আমরা ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় সম্পর্কে লিখছি, যখন শত্রুর গায়ে কাঁপন ধরানো দাপট ছিল আমাদের। মুসলিম শাসকের নাম শুনলে যেকোনো অমুসলিম শাসকের রক্ত বরফের মতো শীতল হয়ে আসত। ইসলামী সাম্রাজ্যে আক্রমণ করা কিংবা মুসলিম নারীদের ধরে নিয়ে যাওয়া তো বহুদূরের বিষয়, ইসলামী সাম্রাজ্যের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতেও তাদের বুক কাঁপত। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাইজান্টাইন সম্রাট তোফাইল ইবনে মিখাইলের ইসলামী মানচিত্রে কামড় বসানো ও মুসলিম নারীদের গায়ে হাত তোলার সাহস কীভাবে হলো? খিলাফতের বীর সেনারা-ই বা তখন কী করছিল??
প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পেতে আমাদেরকে ইতিহাসের আরেকটু পেছনে যেতে হবে।
দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী বাবাক খুররামির উত্থান-পতনের গল্প
মাদায়েনের এক সাধারণ পরিবারে ১৮২ হিজরী মোতাবেক ৭৯৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে বাবাক খুররামি। জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও পরবর্তী সময়ে খুররামিয়াহ ফেরকার (১) আদর্শ গ্রহণ করে সে মুশরিক হয়ে যায়। তার শৈশব কাটে আজারবাইজানের বেলালাবাদ শহরে। জন্মের কিছুদিনের মাথায় তার বাবা মারা যায়। তাই ছোট থেকেই বিভিন্ন আমীর-উমারাদের ঘরে কাজ করে বড় হতে থাকে বাবাক খুররামি। সেই সুবাদে আজারাবাইজানের একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল ‘বায’ এর শাসক এবং খুররামিয়াহ ফেরকার একজন গুরু জাভেদানের ঘরে সে কাজ পায়। নিজের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা, কর্মদক্ষতা, বিচক্ষণতা ও একনিষ্ঠতার দরুণ সে খুব দ্রুত জাভেদানের নৈকট্য অর্জন করে ফেলে। কথিত আছে, জাভেদানের স্ত্রীর সাথেও তার গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা উভয়ে মিলে বিষপানে জাভেদানকে হত্যা করে।
ঘটনা যাই হোক; আকস্মিকভাবে জাভেদান মৃত্যুবরণ করে। তার আকস্মিক মৃত্যুর পর তার রাজ্য-রাজত্ব ও শিষ্যদের উপর একচ্ছত্র আধিপত্য লাভ করে বাবাক খুররামি। ধীরে ধীরে আজারবাইজানে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকে সে। প্রথমদিকে শুধু আজারবাইজানের বাদিন পাহাড়ে তার ঘাঁটি থাকলেও তার ক্রমবর্ধামান শক্তির অশুভ প্রভাব একসময় পার্শ্বস্থ মুসলিম দুর্গগুলোর উপর খুব খারাপভাবে পড়তে থাকে। আজারবাইজানের বিভিন্ন অঞ্চলে তার ভ্রান্ত চিন্তাও ছড়িয়ে পড়তে থাকে খুব দ্রুত। নিকটবর্তী মুসলিমদের উপর চলতে থাকে নির্মম নির্যাতন। একসময় শক্তিশালী আব্বাসী খেলাফতের বিরুদ্ধে সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
বাবাক খুররামির উত্থান শুরু হয় ২০১ হিজরী মোতাবেক ৮১৬ খ্রিস্টাব্দে। খলিফা মামুনুর রশীদের শাসনামল তখন। আজারবাইজানে একের পর এক দুর্গ দখল ও মুসলিমদের উপর অত্যাচারের দুঃসংবাদ যখন বাগদাদে আসতে থাকে তখন খলিফা মামুনুর রশীদ নতুন এই বিদ্রোহের ব্যাপারে পূর্ণ মনোযোগী হন। কিন্তু ততদিন দিজলা-ফুরাতের পানি গড়িয়ে গেছে অনেকদূর। আজারবাইজানের বাবাক খুররামি আব্বাসী খেলাফতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খলিফা মামুনুর রশীদ নিজের বাছাই করা সেনাপতিদের পাঠাতে শুরু করেন আজারবাইজানে। ২০৪ হিজরীতে সেনাপতি ইয়াহয়া ইবনে মুয়ায, ২০৫ হিজরীতে ঈসা ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে আবি খালিদ, ২০৯ হিজরীতে সেনাপতি যারিক ও আহমাদ ইবনে জুনাইদকে বাবাকের বিরুদ্ধে অভিযানে পাঠান।
কিন্তু তাদের কেউই খলিফাকে সাফল্যের মুখ দেখাতে পারেন নি। আহমাদ ইবনে জুনাইদ বাবাকের হাতে নিহত হন। খলিফা মামুন নতুন করে ইবরাহীম ইবনে লাইসকে অভিযানে পাঠান। তিনিও ব্যর্থ হন। অবশেষে ২১২ হিজরীতে পাঠান সকলের আস্থাভাজন সেনাপতি মুহাম্মাদ ইবনে হামীদ তুসীকে। মুহাম্মাদ ইবনে হামীদ তুসী ও বাবাক খুররামির মাঝে গুরুতর লড়াই সঙ্ঘটিত হয়। প্রথমদিকে বাবাক কিছুটা পিছু হটলেও শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদ ইবনে হামীদ তুসী পরাজিত হন। বাবাক তাকেও হত্যা করে ফেলে।
এভাবে খলিফা মামুনুর রশীদের প্রেরিত সেনাপতিরা একে একে নিহত হতে থাকেন বাবাকের হাতে। আব্বাসী খেলাফতের জন্য বাবাক খুররামি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। নামজাদা সেনাপতিদের একে একে পরাজিত করে বাবাক খুররামি হয়ে ওঠে ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ বিদ্রোহী৷
২১৮ হিজরীতে খলিফা মামুনুর রশীদ মারা যান। পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত হন তার ভাই মুতাসিম বিল্লাহ। ২২২ হিজরীতে খলিফা মুতাসিম বিল্লাহ বিচক্ষণ সেনাপতি আফশিনের নেতৃত্বে বিশাল এক বাহিনী প্রেরণ করেন বাবাক খুররামির বিরুদ্ধে। সেনাপতি আফশিনের শক্তিশালী আক্রমণের সামনে বাবাক পিছু হটতে বাধ্য হয়। আফশিন আরও সামনে এগিয়ে যান। একসময় বাবাক খুররামিকে অবরোধের ভেতর নিয়ে আসতে সক্ষম হন তিনি। অবরোধ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে। বাবাক বুঝতে পারে, তার খেলা শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও তার কুটিল মস্তিষ্কে খেলা করে নতুন কিছু। বাঁচার জন্য তূণীর শেষ তিরটিও সে নিক্ষেপ করে।
কবুতরের পায়ে একটি চিঠি দিয়ে বাবাক তা পাঠিয়ে দেয় বাইজান্টাইন সম্রাট তোফাইলের কাছে। চিঠিতে লেখা ছিল- “মহামান্য সম্রাট! তোমার জন্য আমি নিবেদিত প্রাণ। খলিফার সকল সৈন্যকে আমি আটকে রেখেছি আমার আস্তানায়। সাম্রাজ্যের সীমান্ত উন্মুক্ত করে দিয়েছি তোমার জন্যে। এই সুযোগে তুমি ইসলামি সাম্রাজ্যে মরণ-কামড় বসাও।” ধূর্ত বাবাক ভেবেছিল, তোফাইল সীমান্তে আক্রমণ করলে তার অবরোধে শৈথল্য আসবে। এই সুযোগে সে পালিয়ে যাবে।
খিলাফতের ভেতরেই খিলাফতের এত বড় দুশমনের মাথাচাড়া দিয়ে উঠার সংবাদটি গোপন ছিল না। আরও আগেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল বহির্বিশ্বে। খিলাফতের ভেতরগত দুর্বলতা থেকে ফায়েদা হাসিলের সুযোগকে হাতছাড়া করতে চায় নি বাইজান্টাইনের সম্রাট তোফাইল ইবনে মিখাইল। তদুপরি যখন স্বয়ং বাবাকের পক্ষ থেকে তার কাছে চিঠি আসলো, তখন সে লক্ষাধিক সেনার সমাবেশ ঘটায় এবং জিবাত্রা, মালিতা, সুমাইসিত ও আশপাশের শহরগুলোতে আক্রমণ করে বসে। কিন্তু তার এই সিদ্ধান্ত কত বড় ভুল ছিল, তা বুঝতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
টিকা:
(১) এই ফেরকার অনুসারীরা মনে করত পৃথিবীতে দুজন সৃষ্টিকর্তা আছেন। একজন ভালো বিষয়ের দেখভাল করেন আর অপরজন খারাপ বিষয়ের দেখভাল করেন।
তথসূত্রঃ
(১) তারিখে তাবারী
(২) তারিখে ইবনে খালদুন
(৩) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া
(৪) আল-কামিল ফিত তারিখ এবং ইতিহাসের উপর রচিত অন্যান্য কিতাব।
আগের পর্বগুলো পড়ুন :
১। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
– https://alfirdaws.org/2022/04/01/56426/
|| পর্ব-১ ||
সারিয়্যায়ে হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব: ইসলামের প্রথম যুদ্ধাভিজান
– https://alfirdaws.org/2022/04/01/56426/
২। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/05/56473/
|| পর্ব-২ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিজান [প্রথম কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/05/56473/
৩। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
|| পর্ব-৩ ||
ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [দ্বিতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/09/56561/
৪। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ ।। পর্ব-৪ ।। ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ: ইসলামের প্রথম বিজয়াভিযান [তৃতীয় কিস্তি]
– https://alfirdaws.org/2022/04/14/56664/
– https://alfirdaws.org/2022/04/14/56664/
৫। বিজয়ের মাস: মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৫।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(প্রথম কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/18/56729
– https://alfirdaws.org/2022/04/18/56729
৬। বিজয়ের মাস : মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৬।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়: আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(দ্বিতীয় কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/04/23/56840/
– https://alfirdaws.org/2022/04/23/56840/
৭। বিজয়ের মাস; মাহে রমাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।।পর্ব-৭।। ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়; আরব উপদ্বীপে পৌত্তলিকদের নাপাক আধিপত্যের অবসান।(শেষ কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2022/05/01/56964/
– https://alfirdaws.org/2022/05/01/56964/
৮। বিজয়ের মাস; মাহে রামাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ।। পর্ব-৮।। ১৩ হিজরীর ১২ রমাদান, ঐতিহাসিক বুওয়াইবের যুদ্ধে পারস্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অবিশ্বাস্য বিজয়।
– https://alfirdaws.org/2023/03/26/62805/
– https://alfirdaws.org/2023/03/26/62805/
৯। বিজয়ের মাস; মাহে রামাদানের গৌরবদীপ্ত বিজয়-সিরিজ || পর্ব-৯ || ২২৩ হিজরীর ৬ রমাদান, বাইজান্টাইনের সর্বাধিক সুরক্ষিত ও অজেয়-খ্যাত আম্মুরিয়া শহর বিজয়। (প্রথম কিস্তি)
– https://alfirdaws.org/2023/04/02/62870/
– https://alfirdaws.org/2023/04/02/62870/