‘খারিজি’ কারা ছিল?
ইসলামের ইতিহাসজুড়ে, সময়ের পরিক্রমায় অসংখ্য গোষ্ঠীর*সৃষ্টি হয়েছিল যারা এই ধর্মের ব্যাপারে মৌলিকভাবে নতুন ও বিচিত্র ধরনের সব চিন্তাধারা প্রবর্তন করে এসেছে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম সহিংস গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছিল ৬৫৬ থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত আলী (রাঃ) এর খিলাফতে রাজনৈতিক কোন্দলের সময়, যারা ‘খারিজি’ নামে পরিচিত ছিল। এক মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে এদের উত্থান হয়েছিল, যা পরবর্তীতে চরমপন্থায় রূপ নেয় এবং অন্য সকল মুসলিমদের চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। যদিও মুসলিম বিশ্বে তারা কখনোই বড় রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি, তবুও তাদের সময়ে তাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশী। তাদের এই চিন্তাধারা সময়ের পরিক্রমায় গত ১৪০০ বছর ধরে অসংখ্যবার একই ধরনের অন্য অনেক গোষ্ঠীর মাঝে পুনরাবৃত্ত হয়ে এসেছে।
পটভূমিঃ
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে (৩৫ হিজরী সনে) মুসলিমদের খলিফা উসমান বিন আফফান (রাঃ) কে একদল মুসলিম মিশরীয় সৈন্য হত্যা করে। কারণ তাদের এবং মিশরের নিযুক্ত গভর্নরের মাঝে একটি বিরোধের সমাধান উসমান (রাঃ) যেভাবে করেছিলেন সে ব্যাপারে তারা অসন্তুষ্ট ছিল। পূর্ববর্তী দুই খলিফা আবু বকর (রাঃ) এবং উমর (রাঃ) তাদের মৃত্যুর পূর্বে অন্তত কিছু দিকনির্দেশনা রেখে গিয়েছিলেন পরবর্তী খলিফা কে হবে সে ব্যাপারে। আবু বকর (রাঃ) সরাসরি উমর (রাঃ) কে খলিফা নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন এবং এরপর উমর (রাঃ) ৬ সদস্যের একটি পরিষদ ঠিক করে গিয়েছিলেন। কিন্তু উসমান (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করার ব্যাপারে কোন কাঠামো দাঁড় করিয়ে যেতে পারেননি।
উসমান (রাঃ) কে হত্যার পর হত্যাকারীরা মদিনায় নিজেদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তাদের ইচ্ছে ছিল আলী (রাঃ) নতুন খলিফা হোক। আলী (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই তাদের এমন দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ এই দাবী মেনে নিলে সবাই হয়তো ভাবতে পারতো হত্যাকারী বিদ্রোহী দলের কার্যকলাপের প্রতি আলী (রাঃ) এর পরোক্ষ সমর্থন আছে। কারণ বিদ্রোহীরা যখন উসমান (রাঃ) এর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে তখন আলী (রাঃ) তাঁর নিজের দুই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন উসমান (রাঃ) কে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু যখন মদিনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আলী (রাঃ) কে বুঝান যে রাসূল ﷺ এর চাচাত ভাই ও জামাতা হিসেবে তিনিই মুসলিম রাজ্যের শান্তি ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি মুসলিমদের ৪র্থ খলিফা হয়েছিলেন।
খলিফা হবার সাথে সাথেই আলী (রাঃ) এর কিছু বিরোধী জুটে গেল। তখন মিশরের গভর্নর ছিলেন উসমান (রাঃ) এর চাচাত ভাই মুয়াবিয়া (রাঃ)। উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার আলী (রাঃ) করবেন, শুধুমাত্র এই শর্তে মুয়াবিয়া (রাঃ) তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। অন্যদিকে আলী (রাঃ) মুসলিমদের স্বার্থে (তখনকার খারাপ পরিস্থিতিতে) সেই কাজে সায় দেননি। তিনি অবশ্যই বিদ্রোহীদের কাজকে অনুমোদন দেননি, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্রোহীদের শাস্তি দিলে আরো বড় ধরনের বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারে, যা নবগঠিত মুসলিম খিলাফতের জন্য আরও রক্তপাত ও নতুন বিপদের কারণ হতে পারে। এই ভেবে আলী (রাঃ) ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সমর্থন না পাওয়ায়, আলী (রাঃ) খিলাফতের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ প্রদেশ থেকে বঞ্চিত হলেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) সিরিয়াতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি উমর (রাঃ) এর সময় থেকে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সেই অঞ্চলের স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও নতুন আরব মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটান। অন্যদিকে আলী (রাঃ) এর সাথে ছিল ইরাকী জনগনের শক্ত সমর্থন, বিশেষ করে কুফা নগরী থেকে। আলী (রাঃ) এর আনুগত্য না করায় কুফা’র জনগণ মুয়াবিয়া (রাঃ) এর উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল।
মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সিরিয়ান সমর্থক এবং আলী (রাঃ) এর ইরাকি সমর্থকদের মধ্যে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে তাঁরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে মধ্যস্থতা করতে সম্মত হন। তৃতীয় পক্ষের কাজ হবে এই বিতর্কের সমাধান করা, সম্ভাব্য নতুন খলিফা বাছাই করা এবং এর মাধ্যমে মুসলিম খিলাফতের সম্ভাব্য বিপজ্জনক রাজনৈতিক বিভক্তির এক শান্তিপূর্ণ সমাধান আনা।
কিন্তু মধ্যস্থটা করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ঝামেলায় পড়লেন আলী (রাঃ)। তাঁর সমর্থকদের একটি অংশ (উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার না করার) সিদ্ধান্তে এতোটাই প্রণোদিত ছিল যে মধ্যস্থতা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তারা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়ে। তাদের মতে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সাথে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে আলী (রাঃ) বড় এক পাপ করে ফেলেছেন। পরে তারা আলী (রাঃ) এর দলত্যাগ করলো এবং ‘খারিজি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো, যার অর্থ হচ্ছে “যারা (দল)ত্যাগ করেছে”।
খারিজি মতবাদ
কিভাবে একটি রাজনৈতিক মতবাদ একটি বিপথগামী ইসলামী মতবাদে পরিণত হয়, খারিজিদের অগ্রগতি ছিল তারই শিক্ষা (পরবর্তীতে একই পন্থায় এক রাজনৈতিক থেকে ধর্মীয় মতবাদে রূপান্তরের মাধ্যমে শিয়া মতবাদের উদ্ভব হয়)। আলী (রাঃ) ভুল করেছেন, খারিজিদের এই মতবাদ পরবর্তীতে এমন ধারণায় রূপ নেয়ঃ “পাপী ব্যক্তি শাসক হবার অযোগ্য”। তাদের এই ধারণাই ছিল অনেক চরমপন্থী মানসিকতার, কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
তারা যুক্তি দেখায় যে পাপ হচ্ছে কুফর (আল্লাহ্*কে অবিশ্বাস করা) এর আর এক রূপ। তাদের মতে, কেউ যদি কোন পাপ করে থাকে তাহলে পাপের প্রভাবে সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এ ধরনের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে এমনকি ব্যক্তিটি যদি রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীও হন। অন্যদিকে, কেউ যদি তাদের এই বিশ্বাসের সাথে একমত না হয় তাহলে তো সে ব্যক্তি এমনিতেই একজন কাফির (অবিশ্বাসী) হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার সাথেও যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে।
খারিজিদের বিশ্বাসের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, তাক্*ফির (কাউকে কাফের/অবিশ্বাসী ঘোষণা করা) খুবই সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলো সাধারণত খুবই বিরল। অধিকাংশের মতামত অনুযায়ী, ইমাম আল-তাহাউয়ি এর ’আকিদা গ্রন্থ অনুযায়ী, শুধুমাত্র যে জিনিষটা কোন ব্যক্তির মুসলিম পরিচয় বাতিল করে দেয় তা হচ্ছে জনসম্মুখে ঘোষণা করা যে “আল্লাহ্* ছাড়া কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রাসূল”-এ সে আর বিশ্বাস করেনা। অধিকাংশ খারিজি ছিল অশিক্ষিত, কুর’আনের আয়াত ও রাসূলের হাদিসের ব্যাপারে ভাল জ্ঞান তাদের ছিলনা। তাদের বেশীরভাগই ছিল হানাদার মরু বেদুইন, যাদের মূল শক্তি ছিল খারিজি ধ্যান-ধারণা, ইসলামের ব্যাপারে তারা ছিল সম্পূর্ণই অজ্ঞ।
খারিজিদের মতবাদ কখনোই জনসাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্য ছিলনা। আর তাছাড়া রাসূল ﷺ এর শিক্ষা বিকৃত করায় খারিজিদের এই চরমভাবাপূর্ণ মতবাদ গ্রহণ করা সবার জন্যই খুব কঠিন ছিল। কিন্তু তারপরও তা খারিজিদের এই ছোট্ট গোষ্ঠীকে মুসলিম বিশ্বের বড় প্রভাব বিস্তার করা থেকে দমাতে পারেনি।
খারিজিরা তাদের মতবাদ অনুযায়ী মধ্যস্থতার সাথে জড়িত সকল রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার চেষ্টা চালায়, মূলত যে মধ্যস্থতার কারণেই তাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং মিশরের গভর্নর ‘আম্*র ইবনে আল-‘আস (রাঃ) কে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ‘আম্*র ইবনে আল-‘আস (রাঃ), মুয়াবিয়া (রাঃ) কে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং মুয়াবিয়া (রাঃ) এর নামেই মিশর শাসন করছিলেন। কিন্তু খারিজিরা ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আলি (রাঃ) কে হত্যা করতে সক্ষম হয়। রাসূল ﷺ এর চাচাত ভাই ও জামাতার গুপ্তহত্যার মাধ্যমে খিলাফতের রাশিদুন যুগের সম্পাতি ঘটে এবং সূচনা হয় উমাইয়া খিলাফতের, যার নেতৃত্বে ছিলেন মুয়াবিয়া (রাঃ)।
খারিজিরা এরপরও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উমাইয়া এবং আব্বাসীদের জন্য উপদ্রবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও তারা তাদের অসংখ্য বিদ্রোহের মাধ্যমে কখনোই কোন বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর নিজেদের দখলে আনতে পারেনি, কিন্তু তারপরও মরু বেদুইন হওয়ার সুবাদে গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াত, আর যারা তাদের বিশ্বাসের সাথে একমত ছিলনা তাদের হয়রানি করতো, হাঙ্গা-গোলযোগ সৃষ্টি করে বেড়াতো। এটাই ছিল তাদের প্রকৃতি। উত্তর আফ্রিকাতে স্থানীয় বার্বা*র জনগোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আরবদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করার মাধ্যমে তারা বার্বারদের কিছু সমর্থন পেয়েছিল।
অবশেষে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় খারিজি আন্দোলন, যার মূল কারণ ছিল তারা নিজেরাই। তাদের চরমপন্থী চেতনার কারণেই মুসলিমরা তাদের মতবাদ গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের মাঝে একটি দল সময়ের সাথে কিছুটা মধ্যপন্থী হতে সমর্থ হয় এবং ‘ইবাদী’ সম্প্রদায়ের সূচনা করে। এই ইবাদীরা আজ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান এর জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ। যদিও খারিজি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি, তবে কোন ব্যক্তি পাপ করলে তাকে কাফির ঘোষণা করার এই মতবাদটা সময়ের সাথে বহু চরমপন্থী গোষ্ঠীর আন্দোলন পুনরূজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছে, এমনকি এই আধুনিক যুগে কিছু রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝেও।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ*Who Were the Kharijis?*আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ সাদি ইউসুফ খান
Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ
Hodgson, Marshall G. S.*The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization. Chicago: U of Chicago, 1974.
Ibn Khaldūn.*The Muqaddimah, An Introduction To History. Bollingen, 1969. 230.
Saunders, John J.*A History of Medieval Islam. London: Routledge & Kegan Paul, 1980.
#copy
ইসলামের ইতিহাসজুড়ে, সময়ের পরিক্রমায় অসংখ্য গোষ্ঠীর*সৃষ্টি হয়েছিল যারা এই ধর্মের ব্যাপারে মৌলিকভাবে নতুন ও বিচিত্র ধরনের সব চিন্তাধারা প্রবর্তন করে এসেছে। এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অন্যতম সহিংস গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছিল ৬৫৬ থেকে ৬৬১ সাল পর্যন্ত আলী (রাঃ) এর খিলাফতে রাজনৈতিক কোন্দলের সময়, যারা ‘খারিজি’ নামে পরিচিত ছিল। এক মৌলিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা থেকে এদের উত্থান হয়েছিল, যা পরবর্তীতে চরমপন্থায় রূপ নেয় এবং অন্য সকল মুসলিমদের চিন্তাধারা থেকে ভিন্ন হয়ে যায়। যদিও মুসলিম বিশ্বে তারা কখনোই বড় রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় শক্তিতে পরিণত হতে পারেনি, তবুও তাদের সময়ে তাদের প্রভাব ছিল অনেক বেশী। তাদের এই চিন্তাধারা সময়ের পরিক্রমায় গত ১৪০০ বছর ধরে অসংখ্যবার একই ধরনের অন্য অনেক গোষ্ঠীর মাঝে পুনরাবৃত্ত হয়ে এসেছে।
পটভূমিঃ
৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে (৩৫ হিজরী সনে) মুসলিমদের খলিফা উসমান বিন আফফান (রাঃ) কে একদল মুসলিম মিশরীয় সৈন্য হত্যা করে। কারণ তাদের এবং মিশরের নিযুক্ত গভর্নরের মাঝে একটি বিরোধের সমাধান উসমান (রাঃ) যেভাবে করেছিলেন সে ব্যাপারে তারা অসন্তুষ্ট ছিল। পূর্ববর্তী দুই খলিফা আবু বকর (রাঃ) এবং উমর (রাঃ) তাদের মৃত্যুর পূর্বে অন্তত কিছু দিকনির্দেশনা রেখে গিয়েছিলেন পরবর্তী খলিফা কে হবে সে ব্যাপারে। আবু বকর (রাঃ) সরাসরি উমর (রাঃ) কে খলিফা নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন এবং এরপর উমর (রাঃ) ৬ সদস্যের একটি পরিষদ ঠিক করে গিয়েছিলেন। কিন্তু উসমান (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর পূর্বে পরবর্তী খলিফা নিযুক্ত করার ব্যাপারে কোন কাঠামো দাঁড় করিয়ে যেতে পারেননি।
উসমান (রাঃ) কে হত্যার পর হত্যাকারীরা মদিনায় নিজেদের শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। তাদের ইচ্ছে ছিল আলী (রাঃ) নতুন খলিফা হোক। আলী (রাঃ) স্বাভাবিকভাবেই তাদের এমন দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ এই দাবী মেনে নিলে সবাই হয়তো ভাবতে পারতো হত্যাকারী বিদ্রোহী দলের কার্যকলাপের প্রতি আলী (রাঃ) এর পরোক্ষ সমর্থন আছে। কারণ বিদ্রোহীরা যখন উসমান (রাঃ) এর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে তখন আলী (রাঃ) তাঁর নিজের দুই ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন উসমান (রাঃ) কে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু যখন মদিনার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আলী (রাঃ) কে বুঝান যে রাসূল ﷺ এর চাচাত ভাই ও জামাতা হিসেবে তিনিই মুসলিম রাজ্যের শান্তি ও স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি, তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিনি মুসলিমদের ৪র্থ খলিফা হয়েছিলেন।
খলিফা হবার সাথে সাথেই আলী (রাঃ) এর কিছু বিরোধী জুটে গেল। তখন মিশরের গভর্নর ছিলেন উসমান (রাঃ) এর চাচাত ভাই মুয়াবিয়া (রাঃ)। উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার আলী (রাঃ) করবেন, শুধুমাত্র এই শর্তে মুয়াবিয়া (রাঃ) তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিলেন। অন্যদিকে আলী (রাঃ) মুসলিমদের স্বার্থে (তখনকার খারাপ পরিস্থিতিতে) সেই কাজে সায় দেননি। তিনি অবশ্যই বিদ্রোহীদের কাজকে অনুমোদন দেননি, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্রোহীদের শাস্তি দিলে আরো বড় ধরনের বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারে, যা নবগঠিত মুসলিম খিলাফতের জন্য আরও রক্তপাত ও নতুন বিপদের কারণ হতে পারে। এই ভেবে আলী (রাঃ) ব্যাপারটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সমর্থন না পাওয়ায়, আলী (রাঃ) খিলাফতের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ প্রদেশ থেকে বঞ্চিত হলেন। মুয়াবিয়া (রাঃ) সিরিয়াতে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি উমর (রাঃ) এর সময় থেকে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন এবং অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সেই অঞ্চলের স্থানীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায় ও নতুন আরব মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটান। অন্যদিকে আলী (রাঃ) এর সাথে ছিল ইরাকী জনগনের শক্ত সমর্থন, বিশেষ করে কুফা নগরী থেকে। আলী (রাঃ) এর আনুগত্য না করায় কুফা’র জনগণ মুয়াবিয়া (রাঃ) এর উপর ভীষণ ক্ষিপ্ত ছিল।
মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সিরিয়ান সমর্থক এবং আলী (রাঃ) এর ইরাকি সমর্থকদের মধ্যে সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে তাঁরা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে নিজেদের মাঝে মধ্যস্থতা করতে সম্মত হন। তৃতীয় পক্ষের কাজ হবে এই বিতর্কের সমাধান করা, সম্ভাব্য নতুন খলিফা বাছাই করা এবং এর মাধ্যমে মুসলিম খিলাফতের সম্ভাব্য বিপজ্জনক রাজনৈতিক বিভক্তির এক শান্তিপূর্ণ সমাধান আনা।
কিন্তু মধ্যস্থটা করতে গিয়ে অপ্রত্যাশিত ঝামেলায় পড়লেন আলী (রাঃ)। তাঁর সমর্থকদের একটি অংশ (উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার না করার) সিদ্ধান্তে এতোটাই প্রণোদিত ছিল যে মধ্যস্থতা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তারা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়ে। তাদের মতে মুয়াবিয়া (রাঃ) এর সাথে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে আলী (রাঃ) বড় এক পাপ করে ফেলেছেন। পরে তারা আলী (রাঃ) এর দলত্যাগ করলো এবং ‘খারিজি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করলো, যার অর্থ হচ্ছে “যারা (দল)ত্যাগ করেছে”।
খারিজি মতবাদ
কিভাবে একটি রাজনৈতিক মতবাদ একটি বিপথগামী ইসলামী মতবাদে পরিণত হয়, খারিজিদের অগ্রগতি ছিল তারই শিক্ষা (পরবর্তীতে একই পন্থায় এক রাজনৈতিক থেকে ধর্মীয় মতবাদে রূপান্তরের মাধ্যমে শিয়া মতবাদের উদ্ভব হয়)। আলী (রাঃ) ভুল করেছেন, খারিজিদের এই মতবাদ পরবর্তীতে এমন ধারণায় রূপ নেয়ঃ “পাপী ব্যক্তি শাসক হবার অযোগ্য”। তাদের এই ধারণাই ছিল অনেক চরমপন্থী মানসিকতার, কিন্তু ঘটনার শেষ এখানেই নয়।
তারা যুক্তি দেখায় যে পাপ হচ্ছে কুফর (আল্লাহ্*কে অবিশ্বাস করা) এর আর এক রূপ। তাদের মতে, কেউ যদি কোন পাপ করে থাকে তাহলে পাপের প্রভাবে সে অবিশ্বাসী হয়ে যায়। এ ধরনের ব্যক্তির সাথে যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে এমনকি ব্যক্তিটি যদি রাসূল (সাঃ) এর সাহাবীও হন। অন্যদিকে, কেউ যদি তাদের এই বিশ্বাসের সাথে একমত না হয় তাহলে তো সে ব্যক্তি এমনিতেই একজন কাফির (অবিশ্বাসী) হিসেবে গণ্য হবে, এবং তার সাথেও যুদ্ধ করা যাবে, তাকে হত্যাও করা যাবে।
খারিজিদের বিশ্বাসের মধ্যে প্রকৃত ইসলামী ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, তাক্*ফির (কাউকে কাফের/অবিশ্বাসী ঘোষণা করা) খুবই সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলো সাধারণত খুবই বিরল। অধিকাংশের মতামত অনুযায়ী, ইমাম আল-তাহাউয়ি এর ’আকিদা গ্রন্থ অনুযায়ী, শুধুমাত্র যে জিনিষটা কোন ব্যক্তির মুসলিম পরিচয় বাতিল করে দেয় তা হচ্ছে জনসম্মুখে ঘোষণা করা যে “আল্লাহ্* ছাড়া কোন ইলাহ নেই ও মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর রাসূল”-এ সে আর বিশ্বাস করেনা। অধিকাংশ খারিজি ছিল অশিক্ষিত, কুর’আনের আয়াত ও রাসূলের হাদিসের ব্যাপারে ভাল জ্ঞান তাদের ছিলনা। তাদের বেশীরভাগই ছিল হানাদার মরু বেদুইন, যাদের মূল শক্তি ছিল খারিজি ধ্যান-ধারণা, ইসলামের ব্যাপারে তারা ছিল সম্পূর্ণই অজ্ঞ।
খারিজিদের মতবাদ কখনোই জনসাধারণের মাঝে গ্রহণযোগ্য ছিলনা। আর তাছাড়া রাসূল ﷺ এর শিক্ষা বিকৃত করায় খারিজিদের এই চরমভাবাপূর্ণ মতবাদ গ্রহণ করা সবার জন্যই খুব কঠিন ছিল। কিন্তু তারপরও তা খারিজিদের এই ছোট্ট গোষ্ঠীকে মুসলিম বিশ্বের বড় প্রভাব বিস্তার করা থেকে দমাতে পারেনি।
খারিজিরা তাদের মতবাদ অনুযায়ী মধ্যস্থতার সাথে জড়িত সকল রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার চেষ্টা চালায়, মূলত যে মধ্যস্থতার কারণেই তাদের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা মুয়াবিয়া (রাঃ) এবং মিশরের গভর্নর ‘আম্*র ইবনে আল-‘আস (রাঃ) কে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ‘আম্*র ইবনে আল-‘আস (রাঃ), মুয়াবিয়া (রাঃ) কে সমর্থন দিয়েছিলেন এবং মুয়াবিয়া (রাঃ) এর নামেই মিশর শাসন করছিলেন। কিন্তু খারিজিরা ৬৬১ খ্রিস্টাব্দে খলিফা আলি (রাঃ) কে হত্যা করতে সক্ষম হয়। রাসূল ﷺ এর চাচাত ভাই ও জামাতার গুপ্তহত্যার মাধ্যমে খিলাফতের রাশিদুন যুগের সম্পাতি ঘটে এবং সূচনা হয় উমাইয়া খিলাফতের, যার নেতৃত্বে ছিলেন মুয়াবিয়া (রাঃ)।
খারিজিরা এরপরও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে উমাইয়া এবং আব্বাসীদের জন্য উপদ্রবের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও তারা তাদের অসংখ্য বিদ্রোহের মাধ্যমে কখনোই কোন বড় ও গুরুত্বপূর্ণ শহর নিজেদের দখলে আনতে পারেনি, কিন্তু তারপরও মরু বেদুইন হওয়ার সুবাদে গোটা মুসলিম বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াত, আর যারা তাদের বিশ্বাসের সাথে একমত ছিলনা তাদের হয়রানি করতো, হাঙ্গা-গোলযোগ সৃষ্টি করে বেড়াতো। এটাই ছিল তাদের প্রকৃতি। উত্তর আফ্রিকাতে স্থানীয় বার্বা*র জনগোষ্ঠীর সাথে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আরবদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি করার মাধ্যমে তারা বার্বারদের কিছু সমর্থন পেয়েছিল।
অবশেষে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় খারিজি আন্দোলন, যার মূল কারণ ছিল তারা নিজেরাই। তাদের চরমপন্থী চেতনার কারণেই মুসলিমরা তাদের মতবাদ গ্রহণ করতে পারেনি। তাদের মাঝে একটি দল সময়ের সাথে কিছুটা মধ্যপন্থী হতে সমর্থ হয় এবং ‘ইবাদী’ সম্প্রদায়ের সূচনা করে। এই ইবাদীরা আজ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান এর জনসংখ্যার এক বিশাল অংশ। যদিও খারিজি আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি, তবে কোন ব্যক্তি পাপ করলে তাকে কাফির ঘোষণা করার এই মতবাদটা সময়ের সাথে বহু চরমপন্থী গোষ্ঠীর আন্দোলন পুনরূজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছে, এমনকি এই আধুনিক যুগে কিছু রাজনৈতিক আন্দোলনের মাঝেও।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ*Who Were the Kharijis?*আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদকঃ সাদি ইউসুফ খান
Bibliography – গ্রন্থপঞ্জিঃ
Hodgson, Marshall G. S.*The Venture of Islam: Conscience and History in a World Civilization. Chicago: U of Chicago, 1974.
Ibn Khaldūn.*The Muqaddimah, An Introduction To History. Bollingen, 1969. 230.
Saunders, John J.*A History of Medieval Islam. London: Routledge & Kegan Paul, 1980.
#copy
Comment