এখন থেকে ৪৪ বছর আগের ঘটনা, ১৯৭৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (সৌর হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১৩৫৭ সালের ২৬শে দালওয়া)। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এক লক্ষ সোভিয়েত সৈন্য হীরতান সীমান্ত (আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যবর্তী একটি সীমান্ত) থেকে আফগানিস্তানে আগ্রাসী আক্রমণের সূচনা করে।
অতঃপর দীর্ঘ এক দশক আফগানিস্তানে রুশ বাহিনী দখলদারিত্ব, যুদ্ধাপরাধ এবং মুসলিমদের ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন, রচিত হয় অত্যাচারের করুণ এক ইতিহাস। যদিও শেষ পর্যন্ত মুজাহিদদের হাতে আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
সোভিয়েতের লাল ফৌজ বা রেড আর্মি আফগানিস্তানে আক্রমণের সিদ্ধান্তটি ছিল একটি ব্যর্থ সিদ্ধান্ত। কারণ আফগানিস্তানে আক্রমণের পর তাদেরকে বিশ্ব রাজনীতিতে কঠিন প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সেসময় তারা কেবল আফগানিস্তান থেকেই বিতাড়িত হয়নি, বরং তাদের আধিপত্যে থাকা অন্যান্য এলাকা থেকেও নিয়ন্ত্রণ হারাতে হয়েছিল।
বিশ্বের পরাশক্তিগুলো যখনই আফগানিস্তান আক্রমণ করেছে, তখনই চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। কিন্তু কেন তারা এমন ঝুঁকিতে পড়ল? আধুনিক সমরাস্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নতিই কী তাদেরকে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তারে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছিল? অথবা, খুব সম্ভবত তারা নিজেদেরকে বাস্তব ক্ষতির মুখোমুখি করা ছাড়া প্রকৃত মর্ম অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
পূর্বে আফগানিস্তান থেকে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের পরাজয় ঘটেছে। এছাড়াও “আফগানিস্তান সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান” উক্তিটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, তা সত্ত্বেও সমসাময়িক সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো কেন আবারও তাদের ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে? কেন তারা আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে নিরপরাধ জনগণকে বারবার ক্ষত-বিক্ষত করেছে? কেন তারা আফগানিস্তানে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহ ও বিশ্ববাসীকে বিভিন্ন সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে?
প্রশ্নগুলোর উত্তর এখনো স্পষ্ট নয়, কারণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সব জায়গায় তাদের অহমিকা জুলুম অত্যাচারের আস্তাকুড়ের ফাঁদে আটকা পড়েছে।
আফগানিস্তানের অতীত ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা বিশ্ববাসীর জন্য একটি জাগরণী বার্তা হিসেবে কাজ করবে। এবং এর ফলে হানাদার দেশগুলো পুনরায় আর আফগানিস্তানের ক্ষতিসাধনের চেষ্টা করবে না বলে আমরা আশা করি।
দৃঢ়চিত্তের অধিকারী বীর আফগান জাতি অন্তত এটি বুঝতে সক্ষম যে, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললে দেশের অর্থনীতি, উন্নতি এবং বৈদেশিক নীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তাছাড়া হত্যা, ধ্বংসযজ্ঞ, অর্থনৈতিক চাপ এবং দারিদ্র্যতা বৃদ্ধি পাবে। তা সত্ত্বেও আফগান মুসলিমদের প্রকৃতি ও সুদৃঢ় ঈমান ভিন্ন জাতির দাসত্ব ও আনুগত্য করতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, নৃশংস হানাদার বাহিনীর সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি ছিন্নভিন্ন করতে আল্লাহর রাস্তায় আন্তরিক জিহাদই একমাত্র পথ। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে বলেন, وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن کُنتُم مُّؤْمِنِینَ তোমরা হীনবল হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না, বস্তুতঃ তোমরাই জয়ী থাকবে যদি তোমরা মু’মিন হও। [সূরা আল-ইমরান ৩ঃ১৩৯]
ইতিহাস এই সত্যের সাক্ষ্য দেয় যে, যখন কোনো মুসলিম জাতি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করে এবং স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব ভুলে যায়, তখন তারা আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতা হারানোর আশংকায় পড়ে। যারা বিদেশী দখলদারের চাপিয়ে দেয়া উপনিবেশের ছায়ায় আরামে রাতযাপন করে, তারা প্রকারান্তরে মুসলিম ভূমিসমূহে একের পর এক অগ্নিকুণ্ডের পথ সুগম করে। এ কারণেই উপনিবেশকারী শক্তি এক সময় সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান নামে খ্যাত আফগানিস্তান অনুপ্রবেশ করতে সাহস করে।
উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসে এমন অনেক ব্যক্তি ছিল, যারা ক্ষমতা ও তুচ্ছ পার্থিব লাভের আশায় ক্ষমতাসীন প্রভুদের সন্তুষ্ট করতে নিজেদের ঈমানী ও রাজনৈতিক চেতনাকে বিক্রি করে দিয়েছিল।
আফগান জনগণ লড়াইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের তিনটি পরাশক্তিকে একের পর এক পরাজয়ের স্বাদ আস্বাদন করিয়েছেন। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম উল্লেখযোগ্য, যারা ছিল যুদ্ধের মূল ইন্ধন দাতা ও অসংখ্য নৃশংসতার মূল হোতা। পরাশক্তি দেশগুলো পরাজয়ের পর পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য থেকে শিক্ষিত অনেক আফগান নাগরিক দেশে ফিরে আসে। সেসময় এসব শিক্ষিতরা সুশীল সমাজের বেশ ধরে বিদেশ থেকে আমদানি করা নোংরা মতবাদকে আফগান জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়ারও ষড়যন্ত্র করেছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানের বেসামরিক জনগণের ওপর চরম সীমালঙ্ঘন করেছে। সারাবিশ্ব আজ তাদের জুলুম নির্যাতনের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত। তারা কখনোই আফগান জাতিকে বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করতে দেয়নি। নিরাপত্তা ও স্বাধীনভাবে নিজ দেশে বাঁচতে দেয়নি। বরং তারা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে নিজেদের অনুগত দাসে পরিণত করে চক্রান্তের জাল বাঁধে। এর মাধ্যমে তারা নিরীহ আফগানবাসীকে ধ্বংসযজ্ঞের দিকে ঠেলে দেয়, এমনকি তারা নিজেরাও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে পরে যায়।
সোভিয়েত লালফৌজ যখন আফগানিস্তানের কমিউনিস্টপন্থী পুতুল প্রশাসনকে সমর্থন এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাবকে আরও প্রসারিত করতে অনুপ্রবেশ করে, তখন কমিউনিজম মতবাদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিলো। তারা সোভিয়েত হানাদার বাহিনীর ভোগদখল, নিপীড়ন, স্বার্থপরতা ও উদ্ধতপূর্ণ আগ্রাসনকে ত্বরান্বিত করেছিল। দখলদারিত্বের শুরু থেকেই তারা নির্লজ্জভাবে আফগান জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবমাননা করেছে। এমনকি স্থল ও আকাশ উভয় পথেই তারা নির্মমভাবে বোমা হামলা চালিয়েছিল।
আফগান জনগণ তাদের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার সূত্রেই মুসলিম ভূমির আত্মরক্ষার বিষয়ে সচেতন ছিল। তারা কখনোই বহিঃশক্তির আগ্রাসনে ভীত হয়নি। তাদের সুদৃঢ় চেতনা সোভিয়েত লালফৌজের জবরদখলের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত লাল ফৌজের জুলুম-নির্যাতন দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এই আগ্রাসনের ফলে দেশের অর্থনীতিতে ধ্বস নামে এবং আফগান জনগণ চরম দারিদ্র্যতা ও নিপীড়নের মধ্যে নিমজ্জিত হয়।
বিশ্বের সব মুসলিম দেশ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো লালফৌজের ভয়ংকর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আর নিরীহ আফগান বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আফগানবাসীর ক্রোধ এবং স্বাভাবিক প্রকৃতিও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছিলো। ফলে ব্যাপক বিদ্রোহ আরম্ভ হয়। লোকেরা কুড়াল, বেলচা এমনকি কোদালের মতো কৃষি সরঞ্জাম নিয়েও যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়ে। এবং সোভিয়েত লাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদে নেতৃত্বদানকারী মুজাহিদীনদের পাশে একত্রিত হয়ে সমর্থন জানায় তারা।
অবশেষে ১৯৮৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (১৩৬৭ সালের ২৬শে দালওয়া) আবরাহার হস্তিবাহিনী যেমন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, কোদাল ও বেলচার মতো নগণ্য অস্ত্রে সজ্জিত আফগানবাসীর হাতে তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তির লাল বাহিনীও তেমনি নাস্তানাবুদ হয়েছিলো। মুজাহিদ বাহিনীর আঘাতে তাদেরকে আফগানিস্তান থেকে পলায়নের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত করেছিল। পরিশেষে লজ্জা ও অবমাননার ইতিহাস নিয়ে তারা আফগানিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়।
তথ্যসূত্র:
——-
1) 26th of Dalwa, a reminder of the indomitable spirit of innocent Afghans in resistance against invaders
– http://tinyurl.com/dkm85sem
Comment