ইসলাম কি অস্ত্রের মুখে ছড়িয়েছিল?
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি প্রচলিত অভিযোগ হচ্ছে,*“ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তলোয়ারের মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ ঘটেছে।”*এটি বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়া ইসলাম-বিদ্বেষীদের প্রিয় একটি বুলি, যাতে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের ব্যাপারে মানুষকে ভীত-সন্তস্ত্র করে তোলা যায়। বহুল-আলোচিত এই বিষয়টি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তাই এর সত্যতা যাচাই করার জন্য এই বিষয়টি নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
প্রথম দিকের বিজয়গুলোঃ মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্য
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটেছিল রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর পর, ৬৩০ এর দশকের শুরুর দিকে। বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য এবং সাসানিদ (পারসিক) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় যা এই নতুন ধর্ম ইসলামকে নতুন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে দেয়। এই ধর্মের অনুসারী মরুর আরব যোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল এমন সব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের, যাদের রাজধানী ছিল*কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে ইস্তানবুল)*এবং তিসফুনে।
ইসলামের ১ম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) সৈনিকদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন, যেগুলোর সাথে এই আধুনিক যুগের যুদ্ধবিগ্রহের রীতি-নীতির তুলনা করলে অনেক সংকীর্ণই মনে হবেঃ
“যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে দশটি নীতিমালা দিচ্ছি। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা কিংবা সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবেনা। মৃতদেহ বিকৃত করবেনা। শিশুদের হত্যা করবেনা, নারী কিংবা বয়স্কদেরও নয়। বৃক্ষাদির কোন ক্ষতি করোনা, কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দিবেনা, বিশেষ করে ফলবতী বৃক্ষগুলোর দিকে বেশী নজর রাখবে। শত্রুবাহিনীর পাল থেকেও কোন প্রাণী হত্যা করবেনা, খাদ্য সঞ্চয় করবে, অপচয় করবেনা। তোমরা হয়তো এমন সব মানুষের দেখা পাবে যারা সন্ন্যাসী হিসেবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে (সন্যাসব্রত পালন করেছে); তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিবে, উত্যক্ত করবেনা এবং এড়িয়ে চলবে।” (১)
এই যুদ্ধরীতিগুলো ছিল তৎকালীন সময়ে অনন্য ও সৃষ্টিশীল। মুসলিমদের অভিযানের ঠিক আগেই, পারসিক এবং বাইজেন্টিয়ানদের মাঝে এক দশক ধরে চলা যুদ্ধে গোটা সিরিয়া ও ইরাককে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। আবু বকর (রাঃ) নিশ্চিত করেন যে, মুসলিম বাহিনী এ ধরনের নীতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করবেনা। জনসাধারণ নয়, বরং মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ সৈন্যবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আবু বকর (রাঃ) এর এই উদাহরণের উপর ভিত্তি করেই ইসলামী শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত, যে আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র ‘ন্যায়সঙ্গত’ যুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট সৈন্যদলের বিপক্ষে ছাড়া অন্য যে কারো বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
মিশর, সিরিয়া এবং ইরাক বিজয়ের যুদ্ধে মুসলিমরা কি কৌশল অবলম্বন করেছিল সে ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধান চালানো এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নয়। আর্টিকেলে মূল লক্ষ্য অনুযায়ী এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, সিরিয়া ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝে মুসলিমদের অধীনে আসে, মিশর আসে ৬৪২, এবং ইরান ও পারস্য আসে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝে। সিরিয়াতে রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মীয় ঘাঁটি এবং পাশাপাশি মিশরে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি হাতছাড়া হয়ে গেলে বাইজেন্টাইনরা বেশ বিপাকে পড়ে যায় এবং দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে মুসলিমদের জয়ের পর পারস্যের সাসানিদ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে এটা ছিল তৎকালীন বিশ্বের দুই মহাশক্তির জন্য এক আকস্মিক দুর্যোগ এবং মহাবিপর্যয়। কিন্তু এই আর্টিকেলের মূল বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কিভাবে মুসলিমদের জয়ের পর একটা ধর্ম হিসেবে এই অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রসার লাভ করে।
নিঃসন্দেহে, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য সাধারণ মানুষের উপর কোন প্রকার জোর খাটানো হয়নি। বরং এ ব্যাপারে যদি কিছু বলা হয়েও থাকতো, তাহলে জনসাধারণ যেভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন ধারণ করে আসছিল, সেটাতেই উৎসাহিত করা হতো। উদাহরণস্বরূপ,*জেরুজালেম বিজয়ের*পর শহরের প্রধানদের সাথে তৎকালীন খলিফা উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) যে আত্মসমর্পণ চুক্তিনামা লিখেন তার অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা যায়ঃ
“তিনি (উমর) নিশ্চয়তা দিচ্ছেন তাদের জান, মাল, গীর্জা, *ক্রুশ, শহরের সুস্থ-অসুস্থ সকলকে… মুসলিমরা তাদের গীর্জা দখল করবেনা এবং ধ্বংসও করবেনা…*তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে না।”*(২)
তৎকালীন কোন সাম্রাজ্যেরই ধর্মীয় সহনশীলতার ব্যাপারে এমন ধারণা ছিলনা। একজন সাহাবী হিসেবে উমর (রাঃ) ইসলামী আইন অনুযায়ী এই চুক্তিনামা সম্পাদন করলেন, এবং বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে তার এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। অন্যান্য বিজিত অঞ্চলঃ মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্যে একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল। বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীরা হোক খ্রিস্টান বা ইহুদি কিংবা সাবিয়ান, অথবা জরাথ্রুস্টবাদ এর অনুসারী যাই হোক না কেন, সবাইকে যার যার ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। ইসলামের প্রাথমিক দিকের এই বিজয়গুলোতে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের একটা উদাহরণও পাওয়া যায়না।
জোরপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন করা যে হয়নি, এর প্রমাণ হচ্ছে এসব দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপস্থিতি। মুসলিমদের বিজয়ের পরের কয়েক শতাব্দী ধরে এসব অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষই খ্রিস্টান থেকে যায়। ধীরে ধীরে তারা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে, আর সাথে সাথে আরবীও নিজেদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে। বর্তমানে খ্রিস্টানদের একটা বড় অংশ রয়ে গিয়েছে যারা মিশরের জনসংখ্যার ৯%, সিরিয়ার ১০%, লেবাননের ৩৯%, এবং ইরাকের জনসংখ্যার ৩%। যদি মুসলিমদের বিজয়ের পরপরই, অথবা এমনকি পরবর্তী মুসলিম শাসনের সময়ও যদি জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হতো তাহলে আর এই অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কোন অস্তিত্ব থাকতোনা। তাদের অস্তিত্বই হচ্ছে ইসলাম যে অস্ত্রের মুখে ছড়ায়নি তার প্রমাণ।
উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন
ইসলাম আগমনের পর গোড়ার দিকে মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্য বিজয়ের সৈন্য এবং নেতারা ছিলেন মুসলিমদের ১ম প্রজন্ম। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীও ছিলেন। এখন প্রশ্ন আসে, পরবর্তী প্রজন্মে যখন মুসলিমদের বিস্তার অব্যাহত থাকে সুদূর-পশ্চিমে, উত্তর আফ্রিকায়, এবং এরও পরে স্পেনে, তখন কি হয়েছিল?
৭ম শতকের দিকে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে ছিল বার্বার জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মিশর থেকে আলজেরিয়া পর্যন্ত গোটা উপকূলীয় অঞ্চল বাইজেন্টাইনদের অধীনে থাকলেও এ অঞ্চলের জনগণ তাদের অনুগত ছিলনা। তাদের দমিয়ে রাখতে বাইজেন্টাইনদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের আগের শতাব্দীতে অঞ্চলটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয় একে বিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিণত করে। অবস্থাটা ছিল এক সময়ের গৌরবময় প্রদেশের একটি কঙ্কাল মাত্র।
প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রাঃ) উত্তর আফ্রিকার উপকূল জয়ের জন্য উকবা বিন নাফি কে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। কয়েক দশকের মাঝেই উত্তর আফ্রিকায় মুসলিমদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। যুদ্ধের বিস্তারিত কৌশলের আলোকপাত এখানে আর করা হলোনা।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে আমরা যে উদাহরণ দেখেছিলাম উত্তর আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। কোন স্থানীয় অধিবাসীকে ধর্মান্তরে বাধ্য করা হয়নি। মুসলিম কিংবা অমুসলিম কোন সূত্রেই বার্বারদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়না। প্রকৃতপক্ষে, বেশীরভাগ বার্বার অনেক দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে। গোটা মহাদেশজুড়ে ব্যাপক আকারে বার্বারদের ইসলাম গ্রহণ এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানের ফলে মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বার্বার জনগোষ্ঠীকে যদি জোরপূর্বক ধর্মান্তর করানো হতো, তবে নিশ্চিতভাবেই ইসলামের জন্য তাদের এই আগ্রহ ও উদ্দীপনা থাকতোনা। এই আগ্রহ ও উদ্দীপনাই তাদের মুসলিম বাহিনীতে যোগদানের পিছনে মূল কারণ ছিল এবং যা সম্ভব করেছিল ইসলামের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরো বিস্তৃত করার, এমনকি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধেও।
মুসলিমদের উত্তর আফ্রিকা জয়ের পর এমন এক প্রস্তাব এসেছিল যা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়। ৮ম শতকের শুরুর দিকে আইবেরিয়া উপদ্বীপ (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) ছিল ভিসিগোথিক রাজা রডারিক এর শাসনাধীন। তখন আইবেরিয়ার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম গভর্নরের সাথে দেখা করতে যান এবং রডারিকের নির্মম অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি এই প্রতিশ্রুতিও দেন যে, রডারিকের বিরুদ্ধে যদি মুসলিমরা অভিযান চালায় তবে তিনি নিজ সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে মুসলিমদের সহায়তা করবেন
শুরুর দিকে কিছু ছোটখাট আক্রমণের মাধ্যমে স্থানীয়দের সমর্থন কেমন হবে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন মুসলিম জেনারেল তারিক বিন জিয়াদ (যিনি খুব সম্ভবত বার্বার জাতিগোষ্ঠীর ছিলেন)। এরপর তিনি মরক্কো থেকে তার বাহিনী নিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে আইবেরীয়া পৌঁছান ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। কয়েক মাসের মাঝেই*তারিকের বাহিনী রাজা রডারিককে পরাজিত করেআইবেরিয়াতে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আর তিন বছরের মাথায় গোটা আইবেরিয়া মুসলিমদের অধীনে চলে আসে। ভিসিগোথদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা অনেক শহর মুসলিমদের ন্যায়বিচার ও সাম্যতার ব্যাপারে জানতে পেরে স্বেচ্ছায় তাদের শহরের দরজা খুলে দেয় এবং মুসলিমদের স্বাগত জানায়।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের বহু দলিলাদি ও প্রমাণপত্র টিকে ছিল যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এই বিজয়টি মোটেও জোর করে ধর্মান্তর করার উদ্দেশ্যে ছিলনা। ৭১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে, সেখানকার এক মুসলিম গভর্নর এক ভিসিগোথের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করেন, যেখানে একটা বিধান ছিল যে স্থানীয় ব্যক্তিদের*—
“হত্যা করা হবেনা কিংবা কয়েদী হিসেবেও নেয়া হবেনা। তাদেরকে তাদের নারী ও শিশুদের থেকেও আলাদা করা হবেনা। তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবেনা, তাদের গীর্জাও পুড়িয়ে ফেলা হবেনা।”*(৩)
মুসলিম স্পেন (যা পরবর্তীতে ‘আল-আন্দালুস’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে) এর উদাহরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে স্থানীয় জনগণকে (যাদের বেশীরভাগই ছিল খ্রিস্টান, যদিও একটা বড় ইহুদি জনসংখ্যাও ছিল) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য জোর করা হয়নি। বরং বাস্তবে এরপরের শতাব্দীগুলোতে আল-আন্দালুস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে যেখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান সবাই জ্ঞান, সংস্কৃতি ও দর্শন চর্চায় এক স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেছিল। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই আলোকিত ভূমির শেষ হয় আরো কয়েক শতাব্দী পরে যখন ‘খ্রিস্টান রিকনকুয়েস্তা’ (খ্রিস্টানদের পুনর্দখল) এর মাধ্যমে যা গোটা আইবেরিয়া থেকে সাফল্যের সাথে মুসলিম ও ইহুদিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করে।
হিন্দুস্তান
আজ বিশ্বের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দু’টি হচ্ছে পাকিস্তান (২য়) এবং ভারত (৩য়)। এই দু’টি দেশ মোটামুটি গোটা হিন্দুস্তানজুড়ে ব্যাপৃত। এই অঞ্চলের জনমানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের এক অবিশ্বাস্য এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিমদের বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও রাজবংশ দ্বারা শাসিত হলেও হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্ম উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণের ব্যাপারটা তখনকার যুদ্ধবিগ্রহের নিয়ম-কানুনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। শ্রীলংকায় বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজিত থাকা মুসলিম ব্যবসায়ীদের কন্যাদের জাহাজে সিন্ধু (যা বর্তমানে পাকিস্তান) অঞ্চলের জলদস্যুরা আক্রমণ করে এবং জাহাজের নারীদের আটক করে দাসবৃত্তির কাজে নিয়োজিত করে। বন্দী নারীদের মুক্ত করতে এবং জলদস্যুদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর নেতৃত্বে*৭১০ খ্রিস্টাব্দে একটা অভিযান পরিচালিত হয়। মুহাম্মাদ বিন কাশিম ছিলেন আরবের তায়েফের অধিবাসী।
এতো দূরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর সফল সেনা অভিযানের পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দুস্তানের চলমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামাজিক সমস্যা। হিন্দু ধর্মের একটি বিশ্বাস হচ্ছে বর্ণপ্রথা, যা সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছিল খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কিছু সামাজিক শ্রেণীতে। উঁচু শ্রেণী ধন্যাঢ্য এবং আরামদায়ক জীবন যাপন করতো, অন্যদিকে নীচু শ্রেণীর সবাইকে (বিশেষ করে যারা অচ্ছুত নামে পরিচিত ছিল বা যাদের ছোঁয়া যেতোনা) দেখা হতো সমাজের অভিশাপ হিসেবে। সাথে ছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়, যারা গোটা দেশজুড়েই সাধারণত হিন্দু রাজপুতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছিল। মুসলিমদের অনুপ্রবেশের পর তাদের প্রতি সামাজিক সাম্যের প্রতিশ্রুতির কারণে বেশীরভাগ বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু তাদের স্বাগত জানায়। বাস্তবে, হিন্দুস্তানের সর্বপ্রথম মুসলিমরা সম্ভবত নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিল, যেহেতু ইসলাম তাদেরকে মুক্ত করে পূর্ববর্তী অত্যাচারী সামাজিক ব্যবস্থা থেকে।
সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এটা দেখাতে সক্ষম হন যে ইসলামী শরীয়াহর সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারটা শুধু খ্রিস্টান কিংবা ইহুদিদের জন্যই নয়। উপমহাদেশের বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হয়নি, বরং তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়া হয়। এক ঘটনায়, এক অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর কাছে এই মর্মে তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, মুসলিম বাহিনী হয়তো তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করবে এবং যার ফলে তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম পালন করা বন্ধ করে দিতে হবে। এ অভিযোগ শুনে বিন কাশিম সেই শহরের বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতার সাথে বৈঠক করেন এবং তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেন, এবং তাদের অনুরোধ করেন যাতে তারা তাদের জীবন ঠিক আগের মতোই যাপন করে যায়।
উপসংহার
আমরা আবার আর্টিকেলের শুরুর দিকে আরোপ করা প্রশ্নে ফিরে যাই, ইসলাম কি সত্যিই অস্ত্রের মুখে ছড়িয়েছিল? যখন অসংখ্য মানুষ রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ইস্যুকে ব্যবহার করছে, তখন আমরা সন্দেহাতীতভাবে দেখতে পাই যে ইসলাম ধর্ম জবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, ভীতি কিংবা রক্তপাতের মাধ্যমে ছড়ায়নি। কোথাও মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে এরূপ কোন বর্ণনাই পাওয়া যায়না। মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করলেও, বাস্তবে তাঁরা এই পথ গ্রহণ করেছিলেন অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করার জন্যে। মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ সবসময়ই ছিল সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, স্থানীয় জনতার সাথে নয়। যদিও এই আর্টিকেলে মুসলিমদের শুরুর দিকের প্রজন্মের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল বিজয়ের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমরা এই ধারা রেখে গিয়েছেন গোটা ইসলামের ইতিহাস জুড়েই।
এটা মনে রাখা জরুরী যে উল্লেখিত ঘটনাগুলো ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ইতিহাসে প্রথম কিছু উদাহরণ। যখন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং স্বাধীনতা পশ্চিমা সভ্যতায় সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল ১৭শ এবং ১৮শ শতকের দিকে, তখন মুসলিমরা ধর্মীয় স্বাধীনতার চর্চা করে আসছে ৭ম শতক থেকে। ইসলামের বাণী উগ্রপন্থায় এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলে তথাকথিত রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ‘পণ্ডিতগণ’*যেসব যুক্তিতর্ক পেশ করে থাকেন তাদের এসব যুক্তিতর্কের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিই নেই। বরং বাস্তবে মুসলিমদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই চর্চা প্রভাবিত করেছিল ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে হিন্দুস্তানের মতো বৈচিত্র্যময় সব অঞ্চলের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারাকে।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ*Did Islam spread by sword?*আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ খালিদ ফায়াদ
হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান, বর্তমান Indian Subcontinent (ভারতীয় উপমহাদেশ) এর ঐতিহাসিকভাবে জনপ্রিয় নামগুলির একটি। এই নামের আক্ষরিক অর্থ “সিন্ধু নদের দেশ”। হিন্দুস্তান নামটি বেশ প্রাচীন, যা এসেছে আদি ফার্সি শব্দ “হিন্দু” থেকে। ফার্সি ভাষায় সিন্ধু নদকে বলা হতো হিন্দু নদ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় “স্তান” অনুসর্গটি (ফার্সি ভাষায় যার অর্থ “স্থান”)। আগে হিন্দুস্তান বলতে গোটা উপমহাদেশকেই বোঝাত।
ঐতিহাসিকভাবে “হিন্দু” কোন ধর্মের নাম নয় বরং সিন্ধু নদের পাড়ে বসবাসরত মানুষদেরকে বোঝাতো তারা যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন। অন্যদিকে, বর্তমান হিন্দুধর্মের মূল নাম হচ্ছে সনাতন ধর্ম (সংস্কৃতঃ सनातन धर्म) যা কালের বিবর্তনে এখন হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অতীতে এই অঞ্চলকে (এবং এখনও) “আল-হিন্দ/হিন্দুস্তান” বলেই ডাকতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রাসূল*ﷺ এর সময়ও এই উপমহাদেশকে বুঝানোর জন্য আল-হিন্দ (الهند) নামটি ব্যবহৃত হয়েছে।*এই ওয়েবসাইট এর মূল ইংরেজি আর্টিকেলগুলোতে India বলতে বুঝানো হয়েছে গোটা উপমহাদেশ, যা মূলত হিন্দুস্তান। ঐতিহাসিকভাবেইসলামের হারানো ইতিহাস*এর ক্ষেত্রেও তাই আমরা “হিন্দুস্তান” নামটিই ব্যবহার করব। বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃlostislamichistorybangla.wordpress.com/হিন্দুস্তান/
Citations:
এই সংজ্ঞানুযায়ী, আধুনিক যুগের সন্ত্রাসবাদ পরিষ্কারভাবে ইসলামী আইনের পরিপন্থী।
(১)- Aboul-Enein, H. Yousuf and Zuhur, Sherifa, Islamic Rulings on Warfare, p. 22, Strategic Studies Institute, US Army War College, Diane Publishing Co., Darby PA
(২)- Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.*pg.91
(৩)- Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.*pg.315
Sources:
Aboul-Enein, H. Yousuf and Zuhur, Sherifa, Islamic Rulings on Warfare, p. 22, Strategic Studies Institute, US Army War College, Diane Publishing Co., Darby PA
CIA World Factbook
Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.
Ochsenwald, W., & Fisher, S. (2003). The Middle East: A History. (6th ed.). New York: McGraw-Hill.
#copy
ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে একটি প্রচলিত অভিযোগ হচ্ছে,*“ইসলাম একটি বিশ্বজনীন ধর্ম হওয়ার একমাত্র কারণ হচ্ছে তলোয়ারের মাধ্যমে এর সম্প্রসারণ ঘটেছে।”*এটি বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়া ইসলাম-বিদ্বেষীদের প্রিয় একটি বুলি, যাতে পশ্চিমা বিশ্বে ইসলামের ব্যাপারে মানুষকে ভীত-সন্তস্ত্র করে তোলা যায়। বহুল-আলোচিত এই বিষয়টি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, তাই এর সত্যতা যাচাই করার জন্য এই বিষয়টি নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
প্রথম দিকের বিজয়গুলোঃ মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্য
প্রকৃতপক্ষে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটেছিল রাসূল (সাঃ) এর মৃত্যুর পর, ৬৩০ এর দশকের শুরুর দিকে। বাইজেন্টাইন (পূর্ব রোমান) সাম্রাজ্য এবং সাসানিদ (পারসিক) সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয় যা এই নতুন ধর্ম ইসলামকে নতুন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করে দেয়। এই ধর্মের অনুসারী মরুর আরব যোদ্ধাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছিল এমন সব প্রাচীন ও প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যের, যাদের রাজধানী ছিল*কনস্ট্যান্টিনোপোল (বর্তমানে ইস্তানবুল)*এবং তিসফুনে।
ইসলামের ১ম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) সৈনিকদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিমালা বেঁধে দিয়েছিলেন, যেগুলোর সাথে এই আধুনিক যুগের যুদ্ধবিগ্রহের রীতি-নীতির তুলনা করলে অনেক সংকীর্ণই মনে হবেঃ
“যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবে সে ব্যাপারে দশটি নীতিমালা দিচ্ছি। কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা কিংবা সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাবেনা। মৃতদেহ বিকৃত করবেনা। শিশুদের হত্যা করবেনা, নারী কিংবা বয়স্কদেরও নয়। বৃক্ষাদির কোন ক্ষতি করোনা, কিংবা আগুনে পুড়িয়ে দিবেনা, বিশেষ করে ফলবতী বৃক্ষগুলোর দিকে বেশী নজর রাখবে। শত্রুবাহিনীর পাল থেকেও কোন প্রাণী হত্যা করবেনা, খাদ্য সঞ্চয় করবে, অপচয় করবেনা। তোমরা হয়তো এমন সব মানুষের দেখা পাবে যারা সন্ন্যাসী হিসেবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে (সন্যাসব্রত পালন করেছে); তাদেরকে তাদের মতো থাকতে দিবে, উত্যক্ত করবেনা এবং এড়িয়ে চলবে।” (১)
এই যুদ্ধরীতিগুলো ছিল তৎকালীন সময়ে অনন্য ও সৃষ্টিশীল। মুসলিমদের অভিযানের ঠিক আগেই, পারসিক এবং বাইজেন্টিয়ানদের মাঝে এক দশক ধরে চলা যুদ্ধে গোটা সিরিয়া ও ইরাককে ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিল। আবু বকর (রাঃ) নিশ্চিত করেন যে, মুসলিম বাহিনী এ ধরনের নীতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করবেনা। জনসাধারণ নয়, বরং মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ শুধুমাত্র প্রতিপক্ষ সৈন্যবাহিনী ও সরকারের বিরুদ্ধেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আবু বকর (রাঃ) এর এই উদাহরণের উপর ভিত্তি করেই ইসলামী শরীয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত, যে আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র ‘ন্যায়সঙ্গত’ যুদ্ধে একটি সুস্পষ্ট সৈন্যদলের বিপক্ষে ছাড়া অন্য যে কারো বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ।
মিশর, সিরিয়া এবং ইরাক বিজয়ের যুদ্ধে মুসলিমরা কি কৌশল অবলম্বন করেছিল সে ব্যাপারে গভীর অনুসন্ধান চালানো এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য নয়। আর্টিকেলে মূল লক্ষ্য অনুযায়ী এটুকু উল্লেখ করাই যথেষ্ট যে, সিরিয়া ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মাঝে মুসলিমদের অধীনে আসে, মিশর আসে ৬৪২, এবং ইরান ও পারস্য আসে ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝে। সিরিয়াতে রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মীয় ঘাঁটি এবং পাশাপাশি মিশরে তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি হাতছাড়া হয়ে গেলে বাইজেন্টাইনরা বেশ বিপাকে পড়ে যায় এবং দুর্বল হয়ে যায়। অন্যদিকে মুসলিমদের জয়ের পর পারস্যের সাসানিদ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে এটা ছিল তৎকালীন বিশ্বের দুই মহাশক্তির জন্য এক আকস্মিক দুর্যোগ এবং মহাবিপর্যয়। কিন্তু এই আর্টিকেলের মূল বিষয়টি বুঝতে হলে আমাদের ভেবে দেখতে হবে, কিভাবে মুসলিমদের জয়ের পর একটা ধর্ম হিসেবে এই অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রসার লাভ করে।
নিঃসন্দেহে, ইসলাম গ্রহণ করার জন্য সাধারণ মানুষের উপর কোন প্রকার জোর খাটানো হয়নি। বরং এ ব্যাপারে যদি কিছু বলা হয়েও থাকতো, তাহলে জনসাধারণ যেভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন ধারণ করে আসছিল, সেটাতেই উৎসাহিত করা হতো। উদাহরণস্বরূপ,*জেরুজালেম বিজয়ের*পর শহরের প্রধানদের সাথে তৎকালীন খলিফা উমর ইবন আল-খাত্তাব (রাঃ) যে আত্মসমর্পণ চুক্তিনামা লিখেন তার অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা যায়ঃ
“তিনি (উমর) নিশ্চয়তা দিচ্ছেন তাদের জান, মাল, গীর্জা, *ক্রুশ, শহরের সুস্থ-অসুস্থ সকলকে… মুসলিমরা তাদের গীর্জা দখল করবেনা এবং ধ্বংসও করবেনা…*তাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করা হবে না।”*(২)
তৎকালীন কোন সাম্রাজ্যেরই ধর্মীয় সহনশীলতার ব্যাপারে এমন ধারণা ছিলনা। একজন সাহাবী হিসেবে উমর (রাঃ) ইসলামী আইন অনুযায়ী এই চুক্তিনামা সম্পাদন করলেন, এবং বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীদের সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে তার এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। অন্যান্য বিজিত অঞ্চলঃ মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্যে একই ধরনের চুক্তি হয়েছিল। বিজিত অঞ্চলের অধিবাসীরা হোক খ্রিস্টান বা ইহুদি কিংবা সাবিয়ান, অথবা জরাথ্রুস্টবাদ এর অনুসারী যাই হোক না কেন, সবাইকে যার যার ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। ইসলামের প্রাথমিক দিকের এই বিজয়গুলোতে জোরপূর্বক ধর্মান্তরের একটা উদাহরণও পাওয়া যায়না।
জোরপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন করা যে হয়নি, এর প্রমাণ হচ্ছে এসব দেশে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের উপস্থিতি। মুসলিমদের বিজয়ের পরের কয়েক শতাব্দী ধরে এসব অঞ্চলের বেশীরভাগ মানুষই খ্রিস্টান থেকে যায়। ধীরে ধীরে তারা ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে, আর সাথে সাথে আরবীও নিজেদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে থাকে। বর্তমানে খ্রিস্টানদের একটা বড় অংশ রয়ে গিয়েছে যারা মিশরের জনসংখ্যার ৯%, সিরিয়ার ১০%, লেবাননের ৩৯%, এবং ইরাকের জনসংখ্যার ৩%। যদি মুসলিমদের বিজয়ের পরপরই, অথবা এমনকি পরবর্তী মুসলিম শাসনের সময়ও যদি জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হতো তাহলে আর এই অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কোন অস্তিত্ব থাকতোনা। তাদের অস্তিত্বই হচ্ছে ইসলাম যে অস্ত্রের মুখে ছড়ায়নি তার প্রমাণ।
উত্তর আফ্রিকা এবং স্পেন
ইসলাম আগমনের পর গোড়ার দিকে মিশর, সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্য বিজয়ের সৈন্য এবং নেতারা ছিলেন মুসলিমদের ১ম প্রজন্ম। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীও ছিলেন। এখন প্রশ্ন আসে, পরবর্তী প্রজন্মে যখন মুসলিমদের বিস্তার অব্যাহত থাকে সুদূর-পশ্চিমে, উত্তর আফ্রিকায়, এবং এরও পরে স্পেনে, তখন কি হয়েছিল?
৭ম শতকের দিকে উত্তর আফ্রিকার উপকূলে ছিল বার্বার জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মিশর থেকে আলজেরিয়া পর্যন্ত গোটা উপকূলীয় অঞ্চল বাইজেন্টাইনদের অধীনে থাকলেও এ অঞ্চলের জনগণ তাদের অনুগত ছিলনা। তাদের দমিয়ে রাখতে বাইজেন্টাইনদের অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের আগের শতাব্দীতে অঞ্চলটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক বিপর্যয় একে বিধ্বস্ত অঞ্চলে পরিণত করে। অবস্থাটা ছিল এক সময়ের গৌরবময় প্রদেশের একটি কঙ্কাল মাত্র।
প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রাঃ) উত্তর আফ্রিকার উপকূল জয়ের জন্য উকবা বিন নাফি কে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। কয়েক দশকের মাঝেই উত্তর আফ্রিকায় মুসলিমদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়। যুদ্ধের বিস্তারিত কৌশলের আলোকপাত এখানে আর করা হলোনা।
দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়াতে আমরা যে উদাহরণ দেখেছিলাম উত্তর আফ্রিকার ক্ষেত্রেও তাই ঘটে। কোন স্থানীয় অধিবাসীকে ধর্মান্তরে বাধ্য করা হয়নি। মুসলিম কিংবা অমুসলিম কোন সূত্রেই বার্বারদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরের ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়না। প্রকৃতপক্ষে, বেশীরভাগ বার্বার অনেক দ্রুত ইসলাম গ্রহণ করে। গোটা মহাদেশজুড়ে ব্যাপক আকারে বার্বারদের ইসলাম গ্রহণ এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানের ফলে মুসলিমদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই বার্বার জনগোষ্ঠীকে যদি জোরপূর্বক ধর্মান্তর করানো হতো, তবে নিশ্চিতভাবেই ইসলামের জন্য তাদের এই আগ্রহ ও উদ্দীপনা থাকতোনা। এই আগ্রহ ও উদ্দীপনাই তাদের মুসলিম বাহিনীতে যোগদানের পিছনে মূল কারণ ছিল এবং যা সম্ভব করেছিল ইসলামের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরো বিস্তৃত করার, এমনকি বাইজেন্টাইনদের বিরুদ্ধেও।
মুসলিমদের উত্তর আফ্রিকা জয়ের পর এমন এক প্রস্তাব এসেছিল যা সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়। ৮ম শতকের শুরুর দিকে আইবেরিয়া উপদ্বীপ (বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল) ছিল ভিসিগোথিক রাজা রডারিক এর শাসনাধীন। তখন আইবেরিয়ার এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম গভর্নরের সাথে দেখা করতে যান এবং রডারিকের নির্মম অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি এই প্রতিশ্রুতিও দেন যে, রডারিকের বিরুদ্ধে যদি মুসলিমরা অভিযান চালায় তবে তিনি নিজ সৈন্যবাহিনীর মাধ্যমে মুসলিমদের সহায়তা করবেন
শুরুর দিকে কিছু ছোটখাট আক্রমণের মাধ্যমে স্থানীয়দের সমর্থন কেমন হবে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করলেন মুসলিম জেনারেল তারিক বিন জিয়াদ (যিনি খুব সম্ভবত বার্বার জাতিগোষ্ঠীর ছিলেন)। এরপর তিনি মরক্কো থেকে তার বাহিনী নিয়ে জিব্রাল্টার প্রণালী পার হয়ে আইবেরীয়া পৌঁছান ৭১১ খ্রিস্টাব্দে। কয়েক মাসের মাঝেই*তারিকের বাহিনী রাজা রডারিককে পরাজিত করেআইবেরিয়াতে মুসলিম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। আর তিন বছরের মাথায় গোটা আইবেরিয়া মুসলিমদের অধীনে চলে আসে। ভিসিগোথদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা অনেক শহর মুসলিমদের ন্যায়বিচার ও সাম্যতার ব্যাপারে জানতে পেরে স্বেচ্ছায় তাদের শহরের দরজা খুলে দেয় এবং মুসলিমদের স্বাগত জানায়।
মুসলিমদের স্পেন বিজয়ের বহু দলিলাদি ও প্রমাণপত্র টিকে ছিল যা থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় এই বিজয়টি মোটেও জোর করে ধর্মান্তর করার উদ্দেশ্যে ছিলনা। ৭১৩ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে, সেখানকার এক মুসলিম গভর্নর এক ভিসিগোথের সাথে একটি চুক্তির মাধ্যমে মধ্যস্থতা করেন, যেখানে একটা বিধান ছিল যে স্থানীয় ব্যক্তিদের*—
“হত্যা করা হবেনা কিংবা কয়েদী হিসেবেও নেয়া হবেনা। তাদেরকে তাদের নারী ও শিশুদের থেকেও আলাদা করা হবেনা। তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হবেনা, তাদের গীর্জাও পুড়িয়ে ফেলা হবেনা।”*(৩)
মুসলিম স্পেন (যা পরবর্তীতে ‘আল-আন্দালুস’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠে) এর উদাহরণ থেকে আমরা দেখতে পাই যে স্থানীয় জনগণকে (যাদের বেশীরভাগই ছিল খ্রিস্টান, যদিও একটা বড় ইহুদি জনসংখ্যাও ছিল) ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য জোর করা হয়নি। বরং বাস্তবে এরপরের শতাব্দীগুলোতে আল-আন্দালুস সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে যেখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান সবাই জ্ঞান, সংস্কৃতি ও দর্শন চর্চায় এক স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেছিল। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই আলোকিত ভূমির শেষ হয় আরো কয়েক শতাব্দী পরে যখন ‘খ্রিস্টান রিকনকুয়েস্তা’ (খ্রিস্টানদের পুনর্দখল) এর মাধ্যমে যা গোটা আইবেরিয়া থেকে সাফল্যের সাথে মুসলিম ও ইহুদিদের জাতিগতভাবে নির্মূল করে।
হিন্দুস্তান
আজ বিশ্বের সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দু’টি হচ্ছে পাকিস্তান (২য়) এবং ভারত (৩য়)। এই দু’টি দেশ মোটামুটি গোটা হিন্দুস্তানজুড়ে ব্যাপৃত। এই অঞ্চলের জনমানুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের এক অবিশ্বাস্য এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিমদের বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও রাজবংশ দ্বারা শাসিত হলেও হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্ম উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
উপমহাদেশে মুসলিমদের আক্রমণের ব্যাপারটা তখনকার যুদ্ধবিগ্রহের নিয়ম-কানুনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। শ্রীলংকায় বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজিত থাকা মুসলিম ব্যবসায়ীদের কন্যাদের জাহাজে সিন্ধু (যা বর্তমানে পাকিস্তান) অঞ্চলের জলদস্যুরা আক্রমণ করে এবং জাহাজের নারীদের আটক করে দাসবৃত্তির কাজে নিয়োজিত করে। বন্দী নারীদের মুক্ত করতে এবং জলদস্যুদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর নেতৃত্বে*৭১০ খ্রিস্টাব্দে একটা অভিযান পরিচালিত হয়। মুহাম্মাদ বিন কাশিম ছিলেন আরবের তায়েফের অধিবাসী।
এতো দূরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর সফল সেনা অভিযানের পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দুস্তানের চলমান খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু সামাজিক সমস্যা। হিন্দু ধর্মের একটি বিশ্বাস হচ্ছে বর্ণপ্রথা, যা সমাজকে বিভক্ত করে রেখেছিল খুবই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত কিছু সামাজিক শ্রেণীতে। উঁচু শ্রেণী ধন্যাঢ্য এবং আরামদায়ক জীবন যাপন করতো, অন্যদিকে নীচু শ্রেণীর সবাইকে (বিশেষ করে যারা অচ্ছুত নামে পরিচিত ছিল বা যাদের ছোঁয়া যেতোনা) দেখা হতো সমাজের অভিশাপ হিসেবে। সাথে ছিল বৌদ্ধ সম্প্রদায়, যারা গোটা দেশজুড়েই সাধারণত হিন্দু রাজপুতদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আসছিল। মুসলিমদের অনুপ্রবেশের পর তাদের প্রতি সামাজিক সাম্যের প্রতিশ্রুতির কারণে বেশীরভাগ বৌদ্ধ এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু তাদের স্বাগত জানায়। বাস্তবে, হিন্দুস্তানের সর্বপ্রথম মুসলিমরা সম্ভবত নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিল, যেহেতু ইসলাম তাদেরকে মুক্ত করে পূর্ববর্তী অত্যাচারী সামাজিক ব্যবস্থা থেকে।
সিন্ধু বিজয়ের মাধ্যমে মুহাম্মাদ বিন কাশিম এটা দেখাতে সক্ষম হন যে ইসলামী শরীয়াহর সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারটা শুধু খ্রিস্টান কিংবা ইহুদিদের জন্যই নয়। উপমহাদেশের বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়কে জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হয়নি, বরং তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেয়া হয়। এক ঘটনায়, এক অঞ্চলের বৌদ্ধ সম্প্রদায় মুহাম্মাদ বিন কাশিম এর কাছে এই মর্মে তাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে যে, মুসলিম বাহিনী হয়তো তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করবে এবং যার ফলে তাদেরকে তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম পালন করা বন্ধ করে দিতে হবে। এ অভিযোগ শুনে বিন কাশিম সেই শহরের বৌদ্ধ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতার সাথে বৈঠক করেন এবং তাদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দেন, এবং তাদের অনুরোধ করেন যাতে তারা তাদের জীবন ঠিক আগের মতোই যাপন করে যায়।
উপসংহার
আমরা আবার আর্টিকেলের শুরুর দিকে আরোপ করা প্রশ্নে ফিরে যাই, ইসলাম কি সত্যিই অস্ত্রের মুখে ছড়িয়েছিল? যখন অসংখ্য মানুষ রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় ইস্যুকে ব্যবহার করছে, তখন আমরা সন্দেহাতীতভাবে দেখতে পাই যে ইসলাম ধর্ম জবরদস্তি, বলপ্রয়োগ, ভীতি কিংবা রক্তপাতের মাধ্যমে ছড়ায়নি। কোথাও মানুষকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে এরূপ কোন বর্ণনাই পাওয়া যায়না। মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করলেও, বাস্তবে তাঁরা এই পথ গ্রহণ করেছিলেন অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা করার জন্যে। মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধ সবসময়ই ছিল সরকার এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে, স্থানীয় জনতার সাথে নয়। যদিও এই আর্টিকেলে মুসলিমদের শুরুর দিকের প্রজন্মের নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চল বিজয়ের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, পরবর্তী প্রজন্মের মুসলিমরা এই ধারা রেখে গিয়েছেন গোটা ইসলামের ইতিহাস জুড়েই।
এটা মনে রাখা জরুরী যে উল্লেখিত ঘটনাগুলো ছিল ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ইতিহাসে প্রথম কিছু উদাহরণ। যখন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং স্বাধীনতা পশ্চিমা সভ্যতায় সর্বপ্রথম দেখা গিয়েছিল ১৭শ এবং ১৮শ শতকের দিকে, তখন মুসলিমরা ধর্মীয় স্বাধীনতার চর্চা করে আসছে ৭ম শতক থেকে। ইসলামের বাণী উগ্রপন্থায় এবং যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলে তথাকথিত রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিক ‘পণ্ডিতগণ’*যেসব যুক্তিতর্ক পেশ করে থাকেন তাদের এসব যুক্তিতর্কের কোন ঐতিহাসিক ভিত্তিই নেই। বরং বাস্তবে মুসলিমদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এই চর্চা প্রভাবিত করেছিল ইউরোপ, আমেরিকা থেকে শুরু করে হিন্দুস্তানের মতো বৈচিত্র্যময় সব অঞ্চলের সংস্কৃতি ও চিন্তাধারাকে।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ*Did Islam spread by sword?*আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ খালিদ ফায়াদ
হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান, বর্তমান Indian Subcontinent (ভারতীয় উপমহাদেশ) এর ঐতিহাসিকভাবে জনপ্রিয় নামগুলির একটি। এই নামের আক্ষরিক অর্থ “সিন্ধু নদের দেশ”। হিন্দুস্তান নামটি বেশ প্রাচীন, যা এসেছে আদি ফার্সি শব্দ “হিন্দু” থেকে। ফার্সি ভাষায় সিন্ধু নদকে বলা হতো হিন্দু নদ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনপ্রিয় “স্তান” অনুসর্গটি (ফার্সি ভাষায় যার অর্থ “স্থান”)। আগে হিন্দুস্তান বলতে গোটা উপমহাদেশকেই বোঝাত।
ঐতিহাসিকভাবে “হিন্দু” কোন ধর্মের নাম নয় বরং সিন্ধু নদের পাড়ে বসবাসরত মানুষদেরকে বোঝাতো তারা যে ধর্মের অনুসারীই হোক না কেন। অন্যদিকে, বর্তমান হিন্দুধর্মের মূল নাম হচ্ছে সনাতন ধর্ম (সংস্কৃতঃ सनातन धर्म) যা কালের বিবর্তনে এখন হিন্দুধর্ম নামে পরিচিত হয়ে গিয়েছে।
সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অতীতে এই অঞ্চলকে (এবং এখনও) “আল-হিন্দ/হিন্দুস্তান” বলেই ডাকতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, রাসূল*ﷺ এর সময়ও এই উপমহাদেশকে বুঝানোর জন্য আল-হিন্দ (الهند) নামটি ব্যবহৃত হয়েছে।*এই ওয়েবসাইট এর মূল ইংরেজি আর্টিকেলগুলোতে India বলতে বুঝানো হয়েছে গোটা উপমহাদেশ, যা মূলত হিন্দুস্তান। ঐতিহাসিকভাবেইসলামের হারানো ইতিহাস*এর ক্ষেত্রেও তাই আমরা “হিন্দুস্তান” নামটিই ব্যবহার করব। বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃlostislamichistorybangla.wordpress.com/হিন্দুস্তান/
Citations:
এই সংজ্ঞানুযায়ী, আধুনিক যুগের সন্ত্রাসবাদ পরিষ্কারভাবে ইসলামী আইনের পরিপন্থী।
(১)- Aboul-Enein, H. Yousuf and Zuhur, Sherifa, Islamic Rulings on Warfare, p. 22, Strategic Studies Institute, US Army War College, Diane Publishing Co., Darby PA
(২)- Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.*pg.91
(৩)- Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.*pg.315
Sources:
Aboul-Enein, H. Yousuf and Zuhur, Sherifa, Islamic Rulings on Warfare, p. 22, Strategic Studies Institute, US Army War College, Diane Publishing Co., Darby PA
CIA World Factbook
Kennedy, H. (2007). The Great Arab Conquests: How the Spread of Islam Changed the World We Live In. Philadelphia: Da Capo Press.
Ochsenwald, W., & Fisher, S. (2003). The Middle East: A History. (6th ed.). New York: McGraw-Hill.
#copy
Comment