সীরাত থেকে শিক্ষা- ০১ অনেকে হক বুঝেও কবুল করে না, বরং বিরোধিতা করে
মাক্কী যিন্দেগি: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কায় ছিলেন, মক্কার নেতারা ঈমান আনেনি। তার মধ্যে রাসূলের বড় দুশমন ছিলো আবু জাহেল। অপরদিকে বড় আশ্রয় ছিলেন রাসূলের চাচা আবু তালেব।
আবু তালেব এবং আবু জাহেল উভয়ই হক বুঝেছে। স্পষ্টই জানতো যে, রাসূল আল্লাহর নবী। এরপরও কেন ঈমান আনলো না?
আবু জাহেল: আবু জাহেল রাসূলকে নবী মানেনি হিংসাবশত। অন্যকে নিজের চেয়ে বড় মানতে সে ছিল নারাজ। মুগিরা বিন শুবা রাদি. বলেন, আমি কিভাবে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি জানো? একদিন আবু জাহেল আমাকে বললো, মুগিরা! আমি তো জানি মুহাম্মাদ নবী। কিন্তু আমি তাকে কখনই নবী বলে স্বীকার করবো না। বনু হাশেম (রাসূলের বংশ) আমাদের চেয়ে বড় হয়ে যাক তা আমি কখনই হতে দিতে চাইনি। সবসময় চেয়েছি তাদের টেক্কা দিতে। কিন্তু এখন যে তারা নবী দাবি করে বসলো, এটা স্বীকার করে নিলে তাদের সাথে টেক্কা দেয়ার আর কোনো উপায় থাকবে না (কারণ, চেষ্টাবলে তো আর নবী হওয়া যাবে না, নবীর মর্যাদা আখের অধরাই থেকে যাবে)। কাজেই মুহাম্মাদকে আমি স্বীকারই করবো না যে, সে নবী। স্বীকার করলে তারা আমাদের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী হয়ে যাবে, যার সমান আমরা আর কখনই হতে পারবো না।
মুগিরা বিন শুবা রাদি. বলেন, আবু জাহেলের কথাটি শুনার পর থেকে আমি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি।[1]
আবু তালেব: আবু তালেব ঈমান আনেননি কেন? তিনি তো জানতেন রাসূল আল্লাহর নবী। এবং তিনি আজীবন রাসূলকে রক্ষা করে গেছেন। তিনি যতদিন হায়াতে ছিলেন, কাফেররা রাসূলের গায়ে হাত দিতে সাহস করতো না। তিনি মারা যাওয়ার পর রাসূলের উপর থেকে প্রতিরক্ষার ছায়াটি উঠে যায়। কাফেররা দুঃসাহসী হয়ে উঠে। তায়েফের মতো মর্মান্তিক ঘটনা তখন ঘটে। চাচা আবু তালেব ঢাল হয়ে আজীবন রাসূলকে রক্ষা করে গেছেন, কিন্তু শেষে ঈমান কবুল না করেই কেন মারা গেলেন? কারণ, লোকজন বলবে, বাপদাদার ধর্ম ছেড়ে আবু তালেব শেষে ভাতিজার ধর্ম মেনে নিলো। লোকটা তো বড় সমঝদার ছিলো, বড় বুদ্ধিমান ছিল, বড় দৃঢ় মানুষ ছিল; কিন্তু মরার সময় সব হারালো। মরণের ভয়ে আদর্শ বিসর্জন দিলো। এই লজ্জা তিনি সইতে পারবেন না, তাই জাহান্নাম বরণ করে নিলেন।[2] নাউজুবিল্লাহ।
মাদানী যিন্দেগি: রাসূল মদীনায় যাওয়ার পর মদীনায় প্রধান দুশমন ছিলো ক. মদীনার ইয়াহুদিরা খ. মদীনার মুনাফিকরা। এছাড়াও আস্তে আস্তে আরব ও তার আশপাশের ইয়াহুদি, খৃস্টান, মাজুসি ও মুশরিকরা দুশমন হয়ে উঠতে থাকে। তাদের মধ্যে গ. রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াস উল্লেখযোগ্য।
ইয়াহুদ: ইয়াহুদ-নাসারার কাছে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের ইলম ছিল (তাওরাত ও ইঞ্জিল)। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে শেষ নবীর বিবরণ ছিল। সে বিবরণ দেখে ইয়াহুদিরা শতভাগ নিশ্চিতভাবেই জানতো যে, রাসূল আল্লাহর নবী। এই ইয়াহুদিরা মদীনায় আনসারিদের পাশে বাস করতো। তাদের মুখে মুখে শুনে আনসারি সাহাবাগণ মুশরিক থাকতেই শেষ নবী সম্পর্কে অনেক কথা জেনে ফেলেছিলো। শেষে নবীজির দাওয়াত পেয়ে তারা বুঝতে পারে যে, ইয়াহুদিদের মুখে তারা যে শেষ নবীর বিবরণ শুনে আসছিল, তিনিই সেই শেষ নবী। তখন তারা ঈমান আনেন। রাসূলকে নিজ দেশে আশ্রয় দেন।
পক্ষান্তরে ইয়াহুদিরা; যারা দিবালোকের মতো রাসূলকে সত্য নবী হিসেবে জানতো- তারা তাঁকে নবী হিসেবে স্বীকৃতি দিলো না, বরং কূটচাল শুরু করলো।
ইয়াহুদিরা কেন মানলো না? কারণ, রাসূল ইয়াহুদিদের বংশের লোক না। বিধায় আবু জাহেলের মতো তারাও হিংসাবশত অস্বীকার করলো। ইয়াহুদি বংশের নয় এমন লোককে নবী স্বীকার করলে তো তাদের মান কমে যাবে। এটা হতে পারে না!
হিরাক্লিয়াস: হিরাক্লিয়াস নাসারাদের সম্রাট এবং বড় ইলমওয়ালা পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলো। সহীহ বুখারিসহ অন্যান্য কিতাবে বিস্তারিত বিবরণ এসেছে যে, হিরাক্লিয়াস রাসূলকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করেছে এবং স্বীকারও করেছে। কিন্তু নবীর আনুগত্য মেনে নিলে রোমানরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। রাজত্ব হারানোর ভয়ে সে রাসূলকে নবী হিসেবে জানা ও স্বীকার করার পরও মুসলমান হলো না। বরং রাসূলের বিরুদ্ধে আজীবন যুদ্ধ করে গেলো।
অপরদিকে হাবশার বাদশা নাজ্জাশিও খৃস্টান ছিলেন। তিনি সাহাবাদের কাছে রাসূলের বিবরণ শুনে মুসলমান হয়ে যান। কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে হাবশায় হিজরত করে যাওয়া মুহাজির সাহাবাদের নিরাপত্তা বিধান করেন।
দু’জনের মাঝে বেশ-কমটা কোথায়? একজন রাজত্বের মায়া ত্যাগ করতে পারলো না, আরেকজন আখেরাতের রাজত্বের সামনে দুনিয়ার সামান্য রাজত্ব বিসর্জন দিতে কুণ্ঠাবোধ করলো না।
***
এভাবেই হক বুঝার পরও অনেকে হক কবুল করে না, হককে হক বলে স্বীকার করে না। কেউ ক্ষমতা, নেতৃত্ব হারানো ভয়ে। কেউ লোকজনের সামনে ছোট হতে হবে ভয়ে। কেউ আপন ঘরানার না হওয়ার কারণে।
সুবহানাল্লাহ! ঈমানের পথে যেসব জিনিস বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল; আজ জিহাদের পথে, দ্বীনের পথে সেসব জিনিসই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেউ এই ভয়ে যে: চাকরি চলে যাবে।
কেউ এই ভয়ে যে, লোকজন কি বলবে?!
কেউ এই কারণে যে, তাদের ঘরানার লোক না।
কেউ এই ভয়ে যে, এতোদিন বিরোধিতা করেছি, এখন মেনে নিলে তো আমি হার মানলাম।
ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন অজুহাত, বিভিন্ন বাধা। হাদিসে এসেছে: শয়তান যখন একটা মানুষকে ঈমান থেকে ফেরাতে পারে না, তখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে- অন্তত হিজরত ও জিহাদ থেকে যেন বিচ্যুত করতে পারে। সুবহানাল্লাহ! রাসূলের বাণী কতই না সত্য।
***
শিক্ষা: সীরাত থেকে বুঝা গেলো: হকের দাওয়াত যতভাবেই পেশ করা হোক; যত ভালো করে, যত দলীল প্রমাণ দিয়ে, যত হৃদয়গ্রাহী করেই বুঝানো হোক: বড় বড় নেতৃত্বস্থানীয় অনেক লোক এমন থেকে যাবে, যারা দিল থেকে সত্যকে উপলব্ধি করবে, কিন্তু বিভিন্ন স্বার্থের সামনে হার মেনে সত্যকে অস্বীকার করবে, বিরোধিতা।
অতএব, শুধু মুখের দাওয়াত আর আখলাক দেখিয়েই সবাইকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে আসা যাবে, তরবারি প্রয়োগের দরকার পড়বে না: এ ধারণা চরম ভুল। নতুবা কেন ইয়াহুদিরা ঈমান কুবল করলো না? কেন আবু জাহেল রাসূলকে নবী বলে স্বীকার করলো না? কেন হিরাক্লিয়াস আবু তালেবের মতো লোকেরা সব জেনে বুঝে এবং স্বীকার করেও হক গ্রহণ করলো না?
@ রাসূল কি তাদেরকে সঠিকভাবে দাওয়াত দিতে পারেননি? (নাউযুবিল্লাহ)
@নাকি তারা হক বুঝেনি?
@ নাকি বুঝেও কবুল করেনি?
যখন বিষয়টি এমনই, তাহলে আজ আমরা কিভাবে আশা করছি শুধু দাওয়াত দিয়েই ইসলাম বিজয় করে ফেলবো? যেটি রাসূলের দ্বারা সম্ভব হয়নি, সেটি আমরা নাদানরা করে ফেলবো! কস্মিনকালেও না। বরং এদের বেলায় সে পন্থাই গ্রহণ করতে হবে, যা রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম গ্রহণ করেছেন। বদরে, উহুদে, খন্দকে। বনু নজির, বনু কুরাইজা, খায়বারে। মূতা ও তাবুকে। ফাতহে মক্কায়। আহলে রিদ্দার বিরুদ্ধে। ইয়ামামা, কাদিসিয়া ও ইয়ারমুকে।
হে আল্লাহ আমাদেরকে ঈমানের সহীহ বুঝ দান কর। আমাদের আখলাক সুন্দর করে দাও। আমাদের বানিয়ে দাও রাতের দরবেশ আর দিনের অশ্বারোহী বীর সেনানী। যেমনটা বানিয়েছিলে তোমার নবীকে। নবীর সাহাবাগণকে।
********
***
***
[1] سير أعلام النبلاء ط الحديث (1/ 217): وقال يونس بن بكير، عن هشام بن سعد، عن زيد بن أسلم، عن المغيرة بن شعبة، قال: إن أول يوم عرفت رسول الله صلى الله عليه وسلم إني أمشي أنا وأبو جهل، إذ لقينا رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال لأبي جهل: "يا أبا الحكم هلم إلى الله وإلى رسوله، أدعوك إلى الله". فقال أبو جهل: يا محمد هل أنت منته عن سب آلهتنا، هل تريد إلا أن نشهد أن قد بلغت، فوالله لو أني أعلم أن ما تقول حقا ما اتبعتك. فانصرف رسول الله صلى الله عليه وسلم، وأقبل علي فقال: والله إني لأعلم أن ما يقول حق، ولكن بني قصي قالوا: فينا الحجابة، فقلنا: نعم، فقالوا: ففينا الندوة، قلنا: نعم، ثم قالوا: فينا اللواء، فقلنا: نعم، وقالوا: فينا السقاية، فقلنا: نعم، ثم أطعموا وأطعمنا حتى إذا تحاكت الركب قالوا: منا نبي. والله لا أفعل. اهـ
[2] صحيح مسلم للنيسابوري (1/ 41): 144 - حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ حَاتِمِ بْنِ مَيْمُونٍ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ سَعِيدٍ حَدَّثَنَا يَزِيدُ بْنُ كَيْسَانَ عَنْ أَبِى حَازِمٍ الأَشْجَعِىِّ عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- لِعَمِّهِ « قُلْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ أَشْهَدُ لَكَ بِهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ ». قَالَ لَوْلاَ أَنْ تُعَيِّرَنِى قُرَيْشٌ يَقُولُونَ إِنَّمَا حَمَلَهُ عَلَى ذَلِكَ الْجَزَعُ لأَقْرَرْتُ بِهَا عَيْنَكَ فَأَنْزَلَ اللَّهُ (إِنَّكَ لاَ تَهْدِى مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَهْدِى مَنْ يَشَاءُ).
Comment