পরিকল্পনাটি ভারতীয়
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাটি ভারতীয়। আওয়ামী লীগ ব্যবহৃত হয়েছে সে ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার রূপে। অথচ গণতান্ত্রিক সংগঠনের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার কথা নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথা রাজনীতিতে স্বচ্ছতা; বিদেশী এজেন্ডা পালন বা বিদেশী গুপ্তচরদের সাথে সংশ্লিষ্টতার বদলে গুরুত্ব পায় জনগণের সাথে সংশ্লিষ্টতা। অথচ শেখ মুজিবের রাজনীতির সাথে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা ছিল অতি সামান্যই। কখনো তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন;সেটি ভাল না লাগায় সাথে সাথে প্রেসিডেন্টও হয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে দলীয় নেতাদের ডেকে পরামর্শ নেননি। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আবির্ভুত হয়েছেন নির্ভেজাল স্বৈরাচারী রূপে। স্রেফ ভোটের জন্য জনগণের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন, কিন্তু দেশের ভাগ্য নির্ধারণে দেশের বিজ্ঞজন বা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেননি। সেটি একাত্তরে যেমন নয়, তেমনি একাত্তরের আগে বা পরেও নয়। পরামর্শ করেছেন ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে। সে লক্ষ্যে ষাটের দশকেই তিনি ভারতে গেছেন। ভারত সরকার ১৯৪৭ থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার চেষ্টায় ছিল। শেখ মুজিব সে কাজে ভারতের সহযোগী হন। এ নিয়ে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’য়ের কর্মকর্তাগণই শুধু মুখ খুলেনি, মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহুনেতাও।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয় নাশকতা নিয়ে এক কালের আওয়ামী লীগ নেতা ও দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। যে মিথ্যাচারটি একাত্তরে দেশ জুড়ে ছড়ানো হয়েছে তা হলো, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনে না। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশটি সৃষ্টির মূল কাজটি যে নেহায়েতই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ -সে কথাটি ভারতীয় কতৃপক্ষও খুব একটা জোরে শোরে প্রচার করে না। তারা জানে,সেটি প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কাছেই শুধু নয়, মুসলিম বিশ্বেও ভারত ভিলেন রূপে চিত্রিত হবে। এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্ঠিকে তারা বাংলাদেশেীদের একান্ত নিজেদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ভারত সরকার সত্য বিষয়টি লুকাতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিপুল সংখ্যক রাজাকারদের কারণে সে পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে পাকিস্তান বাহিনী বা রাজাকারদের পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। একাত্তরের শেষদিকে তাই স্বয়ং ভারতীয় বাহিনীকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালী ও পাকিস্তানীদের লড়াই না হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সরাসরি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এ লড়ায়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের ফলে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। সেটি আরো পরিস্কার হয়, রেসকোর্সের ময়দানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বভাগের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।এ চুক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর উপস্থিতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল সেটির সুস্পষ্ট দলিল হলো ১৬ই ডিসেম্বরের এ চুক্তি। ভারত যেভাবে তার আগ্রাসী চরিত্রটি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিল সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে মুসলিম বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশকে প্রথমে স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ এর আগে বা পরে অন্য কোন মুসলিম দেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নিয়ে কখনোই্ এরূপ ঘটনা ঘটেনি। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম দেশকে তাবত মুসলিম দেশ সাথে সাথে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা-প্রাপ্তি শুধু সে দেশটির জনগণের জন্যই নয়,সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছেও সেটি অতিশয় আনন্দের ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। না হওয়ার কারণ, তাদের কাছে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান রূপে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পরই অন্য মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানে এগিয়ে আসে। অথচ এ বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে নাই, ছাত্রদেরকে ইচ্ছা করেই তা পড়ানো হয় না। লক্ষ্যণীয় হলো ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যে সত্যটিকে লুকাতে পারিনি, বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটিই লুকানো হচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের কোথায় কে লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য ও তার কমান্ডারগণ কে কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো –সে বিবরণ নাই। বিবরণ নাই, ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। একাত্তরের যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে, কতজন আহত হয়েছে -স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সে তথ্যও নাই। বুঝা যায়, সরকার ইচ্ছা করেই কিছুই লুকাতে চেয়েছে। সেটি বাংলাদেশের জন্মে ভারতের ভূমিকার কথা। কারণটিও বোধগম্য। ষড়যন্ত্র কথা তো প্রকাশ করা যায় না; সেগুলো গোপন রাখাই নিয়ম।একাত্তরের যুদ্ধের বহু ঘটনাই তা ইতিহাসের বইয়ে নাই।
ইতিহাসের বইয়ে যে সত্য বিষয়টি কখনোই বলা হয়নি না তা হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের পূর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দূরে থাক একটি জেলা, একটি মহকুমা বা একটি থানাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোন জেলা শহরে মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্য দিবালোকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরতে পারিনি। একাত্তরের মূল লড়াইটি লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। একই কারণে চীনা বা রুশ বাহিনী ভিয়েতনামে প্রবেশ করেনি। একটি দেশের ভূগোলে কিভাবে পরিবর্তন আনতে হবে জাতিসংঘের বিধানে তার একটি বিধিবদ্ধ আইন আছে। সেটি কখনই কোন বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়। ভারত-ভাগের পূর্বে সে ইস্যুর উপর গণভোট হয়েছে, পাকিস্তানের ১৯৭১’য়ের নির্বাচন সেরূপ ছিল না। নির্বাচন হয়েছিল স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে। কিন্তু ভারত সে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এজন্য যুদ্ধ চলা কালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতিসমর্থন জানিয়েছে। ভারতের পক্ষে থেকেছে শুধু সোভিয়েত রাশিয়া ও তার কিছু মিত্র দেশ।
লুকাতে পারিনি অপরাধ
ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে -এ ভয়েই ভারত নিজেদের অর্থ, অস্ত্র ও লোকবল দ্বারা পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। ভারতীয় মুসলিমগণ পাকিস্তানের উপর এমন হামলার ঘোরতর বিরোধী ছিল। তবে ভারতীয় মুসলিমগণ যাই ভাবুক, ভারতের দুশ্চিন্তার মূল কারণ, পাকিস্তানের উপর ভারতের আগ্রাসন অন্যদেরও নৈতিক বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার যুদ্ধে অংশ নেয়ার। এজন্যই রেসকোর্সের ময়দানে জেনারেল ওসমানীকে শামিল করাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবলেও ভারতের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা ছিল বড় রকমের ভুল। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাঁধে বন্দুক রাখার ন্যায় তাঁর উপস্থিতিরও লোক-দেখানো রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিবিদ এবং ভারতীয় ইনটেলিজেন্স এর সাবেক প্রধান Mr.J.N. Dixit তার রচিত “Liberation and Beyond” বইতে জেনারেল ওসমানীকে রেসকোর্সে শামিল না করাকে “major political mistake” বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবতা হলো, অতি সতর্কতার সাথে খুন করার পরও সব খুনিই খুনের আলামত ঘটনা স্থলে রেখে যায়। অপরাধ বিজ্ঞানীদের তাই বিশ্বাস, তদন্তে আন্তুরিক হলে কোন খুনিই গ্রেফতার এবং সে সাথে খুনের বিচার থেকে রেহাই পেতে পারে না। অন্যদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় আগ্রাসনের সে অপরাধ যতই লুকানোর চেষ্ঠা করুক, শত শত বছর ধরে ভারত শুধু বাংলাদেশী মুসলিমদের কাছেই নয়, সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের কাছেও শত্রু রূপে চিহ্নিত হবে -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
বাংলাদেশ সৃষ্টি নিয়ে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র”য়ের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিস্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”-(B.Ramon, 2007)। অনুবাদঃ “পূর্ব পাকিস্তানে ‘র’য়ের সাফল্যই জন্ম দেয় বাংলাদেশের; এবং কাউ’য়ের নেতৃত্ব এবং নায়ার’য়ের পরিকল্পনা ছাড়া সে সাফল্য অর্জন সম্ভব হত না।” একাত্তর নিয়ে মিস্টার বি. রমন’য়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে মুজিবের জন্য তারা কোন স্থানই রাখেনি। অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদী পক্ষটি “র”এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। এরও গুঢ় রহস্য রয়েছে। কারণ তারা নিজেরাও জানে,এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা অপরাধী রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্যই সুনাম বয়ে আনে না। যেসব ভারতীয় সেনা অফিসার ও সৈনিক কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যার নায়ক, তারাই একাত্তরে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছিল এবং মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দিয়েছিল। কাশ্মীরের সে ভারতীয় খুনিদের কথা আওয়ামী ঘরানার নেতা-কর্মীরা আজ মুখেই আনে না। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নিজেদের অর্জন বলে অহংকার দেখায়। অথচ র’য়ের দাবি,তাদের ভুমিকাই হলো মূল। এ ব্যাপারে মিস্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’তে লিখেছেনঃ “The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon, 2007)। অনুবাদঃ ১৯৬৮ এর পূর্বে আইবি (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) এবং পরবর্তীতে ‘র’ পূর্ব পাকিস্তানের বহু রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সে নেটওয়ার্কটি ‘র’ এবং (আওয়ামী লীগের) রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয় ত্বরিৎ বেগে নিজেদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা ও আমলাদের দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পাল্টা সরকার গঠনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরিতে।….স্থানীয় লোকদের মধ্যে একমাত্র তারাই ভারত এবং তার এজেন্সীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল যারা বিহার থেকে আগত মোহাজির।
প্রস্তুতিটি বহু বছরের
মিস্টার বি. রমনের কথায় এটি সুস্পষ্ট যে, একাত্তরে যা ঘটেছে তার পরিকল্পনা একাত্তরে হয়নি। প্রস্তুতিটি বহু বছরের। পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা আই,বি এবং ১৯৬৮এর পর “র” ষাটের দশকের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঙালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে তারা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো গড়ে তোলে। এমনকি ট্রেনিং দেয়ার কাজও শুরু করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা Director of Intelelligence Bureau (DIB) জানতে পারে যে কলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়ীতে - যা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর, সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। -(মাসুদুল হক)।
মিস্টার বি. রমনের লেখা থেকে প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের রিপোর্ট আদৌ মিথ্যা ছিল না। এ গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে দেখা ভারতের কাম্য ছিল না। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পিছনে তারা যে বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল –বিশেষ করে ১৯৭০য়ের নির্বাচনে তার মূল লক্ষ্যটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা, শেখ মুজিবকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নয়। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে মিস্টার বি. রমনের কথা অনুসারে র’ যেভাবে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা এঁটেছিল তা সফল হত না। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার পক্ষ থেকে সে সময় ময়দানে মুজিবই একমাত্র খেলাওয়াড় ছিলেন না, ময়দানে ছিল আরো অনেকেই। ছাত্রলীগের নেতৃপর্যায়ে এদের পাল্লাই ছিল ভারি। তাদের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে “র”য়ের সে পরিকল্পনাটি থেকে কোনরূপ বিচ্যুত না হন। বস্তুত শেখ মুজিব তখন নিজেই এক পরাধীন ব্যক্তি, তিনি ছিলেন ভারতীয় “র” এবং ছাত্রলীগ নেতাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তখন তার পক্ষে “র”এর কাছে কৃত ওয়াদা থেকে পিছুটান দেয়ার সামান্যতম সুযোগও ছিল না। বহু আগেই ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। মুজিবের কাজ ছিল একজন জিম্মির ন্যায় বিনা প্রতিবাদে তাদের অনুসরণ করা। মুজিব সেটি করেছিলেনও। গাড়ীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আপোষে শেখ মুজিবের আদৌ কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ তাতে আগ্রহ ছিল না ভারতের। আর ভারতের যাতে আগ্রহ নেই তাতে মুজিবেরই বা আগ্রহ সৃষ্টি হয় কি করে? ২৩ মার্চের বৈঠকে মুজিবের ৬ দফা ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো উভয়ই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মুজিবের আগ্রহ ছিল না পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়ে আলোচনাকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার। ছাত্রলীগের নেতারা ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে মুজিবের বৈঠককে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে। এবং তা নিয়ে আওয়ামী-বাকশালী শিবিরে কোন দ্বিমত নেই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন নিয়ে এজন্যই মুজিব আলোচনায় রাজী ছিল না। ফলে বৈঠক ভেঙ্গে যায়। কারণ ভারতীয় র’এবং ছাত্রলীগ নেতাদের গোলপোষ্ট তখন ভিন্ন। সেটি ৬ দফা নয়, বরং এক দফা তথা পাকিস্তান ভাঙ্গা। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো সেটি বুঝতে পারে এবং মার্চের আলোচনা ব্যর্থ হয়।
কিন্তু এ বিষয়ে অতিশয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি হলো তাদের,যারা মনে করে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে স্রেফ স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার ভূলের কারণে। সে ভূলটি ছিল মুজিবের হাতে ক্ষমতা না দেয়া। যেন মুজিব ও তার দল পাকিস্তান রক্ষার জন্য দু*ই*পায়ে খাড়া ছিল! এবং মুজিবে হাতে ক্ষমতা দিলেই যেন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকে! ভারত যে পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্যাপারে কতটা আপোষহীন ছিল সেটি পরবর্তীতে আরো পরিস্কার হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খান আন্তরিক ভাবেই চেষ্টা করেছিলেন। এমন কি যুদ্ধ এড়াতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে গণভোটের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের পক্ষে এর চেয়ে বেশী ছাড় দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভারত তাতে রাজী হয়নি। বরং সেটি হতে দেয়নি। এমন কি যে সব উদ্বাস্তু ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের ফেরতও আসতে দেয়নি। এব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিন্জার লিখেছেন, “Despite Yahya’s proclamation of an amnesty India made the return of refugees to East Pakistan depend on a political settlement there. But India reserved the right to define what constituted an acceptable political settlement on the sovereign territory of its neighbor.” (The White House Years, page 858). অনুবাদঃ ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শণের পরও ভারত বলছে উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়াটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক মীমাংসার উপর। কিন্তু ভারত তার প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌম সীমানার মধ্যে সে রাজনৈতিক মীমাংসাটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি তার নিজস্ব এখতিয়ারে রাখছে।
স্বৈরাচারী ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা বা গণতন্ত্র-দুষমন দুর্বৃত্তদের রাজনীতির কর্ণধার হওয়া কোন দেশেই অসম্ভব কিছু নয়। বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়। একাত্তরের পর বাংলাদেশেও সেটি বার বার হয়েছে। কিন্তু সে জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ সে দেশের মানচিত্র ভাঙ্গায় হাত দেয় না। এমন কাজ একমাত্র বিদেশী দুশমনদের হাতেই হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশটির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এরপরও ধৈর্যের সাথে দেশ গড়ার চেষ্ঠা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন, জনাব মোহম্মদ আলী বগুড়া ও জনাব সোহরাওয়ার্দী অপসারিত হয়েছেন, সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্রও রহিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, সোহরাওয়ার্দি বা অন্য কোন নেতাই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামেননি। এমনকি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও নয়।তাতে দেশ বেঁচে গেছে। আর দেশ বাঁচলেই তো রাজনীতি বাঁচে। কিন্তু একাত্তরে দেশের রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। দেশ না বাঁচায় রাজনীতিও বাঁচেনি। ৪৪ বছর পরও বঙ্গীয় এ দেশে পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে যে রাজনীতি ছিল সে রাজনীতি এখন আর জীবিত নাই। ১৯৫৪ বা ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের ন্যায় কোন নির্বচনের কথা তাই ভাবাই যায়না। একাত্তরের পূর্ব থেকেই দেশ দখলে গেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এবং “র” প্রতিপালিত এজেন্টদের হাতে। বি. রমনের বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’ বা অশোক রায়না রচিত Inside R&AW সে কিচ্ছাতেই ভরপুর। ভারতের স্ট্রাটেজিক লক্ষ্য হলো, বিশ্বের দরবারে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ। সে কথার স্বীকারোক্তি এসেছে মি. রমনের বইতে। তিনি এক্ষেত্রে “র” এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেনঃ An emerging power such as India, which is aspiring to take its place by 2020 among the leading powers of the world, has to have an external intelligence agency which has the ability to see, hear, smell and feel far and near. (B. Ramon, 2007). অনুবাদঃ ভারতের মত একটি উদীয়মান শক্তি যা ২০২০সালের মধ্যেই নিজেকে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলোর মাঝে অন্তর্ভূক্ত করার আশা পোষণ করে তাকে অবশ্যই বৈদেশিক বিষয়ক এমন একটি গোয়েন্দা এজেন্সীর অধিকারি হতে হবে যার সামর্থ্য থাকবে দূরের বা নিকটের ঘটনাবলিকে দেখা, শ্রবন করা,ঘ্রাণ নেয়া ও অনুধাবন করার।
ভারতের স্বপ্ন ও স্ট্রাটেজী
১৯৬২ সালে চীনের হাতে অপমানজনক পরাজয়ের পর ভারতের বৃহৎ শক্তি রূপে বেড়ে উঠার স্বপ্নে প্রচণ্ড ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৬৫ য়ে পাকিস্তান পরাজিত করতে না পারায় সে পুরোন অপমানের সাথে নতুন অপমান যোগ হয়। ভারত এরপর প্রচণ্ড ভাবে মনযোগী হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। তখন বিপুল বিনয়োগ হয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পঞ্চম বাহিনী বা ট্রোজান হর্স গড়ে তোলার কাজে।শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ মূলত ব্যবহৃত হয়েছেন সে লক্ষ্য পূরণে। তবে ভারতের লক্ষ্য নিছক পাকিস্তানকে শক্তিহীন করা নয়, সেটি হলো উপমহাদেশের মুসলিমদের শক্তিহীন করা। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও ভারতীয় স্ট্রাটেজী শেষ হয়নি। তাই বর্তমান স্ট্রাটেজী বাংলাদেশকেও দুর্বল ও লাগাতর অধীনত রাখা। সে সাথে দুর্বল করা প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকাকে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বাংলাদেশের আর্মির হাতে পোঁছতে দেয়নি। সেটি ছিল ভারতীয় পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্দ অংশ। প্রশ্ন হলো, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের যে পরিমান অস্ত্র মওজুদ ছিল,বাংলাদেশ সরকার কি আজও তা কিনতে পেরেছে? অথচ তা নিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের মুখে সামান্যতম ক্ষোভ নাই। ভারতীয় ট্রোজান হর্স বা পঞ্চম বাহিনীর লোকদের তা থাকার কথাও নয়।
ভারতের ভয়, পাকিস্তানের ন্যায় বাংলাদেশেরও যদি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে সে খড়গ একমাত্র তাদের ঘাড়েই পড়বে। তারা জানে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে কোন গুলী নিক্ষিপ্ত হলে সেটি ভারত ছাড়া অন্য কোথাও পড়বে না। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই ভারত অতি সতর্ক। ভারত চায়,বাংলাদেশ সরকারের নিঃশর্ত আনুগত্য। তাই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়াটাই অপরাধ। মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ সেটি ভাল করেই বোঝে। তাই দূর্নীতি দমন,গুম-খুন, চুরি-ডাকাতি,পদ্মা বা তিস্তার পানি, পদ্মা সেতু নির্মাণ বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আওয়ামী বাকশালীদের মাথা ব্যাথা নেই। তাদের মূল এজেণ্ডা ভারত-বিরোধীদের নির্মূল।ভারতের পক্ষ থেকে এটিই তাদের উপর অর্পিত দায়ভার। গদীতে থাকার স্বার্থে তাদের মূল কাজটি ভারতে খুশি রাখা। একারণেই, ভারতে মুসলিম নিধন বা মসজিদ ধ্বংসর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীগণ কোন প্রতিবাদ করে না। নিশ্চুপ থাকে কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকা বললে কি হবে, আওয়ামী-বাকশালী মহলটি সেখানে ভারতীয় অধিকৃতিকেই জায়েজ বলে মেনে নেয়।
মার্কিনী রোষানল
১৯৬২’য়ের ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য অপসারণের দাবী করে।ভারত সে দাবী মেনে না নেয়ায় ১৯৬২ এর ২০ই অক্টোবরে হামলা করে।২০শে নবেম্বরের মধ্যে লাদাখ এলাকার দুই হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের NEFA এলাকার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়।২৮ শে অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ.কেনেডি আইয়ুব খানকে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলে।কিন্তু তিনি তা করেননি।এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,চীন তখনও মার্কিন বিরোধীতার কারণে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি।পাকিস্তান সদস্য পদ লাভে চীনকে জোড়ালো সমর্থন করে।পেশোয়ারের কাছে ছিল সিআইয়ের গোপন ঘাঁটি,সেখান থেকে CIA U-2 গোয়েন্দা বিমান পাঠাতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে।পাকিস্তান সে ঘাঁটিও বন্ধ করে দেয়।এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড ক্রোধ চাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।অপর দিকে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয়ের পর ভারতও প্রতিশোধের পরিকল্পনা নেয়।এবং সেটি যতটা না চীনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের অঙ্গহানির।আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা নেয় আইয়ুব খানের অপসারণের ও পাকিস্তানকে দুর্বল করার।-(মাসুদুল হক)।প্রখ্যাত গবেষক ও পররাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী জনাব জি.ডব্লিও.চৌধুরী তার বই “Last Days of United Pakistan” বইতে দেখিয়েছেন,পাকিস্তানের কপালে একাত্তরে যা কিছু ঘটেছে সেটি নিছক একটি নির্বাচনের ফলাফল ছিল না। ছিল তৎকালীন আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল।তাতে যুক্ত ছিল নিছক ভারত নয়,সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
তখন র`এবং সি.আই.এ -উভয়েরই প্রয়োজন পড়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের পক্ষে নিজ খেলোয়াড়ের। সে স্থানটি পূরণ করে শেখ মুজিব। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানে তাঁকে নিজেদের খেলোয়াড় রূপে বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৫ই ও ৬ই ফেব্রেয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগ যোগ দেয়। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা জনাব নসরুল্লাহ খান। এ সভায় শেখ মুজিব হঠাৎ করেই ৬ দফা পেশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছেও বিষয়টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক মাসুদুল হকের কাছে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, “লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে মুজিব আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি। আমরা জানতাম না মুজিব এ ধরনের প্রস্তাব তুলবে।” -(মাসুদুল হক)
রহস্যময় ৬ দফা
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগ ৬ দফাপন্থী এবং ৬ দফা বিরোধী দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ জেলার মধ্যে ১৪ জেলা সভাপতি ৬ দফার বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। কিন্তু কে এবং কিভাবে ৬ দফা রচনা সে রহস্যের আজও সমাধা হয়নি। পাকিস্তানের গোয়ান্দা বিভাগ ডিআইবি এটিকে সিআইয়ের চাল হিসাবে মনে করে। ভাষানীপন্থী ন্যাপও সেটিই মনে করে। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যাল জেনারেল ছিলেন মিস্টার ব্রাউন। তিনি একই সাথে সিআইয়ের স্টেশন চীফেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাথে শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগের একাংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় মার্কিন কনসালে আরেক কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল চিশহোস। চিশহোসের বাসায় মাঝে মাঝে পার্টি দেয়া হত। এসব পার্টিতে বাছাই করা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা ও পদস্থ বাঙালী কর্মকর্তাদের দাওয়াত দেয়া হত। এভাবে একদিকে ভারতীয় ‘র`এর তৎপরতা যেমন চরম আকার ধারণা করেছিল,তেমনি তৎপরতা বেড়েছিল মার্কিন সিআইয়ের। পরে পাকিস্তান সরকার কর্নেল চিশহোসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা এ,টি,এস,সফদর জানান, শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে উঠার আগে ৬ দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দুস নামে একজন সিএসপি অফিসার তার হাতে তুলে দেন। উল্লেখ্য যে, রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আগরতলা মামলার একজন আসামী এবং শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের লোক।-(মাসুদুল হক)।
সাপ্তাহিক মেঘনার (১৬/১২/৮৫) সাথে এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ৬ দফা তিনি প্রথম দেখেন একটি টাইপকরা কাগজে শেখ মুজিবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাত্তরের ঘটনাবলী, পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশের সৃষ্টি - এসবের শুরু হয় মূলত ৬ দফা থেকে। অথচ এটির প্রণয়নে শেখ মুজিব নিজ দলের নেতাদের সাথেও কোনরূপ পরামর্শ করেননি। ৬ দফা প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন দলীয় সম্মেলন বা পরামর্শ সভাও হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেটিই প্রথাসিদ্ধ রীতি। কিন্তু সেটি প্রণিত হয় রুহুল কুদ্দুসের ন্যায় একজন সন্দেহভাজন চরিত্রের মানুষের দ্বারা যিনি বিদেশী শক্তির বিশ্বস্ত বন্ধুরূপে বহু পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন।
কোন পরিকল্পনা যখন বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ রূপে অগ্রসর হয় তখন সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমুহ কখনোই প্রকাশ্যে নেয়া হয় না। দেশবাসীকে ও দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়ায় জড়িত করা হয় না। সেটি ৬ দফা প্রণয়নের সময় যেমন হয়নি, তেমনি পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্যাপারেও হয়নি। অথচ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল প্রকাশ্য জনসভায়। তার সাথে সম্পৃক্ত ছিল মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় নেতাকর্মীগণ। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা প্রণয়ন ও পাকিস্তান ভাঙ্গার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও কোন প্রকাশ্য বৈঠক হয়নি। ইতিহাসের লেখকদের দায়িত্ব হলো, এসব সিদ্ধান্তের গুঢ় রহস্যগুলি উদঘাটন করা। কারা ছিল নেপথ্যের নায়ক বা ভিলেন তাদের খুঁজে বের করা এবং সত্য থেকে মিথ্যাগুলোকে সতর্কতার সাথে আলাদা করা। বাংলাদেশে ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা একাজটিও হয়নি। তারা বরং অতি পরিচিত মিথ্যাগুলোকেও পাঠ্য তালিকাভুক্ত করেছে। এভাবে মিথ্যাচর্চাও ইতিহাসের পাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ‘র’
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে র’য়ের কি ভূমিকা ছিল -সে বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “Inside RAW” বইতে। সেটি এরকমঃ...কিন্তু ততদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবপন্থী একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট ও মুজিবপন্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহিত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কর্নেল মেনন ( ইনি হলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’এর দিল্লিস্থ পাকিস্তান ডেস্কের দায়িত্বশীল। তার আসল নাম কর্নেল শংকর নায়ার। মেনন তার ছদ্দ নাম) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। তিনি আগরতলা বৈঠকের পর ইঙ্গিত পান যে, মুজিবপন্থী গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। কর্নেল মেনন তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তার সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।.. তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকাস্থ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস অস্ত্রাগারে হামালা চালায়। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এই পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ কর্নেল মেনন ধারণা করেছিলেন। এর কয়েক মাস পর ৬ই জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসাবে জড়িত করা হয়। এই মামলাই পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে পরিচিত পায়।-(অশোকা রায়না, ১৯৯৬)
২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। যারা মনে করেন,পাকিস্তান আর্মির মিলিটারি এ্যাকশনের পরই মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সিদ্ধান্ত নেন -তাদের ধারণা আদৌ সত্য নয়। অশোক রায়না লিখেছেন, “কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমন ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী র’য়ের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিবিড় যোগাযোগ ঐ সমস্ত তরুণ, অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুণ ভাবে বৃদ্ধি করে। ... ইতিমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এজেন্টদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়, তখনই সেই ভয়াবহ ‘কালো রাত্রী’(২৫ শে মার্চ)’র পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।- (অশোক রায়না, ১৯৯৬)।একাত্তরের যুদ্ধটির শুরু তাই একাত্তরে নয়, শুরুটি হয়েছিল বহু পূর্ব থেকেই। তবে সব সময়ই এর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছিল ভারত। এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষ ও তার গুপ্তচর সংস্থা তা থেকে অজ্ঞ ছিল না। তবে অজ্ঞ রাখা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে। প্রতিটি ষড়যন্ত্রে তো তাই হয়ে থাকে।
গ্রন্থপঞ্জি
মাসুদুল হক; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র’ এবং সিআইএ,মৌল প্রকাশনী ৩৮/২ক, বাংলা বাজার, ঢাকা ১১০০।
অলি আহাদ; জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি: ১২৫,মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০।
B.Ramon, 2007; The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane, Lance Publishers & Distributors 2/42 Sarvapriya Vihar, New Delhi 11016.
অশোকা রায়না,১৯৯৬; ইনসাইড র’ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায়, (বাংলা অনুবাদ) অনুবাদ,লেঃ (অবঃ) আবু রুশদ রুমী প্রকাশনী।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাটি ভারতীয়। আওয়ামী লীগ ব্যবহৃত হয়েছে সে ভারতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের হাতিয়ার রূপে। অথচ গণতান্ত্রিক সংগঠনের ক্ষেত্রে সেটি হওয়ার কথা নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল কথা রাজনীতিতে স্বচ্ছতা; বিদেশী এজেন্ডা পালন বা বিদেশী গুপ্তচরদের সাথে সংশ্লিষ্টতার বদলে গুরুত্ব পায় জনগণের সাথে সংশ্লিষ্টতা। অথচ শেখ মুজিবের রাজনীতির সাথে নিজ দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা ছিল অতি সামান্যই। কখনো তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন;সেটি ভাল না লাগায় সাথে সাথে প্রেসিডেন্টও হয়েছেন। কিন্তু তা নিয়ে দলীয় নেতাদের ডেকে পরামর্শ নেননি। সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং আবির্ভুত হয়েছেন নির্ভেজাল স্বৈরাচারী রূপে। স্রেফ ভোটের জন্য জনগণের কাছে ধর্ণা দিয়েছেন, কিন্তু দেশের ভাগ্য নির্ধারণে দেশের বিজ্ঞজন বা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা করেননি। সেটি একাত্তরে যেমন নয়, তেমনি একাত্তরের আগে বা পরেও নয়। পরামর্শ করেছেন ভারতীয় গুপ্তচরদের সাথে। সে লক্ষ্যে ষাটের দশকেই তিনি ভারতে গেছেন। ভারত সরকার ১৯৪৭ থেকেই পাকিস্তান ভাঙ্গার চেষ্টায় ছিল। শেখ মুজিব সে কাজে ভারতের সহযোগী হন। এ নিয়ে শুধু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’য়ের কর্মকর্তাগণই শুধু মুখ খুলেনি, মুখ খুলেছে বাংলাদেশের বহুনেতাও।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতীয় নাশকতা নিয়ে এক কালের আওয়ামী লীগ নেতা ও দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও পরবর্তীতে জাতীয় লীগ নেতা জনাব অলি আহাদ বলেন, “১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানকালে ময়মনসিংহ নিবাসী রাজবন্দীদ্বয় আব্দুর রহমান সিদ্দিকী ও আবু সৈয়দের নিকট হইতে আমি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিষয়াদী অবগত হই। ভারতে মুদ্রিত বিচ্ছিন্নতাবাদ সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন ময়মনসিংহ ও বিভিন্ন জেলায় বিতরণকালেই তাহারা গ্রেফতার হইয়াছিলেন।”-(অলি আহাদ)। যে মিথ্যাচারটি একাত্তরে দেশ জুড়ে ছড়ানো হয়েছে তা হলো, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশের সৃষ্টি মূলত মুক্তিবাহিনীর অবদান। ভারতের নাম তারা সহজে মুখে আনে না। পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশটি সৃষ্টির মূল কাজটি যে নেহায়েতই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাজ -সে কথাটি ভারতীয় কতৃপক্ষও খুব একটা জোরে শোরে প্রচার করে না। তারা জানে,সেটি প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের কাছেই শুধু নয়, মুসলিম বিশ্বেও ভারত ভিলেন রূপে চিত্রিত হবে। এজন্যই বাংলাদেশ সৃষ্ঠিকে তারা বাংলাদেশেীদের একান্ত নিজেদের কাজ বলে চালিয়ে দিতে চায়। কিন্তু ভারত সরকার সত্য বিষয়টি লুকাতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিপুল সংখ্যক রাজাকারদের কারণে সে পরিকল্পনা সফল হতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর কাঁধে বন্দুক রেখে পাকিস্তান বাহিনী বা রাজাকারদের পরাজয় করা সম্ভব হয়নি। একাত্তরের শেষদিকে তাই স্বয়ং ভারতীয় বাহিনীকেই যুদ্ধে নামতে হয়েছে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙালী ও পাকিস্তানীদের লড়াই না হয়ে পাকিস্তান ও ভারতের সরাসরি লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। এ লড়ায়ে পাকিস্তানের পরাজয়ের ফলে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ। সেটি আরো পরিস্কার হয়, রেসকোর্সের ময়দানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল অরোরা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বভাগের কমান্ডার জেনারেল নিয়াজীর মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে।এ চুক্তির মধ্য দিয়ে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
রেসকোর্সে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর উপস্থিতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যে অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ছিল সেটির সুস্পষ্ট দলিল হলো ১৬ই ডিসেম্বরের এ চুক্তি। ভারত যেভাবে তার আগ্রাসী চরিত্রটি বিশ্ববাসীর কাছ থেকে লুকাতে চেয়েছিল সেটি সম্ভব হয়নি। ফলে মুসলিম বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশকে প্রথমে স্বীকৃতি দেয়নি। অথচ এর আগে বা পরে অন্য কোন মুসলিম দেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি নিয়ে কখনোই্ এরূপ ঘটনা ঘটেনি। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুসলিম দেশকে তাবত মুসলিম দেশ সাথে সাথে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, একটি মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা-প্রাপ্তি শুধু সে দেশটির জনগণের জন্যই নয়,সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছেও সেটি অতিশয় আনন্দের ঘটনা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। না হওয়ার কারণ, তাদের কাছে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তান রূপে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপসারণ এবং পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের পরই অন্য মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানে এগিয়ে আসে। অথচ এ বিষয়টি বাংলাদেশের ইতিহাসে নাই, ছাত্রদেরকে ইচ্ছা করেই তা পড়ানো হয় না। লক্ষ্যণীয় হলো ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী যে সত্যটিকে লুকাতে পারিনি, বাংলাদেশের ইতিহাসের বইয়ে সেটিই লুকানো হচ্ছে। পাঠ্য পুস্তকে মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডারদের কোথায় কে লড়াই করেছেন সে বিবরণ থাকলেও ভারতীয় বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য ও তার কমান্ডারগণ কে কোথায় কি ভাবে যুদ্ধ করলো –সে বিবরণ নাই। বিবরণ নাই, ভারতীয় বিমান ও নৌবাহিনীর ভূমিকার। একাত্তরের যুদ্ধে কতজন ভারতীয় সৈন্য প্রাণ দিয়েছে, কতজন আহত হয়েছে -স্কুলের পাঠ্যবইয়ে সে তথ্যও নাই। বুঝা যায়, সরকার ইচ্ছা করেই কিছুই লুকাতে চেয়েছে। সেটি বাংলাদেশের জন্মে ভারতের ভূমিকার কথা। কারণটিও বোধগম্য। ষড়যন্ত্র কথা তো প্রকাশ করা যায় না; সেগুলো গোপন রাখাই নিয়ম।একাত্তরের যুদ্ধের বহু ঘটনাই তা ইতিহাসের বইয়ে নাই।
ইতিহাসের বইয়ে যে সত্য বিষয়টি কখনোই বলা হয়নি না তা হলো, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশের পূর্বে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৯ মাসে পুরা বাংলাদেশ দূরে থাক একটি জেলা, একটি মহকুমা বা একটি থানাও মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। কোন জেলা শহরে মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্য দিবালোকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে ঘুরতে পারিনি। একাত্তরের মূল লড়াইটি লড়েছে ভারতীয় সেনা বাহিনী। তবে ভারত শুরু থেকেই একটি মুসলিম দেশ ভাঙ্গার অপরাধ কাঁধে নিতে চায়নি। কারণ এটি জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। একই কারণে চীনা বা রুশ বাহিনী ভিয়েতনামে প্রবেশ করেনি। একটি দেশের ভূগোলে কিভাবে পরিবর্তন আনতে হবে জাতিসংঘের বিধানে তার একটি বিধিবদ্ধ আইন আছে। সেটি কখনই কোন বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের মাধ্যমে নয়। ভারত-ভাগের পূর্বে সে ইস্যুর উপর গণভোট হয়েছে, পাকিস্তানের ১৯৭১’য়ের নির্বাচন সেরূপ ছিল না। নির্বাচন হয়েছিল স্বায়ত্বশাসনের দাবীতে। কিন্তু ভারত সে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। এজন্য যুদ্ধ চলা কালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদের অধিকাংশ সদস্য পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতিসমর্থন জানিয়েছে। ভারতের পক্ষে থেকেছে শুধু সোভিয়েত রাশিয়া ও তার কিছু মিত্র দেশ।
লুকাতে পারিনি অপরাধ
ইতিহাসে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে -এ ভয়েই ভারত নিজেদের অর্থ, অস্ত্র ও লোকবল দ্বারা পাকিস্তান ভাঙ্গার এ যুদ্ধকে বাঙালীদের মুক্তিযুদ্ধ বলে চালানোর চেষ্টা করেছে। ভারতীয় মুসলিমগণ পাকিস্তানের উপর এমন হামলার ঘোরতর বিরোধী ছিল। তবে ভারতীয় মুসলিমগণ যাই ভাবুক, ভারতের দুশ্চিন্তার মূল কারণ, পাকিস্তানের উপর ভারতের আগ্রাসন অন্যদেরও নৈতিক বৈধতা দিবে ভারত-ভাঙ্গার যুদ্ধে অংশ নেয়ার। এজন্যই রেসকোর্সের ময়দানে জেনারেল ওসমানীকে শামিল করাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাসঙ্গিক ভাবলেও ভারতের কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে তা ছিল বড় রকমের ভুল। মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাঁধে বন্দুক রাখার ন্যায় তাঁর উপস্থিতিরও লোক-দেখানো রাজনৈতিক প্রয়োজন ছিল। প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিবিদ এবং ভারতীয় ইনটেলিজেন্স এর সাবেক প্রধান Mr.J.N. Dixit তার রচিত “Liberation and Beyond” বইতে জেনারেল ওসমানীকে রেসকোর্সে শামিল না করাকে “major political mistake” বলে অভিহিত করেছেন। বাস্তবতা হলো, অতি সতর্কতার সাথে খুন করার পরও সব খুনিই খুনের আলামত ঘটনা স্থলে রেখে যায়। অপরাধ বিজ্ঞানীদের তাই বিশ্বাস, তদন্তে আন্তুরিক হলে কোন খুনিই গ্রেফতার এবং সে সাথে খুনের বিচার থেকে রেহাই পেতে পারে না। অন্যদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় আগ্রাসনের সে অপরাধ যতই লুকানোর চেষ্ঠা করুক, শত শত বছর ধরে ভারত শুধু বাংলাদেশী মুসলিমদের কাছেই নয়, সমগ্র বিশ্বের মুসলিমদের কাছেও শত্রু রূপে চিহ্নিত হবে -তা নিয়ে কি সন্দেহ আছে?
বাংলাদেশ সৃষ্টি নিয়ে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র”য়ের সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মিস্টার বি. রমন লিখেছেনঃ “The R&AW’s success in East Pakistan, which led to the birth of Bangladesh, would not have been possible without the leadership of Kao and the ideas of Nair,”-(B.Ramon, 2007)। অনুবাদঃ “পূর্ব পাকিস্তানে ‘র’য়ের সাফল্যই জন্ম দেয় বাংলাদেশের; এবং কাউ’য়ের নেতৃত্ব এবং নায়ার’য়ের পরিকল্পনা ছাড়া সে সাফল্য অর্জন সম্ভব হত না।” একাত্তর নিয়ে মিস্টার বি. রমন’য়ের মূল্যায়নে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে মুজিবের জন্য তারা কোন স্থানই রাখেনি। অথচ বাঙালী জাতীয়তাবাদী পক্ষটি “র”এর ভূমিকার কথা মুখে আনে না। এরও গুঢ় রহস্য রয়েছে। কারণ তারা নিজেরাও জানে,এ সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেলে আজ হোক কাল মুসলিম ইতিহাসে তারা অপরাধী রূপে চিত্রিত হবেই। কারণ ভারতের ন্যায় একটি শত্রুদেশের গুপ্তচর সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্টতা কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের জন্যই সুনাম বয়ে আনে না। যেসব ভারতীয় সেনা অফিসার ও সৈনিক কাশ্মীরে মুসলিম গণহত্যার নায়ক, তারাই একাত্তরে বাংলাদেশের সৃষ্টিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছিল এবং মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ট্রেনিং দিয়েছিল। কাশ্মীরের সে ভারতীয় খুনিদের কথা আওয়ামী ঘরানার নেতা-কর্মীরা আজ মুখেই আনে না। বরং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নিজেদের অর্জন বলে অহংকার দেখায়। অথচ র’য়ের দাবি,তাদের ভুমিকাই হলো মূল। এ ব্যাপারে মিস্টার বি. রমন তার বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’তে লিখেছেনঃ “The IB (Intellegence Bureau) before 1968 & the R&AW thereafter had built up a network of relationship with many political leaders and government officials of East Pakistan. The networking enabled the R&AW and the leaders and officials of East Pakistan to quickly put in position the required infrastructure for a liberation struggle consisting of a parallel government with its own fighters trained by the Indian security forces and its own bureaucracy. .. The only sections of the local population, who were hostile to India and its agencies, were the Muslim migrants from Bihar.” -(B.Ramon, 2007)। অনুবাদঃ ১৯৬৮ এর পূর্বে আইবি (ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো) এবং পরবর্তীতে ‘র’ পূর্ব পাকিস্তানের বহু রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। সে নেটওয়ার্কটি ‘র’ এবং (আওয়ামী লীগের) রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয় ত্বরিৎ বেগে নিজেদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোদ্ধা ও আমলাদের দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং পাল্টা সরকার গঠনের জন্য একটি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরিতে।….স্থানীয় লোকদের মধ্যে একমাত্র তারাই ভারত এবং তার এজেন্সীর প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল যারা বিহার থেকে আগত মোহাজির।
প্রস্তুতিটি বহু বছরের
মিস্টার বি. রমনের কথায় এটি সুস্পষ্ট যে, একাত্তরে যা ঘটেছে তার পরিকল্পনা একাত্তরে হয়নি। প্রস্তুতিটি বহু বছরের। পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার কাজ ত্বরান্বিত করার লক্ষে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা আই,বি এবং ১৯৬৮এর পর “র” ষাটের দশকের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিচ্ছিন্ন আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাঙালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে তারা বিস্তৃত নেটওয়ার্ক এবং অবকাঠামো গড়ে তোলে। এমনকি ট্রেনিং দেয়ার কাজও শুরু করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা Director of Intelelligence Bureau (DIB) জানতে পারে যে কলকাতার ভবানীপুর এলাকার একটি বাড়ীতে - যা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার অপারেশনাল সদর দফতর, সেখানে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে একটি সংগঠন কাজ করছে। তাদের লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করা। -(মাসুদুল হক)।
মিস্টার বি. রমনের লেখা থেকে প্রমাণিত হয়, পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের রিপোর্ট আদৌ মিথ্যা ছিল না। এ গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী রূপে দেখা ভারতের কাম্য ছিল না। শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের পিছনে তারা যে বিশাল পুঁজি বিনিয়োগ করেছিল –বিশেষ করে ১৯৭০য়ের নির্বাচনে তার মূল লক্ষ্যটি ছিল পাকিস্তান ভাঙ্গা, শেখ মুজিবকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নয়। শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হলে মিস্টার বি. রমনের কথা অনুসারে র’ যেভাবে পূর্বপাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা এঁটেছিল তা সফল হত না। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার পক্ষ থেকে সে সময় ময়দানে মুজিবই একমাত্র খেলাওয়াড় ছিলেন না, ময়দানে ছিল আরো অনেকেই। ছাত্রলীগের নেতৃপর্যায়ে এদের পাল্লাই ছিল ভারি। তাদের দায়িত্ব ছিল শেখ মুজিবকে নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে “র”য়ের সে পরিকল্পনাটি থেকে কোনরূপ বিচ্যুত না হন। বস্তুত শেখ মুজিব তখন নিজেই এক পরাধীন ব্যক্তি, তিনি ছিলেন ভারতীয় “র” এবং ছাত্রলীগ নেতাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তখন তার পক্ষে “র”এর কাছে কৃত ওয়াদা থেকে পিছুটান দেয়ার সামান্যতম সুযোগও ছিল না। বহু আগেই ছাত্রলীগের নেতারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছিল। মুজিবের কাজ ছিল একজন জিম্মির ন্যায় বিনা প্রতিবাদে তাদের অনুসরণ করা। মুজিব সেটি করেছিলেনও। গাড়ীতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা টানিয়ে ইয়াহিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আপোষে শেখ মুজিবের আদৌ কোন আগ্রহ ছিল না। কারণ তাতে আগ্রহ ছিল না ভারতের। আর ভারতের যাতে আগ্রহ নেই তাতে মুজিবেরই বা আগ্রহ সৃষ্টি হয় কি করে? ২৩ মার্চের বৈঠকে মুজিবের ৬ দফা ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টো উভয়ই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও মুজিবের আগ্রহ ছিল না পাকিস্তানের অখণ্ডতা নিয়ে আলোচনাকে আরো সামনে এগিয়ে নেয়ার। ছাত্রলীগের নেতারা ইয়াহিয়া খান ও ভূট্টোর সাথে মুজিবের বৈঠককে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে। এবং তা নিয়ে আওয়ামী-বাকশালী শিবিরে কোন দ্বিমত নেই। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন নিয়ে এজন্যই মুজিব আলোচনায় রাজী ছিল না। ফলে বৈঠক ভেঙ্গে যায়। কারণ ভারতীয় র’এবং ছাত্রলীগ নেতাদের গোলপোষ্ট তখন ভিন্ন। সেটি ৬ দফা নয়, বরং এক দফা তথা পাকিস্তান ভাঙ্গা। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো সেটি বুঝতে পারে এবং মার্চের আলোচনা ব্যর্থ হয়।
কিন্তু এ বিষয়ে অতিশয় বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্গতি হলো তাদের,যারা মনে করে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে স্রেফ স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার ভূলের কারণে। সে ভূলটি ছিল মুজিবের হাতে ক্ষমতা না দেয়া। যেন মুজিব ও তার দল পাকিস্তান রক্ষার জন্য দু*ই*পায়ে খাড়া ছিল! এবং মুজিবে হাতে ক্ষমতা দিলেই যেন পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া থেকে বেঁচে থাকে! ভারত যে পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্যাপারে কতটা আপোষহীন ছিল সেটি পরবর্তীতে আরো পরিস্কার হয়ে উঠে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া খান আন্তরিক ভাবেই চেষ্টা করেছিলেন। এমন কি যুদ্ধ এড়াতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশ্নে গণভোটের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের পক্ষে এর চেয়ে বেশী ছাড় দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ভারত তাতে রাজী হয়নি। বরং সেটি হতে দেয়নি। এমন কি যে সব উদ্বাস্তু ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের ফেরতও আসতে দেয়নি। এব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিন্জার লিখেছেন, “Despite Yahya’s proclamation of an amnesty India made the return of refugees to East Pakistan depend on a political settlement there. But India reserved the right to define what constituted an acceptable political settlement on the sovereign territory of its neighbor.” (The White House Years, page 858). অনুবাদঃ ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে একটি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শণের পরও ভারত বলছে উদ্বাস্তুদের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়াটি নির্ভর করছে রাজনৈতিক মীমাংসার উপর। কিন্তু ভারত তার প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌম সীমানার মধ্যে সে রাজনৈতিক মীমাংসাটি গ্রহণযোগ্য হওয়ার বিষয়টি তার নিজস্ব এখতিয়ারে রাখছে।
স্বৈরাচারী ব্যক্তির ক্ষমতায় আসা বা গণতন্ত্র-দুষমন দুর্বৃত্তদের রাজনীতির কর্ণধার হওয়া কোন দেশেই অসম্ভব কিছু নয়। বিশ্বের বহু দেশেই সেটি হয়। একাত্তরের পর বাংলাদেশেও সেটি বার বার হয়েছে। কিন্তু সে জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকগণ সে দেশের মানচিত্র ভাঙ্গায় হাত দেয় না। এমন কাজ একমাত্র বিদেশী দুশমনদের হাতেই হতে পারে। পাকিস্তানে গণতন্ত্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র শুরু হয় দেশটির প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই। দেশের প্রায় সকল রাজনৈতিক দল এরপরও ধৈর্যের সাথে দেশ গড়ার চেষ্ঠা করে গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে জনাব নাজিমুদ্দিন, জনাব মোহম্মদ আলী বগুড়া ও জনাব সোহরাওয়ার্দী অপসারিত হয়েছেন, সামরিক আইন জারি হয়েছে এবং দেশের শাসনতন্ত্রও রহিত হয়েছে। কিন্তু সেজন্য নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী বগুড়া, সোহরাওয়ার্দি বা অন্য কোন নেতাই পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে নামেননি। এমনকি চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ও নয়।তাতে দেশ বেঁচে গেছে। আর দেশ বাঁচলেই তো রাজনীতি বাঁচে। কিন্তু একাত্তরে দেশের রাজনীতি আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদদের হাতে থাকেনি। দেশ না বাঁচায় রাজনীতিও বাঁচেনি। ৪৪ বছর পরও বঙ্গীয় এ দেশে পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে যে রাজনীতি ছিল সে রাজনীতি এখন আর জীবিত নাই। ১৯৫৪ বা ১৯৭০’য়ের নির্বাচনের ন্যায় কোন নির্বচনের কথা তাই ভাবাই যায়না। একাত্তরের পূর্ব থেকেই দেশ দখলে গেছে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এবং “র” প্রতিপালিত এজেন্টদের হাতে। বি. রমনের বই The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane’ বা অশোক রায়না রচিত Inside R&AW সে কিচ্ছাতেই ভরপুর। ভারতের স্ট্রাটেজিক লক্ষ্য হলো, বিশ্বের দরবারে বৃহৎ শক্তির মর্যাদা লাভ। সে কথার স্বীকারোক্তি এসেছে মি. রমনের বইতে। তিনি এক্ষেত্রে “র” এর ভূমিকার কথাও তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেনঃ An emerging power such as India, which is aspiring to take its place by 2020 among the leading powers of the world, has to have an external intelligence agency which has the ability to see, hear, smell and feel far and near. (B. Ramon, 2007). অনুবাদঃ ভারতের মত একটি উদীয়মান শক্তি যা ২০২০সালের মধ্যেই নিজেকে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় শক্তিগুলোর মাঝে অন্তর্ভূক্ত করার আশা পোষণ করে তাকে অবশ্যই বৈদেশিক বিষয়ক এমন একটি গোয়েন্দা এজেন্সীর অধিকারি হতে হবে যার সামর্থ্য থাকবে দূরের বা নিকটের ঘটনাবলিকে দেখা, শ্রবন করা,ঘ্রাণ নেয়া ও অনুধাবন করার।
ভারতের স্বপ্ন ও স্ট্রাটেজী
১৯৬২ সালে চীনের হাতে অপমানজনক পরাজয়ের পর ভারতের বৃহৎ শক্তি রূপে বেড়ে উঠার স্বপ্নে প্রচণ্ড ভাটা পড়ে। এরপর ১৯৬৫ য়ে পাকিস্তান পরাজিত করতে না পারায় সে পুরোন অপমানের সাথে নতুন অপমান যোগ হয়। ভারত এরপর প্রচণ্ড ভাবে মনযোগী হয় পাকিস্তান ভাঙ্গার কাজে। তখন বিপুল বিনয়োগ হয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পঞ্চম বাহিনী বা ট্রোজান হর্স গড়ে তোলার কাজে।শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ মূলত ব্যবহৃত হয়েছেন সে লক্ষ্য পূরণে। তবে ভারতের লক্ষ্য নিছক পাকিস্তানকে শক্তিহীন করা নয়, সেটি হলো উপমহাদেশের মুসলিমদের শক্তিহীন করা। তাই একাত্তরে পাকিস্তান ভেঙ্গে গেলেও ভারতীয় স্ট্রাটেজী শেষ হয়নি। তাই বর্তমান স্ট্রাটেজী বাংলাদেশকেও দুর্বল ও লাগাতর অধীনত রাখা। সে সাথে দুর্বল করা প্রতিবেশী নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকাকে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করার লক্ষ্যেই একাত্তরে পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া বহু হাজার কোটি টাকার অস্ত্র বাংলাদেশের আর্মির হাতে পোঁছতে দেয়নি। সেটি ছিল ভারতীয় পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্দ অংশ। প্রশ্ন হলো, একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের যে পরিমান অস্ত্র মওজুদ ছিল,বাংলাদেশ সরকার কি আজও তা কিনতে পেরেছে? অথচ তা নিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের মুখে সামান্যতম ক্ষোভ নাই। ভারতীয় ট্রোজান হর্স বা পঞ্চম বাহিনীর লোকদের তা থাকার কথাও নয়।
ভারতের ভয়, পাকিস্তানের ন্যায় বাংলাদেশেরও যদি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পায় তবে সে খড়গ একমাত্র তাদের ঘাড়েই পড়বে। তারা জানে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে কোন গুলী নিক্ষিপ্ত হলে সেটি ভারত ছাড়া অন্য কোথাও পড়বে না। তাই বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরু থেকেই ভারত অতি সতর্ক। ভারত চায়,বাংলাদেশ সরকারের নিঃশর্ত আনুগত্য। তাই ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদি হওয়াটাই অপরাধ। মুজিব এবং তার আওয়ামী লীগ সেটি ভাল করেই বোঝে। তাই দূর্নীতি দমন,গুম-খুন, চুরি-ডাকাতি,পদ্মা বা তিস্তার পানি, পদ্মা সেতু নির্মাণ বা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে আওয়ামী বাকশালীদের মাথা ব্যাথা নেই। তাদের মূল এজেণ্ডা ভারত-বিরোধীদের নির্মূল।ভারতের পক্ষ থেকে এটিই তাদের উপর অর্পিত দায়ভার। গদীতে থাকার স্বার্থে তাদের মূল কাজটি ভারতে খুশি রাখা। একারণেই, ভারতে মুসলিম নিধন বা মসজিদ ধ্বংসর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীগণ কোন প্রতিবাদ করে না। নিশ্চুপ থাকে কাশ্মীরে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অধিকৃত কাশ্মীরকে বিতর্কিত এলাকা বললে কি হবে, আওয়ামী-বাকশালী মহলটি সেখানে ভারতীয় অধিকৃতিকেই জায়েজ বলে মেনে নেয়।
মার্কিনী রোষানল
১৯৬২’য়ের ১৩ অক্টোবর চীন ভারতকে কাশ্মীরের লাদাখ সীমান্ত থেকে তার সৈন্য অপসারণের দাবী করে।ভারত সে দাবী মেনে না নেয়ায় ১৯৬২ এর ২০ই অক্টোবরে হামলা করে।২০শে নবেম্বরের মধ্যে লাদাখ এলাকার দুই হাজার বর্গমাইল এবং তিব্বত সীমান্তের NEFA এলাকার প্রায় দেড় হাজার বর্গমাইল এলাকা দখল করে নেয়।২৮ শে অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ.কেনেডি আইয়ুব খানকে ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বলে।কিন্তু তিনি তা করেননি।এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে,চীন তখনও মার্কিন বিরোধীতার কারণে জাতিসংঘের সদস্য হতে পারেনি।পাকিস্তান সদস্য পদ লাভে চীনকে জোড়ালো সমর্থন করে।পেশোয়ারের কাছে ছিল সিআইয়ের গোপন ঘাঁটি,সেখান থেকে CIA U-2 গোয়েন্দা বিমান পাঠাতো রাশিয়ার অভ্যন্তরে।পাকিস্তান সে ঘাঁটিও বন্ধ করে দেয়।এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রচণ্ড ক্রোধ চাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।অপর দিকে ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্তে যুদ্ধে চীনের হাতে পরাজয়ের পর ভারতও প্রতিশোধের পরিকল্পনা নেয়।এবং সেটি যতটা না চীনের বিরুদ্ধে তার চেয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে।পরিকল্পনা নেয় পাকিস্তানের অঙ্গহানির।আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পনা নেয় আইয়ুব খানের অপসারণের ও পাকিস্তানকে দুর্বল করার।-(মাসুদুল হক)।প্রখ্যাত গবেষক ও পররাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী জনাব জি.ডব্লিও.চৌধুরী তার বই “Last Days of United Pakistan” বইতে দেখিয়েছেন,পাকিস্তানের কপালে একাত্তরে যা কিছু ঘটেছে সেটি নিছক একটি নির্বাচনের ফলাফল ছিল না। ছিল তৎকালীন আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের ফলাফল।তাতে যুক্ত ছিল নিছক ভারত নয়,সোভিয়েত রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও।
তখন র`এবং সি.আই.এ -উভয়েরই প্রয়োজন পড়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের পক্ষে নিজ খেলোয়াড়ের। সে স্থানটি পূরণ করে শেখ মুজিব। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই পাকিস্তানের রাজনীতির ময়দানে তাঁকে নিজেদের খেলোয়াড় রূপে বেছে নেয়। ১৯৬৬ সালের ৫ই ও ৬ই ফেব্রেয়ারিতে লাহোরে আইয়ুব বিরোধী দলসমুহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে জনাব নুরুল আমীনের নেতৃত্বাধীন এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামী এবং আওয়ামী লীগ যোগ দেয়। তখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন পাঞ্জাবের নবাবজাদা জনাব নসরুল্লাহ খান। এ সভায় শেখ মুজিব হঠাৎ করেই ৬ দফা পেশ করেন। এমনকি আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় লোকদের কাছেও বিষয়টি বিস্ময়ের জন্ম দেয়। সাংবাদিক মাসুদুল হকের কাছে এক সাক্ষাৎকারে তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, “লাহোর যাত্রার প্রাক্কালে এমনকি লাহোরে গিয়েও এ সম্পর্কে মুজিব আমাদের সঙ্গে আলাপ করেননি। আমরা জানতাম না মুজিব এ ধরনের প্রস্তাব তুলবে।” -(মাসুদুল হক)
রহস্যময় ৬ দফা
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে আওয়ামী লীগ ৬ দফাপন্থী এবং ৬ দফা বিরোধী দুই খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৭ জেলার মধ্যে ১৪ জেলা সভাপতি ৬ দফার বিরোধীতা করে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে। কিন্তু কে এবং কিভাবে ৬ দফা রচনা সে রহস্যের আজও সমাধা হয়নি। পাকিস্তানের গোয়ান্দা বিভাগ ডিআইবি এটিকে সিআইয়ের চাল হিসাবে মনে করে। ভাষানীপন্থী ন্যাপও সেটিই মনে করে। সে সময় ঢাকায় মার্কিন কনস্যাল জেনারেল ছিলেন মিস্টার ব্রাউন। তিনি একই সাথে সিআইয়ের স্টেশন চীফেরও দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সাথে শেখ মুজিব ও ছাত্রলীগের একাংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সময় মার্কিন কনসালে আরেক কর্মকর্তা ছিলেন কর্নেল চিশহোস। চিশহোসের বাসায় মাঝে মাঝে পার্টি দেয়া হত। এসব পার্টিতে বাছাই করা রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা ও পদস্থ বাঙালী কর্মকর্তাদের দাওয়াত দেয়া হত। এভাবে একদিকে ভারতীয় ‘র`এর তৎপরতা যেমন চরম আকার ধারণা করেছিল,তেমনি তৎপরতা বেড়েছিল মার্কিন সিআইয়ের। পরে পাকিস্তান সরকার কর্নেল চিশহোসকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং দেশ থেকে বহিষ্কার করে দেয়। পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তা এ,টি,এস,সফদর জানান, শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন তেজগাঁও বিমান বন্দরে লাহোরগামী বিমানে উঠার আগে ৬ দফা প্রস্তাবের একটি টাইপ করা কপি রুহুল কুদ্দুস নামে একজন সিএসপি অফিসার তার হাতে তুলে দেন। উল্লেখ্য যে, রুহুল কুদ্দুস ছিলেন আগরতলা মামলার একজন আসামী এবং শেখ মুজিবের ইনার সার্কেলের লোক।-(মাসুদুল হক)।
সাপ্তাহিক মেঘনার (১৬/১২/৮৫) সাথে এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগ নেতা জনাব আব্দুল মালেক উকিল বলেন, ৬ দফা তিনি প্রথম দেখেন একটি টাইপকরা কাগজে শেখ মুজিবের পকেটে ১৯৬৬ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় কনভেনশনে যাওয়ার পথে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা হলো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একাত্তরের ঘটনাবলী, পাকিস্তান ভাঙ্গা ও বাংলাদেশের সৃষ্টি - এসবের শুরু হয় মূলত ৬ দফা থেকে। অথচ এটির প্রণয়নে শেখ মুজিব নিজ দলের নেতাদের সাথেও কোনরূপ পরামর্শ করেননি। ৬ দফা প্রণয়নের প্রাক্কালে কোন দলীয় সম্মেলন বা পরামর্শ সভাও হয়নি। অথচ গণতান্ত্রিক রাজনীতির সেটিই প্রথাসিদ্ধ রীতি। কিন্তু সেটি প্রণিত হয় রুহুল কুদ্দুসের ন্যায় একজন সন্দেহভাজন চরিত্রের মানুষের দ্বারা যিনি বিদেশী শক্তির বিশ্বস্ত বন্ধুরূপে বহু পূর্ব থেকেই পরিচিত ছিলেন।
কোন পরিকল্পনা যখন বিদেশী ষড়যন্ত্রের অংশ রূপে অগ্রসর হয় তখন সে ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমুহ কখনোই প্রকাশ্যে নেয়া হয় না। দেশবাসীকে ও দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণের সে প্রক্রিয়ায় জড়িত করা হয় না। সেটি ৬ দফা প্রণয়নের সময় যেমন হয়নি, তেমনি পাকিস্তান ভাঙ্গার ব্যাপারেও হয়নি। অথচ পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহিত হয়েছিল প্রকাশ্য জনসভায়। তার সাথে সম্পৃক্ত ছিল মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় নেতাকর্মীগণ। অথচ বাংলাদেশের ইতিহাসে ৬ দফা প্রণয়ন ও পাকিস্তান ভাঙ্গার ন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও কোন প্রকাশ্য বৈঠক হয়নি। ইতিহাসের লেখকদের দায়িত্ব হলো, এসব সিদ্ধান্তের গুঢ় রহস্যগুলি উদঘাটন করা। কারা ছিল নেপথ্যের নায়ক বা ভিলেন তাদের খুঁজে বের করা এবং সত্য থেকে মিথ্যাগুলোকে সতর্কতার সাথে আলাদা করা। বাংলাদেশে ইতিহাসের লেখকদের দ্বারা একাজটিও হয়নি। তারা বরং অতি পরিচিত মিথ্যাগুলোকেও পাঠ্য তালিকাভুক্ত করেছে। এভাবে মিথ্যাচর্চাও ইতিহাসের পাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং ‘র’
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের প্রস্তুতিতে র’য়ের কি ভূমিকা ছিল -সে বিষয়ে আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন ভারতীয় সাংবাদিক অশোক রায়না তার “Inside RAW” বইতে। সেটি এরকমঃ...কিন্তু ততদিনে ভারতীয় এজেন্টরা পূর্ব পাকিস্তানের মুজিবপন্থী একটি অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। আগরতলায় ১৯৬২-৬৩ সালে ভারতীয় এজেন্ট ও মুজিবপন্থীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে পরবর্তী গৃহিত কার্যক্রম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। কর্নেল মেনন ( ইনি হলেন ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’এর দিল্লিস্থ পাকিস্তান ডেস্কের দায়িত্বশীল। তার আসল নাম কর্নেল শংকর নায়ার। মেনন তার ছদ্দ নাম) যিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ও মুজিবপন্থী অংশের যোগাযোগ রক্ষাকারী ছিলেন। তিনি আগরতলা বৈঠকের পর ইঙ্গিত পান যে, মুজিবপন্থী গ্রুপ আন্দোলন শুরু করার জন্য অত্যন্ত উদগ্রীব। কর্নেল মেনন তাদের এই বলে সতর্ক করে দেন যে, তার সঠিক ফলদায়ক সিদ্ধান্তে আসার সময় এখনো হয়নি।.. তারা অস্ত্রের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং ঢাকাস্থ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস অস্ত্রাগারে হামালা চালায়। কিন্তু এই প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। আসলে এই পদক্ষেপ একটি ধ্বংসাত্মক ফলাফল ডেকে আনে, ঠিক যেরূপ কর্নেল মেনন ধারণা করেছিলেন। এর কয়েক মাস পর ৬ই জানুয়ারি ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ভারতের সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার চক্রান্ত করার জন্য ২৮ জন পাকিস্তানীর বিচার করা হবে। শেখ মুজিবকেও বারদিন পর একজন দোষী হিসাবে জড়িত করা হয়। এই মামলাই পরবর্তীতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হিসাবে পরিচিত পায়।-(অশোকা রায়না, ১৯৯৬)
২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। যারা মনে করেন,পাকিস্তান আর্মির মিলিটারি এ্যাকশনের পরই মুজিব স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার সিদ্ধান্ত নেন -তাদের ধারণা আদৌ সত্য নয়। অশোক রায়না লিখেছেন, “কর্নেল মেননের অবিরাম ভ্রমন ও যোগাযোগের জন্য সীমান্তব্যাপী র’য়ের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র খোলা হয় এবং কর্নেল মেননের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের প্রতিরোধ আন্দোলনকারীদের নিবিড় যোগাযোগ ঐ সমস্ত তরুণ, অবিশ্রান্ত ও উৎসর্গীকৃত গুপ্ত যোদ্ধাদের মনোবল দারুণ ভাবে বৃদ্ধি করে। ... ইতিমধ্যে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র স্থাপন শেষ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের এজেন্টদের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের প্রশিক্ষণ প্রদান শুরু হয়, তখনই সেই ভয়াবহ ‘কালো রাত্রী’(২৫ শে মার্চ)’র পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে।- (অশোক রায়না, ১৯৯৬)।একাত্তরের যুদ্ধটির শুরু তাই একাত্তরে নয়, শুরুটি হয়েছিল বহু পূর্ব থেকেই। তবে সব সময়ই এর পরিকল্পনা ও পরিচালনায় ছিল ভারত। এবং মার্কিন কর্তৃপক্ষ ও তার গুপ্তচর সংস্থা তা থেকে অজ্ঞ ছিল না। তবে অজ্ঞ রাখা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে। প্রতিটি ষড়যন্ত্রে তো তাই হয়ে থাকে।
গ্রন্থপঞ্জি
মাসুদুল হক; বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র’ এবং সিআইএ,মৌল প্রকাশনী ৩৮/২ক, বাংলা বাজার, ঢাকা ১১০০।
অলি আহাদ; জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ১৯৭৫, বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি: ১২৫,মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা ১০০০।
B.Ramon, 2007; The Kaoboys of the R&AW, Down Memory Lane, Lance Publishers & Distributors 2/42 Sarvapriya Vihar, New Delhi 11016.
অশোকা রায়না,১৯৯৬; ইনসাইড র’ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার অজানা অধ্যায়, (বাংলা অনুবাদ) অনুবাদ,লেঃ (অবঃ) আবু রুশদ রুমী প্রকাশনী।
Comment