২২৩ হিজরী। আব্বাসী খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ (রাজত্বকাল: ২১৮ থেকে ২২৭ হিজরী) বসে আছেন সিংহাসনে। খলিফার সাক্ষাতপ্রার্থী এক আগন্তুক অনুমতি পেয়ে ভেতরে আসল। ভয় ও আতঙ্কের ছাপ আগন্তুকের চোখে-মুখে। ধূলিমলিন পোশাক। খলিফা জানতে চাইলেন, “কে তুমি? কী সংবাদ এনেছো?”
“জিবাত্রা, মালিতা ও সুমাইসাতে বাইজান্টাইন সম্রাট তোফাইল ইবনে মিখাইল আক্রমণ করে বসতিগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিম যুবকদের জবাই করে ভয়ানকভাবে অঙ্গ-বিকৃত করেছে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাদের চোখ উপড়ে নাক-কান কেটে দিয়েছে। পেট ফেড়ে দিয়েছে।” এতটুকু বলে আগন্তুক থেমে গেল।
খলিফা মুতাসিম বিল্লাহর চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। রাগে ফুঁসতে শুরু করেছেন। চোখ থেকে যেন ঠিকরে পড়ছে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ।
কিছুটা বিরতি টেনে আগন্তুক পুনরায় বলতে শুরু করল, “মুসলিম মা-বোনদের অবাধে ধর্ষণ করেছে। সহস্রাধিক মুসলিম নারীকে ধরে নিয়ে গেছে। এক হাশেমী বোনকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় আমি তাকে চিৎকার করে বলতে শুনেছি: “ওয়া মুতাসিমাহ।” (হে মুতাসিম আমাকে উদ্ধার করো)
খলিফার আপাদমস্তক ঝাঁকুনি দিয়ে উঠেছে। শরীরের লোমগুলো কাটার ন্যায় দাঁড়িয়ে গেছে। খলিফা বসা থেকে বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়ালেন আর চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেনঃ “লাব্বাইক, লাব্বাইক ইয়া উখতাহ।” (হে বোন, আমি সাড়া দিলাম তোমার ডাকে)
খলিফা সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা দিয়ে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে যান। বাগদাদের কাজী আব্দুর রহমান ইবনে ইসহাকসহ আরো ৩৩০ জন নির্ভরযোগ্য সাক্ষীর উপস্থিতিতে নিজের সমুদয় সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ সন্তানদের জন্য, এক তৃতীয়াংশ খাদেমদের জন্য আর এক তৃতীয়াংশ আল্লাহর জন্য ওয়াকফ করে দেন। তারপর বিশাল বাহিনী নিয়ে জিবাত্রা ও মালিতার দিকে যাত্রা করেন। (১)
জুমাদাল উলার ২ তারিখে দিজলার তীরে ঘাঁটি স্থাপন করেন। সেনাপতি উজাইফ ইবনে আনবাসা, উমর আল ফারগানিকে অগ্রবর্তী একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে দ্রুত জিবাত্রা ও মালিতার উদ্দেশ্যে রাওয়ানা করিয়ে দেন। কিন্তু তারা পৌঁছার পূর্বেই বাইজান্টাইন বাহিনী পালিয়ে যায়। আজিফ ইবনে আনবাসা শহরগুলো পুনর্গঠন করেন। পলাতক শহরবাসীকে নিরাপদে ফিরিয়ে আনেন।
এবারের মতো বাইজান্টাইন বাহিনী খলিফার হাত থেকে বেঁচে গেল ঠিক, কিন্তু ইসলামী সাম্রাজ্যে তাদের এমন দুঃসাহসিক আক্রমণের দৃষ্টান্তমূলক প্রতিশোধ গ্রহণ করা খলিফার উপর অপরিহার্য হয়ে পড়ে। নতুবা তাদের সাহস আরও বেড়ে যাবে। অমুসলিমরা ইসলামী সাম্রাজ্যকে দুর্বল ভাবার সুযোগ পেয়ে যাবে। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃত নারীদের মুক্ত করা অবশ্য কর্তব্য।
সার্বিক দিক বিবেচনায়, খলিফা এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সভাসদদের কাছে জানতে চান, বাইজান্টাইনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত শহর কোনটি? উত্তরে সবাই বলে, আম্মুরিয়া হচ্ছে বাইজান্টাইনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত শহর। শহরটি তাদের কাছে অনেক দিক থেকে কনস্টান্টিনোপলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। এখনো পর্যন্ত কোনো মুসলিম শাসক তা জয় করতে পারেন নি।
“আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আম্মুরিয়া। শহরটি আমরা জয় করব,” দ্বিধাহীনচিত্তে খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
টিকা:
(১) ইতিহাসের এই অংশটুকু যখন লিখছি তখন বারবার মনে পড়ছে বোন আফিয়া সিদ্দীকির কথা। চোখ দুটি ঝাপসা হয়ে আসছে শুধু। যেসব শাসকরা নিজেদেরকে মুসলিম শাসক ও মুসলিমদের অভিভাবক বলে দাবী করে- সেরকম এক শাসক-ই আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছিল বোন আফিয়া সিদ্দীকিকে। পাকিস্তান থেকে তুলে নিয়ে তাকে রাখা হয় আফগানিস্তানের বাগরাম কারাগারে। সেখানে তার উপর অবিরাম চলতে থাকে অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন। নির্যাতনের প্রচণ্ডতায় তিনি এমনভাবে চিৎকার করতেন যে, তার অনবরত বিকট চিৎকারের কারণে পাশের সেলগুলোতেও কোনো বন্দী থাকতে চাইত না। বোন আফিয়া সিদ্দীকির মতো না জানি আরো কত অজানা বোন প্রতিনিয়ত একজন মুতাসিমের পথ চেয়ে আছে! কিন্তু আজকের এই পৃথিবীতে একজন মুতাসিমের বড়ই অভাব!
তথসূত্রঃ
(১) https://ar.m.wikipedia.org/wiki/%D9%...B1%D9%8A%D8%A9
(২) তারিখে তাবারী
(৩) তারিখে ইবনে খালদুন
(৪) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া
(৫) আল-কামিল ফিত তারিখ এবং ইতিহাসের উপর রচিত অন্যান্য কিতাব।
আগের পর্বগুলো পড়ুন :
১। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
– https://alfirdaws.org/2022/04/01/56426/
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
– https://alfirdaws.org/2022/04/01/56426/
২। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/05/56473/
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/05/56473/
৩। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
৪। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ ।। পর্ব-৪ ।। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [তৃতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/14/56664/
– https://alfirdaws.org/2022/04/14/56664/
৫। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৫।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(প্রথম কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/18/56729
– https://alfirdaws.org/2022/04/18/56729
৬। বিজয়ের মাস : মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৬।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(দ্বিতীয় কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/23/56840/
– https://alfirdaws.org/2022/04/23/56840/
৭। বিজয়ের মাস; মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৭।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়; আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(শেষ কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/05/01/56964/
– https://alfirdaws.org/2022/05/01/56964/
৮। বিজয়ের মাস; মাহে রামাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।। পর্ব-৮।। ১৩ হিজরীর ১২ রমাদান, ঐতিহাসিক বুওয়াইবের যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অবিশ্বাস্য বিজয়।
– https://alfirdaws.org/2023/03/26/62805/
– https://alfirdaws.org/2023/03/26/62805/
Comment