ইসলামের তারকাগণ| পর্ব: ১২ |
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (শেষ পর্ব)
হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু (শেষ পর্ব)
মুরতাদবিরোধী যুদ্ধ ও হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর শাসনামলে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ মুরতাদবিরোধী যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুনাফিকরা দ্বীনের উপর আঘাত হানার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতকে মনে করে সুবর্ণ সুযোগ। এদের কেউ নিজেকে নবী দাবি করে বসে। কেউ আবার যাকাত অস্বীকার করে। কেউ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মোটকথা চতুর্দিকে বিশৃংখলা ছড়িয়ে পড়ে। ফিতনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। আর ইসলামবিরোধীরা মোক্ষম সুযোগ ভেবে সেই আগুনে হাওয়া দিতে থাকে।
ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সাহসিকতার সাথে এসকল ফিতনা মোকাবিলা করেছেন। উক্ত ফিতনা নির্মূলে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু জোরালো ভূমিকা রাখেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত তখন তুলাইহা ইবনে খুওয়াইলিদ আল আসাদী নিজেকে নবী বলে ঘোষণা করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর বিভিন্ন গোত্র তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। তখন পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এই ফিতনা নির্মূলের জন্য হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন। তুলাইহার বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। তুলাইহা পালিয়ে শামে চলে যান। অবশ্য পরবর্তীতে তিনি ইসলামে ফিরে এসেছিলেন। পরবর্তীতে পারসিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর যুগে শাহাদাতবরণ করেন।
যাইহোক, তুলাইহা পালিয়ে যাওয়ার পর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ পরাজিতদের ধাওয়া করে হত্যা করতে থাকেন। এসময় তাদের অনেকেই আবার ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
তুলাইহার বাহিনীকে দমন করার পর তিনি মালেক ইবনে নুয়াইরা ও তার সঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযানে বের হন। এরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল। সে যখন হযরত খালিদের আগমন সম্পর্কে জানতে পারে তখন সে তার গোত্রের লোকদের গ্রেফতার এড়াতে যার যেদিকে ইচ্ছা, পালিয়ে যেতে বলে। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ তাকে তার গোত্রের কয়েকজনের সাথে বন্দি করতে সমর্থ হন। যেই রাতে তাদেরকে বন্দী করা হয় সেই রাতে প্রচন্ড শীত পড়েছিলো। শীতে বন্দিদের যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য করে, হযরত খালিদ প্রহরীদেরকে বললেন ‘আদফিঊ আসরাকুম’। বাক্যটির সাধারণ অর্থ হলো ‘বন্দিদের জন্য উষ্ণতার ব্যবস্থা করো’। প্রহরীরা ছিল কিনানা গোত্রের। তাদের ভাষারীতি অনুযায়ী বাক্যটির অর্থ হল ‘বন্দিদেরকে হত্যা কর’।
তারা বন্দিদের হত*্যা করতে শুরু করে। হযরত খালিদ যখন বিষয়টি জানতে পারেন তখন বন্দিদের কেউ আর বেঁচে নেই।
হযরত খালিদ অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের বিরূপ প্রভাব কিছুটা হলেও লাঘব করার চেষ্টা করেছেন। তিনি নিহত মালিক ইবনে নুয়াইরার বিধবা স্ত্রীকে নিজেই বিবাহ করে নেন।
মুসাইলামা কাযযাব
যারা নবী দাবি করেছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক ও বড় হুমকি ছিল মুসাইলামা। তার সহযোগী ও সৈন্য সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ মুসাইলামাকে দমন করার জন্য বের হন। উভয় পক্ষের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। বনু হানীফা ও মুসাইলামার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধে 370 জনের বেশি মুহাজির ও আনসার শাহাদাতবরণ করেন। তাদের অধিকাংশই ছিলেন নবুওয়াতের প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারী এবং কুরআনে হাফেজ। এত অধিক সংখ্যক কোরআনে হাফেজ শাহাদাতবরণের ফলে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর আশংকা হয় যে, এভাবে কুরআন হারিয়ে যেতে পারে। তাই তিনি কুরআন সংকলন করার উদ্যোগ গ্ৰহণ করেন।
ইরাকে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ এর বিজয়াভিযান:
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের পর মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এসকল ফেতনা ইসলামের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হযরত আবু বকর শক্তহাতে এসব ফিতনা নির্মূল করেন। বার হিজরীর শুরুর দিকে (৬৩৩ইং) মুসলিম বিশ্বের সীমানা ঝুঁকিমুক্ত করতে এবং মুসলিমদের শত্রু পারসিকদের হুমকিমুক্ত করতে হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ইরাকের দিকে মনোযোগ দেন। এই লক্ষ্যে সর্বপ্রথম তিনি হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদকে প্রেরণ করেন। তিনি পারসিকদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জনের পর হিরা অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হন। অল্পতেই তিনি হিরা জয় করেন। তারা জিযিয়া প্রদান করতে সম্মত হয়। এভাবে তার বিজয়াভিযান অব্যাহত থাকে এবং ইরাকের বড় একটি অংশ মুসলমানদের অধিকারে চলে আসে।
তারপর আম্বার বিজয়ের জন্য অগ্রসর হন। আম্বারবাসী দুর্গে আশ্রয় নেয়। দুর্গের চারপাশে ছিল গভীর পরিখা। দুর্গ প্রাচীরের উপর থেকে চলছিল তীরবৃষ্টি। মুসলিমরা কিছুতেই পরিখা অতিক্রম করতে পারছিলেন না। কিন্তু হযরত খালিদ দমার পাত্র ছিলেন না। তিনি মুসলিম যোদ্ধাদেরকে প্রাচীরের উপর থাকা প্রহরীদের চোখ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপের আদেশ করেন। এতে প্রায় 1000 চোখ আক্রান্ত হয়। তারপর হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ দুর্বল উটগুলো জবাই করে পরিখার তুলনামূলক সংকীর্ণ একটি অংশ ভরাট করে ফেলেন। প্রাচীরের উপর থেকে তীর বৃষ্টি উপেক্ষা করে মুসলিম যোদ্ধাদের একটি অংশ পরিখা অতিক্রম করতে সমর্থ হন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে পারসিক সেনাপতি সন্ধির প্রস্তাব করে এবং সন্ধির মধ্য দিয়ে দুর্গের কর্তৃত্ব মুসলিমদের হাতে ছেড়ে দেয়।
হযরত যাবারকান ইবনে বদরকে খলীফা নিযুক্ত করে হযরত খালিদ আইনুত তামার অভিমুখে রওয়ানা হন। তাঁকে প্রতিরোধ করতে বহু সংখ্যক সেনা সেখানে সমবেত হয়। বেশকিছু আরব গোত্র তাদেরকে সাহায্য করছিল। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদের আগমনের কথা জানতে পেরে অনেকেই পালিয়ে যায়। অবশিষ্টরা দুর্গে আশ্রয় নেয়। হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ দুর্গ অবরোধ করে রাখেন। অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উয়াইম ইবনে কাহেলকে খলিফা নিযুক্ত করে হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ দৌমাতুল জান্দাল অভিমুখে রওয়ানা হন এবং তা বিজয় করেন।
হযরত খালিদ হাছীদ, খানাফিস,ও মাসইয়াখ বিজয় করেন। ফারাজ এবং দিজলা ও ফুরাতের মধ্যবর্তী আরদুস সাওয়াদ পর্যন্ত তাঁর শাসনের অধীনে চলে আসে।
ওফাত:
৬৪২ সালে খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু ইন্তেকাল করেন। তাঁকে এমেসায় দাফন করা হয়। তিনি যুদ্ধে শহিদ হতে ইচ্ছুক ছিলেন তাই বাড়িতে মৃত্যুর পূর্বে তিনি বিমর্ষ হয়ে যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি বেদনা নিয়ে বলেন :
“আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতচিহ্নবিহীন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের কারণে হয় নি। এরপরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়।”
তথ্যসূত্র:
উজামা ফিল ইসলাম
[সম্মানিত পাঠক! ‘ইসলামের তারকাগণ’ সিরিজে কোনো ভুল নজরে পড়লে কমেন্টবক্সে আমাদের জানানোর অনুরোধ রইলো। আশা করি, দ্বীনের খাতিরে পরামর্শ-নসিহত দিয়ে আমাদের পাশে থাকবেন ইনশাআল্লাহ।]
Comment