(আগের পর্বের বাকি অংশ)
দলিলভিত্তিক ফিকহ চর্চাঃ
“দারুল উলূম দেওবন্দ” দলিলভিত্তিক ফিকহ চর্চাকে তার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রথমত- ফিকহে মুদাল্লাল তথা যে সকল কিতাবের মাসআলাগুলো দলিলের উল্লেখসহ লিখা হয়েছে সে সকল কিতাবকে এ পাঠ্যসূচিতে আনা হয়েছে। দ্বিতীয়ত- উসুলে ফিকহ তথা শরীয়তের দলীলসমূহ থেকে মাসআলা উদঘাটনের মূলনীতি বিষয়ে রচিত কিতাবাদি এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পাঠ্যসূচিতে এ দু'টি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি সুস্পষ্টভাবে জানান দেয় যে, উম্মত ব্যক্তির অনুসরণের উপর নির্ভরশীল হয়ে দলিল প্রমাণ তথা কুরআন, হাদীস, ইজমা, কেয়াস থেকে হাত ধুয়ে বসে থাকুক তা আকাবিরে দেওবন্দ চাইতেন না। বরং তারা চাইতেন ওলামায়ে কেরাম মুজতাহিদ পর্যায়ে উন্নীত না হলেও মুজতাহিদ ওলামায়ে কেরাম কোন পন্থায় কিসের ভিত্তিতে মাসআলা-মাসায়েল উদ্ভাবন করেছেন সে পথ ও উৎসগুলোর সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের পরিচয় থাকুক।
যদি মনে করা হয়, কোন মাসআলা কোন দলিল থেকে কীভাবে কোন মূলনীতির আলোকে উদ্ভাবিত হয়েছে তা আমাদের দেখার বিষয় নয়, বা দেখা অনর্থক বা অনধিকার চর্চা তাহলে এ পুরা শিক্ষাব্যবস্থাকেই অনর্থক বলতে হবে। যে পড়াশোনার কোন প্রায়োগিক প্রভাব নেই তার পেছনে সময় ব্যয় করার কোন বৈধতা নেই।
তাই ফিকহে মুদাল্লাল এবং উসুলে ফিকহ চর্চা করার কার্যকরী দিকটি হচ্ছে, দলিল বহির্ভূত বা মূলনীতির বাইরে অন্য কোন পদ্ধতিতে যদি কেউ কোন আমলকে শরয়ী স্থান দিতে চায় তাহলে যেন নির্দিধায় তা প্রত্যাখ্যান করা যায়। যে বিষয়গুলো শরীয়তের দলিল হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি তার মাধ্যমে গায়রে শরীয়ত যাতে শরীয়তের লেবাস ধরতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা যায়। এতে করে একজন অনুসারী শতভাগ আস্থাশীল হয়ে উঠে যে, সে ফিকহ, মাযহাব ও আইম্মায়ে কেরামের ইজতেহাদের অনুসরণের মাধ্যমে মূলত দ্বীনের উৎসগুলোরই অনুসরণ করছে।
এমনিভাবে সুন্নত ও আদব শিরোনামে যে বিষয়গুলোর অনুসরণকে জরুরী মনে করা হচ্ছে দলিলের আলোকে বাস্তবেও সেগুলো শরিয়ত স্বীকৃত সুন্নত ও আদব কি না তা নিশ্চিত করা যায়।
এভাবে সময়ের চাহিদাকে সামনে রেখে দারুল উলুম দেওবন্দ আরো বেশ কিছু বিষয়কে তার পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। উম্মত যেন দলিলমুখী হয়, কুরআন-হাদীসভিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয় তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাসাওউফের পরিশুদ্ধিঃ
উম্মতের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য যে বিশেষ নিয়মকানুন অনুশীলন করেছেন তা তাসাওউফ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। পদ্ধতির উৎকর্ষ ও কাজের ব্যাপ্তির সাথে সাথে এটি দ্বীনী কাজের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কর্তৃক আনীত ঈমান ও আমলের সমন্বিত রূপকে তার সঠিক পরিচয় ও সঠিক মাপকাঠিতে ধরে রাখার জন্য তাসাওউফ শিরোনামের এ মেহনতটি একটি বড় ধরনের সহযোগী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আত্মার ব্যাধিসমূহ নিরাময়ের জন্য কুরআন, হাদীস এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কৌশল তৈরি করেছেন, প্রয়োগ করেছেন, প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মানবতার চির শত্রু দ্বীনের কোন ভালো কাজকেই ভালোভাবে চলতে দিতে চায় না। আর দ্বীনের যেসব বিভাগের উপর ইলমের নেগরানী দুর্বল সেসব বিভাগে তার প্রভাব বিস্তার তুলনামূলক বেশি থাকে। তাসাওউফের ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য।
শরীয়তের হাকীকত উপলব্ধি ও হাদীস নির্দেশিত ইহসানের স্তরে ইবাদতকে উন্নীত করার জন্য তাসাওউফের শিরোনামে যে মেহনত চালু করা হয়েছিল এবং এর ভালো ফলাফল উম্মত পেতে শুরু করেছিল সে তাসাওউফ কোন কোন ক্ষেত্রে এসে শরীয়তের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বসেছে। শরীয়তের যে আমলগুলোকে পূর্ণতায় পৌছানোর জন্য তাসাওউফের মেহনত শুরু হয়েছে সে আমলগুলোকেই অনর্থক কাজ বলে আখ্যা দেয়া হল। প্রথমেই শরীয়ত ও তরীকত দুটি নামে দ্বীনকে ভাগ করে ফেলা হল।
বলা হতে লাগল, হালাল-হারাম নির্ধারণে শরীয়ত ও তরীকতের মানদণ্ড আলাদা। কুরআন হাদীসের আলোকে হারাম ও কুফর হিসাবে প্রমাণিত বহু বিষয় তরীকতের মানদণ্ডে হালাল ও ওয়াজিব হিসাবে সামনে আসতে লাগল। কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কেয়াসের ইলমকে বলা হল, এটা প্রাথমিক পর্যায়ের দ্বীনদারদের ইলম। আর স্বপ্ন, কাশফ ও মুরাকাবাকে বলা হল, এটা কামেল দ্বীনদারদের ইলম। নুবুওয়াতের ইলম ও বেলায়েতের ইলম নামে দু'টি আলাদা ইলম আবিষ্কার করা হল।
আউলিয়া কেরাম আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা ও পরিচালনার উপর হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছেন- এমন ধ্যান ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। দ্বীনের প্রতিটি অঙ্গনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত সুন্নাহের পরিবর্তে খিযির আলাইহিস সালামের অলৌকিক পথ ও পন্থা বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে। আল্লাহ তায়ালার খাস গুণাবলী বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে শুরু করেছে। সাহাবা-তাবেয়ীনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ অলৌকিক-অসম্ভব ব্যাপারগুলো পরবর্তীরা ঘটাতে শুরু করেছেন। সর্বোপরি আউলিয়া কেরাম সিজদা পাওয়ার স্তরে পৌছে গেছেন।
কাঙ্খিত অবদানঃ
এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আকাবিরে দারুল উলুম দেওবন্দ দ্বীনী খেদমতের এ বিভাগটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। ইলমী তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে তাযকিয়া নফসের এ অনুশীলনকে সঠিক পথে অস্তিত্বের ধারণাকে বিলুপ্ত করার সাধ্য মাফিক চেষ্টা করেছেন। তাযকিয়ায়ে নফস তথা ইহসানের মকামে উন্নীত হওয়ার জন্য কুরআন-হাদীসে যেসকল নির্দেশনা এসেছে সেগুলোর প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করার মাধ্যমে যেসকল ক্ষেত্রে তাসাওউফের মেহনতের বিচ্যুতি ও স্থলন ঘটেছিল সেগুলোকেও শুধরানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাসাওউফের প্রচলিত ধারাগুলোর ততটুকু মূল্যায়ন তারা বহাল রাখার চেষ্টা করেছেন যতটুকুতে শরীয়তের বিরোধিতা হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের এ পদক্ষেপ ছিল সংস্কারমূলক, যে সংস্কারের তারা সূচনা করেছিলেন।
দারুল উলুম দেওবন্দের কর্ণধারগণের বেলায় এ দাবি করা যায় যে, তাসাওউফের পরিশুদ্ধিমূলক কার্যক্রমে তাঁরা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে সফলকাম হয়েছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেমন রাতারাতি আপন রূপে ফিরিয়ে আনা যায় না, তেমনিভাবে আকীদা বিশ্বাসের এ চরম বিচ্যুত পরিস্থিতি থেকে একটি জাতিকে সহীহ আকীদা বিশ্বাসের উপর তুলে আনাও কোন সহজ বিষয় নয়। এর সঙ্গে যদি বহিরাগত আরো বহু বাধারও সমাহার থাকে তাহলে তা আরো কঠিন। মোটকথা, দারুল উলুম দেওবন্দের সাহসী পদক্ষেপের বদৌলতে এ ভূখণ্ডের মুসলমানরা সহীহ আকীদা বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে এবং রূহের সহীহ খোরাক পেয়েছে।
অমুসলিমদের আগ্রাসন প্রতিরোধঃ
রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষমতা ব্যবহার করার পাশাপাশি খ্রিস্টবাদের প্রচারকরাও মুসলমানদের ঈমান আকীদার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছিল। ধর্ম প্রচারে উঠেপড়ে নেমে গিয়েছিল। সরলমনা মুসলমানদেরকে মিথ্যা গল্প শুনিয়ে, ইসলামের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করার সব ধরনের কৌশল তারা ব্যবহার করে চলছিল।
এমন এক নাযুক পরিস্থিতিতে ওলামায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ইসলামের অসারতা প্রমাণ করে, ইসলামের শোভা- সৌন্দর্যকে তুলে ধরে খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারকদের মিথ্যা গল্পের অসারতা প্রমাণ করে, ইসলামের সঠিক অবয়ব ও পরিচয়কে সামনে এনে এ মুসলিম জাতিকে সঠিক ধর্মের উপর টিকিয়ে রাখার সর্বাত্বক চেষ্টা করেছেন। গ্রস্থাবলী রচনা করেছেন। পাদ্রীদের সঙ্গে সম্মুখ বিতর্ক করেছেন, আর ইসলামের দাওয়াতকে সকল অঙ্গনে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ইসলামের পথে দাওয়াত দানকারীরা সবাই আজো তাঁদের সেসকল দাওয়াতি কলা কৌশল দ্বারা উপকৃত হচ্ছে, তাদের এ বিষয়ক গ্রন্থাবলী আজো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে দারুল উলুম দেওবন্দ আরো অসংখ্য স্বপ্ন ও কর্ম নিয়ে পথ চলা শুরু করেছে, শতাব্দীকাল চলেছে, এখনো চলছে। গন্তব্য সুনিশ্চিত, গতি পরিমিত এবং পদক্ষেপ দৃঢ়।
সংগৃহীত
দলিলভিত্তিক ফিকহ চর্চাঃ
“দারুল উলূম দেওবন্দ” দলিলভিত্তিক ফিকহ চর্চাকে তার পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রথমত- ফিকহে মুদাল্লাল তথা যে সকল কিতাবের মাসআলাগুলো দলিলের উল্লেখসহ লিখা হয়েছে সে সকল কিতাবকে এ পাঠ্যসূচিতে আনা হয়েছে। দ্বিতীয়ত- উসুলে ফিকহ তথা শরীয়তের দলীলসমূহ থেকে মাসআলা উদঘাটনের মূলনীতি বিষয়ে রচিত কিতাবাদি এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
পাঠ্যসূচিতে এ দু'টি বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি সুস্পষ্টভাবে জানান দেয় যে, উম্মত ব্যক্তির অনুসরণের উপর নির্ভরশীল হয়ে দলিল প্রমাণ তথা কুরআন, হাদীস, ইজমা, কেয়াস থেকে হাত ধুয়ে বসে থাকুক তা আকাবিরে দেওবন্দ চাইতেন না। বরং তারা চাইতেন ওলামায়ে কেরাম মুজতাহিদ পর্যায়ে উন্নীত না হলেও মুজতাহিদ ওলামায়ে কেরাম কোন পন্থায় কিসের ভিত্তিতে মাসআলা-মাসায়েল উদ্ভাবন করেছেন সে পথ ও উৎসগুলোর সঙ্গে ওলামায়ে কেরামের পরিচয় থাকুক।
যদি মনে করা হয়, কোন মাসআলা কোন দলিল থেকে কীভাবে কোন মূলনীতির আলোকে উদ্ভাবিত হয়েছে তা আমাদের দেখার বিষয় নয়, বা দেখা অনর্থক বা অনধিকার চর্চা তাহলে এ পুরা শিক্ষাব্যবস্থাকেই অনর্থক বলতে হবে। যে পড়াশোনার কোন প্রায়োগিক প্রভাব নেই তার পেছনে সময় ব্যয় করার কোন বৈধতা নেই।
তাই ফিকহে মুদাল্লাল এবং উসুলে ফিকহ চর্চা করার কার্যকরী দিকটি হচ্ছে, দলিল বহির্ভূত বা মূলনীতির বাইরে অন্য কোন পদ্ধতিতে যদি কেউ কোন আমলকে শরয়ী স্থান দিতে চায় তাহলে যেন নির্দিধায় তা প্রত্যাখ্যান করা যায়। যে বিষয়গুলো শরীয়তের দলিল হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি তার মাধ্যমে গায়রে শরীয়ত যাতে শরীয়তের লেবাস ধরতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা যায়। এতে করে একজন অনুসারী শতভাগ আস্থাশীল হয়ে উঠে যে, সে ফিকহ, মাযহাব ও আইম্মায়ে কেরামের ইজতেহাদের অনুসরণের মাধ্যমে মূলত দ্বীনের উৎসগুলোরই অনুসরণ করছে।
এমনিভাবে সুন্নত ও আদব শিরোনামে যে বিষয়গুলোর অনুসরণকে জরুরী মনে করা হচ্ছে দলিলের আলোকে বাস্তবেও সেগুলো শরিয়ত স্বীকৃত সুন্নত ও আদব কি না তা নিশ্চিত করা যায়।
এভাবে সময়ের চাহিদাকে সামনে রেখে দারুল উলুম দেওবন্দ আরো বেশ কিছু বিষয়কে তার পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। উম্মত যেন দলিলমুখী হয়, কুরআন-হাদীসভিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয় তার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে।
তাসাওউফের পরিশুদ্ধিঃ
উম্মতের বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিবর্গ আত্মার পরিশুদ্ধির জন্য যে বিশেষ নিয়মকানুন অনুশীলন করেছেন তা তাসাওউফ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। পদ্ধতির উৎকর্ষ ও কাজের ব্যাপ্তির সাথে সাথে এটি দ্বীনী কাজের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বিভাগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মুহাম্মাদে আরাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম কর্তৃক আনীত ঈমান ও আমলের সমন্বিত রূপকে তার সঠিক পরিচয় ও সঠিক মাপকাঠিতে ধরে রাখার জন্য তাসাওউফ শিরোনামের এ মেহনতটি একটি বড় ধরনের সহযোগী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আত্মার ব্যাধিসমূহ নিরাময়ের জন্য কুরআন, হাদীস এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কৌশল তৈরি করেছেন, প্রয়োগ করেছেন, প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কিন্তু মানবতার চির শত্রু দ্বীনের কোন ভালো কাজকেই ভালোভাবে চলতে দিতে চায় না। আর দ্বীনের যেসব বিভাগের উপর ইলমের নেগরানী দুর্বল সেসব বিভাগে তার প্রভাব বিস্তার তুলনামূলক বেশি থাকে। তাসাওউফের ক্ষেত্রে এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য।
শরীয়তের হাকীকত উপলব্ধি ও হাদীস নির্দেশিত ইহসানের স্তরে ইবাদতকে উন্নীত করার জন্য তাসাওউফের শিরোনামে যে মেহনত চালু করা হয়েছিল এবং এর ভালো ফলাফল উম্মত পেতে শুরু করেছিল সে তাসাওউফ কোন কোন ক্ষেত্রে এসে শরীয়তের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বসেছে। শরীয়তের যে আমলগুলোকে পূর্ণতায় পৌছানোর জন্য তাসাওউফের মেহনত শুরু হয়েছে সে আমলগুলোকেই অনর্থক কাজ বলে আখ্যা দেয়া হল। প্রথমেই শরীয়ত ও তরীকত দুটি নামে দ্বীনকে ভাগ করে ফেলা হল।
বলা হতে লাগল, হালাল-হারাম নির্ধারণে শরীয়ত ও তরীকতের মানদণ্ড আলাদা। কুরআন হাদীসের আলোকে হারাম ও কুফর হিসাবে প্রমাণিত বহু বিষয় তরীকতের মানদণ্ডে হালাল ও ওয়াজিব হিসাবে সামনে আসতে লাগল। কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কেয়াসের ইলমকে বলা হল, এটা প্রাথমিক পর্যায়ের দ্বীনদারদের ইলম। আর স্বপ্ন, কাশফ ও মুরাকাবাকে বলা হল, এটা কামেল দ্বীনদারদের ইলম। নুবুওয়াতের ইলম ও বেলায়েতের ইলম নামে দু'টি আলাদা ইলম আবিষ্কার করা হল।
আউলিয়া কেরাম আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা ও পরিচালনার উপর হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছেন- এমন ধ্যান ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। দ্বীনের প্রতিটি অঙ্গনে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত সুন্নাহের পরিবর্তে খিযির আলাইহিস সালামের অলৌকিক পথ ও পন্থা বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছে। আল্লাহ তায়ালার খাস গুণাবলী বান্দার ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে শুরু করেছে। সাহাবা-তাবেয়ীনের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ অলৌকিক-অসম্ভব ব্যাপারগুলো পরবর্তীরা ঘটাতে শুরু করেছেন। সর্বোপরি আউলিয়া কেরাম সিজদা পাওয়ার স্তরে পৌছে গেছেন।
কাঙ্খিত অবদানঃ
এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আকাবিরে দারুল উলুম দেওবন্দ দ্বীনী খেদমতের এ বিভাগটিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছেন। ইলমী তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে তাযকিয়া নফসের এ অনুশীলনকে সঠিক পথে অস্তিত্বের ধারণাকে বিলুপ্ত করার সাধ্য মাফিক চেষ্টা করেছেন। তাযকিয়ায়ে নফস তথা ইহসানের মকামে উন্নীত হওয়ার জন্য কুরআন-হাদীসে যেসকল নির্দেশনা এসেছে সেগুলোর প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করার মাধ্যমে যেসকল ক্ষেত্রে তাসাওউফের মেহনতের বিচ্যুতি ও স্থলন ঘটেছিল সেগুলোকেও শুধরানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। তাসাওউফের প্রচলিত ধারাগুলোর ততটুকু মূল্যায়ন তারা বহাল রাখার চেষ্টা করেছেন যতটুকুতে শরীয়তের বিরোধিতা হয়নি। এক্ষেত্রে তাদের এ পদক্ষেপ ছিল সংস্কারমূলক, যে সংস্কারের তারা সূচনা করেছিলেন।
দারুল উলুম দেওবন্দের কর্ণধারগণের বেলায় এ দাবি করা যায় যে, তাসাওউফের পরিশুদ্ধিমূলক কার্যক্রমে তাঁরা উল্লেখযোগ্য পর্যায়ে সফলকাম হয়েছেন। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে যেমন রাতারাতি আপন রূপে ফিরিয়ে আনা যায় না, তেমনিভাবে আকীদা বিশ্বাসের এ চরম বিচ্যুত পরিস্থিতি থেকে একটি জাতিকে সহীহ আকীদা বিশ্বাসের উপর তুলে আনাও কোন সহজ বিষয় নয়। এর সঙ্গে যদি বহিরাগত আরো বহু বাধারও সমাহার থাকে তাহলে তা আরো কঠিন। মোটকথা, দারুল উলুম দেওবন্দের সাহসী পদক্ষেপের বদৌলতে এ ভূখণ্ডের মুসলমানরা সহীহ আকীদা বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে এবং রূহের সহীহ খোরাক পেয়েছে।
অমুসলিমদের আগ্রাসন প্রতিরোধঃ
রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষমতা ব্যবহার করার পাশাপাশি খ্রিস্টবাদের প্রচারকরাও মুসলমানদের ঈমান আকীদার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছিল। ধর্ম প্রচারে উঠেপড়ে নেমে গিয়েছিল। সরলমনা মুসলমানদেরকে মিথ্যা গল্প শুনিয়ে, ইসলামের বিরুদ্ধে বিষ ছড়িয়ে বিভ্রান্ত করার সব ধরনের কৌশল তারা ব্যবহার করে চলছিল।
এমন এক নাযুক পরিস্থিতিতে ওলামায়ে দারুল উলুম দেওবন্দ ইসলামের অসারতা প্রমাণ করে, ইসলামের শোভা- সৌন্দর্যকে তুলে ধরে খ্রিস্টীয় ধর্মপ্রচারকদের মিথ্যা গল্পের অসারতা প্রমাণ করে, ইসলামের সঠিক অবয়ব ও পরিচয়কে সামনে এনে এ মুসলিম জাতিকে সঠিক ধর্মের উপর টিকিয়ে রাখার সর্বাত্বক চেষ্টা করেছেন। গ্রস্থাবলী রচনা করেছেন। পাদ্রীদের সঙ্গে সম্মুখ বিতর্ক করেছেন, আর ইসলামের দাওয়াতকে সকল অঙ্গনে ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ইসলামের পথে দাওয়াত দানকারীরা সবাই আজো তাঁদের সেসকল দাওয়াতি কলা কৌশল দ্বারা উপকৃত হচ্ছে, তাদের এ বিষয়ক গ্রন্থাবলী আজো অমুসলিমদেরকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে দারুল উলুম দেওবন্দ আরো অসংখ্য স্বপ্ন ও কর্ম নিয়ে পথ চলা শুরু করেছে, শতাব্দীকাল চলেছে, এখনো চলছে। গন্তব্য সুনিশ্চিত, গতি পরিমিত এবং পদক্ষেপ দৃঢ়।
সংগৃহীত
Comment