আত্মঘাতি ইতিহাস
কোন জাতি ভূমিকম্প, ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা মহামারিতে ধ্বংস হয় না। ধ্বংসের বীজ থাকে তার নিজ ইতিহাসে। আত্মহননের সে বীজ থেকে জন্ম নেয় জনগণের মাঝে আত্মঘাতি ঘৃণা; এবং সে ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও হানাহানি।যতই সে বিষপূর্ণ ইতিহাস পা|ঠ করা হয় ততই বাড়ে জনগণের মাঝে যুদ্ধের নেশা। বাড়ে সত্যচ্যুতি ও ভ্রষ্টতা। এমন আত্মহনন ও পথভ্রষ্টতার ভয়ানক বীজ ছিল ইসলামপূর্ব আরবদের ইতিহাসে। সে ইতিহাসই আরবদের সভ্য ভাবে বেড়ে উঠাকে শত শত বছর যাবত পুরাপুরি অসম্ভব করে রেখেছিল। নানা গোত্রে বিভক্ত আরবগণ নিজ নিজ গোত্রের বীরত্ব গাথা নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখতো। সে কবিতায় থাকতো প্রতিদ্বন্দী গোত্রের বিরুদ্ধে বিষপূর্ণ ঘৃনা। থাকতো নিজেদের নিয়ে মিথ্যা গর্ব। নিয়মিত আসর বসতো সে কবিতা পাঠের। আরব গোত্রগুলির মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আগুণ শত শত বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে কবিতাগুলি পেট্রোলের কাজ দিত। একই রূপ আজ পেট্রোল ঢালছে বাংলাদেশের একাত্তরের ইতিহাস। তাই একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলেও সে যুদ্ধের সহিংস চেতনাটি মারা পড়েনি। বরং সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার মূলে নিয়মিত পানি ঢালা হচ্ছে। প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছেবহু একাত্তরের। এমন দেশের বিনাশে কি বিদেশী শত্রু লাগে?
জাহিলিয়াত যুগের আরবদের শক্তিহীন রাখার জন্য বিদেশী শত্রুর পক্ষ থেকে হামলার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ,তারা নিজেরাই দিনের পর দিন লিপ্ত ছিল আত্মবিনাশে। ইসলামের আগমনে তাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি হয়,আত্মবিনাশের পথ ছেড়ে তারা আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ পায়। পায় পবিত্র কোরআনে প্রদর্শিত জান্নাতের পথ। ফলে কয়েক দশকের মধ্যে তারা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়। ইসলাম তার শ্বাশ্বত সামর্থ্য নিয়ে এখনও বিজয়ের সে পথটি খুলে দিতে সদা প্রস্তুত। ইসলামের পথ মানেই সভ্যতর মানুষ হওয়ার পথ, এবং বিশ্বশক্তি রূপে দ্রুত বেড়ে উঠার পথ। কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের এরূপ মিশন নিয়ে বেড়ে উঠাকে ভয় করে এমন শত্রুরা রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘিরে। বাংলাদেশের জনগণকে ইসলামের পথে চলতে দিতে তারা রাজী নয়। বরং বাঙালী মুসলিমদের আত্মবিনাশেই তাদের বিপুল আনন্দ। আর সে আত্মবিনাশ বাড়াতে তারা একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে মনগড়া মিথ্যা ছড়াচ্ছে। তাদের সৃষ্ট একাত্তরে ঘৃণা এবং সে ঘৃণাসৃষ্ঠ সংঘাতের আগুণকে বাঁচিয়ে রাখতে লাগাতর পেট্রোলও ঢালছে। সেটি তাদের সৃষ্ট তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মিডিয়াকর্মীদের মাধ্যমে।
লক্ষ্য সংঘাতকে জীবিত রাখা
বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে।লেখা হয়েছে অসত্যে ভরপুর অসংখ্য গ্রন্থ,গল্প,উপন্যাস ও নাটক।নির্মিত হয়েছে বহু ছায়াছবি।এখনও সে বিকৃত ইতিহাস রচনার কাজটি জোরে শোরে চলছে।মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে শুধু ইতিহাসের গ্রন্থ নয়,সাহিত্য,শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়াকেও ব্যবহৃত করা হচ্ছে হাতিয়ার রূপে।মিথ্যাচারে যে স্রেফ অপমানই বাড়ে,সম্মান নয় –সে সামান্য সত্যটুকু বুঝার সামর্থ্যও যে এসব বাঙালীদের লোপ পেয়েছে,সেটি বুঝা যায় মিথ্যার পর্বত সমান আয়োজন দেখে। প্রতি দেশেই যুদ্ধ ধ্বংস ও মৃত্যু ডেকে আনে, হিংসাত্মক ঘৃনাও জন্ম নেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও হিংসাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সে ঘৃনার ভিত্তিতে দেশে যুদ্ধাবস্থা বছরের পর বাঁচিয়ে রাখা -কোন সভ্য দেশের কাজ নয়। এমন কাজ যে আত্মঘাতি,এবং সে এজেণ্ডাটি যে শত্রুপক্ষের –সেটুকু বুঝার সামর্থ্যও যে বেঁচে আছে,সে প্রমাণ অতি সামান্য। উপরুন্ত,ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী হিন্দু দেশের পাশে ষোল কোটি মুসলিমের দেশ হওয়ার বিপদটিও বিশাল।বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ জন্য শত্রুর অভাব নেই। কোন দেশে ষোল কোটি মানুষ ইসলাম নিয়ে খাড়া হলে তাদের পাশে মহান আল্লাহতায়ালার ফেরেশতারাও দল বেঁধে হাজির হয়।তখন তারা বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়।সে বিশাল সম্ভাবনাটি তো বাঙালী মুসলিমের। যে আরবগণ ১৪ শত বছর পূর্বে বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল তারা আজকের বাঙালী মুসলিমদের চেয়ে বেশী স্বচ্ছল ছিল না।মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তো মানব সম্পদ।পাট,তূলা,গ্যাস,তেল বা স্বর্ণের উন্নয়নে যতই বিনিয়োগ হোক -সেগুলির মূল্য কতই বা বাড়ানো যায়? সর্বাধিক উন্নয়ন তো আসে তখন,যখন মূল্য সংযোজনটি ঘটে মানব জীবনে।সে উন্নত মানব তখন দ্রুত উচ্চতর সভ্যতা গড়ে তোলে।ইসলামেমূল প্রায়োরিটি তাই মানব উন্নয়ন।সে উন্নত মানব ভাঙ্গে ভাষা,বর্ণ ও গোত্রের নামে গড়া বিভেদের দেয়াল।প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ একতার পথেই গড়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।ইসলামের শত্রুগণ চায় না,বাঙালী মুসলিমগণও সে পথে বেড়ে উঠুক।তাদের ভয় তো বাংলাদেশের বেড়ে উঠা নিয়ে।ফলে তাদের এজেন্ডা শুধু ইসলাম থেকে দূরে সরানো নয়,একতার পথে থেকে হঠানোও।ফলে ইতিহাসে ঢুকানো হয়েছে নাশকতার বিশাল উপকরণ।এ নাশকতাটি বিভক্তির।ইতিহাস চর্চার নামে তাদের লক্ষ্য,একাত্তরের সৃষ্ট ঘৃণাকে শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখা।
যুদ্ধ শেষে সব দেশেই শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৫ কোটির বেশী মানুষ নিহত হয়েছিল। মানব ইতিহাসে এতো বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর কোন কালেই হয়নি।জাপানের দুটি শহরের উপর মার্কিনীরা আনবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে এবং বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী জার্মানের বহু শহরকে প্রায় পুরাপুরি বিধ্বস্ত করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে জাপান ও জার্মানী উভয়ই মার্কিনীদের মিত্রে পরিণত হয়। দাবী করা হয়,জার্মানীরা ৬০ লক্ষ ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে।কিন্তু আজ জার্মানই ইসরাইলের অতি ঘনিষ্ট মিত্র।ইউরোপীয়রা বিভেদের সীমান্ত বিলুপ্ত করে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন গড়েছে।পৃথিবীর অন্যরা এভাবে বিভক্তি ও সংঘাতের পথ ছাড়লেও,বাংলাদেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের তাতে রুচি নাই। বাঙালী মুসলিমগণ চাইলেও প্রতিবেশী ভারত সেটি হতে দিবে না।ভারতীয় এজেন্ডা পালনে তাদের বাংলাদেশী তাঁবেদারগণ যুদ্ধের ৪৪ বছর পরও তাই নির্মূলমুখি।একাত্তরে তাদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা।কিন্তু সেটিই তাদের একমাত্র এজেন্ডা ছিল না।পরবর্তী এজেন্ডাটি হলো,ইসলামপন্থীদের নির্মূল।তাদের ভয়,সেটি না হলে পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান গড়ে উঠবে।সেটি হলে ভারতের বিপদটি আরো ভয়ানক হবে।পাকিস্তানের ওপারে বাংলাদেশের চেয়েও বড় ৭টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত কোন ভারতীয় ভূ-ভাগ নেই।কিন্তু বাংলাদেশের ওপারে আছে।বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানটি ভারতের জন্য এজন্যই এতোটা বিপদজনক।ভারতীয় রাজনীতিতে এতোদিন মূল উপাদানটি ছিল প্রচণ্ড পাকিস্তান ভীতি।সেটি ১৯৪৭ সাল থেকেই।পাকিস্তান ভীতি নিয়েই কাশ্মীরে অবস্থান নিয়েছে ৬ লাখ ভারতীয় সৈন্য।একাত্তরের পর ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ হয়েছে নতুন উপসর্গ।সেটি বাংলাদেশ ভীতি।যেখানেই মুসলিম সেখানেই ভারতের ভয়।বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম তো সে তূলনায় বিশাল। এজন্যই দিল্লির কর্তাব্যক্তিগণ খোলাখুলি বলে,“বাংলাদেশকে আর ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না।” ফলে বাংলাদেশেও চায়,কাশ্মীরের ন্যায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধাবস্থা।তাই একাত্তরের পূর্বে গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব হলেও এখন সেটি অসম্ভব হয়ে পড়ছে।কারণ,ভারতীয় রাডারের নীচে সেটি জুটে না।
একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল।একটি পক্ষ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল।আরেকটি পক্ষ ১৯৪৬ সালের গণভোটে শতকরা ৯৬ ভাগ বাঙালী মুসলিমের পাকিস্তানভূক্তির সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে অখণ্ড পাকিস্তানের সাথে থাকাকেই নিজেদের স্বাধীনতা ভেবেছিল।পাকিস্তান থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার মধ্যে বরং ভারতীয় আধিপত্যের অধীনে চিরকালের গোলামীর ভয় দেখেছিল।একাত্তরে এরূপ দুটি ভিন্ন চেতনা নিয়েই যুদ্ধ হয়েছিল।পাকিস্তানী পক্ষের পরাজয়ের পর এখন আর কেউই বাংলাদেশকে পাকিস্তানভুক্ত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করছে না।কিন্তু যুদ্ধ থামলেও মিথ্যাচার থামেনি।সে মিথ্যাচার ঢুকেছে দেশের ইতিহাসেও।দিন দিন সেটি আরো হিংসাত্মক রূপ নিচ্ছে।পরিকল্পিত এ মিথ্যাচারের লক্ষ্য একটিই। আর তা হলো,দেশ-বিদেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে সত্যকে আড়াল করা।এবং যারা একাত্তরের লড়াইয়ে বিজয়ী,তাদের কৃত অপরাধগুলো লুকিয়ে ফেরেশতাতুল্য রূপে জাহির করা। সে সাথে যারা সেদিন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদেরকে জনগণের শত্রু রূপে চিত্রিত করা। যারা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ অবধি শাসনকালে দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত করলো, একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠালো, ডেকে আনলো ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এবং মানুষকে পাঠালো ডাস্টবিনের পাশে কুকুরের সাথে উচ্ছিষ্ঠ খোঁজের লড়াইয়ে এবং নারীদের বাধ্য করলো মাছধরা জালপড়তে -তাদেরকে আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বলা হচ্ছে বস্তুত সে পরিকল্পনারই অংশ রূপে।
এরূপ মিথ্যাচারের আরেকটি বড় উদ্দেশ্য, একাত্তরে বাংলার মুসলামানদের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী বিভক্তি সৃষ্টি হলো, সেটিকে স্থায়ী রূপ দেয়া। বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্যই পরিকল্পিত ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হচেছ। প্রশ্ন হলো, একাত্তরে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করলো তাদেরকে কি বাংলাদেশের দালাল বলা যায়? তেমনি অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য যারা লড়াই করলো বা প্রাণ দিল তাদেরকেও কি পাকিস্তানের দালাল বলা যায়? অথচ জেনে বুঝে তাদের বিরুদ্ধে “দালাল” শব্দটির ন্যায় ঘৃনাপূর্ণ শব্দের প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে। অথচ ঘৃনা একটি সমাজে বারুদের কাজ করে। সেটি ছড়ানো হলে যে কোন সময়ে সে সমাজে সহজেই বিস্ফোরন শুরু হয়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের অনেকেই বয়সের ভারে দুনিয়া থেকে ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে।তবে মানুষ বিদায় নিলেও ঘৃণা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে চেতনার সংঘাতও। যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে তারা মূলত সে সংঘাতকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশকে অশান্ত ও দুর্বল করা। আর বাংলাদেশ দুর্বল হলে প্রচুর আনন্দ বাড়ে ভারতের। কারণ তারা বাংলাদেশে নিজেদের বাজার চায়। আর বাংলাদেশ দুর্বল হলে সে বাজারটি ধরে রাখাটিও সহজ হয়। একই লক্ষ্যে দালাল বলে তাদের বিরুদ্ধেও তীব্র ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে যাদের জন্ম বাংলাদেশ সৃষ্টির পর; এবং যারা দেশে ইসলামী চেতনার বিজয় চায়। এ নিয়ে বিবাদ নাই, দেশে দেশে যারা ইসলামের বিজয় চায় তারাই একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানে পক্ষ নিয়েছিল। তাই পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও ইসলামপন্থীদের নির্মূল করার বিষয়টি ভারত ও ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টদের এজেন্ডা থেকে বাদ পড়েনি। তাদের কাছে সেটি বাদ পড়ার বিষয়ও নয়। ইসলামের বিজয় ঠ্যাকাতেই ঘৃণা ছড়ানোর এ বিপুল আয়োজন। আর ধ্বংসাত্মক আয়োজনের অগ্রভাগে রয়েছে বাংলাদেশের ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টগণ। এরূপ ঘৃণা ছড়ানোর পিছনে শুরু থেকেই অন্য যে উদ্দেশ্যটি কাজ করেছিল তা হলো, পাকিস্তানপন্থী বাঙালী ও অবাঙালীদের বিরুদ্ধে তাদের কৃত নৃশংস কর্মগুলোকে জায়েজ রূপে গ্রহণযোগ্য করা।
প্রকল্প মিথ্যা রটনায়
একাত্তর নিয়ে মিথ্যা রটনাটি স্রেফ কিছু বই-পুস্তক রচনার মধ্যে সীমিত রাখা হয়নি। একাজটি করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে; এবং সেটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই, পত্র-পত্রিকা, টিভি, সাহিত্য, সিনেমা, নাটকসহ সর্বত্র ছেয়ে আছে এ মিথ্যাচার। অথচ মিথ্যার স্রোতে ভাসাটি কোন সভ্য, রুচিবান ও ন্যায়পরায়ন মানুষের কাজ নয়। অথচ এ জঘন্য পাপের কাজটি করা হচ্ছে ইতিহাস রচনার নামে।ইতিহাসের বইয়ের কাজ মিথ্যা রটনা নয়।ইতিহাস কোন দলের বা পক্ষের নয়;এটি তো জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির নিরপেক্ষ ইতিবৃত্ত।দেশের সরকার সাধারণত একটি দলের। তাদের থাকে দলীয় এজেন্ডাও। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে তাই নিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব; ফলে তাদের দ্বারা ইতিহাস রচনাও অসম্ভব। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস আসলে কোন ইতিহাস নয়, বরং ব্যক্তি বা দলের পক্ষে চাটুকরিতা বা গুণকীর্তন। মিথ্যা ইতিহাস পড়ে অনেকে মিথ্যার ভক্ত ও প্রচারকে পরিণত হয়; কিন্তু বিবেকমান ব্যক্তিগণ সে মিথ্যাকে তারা ত্বরিৎ সনাক্ত করে ফেলে। তারা হতভম্ব হয় মিথ্যার কুৎসিত চেহারাটি দেখে।
মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়লেও সেটি স্বল্প সময়ের জন্য। মিথ্যা ভেদ করে সত্যের প্রকাশও তেমনি অনিবার্য। শর্মিলা বোস তাঁর “Dead Reckoning” বইতে সে সব অবিশ্বাস্য মিথ্যার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন; সে সাথে তুলে ধরেছেন তার নিজের মনের কিছু প্রতিক্রিয়া। জনৈক রশিদ হায়দার সংকলিত এবং বাংলা এ্যাকাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘একাত্তরের স্মৃতি’ নামক বই থেকে ‘বাঘের খাচায় ছয়বার’ নামক নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, “When I first read the title of a Bengali article “Bagher Khanchay Chhoybar” (Six times in the tiger’s cage) in a collection of memoirs of 1971, I thought the author was referring to being in a Pakistani prison six times. Bengali nationalist accounts usually refer to West Pakistani in terms of animals, and most of the accounts are written in flowery language in somewhat melodramatic style. Muhammad Shafiqul Alam Chowdhury, however, was referring to actual tigers. .. Shafiqul Alam Chowdhury claims that he was an organiser of ‘sangram parishad’ in the unions of Saldanga and Pamuli and arranged for military training of youth with rifles taken from Boda police station. …He states that he was arrested, and over the next several days he was beaten during questioning at Thakurgaon cantonment and lost consciousness, and every time he came to sense, he found in a cage of 4 tigers. Alam writes, the tigers did nothing to him – in fact, he claims that a baby tiger slept with its head on his feet regularly! However, he writes that one day the military put fifteen people in the tiger’s cage and the tigers mauled a dozen of the prisoners. He claims the mauled prisoners were then taken out and shot... It beggars belief that the tigers would maul everyone else who was put into the cage but never touch Shafikul Alam –except to sleep on her feet – even though he was put in there on six different occasions. ..It is also not clear why those who were alleged shooting so many other prisoners did not shoot him too.” -(Sharmilla Bose, 2011). অনুবাদঃ “উনিশ শ’ একাত্তরের স্মৃতিকথার উপর প্রকাশিত একটি সংকলন থেকে যখন “বাঘের খাঁচায় ৬ বার” নামক প্রবন্ধটি প্রথম বার পড়লাম তখন ভাবলাম, লেখক বোধ হয় পাকিস্তানের জেলে ৬ বার বন্দি হওয়ার কথা বলেছেন। আমার সেরূপ ধারণা হওয়ার কারণ, বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাধারণত পশু রূপে চিত্রিত করে থাকে। তাদের লেখা অধিকাংশ কাহিনীর ভাষাই অতি আবেগপূর্ণ এবং অলংকারময়। তবে মুহাম্মদ শফিকুল আলম চৌধুরী তার কাহিনীতে আসল বাঘের কথাই বলেছেন।… শফিকুল আলম চৌধুরী র দাবী, তিনি সালদাঙ্গা এবং পামুলী ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিষদের সংগঠক ছিলেন এবং বোদা থানা থেকে ছিনিয়ে নেয়া রাইফেল দিয়ে যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বর্ননা, তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং কয়েকদিন ধরে ঠাকুরগাঁ সেনানীবাসে প্রশ্নোত্তরের সময় তার উপর মারধর করা হয়। এর ফলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর যখনই জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন তখনই দেখেন একটি খাঁচায় ৪টি বাঘের সামনে। তবে জনাব আলম লিখেছেন, বাঘগুলো তাকে কিছুই করেনি, বরং শিশু বাঘটি তার পায়ের উপর মাথা রেখে নিয়মিত ঘুমাতো। এরপর বর্ণনা দিয়েছেন, সৈন্যরা একদিন ১৫ জন বন্দিকে বাঘের খাঁচায় রেখে যায়। বাঘগুলো তাদের মধ্য থেকে প্রায় ডজন খানেককে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। তার দাবী, আহত বন্দিদেরকে সেখান থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। অবিশ্বাস্য রকমের বিস্ময়টি হলো, বাঘগুলো খাঁচায় বন্দি প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে, কিন্তু শফিকুল আলমের পায়ের উপর ঘুমানো ছাড়া তারা তাকে কখনোই স্পর্শ করেনি, যদিও সেখানে তাকে ৬ বারের জন্য রাখা হয়েছিল।.. এটাও রহস্যময় যে, যাদের উপর গুলি করে অন্যান্য বহুবন্দির হত্যার অভিযোগ -তারা কেন তাকে হত্যা করলো না?” শফিকুল আলম চৌধুরী র কাহিনী যে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানায়োট সেটি বুঝবার জন্য কি বেশী লেখাপড়া ও কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন আছে? সূর্যের ন্যায় মিথ্যাও এখানে জ্বল জ্বল করছে। তবে তাজ্জবের বিষয়, এ মিথ্যা কাহিনীর প্রকাশক বটতলার কোন অর্থলোভী দুর্বৃত্ত প্রকাশক নয়, বরং খোদ বাংলা এ্যাকাডেমী -যার মূল দায়িত্ব জনস্বার্থে গবেষণামূলক বইয়ের প্রকাশনা। নিরেট মিথ্যা প্রচারে জনগণের অর্থে পরিচালিত দেশের সর্বোচ্চ এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটিও যে কতটা তৎপর -এ হলো তার প্রমাণ। বাংলা এ্যাকাডেমীর ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠানটির যখন এরূপ অবস্থা, অন্যদের অবস্থা যে কতটা খারাপ হতে পারে সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে? বরং এ প্রমাণ অসংখ্য, একাত্তর নিয়ে মিথ্যা রটনাটি পরিণত হয় এক বিশাল শিল্পে। এবং সে শিল্পের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সে শিল্পের মূল কারিগর হলো সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, প্রশাসক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ।
একাত্তরে সীমাহীন মিথ্যাচার হয়েছে মূলত দুটি লক্ষ্যেঃ এক).যারা প্রকৃত অপরাধি তারা সেটি করেছে নিজেদের অপরাধগুলোকে আড়াল করতে, অথবা সে অপরাধকে জনগণের কাছে জায়েজ করতে। দুই). রাজনৈতিক বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধ পরায়ন করতে। সে বিশাল মিথ্যাচারের মাধ্যমেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাকরিচ্যুৎ ও গৃহচ্যুৎ করা, তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাঠ দখল করা, হ্যাইজাক করে মুক্তিপণ আদায় করা, কারারুদ্ধ করা, তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা, এমন কি হত্যা ও হত্যার পর লাশগুলোকে কবর না দিয়ে নদীর পাড়ে বা ডোবায় পচিয়ে ফেলাও সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এমন বীভৎসতাই ছিল একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও মূল্যবোধ। বৃটিশ শাসনামলে হাজার হাজার মানুষ ঔপনিবেশিক শাসকদের কর্মচারী রূপে স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের উপর অনেক জুলুম করেছে। পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে অনেকে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ দেশবাসীর উপর গুলিও চালিয়েছে। অনেকে বৃটিশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর কি এদের কাউকে সে জন্য দালাল বলা হয়েছে? তাদেরকে কি জেলে ঢুকানো হয়েছে? কারো কি চাকুরি, ঘরবাড়ি ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে? সবাইকে বরং আবার গুরুত্বপূর্ণ পদে একই বিভাগে বসানো হয়েছে। এটি যেমন পাকিস্তানে হয়েছে, তেমনি ভারতেও হয়েছে।
লক্ষ্য গৃহযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্শাল পেত্যাঁ জার্মান নাৎসীদের সহায়তায় ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলে ভিশিতে এক সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁকেও বিজেতা জেনারেল দ্যাগল এ অপরাধে হত্যা করেননি। তার বিচার হয়েছিল। বিচারে তাকে জেল দেয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাদক্ষ হিসাবে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে পরে মুক্তি দেয়া হয়। এবং মৃত্যুর পর তাঁকে বীরের মর্যাদা দেয়া হয়। -(সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ১৯৯৩)। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ফজলুল কাদের চৌধুরী,আব্দুস সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান,নূরুল আমীন, ডাঃ আব্দুল মোত্তালেব মালেক (যিনি ৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন), মাহমুদ আলী (আসাম মুসলিম লীগের সেক্রেটারি) এবং আরো অনেক পাকিস্তানপন্থী নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনে ১৯৪৭-এর পূর্বে ও পরে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অথচ তাদেরকে দালাল ও খুনি বলা হয়েছে। বলা হয়, ফজলুল কাদের চৌধুরী , আব্দুস সবুর খান, খাজা খয়ের উদ্দিন নাকি হুকুম দিয়ে মানুষ খুন করিয়েছেন। বৃদ্ধ ডাঃ আব্দুল মোত্তলেব মালেকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। ইসলামী দলগুলোর অনেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের নারী সরবরাহ করতো। অথচ এ অভিযোগগুলির কোনটিই প্রমাণিত হয়নি। মুজিব আমলে নয়, পরেও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিথ্যার প্রচার থামেনি। আওয়ামী বাকশালী চক্র ও তাদের মিত্ররা আজও এ নিরেট মিথ্যাগুলোকে জোরে শোরে লাগাতর রটনা করে। ইতিহাসের বইয়ে এসব মিথ্যা ঢুকানোর পিছনে কাজ করেছে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সে মিথ্যাচারটি হয়েছে শেখ মুজিব ও তার দলের ইমেজকে বড় করে দেখানোর প্রয়োজনে। মিথ্যাচার হয়েছে ভারতের অপরাধগুলো লুকিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেশটিকে বন্ধু রূপে জাহির করার প্রয়োজনে। এবং সে সাথে বিরোধীদের চরিত্রহরণ ও তাদেরকে হত্যাযোগ্য প্রমাণ করার লক্ষ্যে। যে কোন দেশের রাজনীতিতে ঘৃনা, সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় তো এভাবেই। এমন এক ঘৃণাপূর্ণ পরিবেশে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে ফাঁসির হুকুম বা যাবতজীবন কারাদণ্ড দিবে এবং বিপুল সংখ্যক জনতা সে রায় শুনে মিষ্টি বিতরণ করবে বা উৎসব করবে তাতেই বা সন্দেহ থাকে কি? মিথ্যাচর্চা যখন জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয় তখন সেটি যে জনগণের চরিত্রও মিথ্যায় অভ্যস্থ করবে -তাতেই বা বিস্ময় কি?
নানা প্রেক্ষাপটে প্রতিদেশেই বিভক্তি দেখা দেয়। সে বিভক্তি নিয়ে প্রকাণ্ড রক্তপাতও হয়। নবীজীর (সাঃ) আমলে আরবের মানুষ বিভক্ত হয়েছিল মুসলমান ও কাফের -এ দুটি শিবিরে। কিন্তু সে বিভক্তি বেশি দিন টেকেনি। সে বিভক্তি বিলুপ্ত না হলে মুসলিমগণ কি বিশ্বশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো? জার্মানরা বিভক্ত হয়েছিল নাজি ও নাজিবিরোধী -এ দুই দলে। সে বিভক্তিও বেশীদিন টেকেনি। তা বিলুপ্ত না হলে জার্মানগণ আজ ইউরোপের প্রধানতম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারতো? বিভক্তি দেখা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। সে বিভক্তি এতোটাই প্রবল ছিল যে আব্রাহাম লিংকনের আমলে উত্তর ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মাঝে প্রকাণ্ড গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ তাতে নিহতও হয়েছিল। কিন্তু সে বিভক্তিও বেশী দিন টেকেনি। সেটি বিলুপ্ত না হলে দক্ষিণ আমেরিকার মত উত্তর আমেরিকাতেও উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পেরুর ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু রাষ্ট্রের জন্ম হত। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যেভাবে অপ্রতিদ্বন্দি বিশ্বশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করছে তা কি সম্ভব হত? পারতো কি পৃথিবী জুড়ে প্রভাব সৃষ্টি করতে?
যে পাপ বিভক্তি ও বিদ্রোহে
আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মসম্মান ও বিশাল বিজয় আসে একতার পথ ধরে। বিভক্তির মধ্য দিয়ে আসে আত্মহনন, আত্মগ্লানি ও পরাজয়। বাংলাদেশ আজ সে বিভক্তির পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছে। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে বড় আত্মঘাত আর কি হতে পারে? একতার গুরুত্ব শুধু বিবেকবান মানুষই নয়, পশুপাখিও বোঝে। তাই তারাও দল বেঁধে চলে। একতা গড়া ইসলামে ফরয; এবং বিভক্তি গড়ার প্রতিটি প্রচেষ্টাই হলো হারাম। বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একতার পথে চলা ও না-চলার বিষয়টি ব্যক্তির খেয়াল খুশির উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে অলংঘনীয় নির্দেশ এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন,“ওয়া তাছিমু বিহাব্*লিল্লাহে জামিয়াঁও ওয়ালাতাফাররাকু”।* ***অর্থঃ “এবং তোমরা আল্লাহর রশি (আল্লাহর দ্বীন তথা পবিত্র কোরআন বা ইসলামকে) আঁকড়ে ধর এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়োনা..।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কঠোর আযাব প্রাপ্তির জন্য মুর্তিপুজারি বা কাফের হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সে জন্য বিভক্তির পথে পা বাড়ানোই যথেষ্ট। সে শাস্তির হুশিয়ারিও এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো এবং মতবিরোধ সৃষ্টি করলো। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর আয়াব।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)। তাই কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা কোন জায়েজ কর্ম নয়। ফলে সেটি ঈমানদারের কাজ নয়, সে কাজটি ইসলামের শত্রুদের। মুসলিম ভুমির একতা রক্ষার প্রতি এরূপ কোরআনী ঘোষণা থাকার কারণে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খলিফাদের আমলে অখণ্ড মুসলিম ভূগোল শত শত বছর বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছে। অথচ সে সময়েও বহু সমস্যা ছিল, বহু অনাচারও ছিল। কিন্তু সেসব কারণো বার বার সরকার পরিবর্তন হলেও সে অখণ্ড ভূগোল খণ্ডিত হয়নি। অথচ সে অখণ্ড আরব ভূমি আজ ২২ টুকরোয় বিভক্ত। আরব ভূমিতে বিভক্তির এরূপ অসংখ্য দেয়াল গড়া হয়েছে স্রেফ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের সহযোগী সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট ও ট্রাইবালিস্ট নেতাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এ বিভক্তির লক্ষ্য মুসলিম স্বার্থ বা আরব স্বার্থকে প্রতিরক্ষা দেয়া ছিল না। লক্ষ্যণীয় হলো, এরূপ আত্মঘাতি বিভক্তির সাথে কোন ঈমানদার ব্যক্তি জড়িত ছিলেন না। কারণ ঈমানদার হওয়ার অর্থই তো প্যান-ইসলামীক হওয়া। অথাৎ ভাষা, বর্ণ, ভূগোল ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠা। বিভক্তি শুধু দুর্বলতা ও পরাধীনতাই বাড়ায়। ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে এজন্যই তারা বার বার পরাজিত হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের সীসাঢালা দেয়ালের ন্যায় ঈমানদারদের একতাবদ্ধ হতে বলেছেন। কিসের ভিত্তিতে একতা গড়তে হবে সেটিও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। একতার ভিত্তিটি হলো ইসলাম; ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলভিত্তিক জাতীয়তা নয়। মহান আল্লাহতয়ালার প্রতিটি হুকুমই অলঙ্ঘনীয়। ফলে একতা প্রতিষ্ঠার প্রতিটি প্রয়াসই পবিত্র ইবাদত;তেমনি বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা গড়ার প্রতিটি প্রয়াসই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে হারাম। রাজার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রাণদন্ড হয়। সমগ্র বিশ্বের মহাপ্রভু মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও কি তাই রহমত বয়ে আনে? এরূপ বিদ্রোহ যে শুধু পরকালে জাহান্নামে নেয় –তা নয়। দুনিয়ার বুকেও আযাবের কারণ হয়। জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের অপরাধটি তাই শুধু স্রেফ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল খোদ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধেও। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রমাণ শুধু এ নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের রাজস্বের অর্থে একটি মুসলিম দেশে সুদী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পাবে। বা সে অর্থে বেশ্যাবৃত্তি বা জ্বিনার ন্যায় জঘন্য হারাম কর্মগুলি পুলিশী পাহারাদারি পাবে। বা আইন-আদালত থেকে আল্লাহতায়ালার আইনকে সরিয়ে ব্রিটিশদের রচিত কুফরি ফৌজদারি বিধি (পেনাল কোড) প্রতিষ্ঠা করা হবে। বরং মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ ঘটেছে ভাষা, বর্ণ ও পৃথক ভূগোলের নামে বিভক্তি গড়ায় এবং মুসলিম উম্মাহকে শক্তিহীন করায়।
১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ ভাষা বা বর্ণকে নয়, ইসলামকে আঁকড়ে ধরেছিল। বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, গুজরাটি, বালুচ -এরূপ নানা ভাষার মুসলিমগণ ভাষার বন্ধন ডিঙ্গিয়ে ঈমানী পরিচয় নিয়ে একাতাবদ্ধ হয়েছিল। তারা সেদিন ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিক ভিন্নতার সাথে ভূলে গিয়েছিল ধর্মীয় ফেরকা ও মাযহাবী বিরোধগুলোও। উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে এটি ছিল অতি বিশাল অর্জন। মুসলিম উম্মাহর মাঝে এমন ঈমানী ভাতৃত্ব সেদিন বিশাল পুরস্কার এনেছিল মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। সেটি হলো পাকিস্তান। সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটি গড়তে একটি তীরও ছুড়তে হয়নি। কিন্তু সে প্যান-ইসলামীক ঐক্য ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় হিন্দুদের ভাল লাগেনি। সে ঐক্যের ভিত্তিতে উপমহাদেশের বুকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাক বা দেশটি বেঁচে থাকুক সেটিও তারা চায়নি। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের শত্রু। তারা চাইতো মুসলিমগণ ভারতীয় হিন্দুদের গোলাম রূপে বেঁচে থাকুক, স্বাধীন ভাবে নয়। ইসলামের শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচার তো প্রশ্নই উঠে না। গরু গোশতো ঘরের রাখার মিথ্যা অভিযোগে সেদেশে নির্মম প্রহারে রাজপথে মুসলিমকে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি ভারতীয় পত্রিকাগুলি সে খবর ছেপেছে। গরুর জীবনে যে নিরাপত্তা আছে, ভারতীয় মুসলিমের জীবনে সে নিরাপত্তাটুকুও নেই।
পবিত্র কোরআনে মুসলিমদের পরিচয় পেশ করা হয়ছে হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল রূপে। এমনটি কি কখনো ধারণা করা যায়,মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজ বাহিনীতে অনৈক্য চাইবেন? এবং সেটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, বর্ণ, পতাকা বা ভৌগলিক স্বার্থের নামে? মুসলিম উম্মাহর একতা, শক্তি ও বিজয়ের চেয়ে বিভক্তির এ উপকরণগুলি কি কখনো গুরুত্ব পেতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর বাহিনীতে একতার যে কোন উদ্যোগে যে খুশি হবেন -সেটিই তো স্বাভাবিক। মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তির যে কোন উদ্যোগ তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এমন বিদ্রোহ যে ভয়ানক শাস্তি আনবে সেটিও কি দুর্বোধ্য? ১৯৪৭’য়ে উপমহাদেশের মুসলমানদের একতা মহান আল্লাহতায়ালাকে এতোই খুশি করেছিল যে প্রতিদানে বিশাল রহমত নেমে এসেছিল। মহান আল্লাহতায়ালার সে করুণার কারণেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কোন যুদ্ধ লড়তে হয়নি। অস্ত্র না ধরেই বিশাল শত্রু পক্ষকে সেদিন তারা পরাজিত করতে পেরেছিল। অথচ ইংরেজ ও হিন্দু -সে সময়ের এ দুটি প্রবল প্রতিপক্ষই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার বিরোধীতা করেছে।
শেখ মুজিব ও তার দলীয় নেতাকর্মীগণ দেখেছে শুধু গদিপ্রাপ্তির স্বার্থটি। গদির লোভে মিথ্যা বলা এবং যে কোন শক্তির সাহায্য নিতেও তাদের কোন আপত্তি ছিল না। সেরূপ সাহায্য দিতে প্রতিবেশী ভারতও দু’পায়ে খাড়া ছিল। কারণ, পাকিস্তান ভাঙ্গার মাঝে ভারত তার নিজের বিশাল স্বার্থটি দেখেছিল। শেখ মুজিব ও তার সহচরদের এজেণ্ডায় বাঙালী মুসলিমদের স্বার্থ গুরুত্ব পায়নি। ফলে ভারতের ন্যায় একটি অমুসলিম দেশের অর্থ, অস্ত্র ও উস্কানিতে একটি মুসলিম ভূমিকে তারা বিভক্ত করেছেন। ইসলাম ধর্ম মতে এটি নিরেট পাপকর্ম। ফলে শুধু ভারতের গোলামী নয়, মহান আল্লাহতায়ালার আযাবও ডেকে এনেছেন। পরিণতিতে বাংলাদেশের ন্যায় সুজলা সুফলা একটি উর্বর দেশে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ সে দুর্ভিক্ষে মারা যায়। মুজিবের সে আত্মঘাতি রাজনীতিতে শুধু প্রাণহানি নয়, বাঙালী মুসলিমের চরম ইজ্জতহানিও হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশটি ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়। যে বাঙালী মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরা রাজনৈতিক চিত্রই পাল্টে দিল তাদের এরূপ ইজ্জতহানি বা অপমান কি কম বেদনাদায়ক? এ বিকট অপমান নিয়ে আজ থেকে হাজার বছর পরও কি ইতিহাসের পাতায় তাদের হাজির হতে হবে না? মুজিব ও তার সহচরদের চেতনায় সে ভাবনাটি কি কোন কালেও স্থান পেয়েছে?
অসহ্য ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা
ইসলামের শত্রুপক্ষের কাছে ১৯৪৭’য়ের পরাজয় যেমন কাম্য ছিল না, তেমনি সহনীয়ও ছিল না। তাদের এজেন্ডা তো মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করা। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইন্সটিটিউশন হলো খেলাফত। খেলাফতের মূলে ছিল প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্ব; এবং ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার সীমানা ডিঙ্গিয়ে মুসলিম ঐক্য। সে সাথে লক্ষ্য ছিল বিশ্বশক্তি রূপে মজবুত প্রতিরক্ষা ও আত্মসস্মান নিয়ে বাঁচা। সংঘাতময় এ বিশ্বে যাদের সামরিক শক্তি নাই তাদের কি স্বাধীনতা ও ইজ্জত থাকে? খেলাফতের কারণেই ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, স্পানীশ, পুর্তগীজ ও ইউরোপের নানা ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে সফল হলেও মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার খেলাফতভূক্ত মুসলিম ভূমিতে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। নেকড়ে বাঘ সব সময়ই ছাগল-ভেড়া খোঁজে, বিশাল হাতি নয়। সে খোঁজেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ পাশের ওসমানিয়া খেলাফত ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরের বিচ্ছন্ন বাংলায় গিয়ে পৌঁছে। একারণে শুরু থেকেই তাদের টার্গেট ছিল, খেলাফতের বিনাশ ঘটিয়ে সহজে শিকারযোগ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট নির্মান করা এবং সে রাষ্ট্রগুলির মাঝে ইসরাইলের ন্যায় স্যাটেলাইট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সে সাথে লক্ষ্য ছিল, মুসলিম বিশ্বের বিশাল সম্পদের উপর অবিরাম সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবকাঠামো নির্মাণ। সে লক্ষ্য অর্জনে তারা ১৯২৩ সালে সফল হয়।ফলে জর্দান, কাতার, কুয়েত, দুবাই, বাহরাইনের মত বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড -যা এক সময় উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে জেলার মর্যাদাও রাখতো না -সেগুলিকেও রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এরূপ বিভক্তির কারণেই মুসলিম ভূমির তেল ও গ্যাসের ন্যায় সম্পদ থেকে মুসলিমদের চেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি।
মুসলিম উম্মাহ আজ শক্তিহীন ও প্রতিরক্ষাহীন। জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট বিভক্তিই মুসলিমদের এরূপ পঙ্গুত্ব ও অপমান বাড়িয়েছে। পবিত্র আল আকসা মসজিদসহ বিশাল মুসলিম ভূমি আজ অধিকৃত। আন্তর্জাতিক ফোরামে দেড়শত কোটি মুসলিমের কথা গুরুত্ব পায় না, অথচ গুরুত্ব পায় সাড়ে ৫ কোটি ব্রিটিশ ও ফরাশীদের কথা।মুসলিম উম্মাহর পঙ্গুত্ব বাড়াতেই খেলাফত ভেঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে বিশের বেশী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। খেলাফত বিলুপ্ত হওয়ার সে দুর্দিনেই প্রতিষ্ঠা পায় নানা ভাষাভাষীর মুসলমানদের নিয়ে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। তাদের চোখের সামনে পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে এবং সেটি টিকে থাকবে -সেটি তাদের কাছে অসহ্য ছিল। ফলে পাকিস্তান জন্ম থেকেই ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের টার্গেটে পারিণত হয়। ভারত সে লক্ষ্যে কাজ করছে ১৯৪৭ সাল থেকেই। আরবদেরকে এরাই বিশেরও বেশী টুকরায় বিভক্ত করেছে। নব্যসৃষ্ট এসব দেশগুলির প্রতিটিতে এমন সব স্বৈরাচারী তাঁবেদারকে বসিয়েছে যাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোত্রীয় স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন মহত্তর ভাবনা গুরুত্ব পায় না। তাদের মূল কাজ, সাম্রাজ্যবাদীদের গড়া বিভক্ত ভূগোলকে টিকিয়ে রাখা। বিভক্তির প্রাচীর ভাঙ্গার যে কোন প্রয়াসই তাদের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে প্রাণদণ্ডও দেয়া হয়।
একই কারণে পাকিস্তানের ন্যায় ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশও আজ শত্রুশক্তির টার্গেট। বিশেষ করে ভারতের। ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের ন্যায় আরেক শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে যে তারা মেনে নেবে না,তাদের সে ঘোষণাটিও সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহর দেয়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করুক সেটিও তারা মানতে রাজী নয়। বাঙালী মুসলিমগণ আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হোক ও তাঁর আইনের আপোষহীন অনুসারি হোক এতেও তাদের আপত্তি। ইসলামের এ অতি সনাতন রূপকে তারা ‘মৌলবাদ’ বলে। এজন্যই বাংলাদেশের অখণ্ড ভূগোল যেমন ভারতীয় আগ্রাসনের টার্গেট, তেমনি টার্গেট হলো একতাবদ্ধ মুসলিম জনগণও। যে কারণে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তেমনি আগ্রহ বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও খণ্ডিত রাষ্ট্রে পরিণত করায়। এজন্যই ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর পরই শুরু হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক লুণ্ঠন। তাদের হাতে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া অস্ত্রই শুধু লুট হয়নি। লুট হয়েছে অফিস-আদালত ও কলকারখানার বহু হাজার কোটি টাকার মালামাল। নিজেদের লক্ষ্য পূরণে পাকিস্তান ভাঙ্গাটি তাদের কাছে ছিল প্রথম পর্ব মাত্র, শেষ পর্ব নয়। বাংলাদেশকেও তারা ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর করতে চায়। ভূগোল ভাঙ্গার লক্ষ্যে ভারতীয় সরকার ও পুলিশের সামনে পশ্চিম বাংলার মাটিতে প্রতিপালিত হচ্ছে “স্বাধীন বঙ্গভূমি” প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল এসব প্রাক্তন বৃহত্তর জেলাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক করে এরা স্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র গড়তে চায়। এদের নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার প্রকল্প শুধু সেটিই নয়, একই লক্ষ্যে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের নিজ ভূমিতে বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণও দিয়েছে। ভারতের একাত্তরের ভূমিকার বিশ্লেষণে এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ঘটনাবলিকে সামনে না রাখলে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস রচনার কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
কোন জাতি ভূমিকম্প, ঘুর্নিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা মহামারিতে ধ্বংস হয় না। ধ্বংসের বীজ থাকে তার নিজ ইতিহাসে। আত্মহননের সে বীজ থেকে জন্ম নেয় জনগণের মাঝে আত্মঘাতি ঘৃণা; এবং সে ঘৃণা থেকে জন্ম নেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও হানাহানি।যতই সে বিষপূর্ণ ইতিহাস পা|ঠ করা হয় ততই বাড়ে জনগণের মাঝে যুদ্ধের নেশা। বাড়ে সত্যচ্যুতি ও ভ্রষ্টতা। এমন আত্মহনন ও পথভ্রষ্টতার ভয়ানক বীজ ছিল ইসলামপূর্ব আরবদের ইতিহাসে। সে ইতিহাসই আরবদের সভ্য ভাবে বেড়ে উঠাকে শত শত বছর যাবত পুরাপুরি অসম্ভব করে রেখেছিল। নানা গোত্রে বিভক্ত আরবগণ নিজ নিজ গোত্রের বীরত্ব গাথা নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখতো। সে কবিতায় থাকতো প্রতিদ্বন্দী গোত্রের বিরুদ্ধে বিষপূর্ণ ঘৃনা। থাকতো নিজেদের নিয়ে মিথ্যা গর্ব। নিয়মিত আসর বসতো সে কবিতা পাঠের। আরব গোত্রগুলির মাঝে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের আগুণ শত শত বাঁচিয়ে রাখার জন্য সে কবিতাগুলি পেট্রোলের কাজ দিত। একই রূপ আজ পেট্রোল ঢালছে বাংলাদেশের একাত্তরের ইতিহাস। তাই একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হলেও সে যুদ্ধের সহিংস চেতনাটি মারা পড়েনি। বরং সেটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তার মূলে নিয়মিত পানি ঢালা হচ্ছে। প্রেক্ষাপট তৈরি করা হচ্ছেবহু একাত্তরের। এমন দেশের বিনাশে কি বিদেশী শত্রু লাগে?
জাহিলিয়াত যুগের আরবদের শক্তিহীন রাখার জন্য বিদেশী শত্রুর পক্ষ থেকে হামলার প্রয়োজন পড়েনি। কারণ,তারা নিজেরাই দিনের পর দিন লিপ্ত ছিল আত্মবিনাশে। ইসলামের আগমনে তাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি হয়,আত্মবিনাশের পথ ছেড়ে তারা আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ পায়। পায় পবিত্র কোরআনে প্রদর্শিত জান্নাতের পথ। ফলে কয়েক দশকের মধ্যে তারা বিশ্বের বুকে সবচেয়ে শক্তিশালী বিশ্বশক্তিতে পরিণত হয়। ইসলাম তার শ্বাশ্বত সামর্থ্য নিয়ে এখনও বিজয়ের সে পথটি খুলে দিতে সদা প্রস্তুত। ইসলামের পথ মানেই সভ্যতর মানুষ হওয়ার পথ, এবং বিশ্বশক্তি রূপে দ্রুত বেড়ে উঠার পথ। কিন্তু বাঙালী মুসলিমদের এরূপ মিশন নিয়ে বেড়ে উঠাকে ভয় করে এমন শত্রুরা রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘিরে। বাংলাদেশের জনগণকে ইসলামের পথে চলতে দিতে তারা রাজী নয়। বরং বাঙালী মুসলিমদের আত্মবিনাশেই তাদের বিপুল আনন্দ। আর সে আত্মবিনাশ বাড়াতে তারা একাত্তরের ইতিহাস নিয়ে মনগড়া মিথ্যা ছড়াচ্ছে। তাদের সৃষ্ট একাত্তরে ঘৃণা এবং সে ঘৃণাসৃষ্ঠ সংঘাতের আগুণকে বাঁচিয়ে রাখতে লাগাতর পেট্রোলও ঢালছে। সেটি তাদের সৃষ্ট তাঁবেদার বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও মিডিয়াকর্মীদের মাধ্যমে।
লক্ষ্য সংঘাতকে জীবিত রাখা
বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে প্রচুর মিথ্যাচার হয়েছে।লেখা হয়েছে অসত্যে ভরপুর অসংখ্য গ্রন্থ,গল্প,উপন্যাস ও নাটক।নির্মিত হয়েছে বহু ছায়াছবি।এখনও সে বিকৃত ইতিহাস রচনার কাজটি জোরে শোরে চলছে।মিথ্যাকে বাঁচিয়ে রাখার কাজে শুধু ইতিহাসের গ্রন্থ নয়,সাহিত্য,শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়াকেও ব্যবহৃত করা হচ্ছে হাতিয়ার রূপে।মিথ্যাচারে যে স্রেফ অপমানই বাড়ে,সম্মান নয় –সে সামান্য সত্যটুকু বুঝার সামর্থ্যও যে এসব বাঙালীদের লোপ পেয়েছে,সেটি বুঝা যায় মিথ্যার পর্বত সমান আয়োজন দেখে। প্রতি দেশেই যুদ্ধ ধ্বংস ও মৃত্যু ডেকে আনে, হিংসাত্মক ঘৃনাও জন্ম নেয়। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও হিংসাকে বাঁচিয়ে রাখা এবং সে ঘৃনার ভিত্তিতে দেশে যুদ্ধাবস্থা বছরের পর বাঁচিয়ে রাখা -কোন সভ্য দেশের কাজ নয়। এমন কাজ যে আত্মঘাতি,এবং সে এজেণ্ডাটি যে শত্রুপক্ষের –সেটুকু বুঝার সামর্থ্যও যে বেঁচে আছে,সে প্রমাণ অতি সামান্য। উপরুন্ত,ভারতের ন্যায় একটি আগ্রাসী হিন্দু দেশের পাশে ষোল কোটি মুসলিমের দেশ হওয়ার বিপদটিও বিশাল।বাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে এ জন্য শত্রুর অভাব নেই। কোন দেশে ষোল কোটি মানুষ ইসলাম নিয়ে খাড়া হলে তাদের পাশে মহান আল্লাহতায়ালার ফেরেশতারাও দল বেঁধে হাজির হয়।তখন তারা বিশাল শক্তিতে পরিণত হয়।সে বিশাল সম্ভাবনাটি তো বাঙালী মুসলিমের। যে আরবগণ ১৪ শত বছর পূর্বে বিশ্বশক্তির জন্ম দিয়েছিল তারা আজকের বাঙালী মুসলিমদের চেয়ে বেশী স্বচ্ছল ছিল না।মহান আল্লাহতায়ালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তো মানব সম্পদ।পাট,তূলা,গ্যাস,তেল বা স্বর্ণের উন্নয়নে যতই বিনিয়োগ হোক -সেগুলির মূল্য কতই বা বাড়ানো যায়? সর্বাধিক উন্নয়ন তো আসে তখন,যখন মূল্য সংযোজনটি ঘটে মানব জীবনে।সে উন্নত মানব তখন দ্রুত উচ্চতর সভ্যতা গড়ে তোলে।ইসলামেমূল প্রায়োরিটি তাই মানব উন্নয়ন।সে উন্নত মানব ভাঙ্গে ভাষা,বর্ণ ও গোত্রের নামে গড়া বিভেদের দেয়াল।প্রাথমিক যুগের মুসলিমগণ একতার পথেই গড়েছিল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা।ইসলামের শত্রুগণ চায় না,বাঙালী মুসলিমগণও সে পথে বেড়ে উঠুক।তাদের ভয় তো বাংলাদেশের বেড়ে উঠা নিয়ে।ফলে তাদের এজেন্ডা শুধু ইসলাম থেকে দূরে সরানো নয়,একতার পথে থেকে হঠানোও।ফলে ইতিহাসে ঢুকানো হয়েছে নাশকতার বিশাল উপকরণ।এ নাশকতাটি বিভক্তির।ইতিহাস চর্চার নামে তাদের লক্ষ্য,একাত্তরের সৃষ্ট ঘৃণাকে শত শত বছর বাঁচিয়ে রাখা।
যুদ্ধ শেষে সব দেশেই শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হয়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৫ কোটির বেশী মানুষ নিহত হয়েছিল। মানব ইতিহাসে এতো বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর কোন কালেই হয়নি।জাপানের দুটি শহরের উপর মার্কিনীরা আনবিক বোমা নিক্ষেপ করেছে এবং বহু লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী জার্মানের বহু শহরকে প্রায় পুরাপুরি বিধ্বস্ত করেছে। কিন্তু যুদ্ধ শেষে জাপান ও জার্মানী উভয়ই মার্কিনীদের মিত্রে পরিণত হয়। দাবী করা হয়,জার্মানীরা ৬০ লক্ষ ইহুদীকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে।কিন্তু আজ জার্মানই ইসরাইলের অতি ঘনিষ্ট মিত্র।ইউরোপীয়রা বিভেদের সীমান্ত বিলুপ্ত করে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন গড়েছে।পৃথিবীর অন্যরা এভাবে বিভক্তি ও সংঘাতের পথ ছাড়লেও,বাংলাদেশে বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের তাতে রুচি নাই। বাঙালী মুসলিমগণ চাইলেও প্রতিবেশী ভারত সেটি হতে দিবে না।ভারতীয় এজেন্ডা পালনে তাদের বাংলাদেশী তাঁবেদারগণ যুদ্ধের ৪৪ বছর পরও তাই নির্মূলমুখি।একাত্তরে তাদের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা।কিন্তু সেটিই তাদের একমাত্র এজেন্ডা ছিল না।পরবর্তী এজেন্ডাটি হলো,ইসলামপন্থীদের নির্মূল।তাদের ভয়,সেটি না হলে পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান গড়ে উঠবে।সেটি হলে ভারতের বিপদটি আরো ভয়ানক হবে।পাকিস্তানের ওপারে বাংলাদেশের চেয়েও বড় ৭টি প্রদেশ নিয়ে গঠিত কোন ভারতীয় ভূ-ভাগ নেই।কিন্তু বাংলাদেশের ওপারে আছে।বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানটি ভারতের জন্য এজন্যই এতোটা বিপদজনক।ভারতীয় রাজনীতিতে এতোদিন মূল উপাদানটি ছিল প্রচণ্ড পাকিস্তান ভীতি।সেটি ১৯৪৭ সাল থেকেই।পাকিস্তান ভীতি নিয়েই কাশ্মীরে অবস্থান নিয়েছে ৬ লাখ ভারতীয় সৈন্য।একাত্তরের পর ভারতীয় রাজনীতিতে যোগ হয়েছে নতুন উপসর্গ।সেটি বাংলাদেশ ভীতি।যেখানেই মুসলিম সেখানেই ভারতের ভয়।বাংলাদেশের ১৬ কোটি মুসলিম তো সে তূলনায় বিশাল। এজন্যই দিল্লির কর্তাব্যক্তিগণ খোলাখুলি বলে,“বাংলাদেশকে আর ভারতীয় রাডারের বাইরে যেতে দেয়া হবে না।” ফলে বাংলাদেশেও চায়,কাশ্মীরের ন্যায় সার্বক্ষণিক যুদ্ধাবস্থা।তাই একাত্তরের পূর্বে গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব হলেও এখন সেটি অসম্ভব হয়ে পড়ছে।কারণ,ভারতীয় রাডারের নীচে সেটি জুটে না।
একাত্তরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছিল।একটি পক্ষ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল।আরেকটি পক্ষ ১৯৪৬ সালের গণভোটে শতকরা ৯৬ ভাগ বাঙালী মুসলিমের পাকিস্তানভূক্তির সিদ্ধান্তকে সঠিক মনে করে অখণ্ড পাকিস্তানের সাথে থাকাকেই নিজেদের স্বাধীনতা ভেবেছিল।পাকিস্তান থেকে বিচ্ছন্ন হওয়ার মধ্যে বরং ভারতীয় আধিপত্যের অধীনে চিরকালের গোলামীর ভয় দেখেছিল।একাত্তরে এরূপ দুটি ভিন্ন চেতনা নিয়েই যুদ্ধ হয়েছিল।পাকিস্তানী পক্ষের পরাজয়ের পর এখন আর কেউই বাংলাদেশকে পাকিস্তানভুক্ত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করছে না।কিন্তু যুদ্ধ থামলেও মিথ্যাচার থামেনি।সে মিথ্যাচার ঢুকেছে দেশের ইতিহাসেও।দিন দিন সেটি আরো হিংসাত্মক রূপ নিচ্ছে।পরিকল্পিত এ মিথ্যাচারের লক্ষ্য একটিই। আর তা হলো,দেশ-বিদেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে সত্যকে আড়াল করা।এবং যারা একাত্তরের লড়াইয়ে বিজয়ী,তাদের কৃত অপরাধগুলো লুকিয়ে ফেরেশতাতুল্য রূপে জাহির করা। সে সাথে যারা সেদিন অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদেরকে জনগণের শত্রু রূপে চিত্রিত করা। যারা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ অবধি শাসনকালে দেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত করলো, একদলীয় বাকশালী শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠালো, ডেকে আনলো ভয়ানক দুর্ভিক্ষ এবং মানুষকে পাঠালো ডাস্টবিনের পাশে কুকুরের সাথে উচ্ছিষ্ঠ খোঁজের লড়াইয়ে এবং নারীদের বাধ্য করলো মাছধরা জালপড়তে -তাদেরকে আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বলা হচ্ছে বস্তুত সে পরিকল্পনারই অংশ রূপে।
এরূপ মিথ্যাচারের আরেকটি বড় উদ্দেশ্য, একাত্তরে বাংলার মুসলামানদের মাঝে যে রক্তক্ষয়ী বিভক্তি সৃষ্টি হলো, সেটিকে স্থায়ী রূপ দেয়া। বিভক্তিকে স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্যই পরিকল্পিত ভাবে ঘৃণা ছড়ানো হচেছ। প্রশ্ন হলো, একাত্তরে যারা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করলো তাদেরকে কি বাংলাদেশের দালাল বলা যায়? তেমনি অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য যারা লড়াই করলো বা প্রাণ দিল তাদেরকেও কি পাকিস্তানের দালাল বলা যায়? অথচ জেনে বুঝে তাদের বিরুদ্ধে “দালাল” শব্দটির ন্যায় ঘৃনাপূর্ণ শব্দের প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে। অথচ ঘৃনা একটি সমাজে বারুদের কাজ করে। সেটি ছড়ানো হলে যে কোন সময়ে সে সমাজে সহজেই বিস্ফোরন শুরু হয়। একাত্তরে যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তাদের অনেকেই বয়সের ভারে দুনিয়া থেকে ইতিমধ্যে বিদায় নিয়েছে।তবে মানুষ বিদায় নিলেও ঘৃণা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে চেতনার সংঘাতও। যারা ঘৃণা ছড়াচ্ছে তারা মূলত সে সংঘাতকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাদের লক্ষ্য, বাংলাদেশকে অশান্ত ও দুর্বল করা। আর বাংলাদেশ দুর্বল হলে প্রচুর আনন্দ বাড়ে ভারতের। কারণ তারা বাংলাদেশে নিজেদের বাজার চায়। আর বাংলাদেশ দুর্বল হলে সে বাজারটি ধরে রাখাটিও সহজ হয়। একই লক্ষ্যে দালাল বলে তাদের বিরুদ্ধেও তীব্র ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে যাদের জন্ম বাংলাদেশ সৃষ্টির পর; এবং যারা দেশে ইসলামী চেতনার বিজয় চায়। এ নিয়ে বিবাদ নাই, দেশে দেশে যারা ইসলামের বিজয় চায় তারাই একাত্তরে অখণ্ড পাকিস্তানে পক্ষ নিয়েছিল। তাই পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও ইসলামপন্থীদের নির্মূল করার বিষয়টি ভারত ও ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টদের এজেন্ডা থেকে বাদ পড়েনি। তাদের কাছে সেটি বাদ পড়ার বিষয়ও নয়। ইসলামের বিজয় ঠ্যাকাতেই ঘৃণা ছড়ানোর এ বিপুল আয়োজন। আর ধ্বংসাত্মক আয়োজনের অগ্রভাগে রয়েছে বাংলাদেশের ভারতপন্থী সেক্যুলারিস্টগণ। এরূপ ঘৃণা ছড়ানোর পিছনে শুরু থেকেই অন্য যে উদ্দেশ্যটি কাজ করেছিল তা হলো, পাকিস্তানপন্থী বাঙালী ও অবাঙালীদের বিরুদ্ধে তাদের কৃত নৃশংস কর্মগুলোকে জায়েজ রূপে গ্রহণযোগ্য করা।
প্রকল্প মিথ্যা রটনায়
একাত্তর নিয়ে মিথ্যা রটনাটি স্রেফ কিছু বই-পুস্তক রচনার মধ্যে সীমিত রাখা হয়নি। একাজটি করা হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে; এবং সেটি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে। স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই, পত্র-পত্রিকা, টিভি, সাহিত্য, সিনেমা, নাটকসহ সর্বত্র ছেয়ে আছে এ মিথ্যাচার। অথচ মিথ্যার স্রোতে ভাসাটি কোন সভ্য, রুচিবান ও ন্যায়পরায়ন মানুষের কাজ নয়। অথচ এ জঘন্য পাপের কাজটি করা হচ্ছে ইতিহাস রচনার নামে।ইতিহাসের বইয়ের কাজ মিথ্যা রটনা নয়।ইতিহাস কোন দলের বা পক্ষের নয়;এটি তো জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির নিরপেক্ষ ইতিবৃত্ত।দেশের সরকার সাধারণত একটি দলের। তাদের থাকে দলীয় এজেন্ডাও। সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষে তাই নিরপেক্ষ হওয়া অসম্ভব; ফলে তাদের দ্বারা ইতিহাস রচনাও অসম্ভব। পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস আসলে কোন ইতিহাস নয়, বরং ব্যক্তি বা দলের পক্ষে চাটুকরিতা বা গুণকীর্তন। মিথ্যা ইতিহাস পড়ে অনেকে মিথ্যার ভক্ত ও প্রচারকে পরিণত হয়; কিন্তু বিবেকমান ব্যক্তিগণ সে মিথ্যাকে তারা ত্বরিৎ সনাক্ত করে ফেলে। তারা হতভম্ব হয় মিথ্যার কুৎসিত চেহারাটি দেখে।
মেঘের আড়ালে সূর্য ঢাকা পড়লেও সেটি স্বল্প সময়ের জন্য। মিথ্যা ভেদ করে সত্যের প্রকাশও তেমনি অনিবার্য। শর্মিলা বোস তাঁর “Dead Reckoning” বইতে সে সব অবিশ্বাস্য মিথ্যার কিছু উদাহরণ তুলে ধরেছেন; সে সাথে তুলে ধরেছেন তার নিজের মনের কিছু প্রতিক্রিয়া। জনৈক রশিদ হায়দার সংকলিত এবং বাংলা এ্যাকাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত ‘একাত্তরের স্মৃতি’ নামক বই থেকে ‘বাঘের খাচায় ছয়বার’ নামক নিবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি লিখেছেন, “When I first read the title of a Bengali article “Bagher Khanchay Chhoybar” (Six times in the tiger’s cage) in a collection of memoirs of 1971, I thought the author was referring to being in a Pakistani prison six times. Bengali nationalist accounts usually refer to West Pakistani in terms of animals, and most of the accounts are written in flowery language in somewhat melodramatic style. Muhammad Shafiqul Alam Chowdhury, however, was referring to actual tigers. .. Shafiqul Alam Chowdhury claims that he was an organiser of ‘sangram parishad’ in the unions of Saldanga and Pamuli and arranged for military training of youth with rifles taken from Boda police station. …He states that he was arrested, and over the next several days he was beaten during questioning at Thakurgaon cantonment and lost consciousness, and every time he came to sense, he found in a cage of 4 tigers. Alam writes, the tigers did nothing to him – in fact, he claims that a baby tiger slept with its head on his feet regularly! However, he writes that one day the military put fifteen people in the tiger’s cage and the tigers mauled a dozen of the prisoners. He claims the mauled prisoners were then taken out and shot... It beggars belief that the tigers would maul everyone else who was put into the cage but never touch Shafikul Alam –except to sleep on her feet – even though he was put in there on six different occasions. ..It is also not clear why those who were alleged shooting so many other prisoners did not shoot him too.” -(Sharmilla Bose, 2011). অনুবাদঃ “উনিশ শ’ একাত্তরের স্মৃতিকথার উপর প্রকাশিত একটি সংকলন থেকে যখন “বাঘের খাঁচায় ৬ বার” নামক প্রবন্ধটি প্রথম বার পড়লাম তখন ভাবলাম, লেখক বোধ হয় পাকিস্তানের জেলে ৬ বার বন্দি হওয়ার কথা বলেছেন। আমার সেরূপ ধারণা হওয়ার কারণ, বাঙালী জাতীয়তাবাদীরা পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাধারণত পশু রূপে চিত্রিত করে থাকে। তাদের লেখা অধিকাংশ কাহিনীর ভাষাই অতি আবেগপূর্ণ এবং অলংকারময়। তবে মুহাম্মদ শফিকুল আলম চৌধুরী তার কাহিনীতে আসল বাঘের কথাই বলেছেন।… শফিকুল আলম চৌধুরী র দাবী, তিনি সালদাঙ্গা এবং পামুলী ইউনিয়নে সংগ্রাম পরিষদের সংগঠক ছিলেন এবং বোদা থানা থেকে ছিনিয়ে নেয়া রাইফেল দিয়ে যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তার বর্ননা, তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং কয়েকদিন ধরে ঠাকুরগাঁ সেনানীবাসে প্রশ্নোত্তরের সময় তার উপর মারধর করা হয়। এর ফলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এরপর যখনই জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন তখনই দেখেন একটি খাঁচায় ৪টি বাঘের সামনে। তবে জনাব আলম লিখেছেন, বাঘগুলো তাকে কিছুই করেনি, বরং শিশু বাঘটি তার পায়ের উপর মাথা রেখে নিয়মিত ঘুমাতো। এরপর বর্ণনা দিয়েছেন, সৈন্যরা একদিন ১৫ জন বন্দিকে বাঘের খাঁচায় রেখে যায়। বাঘগুলো তাদের মধ্য থেকে প্রায় ডজন খানেককে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। তার দাবী, আহত বন্দিদেরকে সেখান থেকে বের করে গুলি করে হত্যা করা হয়। অবিশ্বাস্য রকমের বিস্ময়টি হলো, বাঘগুলো খাঁচায় বন্দি প্রত্যেক ব্যক্তিকে ক্ষতবিক্ষত করে, কিন্তু শফিকুল আলমের পায়ের উপর ঘুমানো ছাড়া তারা তাকে কখনোই স্পর্শ করেনি, যদিও সেখানে তাকে ৬ বারের জন্য রাখা হয়েছিল।.. এটাও রহস্যময় যে, যাদের উপর গুলি করে অন্যান্য বহুবন্দির হত্যার অভিযোগ -তারা কেন তাকে হত্যা করলো না?” শফিকুল আলম চৌধুরী র কাহিনী যে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানায়োট সেটি বুঝবার জন্য কি বেশী লেখাপড়া ও কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন আছে? সূর্যের ন্যায় মিথ্যাও এখানে জ্বল জ্বল করছে। তবে তাজ্জবের বিষয়, এ মিথ্যা কাহিনীর প্রকাশক বটতলার কোন অর্থলোভী দুর্বৃত্ত প্রকাশক নয়, বরং খোদ বাংলা এ্যাকাডেমী -যার মূল দায়িত্ব জনস্বার্থে গবেষণামূলক বইয়ের প্রকাশনা। নিরেট মিথ্যা প্রচারে জনগণের অর্থে পরিচালিত দেশের সর্বোচ্চ এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটিও যে কতটা তৎপর -এ হলো তার প্রমাণ। বাংলা এ্যাকাডেমীর ন্যায় একটি প্রতিষ্ঠানটির যখন এরূপ অবস্থা, অন্যদের অবস্থা যে কতটা খারাপ হতে পারে সেটি কি এরপরও বুঝতে বাঁকি থাকে? বরং এ প্রমাণ অসংখ্য, একাত্তর নিয়ে মিথ্যা রটনাটি পরিণত হয় এক বিশাল শিল্পে। এবং সে শিল্পের ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সে শিল্পের মূল কারিগর হলো সেক্যুলার বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, প্রশাসক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীগণ।
একাত্তরে সীমাহীন মিথ্যাচার হয়েছে মূলত দুটি লক্ষ্যেঃ এক).যারা প্রকৃত অপরাধি তারা সেটি করেছে নিজেদের অপরাধগুলোকে আড়াল করতে, অথবা সে অপরাধকে জনগণের কাছে জায়েজ করতে। দুই). রাজনৈতিক বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিশোধ পরায়ন করতে। সে বিশাল মিথ্যাচারের মাধ্যমেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে চাকরিচ্যুৎ ও গৃহচ্যুৎ করা, তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাঠ দখল করা, হ্যাইজাক করে মুক্তিপণ আদায় করা, কারারুদ্ধ করা, তাদের নাগরিকত্ব হরণ করা, এমন কি হত্যা ও হত্যার পর লাশগুলোকে কবর না দিয়ে নদীর পাড়ে বা ডোবায় পচিয়ে ফেলাও সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এমন বীভৎসতাই ছিল একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা ও মূল্যবোধ। বৃটিশ শাসনামলে হাজার হাজার মানুষ ঔপনিবেশিক শাসকদের কর্মচারী রূপে স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের উপর অনেক জুলুম করেছে। পুলিশের চাকরি করতে গিয়ে অনেকে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ দেশবাসীর উপর গুলিও চালিয়েছে। অনেকে বৃটিশের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছে। কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর কি এদের কাউকে সে জন্য দালাল বলা হয়েছে? তাদেরকে কি জেলে ঢুকানো হয়েছে? কারো কি চাকুরি, ঘরবাড়ি ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে? সবাইকে বরং আবার গুরুত্বপূর্ণ পদে একই বিভাগে বসানো হয়েছে। এটি যেমন পাকিস্তানে হয়েছে, তেমনি ভারতেও হয়েছে।
লক্ষ্য গৃহযুদ্ধ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্শাল পেত্যাঁ জার্মান নাৎসীদের সহায়তায় ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চলে ভিশিতে এক সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁকেও বিজেতা জেনারেল দ্যাগল এ অপরাধে হত্যা করেননি। তার বিচার হয়েছিল। বিচারে তাকে জেল দেয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাদক্ষ হিসাবে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ জন্য তাঁকে পরে মুক্তি দেয়া হয়। এবং মৃত্যুর পর তাঁকে বীরের মর্যাদা দেয়া হয়। -(সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, ১৯৯৩)। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে ফজলুল কাদের চৌধুরী,আব্দুস সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান,নূরুল আমীন, ডাঃ আব্দুল মোত্তালেব মালেক (যিনি ৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন), মাহমুদ আলী (আসাম মুসলিম লীগের সেক্রেটারি) এবং আরো অনেক পাকিস্তানপন্থী নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের ভাগ্য পরিবর্তনে ১৯৪৭-এর পূর্বে ও পরে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অথচ তাদেরকে দালাল ও খুনি বলা হয়েছে। বলা হয়, ফজলুল কাদের চৌধুরী , আব্দুস সবুর খান, খাজা খয়ের উদ্দিন নাকি হুকুম দিয়ে মানুষ খুন করিয়েছেন। বৃদ্ধ ডাঃ আব্দুল মোত্তলেব মালেকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনা হয়। ইসলামী দলগুলোর অনেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নাকি পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের নারী সরবরাহ করতো। অথচ এ অভিযোগগুলির কোনটিই প্রমাণিত হয়নি। মুজিব আমলে নয়, পরেও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিথ্যার প্রচার থামেনি। আওয়ামী বাকশালী চক্র ও তাদের মিত্ররা আজও এ নিরেট মিথ্যাগুলোকে জোরে শোরে লাগাতর রটনা করে। ইতিহাসের বইয়ে এসব মিথ্যা ঢুকানোর পিছনে কাজ করেছে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। সে মিথ্যাচারটি হয়েছে শেখ মুজিব ও তার দলের ইমেজকে বড় করে দেখানোর প্রয়োজনে। মিথ্যাচার হয়েছে ভারতের অপরাধগুলো লুকিয়ে বাংলাদেশের মানুষের কাছে দেশটিকে বন্ধু রূপে জাহির করার প্রয়োজনে। এবং সে সাথে বিরোধীদের চরিত্রহরণ ও তাদেরকে হত্যাযোগ্য প্রমাণ করার লক্ষ্যে। যে কোন দেশের রাজনীতিতে ঘৃনা, সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয় তো এভাবেই। এমন এক ঘৃণাপূর্ণ পরিবেশে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকগণও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের পাইকারি হারে ফাঁসির হুকুম বা যাবতজীবন কারাদণ্ড দিবে এবং বিপুল সংখ্যক জনতা সে রায় শুনে মিষ্টি বিতরণ করবে বা উৎসব করবে তাতেই বা সন্দেহ থাকে কি? মিথ্যাচর্চা যখন জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয় তখন সেটি যে জনগণের চরিত্রও মিথ্যায় অভ্যস্থ করবে -তাতেই বা বিস্ময় কি?
নানা প্রেক্ষাপটে প্রতিদেশেই বিভক্তি দেখা দেয়। সে বিভক্তি নিয়ে প্রকাণ্ড রক্তপাতও হয়। নবীজীর (সাঃ) আমলে আরবের মানুষ বিভক্ত হয়েছিল মুসলমান ও কাফের -এ দুটি শিবিরে। কিন্তু সে বিভক্তি বেশি দিন টেকেনি। সে বিভক্তি বিলুপ্ত না হলে মুসলিমগণ কি বিশ্বশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করতে পারতো? জার্মানরা বিভক্ত হয়েছিল নাজি ও নাজিবিরোধী -এ দুই দলে। সে বিভক্তিও বেশীদিন টেকেনি। তা বিলুপ্ত না হলে জার্মানগণ আজ ইউরোপের প্রধানতম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হতে পারতো? বিভক্তি দেখা দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। সে বিভক্তি এতোটাই প্রবল ছিল যে আব্রাহাম লিংকনের আমলে উত্তর ও দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর মাঝে প্রকাণ্ড গৃহযুদ্ধ হয়েছিল। হাজার হাজার মানুষ তাতে নিহতও হয়েছিল। কিন্তু সে বিভক্তিও বেশী দিন টেকেনি। সেটি বিলুপ্ত না হলে দক্ষিণ আমেরিকার মত উত্তর আমেরিকাতেও উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, বলিভিয়া, পেরুর ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বহু রাষ্ট্রের জন্ম হত। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যেভাবে অপ্রতিদ্বন্দি বিশ্বশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করছে তা কি সম্ভব হত? পারতো কি পৃথিবী জুড়ে প্রভাব সৃষ্টি করতে?
যে পাপ বিভক্তি ও বিদ্রোহে
আত্মপ্রতিষ্ঠা, আত্মসম্মান ও বিশাল বিজয় আসে একতার পথ ধরে। বিভক্তির মধ্য দিয়ে আসে আত্মহনন, আত্মগ্লানি ও পরাজয়। বাংলাদেশ আজ সে বিভক্তির পথ ধরেই অগ্রসর হচ্ছে। একটি দেশের জন্য এর চেয়ে বড় আত্মঘাত আর কি হতে পারে? একতার গুরুত্ব শুধু বিবেকবান মানুষই নয়, পশুপাখিও বোঝে। তাই তারাও দল বেঁধে চলে। একতা গড়া ইসলামে ফরয; এবং বিভক্তি গড়ার প্রতিটি প্রচেষ্টাই হলো হারাম। বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে একতার পথে চলা ও না-চলার বিষয়টি ব্যক্তির খেয়াল খুশির উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। এ বিষয়ে অলংঘনীয় নির্দেশ এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেছেন,“ওয়া তাছিমু বিহাব্*লিল্লাহে জামিয়াঁও ওয়ালাতাফাররাকু”।* ***অর্থঃ “এবং তোমরা আল্লাহর রশি (আল্লাহর দ্বীন তথা পবিত্র কোরআন বা ইসলামকে) আঁকড়ে ধর এবং পরস্পরে বিভক্ত হয়োনা..।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৩)। মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে কঠোর আযাব প্রাপ্তির জন্য মুর্তিপুজারি বা কাফের হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সে জন্য বিভক্তির পথে পা বাড়ানোই যথেষ্ট। সে শাস্তির হুশিয়ারিও এসেছে মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা তাদের মত হয়োনা যারা সুস্পষ্ট ঘোষণা আসার পরও পরস্পরে বিভক্ত হলো এবং মতবিরোধ সৃষ্টি করলো। তাদের জন্য রয়েছে কঠোর আয়াব।”-(সুরা আল ইমরান, আয়াত ১০৫)। তাই কোন মুসলিম দেশকে খণ্ডিত করা কোন জায়েজ কর্ম নয়। ফলে সেটি ঈমানদারের কাজ নয়, সে কাজটি ইসলামের শত্রুদের। মুসলিম ভুমির একতা রক্ষার প্রতি এরূপ কোরআনী ঘোষণা থাকার কারণে উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানিয়া খলিফাদের আমলে অখণ্ড মুসলিম ভূগোল শত শত বছর বেঁচে থাকার সুযোগ পেয়েছে। অথচ সে সময়েও বহু সমস্যা ছিল, বহু অনাচারও ছিল। কিন্তু সেসব কারণো বার বার সরকার পরিবর্তন হলেও সে অখণ্ড ভূগোল খণ্ডিত হয়নি। অথচ সে অখণ্ড আরব ভূমি আজ ২২ টুকরোয় বিভক্ত। আরব ভূমিতে বিভক্তির এরূপ অসংখ্য দেয়াল গড়া হয়েছে স্রেফ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের সহযোগী সেক্যুলারিস্ট, ন্যাশনালিস্ট ও ট্রাইবালিস্ট নেতাদের দখলদারি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে। এ বিভক্তির লক্ষ্য মুসলিম স্বার্থ বা আরব স্বার্থকে প্রতিরক্ষা দেয়া ছিল না। লক্ষ্যণীয় হলো, এরূপ আত্মঘাতি বিভক্তির সাথে কোন ঈমানদার ব্যক্তি জড়িত ছিলেন না। কারণ ঈমানদার হওয়ার অর্থই তো প্যান-ইসলামীক হওয়া। অথাৎ ভাষা, বর্ণ, ভূগোল ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠা। বিভক্তি শুধু দুর্বলতা ও পরাধীনতাই বাড়ায়। ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে এজন্যই তারা বার বার পরাজিত হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা মুসলিমদের সীসাঢালা দেয়ালের ন্যায় ঈমানদারদের একতাবদ্ধ হতে বলেছেন। কিসের ভিত্তিতে একতা গড়তে হবে সেটিও সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। একতার ভিত্তিটি হলো ইসলাম; ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলভিত্তিক জাতীয়তা নয়। মহান আল্লাহতয়ালার প্রতিটি হুকুমই অলঙ্ঘনীয়। ফলে একতা প্রতিষ্ঠার প্রতিটি প্রয়াসই পবিত্র ইবাদত;তেমনি বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতা গড়ার প্রতিটি প্রয়াসই হলো মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। ফলে হারাম। রাজার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্রাণদন্ড হয়। সমগ্র বিশ্বের মহাপ্রভু মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও কি তাই রহমত বয়ে আনে? এরূপ বিদ্রোহ যে শুধু পরকালে জাহান্নামে নেয় –তা নয়। দুনিয়ার বুকেও আযাবের কারণ হয়। জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের অপরাধটি তাই শুধু স্রেফ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল খোদ মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধেও। আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রমাণ শুধু এ নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের রাজস্বের অর্থে একটি মুসলিম দেশে সুদী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা পাবে। বা সে অর্থে বেশ্যাবৃত্তি বা জ্বিনার ন্যায় জঘন্য হারাম কর্মগুলি পুলিশী পাহারাদারি পাবে। বা আইন-আদালত থেকে আল্লাহতায়ালার আইনকে সরিয়ে ব্রিটিশদের রচিত কুফরি ফৌজদারি বিধি (পেনাল কোড) প্রতিষ্ঠা করা হবে। বরং মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ এবং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপরাধ ঘটেছে ভাষা, বর্ণ ও পৃথক ভূগোলের নামে বিভক্তি গড়ায় এবং মুসলিম উম্মাহকে শক্তিহীন করায়।
১৯৪৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমগণ ভাষা বা বর্ণকে নয়, ইসলামকে আঁকড়ে ধরেছিল। বাঙালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি, গুজরাটি, বালুচ -এরূপ নানা ভাষার মুসলিমগণ ভাষার বন্ধন ডিঙ্গিয়ে ঈমানী পরিচয় নিয়ে একাতাবদ্ধ হয়েছিল। তারা সেদিন ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিক ভিন্নতার সাথে ভূলে গিয়েছিল ধর্মীয় ফেরকা ও মাযহাবী বিরোধগুলোও। উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে এটি ছিল অতি বিশাল অর্জন। মুসলিম উম্মাহর মাঝে এমন ঈমানী ভাতৃত্ব সেদিন বিশাল পুরস্কার এনেছিল মহান আল্লাহতায়ালা থেকে। সেটি হলো পাকিস্তান। সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তৎকালীন বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ মুসলিম রাষ্ট্রটি গড়তে একটি তীরও ছুড়তে হয়নি। কিন্তু সে প্যান-ইসলামীক ঐক্য ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় হিন্দুদের ভাল লাগেনি। সে ঐক্যের ভিত্তিতে উপমহাদেশের বুকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পাক বা দেশটি বেঁচে থাকুক সেটিও তারা চায়নি। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা ছিল উপমহাদেশের মুসলিমদের শত্রু। তারা চাইতো মুসলিমগণ ভারতীয় হিন্দুদের গোলাম রূপে বেঁচে থাকুক, স্বাধীন ভাবে নয়। ইসলামের শরিয়তের প্রতিষ্ঠা নিয়ে বাঁচার তো প্রশ্নই উঠে না। গরু গোশতো ঘরের রাখার মিথ্যা অভিযোগে সেদেশে নির্মম প্রহারে রাজপথে মুসলিমকে হত্যা করা হয়। সম্প্রতি ভারতীয় পত্রিকাগুলি সে খবর ছেপেছে। গরুর জীবনে যে নিরাপত্তা আছে, ভারতীয় মুসলিমের জীবনে সে নিরাপত্তাটুকুও নেই।
পবিত্র কোরআনে মুসলিমদের পরিচয় পেশ করা হয়ছে হিযবুল্লাহ বা আল্লাহর দল রূপে। এমনটি কি কখনো ধারণা করা যায়,মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজ বাহিনীতে অনৈক্য চাইবেন? এবং সেটি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, বর্ণ, পতাকা বা ভৌগলিক স্বার্থের নামে? মুসলিম উম্মাহর একতা, শক্তি ও বিজয়ের চেয়ে বিভক্তির এ উপকরণগুলি কি কখনো গুরুত্ব পেতে পারে? মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর বাহিনীতে একতার যে কোন উদ্যোগে যে খুশি হবেন -সেটিই তো স্বাভাবিক। মুসলিম উম্মাহর মাঝে বিভক্তির যে কোন উদ্যোগ তাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। এমন বিদ্রোহ যে ভয়ানক শাস্তি আনবে সেটিও কি দুর্বোধ্য? ১৯৪৭’য়ে উপমহাদেশের মুসলমানদের একতা মহান আল্লাহতায়ালাকে এতোই খুশি করেছিল যে প্রতিদানে বিশাল রহমত নেমে এসেছিল। মহান আল্লাহতায়ালার সে করুণার কারণেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় কোন যুদ্ধ লড়তে হয়নি। অস্ত্র না ধরেই বিশাল শত্রু পক্ষকে সেদিন তারা পরাজিত করতে পেরেছিল। অথচ ইংরেজ ও হিন্দু -সে সময়ের এ দুটি প্রবল প্রতিপক্ষই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সর্বপ্রকার বিরোধীতা করেছে।
শেখ মুজিব ও তার দলীয় নেতাকর্মীগণ দেখেছে শুধু গদিপ্রাপ্তির স্বার্থটি। গদির লোভে মিথ্যা বলা এবং যে কোন শক্তির সাহায্য নিতেও তাদের কোন আপত্তি ছিল না। সেরূপ সাহায্য দিতে প্রতিবেশী ভারতও দু’পায়ে খাড়া ছিল। কারণ, পাকিস্তান ভাঙ্গার মাঝে ভারত তার নিজের বিশাল স্বার্থটি দেখেছিল। শেখ মুজিব ও তার সহচরদের এজেণ্ডায় বাঙালী মুসলিমদের স্বার্থ গুরুত্ব পায়নি। ফলে ভারতের ন্যায় একটি অমুসলিম দেশের অর্থ, অস্ত্র ও উস্কানিতে একটি মুসলিম ভূমিকে তারা বিভক্ত করেছেন। ইসলাম ধর্ম মতে এটি নিরেট পাপকর্ম। ফলে শুধু ভারতের গোলামী নয়, মহান আল্লাহতায়ালার আযাবও ডেকে এনেছেন। পরিণতিতে বাংলাদেশের ন্যায় সুজলা সুফলা একটি উর্বর দেশে নেমে আসে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ। লক্ষ লক্ষ মানুষ সে দুর্ভিক্ষে মারা যায়। মুজিবের সে আত্মঘাতি রাজনীতিতে শুধু প্রাণহানি নয়, বাঙালী মুসলিমের চরম ইজ্জতহানিও হয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে দেশটি ভিক্ষার ঝুলিতে পরিণত হয়। যে বাঙালী মুসলিমগণ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের পুরা রাজনৈতিক চিত্রই পাল্টে দিল তাদের এরূপ ইজ্জতহানি বা অপমান কি কম বেদনাদায়ক? এ বিকট অপমান নিয়ে আজ থেকে হাজার বছর পরও কি ইতিহাসের পাতায় তাদের হাজির হতে হবে না? মুজিব ও তার সহচরদের চেতনায় সে ভাবনাটি কি কোন কালেও স্থান পেয়েছে?
অসহ্য ছিল পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা
ইসলামের শত্রুপক্ষের কাছে ১৯৪৭’য়ের পরাজয় যেমন কাম্য ছিল না, তেমনি সহনীয়ও ছিল না। তাদের এজেন্ডা তো মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করা। ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইন্সটিটিউশন হলো খেলাফত। খেলাফতের মূলে ছিল প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্ব; এবং ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার সীমানা ডিঙ্গিয়ে মুসলিম ঐক্য। সে সাথে লক্ষ্য ছিল বিশ্বশক্তি রূপে মজবুত প্রতিরক্ষা ও আত্মসস্মান নিয়ে বাঁচা। সংঘাতময় এ বিশ্বে যাদের সামরিক শক্তি নাই তাদের কি স্বাধীনতা ও ইজ্জত থাকে? খেলাফতের কারণেই ইংরেজ, ফরাসী, ডাচ, স্পানীশ, পুর্তগীজ ও ইউরোপের নানা ঔপনিবেশিক শক্তি এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকার বহু দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারে সফল হলেও মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার খেলাফতভূক্ত মুসলিম ভূমিতে প্রবেশের সুযোগ পায়নি। নেকড়ে বাঘ সব সময়ই ছাগল-ভেড়া খোঁজে, বিশাল হাতি নয়। সে খোঁজেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশগণ পাশের ওসমানিয়া খেলাফত ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরের বিচ্ছন্ন বাংলায় গিয়ে পৌঁছে। একারণে শুরু থেকেই তাদের টার্গেট ছিল, খেলাফতের বিনাশ ঘটিয়ে সহজে শিকারযোগ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট নির্মান করা এবং সে রাষ্ট্রগুলির মাঝে ইসরাইলের ন্যায় স্যাটেলাইট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সে সাথে লক্ষ্য ছিল, মুসলিম বিশ্বের বিশাল সম্পদের উপর অবিরাম সাম্রাজ্যবাদী শোষণের অবকাঠামো নির্মাণ। সে লক্ষ্য অর্জনে তারা ১৯২৩ সালে সফল হয়।ফলে জর্দান, কাতার, কুয়েত, দুবাই, বাহরাইনের মত বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড -যা এক সময় উসমানিয়া খেলাফতের অধীনে জেলার মর্যাদাও রাখতো না -সেগুলিকেও রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয়া হয়। এরূপ বিভক্তির কারণেই মুসলিম ভূমির তেল ও গ্যাসের ন্যায় সম্পদ থেকে মুসলিমদের চেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি।
মুসলিম উম্মাহ আজ শক্তিহীন ও প্রতিরক্ষাহীন। জাতীয়তাবাদীদের সৃষ্ট বিভক্তিই মুসলিমদের এরূপ পঙ্গুত্ব ও অপমান বাড়িয়েছে। পবিত্র আল আকসা মসজিদসহ বিশাল মুসলিম ভূমি আজ অধিকৃত। আন্তর্জাতিক ফোরামে দেড়শত কোটি মুসলিমের কথা গুরুত্ব পায় না, অথচ গুরুত্ব পায় সাড়ে ৫ কোটি ব্রিটিশ ও ফরাশীদের কথা।মুসলিম উম্মাহর পঙ্গুত্ব বাড়াতেই খেলাফত ভেঙ্গে সৃষ্টি করা হয়েছে বিশের বেশী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। খেলাফত বিলুপ্ত হওয়ার সে দুর্দিনেই প্রতিষ্ঠা পায় নানা ভাষাভাষীর মুসলমানদের নিয়ে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান। তাদের চোখের সামনে পাকিস্তানের ন্যায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে এবং সেটি টিকে থাকবে -সেটি তাদের কাছে অসহ্য ছিল। ফলে পাকিস্তান জন্ম থেকেই ইসলামবিরোধী আন্তর্জাতিক কোয়ালিশনের টার্গেটে পারিণত হয়। ভারত সে লক্ষ্যে কাজ করছে ১৯৪৭ সাল থেকেই। আরবদেরকে এরাই বিশেরও বেশী টুকরায় বিভক্ত করেছে। নব্যসৃষ্ট এসব দেশগুলির প্রতিটিতে এমন সব স্বৈরাচারী তাঁবেদারকে বসিয়েছে যাদের কাছে ব্যক্তিস্বার্থ বা গোত্রীয় স্বার্থ ছাড়া অন্য কোন মহত্তর ভাবনা গুরুত্ব পায় না। তাদের মূল কাজ, সাম্রাজ্যবাদীদের গড়া বিভক্ত ভূগোলকে টিকিয়ে রাখা। বিভক্তির প্রাচীর ভাঙ্গার যে কোন প্রয়াসই তাদের কাছে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে প্রাণদণ্ডও দেয়া হয়।
একই কারণে পাকিস্তানের ন্যায় ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশও আজ শত্রুশক্তির টার্গেট। বিশেষ করে ভারতের। ভারতের পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তানের ন্যায় আরেক শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্রের সৃষ্টিকে যে তারা মেনে নেবে না,তাদের সে ঘোষণাটিও সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের মানুষ আল্লাহর দেয়া শরিয়ত প্রতিষ্ঠা করুক সেটিও তারা মানতে রাজী নয়। বাঙালী মুসলিমগণ আল্লাহর অনুগত বান্দাহ হোক ও তাঁর আইনের আপোষহীন অনুসারি হোক এতেও তাদের আপত্তি। ইসলামের এ অতি সনাতন রূপকে তারা ‘মৌলবাদ’ বলে। এজন্যই বাংলাদেশের অখণ্ড ভূগোল যেমন ভারতীয় আগ্রাসনের টার্গেট, তেমনি টার্গেট হলো একতাবদ্ধ মুসলিম জনগণও। যে কারণে পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল তেমনি আগ্রহ বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও খণ্ডিত রাষ্ট্রে পরিণত করায়। এজন্যই ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরের পর পরই শুরু হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যাপক লুণ্ঠন। তাদের হাতে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া অস্ত্রই শুধু লুট হয়নি। লুট হয়েছে অফিস-আদালত ও কলকারখানার বহু হাজার কোটি টাকার মালামাল। নিজেদের লক্ষ্য পূরণে পাকিস্তান ভাঙ্গাটি তাদের কাছে ছিল প্রথম পর্ব মাত্র, শেষ পর্ব নয়। বাংলাদেশকেও তারা ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর করতে চায়। ভূগোল ভাঙ্গার লক্ষ্যে ভারতীয় সরকার ও পুলিশের সামনে পশ্চিম বাংলার মাটিতে প্রতিপালিত হচ্ছে “স্বাধীন বঙ্গভূমি” প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল এসব প্রাক্তন বৃহত্তর জেলাগুলোকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক করে এরা স্বাধীন বঙ্গভূমি রাষ্ট্র গড়তে চায়। এদের নেতা চিত্তরঞ্জন সুতার আওয়ামী লীগের টিকেটে সংসদ সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশের মেরুদণ্ড ভাঙ্গার প্রকল্প শুধু সেটিই নয়, একই লক্ষ্যে ভারত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিদ্রোহীদের নিজ ভূমিতে বিপুল অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণও দিয়েছে। ভারতের একাত্তরের ভূমিকার বিশ্লেষণে এগুলি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব ঘটনাবলিকে সামনে না রাখলে একাত্তরের সঠিক ইতিহাস রচনার কাজ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
Comment