এক নজরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুদ্ধ ও অভিযানসমূহ
(দ্বিতীয় পর্ব)
৫১। গাযওয়া যী ক্বারদ (غزوة ذي قرد أو الغابة) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। হোদায়বিয়ার সন্ধির পরে এটাই ছিল রাসূলের প্রথম যুদ্ধ, যা খায়বর যুদ্ধে গমনের মাত্র তিনদিন পূর্বে সংঘটিত হয়। বনু গাত্বফানের ফাযারা গোত্রের আব্দুর রহমান ফাযারীর নেতৃত্বে একটি ডাকাত দল মদীনায় এসে রাসূলের রাখালকে হত্যা করে চারণ ভূমি থেকে রাসূলের উট সমূহ লুট করে নিয়ে যায়। দক্ষ তীরন্দায সালামা বিন আকওয়া একাই পদব্রজে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যী ক্বারদ প্রস্রবণ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাড়িয়ে নিয়ে যান। তারা সমস্ত উট ছাড়াও তাদের নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাবপত্র ফেলে পালিয়ে যায়। পিছে পিছে রাসূল (ছাঃ) ৫০০ ছাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে সন্ধ্যার পরে উপস্থিত হন। ডাকাত দলের নেতা আব্দুর রহমানের নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাতে ছাহাবী আখরাম শহীদ হন। পরে আবু ক্বাতাদার বর্শার আঘাতে আব্দুর রহমান নিহত হয়। সালামা বিন আকওয়া-এর দুঃসাহস ও বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে গনীমতের দুই অংশ দান করেন এবং মদীনায় ফেরার সময় সম্মান স্বরূপ নিজের উটের পিঠে তাকে বসিয়ে নেন।
৫২। গাযওয়া খায়বর (غزوة خيبر) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। অন্যদের নেননি। এতে মুসলিম পক্ষে ১৮ জন শহীদ ও ৫০ জন আহত হন। ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয়। যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গনীমত লাভ হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফিদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাইছাহ বিন মাসঊদকে প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পরে তারা নিজেরা রাসূলের নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূলের দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফিদাক ভূমি কেবল রাসূলের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়।
৫৩। গাযওয়া ওয়াদিল ক্বোরা (غزوة وادي القرى) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। খায়বার যুদ্ধের পরে রাসূল (ছাঃ) এখানকার ইহুদীদের প্রতি গমন করেন। দিনভর যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে রাসূলের একজন দাস এবং ইহুদী পক্ষে ১১ জন নিহত হয়। বিপুল গনীমত হস্তগত হয়। ইহুদীরা সন্ধি করে এবং চাষের জমিগুলি তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ দেওয়ার শর্তে, যেভাবে খায়বারে করা হয়েছিল। ফেদাক ও তাইমার ইহুদীরা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করে।
৫৪। সারিইয়া আবান বিন সাঈদ (سرية أبان بن سعيد) : ৭ম হিজরীর ছফর মাসে মদীনার আশপাশের লুটেরা বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের নেতৃত্বে নাজদের দিকে প্রেরিত হয় এবং যথাসময়ে তারা অভিযান সফল করে ফিরে আসে।[7]
৫৫। গাযওয়া যাতুর রিক্বা‘ (غزوة ذات الرقاع) : ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদের তিনটি প্রধান পক্ষের দু’টি অর্থাৎ কুরায়েশ ও ইহুদী পক্ষকে দমন করার পর তৃতীয় শক্তি নাজদের বনু গাত্বফানের দিকে এই অভিযান প্রেরিত হয়, যারা প্রায়ই মদীনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুটতরাজ করত। এদের কোন স্থায়ী জনপদ বা দুর্গ ছিল না। এরা ছিল সুযোগসন্ধানী ডাকাত দল। তাই মক্কা ও খায়বরবাসীদের ন্যায় এদের দমন করা সহজ ছিল না। ফলে এদের বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সমূহ প্রতিহত করার জন্য অনুরূপ আকস্মিক হামলা সমূহ পরিচালনা করার প্রয়োজন ছিল। সেমতে খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৪০০ অথবা ৭০০ সাথী নিয়ে এদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আনমার অথবা বনু গাত্বফানের ছা‘লাবা ও মুহারিব গোত্রের লোকেরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিচ্ছে মর্মে সংবাদ পেয়ে তিনি অগ্রসর হন এবং নাখল (نخل) নামক স্থানে তাদের মুখোমুখি হন। কিন্তু তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আবু মূসা আশ‘আরী বলেন, আমাদের ৬ জনের জন্য মাত্র একটি উট ছিল, যা আমরা পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলাম। এ কারণে আমাদের পা সমূহ আহত হয় ও আমার নখ ঝরে পড়ে। ফলে আমরা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পায়ে পট্টি বাঁধি। এ কারণ এ যুদ্ধের নাম হয় যাতুর রিক্বা‘ বা ছেঁড়া পট্টির যুদ্ধ।[8]
সরাসরি যুদ্ধ না হ’লেও এই অভিযানে অনেকগুলি ঘটনা ঘটে। যেমন, (১) তরবারি গাছে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগে জনৈক মুশরিক বেদুঈন গাওরাছ ইবনুল হারেছ অথবা দা‘ছূর এসে রাসূলের তরবারি নিয়ে নেয় ও তাকে হত্যা করার হুমকি দেয়। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) যখন বলেন যে, আমাকে রক্ষা করবেন ‘আল্লাহ’ তখন তার হাত থেকে তরবারি পড়ে যায় এবং পরে সে মুসলমান হয়ে যায়। (২) রাসূল (ছাঃ) সবাইকে নিয়ে ‘ছালাতুল খাওফ’ আদায় করেন (৩) যুদ্ধ হ’তে ফেরার পথে বন্দীনী এক মুশরিক মহিলার স্বামী বদলা হিসাবে মুসলিম বাহিনীর রাতের বেলায় বিশ্রামের সুযোগে পাহারায় নিযুক্ত ছাহাবী আববাদ বিন বিশরের উপরে ছালাতরত অবস্থায় তিন তিনটি তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে মারাত্মক আহত করা সত্ত্বেও তিনি ছালাত ভঙ্গ করেননি। পরে অন্য পাহারা আম্মার বিন ইয়াসার যখন বলেন, আমাকে কেন জাগাননি? তখন তিনি বলেন, إنِّيْ كُنْتُ فِيْ سُوْرَةٍ فَكَرِهْتُ أَنْ اَقْطَعَهَا ‘আমি একটি সূরা পাঠ করছিলাম। যা থেকে বিরত হওয়াটা আমি অপসন্দ করেছিলাম’।
এই অভিযানের ফলে বনু গাত্বফানের লোকেরা আর মাথা উঁচু করেনি। তারা ক্রমে ক্রমে সবাই ইসলাম কবুল করে। তাদের অনেকে মক্কা বিজয়ের অভিযানে ও তার পরে হুনায়েন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সাথে ছিল এবং হুনায়েনের গনীমতের অংশ লাভ করেছিল।
৫৬। সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৭ম হিজরীর ছফর অথবা রবীউল আউয়াল মাস। ক্বাদীদ (قديد) অঞ্চলের বনু মলূহ (بنو ملوح) গোত্রের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক এই অভিযান প্রেরিত হয়েছিল। কেননা তারা ইতিপূর্বে বাশীর বিন সুওয়াইদের (بشير بن سويد) সাথীদের হত্যা করেছিল। রাতেই হামলা করে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয় ও গবাদি-পশু নিয়ে সেনাদল ফিরে আসে। প্রতিপক্ষ বিরাট দল নিয়ে পশ্চাদ্ধাবন করলেও হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামায় তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে ও মুসলিম বাহিনী নিরাপদে ফিরে আসে।
৫৭। সারিইয়া যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية زيد بن حارثة) : ৭ম হিজরী জুমাদাল আখেরাহ। রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের নিকটে রাসূলের প্রেরিত দূত ও পত্রবাহক দেহিইয়া কালবী সম্রাট প্রদত্ত উপঢৌকনাদিসহ ফেরার পথে হুসমা (حسمى) নামক স্থানে পৌঁছলে জুযাম (جذام) গোত্রের কিছু লোক তার উপরে হামলা করে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। মদীনায় ফিরে তিনি নিজ গৃহে প্রবেশের আগে রাসূলের দরবারে উপস্থিত হয়ে সব ঘটনা বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৫০০ সৈন্যের একটি দল হুসমার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তারা জুযাম গোত্রের কিছু লোককে হত্যা করেন এবং ১০০০ উট, ৫০০০ ছাগল ও শ’খানেক নারী ও শিশুকে পাকড়াও করে মদীনায় ফিরে আসেন।
উক্ত গোত্রের সাথে যেহেতু পূর্বেই সন্ধিচুক্তি ছিল এবং অন্যতম গোত্র নেতা যায়েদ সহ কয়েকজন আগেই ইসলাম কবুল করেছিল ও তারা ডাকাত দলের বিরুদ্ধে দেহিইয়াকে সাহায্য করেছিল, সেহেতু যায়েদ বিন রেফা‘আহ জুযামী কালবিলম্ব না করে মদীনায় আসেন ও রাসূলের নিকটে সবকিছু বর্ণনা করেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে গণীমতের সব মাল ফেরৎ দানের নির্দেশ দেন।
৫৮। সারিইয়া ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (سرية عمر بن الخطاب) : ৭ম হিজরীর শা‘বান মাস। হাওয়াযেন গোত্রের বিরুদ্ধে তুরবাহ (ةربة) নামক স্থানে ৩০ জনের এই অভিযান প্রেরিত হয়। কিন্তু প্রতিপক্ষ ভয়ে পালিয়ে যায়। ওমর (রাঃ) সেখানে পৌঁছে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসেন।
৫৯। সারিইয়া আবুবকর ছিদ্দীক (سرية أبي بكر الصديق) : বনু কেলাব গোত্রের বিরুদ্ধে এই অভিযান প্রেরিত হয়। এরা বনু গাত্বফানের মুহারিব ও আনমার গোত্র সমূহের সহযোগী ছিল এবং মুসলমানদের উপরে হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হয়। শত্রুদের কিছু নিহত ও কিছু আহত হয়।[9]
৬০। সারিইয়া বাশীর বিন সা‘দ (سرية بشير بن سعد الأنصاري) : ৭ম হিজরীর শা‘বান মাস। খায়বরের ফিদাক অঞ্চলের সীমান্তবর্তী বনু মুররাহ গোত্রের বিরুদ্ধে বাশীর বিন সা‘দ আনছারীর নেতৃত্বে ৩০ জনের এই সেনাদল প্রেরিত হয়। তিনি সেখানে পৌঁছে কাউকে না পেয়ে কিছু গবাদিপশু খেদিয়ে নিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু রাত্রি বেলায় শত্রুদল পশ্চাদ্ধাবন করে তাদের উপরে অতর্কিতে হামলা করে। এমন সময় তাদের তীর ফুরিয়ে যাওয়ায় সবাই শহীদ হয়ে যান। দলনেতা বাশীর আহত অবস্থায় ফিদাকে নীত হন এবং এক ইহুদীর নিকটে অবস্থান করেন। পরে সুস্থ হয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। উল্লেখ্য যে, ফিদাকের ইহুদীদের সাথে ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর যুদ্ধের সময় সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
৬১। সারিইয়া গালেব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৭ম হিজরীর রামাযান মাস। বনু আওয়াল (بنو عوال) অথবা জুহায়না (جهينة) গোত্রের বিরুদ্ধে মীফা‘আহ[10] অথবা হারাক্বাত (حرقات) নামক স্থানে ১৩০ জনের এই সেনাদল প্রেরিত হয়। যুদ্ধে তারা জয়ী হন এবং উট ও গবাদি-পশু নিয়ে ফিরে আসেন।
এই যুদ্ধে তরুণ যোদ্ধা উসামা বিন যায়েদ (ঐ সময় তাঁর বয়স ১৪ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে) শত্রু পক্ষের মিরদাস বিন নাহীক (مرداس بن نهيك) -কে হত্যা করেন কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করার পরেও (তিনি ভেবেছিলেন যে, লোকটি মৃত্যুর ভয়ে কলেমা পাঠ করেছে)। একথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খুবই মর্মাহত হন এবং তাকে বলেন, فَهَلاَّ شققتَ عن قلبه فتعلم أصادق هو أم كاذب؟ ‘তাহ’লে কেন তুমি তার অন্তর চিরে দেখলে না, সে সত্যবাদী ছিল না মিথ্যাবাদী ছিল’?[11]
৬২। সারিইয়া আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (سرية عبد الله بن رواحة) : ৭ম হিজরীর শাওয়াল মাস।[12] ৩০ জন অশ্বারোহীর এই দলটি খায়বরে প্রেরিত হয় আসীর অথবা বাশীর বিন রেযাম (أسير أو بشير بن رزام) -কে দমন করার জন্য। কেননা তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বনু গাত্বফানকে একত্রিত করছিল। আসীরকে এই বলে প্রলুব্ধ করা হয় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তোমাকে খায়বরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করবেন’। আসীর তার ত্রিশজন সঙ্গীসহ মুসলমানদের সাথে মদীনায় রওয়ানা হয়। কিন্তু পথিমধ্যে কুধারণার বশবর্তী হয়ে উভয় পক্ষে যুদ্ধ শুরু হয় এবং আসীর ও তার ৩০ সাথীর সকলে নিহত হয়।
৬৩। সারিইয়া বাশীর বিন সা‘দ (سرية بشير بن سعد الأنصاري) : ৭ম হিজরীর শাওয়াল মাস। বনু গাত্বফান অথবা ফাযারা গোত্রের ইয়ামন ও জাবার এলাকায় ৩০০ সৈন্যের এই দলটি প্রেরিত হয়। কেননা শত্রুরা তখন মদীনার সীমান্তবর্তী অঞ্চল সমূহের উপরে হামলার জন্য বিরাট একটি দল একত্রিত করেছিল। মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে তাদের দল বিক্ষিপ্ত হয়ে পালিয়ে যায়। বহু গনীমত হস্তগত হয় ও দু’জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হ’লে তারা মুসলমান হয়ে যায়।
৬৪। সারিয়াহ আবু হাদরাদ আসলামী (سرية أبي حدرد الأسلمي) : ৭ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে রাসূলের ওমরাহ পালনের পূর্বে। মাত্র দু’জন সঙ্গী সহ আবু হাদরাদকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) প্রেরণ করেন জাশম বিন মু‘আবিয়া (جشم بن معاوية) গোত্রের একটি দলের বিরুদ্ধে বনু গাত্বফানের গাবাহ (الغابة) নামক স্থানে। যেখানে তারা জমা হয়েছিল ক্বায়েস গোত্রের লোকরদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল করার জন্য। আবু হাদরাদ (রাঃ) সেখানে গিয়ে এমন এক যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করেন যে, শত্রুপক্ষ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় এবং বহু উট ও গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৫। সারিইয়া ইবনু আবিল ‘আওজা (سرية ابن أبي العوجاء) : ৭ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাস। বনু সুলায়েম (بنو سليم) গোত্রকে ইসলামের দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্য ৫০ জনের এই দলটিকে পাঠানো হয়। কিন্তু তারা অগ্রাহ্য করে বলে, لا حاجة لنا إلى ما دعوتنا ‘তুমি যেদিকে আমাদের আহবান করছ, আমাদের তার কোন প্রয়োজন নেই’। অতঃপর তারা মুসলিম দলটির বিরুদ্ধে ঘোরতর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দলনেতা আহত হন। তবে শত্রু পক্ষের দু’জনকে তারা বন্দী করতে সক্ষম হন।[13]
৬৬। সারিইয়া গালিব বিন আব্দুল্লাহ লায়ছী (سرية غالب بن عبد الله الليثي) : ৮ম হিজরীর ছফর মাস। ২০০ লোকের একটি সেনাদল নিয়ে তিনি ফেদাক অঞ্চলের বনু মুররাহ গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হন বশীর বিন সা‘দের ৩০ জন সাথীর শাহাদাত স্থলে। যা ৭ম হিজরীর শা‘বান মাসে সংঘটিত হয়েছিল। শত্রুদের অনেকে নিহত হয় ও বহু গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৭। সারিইয়াহ যাতে আত্বলাহ (سرية ذات أطلح) : ৮ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। মুসলমানদের উপরে হামলা করার জন্য বনু কুযা‘আহ (بنو قضاعة) বিরাট একটি দলকে একত্রিত করছে জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কা‘ব বিন ওমায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি সেনাদল সেখানে প্রেরণ করেন। তারা যাতু আত্বলাহ (ذات أطلح) নামক স্থানে শত্রুদের মুখোমুখি হন। তাঁরা প্রথমে তাদের ইসলামের দাওয়াত দেন। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যাতে সকল ছাহাবীকে তীর দিয়ে ছিদ্র করে করে শহীদ করা হয় নিহতদের মধ্যে একজন মাত্র কোনভাবে বেঁচে যান।
৬৮। সারিইয়াহ যাতে ইরক্ব (سرية ذات عرق) : ৮ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু হাওয়াযেন গোত্র বারবার শত্রুদের সাহায্য করে যাচ্ছিল। ফলে তাদের দমনের জন্য শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদীর নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি সেনাদল উক্ত গোত্রের যাতু ইরক্ব (ذات عرق) নামক স্থানে প্রেরিত হয়। যুদ্ধ হয়নি। তবে কিছু গবাদি পশু হস্তগত হয়।
৬৯। সারিইয়া মুতা (سرية مؤةة) : ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মোতাবেক ৬২৯ খৃষ্টাব্দের আগষ্ট অথবা সেপ্টেম্বর মাস। রোম সম্রাট ক্বায়ছারের পক্ষ হ’তে সিরিয়ার বালক্বায় (البلقاء) নিযুক্ত গবর্ণর শোরাহবীল বিন আমর আল-গাসসানীর নিকটে পত্র সহ প্রেরিত রাসূলের দূত হারেছ বিন উমায়ের আযদীকে হত্যা করা হয়। যা ছিল তৎকালীন সময়ের রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। ফলে মুসলমানদের যুদ্ধ করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। অতএব যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের এক বাহিনী প্রেরিত হয়। পক্ষান্তরে শোরাহবীলের ছিল প্রায় ২ লাখ সৈন্যের এক বিশাল খৃষ্টান বাহিনী। বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নিকটবর্তী ‘মুতা’ নামক স্থানে সংঘটিত এই যুদ্ধে সেনাপতি যায়েদ বিন হারেছাহ, অতঃপর সেনাপতি জাফর বিন আবু ত্বালিব, অতঃপর সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা পরপর শহীদ হ’লে সকলের ঐক্যমতে খালিদ বিন ওয়ালীদ সেনাপতি হন। তিনি সম্মুখের দলকে পিছনে, পিছনের দলকে সম্মুখে ডাইনের দলকে বামে এবং বামের দলকে ডাইনে নিয়ে এক অপূর্ব রণকৌশলের মাধ্যমে মুসলিম বাহিনীকে সসম্মানে শত্রুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে আনেন। নতুন সেনাদল যুক্ত হয়েছে ভেবে এবং মুসলমানেরা তাদেরকে মরু প্রান্তরে নিক্ষেপ করবে সেই ভয়ে রোমানরা পিছু হটে যায়। মুসলিম বাহিনীর মাত্র ১২ জন শহীদ হন। রোমক বাহিনীর হতাহতের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও একা খালেদ বিন ওয়ালীদের যেখানে নয় খানা তরবারি ভেঙ্গেছিল, তাতে অনুমান করা চলে কত সৈন্য তাদের ক্ষয় হয়েছিল।
তৎকালীন বিশ্বের এই সেরা পরাশক্তির সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর এই বীরত্বপূর্ণ মুকাবিলায় খৃষ্টান বিশ্ব যেমন ভয়ে চমকে যায়, আরব বিশ্ব তেমনি হতচকিত হয়ে পড়ে। মাথা উঁচু করার স্বপ্ন ভুলে গিয়ে চির বৈরী বনু গাত্বফান, বনু সুলায়েম, বনু আশজা‘, বনু যুবিয়ান, বনু ফাযারাহ প্রভৃতি গোত্রগুলো ইসলাম কবুল করল। অন্যদিকে রোম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন আরব অঞ্চলে ও দূরবর্তী অঞ্চল সমূহে মুসলিম বিজয়ের সূচনা হ’ল।
৭০। সারিইয়া যাতুস সালাসেল (سرية ذات السلاسل) : ৮ম হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রথমে ৩০০ এবং পরে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২০০ মোট ৫০০ সৈন্যের এই দলটি সিরিয়া সীমান্তে বনু কুযা‘আহ (بنو قضاعة) গোত্রের বিরুদ্ধে প্রেরিত হয়। এরা রোমানদের সঙ্গে মিলে মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। মুসলিম বাহিনী উক্ত গোত্রের ‘সালসাল’ (السلسل) নামক প্রস্রবণের নিকটে অবতরণ করে বিধায় অভিযানটির নাম হয় ‘যাতুস সালাসেল’। শত্রুরা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। শেষোক্ত সাহায্যকারী বাহিনীতে হযরত আবু বকর ও ওমর (রাঃ) ছিলেন। কিন্তু আমর ইবনুল আছকে সেনাপতি করার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তাঁর দাদী অর্থাৎ পিতার মা ছিলেন অত্র এলাকার ‘বালী’ (بلى) গোত্রের মহিলা। সেই সুবাদে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে তারা রোমকদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুসলমানদের জন্য হুমকি হয়ে না দাঁড়ায়।
৭১। সারিইয়া আবু ক্বাতাদাহ (سرية أبي قةادة) : ৮ম হিজরীর শা‘বান মাস। নাজদের বনু গাত্বফানের শাখা ‘মুহারিব’ (محارب) গোত্রের লোকেরা মদীনায় হামলার জন্য তাদের এলাকায় খাযেরাহ (خضرة) নামক স্থানে সেনা প্রস্ত্তত করছে জানতে পেরে ১৫ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। তারা তাদের অনেককে হত্যা করেন ও বাকীরা পালিয়ে যায়। অনেক গনীমত হস্তগত হয়। তারা এ সফরে ১৫ দিন মদীনার বাইরে থাকেন।
৭২। গাযওয়া ফাৎহে মাক্কা (غزوة فةح مكة) বা মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মঙ্গলবার ১০,০০০ ছাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মদীনা হ’তে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার আকস্মিকভাবে মক্কায় উপস্থিত হন ও একপ্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। মক্কা বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবার জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। ৬ষ্ঠ হিজরীর যুল-ক্বা‘দাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি ভঙ্গ করার অপরাধেই কুরায়েশদের বিরুদ্ধে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
৭৩। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৮ম হিজরীর ২৫ রামাযান। কুরায়েশ ও বনু কেনানার সবচেয়ে বড় দেবতা উযযা (العزى) দেবীমূর্তি ভাঙ্গার জন্য একটি ছোট্ট সেনাদল সহ তিনি ‘নাখলা’ উপত্যকায় প্রেরিত হন। মূর্তি ভেঙ্গে ফিরে এলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে পুনরায় পাঠান। সেবারে একজন বিক্ষিপ্ত চুলবিশিষ্ট কৃষ্ণাঙ্গ নগ্ন নারীকে বেরিয়ে আসতে দেখে খালেদ তাকে এক কোপে দ্বিখন্ডিত করে ফেলেন। ফিরে এসে এ ঘটনা বললে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, نعم تلك العزي وقد أيست أن تعبد في بلادكم أبدًا ‘হাঁ এটাই উযযা। তোমাদের দেশে পূজা পাওয়ার ব্যাপারে সে এখন চিরকালের জন্য নিরাশ হয়ে গেল’।[14] ‘মূর্তিপূজারীরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নারীদের আহবান করে’ (নিসা ১১৭)-এর ব্যাখ্যায় ছাহাবী উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) বলেন, مع كل صنم جنية ‘হাঁ, প্রত্যেক মূর্তির সাথে একজন করে মাদী জিন থাকে’।[15] এরা মানুষকে অলক্ষ্যে থেকে প্রলুব্ধ করে এবং দলে দলে লোকেরা বিভিন্ন মূর্তি, প্রতিকৃতি, বেদী, মিনার ও কবরে গিয়ে অযথা শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং মিথ্যা আশায় প্রার্থনা করে। যে বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ হ’তে কোনরূপ দলীল অবতীর্ণ হয়নি।
৭৪। সারিইয়াহ ‘আমর ইবনুল ‘আছ (سرية عمرو بن العاص) : ৮ম হিজরীর রামাযান মাস। মক্কা থেকে তিন মাইল দূরে রেহাত (رهاط) নামক স্থানে রক্ষিত হোযায়েল গোত্রের বড় দেবমূর্তি সুওয়া‘ (سواع) ভেঙ্গে ফেলার জন্য আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে একদল সঙ্গীসহ প্রেরণ করা হয়। প্রহরী বলল, তুমি এ কাজে সক্ষম হবে না। স্বাভাবিক ভাবেই তুমি বাধাপ্রাপ্ত হবে’। তিনি বললেন, তোমরা এখনো বাতিলের উপরে আছ? এ মূর্তি কি শুনতে পায় না দেখতে পায়? বলেই তিনি ওটাকে গুঁড়িয়ে দিলেন’। প্রহরীকে বললেন, এবার তোমার মত কি? সে বলল, أسلمت لله ‘আমি আল্লাহর জন্য ইসলাম কবুল করলাম’।
৭৫। সারিইয়া সা‘দ বিন যায়েদ আশহালী (سرية سعد بن زيد الأشهلى) : ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে। ২০ জন অশ্বারোহী দল সহ সা‘দ বিন যায়েদ (রাঃ)-কে অন্যতম প্রসিদ্ধ দেবী মূর্তি মানাত (مناة) -কে ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করা হয়, যা ক্বাদীদের (قديد) মোশাল্লাল (مشلل) নামক জায়গায় স্থাপিত ছিল। এই মূর্তিকে বিশেষ করে আউস, খাযরাজ ও গাসসান গোত্রের লোকেরা পূজা করত। সা‘দ মূর্তির দিকে অগ্রসর হ’তেই একটি কৃষ্ণাঙ্গ ও বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট উলঙ্গ নারীকে স্বীয় বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বেরিয়ে আসতে দেখেন। এ সময় সে কেবল হায় হায় করছিল (تدعو بالويل)। সা‘দ তাকে এক আঘাতে খতম করে দিলেন। অতঃপর মূর্তি ও ভান্ডারগৃহ ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিলেন।
৭৬। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। মুহাজেরীন, আনছার ও বনু সুলায়েম গোত্রের সমন্বয়ে ৩৫০ জনের একটি দলকে বনু জুযাইমা (بنو جُذَيْمَة) গোত্রের লোকদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য পাঠানো হয়, যুদ্ধের জন্য নয়। কিন্তু স্থানীয়রা স্পষ্টভাবে أسلمنا ‘আমরা ইসলাম কবুল করলাম’ না বলে صبأنا ‘আমরা ধর্মত্যাগী হয়েছি’ বলে। এতে সন্দেহে পতিত হয়ে খালেদ তাদের হত্যা করতে থাকেন ও বন্দী করতে থাকেন এবং পরে প্রত্যেকের নিকটে ধৃত ব্যক্তিকে হত্যা করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেন। কিন্তু বনু সোলায়েম ব্যতীত মুহাজেরীন ও আনছার ছাহাবীগণ কেউ এ নির্দেশ মানেননি। এ ব্যাপারে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) ও তার সাথীগণ ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে সব ঘটনা বললে তিনি খুবই মর্মাহত হন এবং আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়ে দু’বার বলেন, اَللَّهُمَّ إِنِّيْ أَبْرَأُ إِلَيْكَ مِمَّا صَنَعَ خَالِدُ ‘হে আল্লাহ! খালেদ যা করেছে, আমি তা থেকে তোমার নিকটে নিজেকে মুক্ত ঘোষণা করছি’।[16] উক্ত ঘটনায় খালেদ (রাঃ)-এর সাথে মুহাজির ছাহাবী আব্দুর রহমান বিন ‘আওফের কিছু উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। একথা শুনে খালেদকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, مهلا يا خالد، دع عنك أصحابي، فوالله لو كان لك أُحُدٌ ذهبًا ثم أنفقته في سبيل الله ما أدركتَ غدوة رجل من أصحابي ولا روحته- ‘থেমে যাও খালেদ! আমার ছাহাবীগণ থেকে বিরত হও। আল্লাহর কসম! যদি ওহোদ পাহাড় সোনা হয়ে যায়। আর তা সবটাই তুমি আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর, তথাপি আমার একজন ছাহাবীর একটি সকাল বা একটি সন্ধ্যার সমপর্যায়ে পৌঁছতে পারবে না’।[17]
পরে আলী (রাঃ)-কে পাঠিয়ে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিহত ব্যক্তিদের রক্তমূল্য এবং অন্যান্য ক্ষতিপূরণ দান করেন। মানছূরপুরী বলেন, এ ঘটনায় বনু জুযাইমার ৯৫ ব্যক্তি নিহত হয়। তবে এই সংখ্যা সঠিক নাও হ’তে পারে। উল্লেখ্য যে, খালেদ বিন ওয়ালীদ ও আমর ইবনুল আছ (রাঃ) ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে এবং বনু সুলায়েম মুতা যুদ্ধের পর ৮ম হিজরীর শেষার্ধ্বে ইসলাম কবুল করেন। সে হিসাবে এঁরা সবাই ছিলেন অপেক্ষাকৃত নতুন মুসলমান।
৭৭। গাযওয়া হোনায়েন (غزوة حنين) বা হুনায়েন যুদ্ধ : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের আত্মগর্বী নেতারা মক্কা হ’তে আরাফাতের দিকে ২৬ কি.মি. দক্ষিণ-পূর্বে হুনায়েন উপত্যকায় মালেক বিন আওফের নেতৃত্বে ৪০০০ দুঃসাহসী সেনার সমাবেশ ঘটায়। ফলে মক্কা বিজয়ের ১৯তম দিনে ৬ই শাওয়াল শনিবার আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মক্কার ২০০০ নও মুসলিম সহ মোট ১২,০০০ সাথী নিয়ে হুনায়েনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ১০ই শাওয়াল বুধবার রাতে গিয়ে উপস্থিত হন। যুদ্ধে শত্রুপক্ষে ৭১ জন নিহত হয় ও মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন। যুদ্ধে বিশাল পরিমাণের গনীমত হস্তগত হয়।
৭৮। গাযওয়া ত্বায়েফ (غزوة طائف) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হুনায়েন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নেতা মালেক বিন আওফ সহ পরাজিত ছাক্বীফ গোত্রের লোকেরা পালিয়ে গিয়ে ত্বায়েফের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমে খালিদের নেতৃত্বে ১০০০-এর একটি বাহিনী প্রেরণ করা হয়। তারপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজে গমন করেন। তারা তায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ কতদিন স্থায়ী ছিল এ বিষয়ে ১৫ দিন থেকে ৪০ দিন পর্যন্ত মতামত রয়েছে। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জনের অধিক শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। এ সময় ছাহাবীগণ তাঁকে ছাক্বীফ গোত্রের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করার আবেদন জানালে তিনি উত্তম দো‘আ করে বলেন, اللهم اهد ثقيفا وآت بهم ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো’।[18] আল্লাহ সেটাই কবুল করলেন এবং কিছুদিন পর তারা নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করল।
৭৯। সারিইয়া উয়াইনা বিন হিছন ফাযারী (سرية عيينة بن حصن الفزاري) : ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস। বনু তামীম গোত্রের লোকেরা অন্য গোত্রের লোকদের জিযিয়া প্রদান না করার জন্য উত্তেজিত করছিল। সেকারণ তাদের বিরুদ্ধে ‘ছাহরা’ (الصحراء) এলাকায় ৫০ জন অশ্বারোহীর একটি দল প্রেরিত হয়। বনু তামীম পালিয়ে যায়। তাদের পুরুষ-নারী-শিশু মিলে ৬২ জনকে বন্দী করে মদীনায় আনা হয়। পর দিন তাদের ১০ জন নেতা মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করে এবং সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।[19]
৮০। সারিইয়া কুত্ববাহ বিন ‘আমের (سرية قطبة بن عامر) : ৯ম হিজরীর ছফর মাস। তুরবার (ةربة) নিকটবর্তী তাবালা (ةبالة) অঞ্চলে খাছ‘আম (خثعم) গোত্রের একটি শাখার বিরুদ্ধে ২০ জনের এই দলটি প্রেরিত হয়। এরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছিল। যুদ্ধে তাদের অনেকে হতাহত হয়। মুসলিম বাহিনী উট, বকরী, নারী সহ অনেক গনীমত নিয়ে ফিরে আসে। তবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ছেড়ে দেন।
৮১। সারিইয়া যাহহাক বিন সুফিয়ান কেলাবী (سرية ضحاك بن سفيان الكلابي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বনু কেলাব গোত্রকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য এই দলটিকে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু বনু কেলাব তাতে অস্বীকার করে এবং যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ফলে তাদের একজন নিহত হয়।
৮২। সারিইয়া আলী ইবনে আবী ত্বালেব (سرية على بن أبي طالب) : ৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। বিখ্যাত খৃষ্টান গোত্র ত্বাঈ (الطيئ) -এর ‘ফুলস’ (الفلس) মূর্তিটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য ১৫০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। মূর্তি ভাঙ্গার পর দানবীর হাতেম তাঈ-এর পরিবার সহ অনেকে বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে সসম্মানে মুক্তি দেন। হাতেম তাঈ-এর বৃদ্ধা কন্যা সাফানাহ (سفانة) মুক্তি পেয়ে পলাতক ভাই খ্যাতনামা বিদ্বান ও গোত্রনেতা ‘আদী ইবনে হাতেমকে পাবার জন্য সিরিয়ায় যান। পরে ‘আদী মদীনায় এসে মুসলমান হয়ে যান।
৮৩। সারিইয়া আলক্বামা বিন মুজযিয আল-মুদলেজী (سرية علقمة بن مجزز المدلجي) : ৯ম হিজরীর রবীউল আখের। হাবশার কিছু নৌদস্যু জেদ্দা তীরবর্তী এলাকায় সমবেত হয়ে মক্কায় হামলা করার ষড়যন্ত্র করছে জানতে পেরে ৩০০ জনের এই বাহিনী প্রেরিত হয়। আলক্বামা একদল সাথী নিয়ে সাগরে নেমে যান ও একটি দ্বীপে পেঁŠছে যান। এ খবর পেয়ে দস্যুদল দ্রুত পালিয়ে যায়।[20] মানছূরপুরী দলনেতার নাম আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ আল-ক্বারশী আস-সাহমী (عبد الله بن حذافة القرشي السهمي) লিখেছেন।[21]
৮৪। গাযওয়া তাবূক (غزوة تبوك) : ৯ম হিজরীর রজব মাস। এটাই ছিল রাসূলের জীবনের শেষ যুদ্ধ এবং যা রোমকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এ সময় মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার প্রস্ত্ততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী মদীনায় ফিরে আসে।
এই অভিযান কালে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে এবং ২০ দিন তাবূকে অবস্থানে ব্যয়িত হয়। এই যুদ্ধকালের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী ছিল নিম্নরূপ- (১) যুদ্ধের প্রাক্কালে মদীনায় কঠিন দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছিল। এমনকি পর্যাপ্ত ভরণ-পোষণ দাবী করায় ও তাতে ব্যর্থ হওয়ায় রাসূল (ছাঃ) তাঁর স্ত্রীদের সাথে মাসব্যাপী সঙ্গত্যাগের অর্থাৎ ‘ঈলা’ করার ঘোষণা দিতে বাধ্য হন (২) অন্য দিকে মুনাফিকরা মুসলিম বাহিনীতে ফাটল সৃষ্টির জন্য ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ তৈরী করে এবং রাসূলকে সেখানে ছালাত আদায়ের আমন্ত্রণ জানায়। তাবূক থেকে ফিরে এসে তিনি সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। (৩) যুদ্ধের ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা হয়। আবুবকর (রাঃ) তাঁর সকল সম্পদ মিলিয়ে ৪০০০ দিরহাম, ওমর (রাঃ) তাঁর অর্ধেক সম্পদ, মহিলাগণ তাদের গহনা-পত্র এবং অন্যান্য ছাহাবীগণ তাদের সাধ্যমত দান করেন। এদিন সবার উপরে দান ছিল হযরত ওছমানের। রাসূলের কোলে ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা ছড়িয়ে দেওয়া ছাড়াও তিনি ৯০০ উট ও ১০০ ঘোড়া এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি দান করে রাসূলের বিশেষ দো‘আ লাভ করেন। কিন্তু মুনাফিকরা দান করা থেকে বিরত থাকে। (৪) দুর্বল অজুহাত দেখিয়ে তিন জন নিষ্ঠাবান মুসলমান এদিন যুদ্ধে যাননি (৫) গড়ে ১৮ জনের একটি দলের জন্য বাহন ছিল মাত্র ১টি উট (৬) গাছের ছাল-পাতা খেয়ে ও যবেহকৃত উটের নাড়ী-ভুঁড়ির পানি পান করে ছাহাবীগণ অতিকষ্টে বেঁচে থাকেন। এজন্য এ যুদ্ধকে ‘জায়শুল ‘উসরাহ’ (جيش العسرة) বা ‘কষ্টের যুদ্ধ’ নামে অভিহিত করা হয়। (৭) ছামূদ জাতির গযবের স্থান ‘হিজর’ অতিক্রম করার সময় সেখানকার পানি পান না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয় (৮) মু‘জেযার মাধ্যমে একটি শুষ্ক ঝর্ণা হ’তে অবিরাম পানি নির্গত হয় (৯) ছালাত তাক্বদীম ও তাখীরের মাধ্যমে জমা ও ক্বছর করা হয় (১০) প্রবল ঘুর্ণিঝড়ের ফলে শত্রু পক্ষের মনে ভীতির সঞ্চার হয় (১১) মদীনায় ফেরার সময় একটি সংকীর্ণ গিরিপথে ১২ জন মুখোশ ধারী মুনাফিক রাসূলকে হত্যা প্রচেষ্টা চালায় (১২) তাবূক থেকে ফেরার দিন মদীনায় কিশোর-কিশোরীরা বিজয়ী রাসূলকে জানায় উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় طلع البدر علينا… বলে।
৮৫। সারিইয়া খালেদ বিন ওয়ালীদ (سرية خالد بن وليد) : ৯ম হিজরীর রজব মাস। বিনা যুদ্ধে বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাবূকে অবস্থানকালেই পার্শ্ববর্তী দূমাতুল জান্দালের (دومة الجندل) খৃষ্টান নেতা উকাইদারের (أكيدر) বিরুদ্ধে ৪২০ জনের সেনাদল সহ খালেদকে প্রেরণ করেন। খালেদ তাকে বনদী করে রাসূলের দরবারে আনেন এবং তার সাথে সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
৮৬। সারিইয়া উসামাহ বিন যায়েদ বিন হারেছাহ (سرية أسامة بن زيد بن الحارثة) : ১১ হিজরীর ছফর মাস। রোম সম্রাটের অহংকার চূর্ণ করার জন্য এবং মো‘আন (معان) ও পার্শ্ববর্তী আরব অঞ্চলের রোমক গবর্ণর ফারওয়াহ বিন ‘আমর আল-জোযামীকে ইসলাম কবুলের অপরাধে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য এ অভিযান প্রেরিত হয়। সিরিয়ার বালক্বা‘ ও ফিলিস্তীন অঞ্চল অশ্বারোহীদের দ্বারা পদদলিত করে রোমকদের ভীত করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। অভিযান প্রেরণকালে উসামার হাতে পতাকা দিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, سر إلى موضع قتل أبيك فأوطنهم الخيل ‘যাও তোমার পিতার নিহত হওয়ার স্থানে এবং সেখানকার লোকদের ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করো’। বড় বড় ছাহাবী উসামাকে সেনাপতি হিসাবে মেনে নিতে না পারলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়ে বলেন, তোমরা তার পিতার ব্যাপারেও এরূপ বলেছিলে। আল্লাহর কসম! সে যোগ্য ছিল। তার পুত্রও যোগ্য’।
কিন্তু মদীনা হ’তে তিন মাইল দূরে ‘জুরফ’ নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলের শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর শুনে বাহিনী সেখানেই যাত্রা বিরতি করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আবুবকরের খেলাফতকালে উক্ত বাহিনী পুনরায় যাত্রা করে এবং বিজয়ী বেশে ফিরে আসে।
উল্লেখ্য যে, মানছূরপুরী ৮২টি অভিযানের তালিকা দিয়েছেন। আমরা তাঁর তালিকা ও মুবারকপুরীর তালিকা মিলিয়ে মোট ৮৬টি পেয়েছি, যা লিপিবদ্ধ করলাম। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
উভয় পক্ষে শহীদ ও নিহতদের সংখ্যা :
মাদানী জীবনে ৮ বছরে সংঘটিত ৮৬টি গাযওয়া ও সারিইয়ার মধ্যে ২৯টি গাযওয়া ও ৫৭টি সারিইয়াতে উভয় পক্ষে নিহত ও শহীদগণের সঠিক তালিকা নির্ণয় করা মুশকিল। মানছূরপুরী যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় যে, মুসলিম পক্ষে শহীদ হয়েছেন ২৫৯ জন এবং কাফের পক্ষে নিহত হয়েছেন ৭৫৯ জন। উভয়পক্ষে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা ১০১৮ জন।[22] কিন্তু মানছূরপুরী ও মুবারকপুরী উভয়ের দেওয়া যুদ্ধের বর্ণনা সমূহ হিসাব করে দেখা গেছে যে, মুসলিম পক্ষে ৩৩৯ জন এবং কাফির পক্ষে ১০৯১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মানছূরপুরী সারিইয়া ইবনু আবিল আওজা-তে (ক্রমিক ৬৫) মুসলিম পক্ষে ৪৯ জন শহীদ বলেছেন, যেটা ৩৩৯ জনের হিসাবে ধরা হয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী উক্ত বিষয়ে কিছু বলেননি। অনুরূপভাবে গাযওয়া বনু কুরায়যাতে ইহুদীপক্ষে নিহতের সংখ্যা মানছূরপুরী ৪০০ বলেছেন। কিন্তু মুবারকপুরী ৬০০ থেকে ৭০০-এর মধ্যে বলেছেন। মানছূরপুরী ৪০০ ধরে হিসাব করেছেন। কিন্তু আমরা ৬০০ ধরে হিসাব করেছি। ফলে কাফের পক্ষে আমাদের হিসাব তাঁর চাইতে বেশী হয়েছে। এর পরেও ৭টি সারিইয়ায় প্রতিপক্ষের নিহতের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে ‘কিছু লোক’। অতএব কাফের পক্ষে নিহতের সংখ্যা আরও কিছু বাড়তে পারে। উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে বড় ৯টি যুদ্ধে অর্থাৎ বদর (ক্রমিক- ৯) ওহোদ (২০), খন্দক (৩১), খায়বর (৫২), মুতা (৬৯), মক্কা বিজয় (৭২), হোনায়েন (৭৭), ত্বায়েফ (৭৮) ও তাবূক (৮৪) যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে যথাক্রমে ১৪, ৭০, ৬, ১৮, ১২, ২, ৬, ১২, ০০=১৪০ জন এবং কাফের পক্ষে ৭০, ৩৭, ১০, ৯৩, ০০, ১২, ৭১, ০০, ০০=২৯৩ জন সহ সর্বমোট ৪০৩ জন নিহত হয়েছে। তাবূক যুদ্ধে কোন পক্ষে হতাহত হয়নি। আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে তথাকথিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেভাবে দেশে দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করা হয়, তার তুলনায় এগুলি তৃণসম বলা চলে।
অভিযানসমূহ পর্যালোচনা:
অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে ৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৮৬-এর মধ্যে ৬টি অভিযান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৩৭ নং সারিইয়াহ তিনটি ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। বদর সহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে তাদের আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।
শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صابئي) বা বিধর্মী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস গত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা। সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার। কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে নিতান্তই অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহুদী নেতারা ও অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ মূলক।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি হয় তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে এবং অবিরত ভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে। খৃষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না। সিরিয়ার নিকটবর্তী দূমাতুল জান্দালে প্রথম যে অভিযানটি (ক্রমিক-৪৪) তাদের দিকে প্রেরিত হয়, সেটি ছিল মূলতঃ তাবলীগী মিশন এবং তাতে তাদের গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়। পরে যে মুতার যুদ্ধ (ক্রমিক-৬৯) হয়, সেটি ছিল সিরিয়া অঞ্চলে রোমক গবর্ণর শোরাহবীলের মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে। তাবূক যুদ্ধ ছিল আগ্রাসী রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য। অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।
উল্লেখ্য যে, ৩য় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে মুনাফেকী করার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে আর কোন যুদ্ধে যাবার অনুমতি দেননি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও অন্যান্যদের প্রকাশ্যে তওবা ও বারবার অনুরোধে তিনি তাদেরকে ৫ম হিজরীতে মুছত্বালিক যুদ্ধে (ক্রমিক-৪৩) যাবার অনুমতি দেন। কিন্তু তারা যথারীতি মুনাফেকী করে। পরে তাদেরকে আর কোথাও অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাবূক অভিযানে (ক্রমিক-৮৪) তাদের ১২ জন এজেন্ট গোপনে ঢুকে পড়ে ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ উভয় প্রকারের। যুগে যুগে ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। যার সূত্রপাত ঘটে নাখলা যুদ্ধে (ক্রমিক-৮)। এ প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারাহ ২১৭নং আয়াতটি নাযিল হয়।
✍️
Collected
[7] বুখারী, মানছূরপুরী এটা ধরেননি।
[8] বুখারী ২/৫৯২; মুসলিম ২/১১৮।
[9] মুবারকপুরী এটা ধরেননি। মানছুরপুরী সাল-তারিখ ও সেনা সংখ্যা বলেননি।
[10] মানছূরপুরী মুনক্বা‘আহ (منقعة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন, ৩/১৯৭।
[11] মুসনাদ আবু ইয়া‘লা হা/১৫২২ সনদ হাসান; মুসলিম হা/২৭৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়, ৪৩ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৬৮৭২-এর ব্যাখ্যা, ফাৎহুল বারী ১২/২০৩; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৩৪৫০, ‘ক্বিছাছ’ অধ্যায়; মানছূরপুরী এটাকে পৃথক ‘খারবাহ অভিযান’ (سرية خربة) বলেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৭।
[12] মানছূরপুরী এটি ৬ষ্ঠ হিজরীর শাওয়াল মাস লিখেছেন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৫।
[13] কিন্তু মানছূরপুরী বলেন যে, মুসলিম বাহিনীর ১ জন আহত ও ৪৯ জন শহীদ হন। দ্রঃ রহমাতুল্লিল আলামীন ২/১৯৮।
[14] নাসাঈ কুবরা হা/১১৫৪৭; তাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ২/১৪৫-৪৬।
[15] আহমাদ হা/২১২৬৯, সনদ হাসান।
[16] বুখারী হা/৪৩৩৯; মিশকাত হা/৩৯৭৬ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, ৫ অনুচ্ছেদ।
[17] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৩১; ছাহাবীগণের উচ্চ মর্যাদায় বর্ণিত উক্ত মর্মে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।
[18] সীরাতে ইবনে হিশাম ২/৪৮৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৫৯৮৬।
[19] চরিতকারগণ এই ঘটনাকে ৯ম হিজরীর মুহাররম মাস বললেও মুবারকপুরী এতে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। যদিও তিনি পৃথক কোন সাল বা তারিখ উল্লেখ করেননি।
Comment