৯/১১; আমেরিকার উপর জুলুম নাকি তাদের পাপের শাস্তি?

( ৯/১১ সম্পর্কে আল ফিরদাউসের সম্পাদক মুহতারাম ইবরাহীম হাসান হাফিযাহুল্লাহ’র মতামত )
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে সংঘটিত আল-কায়েদার সফল হামলা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে আছে। এই হামলা বিশ্ব রাজনীতি ও যুদ্ধনীতির মোড় পরিবর্তন করে দিয়েছে। এ দিনে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে বিমান হামলা, এবং পেনসিলভানিয়ায় হোয়াইট হাউজমুখী বিমানের বিধ্বস্তের ঘটনায় হামলাকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যায়িত করে পশ্চিমা বিশ্ব দিনটিকে আজও জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমেরিকার কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারাই আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সোমালিয়াসহ প্রায় পুরো মধ্যপ্রাচ্য, জাপান, কোরিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম পর্যন্ত আমেরিকার আগ্রাসন, যুদ্ধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইতিহাসই এর প্রমাণ। তাই আমেরিকা ও তার প্রভাবাধীন রাষ্ট্রগুলোর দুর্নীতিগ্রস্থ সরকার ব্যতীত বাকি বিশ্বের জনসাধারণের কাছে এটি কোন ট্র্যাজেডি নয়, বরং আমেরিকার দীর্ঘদিনের বৈশ্বিক সন্ত্রাস, আগ্রাসন ও গণহত্যার প্রতিফল।
আমেরিকার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের ইতিহাস
৯/১১-এর অনেক আগেই আমেরিকা নিজেকে একটি আগ্রাসী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে প্রায় প্রতিটি দশকেই কোনো না কোনো দেশে তারা আগ্রাসন চালিয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে তাদের যুদ্ধনীতির প্রধান শিকার ছিল মুসলিম বিশ্ব।
২০০১ সালে ৯/১১-এর হামলার প্রতিশোধ নিতে, তখন পর্যন্ত অপ্রমাণিত হামলাকারী শাইখ উসামা রহিমাহুল্লাহ’র আশ্রয়দাতা সরকার হিসেবে তালেবানকে উৎখাতের নামে আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় সন্ত্রাসী যুক্তরাষ্ট্র। যদিও মাত্র এক মাসের মাথায় তালেবান সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। কিন্তু আমেরিকার আগ্রাসনের সেই যে শুরু হয়, তা আজো চলছে তথাকথিত “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ” এর নামে।
আমেরিকার এই তথাকথিত সন্ত্রাসের বিরোধী যুদ্ধে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়ায় নিহত হয় অন্তত ৫০ লক্ষ মানুষ। যার মাঝে আমেরিকা নেতৃত্বাধীন জোটের সরাসরি হামলায় নিহত হয় প্রায় সাড়ে নয় লাখ মানুষ। বাকিরা মৃত্যুবরণ করে এই অন্যায় যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব এবং অবরোধের ফলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল থেকে শুরু করে গ্রামীণ জনপদে বিয়ের আসর, জানাজার নামাজের মতো বেসামরিক জনসমাগম স্থলে ড্রোন হামলা চালিয়ে লক্ষাধিক নিরীহ নারী-শিশুর প্রাণহানি ঘটায় সন্ত্রাসী আমেরিকা। এছাড়াও এই যুদ্ধের ফলে গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ৪ কোটি মানুষ।
২০০৩ সালে “বিধ্বংসী অস্ত্র” আছে এই মিথ্যা অভিযোগে ইরাকে হামলা চালায় আমেরিকা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধে নিহত হয় দুই লাখেরও বেশি সাধারণ মানুষ। দেশটির অবকাঠামো ধ্বংস হয়, লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। অথচ পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়, ইরাকে কোনো “বিধ্বংসী অস্ত্র” ছিলই না। তারও আগে উপসাগরীয় যুদ্ধ চলাকালীন টানা নয় বছর ইরাকে অবরোধ দিয়ে হত্যা করে প্রায় ৫ লক্ষাধিক শিশুকে।
আমেরিকার বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসের জ্বলন্ত প্রমান হচ্ছে ফিলিস্তিনের গণহত্যা, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী ইসরায়েলকে প্রায় সকল প্রকারের মারণাস্ত্রের সরবরাহ এবং অন্ধ সমর্থন দিয়ে আসছে আমেরিকা। সেই সমর্থনের কারণেই ফিলিস্তিনে অবৈধ দখলদারিত্ব, গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাচ্ছে এই দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রটি। গাজায় প্রতিটি হামলার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ও অস্ত্রের যোগান রয়েছে। ফলে আমেরিকা শুধু পরোক্ষভাবে নয়, প্রত্যক্ষভাবেও এই হত্যাযজ্ঞের অংশীদার।
এছাড়া, ২০০২ সালে চালু হওয়া গুয়ান্তানামো বে কারাগার আমেরিকার ভণ্ডামির এক জ্বলন্ত প্রতীক হয়ে আছে। “সন্ত্রাসবাদের নামে” গুয়ান্তানামো বে কারাগারে আটক রাখা হয়েছে ৭৮০ জন মুসলিম বন্দীকে, যাদের অনেককে বিচার ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার এই কারাগার বন্ধের দাবি তুললেও এখনো এটি বিদ্যমান।
৯/১১ ঘটনার পর পশ্চিমা বিশ্ব যখন শোকে ডুবে যায়, তখন মুসলিম বিশ্বের অনেকের প্রতিক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সামাজিক মাধ্যমে, মসজিদে, রাজনৈতিক আলোচনায় একটি প্রশ্ন জোরেশোরে ওঠে—এটি কি স্রেফ একটি হামলা, নাকি আমেরিকার অপরাধের ন্যায্য প্রতিফল?
অনেকেই মনে করেন, আমেরিকা যেভাবে মুসলিম বিশ্বের রক্ত ঝরিয়েছে, গৃহযুদ্ধ উস্কে দিয়েছে, স্বৈরাচারী শাসকদের মদদ দিয়েছে—তাতে করে ৯/১১ আসলে ছিল তাদের পাপের শাস্তি।
যুগ যুগ ধরে আমেরিকা কতৃক পরিচালিত আগ্রাসন, গণহত্যা ও জুলুমের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ৯/১১ এ আমেরিকার প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন এবং ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে হামলা চালানো হয়। হোয়াইট হাউসেও হামলার প্রচেষ্টা চালানো হয়।
৯/১১ এটিই প্রমাণ করে, কোনো রাষ্ট্র যখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাস চালায়, তখন একদিন সেই আগ্রাসনের আগুন তার নিজের ঘরেও পৌঁছায়। সুতরাং, ৯/১১ কোনো “সন্ত্রাসী হামলা” নয়, বরং বিশ্ব রাজনীতির এক ভয়াবহ বাস্তবতা—যে দেশ অন্যের উপর দমন-পীড়ন-আগ্রাসন চালায়, সে নিজেও একদিন পাল্টা প্রতিরোধের শিকার হয়।
৯/১১ হামলার শোককে আমেরিকা বৈশ্বিক মঞ্চে বড় করে দেখানোর মাধ্যমে আসলে নিজের হাতে সৃষ্ট রক্তের নদীকে আড়াল করে। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বহু দেশে লাখো মানুষের প্রাণহানি, বাস্তুচ্যুতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় বহন করছে আমেরিকা। অতএব, আজকের বিশ্ব যখন আমেরিকার নেতৃত্বে “সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ” নিয়ে আলোচনা করে, তখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—আসল সন্ত্রাসী কি আমেরিকা নিজেই নয়?
Comment