দারুল ইরফান কর্তৃক প্রকাশিত
কা‘ব বিন মালেক রাযি. এর ঘটনা থেকে শিক্ষা
শায়খ আবু আব্দুল্লাহ উসামা রহ.
এর থেকে
পর্ব-২
কা‘ব বিন মালেক রাযি. এর ঘটনা থেকে শিক্ষা
শায়খ আবু আব্দুল্লাহ উসামা রহ.
এর থেকে
পর্ব-২
================================================== ===============================
হযরত কা‘ব রাযি. এর মর্যাদা
কা‘ব বিন মালিক রাযি. এ হাদীস তাবুক যুদ্ধের প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন। তিনি এ যুদ্ধে ‘যাচ্ছি করে’ আর যেতে পারেননি। অথচ তিনি পূর্ববর্তী অগ্রগামী আনসারদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং সেই মহান লোকদের একজন ছিলেন যারা ‘বাইয়াতে আকাবা’ এর দিন রাসূলুল্লাহ সা-এর. বরকতময় হাতে বাইআত করার সৌভাগ্য লাভ করে ছিলেন। এটা সেই মহান বাইআত যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহর অনুগ্রহে মদীনা মুনাওয়ারায় ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমরাও তো সেই বরকতময় ফলসমূহের একটি ফল।
হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সকল যুদ্ধ করেছেন তার মধ্যে তাবুকের যুদ্ধেই আমি তাঁর পিছনে রয়ে গিয়ে ছিলাম (অংশ গ্রহণ করতে পারিনি)। তবে বদর যুদ্ধেও শরীক হতে পারিনি। কিন্তু বদর যুদ্ধে যারা শরীক হয়নি তাঁদেরকে তিনি তিরস্কার করেন নি। অর্থাৎ, তিনি বীর বাহাদুর ছিলেন। বদর ব্যতীত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঙ্গে সকল যুদ্ধে শরীক ছিলেন, এবং তিনি তাদের একজন ছিলেন, যারা রণাঙ্গনে বীরত্বের সাথে লড়াই করত এবং দ্বীনের জন্য স্বীয় কুরবানি পেশ করত।
সৎ লোকদেরকে জিহাদ থেকে ফিরিয়ে রাখার জন্য নফসের চক্রান্ত
তবে মানুষ, মানুষই। কখনো শয়তান পথভ্রষ্ট করে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে সে নিজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তার নফস তাকে প্রতারণায় ফেলে দেয়। সাইয়্যেদুনা কা‘ব বিন মালিক রাযি. এই বিষয়টিকে স্পষ্ট ভাবে বর্ণনা করেন।
তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন সময় যুদ্ধের ডাক দিলেন যখন গরমের মৌসুম যৌবনকাল অতিক্রম করছিল। এবং লোকেরা অধিকাংশ সময় খেজুর বৃক্ষের ছায়ায় সময় কাটাত। খেজুর পরিপক্ব হয়ে পাকতে শুরু করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমি এই ঠাণ্ডা ছায়া এবং ফলের প্রতি বেশ আকৃষ্ট ছিলাম।’এই হল মানবীয় আত্মার সেই ভয়ানক প্রতারণা যার উপস্থিতি আমরা ঐ মহান ব্যক্তিদের মাঝেও দেখতে পাই (রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)। সুতরাং যদি এ মহান ব্যক্তিদের মাঝে (জিহাদ থেকে) পিছিয়ে থাকার ব্যাপারে নফসানি প্রতারণা কাজ করতে পারে যাদের ঈমানের সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন, তাহলে আজকে কিছু ভালো মানুষ জিহাদ না করলে কেনই বা আশ্চর্য লাগবে?
বুখারী ও মুসলিমের এ হাদিস সুস্পষ্টভাবে আমাদেরকে বলছে যে, ঐ মহান ব্যক্তিরাও (জিহাদ থেকে) পিছনে রয়ে গিয়েছিলেন, যারা আমাদের চেয়ে এবং আজকের ঐ ভালো লোকদের তুলনায় অনেক অনেক বেশী মর্যাদাবান ছিলেন।
হযরত কা‘ব রাযি. বলেন, ‘লোকেরা (তাবুক যুদ্ধের) প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগল। আমিও আমার প্রস্তুতির চিন্তা করলাম কিন্তু প্রথম দিন অতিবাহিত হয়ে গেল আমি কোন প্রস্তুতি নিলাম না। আমি মনে মনে ভাবলাম যে, আগামীকাল প্রস্তুতি নিয়ে নিব, কিন্তু পরের দিনও কোন প্রস্তুতি নিতে পারলাম না। অতঃপর আমি ভাবলাম যে, (কোন ব্যাপার না!) আমি এখনো সহজেই তাদের সাথে মিলিত হওয়ার সক্ষমতা রাখি।’
লক্ষ্য করুন! নফস কিভাবে মানুষকে প্রতারণায় ফেলে দেয়। যেহেতু তিনি জিহাদে অভ্যস্ত ছিলেন এজন্য নফস তাকে একথা বুঝিয়েছে যে, জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ তো আপনার জন্য সাধারণ ব্যাপার, আপনি এখনো সহজেই বের হওয়ার সক্ষমতা রাখেন।
তিনি বলেন, ‘আমি এই (দোদুল্যমান) অবস্থায়ই ছিলাম, অপরদিকে বাহিনী রওয়ানা হয়ে গেছে। এবং মর্যাদা ও মহত্মের বাহক সে কাফেলা গন্তব্য অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেছে। যার সেনা প্রধান ছিলেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন হযরত আবু বকর রাযি., হযরত উমর রাযি. এবং অন্যান্য মহান সাহাবীগণ।’ অধিকাংশ ঐতিহাসিকদের মতে, এ সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি ছিল।
এক্ষেত্রে সকল মুসলমানকে নফসের ধোঁকার ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। কারণ দ্বীনের সাহায্য ছেড়ে কত লোকই না ঘরে বসে আছে। যাদেরকে নফস এই ধোঁকায় ফেলে রেখেছে যে, সে ইচ্ছা করলেই জিহাদে বের হতে পারবে। অথবা তার পিতা, তার অভিভাবক বা তার মুরব্বি চাইলেই সে বের হতে পারবে। কিন্তু এই মুহূর্তে বের না হওয়াই ইসলামের জন্য মাসলাহাত ও কল্যাণ।
অথচ এটা বাস্তব কথা নয়। শুধু তাদের ধারণা মাত্র। আর নিঃসন্দেহে সৎ ও পুণ্য কাজের ক্ষমতা এবং মন্দ কাজ থেকে বাঁচার তাওফিক শুধু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকেই আসে।
বিলাসিতা ও নফসের ধোঁকা থেকে নির্ভয়তা
সুতরাং এ মহান ব্যক্তিকে তাঁর নফস ধোঁকায় ফেলে দিয়েছে। অথচ তিনি বহুবার নিজেকে যুদ্ধ এবং রণাঙ্গনে পরখ করে দেখেছেন। আর আনসারগণ তো এমনিতেও যুদ্ধবাজ লোক ছিলেন; যুদ্ধ-বিগ্রহের বৈশিষ্ট্য তাঁরা বংশ পরম্পরায় লাভ করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর নফস তাঁকে ধোঁকায় ফেলে দিল। অতএব, নিজেরাই চিন্তা করুন, যখন তাঁদের (সাহাবাদের) ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে, তাহলে সেসব লোকদের পরিণতি কি হতে পারে যারা কখনো আল্লাহর পথে লড়াইয়ের জন্য বের হয়নি? এমন লোকদের নফসের ধোঁকায় পড়ে থাকা কি আরও সহজ ব্যাপার নয়? তাদের (সাহাবীদের) জীবন তো এমনিতেও দুঃখ-কষ্টে ভরা ছিল! না বিদ্যুৎ ছিল, না ছিল অন্য কোন ভোগ সামগ্রী। শুধুমাত্র খেজুর পরিপক্ব হওয়ার উপক্রম ছিল। এ বিষয়টিই তাকে অলস বানিয়েছিল। জিহাদ থেকে বিরত রেখেছিল।
তাহলে সেসব লোক কিভাবে নফসের ফাঁদে পা দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারে যাদের কাছে ভোগ-বিলাসের সামগ্রী ভরপুর। এমনকি তারা বৈধতার সীমা পেরিয়ে বিলাসিতার সীমায় অনুপ্রবেশ করে ফেলেছে! একটু নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করুন! কিভাবে সম্ভব যে, এমন লোক নফসের ধোঁকা থেকে বেঁচে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে রক্ষা করতে চান তার কথা ভিন্ন।
মোট কথা, অন্য সকল সাহাবীগণ বের হয়ে পড়লেন। এবং হযরত কা‘ব রাযি. থেকে এই ত্রুটি হয়ে গেল। তিনি দ্বীনের সাহায্য থেকে পিছনে রয়ে গেলেন।
বিষয়টি অনুধাবন করা প্রয়োজন
প্রচণ্ড গরমের মৌসুম ছিল, অন্য এক বর্ণনায় হযরত উমর রাযি. এই গরমের প্রচণ্ডতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন,
‘আমাদের কেউ যখন তার বাহনের নিকট যেত তখন তার কাছে মনে হত যে, বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হওয়া এবং গরমের তীব্রতার কারণে তার গর্দান নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।’
এমন মুহূর্তে অভ্যাস অনুযায়ী দুনিয়াদাররা ঐসব কথাই বলেছে যা আজও তারা বলে থাকে। কুরআনে হাকিম তাদের একথা বর্ণনা করেছে,
وَقَالُوا لا تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ
“এবং তারা বলতে লাগল যে, (এমন প্রচণ্ড) গরমে অভিযানে যেও না।“
কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে এর চেয়ে বড় বাস্তবতা উল্লেখ করেছেন, “এবং তারা বলতে লাগল যে, (এমন প্রচণ্ড) গরমে অভিযানে যেও না।“
قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ
“বলে দিন, জাহান্নামের আগুন এর চেয়ে অধিক গরম! হায়! তারা যদি একথা বুঝত।“ [1]
এ দুনিয়াদাররা তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস শুনত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর খুতবাতে উপস্থিত হত এবং ভাল করেই জানত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সাথে তাদের ভাষায়ই কথা বলতেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তারপরও বলছেন যে, হায় যদি তারা একথার মর্ম বুঝত! কেন? কেননা, প্রকৃত বুঝ অন্তরের অনুধাবন এবং ভয়কে বলা হয়। এই প্রকৃত বুঝ থেকে তারা বঞ্চিত ছিল। বাহ্যিকভাবে তো একথাগুলোর পূর্ণজ্ঞান তাদের ছিল। কিন্তু যদি তারা প্রকৃত বুঝ রাখত, তাহলে একথা বিশ্বাস করত যে, জাহান্নামের আগুন দুনিয়ার এই গরম এবং কষ্ট থেকে প্রচণ্ড তীব্র।
আজ আমাদের ভাইদেরকে কি বলা হয়? তাদের একথা বলা হয় যে, যখন তোমরা জিহাদের ময়দান থেকে ফিরে আসবে তখন ’বেত্রাঘাত’ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। এবং তাগুতী কয়েদ খানার চাবুকগুলো অনেক শক্ত হয়ে থাকে! তাদের কাছে বলা হয় যে, বিভিন্ন গোয়েন্দা এজেন্সি তোমাদের পিছনে লেগে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরাও তাদেরকে এ কথাই বলবো যে,
قُلْ نَارُ جَهَنَّمَ أَشَدُّ حَرًّا لَوْ كَانُوا يَفْقَهُونَ
অর্থাৎ, “জাহান্নামের আগুন এর চেয়ে প্রচণ্ড তীব্র গরম! হায় যদি তারা এ কথার বুঝ রাখত।“ [2]
আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করি যে, তিনি আমাদের সবাইকে সহীহ ইলম এবং বুঝ শক্তি দান করুন! অর্থাৎ, “জাহান্নামের আগুন এর চেয়ে প্রচণ্ড তীব্র গরম! হায় যদি তারা এ কথার বুঝ রাখত।“ [2]
[1] সূরা তাওবা: ৮১
[2] সূরা তাওবা: ৮১
আরও পড়ুন
Comment