال ٤٦﴾
অর্থ: “আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করো এবং পরস্পর ঝগড়া কোরো না। তাহলে তোমরা (বিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে) সাহস হারিয়ে ফেলবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ করো। নিশ্চই আল্লাহ তা’য়ালা ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” (সূরাঃ আনফাল-৪৬)
৫) ক্বিয়ামুললাইলের ইহতেমাম করবে এবং খুব চোখের পানি ফেলে রোনাজারীর সাথে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে সাহায্য ও মজবুতি চাইবে। স্পষ্ট বিজয় প্রার্থনা করবে এবং কাজের মাঝে সহজতা তলব করবে। এই দোয়া করবে আল্লাহ তা’আলা যেন আমাদের উপর পর্দা দিয়ে রাখেন।
৬) বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করবে। জেনে রাখো, উত্তম যিকির হলো কুরআনুল কারীমের তেলাওয়াত। আমার জানা মতে এ বিষয়ে ওলামায়ে কেরামের ইজমাও রয়েছে। আর আমাদের জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে, এটা আসমান-জমিনের স্রষ্টার কালাম। তিনি তো ঐ স্রষ্টা, যার সাক্ষাতের জন্য তোমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছো।
৭) নিজের অন্তরকে পরিষ্কার করে নিবে। সব ধরনের ভেজাল থেকে একে পবিত্র রাখবে। দুনিয়া নামক যা কিছুই আসুক না কেন, তা ভুলে যাবে ও ভুলিয়ে দিবে! খেলার সময় পার হয়ে গেছে। সত্য প্রতিশ্রুতির সময় এসেছে। আমরা জীবনের কত সময় নষ্ট করে ফেলেছি! এখন কিছু সময় আল্লাহর নৈকট্য ও আনুগত্যের জন্য কেন ব্যয় করব না?
৮) পূর্ণ স্বচ্ছ আত্মা নিয়ে এই কাজে অগ্রসর হবে। কারণ এখন তোমার ও তোমার সামনের পবিত্র জীবনের মাঝে মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধান। হৃদয়গ্রাহী এক পবিত্র জীবনের সূচনা করতে চলেছো। শীঘ্রই তুমি সার্বক্ষণিক নেয়ামতরাজি এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম, সিদ্দিকীন, শহীদগণ ও নেককারদের সান্নিধ্য পাবে। আর এ কথা নিশ্চিত যে, তাঁদের চেয়ে উত্তম সাথী-সঙ্গী আর কেউ নেই। আমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তাঁর এই অনুগ্রহের প্রার্থনা করি। সুতরাং তুমি প্রত্যেক কাজে সুধারণা রাখবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক কাজে সুধারণা রাখা পছন্দ করতেন।
৯) কোনো পরীক্ষার সম্মুখীন হলে কী করবে, কীভাবে দৃঢ়পদ থাকবে এবং কীভাবে আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করবে–এ বিষয়টিও ভালো করে হৃদয়ে গেঁথে নাও। মনে রাখবে! যা কিছু তোমার কাছে পৌঁছার, তা থেকে তুমি বাঁচতে পারবে না। আর যা থেকে তুমি বেঁচে গেছো, তা কিছুতেই তোমার কাছে পৌঁছার ছিল না। আর এই বিশ্বাস রাখো যে, পরীক্ষা আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকেই হয়। এর মাধ্যমে তিনি তোমার মর্যাদা সমুন্নত করেন ও তোমাদের গুনাহ মুছে দেন। অতঃপর এই বিশ্বাসও রাখো যে, এটা তো কিছু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তারপর এই মসিবত আল্লাহর হুকুমে সরে যাবে। সুতরাং সৌভাগ্যবান ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহ তা’য়ালার কাছে মহা প্রতিদানের উপযুক্ত হয়। আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা:
أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَعْلَمِ اللَّهُ الَّذِينَ جَاهَدُوا مِنكُمْ وَيَعْلَمَ الصَّابِرِينَ ﴿ سورۃ آل عمران – ١٤٢﴾
তোমরা কি ভেবেছ যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে ফেলবে? অথচ তোমাদের মধ্যে কারা জিহাদ করেছে ও কারা ধৈর্যশীল, তা এখনও আল্লাহ পরখ করেননি। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪২)
১০) আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
وَلَقَدْ كُنتُمْ تَمَنَّوْنَ الْمَوْتَ مِن قَبْلِ أَن تَلْقَوْهُ فَقَدْ رَأَيْتُمُوهُ وَأَنتُمْ تَنظُرُونَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٤٣﴾
তোমরা তো মৃত্যু আসার আগে (হক্ব পথে) মৃত্যু কামনা করছিলে। তা এখন তোমাদের সম্মুখে, যা তোমরা স্বচক্ষে দেখছো। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪৩)
এবং এই ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
كَم مِّن فِئَةٍ قَلِيلَةٍ غَلَبَتْ فِئَةً كَثِيرَةً بِإِذْنِ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ مَعَ الصَّابِرِينَ ﴿سورۃ البقرۃ – ٢٤٩
অর্থ: আল্লাহর হুকুমে বহু ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর জয়যুক্ত হয়েছে। আর আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথেই আছেন। সূরাঃ বাক্বারাহ-২৪৯)
এবং এই মোবারক ঘোষণাও স্মরণ রাখবে:
إِن يَنصُرْكُمُ اللَّهُ فَلَا غَالِبَ لَكُمْ ۖ وَإِن يَخْذُلْكُمْ فَمَن ذَا الَّذِي يَنصُرُكُم مِّن بَعْدِهِ ۗ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُونَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٦٠﴾
অর্থ: যদি আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদেরকে সাহায্য করেন, তবে কোনো শক্তি তোমাদের উপর বিজয়ী হওয়ার নেই। আর যদি তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করা ছেড়ে দেন, তবে তিনি ছাড়া কে তোমাদেরকে সাহায্য করবে? সুতরাং যে প্রকৃত মুমিন, তার উচিৎ আল্লাহর উপরই ভরসা করা। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৬০)
১১) মাসনূন দোয়ার উপর নিয়মিত আমল করার বিষয়টি তুমি নিজেকে ও নিজের সাথীদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে থাকবে। যেমন- সকাল-সন্ধ্যার আযকার, নতুন শহরে প্রবেশের দোয়া, নতুন জায়গায় নামার দোয়া, শত্রুর মোকাবেলার সময়ের দোয়া ইত্যাদি। আর ঐ দোয়াসমূহের অর্থ ও মর্ম নিয়ে চিন্তা-ফিকির করার প্রতি গুরুত্বারোপ করবে।
১২) ঝাড়-ফুঁকের প্রতি গুরুত্ব দিবে। নিজের উপর, নিজের আসবাবের উপর, নিজের পোশাকের উপর, ছুরির উপর, যন্ত্রপাতি বা অস্ত্রের উপর, নিজের আইডি কার্ডের উপর, পাসপোর্ট, ভিসা, মোট কথা সমস্ত কাগজপত্রের উপর ঝাড়ফুঁক করবে।
১৩) রওয়ানা হওয়ার আগে নিজের অস্ত্রগুলো ভালো করে দেখে নিবে। কারণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে জবাই করবে, সে যেন নিজের ছুরি ভালোভাবে ধার দিয়ে নেয়। আর নিজের জবাইকৃত জিনিসকে যেন সে কষ্ট না দেয়।”
১৪) নিজের কাপড়-চোপড় ভালোভাবে গুছিয়ে নিবে। কারণ এটা আমাদের পূর্বসূরী নেককারদের তরিকা (আল্লাহ তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হোন)। তাঁরা যুদ্ধের পূর্বে নিজেদের পোশাক ভালোভাবে গুছিয়ে নিতেন।
১৫) ফজরের নামায জামাতের সাথে পড়বে এবং তার প্রতিদান নিয়েও চিন্তা-ফিকির করবে। তারপর যিকিরের এহতেমাম করবে এবং অযু অবস্থায় নিজের রুম থেকে বের হবে।
দ্বিতীয় মারহালা:
ট্যাক্সিতে করে এয়ারপোর্টের দিকে যাওয়ার সময় বেশি পরিমাণে আল্লাহর যিকির করবে। যেমন- আরোহণের দোয়া, নতুন এলাকার দোয়া ইত্যাদি।
এয়ারপোর্টে পৌঁছে ট্যাক্সি থেকে নামার সময় নতুন জায়গায় অবতরণের দোয়া পড়বে। তারপর যেখানে যেখানে যাবে, সেখানেও এই দোয়াগুলো পড়ার প্রতি গুরুত্ব দিবে। হাস্যোজ্জ্বল থাকবে। আর এ ব্যাপারে আশ্বস্ত থাকবে যে, আল্লাহ তা’য়ালা ঈমানদারদের সাথে আছেন। তুমি টের না পেলেও ফেরেশতাগণ তোমার হেফাজত করছেন। অতঃপর এই দোয়াগুলো পড়বে
اللہ اعز من خلقہ
اللھم اکفنیھم بما شئت
اللھم انا ندرئ بک فی نحورھم ونعوذ بک من شرورھم
اللھم اجعل لنا من بین ایدیھم سدا امن خلفھم سدا فاغشیناھم فھم لایبصرون
حسبنااللہ ونعم الوکیل
আর এটা পড়ার সময় আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণা অন্তরে রাখবে
الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٣﴾
অর্থাৎ: যাদেরকে লোকেরা বলেছে, “তোমাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ করার জন্য কাফিরদের) বড় দলসমূহ একত্রিত হয়েছে। তাদেরকে ভয় করো।” ফলে এ কথা শুনে তাদের (মুমিনদের) ঈমান আরো বেড়ে গেছে এবং তারা এই উত্তর দিয়েছে, “আমাদের জন্য আল্লাহ-ই যথেষ্ট আর তিনি কতই না উত্তম কর্ম বিধায়ক।”
এই যিকিরসমূহ পড়ার পর দেখবে যে, তোমার কাজ কীভাবে সহজ হয়ে যায়। কারণ আল্লাহ তা’য়ালার ওয়াদা আছে যে, তাঁর যেই বান্দা এই যিকির বলবে আল্লাহ তা’য়ালা তাকে তিনটি জিনিস দিবেন। যথা:
১. সে আল্লাহ তা’য়ালার নেয়ামত ও অনুগ্রহের সাথে প্রত্যাবর্তন করবে।
২. তার কোনো ক্ষতি হবে না।
৩. সে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির পথে চলবে।
আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা:
فَانقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ ۗ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٣
অর্থ: সুতরাং তার (ঈমান ও ইয়াক্বিন, সততা ও ইখলাসের) ফলে সে আল্লাহর (পক্ষ থেকে) পাওয়া বড় নেয়ামত ও অনুগ্রহ নিয়ে এভাবে ফিরে আসলো যে, কোনো (কষ্ট) খারাবী তাকে স্পর্শও করেনি, এবং তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির পথ অনুসরণের মর্যাদাও লাভ করেছে আর আল্লাহ তা’য়ালা মহা অনুগ্রহের অধিকারী। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৩)
মনে রাখবে! শত্রুদের মেশিনারি, অস্ত্র-শস্ত্র, সিকিওরিটি সিস্টেম আর প্রযুক্তি আল্লাহর হুকুম ছাড়া না কোনো উপকারে আসবে, না কোনো ক্ষতি করবে। এজন্যই প্রকৃত ঈমানদারগণ এগুলোকে ভয় পান না। এদেরকে তো আসলে ভয় পায় শয়তানের সঙ্গীরা। এটি শয়তানকে ভয় করারই নামান্তর। শয়তানের সঙ্গী হওয়া থেকে আল্লাহই আমাদের নিজ আশ্রয়ে রাখেন।
আরো মনে রাখবে যে, ভয়-ভীতি হলো বড় এক ইবাদত। এই ইবাদত একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর জন্যই হওয়া চাই। কারণ তিনিই এর মৌলিক হকদার। উল্লেখিত আয়াতসমূহের পর আল্লাহ বলেন:
إِنَّمَا ذَٰلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٤﴾
অর্থ: (এখন তোমাদের জানা হয়ে গেছে যে,) প্রকৃতপক্ষে শয়তানই তার বন্ধুদের ব্যাপারে তোমাদেরকে ভয় দেখায়। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৪)
শয়তানের বন্ধু প্রকৃত পক্ষে পশ্চিমা আদর্শ বা কালচারের অনুসারী ঐ সকল ব্যক্তি, যাদের বক্ষে ঐ নাপাক আদর্শের প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা জমে আছে। তাদের মন-মস্তিষ্কে ঐ আদর্শের মিছে জাঁকজমকের ভয় ছেয়ে গেছে। আল্লাহ তা’য়ালা তো এই ঘোষণা করেছেন:
فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٧٤﴾
অর্থ: সুতরাং (ভবিষ্যতে) তোমরা তাদেরকে সামান্য পরিমাণও ভয় করবে না। আর আমাকেই ভয় করো, যদি তোমরা (প্রকৃত পক্ষে) মুমিন হও। (সূরাঃ আলে ইমরান-১৭৪)
সুতরাং এ কথা হৃদয়ে ভালোভাবে গেঁথে নিবে যে, ভয়-ভীতি বড় একটি ইবাদত। আর আল্লাহ তা’য়ালার নিকটতম ওলী ও মুমিন বান্দাগণ নিজেদের এক ও একক রব আল্লাহ তা’য়ালা ব্যতীত অন্য কাউকে এই ইবাদতের উপযুক্ত মনে করেন না। তাঁর হাতেই তো সকল বস্তুর ধনভাণ্ডার! প্রকৃত ইমানদারগণ এ কথার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন যে, আল্লাহ তা’য়ালা কাফেরদের সমস্ত ষড়যন্ত্রকে অকেজো করে দিবেন। কারণ আল্লাহ তা’য়ালার ঘোষণা আছে:
ذَٰلِكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ مُوهِنُ كَيْدِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ الانفال – ١٨﴾
অর্থ: এই তো গেল মুমিনদের কথা। (আর কাফেরদের ব্যাপারে কথা হলো) আল্লাহ তা’য়ালা কাফেরদের সব ষড়যন্ত্র দুর্বল করে দেন। (সূরাঃ আনফাল-১৮)
এমনিভাবে তোমার জন্য আবশ্যক হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” যিকিরের ইহতেমাম করা। উত্তম যিকিরগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এই যিকিরের ফযিলত রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, “যেই ব্যক্তি অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” কিন্তু কেউ যেন দেখে বুঝতে না পারে যে, তুমি যিকির করছো। এটা খেয়াল রাখবে।
এ ছাড়াও এই যিকিরেরর ফযিলত বুঝার জন্য এটা জানাই যথেষ্ট যে, এই বাক্যটি তাওহীদ বিশ্বাসের সারাংশ। এমন তাওহীদ, যার দাওয়াতকে সমুন্নত করা ও যার পতাকাতলে ক্বিতাল ও জিহাদ করার জন্য তুমি আপন ঘর থেকে বের হয়ে এসেছো। এই সেই তাওহীদ, যার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এবং তাঁর অনুসারীগণ জিহাদ করেছেন এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত করতে থাকবে। হাসি-খুশি থাকবে, প্রশস্ততা ও আত্মতৃপ্তির সাথে প্রত্যেক কদম উঠাবে। কারণ তুমি এমন এক কাজে মগ্ন আছো, যা আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার মাধ্যম। আর এ জন্যই আল্লাহ তা’য়ালার কাছে আশা রাখি যে, এটা এমন এক বরকতময় দিন, যার সন্ধ্যা হবে তোমার জান্নাতে দৃষ্টিনন্দন হুরদের সাথে।
হে যুবক! মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে হাসতে থাকো। কারণ তুমি চিরস্থায়ী জান্নাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছো।
তৃতীয় মারহালা:
বিমানে প্রথম কদম রাখার পূর্বেই আযকার ও দোয়ার ইহতেমাম করবে। হৃদয়ে এ বিষয়টি জাগরুক রাখবে যে, তুমি জিহাদ ফি সাবীলিল্লাহর একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশ করছো । রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর রাস্তায় এক সকাল বা এক বিকাল ব্যয় করা দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যবর্তী যা কিছু আছে তার চেয়েও উত্তম।”
বিমানে ঢুকে নিজের আসনে বসেও পূর্বে উল্লেখিত দোয়া ও যিকিরগুলো করতে থাকবে। তারপর যখন বিমান ধীরে ধীরে চলতে শুরু করবে, তখন সফরের দোয়া পড়বে। কারণ এখন তোমার প্রকৃত মালিকের দিকে তোমার সফর শুরু হয়ে গেছে। এই বরকতময় সফরের ব্যাপারে তো কিছু বলাই বাহুল্য!
তারপর বিমান যখন আকাশে উঠে নিজস্ব গতিতে চলা শুরু করবে, তখন বুঝে নিবে যে, কাতার ডিঙ্গানোর সময় এসে গেছে। অতএব তখন আল্লাহ তা’য়ালার কিতাবে উল্লেখিত এই দোয়া পড়বে:
رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ البقرۃ – ٢٥٠﴾
অর্থ: “হে আমাদের রব! আমাদেরকে সবরের তাওফীক দান করুন, এবং আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখুন ও কাফের দলগুলোর উপর আমাদেরকে বিজয় দান করুন।” (সূরাঃ বাক্বারাহ-২৫০)
আর নিম্নের বরকতময় আয়াতে উল্লেখিত দোয়াও ঠোঁটে জারী রাখবে:
وَمَا كَانَ قَوْلَهُمْ إِلَّا أَن قَالُوا رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَإِسْرَافَنَا فِي أَمْرِنَا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ ﴿سورۃ آل عمران – ١٤٧﴾
অর্থ: তাদের মুখ থেকে এ কথাই বেরিয়েছিল, “হে আমাদের রব! আমাদের ভুল-ত্রুটি মা’ফ করে দিন। আমাদের কাজে যা কিছু সীমালঙ্ঘন করেছি, তা ক্ষমা করে দিন। আর আমাদেরকে দৃঢ় পদ রাখুন এবং কাফেরদের মোকাবেলায় আমাদেরকে সাহায্য করুন।” (সূরাঃ আলে ইমরান-১৪৭)
তা ছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো এই দোয়াও পড়বে:
اللهم منزل الكتاب مجري السحاب هازم الاحزاب اهزمهم وانصرنا عليهم اللهم اهزمهم وزلزلهم
অর্থ: “হে আল্লাহ! হে কিতাব অবতরণকারী, মেঘ-বৃষ্টি সঞ্চালনকারী, দলসমূহকে পরাজিতকারী! তাদেরকে পরাজিত করুন, আমাদেরকে তাদের উপর বিজয় দান করুন, হে আল্লাহ! তাদেরকে পরাজিত করুন এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দিন।”
এক্ষেত্রে এসে নিজের জন্য ও স্বীয় সাথী-সঙ্গীদের জন্য বিজয়, সাহায্য ও দৃঢ়তার দোয়া করবে। এই দোয়া করবে যে, তোমার টার্গেট যেন সঠিক লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছে এবং শত্রুর গায়ে মারাত্মক আঘাত লাগে। আল্লাহর কাছে এমন শাহাদাত কামনা কর, যেন শাহাদাতের সময় তুমি সম্মুখপানে অগ্রসরমান থাকো, পিছপা হওয়া লোকদের মধ্যে যেন গণ্য না হও, ধৈর্যের সাথে প্রতিদানের নিয়তে শাহাদাতের দিকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে থাকো।
তারপর তোমাদের প্রত্যেকেই যেন নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত থাকে। আর এই দায়িত্ব এমন উত্তম পন্থায় আদায় করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করবে, যেন আল্লাহ তা’য়ালা তোমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান।
এই সময়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে ধরবে, যেমনটি আমাদের পূর্বসূরীগণ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বক্ষণে করতেন। অতঃপর যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, সাহসিকতার সাথে বীরের মতো আঘাত করবে। ঐ সকল বীরপুরুষদের মতো সামনে অগ্রসর হবে, যারা দুনিয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করতে চায় না। আর উঁচু আওয়াজে “আল্লাহু আকবার” তাকবীর বলবে। কারণ তাকবীর ধ্বনি কাফেরদের অন্তরে ভয় সৃষ্টি করে। অতপর আল্লাহ তা’য়ালার এই ঘোষণার উপর আমল করবে:
فَاضْرِبُوا فَوْقَ الْأَعْنَاقِ وَاضْرِبُوا مِنْهُمْ كُلَّ بَنَانٍ ﴿سورۃ آل عمران – ١٢﴾
অর্থ: “সুতরাং তোমরা আঘাত করো তাদের প্রত্যেকের ঘাড়ে ঘাড়ে এবং জোড়ায় জোড়ায়।” (সূরাঃ আনফাল-১২)
যেই কাফেরকেই হত্যা করবে, তার মাল নিয়ে নিবে। কারণ এটা মুহাম্মাদ মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি সুন্নাত। তবে হ্যাঁ, মাল সংগ্রহ করতে গিয়ে যেন শত্রুদের পাল্টা আক্রমণের ব্যাপারে বেখেয়াল না হয়ে পড়ো।
আর ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে কিছু করবে না। বরং নিজের প্রত্যেকটি আঘাত ও প্রত্যেকটি কদম একমাত্র আল্লাহর জন্য একনিষ্ঠ করে নিবে। অতঃপর কাফেরদেরকে বন্দী করার সুন্নাতের উপর আমল করবে। তাদেরকে বন্দীও করবে, হত্যাও করবে। যেমনটি আল্লাহ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন:
مَا كَانَ لِنَبِيٍّ أَن يَكُونَ لَهُ أَسْرَىٰ حَتَّىٰ يُثْخِنَ فِي الْأَرْضِ ۚ تُرِيدُونَ عَرَضَ الدُّنْيَا وَاللَّهُ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ۗ وَاللَّهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ﴿سورۃ الانفال – ٦٧﴾
অর্থ: “জমিনে শত্রুদের রক্ত ব্যাপকভাবে প্রবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো নবীর কাছে যুদ্ধবন্দী থাকাটা তাঁর জন্য শোভনীয় নয়। তোমরা দুনিয়ার ফায়দা (মাল) চাইছো, অথচ আল্লাহ তা’য়ালা (তোমাদের জন্য) আখেরাত চান।” (সূরাঃ আনফাল-৬৭)
গনিমতের মাল গ্রহণ করতে কিছুতেই ভুলবে না, চাই তা এক কাপ পানি পরিমাণই হোক না কেন। সুযোগ মতো তা নিজেও পান করবে এবং নিজ সাথীদেরকেও পান করাবে।
অতপর যখন সত্য প্রতিশ্রুত সময় এবং তোমার প্রতীক্ষিত মুহূর্ত ঘনিয়ে আসে, তখন নিজের জামা ছিঁড়ে আল্লাহর রাস্তার এই মৃত্যুর সংবর্ধনায় বক্ষ উন্মুক্ত করে দিবে। আর জবানকে আল্লাহর যিকিরে তরতাজা রাখবে। আর যদি তুমি তোমার কাজের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে টার্গেট অতিক্রম করার বা পূর্ণ হওয়ার কিছু সময় পূর্বে নামায শুরু করে দাও এবং খাতেমাটাও এই অবস্থায় হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! আর এ বিষয়টার প্রতি গুরুত্ব অবশ্যই দিবে, যাতে তোমার শেষ কথা বা বাক্য হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”
আশা করা যায় এরপর ইন’শাআল্লাহ আল্লাহর রহমতের ছায়া তলে জান্নাতুল ফেরদাউসে সাক্ষাৎ হবে।
-
‘নাওয়ায়ে আফগান’ ম্যাগাজিন সেপ্টেম্বর-২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত
معرکہ گیارہ ستمبر کے فدائیوں کو امرائے جہاد کا ہدایت نامہ
এর বাংলা অনুবাদ
Comment