“رأيتُ جعفرًا يطير في الجنة مع الملائكة”
আমি জাফর ইবনে আবু তালেবকে জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে উড়তে দেখেছি।–আল হাদিস
হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশের বনী হাশেম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু তালেব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচা; কুরাইশদের মাঝে গণ্যমান্য একজন ব্যক্তি। হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও মুসলিমগণ দারুল আরকামে প্রবেশের পূর্বেই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর হাতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
প্রথমে ইসলাম গ্রহণকারী মুসলিমগণ কুরাইশের যে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন তাঁদের মধ্যে হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং তাঁর স্ত্রীও ছিলেন।
তাঁরা জানতেন, জান্নাতের পথ কন্টকাকীর্ণ; বিপদাপদে ঘেরা পথ। কিন্তু যে বিষয়টি তাঁদের কষ্ট দিতো, তা হলো ইসলামের বিধান পালনে তাঁদের মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করা। তাই হযরত জাফর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট নিজ স্ত্রী আসমা বিনতে উমাইস ও একদল মুসলিমদের নিয়ে হাবসায় হিজরতের অনুমতি প্রার্থনা করেন।
অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমতিতে জাফর ইবনে আবু তালিবের নেতৃত্বে মুহাজিরদের প্রথম দল হাবশায় হিজরত করেন।
সেখানে তাঁরা আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর রাজ্যে বসবাস করতে লাগলেন। বাদশাহ নাজ্জাশী ছিলেন ন্যায়পরায়ণ, তিনি কারো উপর জুলুম করতেন না।
এদিকে মক্কার মুশরিকরা নাজ্জাশীর কাছে হিজরতকারীদের বিরুদ্ধে চুরি এবং ধর্মত্যাগের অভিযোগ করে। তখন নাজ্জাশী সত্যতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে মুসলিম মুহাজিরদের ডেকে কিছু প্রশ্ন করেন। মুসলিমদের পক্ষ থেকে নাজ্জাশীর এসব প্রশ্নের জবাব খুব প্রজ্ঞার সাথে দেন হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু। জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জবাবে সন্তুষ্ট হন নাজ্জাশী।
হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু গরিব মিসকিনদের খুব ভালবাসতেন। তাঁদের সাখে উত্তম আচরণ করতেন। তাঁদের খেদমত করতেন। এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাকে বলতেন, আবাল মাসাকীন তথা মিসকীনদের পিতা।
৬২৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। এসেই শুনতে পেলেন যে, হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাইবার প্রান্তরে যুদ্ধরত আছেন। হযরত জাফর তৎক্ষণাৎ খাইবার অভিমুখে রওনা হন। তিনি খাইবার পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মুসলিমরা যুদ্ধে জয়ী হয়ে যান।
জাফর ইবনে আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাত :
৮ম হিজরীতে মূতা প্রান্তরে মুসলিম ও রোমানদের মাঝে লড়াই হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেছিলেন মুসলিমদের প্রথম সেনাপতি হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু যদি শহিদ হয়ে যান, তাহলে হযরত জাফর ইবনে আবু তালেব রাদিয়াল্লাহু আনহু যুদ্ধের সেনাপতি হবেন। যদি জাফর শহিদ হয়ে যান, তাহলে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা রাদিয়াল্লাহু আনহু সেনাপতি হবেন। অতঃপর মূতা প্রান্তরে পৌঁছে দেখা গেল মুসলিমদের ৩ হাজার সেনার বিপরীতে রোমানদের সংখ্যা ১ লাখ।
যুদ্ধ শুরু হতেই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করে হযরত যায়েদ বিন হারেসা রাদিয়াল্লাহু আনহু শহিদ হয়ে যান। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বাদেশ অনুযায়ী মুসলিমদের পতাকা হাতে তুলে নেন হযরত জাফর রাদিয়াল্লাহু আনহু। সেনাপতি হিসাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন তিনি। ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলে এক পর্যায়ে তিনি তাঁর লোহিত বর্ণের ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়েন এবং ঘোড়াটির পা কেটে ফেলেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শত্রু সৈন্যের মাঝে ঢুকে পড়েন যুদ্ধের পতাকা ডান হাতে ধারণ করে। কাফিরদের তরবারির আঘাতে প্রথমে তাঁর ডান হাত শহীদ হয়ে যায়। বাম হাতে তিনি পতাকা তুলে ধরলে এবার তাঁর বাম হাতও শত্রুর তরবারির আঘাতে শহীদ হয়। এরপর তিনি তা বাহুদ্বয়ের সাহায্যে বুকের সাথে ইসলামের পতাকা তুলে ধরেন। আর এ অবস্থাতেই শত্রুর উপুর্যপরি বর্শা ও তরবারির আঘাতে তিনি শাহাদাতবরণ করেন।
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
আমি জাফর ইবনে আবু তালেবকে জান্নাতে ফেরেশতাদের সাথে উড়তে দেখেছি।–আল হাদিস
এজন্য সেই দিন থেকে তাঁকে জাফরে তাইয়্যার উপাধি দেওয়া হয়েছে।
হযরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি তাঁর দেহে তরবারি ও বর্শার নব্বইটি আঘাত প্রত্যক্ষ করেছি। প্রত্যেকটি আঘাতই তাঁর দেহের সম্মুখভাগে। পশ্চাৎভাগে কোনো আঘাতই ছিল না।’
যখন তিনি শহীদ হয়ে গেলেন তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরীফের মসজিদে নববীতে বসে বসে সব কিছু দেখতে পেলেন। তিনি হঠাৎ করে গায়েবী সালামের জবাব দিয়ে বলেন: ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম’ উপস্থিত সাহাবাগণ কারণ জিজ্ঞাস করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘ইন্নি আছমাউ মা লা তাছমাউন ওয়াইন্নি আরা মা লা তারাওনা’। অর্থাৎ, তোমরা যা শোনো না আমি তা শুনি, তোমরা যা দেখ না আমি তা দেখি।
তথ্যসূত্র:
সিরাতে ইবনে হিসাম
আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া
আল কামেল ফিত তারিখ/ ইবনে আসির
Comment