আল-আন্দালুস: আমাদের হারানো স্বর্গ
*** আন্দালুস। নামটার মধ্যেই কেমন যেন আপন আপন ভাব আছে। সাথে সাথে কেমন যেন বিরহ বিরহ ভাবও আছে। সবই হয়তো মনের কল্পনা। তবুও মনের কল্পনা তো ভালোবাসা থেকেই তৈরী হয়।
.
মূল পর্বে যাওয়ার আগে, সামান্য একটু ভূমিকা:
= আল্লাহ তা‘আলার রীতিনীতিতে কোনও পরিবর্তন নেই। আমাদের প্রয়োজনেই, এই রীতিনীতিগুলো জানা জরুরী। তাহলে জীবনটা সহজ হয়ে যায়, সুন্দর হয়ে ওঠে।
.
আল্লাহ তা‘আলার স্বীকৃত নীতি হলো, একশ ডিগ্রী গরম হলে পানি টগবগ করে ফুটতে থাকবে। এই নীতি কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এর কমবেশ হবে না। যদি এমন হতো, আজ ত্রিশ ডিগ্রীতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। কাল চল্লিশ ডিগ্রী। পরশু পঞ্চাশ ডিগ্রী
তাহলে জীবনটা কেমন হতো? টিকে থাকাই দায় হয়ে যেতো।
.
আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো। কেয়ামম পর্যন্ত আগুন এই ধর্মের ওপরই বহাল থাকবে। এর ব্যত্যয় ঘটবে না। ব্যতিক্রম হবে না। এটাই চিরাচরিত বিধান। ইব্রাহীম (আ.) আগুনে পোড়েন নি, সেটা মু’জিযা। একজন মুমিন মু’জিযার তালাশে থাকবে না,বস্তুর স্বাভাবিক যা ধর্ম সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।
.
খাবার ছাড়া কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে না। কোনও মানুষ যদি খাবার ছাড়া কয়েক দিন থাকে, সে মারা যাবে এটাই আল্লাহর বিধান।
.
বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান হলো, একটি জাতি একসময় সবল থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকবে। আবার দুর্বলতা থেকে আস্তে আস্তে সবলতার দিকে যাবে। এটা মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
.
ইতিহাসের আশ্চর্যজনক একটা বিষয় হলো, অদ্ভুতভাবেই সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সে হিশেবে বলা যায়, আমরা যখন অতীতের কোনও ইতিহাস পড়ি, প্রকৃতপক্ষে সেটা শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও ইতিহাস। কারণ অতীতে যা ঘটেছে, মোটা দাগে সেটা ভবিষ্যতেও ঘটবে।
.
একজন মুমিন কিভাবে ইতিহাস পাঠ করবে?
= তার ইতিহাস পাঠের ধরন হবে, অতীতের ভাল মানুষেরা কিভাবে কাজ করেছেন, কোন পথে হেঁটেছেন, সেটা যাচাই করা। সে অনুযায়ী নিজে চলার পাথেয় সংগ্রহ করা।
.
আন্দালুসের ইতিহাসটাও আমাদের জন্যে এক জীবন্ত শিক্ষা। এর ইতিহাসে আল্লাহর বিধান এতটা স্পষ্ট হয়ে আছে, অন্য কোনও ইতিহাসে এতটা নেই। উত্থান-শিখর আরোহণ-পতন।
= তবে আমি শেষ পর্যায়কে পতন বলতে চাই না। বলতে চাই পুনরুত্থানের প্রস্তুতি ও প্রেরণা ও শিক্ষাগ্রহণ পর্ব।
.
আন্দালুসের ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় আছে। অন্য জাতিগুলোর ইতিহাসে উত্থান-শিখরছোঁয়া-পতনপর্বটা একবারই ঘটে। কিন্তু আন্দালুসে এই পর্বটা বেশ কয়েক বার ঘটেছে। এই বিষয়টা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বেশ কয়েক বার সতর্ক করেছেন। সহজে তিনি আমাদের থেকে এই ‘আলফিরদাওসুল মাফকুদ’ (হারানো স্বর্গ) ছিনিয়ে নিতে চান নি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, এই স্বর্গ আমাদের হাতেই থেকে যাক, কিন্তু আমরা তার এই নেয়ামতের কদর করতে পারিনি।
.
.
আমরা কেন আন্দালুসকে পড়বো?
------------
আন্দালুসের ইতিহাস আটশ বছরের। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, হিজরী সন হিশেবে আটশত পাঁচ বছরের। ৯২-৮৯৭ হিজরী। আর ঈসায়ী সন হিসাবে ৭৮১ বছর হয়। ৭১১-১৪৯২।
এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে কিছু অংশ আছে, অনালোচিত, কিছু অংশ আছে বহুল আলোচিত। কিছু অংশের ওপর ধূলোর আস্তর জমেছে। কিছু অংশকে কুচক্রীরা বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। তারা কিছু সত্যকে মিথ্যার মতো করে পরিবেশন করেছে আর কিছু মিথ্যা কে সত্যের প্রলেপ দিয়ে আমাদেরকে গিলিয়েছে। এটা অত্যন্ত ভয়ংকর একটা কাজ। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া। ধুলো-ময়লা সরিয়ে আসল সত্যকে বের করে আনা।
.
আন্দালুসের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায়, অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অফুরন্ত গল্প তৈরী হয়েছে। অগুনতি বাঁক সৃষ্টি হয়েছে। বেশুমার গাঁথার জন্ম হয়েছে। অনেক মুজাহিদের জন্ম হয়েছে। অনেক ভীরু-কাপুরষও আত্মপ্রকাশ করেছে। অনেক মুত্তাকী-পরহেযগারের উন্মেষ ঘটেছে। অনেক শরীয়তবিরোধী নাস্তিক ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। অনেক দ্বীনের রক্ষক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য বিশ্বাসঘাতক ফনা তুলেছে। এজন্য আমাদেরকে আন্দালুস জানা দরকার।
.
.
আন্দালুসের যা না জানলেই নয়
------------
আমাদের জানা দরকার ‘বারবাত প্রান্তরের’ ঘটনা। এটা এমন ঘটনা, গুরুত্বের দিক থেকে ইসলামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত যুদ্ধগুলোর একটি হওয়ার মর্যাদা রাখে। এই বারবাত কোনও অংশে ইয়ারমুক-কাদেসিয়া থেকে কম নয়। এই বারবাতের মাধ্যমে শুধু আন্দালুস নয়, বিশ্ব ইতিহাসের বিরাট একটা অর্জনকে মুসলমানরা জয় করেছে।
= কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের কাছে এই বারবাত উপত্যকা বিস্মৃত। বিলুপ্ত। বিযুক্ত।
.
আমাদের জানা দরকার ‘জাহাজ পোড়ানো’র ঘটনা। তারিক বিন যিয়াদ (রহ.) আসলেই কি জাহাজ পুড়িয়েছিলেন? পোড়ালে কেন পুড়িয়েছিলেন? পাশ্চাত্যের সমালোচকদের কাছে এই ঘটনা এত প্রিয় কেন?
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান দাখিল (রহ.) কে ছিলেন? ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, আবদুর রহমান দাখিল না হলে, আন্দালুসে ইসলাম অনেক আগেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান নাসের কে ছিলেন? তিনি তো ছিলেন মধ্যযুগে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাদশাহ। আমাদের জানা আবশ্যক, তিনি কিভাবে এত উঁচু স্তরে আরোহণ করতে পারলেন। কিভাবে তিনি তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
.
আমাদের জানা দরকার, ইউসুফ বিন তাশাফীন কে ছিলেন? তিনি কেমন সেনাপতি ছিলেন, কেমন খোদাভীরু ছিলেন। কতটা শরীয়তের পাবন্দ ছিলেন। তিনি সুদূর আফ্রিকার গহীনতম কোনে থেকেও, এমন অসাধারণভাবে বেড়ে উঠেছিলেন? এই কালো মানিকের মনে জিহাদের প্রতি এমন প্রবল ভালোবাসা-ই-বা কিভাবে তৈরী হলো?
.
আমাদের জানা দরকার অবিস্মরণীয় ‘যাল্লাকাহ’ প্রান্তরের লড়াইয়ের কথা। এই লড়াইয়ে হেরে গেলে মুসলমানদেরকে আরও কয়েক শত বছর আগেই আন্দালুস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবু বকর উমার লামতুনীর কথা। এই মহান মুজাহিদের হাত ধরে আফ্রিকার পনেরটারও বেশি দেশ ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল।
.
আমাদের জানা দরকার আবু ইউসুফ ইয়াকুব মানসুরকে। যিনি চির অম্লান ‘আরাক’ যুদ্ধের মূল নায়ক। মুসলমানদেরকে অতুলনীয় বিজয় এনে দেয়া বীর। খ্রিস্টানদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া সিপাহসালার।
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুরাবিতীনদের কথা। তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের কথা। কিভাবে সেটা শূন্য থেকে পুণ্যতে পৌঁছল?
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুয়াহহিদীনদের কথা। তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘দাওলাহ’র কথা।
.
আমাদের জানা দরকার মসজিদে কুরতুবার কথা। যেটাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিশেবে বিবেচনা করা হতো। কিভাবে মুসলমানদের এই মহান নিদর্শনকে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হলো?
.
আমাদের জানা দরকার ইসাবেলিয়ার অনুপম মসজিদটির কথা।
.
আমাদের জানা থাকা দরকার কুরতুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। পুরো বিশ্ব থেকে ভেঙে পড়া জ্ঞানার্থীদের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার উমাইয়া পাঠাগারের কথা। এতবড় পাঠাগার কিভাবে গড়ে উঠলো?
.
আমাদের জানা দরকার যাহরা প্রাসাদের কথা। জানা দরকার যাহরা শহরের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার হামরা প্রাসাদের কথা। তার অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কথা।
.
পাশাপাশি জানা দরকার ‘ইকাব’ যুদ্ধের কথা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা-শক্তি বেশি থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হয়েছিল। যেন হুনাইনের খন্ডচিত্র ক্ষণিকের জন্যে ফিরে এসেছিল। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন:
-ইকাব যুদ্ধের পর আন্দালুসে যুদ্ধ করতে সক্ষম কোনও যুবকের দেখা মিলত না। এতটা বিপর্যয় ঘটেছিল।
.
আমাদের জানা আবশ্যক কিভাবে আন্দালুসের পতন হয়েছিল। পতনের কারণগুলো কী কী?
.
এটাও জানা দরকার, আন্দালুসে ইসলামের সূর্য ডোবার পর কোথায় উদিত হয়েছিল? জানা দরকার আন্দালুসে সেই অপসৃত সূর্য একই সময়ে কিভাবে ‘কনস্টান্টিনোপল’ বিজয়ের মধ্য দিয়ে উসমানি খিলাফতে উদিত হয়েছিল?
.
আমাদের জানা দরকার ‘ভ্যালেনসিয়া’ শহরের সেই রোমহর্ষক গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই ষাট হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘উব্বাযাহ’ হত্যকান্ডের কথা। যেখানে ভ্যালেনসিয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। একদিনেই ষাট হাজার নিরীহ মুসলমানকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘বারবুশতার’ গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই চল্লিশ হাজার বনী আদমকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। কিভাবে সাত হাজার মুসলিম কুমারীকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
= ইতিহাস একই ভাবে আবার ফিরে আসে। আমাদের জানা দরকার কিভাবে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো?
.
আমরা যদি এসব ইতিহাস জানি, মুসলমানদের কোমরভাঙ্গা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও জানি, তাহলে আজ, বর্তমানেও কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, সেটা জেনে যাব।
.
আমরা চেষ্টা করবো, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখতে। রাব্বে কারীম আমাদেরকে তাওফীক দান করলে কিছুই অসম্ভব নয়। ইনশাআল্লাহ।
(collected)
(প্রথম পর্ব)
*** আন্দালুস। নামটার মধ্যেই কেমন যেন আপন আপন ভাব আছে। সাথে সাথে কেমন যেন বিরহ বিরহ ভাবও আছে। সবই হয়তো মনের কল্পনা। তবুও মনের কল্পনা তো ভালোবাসা থেকেই তৈরী হয়।
.
মূল পর্বে যাওয়ার আগে, সামান্য একটু ভূমিকা:
= আল্লাহ তা‘আলার রীতিনীতিতে কোনও পরিবর্তন নেই। আমাদের প্রয়োজনেই, এই রীতিনীতিগুলো জানা জরুরী। তাহলে জীবনটা সহজ হয়ে যায়, সুন্দর হয়ে ওঠে।
.
আল্লাহ তা‘আলার স্বীকৃত নীতি হলো, একশ ডিগ্রী গরম হলে পানি টগবগ করে ফুটতে থাকবে। এই নীতি কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে। এর কমবেশ হবে না। যদি এমন হতো, আজ ত্রিশ ডিগ্রীতে পানি ফুটতে শুরু করেছে। কাল চল্লিশ ডিগ্রী। পরশু পঞ্চাশ ডিগ্রী
তাহলে জীবনটা কেমন হতো? টিকে থাকাই দায় হয়ে যেতো।
.
আগুনের ধর্ম হলো পোড়ানো। কেয়ামম পর্যন্ত আগুন এই ধর্মের ওপরই বহাল থাকবে। এর ব্যত্যয় ঘটবে না। ব্যতিক্রম হবে না। এটাই চিরাচরিত বিধান। ইব্রাহীম (আ.) আগুনে পোড়েন নি, সেটা মু’জিযা। একজন মুমিন মু’জিযার তালাশে থাকবে না,বস্তুর স্বাভাবিক যা ধর্ম সেটা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।
.
খাবার ছাড়া কোনও প্রাণী বাঁচতে পারে না। কোনও মানুষ যদি খাবার ছাড়া কয়েক দিন থাকে, সে মারা যাবে এটাই আল্লাহর বিধান।
.
বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও আল্লাহর বিধান হলো, একটি জাতি একসময় সবল থাকবে, তারপর আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকবে। আবার দুর্বলতা থেকে আস্তে আস্তে সবলতার দিকে যাবে। এটা মুসলিম-অমুসলিম সবার ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
.
ইতিহাসের আশ্চর্যজনক একটা বিষয় হলো, অদ্ভুতভাবেই সেটার পুনরাবৃত্তি ঘটে। সে হিশেবে বলা যায়, আমরা যখন অতীতের কোনও ইতিহাস পড়ি, প্রকৃতপক্ষে সেটা শুধু অতীত নয়, ভবিষ্যতেরও ইতিহাস। কারণ অতীতে যা ঘটেছে, মোটা দাগে সেটা ভবিষ্যতেও ঘটবে।
.
একজন মুমিন কিভাবে ইতিহাস পাঠ করবে?
= তার ইতিহাস পাঠের ধরন হবে, অতীতের ভাল মানুষেরা কিভাবে কাজ করেছেন, কোন পথে হেঁটেছেন, সেটা যাচাই করা। সে অনুযায়ী নিজে চলার পাথেয় সংগ্রহ করা।
.
আন্দালুসের ইতিহাসটাও আমাদের জন্যে এক জীবন্ত শিক্ষা। এর ইতিহাসে আল্লাহর বিধান এতটা স্পষ্ট হয়ে আছে, অন্য কোনও ইতিহাসে এতটা নেই। উত্থান-শিখর আরোহণ-পতন।
= তবে আমি শেষ পর্যায়কে পতন বলতে চাই না। বলতে চাই পুনরুত্থানের প্রস্তুতি ও প্রেরণা ও শিক্ষাগ্রহণ পর্ব।
.
আন্দালুসের ক্ষেত্রে একটা ব্যতিক্রমধর্মী বিষয় আছে। অন্য জাতিগুলোর ইতিহাসে উত্থান-শিখরছোঁয়া-পতনপর্বটা একবারই ঘটে। কিন্তু আন্দালুসে এই পর্বটা বেশ কয়েক বার ঘটেছে। এই বিষয়টা নিয়ে আমি প্রায়ই ভাবি, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে বেশ কয়েক বার সতর্ক করেছেন। সহজে তিনি আমাদের থেকে এই ‘আলফিরদাওসুল মাফকুদ’ (হারানো স্বর্গ) ছিনিয়ে নিতে চান নি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন, এই স্বর্গ আমাদের হাতেই থেকে যাক, কিন্তু আমরা তার এই নেয়ামতের কদর করতে পারিনি।
.
.
আমরা কেন আন্দালুসকে পড়বো?
------------
আন্দালুসের ইতিহাস আটশ বছরের। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, হিজরী সন হিশেবে আটশত পাঁচ বছরের। ৯২-৮৯৭ হিজরী। আর ঈসায়ী সন হিসাবে ৭৮১ বছর হয়। ৭১১-১৪৯২।
এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসে কিছু অংশ আছে, অনালোচিত, কিছু অংশ আছে বহুল আলোচিত। কিছু অংশের ওপর ধূলোর আস্তর জমেছে। কিছু অংশকে কুচক্রীরা বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। তারা কিছু সত্যকে মিথ্যার মতো করে পরিবেশন করেছে আর কিছু মিথ্যা কে সত্যের প্রলেপ দিয়ে আমাদেরকে গিলিয়েছে। এটা অত্যন্ত ভয়ংকর একটা কাজ। আমাদের উচিত এর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া। ধুলো-ময়লা সরিয়ে আসল সত্যকে বের করে আনা।
.
আন্দালুসের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায়, অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। অফুরন্ত গল্প তৈরী হয়েছে। অগুনতি বাঁক সৃষ্টি হয়েছে। বেশুমার গাঁথার জন্ম হয়েছে। অনেক মুজাহিদের জন্ম হয়েছে। অনেক ভীরু-কাপুরষও আত্মপ্রকাশ করেছে। অনেক মুত্তাকী-পরহেযগারের উন্মেষ ঘটেছে। অনেক শরীয়তবিরোধী নাস্তিক ব্যঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। অনেক দ্বীনের রক্ষক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য বিশ্বাসঘাতক ফনা তুলেছে। এজন্য আমাদেরকে আন্দালুস জানা দরকার।
.
.
আন্দালুসের যা না জানলেই নয়
------------
আমাদের জানা দরকার ‘বারবাত প্রান্তরের’ ঘটনা। এটা এমন ঘটনা, গুরুত্বের দিক থেকে ইসলামের ইতিহাসে সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রাপ্ত যুদ্ধগুলোর একটি হওয়ার মর্যাদা রাখে। এই বারবাত কোনও অংশে ইয়ারমুক-কাদেসিয়া থেকে কম নয়। এই বারবাতের মাধ্যমে শুধু আন্দালুস নয়, বিশ্ব ইতিহাসের বিরাট একটা অর্জনকে মুসলমানরা জয় করেছে।
= কিন্তু এতদসত্ত্বেও মুসলমানদের কাছে এই বারবাত উপত্যকা বিস্মৃত। বিলুপ্ত। বিযুক্ত।
.
আমাদের জানা দরকার ‘জাহাজ পোড়ানো’র ঘটনা। তারিক বিন যিয়াদ (রহ.) আসলেই কি জাহাজ পুড়িয়েছিলেন? পোড়ালে কেন পুড়িয়েছিলেন? পাশ্চাত্যের সমালোচকদের কাছে এই ঘটনা এত প্রিয় কেন?
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান দাখিল (রহ.) কে ছিলেন? ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, আবদুর রহমান দাখিল না হলে, আন্দালুসে ইসলাম অনেক আগেই সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যেতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবদুর রহমান নাসের কে ছিলেন? তিনি তো ছিলেন মধ্যযুগে ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাদশাহ। আমাদের জানা আবশ্যক, তিনি কিভাবে এত উঁচু স্তরে আরোহণ করতে পারলেন। কিভাবে তিনি তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন।
.
আমাদের জানা দরকার, ইউসুফ বিন তাশাফীন কে ছিলেন? তিনি কেমন সেনাপতি ছিলেন, কেমন খোদাভীরু ছিলেন। কতটা শরীয়তের পাবন্দ ছিলেন। তিনি সুদূর আফ্রিকার গহীনতম কোনে থেকেও, এমন অসাধারণভাবে বেড়ে উঠেছিলেন? এই কালো মানিকের মনে জিহাদের প্রতি এমন প্রবল ভালোবাসা-ই-বা কিভাবে তৈরী হলো?
.
আমাদের জানা দরকার অবিস্মরণীয় ‘যাল্লাকাহ’ প্রান্তরের লড়াইয়ের কথা। এই লড়াইয়ে হেরে গেলে মুসলমানদেরকে আরও কয়েক শত বছর আগেই আন্দালুস থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হতো।
.
আমাদের জানা দরকার আবু বকর উমার লামতুনীর কথা। এই মহান মুজাহিদের হাত ধরে আফ্রিকার পনেরটারও বেশি দেশ ইসলামের ছায়াতলে এসেছিল।
.
আমাদের জানা দরকার আবু ইউসুফ ইয়াকুব মানসুরকে। যিনি চির অম্লান ‘আরাক’ যুদ্ধের মূল নায়ক। মুসলমানদেরকে অতুলনীয় বিজয় এনে দেয়া বীর। খ্রিস্টানদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়া সিপাহসালার।
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুরাবিতীনদের কথা। তাদের ইসলামী রাষ্ট্রের কথা। কিভাবে সেটা শূন্য থেকে পুণ্যতে পৌঁছল?
.
আমাদের জানা আবশ্যক মুয়াহহিদীনদের কথা। তাদের প্রতিষ্ঠিত ‘দাওলাহ’র কথা।
.
আমাদের জানা দরকার মসজিদে কুরতুবার কথা। যেটাকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ হিশেবে বিবেচনা করা হতো। কিভাবে মুসলমানদের এই মহান নিদর্শনকে গীর্জায় রূপান্তরিত করা হলো?
.
আমাদের জানা দরকার ইসাবেলিয়ার অনুপম মসজিদটির কথা।
.
আমাদের জানা থাকা দরকার কুরতুবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। পুরো বিশ্ব থেকে ভেঙে পড়া জ্ঞানার্থীদের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার উমাইয়া পাঠাগারের কথা। এতবড় পাঠাগার কিভাবে গড়ে উঠলো?
.
আমাদের জানা দরকার যাহরা প্রাসাদের কথা। জানা দরকার যাহরা শহরের কথা।
.
আমাদের জানা দরকার হামরা প্রাসাদের কথা। তার অনিন্দ্য সৌন্দর্যের কথা।
.
পাশাপাশি জানা দরকার ‘ইকাব’ যুদ্ধের কথা। এই যুদ্ধে মুসলমানদের সংখ্যা-শক্তি বেশি থাকা সত্ত্বেও পরাজিত হয়েছিল। যেন হুনাইনের খন্ডচিত্র ক্ষণিকের জন্যে ফিরে এসেছিল। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন:
-ইকাব যুদ্ধের পর আন্দালুসে যুদ্ধ করতে সক্ষম কোনও যুবকের দেখা মিলত না। এতটা বিপর্যয় ঘটেছিল।
.
আমাদের জানা আবশ্যক কিভাবে আন্দালুসের পতন হয়েছিল। পতনের কারণগুলো কী কী?
.
এটাও জানা দরকার, আন্দালুসে ইসলামের সূর্য ডোবার পর কোথায় উদিত হয়েছিল? জানা দরকার আন্দালুসে সেই অপসৃত সূর্য একই সময়ে কিভাবে ‘কনস্টান্টিনোপল’ বিজয়ের মধ্য দিয়ে উসমানি খিলাফতে উদিত হয়েছিল?
.
আমাদের জানা দরকার ‘ভ্যালেনসিয়া’ শহরের সেই রোমহর্ষক গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই ষাট হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘উব্বাযাহ’ হত্যকান্ডের কথা। যেখানে ভ্যালেনসিয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। একদিনেই ষাট হাজার নিরীহ মুসলমানকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল।
.
আমাদের জানা দরকার ‘বারবুশতার’ গণহত্যার কথা। যেখানে এক দিনেই চল্লিশ হাজার বনী আদমকে শহীদ করে দেয়া হয়েছিল। কিভাবে সাত হাজার মুসলিম কুমারীকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
= ইতিহাস একই ভাবে আবার ফিরে আসে। আমাদের জানা দরকার কিভাবে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলো?
.
আমরা যদি এসব ইতিহাস জানি, মুসলমানদের কোমরভাঙ্গা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথাও জানি, তাহলে আজ, বর্তমানেও কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হবে, সেটা জেনে যাব।
.
আমরা চেষ্টা করবো, প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখতে। রাব্বে কারীম আমাদেরকে তাওফীক দান করলে কিছুই অসম্ভব নয়। ইনশাআল্লাহ।
(collected)
Comment