শুরু পঁচিশে মার্চের পূর্বে
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্ব গোপন সেল গঠন করা হয়েছিল যাটের দশকের মাঝামাঝিতে। জেলা শহরগুলিতেও গোপন সেল গড়ে তোলা হচ্ছিল। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র”য়ের শত শত গুপ্তচর ও ফিল্ড অপারেশনের দায়িত্ব প্রাপ্তরা তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তেসরা মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করায় তাদের জন্য সে সুযোগটি এসে যায়। ৭ই মার্চের ব্ক্তৃতায় শেখ মুজিব হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে লড়াইয়ে নামার হুকুম দেন। নির্দেশ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভাতে ও পানিতে মারার। ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এটি ছিল গোপন সেলের ক্যাডারদের জন্য মাঠে নামার তাগিদ। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোনের পর্ব। শুরু হয় পাকিস্তান আর্মি এবং বিহারীদের উপর হামলা। বিশেষ বিশেষ অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় গুপ্ত ঘাতকেরা। এভাবে রক্তপাতের শুরুটি মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই। পরিকল্পনা মাফিক ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ ঢাকা শহরে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরূপ বৈঠক হোক ও রাজনৈতিক সমাধান হোক –এরা ছিল তার ঘোরতর বিরোধী।
মার্চের শুরুতে ঢাকায় কয়েকজন সামরিক অফিসার সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভাতে ও পানিতে মারার নির্দেশ পালনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ সেনানীবাসে খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত সেনা সদ্স্যগণ তখন বাজার করতো পাশ্ববর্তী কচুক্ষেত বাজার থেকে। সে বাজারটিও অচল করা হয়।–(এ.কে.খন্দকার,২০১৪)।বহু অবাঙালীর দোকানপাঠ লুঠ হয়।দেশজুড়ে নিদারুন অরাজকতা।কিন্তু সেনাবাহিনীর উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ, অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক সামরিক ব্যবস্থা যেন না নেয়া হয়। পাকিস্তান সরকার তখন একটি সফল আলাপ-আলোচনার লক্ষ্যে সত্যই সচেষ্ট ছিল।-(Sarmila Bose, 2011)। মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গবেন না। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে স্বাক্ষর করে সেটির ঘোষণাও দিয়েছিলেন।মুজিব আরো বলেছিলেন,৬ দফা বাইবেল নয়।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাই মুজিবের উপর বিশ্বাস রেখে শেষ অবধি বৈঠক চালিয়ে যান। ইয়াহিয়া খানের সরকার চাচ্ছিল সংসদে বৈঠক বসার আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে নেতাদের মাঝে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত্য হোক। ১৯৭০এর নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের মূল দায়িত্ব ছিল একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। সে কাজটির দায়বদ্ধতা মুজিবের একার ছিল না, ছিল সকল নির্বাচিত সদস্যের। কিন্তু শেখ মুজিবের তা নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না। আগ্রহ ছিল না শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান বা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের সাথে আলোচনায়। অথচ আলোচনা ছাড়া শাসতান্ত্রিক সমাধান অসম্ভব ছিল। দেশটির অস্তিত্বই যখন কাম্য নয়,তখন আবার কিসের শাসনতন্ত্র? শেখ মুজিবের কাছে বিষয়টি ছিল এরূপ। অবশেষে ইয়াহিয়ার পীড়াপীড়িতে যখন বৈঠক বসলো, মুজিব তার অবস্থানে অনড় থাকলেন। কোন রূপ ছাড় না দিয়ে মুজিব তার গোলপোষ্টই পাল্টে ফেলেন। ৬ দফা আঁস্তাকুড়ে ১ দফা তথা স্বাধীনতার পথ ধরলেন। অথচ বিফল আলোচনার দায়ভার চাপাচ্ছিলেন সরকারের উপর। তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ক্যাডারগণ দেশজুড়ে সংগঠিত হচ্ছিল এবং সে সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। অবশেষে ইয়াহিয়া খানেরও স্বপ্নভগ্ন হয়। যাদের হাতে তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি জিম্মি -সে উগ্র ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে অখণ্ড পাকিস্তান বহু আগেই মৃত্যু বরণ করেছিল। তাদের ভাবনায় তখন একটি মাত্র এজেন্ডা এবং সেটি দ্রুত পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃ্ষ্টি। ঢাকার রাজপথে তখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় গুপ্তচর;খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ তখন তাদের হাতে জিম্মি।
ঢাকায় বসবাসকারি পশ্চিম পাকিস্তানী ও ভারত থেকে আগত বিহারীদের বিরুদ্ধে তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের প্রচণ্ড আক্রোশ। তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় বেরুনো।তবে অবাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে চরম ঘৃণা সৃষ্টির কাজটির শুরু বহু আগে থেকেই। নিজেদের মাঝে আলোচনায় তারা তাদেরকে “ছাতুখোর” বলে অবজ্ঞা করত। অথচ তা ছিল ইসলামের আদবের পরিপন্থী। অবজ্ঞাভরে কাউকে তার নিজস্ব নামটি অন্য নামে বা খেতাবে ভাবে ডাকা ইসলামে হারাম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা সেটি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।-(সুরা হুজরাত, আয়াত ১১)। ইসলামী চেতনাবর্জিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ ক্যাডারদেগর মাঝে সে আদবের কোন ধারণাই ছিল না। ১৯৭০’য়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের পর অবাঙালীদের বিরুদ্ধে সে অবজ্ঞা ও আক্রোশ তখন সহিংসতায় রূপ নেয়। ফলে অবাঙালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে থাকে। ফলে দলে দলে তারা পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। তাদের সাথে প্রদেশ ছাড়তে থাকতে অবাঙালী ব্যবসায়ীদের পূঁজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন-ভারতসহ বিশ্বের তাবত দেশগুলি যখন বিদেশী পূঁজির জন্য কাতর, শেখ মুজিব ও তার অনুসারিদের পলিসি হয় বাংলাদেশ থেকে অবাঙালীদের পুঁজি তাড়ানো। ভারতও সেটি মনেপ্রাণে চাইতো। কারণ, বাংলাদেশে শিল্পের বিনাশ ও দেশটির বাজারে নিজেদের পণ্যের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ভারতের জন্য সেটি জরুরী ছিল। ভারতের সে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধজয়ের আগেই শেখ মুজিব ও তার দলীয় ক্যাডারগণ ভারতীয়দের চেয়ে অধীক ভারতীয় রূপে আবির্ভুত হয়। পুরা পরিস্থিতি তখন ভারতের পূর্ণ অনুকূলে। ক্যাম্পাস ছাড়তে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নরত অবাঙালী ছাত্র-ছাত্রীরা। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারী ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, যারা ফিলিস্তিন, মিশর, সিরিয়া, ইরান প্রভৃতি মুসলিম দেশ থেকে এসেছিল তারাও দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান ছাড়ে।
রক্তপাতের প্রথম পর্ব
একাত্তরের রক্তপাত হয়েছিল তিনটি পর্বে। প্রথম পর্বটির শুরু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিবষদের তেসরা মার্চের ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক মুলতবি করার পর। সেটি ঘটে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর মস্কোপন্থী ও চীন পন্থী গ্রুপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বাহিনীর হাতে। ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শেষের সাথে সাথে ঢাকা শহরের অবাঙালীদের বড় বড় বহু দোকান লুট হয়ে যায়। হামলা শুধু অবাঙালীদের উপর হয়নি, কোন কোন জায়গায় হামলা হয়েছে মুসলিম লীগ, জামায়াতের ইসলামী’র ন্যায় পাকিস্থানপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের উপরও ছিল। মুজিবের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা থেকে ফিরে যান। ২৫শে মার্চ রাস্তায় নামে সামরিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা বা ক্যান্টনমেন্ট আছে এমন শহর গুলোর উপর দখল জমালেও অধিকাংশ মফস্বলের জেলা ও মহকুমা শহরগুলো তখন আওয়ামী লীগ বাহিনীর দখলে চলে যায়। ঢাকাতে সামরিক অ্যাকশনে বহু বাঙালী নিহত হয়। কিন্তু মফস্বল শহরগুলোতে সামরিক বাহিনী পৌঁছতে পারিনি। ফলে ভয়ানক বিভীষিকা নেমে আসে সেখানে অবস্থানরত অবাঙালীদের উপর। মফস্বল শহরগুলোতে সে সময় যে সব পাকসেনা ছিল তারাও প্রায় সবাই মারা পড়ে। লেখকের নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় স্বল্প সংখ্যক সেনা সদস্য ছিল; তারা ঘেরাও হয় ইপিআর ও পুলিশের সশস্ত্র সেপাইদের দ্বারা। তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। রাতে দুয়েক জন পালিয়ে যশোর সেনানিবাসে যাবার চেষ্টা করে; পথে তারাও নিহত হয়। হত্যা করা হয় মফস্বল শহরে কর্মরত বহু পশ্চিম পাকিস্তানী সিভিল সার্ভিস অফিসারকে। অনেক জেলাতেই তখন ডিসি, এডিসি এবং মহাকুমা শহরের এসডিও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। সে সাথে চলছিল বিহারিদের মারার উৎসব। সে সময় কুষ্টিয়া জেলার এডিসি ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানী। তার পেট ফেঁড়ে নাড়িভূরি বের করা হয়। তার লাশ পড়ে থাকে থানার সামনে। হত্যার আগে সে অবাঙালী অফিসারকে গাড়ীর সাথে বেঁধে রাস্তায় টানা হয়। কু্ষ্টিয়া শহরের বহু বিহারিকে হত্যা করে পাশের গড়াই নদীতে ফেলা হয়। পাকশি ও ভেড়ামারার শত শত বিহারীকে হত্যা করে তাদের লাশগুলোকে হার্ডিন্জ ব্রিজের নীচে পদ্মা নদীতে ফেলে পচতে দেয়া হয়। এসব লাশ কুকুর, শৃগাল ও শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। বাংলার মাটিতে সে সময় অতিশয় নৃশংস বর্বর কাণ্ডগুলি ঘটে; এবং সেটি বাঙালী মুসলিমদের হাতে। নিহত অবাঙালীগণও মুসলিম ছিল। নিহত মুসলিমদের জানাজা করা এবং তাদের কবর দেয়া জীবিতদের উপর ফরজ। সে ফরজ পালিত না হলে সবাই গুনাহগার হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্যাডারগণ সে ফরজ পালন করেনি এবং কাউকে পালন করতেও দেয়নি।
রক্তপাতের দ্বিতীয় পর্ব
এপ্রিলের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বৃহত্তর দলগুলো সেনানীবাস থেকে মফস্বল শহরগুলিতে পৌঁছা শুরু করে এবং শহরগুলিকে আবার দখলে নেয়া শুরু করে। কিন্তু আসার পথে স্থানে স্থানে অবাঙালীদের শত শত পচা লাশের দৃশ্য তাদের নজরে পড়ে। এর ফলে ভয়ানক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেনা সদস্যদের মনে। তাদের অনেকে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পড়ে। সেটি প্রকাশ পায়, সামনে যে শহরই পেয়েছে সে শহরের উপরইতারা এলোপাথারি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। কুষ্টিয়া শহরে প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে বহু ঘরবাড়ী ও দোকন-পাট জ্বালানো হয়। কে পাকিস্তানপন্থী আর কে পাকিস্তান বিরোধী সেটি পাক-বাহিনী দেখেনি। অনেক পাকিস্তানপন্থীর ঘরবাড়ী যেমন পোড়ানো হয়, তেমনি হত্যা করা হয় অনেক পাকিস্তানপন্থীকেও। যেমন কুষ্টিয়ায় শহরে পুড়িয়ে দেয়া হয় জেলার প্রখ্যাত আইনবিদ জনাব সা’দ আহমদের দ্বি-তলবাড়ী ও গাড়ী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একসময় তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। শেখ মুজিব ৬ দফা পেশ করলে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ঢাকা শহরের দলীয় অফিস থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় পাকিস্তানপন্থী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের ঢাকা শহর শাখা ও ফরিদপুর জেলাশাখার সভাপতিকে। সারা দেশে এরূপ বহু ঘটনা ঘটেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী একে একে সবগুলি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সেনাবাহিনীর এ সফলতার পর লুট-পাট ও হত্যাকাণ্ডে নামে প্রতিশোধ পরায়ন এবং শোকাহত বিহারীরা। বিহারীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও আপনজন হারিয়েছিল বাঙালীদের হাতে। তাদের অনেককে অতি নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বহু বিহারী মহিলা ধর্ষণের শিকারও হয়েছিল। এতে বহু বিহারীই অতিশয় প্রতিশোধ পরায়ণ হয়। তাদের হাতে বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ গ্রন্থের লেখকের সহোদর ভাই এবং এক ভাগ্নে নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছে এমন হত্যাপাগল বিহারীদের হাতে। বিহারীগণও বাঙালীদের ন্যায় নিহতদের লাশ নদীতে বা ডোবায় ফেলে গায়েব করেছে। লেখকের পরিবারও তার ভাই ও ভাগ্নের লাশ পায়নি। সেনা বাহিনীর হাতে দ্রুত সকল জেলা, মহাকুমা ও থানা শহর পুনরায় দখলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীগণ বুঝতে পারে, পাক-আর্মীর মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া যারা হাজার বিহারী হ্ত্যা ও তাদের দোকানপাটে লুটতরাজের ন্যায় ভয়ানক অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল তারা বুঝতে পারে, দেশে অবস্থান করলে তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তখন শুরু হয় তাদের ভারতে আশ্রয় নেয়ার পালা। ভারত অভিমুখে শুরু হয় হিন্দু উদ্বাস্তুদের মিছিল। সে সাথে ভারতের মাটিতে শুরু হয় মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং। অপর দিকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যোগ দেয় হাজার হাজার রাজাকার। আস্তে আস্তে সমগ্র দেশ প্রবেশ করে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থায়। তখন অসংখ্য মানুষ হতাহত হতে থাকে উভয়পক্ষেই।
মুক্তিবাহিনীর হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিজ-কালভার্ট, রেল লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, লঞ্চঘাট, জাহাজ ঘাট, সরকারি ভবন এবং সে সাথে সেগুলির পাহারার কাজে লিপ্ত রাজাকারগণ। হামলা হতে থাকে অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক শান্তি কমিটির নিরস্ত্র সদস্যগণ। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম ও নিজামে ইসলামীর ন্যায় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বহু নেতাকর্মী। বহু অরাজনৈতিক আলেম ও সমাজকর্মী সে সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় নিহত হন। মোনায়েম খানের ন্যায় রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া মুসলিম লীগের বহু বৃদ্ধ ব্যক্তিও মুক্তি বাহিনীর হামলা থেকে প্রাণে বাঁচেননি। আন্তর্জাতিক আইনে এগুলি ছিল যুদ্ধাপরাধ। অথচ আওয়ামী ক্যাডারদের কাছে এগুলো গণ্য হয় বীরত্বগাঁথা রূপে। অনেককে প্রাণ হারাতে হয় স্রেফ গ্রাম্য দলাদলির কারণে। তারা হত্যা করে এমন বহুব্যক্তিকে যারা সক্রিয় ভাবে কোন রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন না। উদাহরণ স্বরূপ প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানী সুদূর মদিনা থেকে বাংলায় এসেছিলেন নিছক আল্লাহর দ্বীনের তা’লীম দিতে। তার কর্মক্ষেত্র ছিল মূলত ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ,মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও তার আশেপাশের এলাকাতে। কিন্তু মুক্তি বাহিনী তাঁকেও ছাড়েনি। ইসলামের চেতনাবাহী এরূপ বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রাণ দিতে হয়। তাদের হত্যা করা হয় ঠান্ডা মাথায় এবং পরিকল্পিত ভাবে। সম্ভবতঃ এ হামলার লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী চেতনা ও ইসলামের পক্ষের শক্তিকে নির্মূল করা। যে ইসলাম বিরোধী আক্রোশ নিয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দাঙ্গার নামে আগুনে ফেলে মুসলিম নিধন ও বাবরী মসসিজদের ন্যায় মসজিদ ধ্বংসও উৎসবযোগ্য গণ্য হয়, একাত্তরে সে অভিন্ন ধারাটি প্রচণ্ড আকার ধারণ করে বাংলাদেশেও।
রক্তপাতের তৃতীয় পর্ব
রক্তপাতের তৃতীয় পর্ব এবং সবচেয়ে রক্তাত্ব পর্বটি শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর। তখন বিহারি, রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য, পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর নেমে আসে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। একাত্তরে কোন পক্ষে কতজন এবং কাদের হাতে কত জন মারা গেল -সে হিসাবটি জেনেবু্ঝেই তাই নেয়া হয়নি। সে হিসাবটি নেয়া হলে জানা যেত, বেশী হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল কাদের হাতে। সম্ভবতঃ বেশীর ভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে। আর সে সত্যটি লুকাতেই হত্যাকান্ডের কোন রেকর্ডই রাখা হয়নি। বাস্তব চিত্রের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। লেখকের নিজ গ্রামে একাত্তরে ৪ জন নিহত হয়। এর মধ্যে দুই জন নিহত হয় বিহারীদের হাতে। এদের দুইজনই ছিল স্কুল ছাত্র। অপর দুই জন নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। তারা দুইজনই ছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা মোহাজির। তাদের একজন ছিলেন খাদ্যবিভাগের থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা। আরেকজন পিতার কৃষিকাজ দেখাশোনা করতেন। তাদের কেউই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। পাশের গ্রামে নিহত হয় একজন, সে ছিল রাজাকার। সে মারা যায় মুক্তি বাহিনীর হাতে। তৃতীয় আরেকটি গ্রামে মারা যায় অতিশয় গরীব পরিবারের দুইজন সদস্য। তারা দুই জনই ছিল রাজাকার। তারা ছিল সহোদর দুই ভাই, বড় ভাইটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়তো। তাদেরকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী। তাদের পিতামাতাও সন্তানদের লাশ আর খুজেঁ পায়নি, হত্যার পর মুক্তিবাহিনী তাদের লাশ কুষ্টিয়া শহরের সন্নিকটে গড়াই নদীতে ফেলে দেয়।
১৬ই ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার রাজাকার এবং শান্তিকমিটির সদস্যদের শুধু হত্যাই করা হয়নি, লুটপাট করা হয় তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য। বহু ঘটনা এমনও ঘটেছে, বাড়ীতে রাজাকারকে না পেয়ে তার নিরীহ পিতা ও ভাইদের হত্যা করা হয়েছে। মহাম্মদপুর, মীরপুর, রংপুরের সৈয়দপুরসহ সারাদেশে বিহারীদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দখলে চলে যায়। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীদের দখলে যায় ধানমন্ডি, গুলশান, কান্টনমেন্ট ও বনানীতে অবস্থিত অবাঙালীদের বড় বড় বাড়ীগুলি। পরাজিত হওয়ার ফলে স্বভাবতই সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় পাকিস্তানপন্থীগণ। দুর্যোগ কালে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের ভারতে পালানোর পথ খোলা থাকলেও, পাকিস্তানপন্থীদের তেমন কোন আশ্রয়স্থলই ছিল না। তাদের জন্য সমগ্র দেশ পরিণত হয় জেলখানায়। পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ায় তাদের কোরবানি দিতে হয় নিজেদের জানমাল, সহায়-সম্পদ, চাকুরি-বাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে।
এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকগণও হামলা থেকে রেহায় পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন এবং অধ্যাপক ড. হাসান জামানের মত প্রখ্যাত ব্যক্তিগণও নৃশংস নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। হাত পা ভেঙ্গে তাদের রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল। এতোটাই প্রহার করেছিল যে, তারা যে মারা যাবে -সেটি নিশ্চিত হয়েই তাদেরকে ফেলে রাখা হয়েছিল। হাজার হাজার নিরস্ত্র অবাঙালীকে তারা ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করে। মানুষ যত অপরাধীই হোক, তার উপরে আদালতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও তার লাশটি আপনজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটি জীবিতদের উপর থেকে যায়। অথচ সে দায়িত্ব সেদিন পালিত হয়নি। যাদেরকে তখন এভাবে হত্যা করা হয়েছে তারা ছিল নিরস্ত্র। কথা হলো, নিরস্ত্র মানুষের সাথে এমন আচরণ কতটা মানবিক? এটি তো যুদ্ধাপরাধ। অথচ আওয়ামী সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা রচিত ইতিহাসে এমন যুদ্ধাপরাধের সামান্যতম উল্লেখও নেই। সে যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়ে কয়েক লক্ষ অবাঙালী আজও নর্দমার পাশে ঝুপড়িতে বসবাস করছে। তাদের সে করুণ অবস্থা দেখে যে কোন সুস্থ্ বিবেকে ঝাঁকুনি লাগার কথা। ভারতের হিন্দুদের তাড়া খেয়ে নিঃস্ব হাতে যখন তারা পাকিস্তানে এসেছিল তখনও তাদের অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। বিহারীদের করুণ অবস্থা দেখে বিদেশীরা বই লেখে, ফিল্ম বানায়, সাহায্যও পাঠায়। কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সে করুণ চিত্র স্থান পায়না। বাঙালীরা তাদের জবরদখল করা ঘর-বাড়ীগুলো ছাড়তেও রাজী নয়। অথচ নবীজী (সাঃ)র হাদীস, যে ব্যক্তি থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে ঈমানদার নয়। হাদীসটির মূল কথা,প্রতিবেশীর জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার মাঝেই মু’মিন ব্যক্তির ঈমানদারী। কিন্তু বিহারী প্রতিবেশীগণ কি বাঙালী মুসলিমদের থেকে সে নিরাপত্তা পেয়েছে?
বাংলাদেশে মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান মূলত ইসলাম বিরোধীদের দখলে। তাদের সে দখলদারি ১৯৪৭’য়ের পূর্বে আংশিক ভাবে হলেও সেটি বলবান হয় ১৯৪৭’য়ের পর। মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা যখন রাজনৈতিক বিবাদে লিপ্ত, ১৯৪৭-এর পরাজিত সেক্যুলার ও বামপন্থী শক্তি তখন বু্দ্ধিবৃত্তির ময়দানটি দখলে নেয়া নিয়ে ব্যস্ত। সে দখলদারির ফলে একাত্তরের পর তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিদ্বন্দিই থাকেনি। এরাই একাত্তরের ইতিহাস রচনার নামে তারা চালিয়েছে সীমাহীন মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের সামর্থ বিশাল। মিথ্যাচারে শুধু ফিরাউনকে নয়, শাপ-শকুন,গরু-বাছুড় এমনকি মাটির মুর্তিকেও পুজনীয় করা যায়। এবং বিতাড়িত ও হত্যাযোগ্য করা যায় নবী-রাসূলদের। এমন মিথ্যাচারের ফলে বাংলাদেশে অতিশয় দুর্বৃত্ত ও স্বৈরাচারী নেতাগণও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে চিত্রিত হয়েছে। অপর দিকে ইসলামপন্থীদের চিত্রিত করা হয়েছে খুনি, চরিত্রহীন ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রূপে। সে মিথ্যাচারটি এতোটাই সীমাহীন যে, নিজেদের নেতাদের বড় করতে গিয়ে তারা ভারতের অবদানকেও অস্বীকার করছে। বলছে,পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করেছে মুক্তিবাহিনী। অথচ সত্য হলো, পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করার পরই ভারতীয় বাহিনী কলকাতার হোটেলে আরাম-আয়াশে ব্যস্ত প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় এনে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু সে ঐতিহাসিক সত্যকে তারা বাংলাদেশে ইতিহাসের পুস্তক থেকে বিলুপ্ত করেছে। নিজেরা ইতিহাসে হারিয়ে যাবে –এ ভয়ে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন কালে তারা ভারতীয় বাহিনীর সে ভূমিকাকে মুখে আনেনা। মুসলিম উম্মাহর শক্তি খর্বকরণে এবং ভারতের চরণ তলে বাঙালী মুসলিমদের সঁপে দেয়ার কাজে শেখ মুজিব ও তার দল যা করেছে -উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তা বিরল। শুধু ভারতীয়দের কাছেই নয়, ইসলামবিরোধী সকল ব্যক্তি ও সকল শক্তির কাছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ এজন্যই এতো প্রিয়।
গ্রন্থপঞ্জি
এ.কে.খন্দকার। ১৯৭১ ভেতরে বাইরে, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪।
Bose, Sarmila; “Problems of Locating Sexual Violence in the 1971 War:The Problem of Numbers,” Economic and Political Weekly September 22, 2007
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্ব গোপন সেল গঠন করা হয়েছিল যাটের দশকের মাঝামাঝিতে। জেলা শহরগুলিতেও গোপন সেল গড়ে তোলা হচ্ছিল। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র”য়ের শত শত গুপ্তচর ও ফিল্ড অপারেশনের দায়িত্ব প্রাপ্তরা তখন সারা পূর্ব পাকিস্তানে। তারা শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তেসরা মার্চের অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করায় তাদের জন্য সে সুযোগটি এসে যায়। ৭ই মার্চের ব্ক্তৃতায় শেখ মুজিব হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে লড়াইয়ে নামার হুকুম দেন। নির্দেশ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভাতে ও পানিতে মারার। ঘোষণা দেন, “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এটি ছিল গোপন সেলের ক্যাডারদের জন্য মাঠে নামার তাগিদ। শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোনের পর্ব। শুরু হয় পাকিস্তান আর্মি এবং বিহারীদের উপর হামলা। বিশেষ বিশেষ অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে অনুপ্রবেশ করে ভারতীয় গুপ্ত ঘাতকেরা। এভাবে রক্তপাতের শুরুটি মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই। পরিকল্পনা মাফিক ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ ঢাকা শহরে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করে। অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচিয়ে রাখার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরূপ বৈঠক হোক ও রাজনৈতিক সমাধান হোক –এরা ছিল তার ঘোরতর বিরোধী।
মার্চের শুরুতে ঢাকায় কয়েকজন সামরিক অফিসার সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়। সেনাবাহিনীর সদস্যদের ভাতে ও পানিতে মারার নির্দেশ পালনে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারগণ সেনানীবাসে খাদ্য সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত সেনা সদ্স্যগণ তখন বাজার করতো পাশ্ববর্তী কচুক্ষেত বাজার থেকে। সে বাজারটিও অচল করা হয়।–(এ.কে.খন্দকার,২০১৪)।বহু অবাঙালীর দোকানপাঠ লুঠ হয়।দেশজুড়ে নিদারুন অরাজকতা।কিন্তু সেনাবাহিনীর উপর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ, অবস্থা যতই প্রতিকূল হোক সামরিক ব্যবস্থা যেন না নেয়া হয়। পাকিস্তান সরকার তখন একটি সফল আলাপ-আলোচনার লক্ষ্যে সত্যই সচেষ্ট ছিল।-(Sarmila Bose, 2011)। মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন,তিনি পাকিস্তান ভাঙ্গবেন না। লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কে স্বাক্ষর করে সেটির ঘোষণাও দিয়েছিলেন।মুজিব আরো বলেছিলেন,৬ দফা বাইবেল নয়।প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাই মুজিবের উপর বিশ্বাস রেখে শেষ অবধি বৈঠক চালিয়ে যান। ইয়াহিয়া খানের সরকার চাচ্ছিল সংসদে বৈঠক বসার আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে নেতাদের মাঝে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐক্যমত্য হোক। ১৯৭০এর নির্বাচনের পর নির্বাচিত সংসদ-সদস্যদের মূল দায়িত্ব ছিল একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। সে কাজটির দায়বদ্ধতা মুজিবের একার ছিল না, ছিল সকল নির্বাচিত সদস্যের। কিন্তু শেখ মুজিবের তা নিয়ে মাথাব্যাথা ছিল না। আগ্রহ ছিল না শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে ভুট্টো, ইয়াহিয়া খান বা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের সাথে আলোচনায়। অথচ আলোচনা ছাড়া শাসতান্ত্রিক সমাধান অসম্ভব ছিল। দেশটির অস্তিত্বই যখন কাম্য নয়,তখন আবার কিসের শাসনতন্ত্র? শেখ মুজিবের কাছে বিষয়টি ছিল এরূপ। অবশেষে ইয়াহিয়ার পীড়াপীড়িতে যখন বৈঠক বসলো, মুজিব তার অবস্থানে অনড় থাকলেন। কোন রূপ ছাড় না দিয়ে মুজিব তার গোলপোষ্টই পাল্টে ফেলেন। ৬ দফা আঁস্তাকুড়ে ১ দফা তথা স্বাধীনতার পথ ধরলেন। অথচ বিফল আলোচনার দায়ভার চাপাচ্ছিলেন সরকারের উপর। তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ক্যাডারগণ দেশজুড়ে সংগঠিত হচ্ছিল এবং সে সাথে যুদ্ধের প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। অবশেষে ইয়াহিয়া খানেরও স্বপ্নভগ্ন হয়। যাদের হাতে তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতি জিম্মি -সে উগ্র ছাত্রলীগ নেতাদের কাছে অখণ্ড পাকিস্তান বহু আগেই মৃত্যু বরণ করেছিল। তাদের ভাবনায় তখন একটি মাত্র এজেন্ডা এবং সেটি দ্রুত পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশের সৃ্ষ্টি। ঢাকার রাজপথে তখন বিপুল সংখ্যক ভারতীয় গুপ্তচর;খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ তখন তাদের হাতে জিম্মি।
ঢাকায় বসবাসকারি পশ্চিম পাকিস্তানী ও ভারত থেকে আগত বিহারীদের বিরুদ্ধে তখন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ক্যাডারদের প্রচণ্ড আক্রোশ। তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় বেরুনো।তবে অবাঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে চরম ঘৃণা সৃষ্টির কাজটির শুরু বহু আগে থেকেই। নিজেদের মাঝে আলোচনায় তারা তাদেরকে “ছাতুখোর” বলে অবজ্ঞা করত। অথচ তা ছিল ইসলামের আদবের পরিপন্থী। অবজ্ঞাভরে কাউকে তার নিজস্ব নামটি অন্য নামে বা খেতাবে ভাবে ডাকা ইসলামে হারাম। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহতায়ালা সেটি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করেছেন।-(সুরা হুজরাত, আয়াত ১১)। ইসলামী চেতনাবর্জিত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ ক্যাডারদেগর মাঝে সে আদবের কোন ধারণাই ছিল না। ১৯৭০’য়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়ের পর অবাঙালীদের বিরুদ্ধে সে অবজ্ঞা ও আক্রোশ তখন সহিংসতায় রূপ নেয়। ফলে অবাঙালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে থাকে। ফলে দলে দলে তারা পূর্ব পাকিস্তান ছাড়তে থাকে। তাদের সাথে প্রদেশ ছাড়তে থাকতে অবাঙালী ব্যবসায়ীদের পূঁজি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন-ভারতসহ বিশ্বের তাবত দেশগুলি যখন বিদেশী পূঁজির জন্য কাতর, শেখ মুজিব ও তার অনুসারিদের পলিসি হয় বাংলাদেশ থেকে অবাঙালীদের পুঁজি তাড়ানো। ভারতও সেটি মনেপ্রাণে চাইতো। কারণ, বাংলাদেশে শিল্পের বিনাশ ও দেশটির বাজারে নিজেদের পণ্যের একচ্ছত্র আধিপত্যের জন্য ভারতের জন্য সেটি জরুরী ছিল। ভারতের সে কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণে ভারতীয় সেনাবাহিনীর যুদ্ধজয়ের আগেই শেখ মুজিব ও তার দলীয় ক্যাডারগণ ভারতীয়দের চেয়ে অধীক ভারতীয় রূপে আবির্ভুত হয়। পুরা পরিস্থিতি তখন ভারতের পূর্ণ অনুকূলে। ক্যাম্পাস ছাড়তে থাকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অধ্যয়নরত অবাঙালী ছাত্র-ছাত্রীরা। শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী ও বিহারী ছাত্র-ছাত্রীরাই নয়, যারা ফিলিস্তিন, মিশর, সিরিয়া, ইরান প্রভৃতি মুসলিম দেশ থেকে এসেছিল তারাও দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান ছাড়ে।
রক্তপাতের প্রথম পর্ব
একাত্তরের রক্তপাত হয়েছিল তিনটি পর্বে। প্রথম পর্বটির শুরু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে জাতীয় পরিবষদের তেসরা মার্চের ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক মুলতবি করার পর। সেটি ঘটে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এর মস্কোপন্থী ও চীন পন্থী গ্রুপ এবং ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী বাহিনীর হাতে। ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শেষের সাথে সাথে ঢাকা শহরের অবাঙালীদের বড় বড় বহু দোকান লুট হয়ে যায়। হামলা শুধু অবাঙালীদের উপর হয়নি, কোন কোন জায়গায় হামলা হয়েছে মুসলিম লীগ, জামায়াতের ইসলামী’র ন্যায় পাকিস্থানপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাকর্মীদের উপরও ছিল। মুজিবের সাথে আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা থেকে ফিরে যান। ২৫শে মার্চ রাস্তায় নামে সামরিক বাহিনী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা বা ক্যান্টনমেন্ট আছে এমন শহর গুলোর উপর দখল জমালেও অধিকাংশ মফস্বলের জেলা ও মহকুমা শহরগুলো তখন আওয়ামী লীগ বাহিনীর দখলে চলে যায়। ঢাকাতে সামরিক অ্যাকশনে বহু বাঙালী নিহত হয়। কিন্তু মফস্বল শহরগুলোতে সামরিক বাহিনী পৌঁছতে পারিনি। ফলে ভয়ানক বিভীষিকা নেমে আসে সেখানে অবস্থানরত অবাঙালীদের উপর। মফস্বল শহরগুলোতে সে সময় যে সব পাকসেনা ছিল তারাও প্রায় সবাই মারা পড়ে। লেখকের নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় স্বল্প সংখ্যক সেনা সদস্য ছিল; তারা ঘেরাও হয় ইপিআর ও পুলিশের সশস্ত্র সেপাইদের দ্বারা। তাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা হয়। রাতে দুয়েক জন পালিয়ে যশোর সেনানিবাসে যাবার চেষ্টা করে; পথে তারাও নিহত হয়। হত্যা করা হয় মফস্বল শহরে কর্মরত বহু পশ্চিম পাকিস্তানী সিভিল সার্ভিস অফিসারকে। অনেক জেলাতেই তখন ডিসি, এডিসি এবং মহাকুমা শহরের এসডিও ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। সে সাথে চলছিল বিহারিদের মারার উৎসব। সে সময় কুষ্টিয়া জেলার এডিসি ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানী। তার পেট ফেঁড়ে নাড়িভূরি বের করা হয়। তার লাশ পড়ে থাকে থানার সামনে। হত্যার আগে সে অবাঙালী অফিসারকে গাড়ীর সাথে বেঁধে রাস্তায় টানা হয়। কু্ষ্টিয়া শহরের বহু বিহারিকে হত্যা করে পাশের গড়াই নদীতে ফেলা হয়। পাকশি ও ভেড়ামারার শত শত বিহারীকে হত্যা করে তাদের লাশগুলোকে হার্ডিন্জ ব্রিজের নীচে পদ্মা নদীতে ফেলে পচতে দেয়া হয়। এসব লাশ কুকুর, শৃগাল ও শকুনের খাদ্যে পরিণত হয়। বাংলার মাটিতে সে সময় অতিশয় নৃশংস বর্বর কাণ্ডগুলি ঘটে; এবং সেটি বাঙালী মুসলিমদের হাতে। নিহত অবাঙালীগণও মুসলিম ছিল। নিহত মুসলিমদের জানাজা করা এবং তাদের কবর দেয়া জীবিতদের উপর ফরজ। সে ফরজ পালিত না হলে সবাই গুনাহগার হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্যাডারগণ সে ফরজ পালন করেনি এবং কাউকে পালন করতেও দেয়নি।
রক্তপাতের দ্বিতীয় পর্ব
এপ্রিলের শুরুতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বৃহত্তর দলগুলো সেনানীবাস থেকে মফস্বল শহরগুলিতে পৌঁছা শুরু করে এবং শহরগুলিকে আবার দখলে নেয়া শুরু করে। কিন্তু আসার পথে স্থানে স্থানে অবাঙালীদের শত শত পচা লাশের দৃশ্য তাদের নজরে পড়ে। এর ফলে ভয়ানক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেনা সদস্যদের মনে। তাদের অনেকে প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে পড়ে। সেটি প্রকাশ পায়, সামনে যে শহরই পেয়েছে সে শহরের উপরইতারা এলোপাথারি ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। কুষ্টিয়া শহরে প্রধান সড়কের পাশ দিয়ে বহু ঘরবাড়ী ও দোকন-পাট জ্বালানো হয়। কে পাকিস্তানপন্থী আর কে পাকিস্তান বিরোধী সেটি পাক-বাহিনী দেখেনি। অনেক পাকিস্তানপন্থীর ঘরবাড়ী যেমন পোড়ানো হয়, তেমনি হত্যা করা হয় অনেক পাকিস্তানপন্থীকেও। যেমন কুষ্টিয়ায় শহরে পুড়িয়ে দেয়া হয় জেলার প্রখ্যাত আইনবিদ জনাব সা’দ আহমদের দ্বি-তলবাড়ী ও গাড়ী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। একসময় তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। শেখ মুজিব ৬ দফা পেশ করলে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ঢাকা শহরের দলীয় অফিস থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয় পাকিস্তানপন্থী ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের ঢাকা শহর শাখা ও ফরিদপুর জেলাশাখার সভাপতিকে। সারা দেশে এরূপ বহু ঘটনা ঘটেছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী একে একে সবগুলি জেলার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সেনাবাহিনীর এ সফলতার পর লুট-পাট ও হত্যাকাণ্ডে নামে প্রতিশোধ পরায়ন এবং শোকাহত বিহারীরা। বিহারীদের অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও আপনজন হারিয়েছিল বাঙালীদের হাতে। তাদের অনেককে অতি নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। বহু বিহারী মহিলা ধর্ষণের শিকারও হয়েছিল। এতে বহু বিহারীই অতিশয় প্রতিশোধ পরায়ণ হয়। তাদের হাতে বহু নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু ঘটে। এ গ্রন্থের লেখকের সহোদর ভাই এবং এক ভাগ্নে নৃশংস হত্যার শিকার হয়েছে এমন হত্যাপাগল বিহারীদের হাতে। বিহারীগণও বাঙালীদের ন্যায় নিহতদের লাশ নদীতে বা ডোবায় ফেলে গায়েব করেছে। লেখকের পরিবারও তার ভাই ও ভাগ্নের লাশ পায়নি। সেনা বাহিনীর হাতে দ্রুত সকল জেলা, মহাকুমা ও থানা শহর পুনরায় দখলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীগণ বুঝতে পারে, পাক-আর্মীর মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া যারা হাজার বিহারী হ্ত্যা ও তাদের দোকানপাটে লুটতরাজের ন্যায় ভয়ানক অপরাধের সাথে যুক্ত ছিল তারা বুঝতে পারে, দেশে অবস্থান করলে তাদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে। তখন শুরু হয় তাদের ভারতে আশ্রয় নেয়ার পালা। ভারত অভিমুখে শুরু হয় হিন্দু উদ্বাস্তুদের মিছিল। সে সাথে ভারতের মাটিতে শুরু হয় মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং। অপর দিকে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যোগ দেয় হাজার হাজার রাজাকার। আস্তে আস্তে সমগ্র দেশ প্রবেশ করে রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধাবস্থায়। তখন অসংখ্য মানুষ হতাহত হতে থাকে উভয়পক্ষেই।
মুক্তিবাহিনীর হামলার মূল লক্ষ্য ছিল ব্রিজ-কালভার্ট, রেল লাইন, বিদ্যুৎ লাইন, লঞ্চঘাট, জাহাজ ঘাট, সরকারি ভবন এবং সে সাথে সেগুলির পাহারার কাজে লিপ্ত রাজাকারগণ। হামলা হতে থাকে অখণ্ড পাকিস্তানের সমর্থক শান্তি কমিটির নিরস্ত্র সদস্যগণ। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম ও নিজামে ইসলামীর ন্যায় পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বহু নেতাকর্মী। বহু অরাজনৈতিক আলেম ও সমাজকর্মী সে সময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় নিহত হন। মোনায়েম খানের ন্যায় রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া মুসলিম লীগের বহু বৃদ্ধ ব্যক্তিও মুক্তি বাহিনীর হামলা থেকে প্রাণে বাঁচেননি। আন্তর্জাতিক আইনে এগুলি ছিল যুদ্ধাপরাধ। অথচ আওয়ামী ক্যাডারদের কাছে এগুলো গণ্য হয় বীরত্বগাঁথা রূপে। অনেককে প্রাণ হারাতে হয় স্রেফ গ্রাম্য দলাদলির কারণে। তারা হত্যা করে এমন বহুব্যক্তিকে যারা সক্রিয় ভাবে কোন রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন না। উদাহরণ স্বরূপ প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। মাওলানা মোস্তাফা আল মাদানী সুদূর মদিনা থেকে বাংলায় এসেছিলেন নিছক আল্লাহর দ্বীনের তা’লীম দিতে। তার কর্মক্ষেত্র ছিল মূলত ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ,মানিকগঞ্জ, নরসিংদী ও তার আশেপাশের এলাকাতে। কিন্তু মুক্তি বাহিনী তাঁকেও ছাড়েনি। ইসলামের চেতনাবাহী এরূপ বহু অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে যুদ্ধকালীন সময়ে প্রাণ দিতে হয়। তাদের হত্যা করা হয় ঠান্ডা মাথায় এবং পরিকল্পিত ভাবে। সম্ভবতঃ এ হামলার লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী চেতনা ও ইসলামের পক্ষের শক্তিকে নির্মূল করা। যে ইসলাম বিরোধী আক্রোশ নিয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দাঙ্গার নামে আগুনে ফেলে মুসলিম নিধন ও বাবরী মসসিজদের ন্যায় মসজিদ ধ্বংসও উৎসবযোগ্য গণ্য হয়, একাত্তরে সে অভিন্ন ধারাটি প্রচণ্ড আকার ধারণ করে বাংলাদেশেও।
রক্তপাতের তৃতীয় পর্ব
রক্তপাতের তৃতীয় পর্ব এবং সবচেয়ে রক্তাত্ব পর্বটি শুরু হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের পর। তখন বিহারি, রাজাকার, শান্তি কমিটির সদস্য, পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উপর নেমে আসে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড। একাত্তরে কোন পক্ষে কতজন এবং কাদের হাতে কত জন মারা গেল -সে হিসাবটি জেনেবু্ঝেই তাই নেয়া হয়নি। সে হিসাবটি নেয়া হলে জানা যেত, বেশী হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল কাদের হাতে। সম্ভবতঃ বেশীর ভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছিল মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে। আর সে সত্যটি লুকাতেই হত্যাকান্ডের কোন রেকর্ডই রাখা হয়নি। বাস্তব চিত্রের কিছু উদাহরণ দেয়া যাক। লেখকের নিজ গ্রামে একাত্তরে ৪ জন নিহত হয়। এর মধ্যে দুই জন নিহত হয় বিহারীদের হাতে। এদের দুইজনই ছিল স্কুল ছাত্র। অপর দুই জন নিহত হয় মুক্তিবাহিনীর হাতে। তারা দুইজনই ছিল ভারতের পশ্চিম বাংলা থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা মোহাজির। তাদের একজন ছিলেন খাদ্যবিভাগের থানা পর্যায়ের কর্মকর্তা। আরেকজন পিতার কৃষিকাজ দেখাশোনা করতেন। তাদের কেউই রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। পাশের গ্রামে নিহত হয় একজন, সে ছিল রাজাকার। সে মারা যায় মুক্তি বাহিনীর হাতে। তৃতীয় আরেকটি গ্রামে মারা যায় অতিশয় গরীব পরিবারের দুইজন সদস্য। তারা দুই জনই ছিল রাজাকার। তারা ছিল সহোদর দুই ভাই, বড় ভাইটি ছিল অত্যন্ত মেধাবী সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স পড়তো। তাদেরকে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী। তাদের পিতামাতাও সন্তানদের লাশ আর খুজেঁ পায়নি, হত্যার পর মুক্তিবাহিনী তাদের লাশ কুষ্টিয়া শহরের সন্নিকটে গড়াই নদীতে ফেলে দেয়।
১৬ই ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার রাজাকার এবং শান্তিকমিটির সদস্যদের শুধু হত্যাই করা হয়নি, লুটপাট করা হয় তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য। বহু ঘটনা এমনও ঘটেছে, বাড়ীতে রাজাকারকে না পেয়ে তার নিরীহ পিতা ও ভাইদের হত্যা করা হয়েছে। মহাম্মদপুর, মীরপুর, রংপুরের সৈয়দপুরসহ সারাদেশে বিহারীদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের দখলে চলে যায়। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাকর্মীদের দখলে যায় ধানমন্ডি, গুলশান, কান্টনমেন্ট ও বনানীতে অবস্থিত অবাঙালীদের বড় বড় বাড়ীগুলি। পরাজিত হওয়ার ফলে স্বভাবতই সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয় পাকিস্তানপন্থীগণ। দুর্যোগ কালে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের ভারতে পালানোর পথ খোলা থাকলেও, পাকিস্তানপন্থীদের তেমন কোন আশ্রয়স্থলই ছিল না। তাদের জন্য সমগ্র দেশ পরিণত হয় জেলখানায়। পাকিস্তানের পক্ষ নেয়ায় তাদের কোরবানি দিতে হয় নিজেদের জানমাল, সহায়-সম্পদ, চাকুরি-বাকুরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হারিয়ে।
এমনকি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাকিস্তানপন্থী শিক্ষকগণও হামলা থেকে রেহায় পায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন এবং অধ্যাপক ড. হাসান জামানের মত প্রখ্যাত ব্যক্তিগণও নৃশংস নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। হাত পা ভেঙ্গে তাদের রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল। এতোটাই প্রহার করেছিল যে, তারা যে মারা যাবে -সেটি নিশ্চিত হয়েই তাদেরকে ফেলে রাখা হয়েছিল। হাজার হাজার নিরস্ত্র অবাঙালীকে তারা ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করে। মানুষ যত অপরাধীই হোক, তার উপরে আদালতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও তার লাশটি আপনজনদের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বটি জীবিতদের উপর থেকে যায়। অথচ সে দায়িত্ব সেদিন পালিত হয়নি। যাদেরকে তখন এভাবে হত্যা করা হয়েছে তারা ছিল নিরস্ত্র। কথা হলো, নিরস্ত্র মানুষের সাথে এমন আচরণ কতটা মানবিক? এটি তো যুদ্ধাপরাধ। অথচ আওয়ামী সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা রচিত ইতিহাসে এমন যুদ্ধাপরাধের সামান্যতম উল্লেখও নেই। সে যুদ্ধাপরাধের শিকার হয়ে কয়েক লক্ষ অবাঙালী আজও নর্দমার পাশে ঝুপড়িতে বসবাস করছে। তাদের সে করুণ অবস্থা দেখে যে কোন সুস্থ্ বিবেকে ঝাঁকুনি লাগার কথা। ভারতের হিন্দুদের তাড়া খেয়ে নিঃস্ব হাতে যখন তারা পাকিস্তানে এসেছিল তখনও তাদের অবস্থা এতোটা খারাপ ছিল না। বিহারীদের করুণ অবস্থা দেখে বিদেশীরা বই লেখে, ফিল্ম বানায়, সাহায্যও পাঠায়। কিন্তু বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় সে করুণ চিত্র স্থান পায়না। বাঙালীরা তাদের জবরদখল করা ঘর-বাড়ীগুলো ছাড়তেও রাজী নয়। অথচ নবীজী (সাঃ)র হাদীস, যে ব্যক্তি থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয় সে ঈমানদার নয়। হাদীসটির মূল কথা,প্রতিবেশীর জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার মাঝেই মু’মিন ব্যক্তির ঈমানদারী। কিন্তু বিহারী প্রতিবেশীগণ কি বাঙালী মুসলিমদের থেকে সে নিরাপত্তা পেয়েছে?
বাংলাদেশে মিডিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির ময়দান মূলত ইসলাম বিরোধীদের দখলে। তাদের সে দখলদারি ১৯৪৭’য়ের পূর্বে আংশিক ভাবে হলেও সেটি বলবান হয় ১৯৪৭’য়ের পর। মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা যখন রাজনৈতিক বিবাদে লিপ্ত, ১৯৪৭-এর পরাজিত সেক্যুলার ও বামপন্থী শক্তি তখন বু্দ্ধিবৃত্তির ময়দানটি দখলে নেয়া নিয়ে ব্যস্ত। সে দখলদারির ফলে একাত্তরের পর তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিদ্বন্দিই থাকেনি। এরাই একাত্তরের ইতিহাস রচনার নামে তারা চালিয়েছে সীমাহীন মিথ্যাচার। মিথ্যাচারের সামর্থ বিশাল। মিথ্যাচারে শুধু ফিরাউনকে নয়, শাপ-শকুন,গরু-বাছুড় এমনকি মাটির মুর্তিকেও পুজনীয় করা যায়। এবং বিতাড়িত ও হত্যাযোগ্য করা যায় নবী-রাসূলদের। এমন মিথ্যাচারের ফলে বাংলাদেশে অতিশয় দুর্বৃত্ত ও স্বৈরাচারী নেতাগণও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী রূপে চিত্রিত হয়েছে। অপর দিকে ইসলামপন্থীদের চিত্রিত করা হয়েছে খুনি, চরিত্রহীন ও মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী রূপে। সে মিথ্যাচারটি এতোটাই সীমাহীন যে, নিজেদের নেতাদের বড় করতে গিয়ে তারা ভারতের অবদানকেও অস্বীকার করছে। বলছে,পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করেছে মুক্তিবাহিনী। অথচ সত্য হলো, পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করার পরই ভারতীয় বাহিনী কলকাতার হোটেলে আরাম-আয়াশে ব্যস্ত প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাদের হেলিকপ্টার যোগে ঢাকায় এনে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু সে ঐতিহাসিক সত্যকে তারা বাংলাদেশে ইতিহাসের পুস্তক থেকে বিলুপ্ত করেছে। নিজেরা ইতিহাসে হারিয়ে যাবে –এ ভয়ে ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবস পালন কালে তারা ভারতীয় বাহিনীর সে ভূমিকাকে মুখে আনেনা। মুসলিম উম্মাহর শক্তি খর্বকরণে এবং ভারতের চরণ তলে বাঙালী মুসলিমদের সঁপে দেয়ার কাজে শেখ মুজিব ও তার দল যা করেছে -উপমহাদেশের সমগ্র মুসলিম ইতিহাসে তা বিরল। শুধু ভারতীয়দের কাছেই নয়, ইসলামবিরোধী সকল ব্যক্তি ও সকল শক্তির কাছে শেখ মুজিব ও তার অনুসারিগণ এজন্যই এতো প্রিয়।
গ্রন্থপঞ্জি
এ.কে.খন্দকার। ১৯৭১ ভেতরে বাইরে, ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৪।
Bose, Sarmila; “Problems of Locating Sexual Violence in the 1971 War:The Problem of Numbers,” Economic and Political Weekly September 22, 2007
Comment