আপনি কি শহীদ তিতুমীর রহিমাহুল্লাহকে চিনেন ?
(এই লেখাটি “titumir media”এর জন্য উৎসর্গিত)
ইবন আদম
পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতি প্রিয় নাম তিতুমীর। স্বাধীনচেতা পালোয়ান তিতুকে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকরা অসম্ভব ভয় পেত। ব্রিটিশের স্থানীয় জমিদাররা তাঁর নাম শুনে হতো আতঙ্কিত। ব্রিটিশ বেনিয়ার নাগপাশ থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। সাহসী তিতুমীর ইসলামের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিতুমীরের এ লড়াই পাক-ভারত মুসলিম ইতিহাসের এক অনন্য বীরত্বগাথা এবং এক গৌরবময় অধ্যায়। মুসলিম মানসপটে শিহরণসঞ্চারী এক স্বাপ্নিক পুরুষ ছিলেন তিতুমীর। তাঁর অসীম সাহস ও ক্ষিপ্রতা আমাদের হৃদয়াবেগ প্রাণিত করে। নারকেলবাড়িয়ায় তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা ইতিহাসের পাতায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। মহান শহীদ তিতুমীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু কোন আপস করেননি।
একাদশ শতকে এক ক্রান্তিকাল চলছে। পাক-ভারত মুসলিম সমাজের তখন ঘোর দুর্দিন। নীলচাষে রাজি না হলে নীল কুঠিয়ালদের চাবুকের আঘাতে গরিব চাষিরা জর্জরিত হতেন। ব্রিটিশ বেনিয়ার তল্পিবাহক হিন্দু জমিদারগণ খাজনা আদায়ের নামে কৃষকের গরু-ছাগল কেড়ে নিতো। বর্ণবাদী হিন্দুদের অমানবিক আচরণ সহ্যের সীমা অতিক্রম করল। হিন্দুরা মুসলমানদের বোন্দা, গেন্দা, বুটা, চান্দি, গেন্দি, পেন্দি ইত্যাদি উপহাসমূলক নামে ডাকত। কেউ ইচ্ছে করলেই মুসলমানি নাম রাখতে পারত না। এ জন্য জমিদারকে ‘খারিজানা’ খাজনা পঞ্চাশ টাকা দিতে হতো। কেউ দাড়ি রাখতে চায় তো, তাকে খাজনা হিসেবে আড়াই টাকা গুনতে হতো। গোঁফ ছাঁটতে দিতে হতো পাঁচসিকা। এখানকার মুসলমানরা মসজিদ বানাতে চাইলে তা স্বাধীনভাবে করা যেত না। জমিদারকে নজরানা না দিয়ে কারো মসজিদ বানানোর সাহস ছিল না। জমিদার প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচ টাকা, আর পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা নজরানা নিত। এমনকি কারো সন্তান হলে এর জন্য জমিদারকে কর দিতে হতো। জমিদারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মুসলমানদের ভাগ্য নির্ভর করত। জমিদার ইচ্ছা করলেই কাউকে তার বাড়িতে বিনা পয়সায় গতর খাটাত। অত্যাচারের এখানেই শেষ নয়। জমিদারের হুকুমের নড়চড় হয়েছে তো, আর রক্ষে ছিল না। চাবুকের আঘাতে প্রজার রক্ত ঝরত। জমিদারের অত্যাচারে প্রজাকে পশুর মতো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হতো। কখনও বা জমিদার প্রজার বাড়ি নিলামে উঠাত।
বাংলার গরিব কৃষক ও মুসলমানদের এই দুর্দিনে চব্বিশ পরগনায় জন্ম নেন শিশু তিতুমীর। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। ১১৮২ সালের ১৪ মাঘ বসিরহাটের চাঁদপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তিতুমীরের পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তাঁর পরিবার ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা)-এর বংশ তালিকার সাথে যুক্ত বলে জানা যায়। তিতুমীরের পূর্বপুরুষ সাইয়েদ শাদাত আলী আরব থেকে বাংলায় এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। লেখাপড়ার প্রতি তিতুমীরের প্রচ- ঝোঁক ছিল। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তিতু এক মাদরাসায় ভর্তি হন। আঠারো বছর বয়সে তিতুমীর ‘কুরআনে হাফেজ’ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। একই সাথে তিনি হাদিসশাস্ত্রে পা-িত্য লাভ করেন। এই সময়ে তিতুমীর আরবি, বাংলা, ফারসি ও অঙ্কশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
বাংলার গরিব কৃষকের ওপর তখন নীল কুঠিয়ালদের ভয়ানক অত্যাচার ও শোষণ চলছিল। এসব দেখে তিতুমীর মর্মাহত হতেন। ব্রিটিশ শাসকের বৈষম্যনীতি এবং বর্ণ হিন্দুদের ঘৃণ্য মনোভাব তাঁর মনকে বিষিয়ে তুলল। এতে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তাই এসব অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য তিতুমীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন। এ জন্য তিনি নিজেকে শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান করার মনস্থ করলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ওস্তাদ হাফিজ নেয়ামত উল্লাহর কাছে শরীরর্চ্চা শুরু করেন। নিবিড় একাগ্রতা ও একনিষ্ঠার কারণে অল্পদিনেই তিতুমীর কুস্তি লাঠিখেলা, তলোয়ার ও ঢাল-সড়কির খেলায় পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে তিনি ঘরসংসার করলেন। বিয়ের চৌদ্দ দিন পর বাবা হাসান আলী মারা গেলেন। এতে তিনি মর্মপীড়া পেলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মানসিক দৃঢ়তায় ছেদ পড়েনি। এ সময় তিনি কলকাতায় চলে আসেন।
১৮২২ সালের কথা। তিতুমীরের বয়স তখন ঊনচল্লিশের কোঠায়। এ বছর হজব্রত পালনের জন্য তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে তাঁর সাথে আরেক বিল্পবী নেতার সাক্ষাৎ ঘটল। নাম সৈয়দ আহমদ। বেরেলির এই বীরও ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের তাড়াতে সংগ্রাম করছিলেন। তিতুমীর সৈয়দ আহমদের স্পর্শে এসে বিল্পবী চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হন। ১৮২৭ সালে তিনি যথারীতি দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি আর বসে থাকলেন না। শুরু হলো কাক্সিক্ষত আন্দোলনের প্রস্তুতি। সমাজ থেকে শিরক ও বিদয়াত দূর করা এবং মুসলমানদের এর কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা ছিল তিতুমীরের প্রাথমিক কাজ। পাশাপাশি অত্যাচারিত অসহায় কৃষকদের জমিদারের শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা ছিল তাঁর অন্যতম বড় কাজ। দেখতে দেখতে তিতুমীরের আন্দোলনে জোয়ার এলো। সমাজের অনেক মানুষ তাঁর কথায় আকৃষ্ট হলো। ফলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা নড়েচড়ে উঠল। জমিদাররা খাজনা ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তাঁর ওপর প্রচ- রেগে গেল। শিরকপন্থী ভ- পীরগণ তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত হলো। আর সুদখোর অত্যাচারী মহাজনরা অর্থ লুটার সুযোগ হারাবার ভয়ে দারুণ ক্ষেপে গেল। ফলে তিতুমীরের বিপক্ষে সবাই একাট্টা হলো। তখনকার জমিদার ছিল কৃষ্ণদেব। তিতুমীর এই অত্যাচারী ও শোষক জমিদারকে সতর্ক করার জন্য চিঠি দিলেন। চিঠি পেয়ে কৃষ্ণদেব ক্ষিপ্ত হলো এবং চিঠির বাহক আমিন উল্লাহকে অত্যাচারে জর্জরিত করল। এতে আমিন উল্লাহ শাহাদাতবরণ করলেন।
আমিন উল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা চব্বিশ পরগনার নারকেলবাড়িয়ার মানুষকে উত্তেজিত করে তুলল। তারা তিতুমীরের সাথে এসে যোগ দিলেন এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের শপথ নিলেন। জমিদারের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সবাই জোট বাঁধলেন। তিতুমীর গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে গঠন করলেন মুক্তিবাহিনী। দেখতে দেখতে তাঁর বাহিনীতে পাঁচ হাজার মুজাহিদ এসে জড়ো হলেন। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করলেন। তিতুমীর তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করলেন। ১৮৩১ সালে তিনি বারসাতের কাছে নারকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করলেন। তারপর তিনি হিন্দুস্তান থেকে ইংরেজ রাজত্ব খতম করার ঘোষণা দিলেন। তিনি মুজাহিদদের উদ্দেশে বললেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাততাড়ি গুটাতে হবে। এ দেশ আমাদের। আমরাই এ দেশ শাসন করব। জমিদাররা আর কোম্পানিকে খাজনা দিতে পারবে না। খাজনা দিতে হবে জনগণের সরকারকে।’
তিতুমীরের এ ঘোষণা ত্বরিত গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জনগণ জমিদারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করল। ফলে এ বছর ছয় নভেম্বর কৃষ্ণদেবের সাথে তিতুমীরের বাহিনীর যুদ্ধ বাধল। হেরে গেল কৃষ্ণদেব। তারপর গোবরডাঙ্গার জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখোপধ্যায়, তারাগোনিয়ার জমিদার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গোরিপ্রসাদ চৌধুরী, গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রাইরা তিতুমীরের বিদ্রোহে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা সফলকাম হলো না। মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ছিলেন ডেভিস নামে এক ইংরেজ। অন্যান্য হিন্দু জমিদারের সহায়তা নিয়ে সে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করল। ডেভিসের নেতৃত্বে তিতুমীরের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হলো। কিন্তু ডেভিস পরাজিত হয়ে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদারের কাছে আশ্রয় নিলো। এই জমিদারও তিতুমীরের সাথে লড়াই করল। তবে তার দল পরাজত হলো এবং জমিদার নিহত হলো।
তারপরও তিতুমীরের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বেনিয়া ইংরেজ ও এ দেশীয় জমিদারের লড়াই থামল না। তারা তিতুমীরের আন্দোলন নির্মূল করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করল। আলেকজান্ডার নামক এক হাবিলদারের নেতৃত্বে নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ চালানো হলো। কিন্তু তিতুর সৈনিকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে আলেকজান্ডার পালিয়ে কোন রকমে জান বাঁচাল। এ নিদারুণ পরাজয়ে ইংরেজদের টনক নড়ল। এ হারের মধ্যে তারা রাজত্বের আশু পতনের ইঙ্গিত দেখতে পেল। ফলে তারা এর একটা বিহিত করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। তিতুমীরকে যেভাবেই হোক হারাতে হবে, এই প্রত্যয় নিয়ে ইংরেজরা পরিকল্পনা আঁটল। ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমীরের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসল। আশপাশের জমিদারগণ ইংরেজদের সাথে এসে গাঁটছড়া বাঁধল। ফলে একটা ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বাকি অংশ নিচে........
(এই লেখাটি “titumir media”এর জন্য উৎসর্গিত)
ইবন আদম
পাক-ভারত উপমহাদেশে মুসলমানদের কাছে অতি প্রিয় নাম তিতুমীর। স্বাধীনচেতা পালোয়ান তিতুকে অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসকরা অসম্ভব ভয় পেত। ব্রিটিশের স্থানীয় জমিদাররা তাঁর নাম শুনে হতো আতঙ্কিত। ব্রিটিশ বেনিয়ার নাগপাশ থেকে এ দেশের অসহায় মানুষকে মুক্তির জন্য তিনি আপসহীন সংগ্রাম করেছেন। সাহসী তিতুমীর ইসলামের ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার সাধন এবং শিরক-বিদয়াত থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই করেছেন। তিতুমীরের এ লড়াই পাক-ভারত মুসলিম ইতিহাসের এক অনন্য বীরত্বগাথা এবং এক গৌরবময় অধ্যায়। মুসলিম মানসপটে শিহরণসঞ্চারী এক স্বাপ্নিক পুরুষ ছিলেন তিতুমীর। তাঁর অসীম সাহস ও ক্ষিপ্রতা আমাদের হৃদয়াবেগ প্রাণিত করে। নারকেলবাড়িয়ায় তাঁর ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা ইতিহাসের পাতায় এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। মহান শহীদ তিতুমীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরণ সংগ্রাম করেছেন, কিন্তু কোন আপস করেননি।
একাদশ শতকে এক ক্রান্তিকাল চলছে। পাক-ভারত মুসলিম সমাজের তখন ঘোর দুর্দিন। নীলচাষে রাজি না হলে নীল কুঠিয়ালদের চাবুকের আঘাতে গরিব চাষিরা জর্জরিত হতেন। ব্রিটিশ বেনিয়ার তল্পিবাহক হিন্দু জমিদারগণ খাজনা আদায়ের নামে কৃষকের গরু-ছাগল কেড়ে নিতো। বর্ণবাদী হিন্দুদের অমানবিক আচরণ সহ্যের সীমা অতিক্রম করল। হিন্দুরা মুসলমানদের বোন্দা, গেন্দা, বুটা, চান্দি, গেন্দি, পেন্দি ইত্যাদি উপহাসমূলক নামে ডাকত। কেউ ইচ্ছে করলেই মুসলমানি নাম রাখতে পারত না। এ জন্য জমিদারকে ‘খারিজানা’ খাজনা পঞ্চাশ টাকা দিতে হতো। কেউ দাড়ি রাখতে চায় তো, তাকে খাজনা হিসেবে আড়াই টাকা গুনতে হতো। গোঁফ ছাঁটতে দিতে হতো পাঁচসিকা। এখানকার মুসলমানরা মসজিদ বানাতে চাইলে তা স্বাধীনভাবে করা যেত না। জমিদারকে নজরানা না দিয়ে কারো মসজিদ বানানোর সাহস ছিল না। জমিদার প্রত্যেক কাঁচা মসজিদের জন্য পাঁচ টাকা, আর পাকা মসজিদের জন্য এক হাজার টাকা নজরানা নিত। এমনকি কারো সন্তান হলে এর জন্য জমিদারকে কর দিতে হতো। জমিদারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মুসলমানদের ভাগ্য নির্ভর করত। জমিদার ইচ্ছা করলেই কাউকে তার বাড়িতে বিনা পয়সায় গতর খাটাত। অত্যাচারের এখানেই শেষ নয়। জমিদারের হুকুমের নড়চড় হয়েছে তো, আর রক্ষে ছিল না। চাবুকের আঘাতে প্রজার রক্ত ঝরত। জমিদারের অত্যাচারে প্রজাকে পশুর মতো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে হতো। কখনও বা জমিদার প্রজার বাড়ি নিলামে উঠাত।
বাংলার গরিব কৃষক ও মুসলমানদের এই দুর্দিনে চব্বিশ পরগনায় জন্ম নেন শিশু তিতুমীর। তাঁর প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। ১১৮২ সালের ১৪ মাঘ বসিরহাটের চাঁদপুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়। তিতুমীরের পিতার নাম মীর হাসান আলী এবং মাতার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তাঁর পরিবার ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা)-এর বংশ তালিকার সাথে যুক্ত বলে জানা যায়। তিতুমীরের পূর্বপুরুষ সাইয়েদ শাদাত আলী আরব থেকে বাংলায় এসে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। লেখাপড়ার প্রতি তিতুমীরের প্রচ- ঝোঁক ছিল। গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে তিতু এক মাদরাসায় ভর্তি হন। আঠারো বছর বয়সে তিতুমীর ‘কুরআনে হাফেজ’ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। একই সাথে তিনি হাদিসশাস্ত্রে পা-িত্য লাভ করেন। এই সময়ে তিতুমীর আরবি, বাংলা, ফারসি ও অঙ্কশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।
বাংলার গরিব কৃষকের ওপর তখন নীল কুঠিয়ালদের ভয়ানক অত্যাচার ও শোষণ চলছিল। এসব দেখে তিতুমীর মর্মাহত হতেন। ব্রিটিশ শাসকের বৈষম্যনীতি এবং বর্ণ হিন্দুদের ঘৃণ্য মনোভাব তাঁর মনকে বিষিয়ে তুলল। এতে তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। তাই এসব অত্যাচারের প্রতিকারের জন্য তিতুমীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলেন। এ জন্য তিনি নিজেকে শারীরিকভাবে সামর্থ্যবান করার মনস্থ করলেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ওস্তাদ হাফিজ নেয়ামত উল্লাহর কাছে শরীরর্চ্চা শুরু করেন। নিবিড় একাগ্রতা ও একনিষ্ঠার কারণে অল্পদিনেই তিতুমীর কুস্তি লাঠিখেলা, তলোয়ার ও ঢাল-সড়কির খেলায় পারঙ্গম হয়ে ওঠেন। এরই মধ্যে তিনি ঘরসংসার করলেন। বিয়ের চৌদ্দ দিন পর বাবা হাসান আলী মারা গেলেন। এতে তিনি মর্মপীড়া পেলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর মানসিক দৃঢ়তায় ছেদ পড়েনি। এ সময় তিনি কলকাতায় চলে আসেন।
১৮২২ সালের কথা। তিতুমীরের বয়স তখন ঊনচল্লিশের কোঠায়। এ বছর হজব্রত পালনের জন্য তিনি মক্কায় গমন করেন। সেখানে তাঁর সাথে আরেক বিল্পবী নেতার সাক্ষাৎ ঘটল। নাম সৈয়দ আহমদ। বেরেলির এই বীরও ভারতের মাটি থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের তাড়াতে সংগ্রাম করছিলেন। তিতুমীর সৈয়দ আহমদের স্পর্শে এসে বিল্পবী চিন্তাধারায় উজ্জীবিত হন। ১৮২৭ সালে তিনি যথারীতি দেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি আর বসে থাকলেন না। শুরু হলো কাক্সিক্ষত আন্দোলনের প্রস্তুতি। সমাজ থেকে শিরক ও বিদয়াত দূর করা এবং মুসলমানদের এর কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করা ছিল তিতুমীরের প্রাথমিক কাজ। পাশাপাশি অত্যাচারিত অসহায় কৃষকদের জমিদারের শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করা ছিল তাঁর অন্যতম বড় কাজ। দেখতে দেখতে তিতুমীরের আন্দোলনে জোয়ার এলো। সমাজের অনেক মানুষ তাঁর কথায় আকৃষ্ট হলো। ফলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা নড়েচড়ে উঠল। জমিদাররা খাজনা ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তাঁর ওপর প্রচ- রেগে গেল। শিরকপন্থী ভ- পীরগণ তাদের স্বার্থের ব্যাঘাত দেখতে পেয়ে ক্ষিপ্ত হলো। আর সুদখোর অত্যাচারী মহাজনরা অর্থ লুটার সুযোগ হারাবার ভয়ে দারুণ ক্ষেপে গেল। ফলে তিতুমীরের বিপক্ষে সবাই একাট্টা হলো। তখনকার জমিদার ছিল কৃষ্ণদেব। তিতুমীর এই অত্যাচারী ও শোষক জমিদারকে সতর্ক করার জন্য চিঠি দিলেন। চিঠি পেয়ে কৃষ্ণদেব ক্ষিপ্ত হলো এবং চিঠির বাহক আমিন উল্লাহকে অত্যাচারে জর্জরিত করল। এতে আমিন উল্লাহ শাহাদাতবরণ করলেন।
আমিন উল্লাহর মৃত্যুর ঘটনা চব্বিশ পরগনার নারকেলবাড়িয়ার মানুষকে উত্তেজিত করে তুলল। তারা তিতুমীরের সাথে এসে যোগ দিলেন এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের শপথ নিলেন। জমিদারের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে সবাই জোট বাঁধলেন। তিতুমীর গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে গঠন করলেন মুক্তিবাহিনী। দেখতে দেখতে তাঁর বাহিনীতে পাঁচ হাজার মুজাহিদ এসে জড়ো হলেন। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করলেন। তিতুমীর তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রস্তুত করলেন। ১৮৩১ সালে তিনি বারসাতের কাছে নারকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা তৈরি করলেন। তারপর তিনি হিন্দুস্তান থেকে ইংরেজ রাজত্ব খতম করার ঘোষণা দিলেন। তিনি মুজাহিদদের উদ্দেশে বললেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাততাড়ি গুটাতে হবে। এ দেশ আমাদের। আমরাই এ দেশ শাসন করব। জমিদাররা আর কোম্পানিকে খাজনা দিতে পারবে না। খাজনা দিতে হবে জনগণের সরকারকে।’
তিতুমীরের এ ঘোষণা ত্বরিত গতিতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জনগণ জমিদারকে খাজনা দিতে অস্বীকার করল। ফলে এ বছর ছয় নভেম্বর কৃষ্ণদেবের সাথে তিতুমীরের বাহিনীর যুদ্ধ বাধল। হেরে গেল কৃষ্ণদেব। তারপর গোবরডাঙ্গার জমিদার কালিপ্রসন্ন মুখোপধ্যায়, তারাগোনিয়ার জমিদার রাজনারায়ণ, নাগপুরের গোরিপ্রসাদ চৌধুরী, গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদার দেবনাথ রাইরা তিতুমীরের বিদ্রোহে বাধা দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু তারা সফলকাম হলো না। মোল্লাহাটির নীলকুঠির ম্যানেজার ছিলেন ডেভিস নামে এক ইংরেজ। অন্যান্য হিন্দু জমিদারের সহায়তা নিয়ে সে তিতুমীরকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করল। ডেভিসের নেতৃত্বে তিতুমীরের বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা হলো। কিন্তু ডেভিস পরাজিত হয়ে গোবরা-গোবিন্দপুরের জমিদারের কাছে আশ্রয় নিলো। এই জমিদারও তিতুমীরের সাথে লড়াই করল। তবে তার দল পরাজত হলো এবং জমিদার নিহত হলো।
তারপরও তিতুমীরের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ বেনিয়া ইংরেজ ও এ দেশীয় জমিদারের লড়াই থামল না। তারা তিতুমীরের আন্দোলন নির্মূল করতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করল। আলেকজান্ডার নামক এক হাবিলদারের নেতৃত্বে নারকেলবাড়িয়ায় আক্রমণ চালানো হলো। কিন্তু তিতুর সৈনিকদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে আলেকজান্ডার পালিয়ে কোন রকমে জান বাঁচাল। এ নিদারুণ পরাজয়ে ইংরেজদের টনক নড়ল। এ হারের মধ্যে তারা রাজত্বের আশু পতনের ইঙ্গিত দেখতে পেল। ফলে তারা এর একটা বিহিত করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলো। তিতুমীরকে যেভাবেই হোক হারাতে হবে, এই প্রত্যয় নিয়ে ইংরেজরা পরিকল্পনা আঁটল। ইংরেজ গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক তিতুমীরের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসল। আশপাশের জমিদারগণ ইংরেজদের সাথে এসে গাঁটছড়া বাঁধল। ফলে একটা ভয়ঙ্কর লড়াইয়ের আভাস স্পষ্ট হয়ে উঠল।
বাকি অংশ নিচে........
Comment