Announcement

Collapse
No announcement yet.

৫৭০-৬১০ – ইসলাম-পূর্ব আরবঃ ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট-

Collapse
This is a sticky topic.
X
X
 
  • Filter
  • Time
  • Show
Clear All
new posts

  • ৫৭০-৬১০ – ইসলাম-পূর্ব আরবঃ ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট-

    ইসলাম-পূর্ব আরবের বিশেষত্ব কি ছিল?

    ৭ম শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখন আরব মরুর বুক থেকে নতুন এক ধর্মীয় ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে, অবতীর্ণ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই রাসূল ﷺ এর নেতৃত্বে ইসলাম গোটা আরব উপদ্বীপের জীবনধারা হয়ে উঠে। প্রথম চার খলিফার শাসনামলেই*পশ্চিমদিকে লিবিয়া এবং পূর্বদিকে পারস্য পর্যন্ত ইসলামের বিস্তার*ঘটে। আর রাসূল ﷺ এর ইন্তেকালের ১০০ বছরের মধ্যেই মুসলিমরা ইসলামের এই ব্যাপ্তি*স্পেন*থেকে*হিন্দুস্তান*পর্যন্ত নিয়ে যায়।

    বিশ্বের ইতিহাসজুড়ে কোন আন্দোলনই প্রথম ১০০ বছরের মধ্যে ইসলামের মতো এতো দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারেনি। ইসলামের মধ্যে এমন কি বিশেষত্ব ছিল এবং এমন কোন অবস্থায়ই বা এর পত্তন ঘটেছিল যে এর বাণী এতো দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল? কিছু ইতিহাসবেত্তা এই দ্রুত বিস্তারের সহজ-সরল ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আরব উপদ্বীপের নিয়মিত খরা, আরবদের নিয়মিত অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও গৃহযুদ্ধ, আরবদের গৌরব ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি বিষয়কে কারণ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন। তবে সত্য অবশ্যই এমন একবাক্যের সহজ-সরল ব্যাখ্যার চেয়ে অনেক বেশী জটিল এবং সূক্ষ্ম। বাস্তবতা হচ্ছে, আরব উপদ্বীপ এবং ততসংলগ্ন অঞ্চলগুলো ইসলামের মতো এমন এক শক্তিশালী একেশ্বরবাদী ধর্ম এবং ঐক্যবদ্ধ শক্তির আগমনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল। ৭ম শতকের শুরুর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, ভাষা, ভূ-প্রকৃতি এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেমন ছিল, ইসলামের আগমনের জন্য এর চেয়ে আর ভাল সামগ্রিক পরিস্থিতি আর হতে পারতো না।

    আরব উপদ্বীপের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা

    আরব উপদ্বীপ হচ্ছে এক রুক্ষ, কর্কশ ভূমি। স্থায়ী কোন নদী, জলপ্রবাহ কিংবা হ্রদের অস্তিত্ব এখানে নেই। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মরুদ্যানগুলোই হচ্ছে এ অঞ্চলে জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন। মরুভূমির মাঝ দিয়ে ভ্রমণ খুবই কষ্টসাধ্য, জীবন বাজি রেখে চলার মতো। এমনকি এখনো এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে যেগুলো পানিশূন্যতার কারণে জনমানবহীন।

    এই ঊষর মরু আরবদের এবং আরব উপদ্বীপের বাইরের লোকদের মাঝে এক ধরনের ‘বাফার জোন’ বা নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে কাজ করতো। এই উপদ্বীপটি ইসলাম আগমনের আগেই তৎকালীন আরবদের মাঝে “জাজিরাত আল-আরব” কিংবা “আরবদের দ্বীপ” হিসেবে পরিচিত ছিল। বহির্বিশ্বের সাথে এই অঞ্চলটির বিচ্ছিন্নতাই ছিল অঞ্চলটিকে দ্বীপ হিসেবে অভিহিত করার কারণ। একমাত্র একজন বলিষ্ঠ, কষ্টসহিষ্ণু, প্রশিক্ষিত আরবের পক্ষেই এই বিজন অঞ্চলে টিকে থাকা সম্ভব। এই অঞ্চলের বাইরের লোকজন এই উপদ্বীপে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। তারপরও তখন দু’টো সাম্রাজ্য ছিল যারা এই প্রচেষ্টা করেছিল


    ইসলামের আগমনের পূর্বে বিশ্বে আরব উপদ্বীপ নিয়ন্ত্রণকারী কোন পরাশক্তি ছিলনা। রোমানরা ভূমধ্যসাগর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করতো এবং রোমানরাই ছিল প্রাচীনকালে বিশ্বের পরাশক্তি। কেউ যদি আরব বিশ্ব জয় করতে পারতো তাহলে একমাত্র রোমানরাই পারতো। প্রকৃতপক্ষে রোমানরা তাদের রাজত্ব বিস্তার করার লক্ষ্যে ২৪ খ্রিস্টপূর্ব সনে একবার আরব উপদ্বীপে আক্রমণ করেছিল, তবে*এটি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। জগৎবিখ্যাত রোমান সৈন্যরা হয়তো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের আবহাওয়ায় অনেক কার্যকরী ছিল, তবে আরব মরুভূমিতে নয়। রোমানরা কখনোই তাদের নিয়ন্ত্রণ আরব মরুভূমির উত্তর সীমান্তের বাইরে নিয়ে যেতে পারেনি।

    ইসলাম-পূর্ব যুগে অন্য আরেক পরাশক্তি ছিল পারসিক (পারস্য/ফারসি) সাম্রাজ্য। আরব উপদ্বীপের উত্তর এবং পূর্বদিকে অবস্থিত এই সাম্রাজ্যটিও আরবে আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল। যার ফলে রোমানদের সাথে ফরাসিদের উপর্যুপরি সংঘাত ও যুদ্ধ লেগেই থাকতো। এ দুই শক্তির মধ্যে একের পর এক এই মহাকাব্যিক ইঁদুর-বিড়াল খেলায় সম্মুখ যুদ্ধের সীমারেখা সিরিয়া এবং ইরাকের মধ্যেই ঘুরপাক খেতো। উভয় পক্ষই একে অপরের অগ্রগতি সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখতো, যার ফলে কোন পক্ষই আরব ভূমিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

    উত্তরদিকে অবস্থিত শক্তিশালী দু’টি প্রতিবেশী সাম্রাজ্যের মাঝে অবিরত যুদ্ধের কারণে আরবরা বস্তুত স্বাধীন ছিল। মূলত, আরবরা একপ্রকার বিচ্ছিন্নও ছিল। এই বিচ্ছিন্নতার কারণে দূরবর্তী সাম্রাজ্যসমূহের রাজনৈতিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আরবদের তেমন মাথা ঘামাতে হয়নি কখনো। তাই বহিঃশক্তির কোন ধরনের আধিপত্য ছাড়াই তারা জীবনধারণ করতে পারতো, সেই সাথে তৈরী করে নিয়েছিল নিজেদের মতো করে এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছিল বিকেন্দ্রীভূত এক রাজনৈতিক ধারা, যার ফলে বেড়ে গিয়েছিল ব্যক্তি ও পারিবারিক স্বাধীনতা। গোত্রের প্রতি আনুগত্য ছিল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি। গোটা উপদ্বীপে মরুভূমিজুড়ে বসবাসরত ডজনখানেক গোত্র যাযাবরবৃত্তি, পশুচারণ, ব্যবসা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতো।

    ভাষা ও সংস্কৃতি

    আরবদের সংস্কৃতি তাদের ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতা দ্বারা খুব বেশী প্রভাবিত ছিল। রুক্ষ কঠোর মরু তো আর একাকী থাকার জায়গা নয়, তাই দাবদাহ ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত টিকে থাকার লড়াইয়ে আত্মীয়স্বজনদের উপর নির্ভরতা ছিল অপরিহার্য। একারণে পরিবার ও গোত্র ছিল আরব সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইউনিট। একইসাথে আতিথেয়তা আরব সংস্কৃতিতে বড় ভূমিকা পালন করতো। মেহমানরা নিরাপত্তা চাওয়ামাত্রই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো, এমনকি শত্রুর তাড়া খেয়ে পলায়নরত অবস্থায় নিরাপত্তা চাইলেও নিরাপত্তা দেয়া হতো। নিজ পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং মেহমানদের নিরাপত্তা প্রদান করার এই প্রথা আরব সংস্কৃতিতে সেই ৭ম শতকের শুরুতেই খুব ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল।

    ধর্মীয় দিক দিয়ে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে আরবরা ছিল বহুশ্বরবাদী। ইব্রাহিম (আ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাইল (আ) আরবদেরকে একেশ্বরবাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮০০ সনে মক্কার পবিত্র কা’বা শরীফ নির্মাণ করেছিলেন। কালের পরিক্রমায় আরবরা ইব্রাহিম (আ) এর একেশ্বরবাদের বাণী বিকৃত করে ফেলে এবং প্রতিমা বা মূর্তির মতো অসংখ্য ক্ষুদ্রাকৃতির “ঈশ্বর” এর প্রবর্তন করে। মজার ব্যাপার হলো, এরপরও তারা মনে করতো আল্লাহই মূল কর্তৃত্বের অধিকারী এবং মূর্তিগুলো আল্লাহর সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নিয়েছে (নাউজুবিল্লাহ্*)। ফলশ্রুতিতে, এক আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে বানানো মসজিদ থেকে পবিত্র কা’বাঘর পরিণত হলো ৩৬০ টিরও বেশী মূর্তি সম্বলিত এক উপসানলয়ে যেখানে আরব গোত্রগুলো তাদের পূজা চালিয়ে যেত।

    সাংস্কৃতিক দিয়ে আরবদের শ্রেষ্ঠ রত্ন ছিল তাদের ভাষা। রুক্ষ মরুর বুকে শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তাই রোমান বা গ্রীকদের মতো আরবদের জন্য ভাস্কর্য কিংবা চিত্রকলার চর্চা খুব একটা বাস্তবসম্মত ছিলনা। এজন্য কেবলমাত্র তাদের তথাকথিত*“ঈশ্বর” এর মূর্তি তৈরী ছাড়া আর কোন কাজে এধরণের শিল্পের চর্চা ছিলনা। বরং এর পরিবর্তে শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সেরা মাধ্যম হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে গেল পদ্য কিংবা কবিতা। আরবী ভাষা এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে এই ভাষার তারল্য এবং ছন্দ খুবই বেশী, যা এই ভাষাকে কবিতা রচনার জন্য এক আদর্শ ভাষায় পরিণত করেছে। প্রতি বছর একবার করে মক্কায় আরবের শ্রেষ্ঠ কবিদের কবিতার আসর বসতো, যেখানে সকলে যার যার নতুন রচিত কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনাতো। আসরের সবচেয়ে জনপ্রিয়রা তাৎক্ষণিকভাবেই যশস্বী ব্যক্তিত্বে পরিণত হতো এবং তাদের কাব্যিক দক্ষতার গল্প ও সুনাম খুব দ্রুত গোটা আরবে ছড়িয়ে পড়তো।

    ইসলামের উত্থানের সাথে এর সম্পর্ক কী?

    ৬১০ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় কুরাইশ গোত্রের এক সম্মানিত ব্যক্তি যখন নতুন এক একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রচার শুরু করলেন, তখন কেউই কল্পনা করতে পারেনি যে তৎকালীন ভৌগলিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি এই নতুন বাণীর প্রচার ও প্রসারের জন্য কতোটা উপযুক্ত এবং প্রস্তুত ছিল। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই এই অনুপম বাণী তৎকালীন পরিবেশের সাথে চমৎকার ভাবে খাপ খেয়ে গেল। এই বাণীর প্রতি যারা বিশ্বাস এনেছিল তাদের অন্তরে আর কোন সংশয়ও রইলোনা যে এই বাণীটি এক ঐশ্বরিক পরিকল্পনার অংশ, যার ফলে একশ বছরের মধ্যেই ইসলাম গোটা বিশ্বের এক নেতৃস্থানীয় ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হবে।

    ভৌগলিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক দিয়েই রোমান এবং ফারসিদের থেকে আরবদের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারটা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতার ফলে বহির্বিশ্বে ইসলাম পরিচিত হয়ে উঠার আগেই অভ্যন্তরীণভাবে শুধুমাত্র আরবদের মাঝে ইসলামের বিকাশ এবং বিস্তারের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরী হয়। রাসূল ﷺ এর জীবদ্দশায় আরবে যদি রোমান কিংবা ফারসিদের আধিপত্য থাকতো তাহলে নিঃসন্দেহে ইসলামের বাণীর প্রচার ও প্রসার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে পারতো। ৭ম শতাব্দীতে রোমানরা ছিল গোঁড়া খ্রিস্টান, আবার একইসাথে অন্যান্য ধর্মের ব্যাপারে তাদের সহিষ্ণুতা ছিল একদম শূন্যের কোঠায়। অন্যদিকে, তৎকালীন আরব গোত্রগুলো যেহেতু রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ছিলনা, অর্থাৎ তাদের কোন রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় প্রশাসন ছিলনা,*এই ব্যাপারটি রাসূল ﷺ কে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ছাড়াই ইসলামের বাণী প্রচার করার সুযোগ করে দিয়েছিল। যদিও শুরুর দিকের বছরগুলোতে তাঁর নিজ গোত্র কুরাইশরা এই পবিত্র বাণীর কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারপরও কুরাইশরা আরবের বহু গোত্রের মাঝে একটিমাত্র গোত্র। ফলে এর থেকে মুক্তি পেতে রাসূল ﷺ কে যা করতে হতো তা হচ্ছে, কুরাইশদের রাজনৈতিক গণ্ডির বাইরে চলে যাওয়া। যা তিনি করেছিলেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরত করার মাধ্যমে।*মদিনায় আরবদের চিরায়ত আতিথেয়তা নীতি তাঁকে নিরাপত্তা প্রদান করেছিল। আরব উপদ্বীপের এই ভৌগলিক এবং একইসাথে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার চেয়ে আর কোন পরিস্থিতিই এই “বিতর্কিত” এবং সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা বাণীর প্রচার এবং প্রসারের জন্য উপযুক্ত হতে পারতোনা।

    পরে রাসূল ﷺ এর ইন্তেকালের পর মুসলিমরা যখন উত্তরাভিমুখে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তার করা শুরু করে, সাথে সাথেই তারা সম্মুখীন হয় দু’টি ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যের। রোমান এবং ফারসিরা উভয়েই বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধে লিপ্ত থেকে হয়ে গিয়েছিল নিঃশেষিত, ভগ্নপ্রায়। ফলে তাদের নিজস্ব অঞ্চলেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল খুবই ভঙ্গুর, এর চেয়ে খারাপ অবস্থা ইতিপূর্বে কখনো ছিলনা। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক দুর্বলতা থাকা মানেই মুসলিম বাহিনী খুব সহজেই এই প্রতিষ্ঠিত দু’টি সাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে পারবে এবং এর মাধ্যমে মুসলিমদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছড়িয়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং দূর-দূরান্তের অঞ্চলগুলোতে।



    আরব উপদ্বীপ একইসাথে সাংস্কৃতিকভাবেও ইসলামের প্রচার এবং প্রসারের জন্য উপযুক্ত স্থান ছিল। ৭ম শতাব্দীর শুরুর দিকে মক্কার সবচেয়ে শক্তিশালী সামাজিক কানুন ছিল আত্মীয়তার বন্ধন। তাই রাসূল ﷺ যখন মুশরিক কিংবা পৌত্তলিকদের অসন্তোষের কারণ হয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁর পরিবার থেকে প্রাপ্ত নিরাপত্তার উপর নির্ভর করেছিলেন। বিশেষ করে তাঁর চাচা আবু তালিব ছিলেন এখানে মূল চরিত্র। কখনোই ইসলাম গ্রহণ না করা সত্ত্বেও চাচা আবু তালিব কখনোই তাঁর ভাতিজাকে নিরাপত্তা দেয়া থেকে বিরত থাকেননি, বরং তিনি এটাকে পারিবারিক দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এই ঐতিহ্য যদি আরবে না থাকতো, তাহলে হয়তো কুরাইশের মুশরিকরা নবুওয়াতের প্রাথমিক বছরগুলোতেই রাসূল ﷺ এর কণ্ঠরোধ করে ফেলতো।

    ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, ইসলাম আগমনের পূর্ব পর্যন্ত আরবরা ছিল মুশরিক কিংবা পৌত্তলিক। তা সত্ত্বেও তাদের মাঝে ইব্রাহিম (আ) এর একেশ্বরবাদী ধর্মের কিছু জানাশোনা ছিল। তাই আরবদের মাঝে আল্লাহ্*র একত্ববাদের বাণী নিয়ে যখন রাসূল ﷺ এর আগমন ঘটে, এই ঘটনা আরবদেরকে তাদের একেশ্বরবাদী অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা তারা ইব্রাহিম (আ) এর কাছ থেকে শিখেছিল। কিন্তু তারপরও, ইসলামের দাবী হচ্ছে “আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্* নেই এবং মুহাম্মাদ হচ্ছে আল্লাহর রাসূল” – মেনে নেয়া। আর এই দাবী মেনে নিলে আরবদেরকে তাদের মূর্তি পরিত্যাগ করতে হবে এবং একদম শুদ্ধ একেশ্বরবাদে ফেরত যেতে হবে। পরবর্তীতে দেখা যায়, অনেকের কাছেই ইসলামের এই দাবী মেনে নেয়া খুব বেশী কঠিন ছিলনা কারণ এই বাণী তাদেরকে ঈমানের পবিত্রতম রূপে নিয়ে যায় যা তারা কয়েক শতাব্দী ধরে হারিয়ে ফেলেছিল।

    একই সময়, আরবদের এই পৌত্তলিকতা আলৌকিকভাবে ইসলামের আসমানী বাণীর কিছু নির্দিষ্ট বিষয় প্রমাণ করে। অন্যান্য ইব্রাহিমী ধর্ম (যেমনঃ ইহুদি এবং খ্রিস্টধর্ম) এর অনুসারীদের মূল আবাস ছিল মূলত রোমান সাম্রাজ্যে, অর্থাৎ ভৌগলিকভাবে আরবদের থেকে বহুদূরে। তারপরও রাসূল ﷺ এর কাছে নাজিলকৃত*আসমানী কিতাব আল-কুর’আনে*ইহুদি ও খ্রিস্টধর্মের আসমানী কিতাবে বর্ণিত একই গল্প এবং নবী-রাসূলদের বর্ণনা পাওয়া যায়। আসমানী প্রত্যাদেশ ছাড়া রাসূল ﷺ এর পক্ষে আদম (আ), মূসা (আ), ইউসুফ (আ), ঈসা (আ) সহ অন্যান্য নবী-রাসূলদের ব্যাপারে জানা কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা। অর্থাৎ, পৌত্তলিকতায় ডুবে থাকা আরব বিশ্বে এমন একজন রাসূলের আগমন ঘটেছিল যার কাছে ইতিপূর্বে আগমনাকারী নবী-রাসূলদের জ্ঞান ছিল এবং নবীদের পরম্পরায় তিনিই ছিলেন শেষ নবী। অনেকের কাছেই, বিশেষ করে হেজায অঞ্চলের ইহুদিদের কাছে এই আসমানী বাণী ছিল আলৌকিক। এর কারণ হলো, রাসূল ﷺ এর পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিলনা ইহুদিদের আসমানী কিতাব “তাওরাত” পড়া, বিশেষত যখন রাসূল ﷺ নিজেই পড়তে জানতেননা, আবার ইহুদিরাও কখনো বহিরাগতদের কাছে নিজেদের আসমানী কিতাবের জ্ঞান প্রকাশ করতোনা।

    সর্বশেষ, আল-কুর’আনের ছন্দোবদ্ধ কাব্যিক প্রকৃতি আরবদের ছন্দোময় সত্তার সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে যায়। যে সমাজে কাব্যিক দক্ষতাকে অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে সবচেয়ে বেশী মর্যাদার চোখে দেখা হয়, যে সমাজের কবিরা নিখুঁত ছন্দোময় শ্লোক রচনায় একে অপরের সাথে ক্রমাগত প্রতিযোগিতা চালিয়ে যায়, সে সমাজে যে আল-কুর’আনের ছন্দোবদ্ধতা মানবরচিত কাব্যের দক্ষতাকে ছাড়িয়ে যাবে তা স্বাভাবিক। আল-কুর’আন যদি অন্য কোন স্থানে অন্য কোন জাতির কাছে নাজিল করা হতো যারা কাব্যের প্রতি এতোটা আসক্ত নয়, তাদের পক্ষে আল-কুর’আনের আলৌকিকতা বুঝা সম্ভব হতোনা। কিন্তু আরবদের মাঝে এই পবিত্র আসমানী কিতাবের আলৌকিকতা এবং ঐশ্বরিক প্রকৃতি নিয়ে কোন সংশয় তো ছিলইনা, বরং এই আসমানী বাণীকে তারা ঐকান্তিকতার সাথে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিল। এই আসমানী বাণী তাদের হৃদয়ে সৃষ্টি করেছিল বাণীটি চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার এক উদ্দীপনা।

    উপসংহার

    উপসংহারে বলা যায়, ৭ম শতাব্দীর যে পারিপার্শ্বিক অবস্থায় রাসূল ﷺ এর আগমন ঘটেছিল তা ছিল ইসলামের আগমনের জন্য আদর্শ এক অবস্থা। ভৌগলিকভাবে তৎকালীন পরাবিশ্বগুলোর থেকে বিচ্ছিন্নতা, সাংস্কৃতিকভাবে রাসূল ﷺ এর আলোড়নপূর্ণ জীবনকে গ্রহণ করার জন্য আরবদের মানসিকতা এবং ভাষার দিক দিয়ে কাব্যিক আসমানী গ্রন্থ আল-কুর’আনের অলৌকিকতা বুঝার সক্ষমতা, এসব দিক দিয়ে চিন্তা করলে এমন কোন স্থান কিংবা কাল চিন্তা করা যায়না যখন ইসলামের শিকড় গাড়তে আদর্শ পরিবেশ ছিল। মুসলিমদের কাছে এসবকিছুই কোন দুর্ঘটনা নয় বরং ইসলামের আগমন এবং বিস্তারের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে অমুসলিম ইতিহাসবীদদেরকে ইসলামের এই তড়িৎ বিকাশ এবং বিস্তারের ব্যাপারটি তাদের তথাকথিত “সেকুলার” (ধর্মনিরপেক্ষ) পরিভাষায় ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খেতে দেখা যায়। বিশ্ব ইতিহাসের অন্যান্য ধর্মগুলোর উত্থানের ঘটনাগুলোর সাথে একে কোন ভাবেই খাপ খাওয়ানো যায় না। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, ইসলামের আগমনের জন্য ৭ম শতকের গোড়ার সময়টিতেই সবচেয়ে আদর্শ সাংস্কৃতিক ও ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপট বিদ্যমান ছিল।

    অনুবাদ করা হয়েছেঃ*What Was Special About Pre-Islamic Arabia?*আর্টিকেল থেকে।
    অনুবাদকঃ*মুহসিন সুরী

    Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ

    Hodgson, M. G. S.*The Venture of Islam, Conscience and History in a World Civilization. 1. Chicago, IL: University of Chicago Press, 1974.

    Hourani, Albert Habib.*A History Of The Arab Peoples. New York: Mjf Books, 1997. Print.

    Kennedy, Hugh.*The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press, 2007. Print.

    Saunders, JJ.*A History of Medieval Islam. London: Routledge, 1965. Print.

    Copy
    শিয়াল দেখলে যাদের গলা শুকিয়ে যায়,
    সিংহের গর্জনে তাদের কলিজা ছিঁড়ে যাবে।

  • #2
    আল্লাহ আপনার মেহনতকে কবুল করুন ও জাযায়ে খাইর দান করুন। আমীন।
    ‘যার গুনাহ অনেক বেশি তার সর্বোত্তম চিকিৎসা হল জিহাদ’-শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.

    Comment

    Working...
    X