কারা রাজাকার ও কারা মুক্তিযোদ্ধা?
মিথ্যাচার,দূর্নীতি ও স্বৈরাচার কখনোই কোন দেশে একাকী আসে না। নৈতিক এ রোগের মহামারিতে মৃত্যু বরণ করে জনগণের বিবেক।মিথ্যা বলা বা মিথ্যা লেখাও তখন অভ্যাসে পরিণত হয়। দেশের ইতিহাসও তখন মিথ্যাচারে পূর্ণ হয়। স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দেয় ব্যক্তিপুঁজার।ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণও তখন পুঁজণীয় হয়। তাছাড়া ইতিহাসের পাতায় স্বৈরচারী দুর্বৃত্তদের বাঁচার খায়েশটিও বিশাল। একারণেই বিস্তর মিথ্যাচার ঢুকে ইতিহাসে। একাত্তরের ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে তাই মুক্তিযুদ্ধের গুণকীর্তন। কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা নেই; উল্লেখ আছে স্রেফ ভিলেন রূপে। চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানের দালাল রূপে। কিন্তু দালালের কর্মে থাকে অর্থপ্রাপ্তির লোভ, তাতে মনের সম্পর্ক থাকে না। প্রাণদানের স্পৃহাও জাগে না। বাংলাভাষী হলেও প্রতিটি রাজাকার ছিল জন্মসূত্রে পাকিস্তানী; তারা মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের গর্বিত ও নিষ্ঠাবান নাগরিক রূপে। কথা হলো, নিজ জন্মভূমির পক্ষে নামলে তাদেরকে কি দালাল বলা যায়? কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে রাজাকারের সে পরিচয়টি আলোচিত হয়নি। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য প্রশ্ন থেকে যায়, কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেনই বা বাঙালী হয়েও তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় প্রাণপনে বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? শুধু আজ নয়,বহুশত বছর পরও এ প্রশ্নগুলি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই।
রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা –উভয়েই একাত্তরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পক্ষ। যে কোন যুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে, সেটি একাত্তরেও ছিল। ইতিহাসের অর্থ স্রেফ একটি পক্ষের ধারাবিবরণী নয়। একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল রাজনীতির দুটি বিপরীত ধারা ও দুটি বিপরীত দর্শনের সংঘাত। প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সেসব মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণ নিয়ে সবাই একই ভাবে ভাবে না। বিপরীতমুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু কোন একটি পক্ষের পরাজয় বা বিদায় হলে সে পক্ষের ইতিহাসকে বিলুপ্ত করা যায় না। তাদের জন্যও ইতিহাসে স্থান ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ জিতেছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে তারা হেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পড়লে মনে হয় দেশটির ইতিহাসের শুরুটি ১৯৭১ থেকে; বড় জোর ১৯৫২ সাল থেকে। এ ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের নায়কদের জন্য স্থান রাখা হয়নি। কারণ তা হলে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, নবাব সলিমুল্লাহ, খাজা নাযিমুদ্দীন, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, নূরুল আমীন, মৌলভী তমিজউদ্দীন খান, আব্দুর সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ন্যায় শত শত ব্যক্তিকে ইতিহাসে স্থান দিতে হয়। আর সেটি হলে শেখ মুজিবের ন্যায় ১৯৭১’য়ের নায়কদের জন্য স্থান বহুলাংশে কমে যায়। মুজিবের অনুসারিগণ সে ছাড় দিতে রাজী নয়। মুজিবের অনুসারিদের লড়াই তাই স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নিয়ে নয়, ইতিহাসের দখলদারি নিয়েও। বাংলাদেশের ইতিহাস তাদের হাতেই অধিকৃত। স্বৈরাচারী রাজনীতির এ হলো আরেক কুফল।
বাংলাদেশে পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে ভারতের সাহায্যপুষ্ট একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ। ইতিহাস রচনার নামে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের গায়ে লাগাতর কালিমা লেপন। ফলে রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে; এবং নিজেদেরকে চিত্রিত করেছে দেশের সর্বকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন, ধর্ষণ, গৃহ-লুট বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। লক্ষাধিক বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থীদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন কোন অজানা কারণে! বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। দেশের ইতিহাস তো এভাবেই কলুষিত হয় এবং আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ে। প্রতিটি ব্যক্তির রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন-জগত নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে চরম দুর্দিনে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কি এতোই কঠিন? ভিলেন রূপে নয়, রাজাকারদেরকে রাজাকার রূপে দেখলে সে উত্তরটি সহজে পাওয়া যেত।
লড়াইটি দর্শনের
১৯৭১’য়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’টি দর্শন প্রবল ভাবে কাজ করেছিল। একটি হলো প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন-এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। এটিই হলো রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার দর্শন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার উৎস হলো এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষণে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং ঘটনার মূল্যায়নে সে দু’টিকে সামনে রাখতে হবে। নইলে বিচারে প্রচণ্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্ম, আচরণ, রুচীবোধ ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য -তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই; খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ পানাহার ও জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে, তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে।
ব্যক্তির চরিত্র, চেতনা ও রাজনৈতিক নীতিমালার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো একটি জীবন-দর্শন। মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এ দর্শন। দর্শন বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। সেটি যদি হয় ইসলামী দর্শন, তবে তা তো অমর। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলামের। সে দর্শন থেকেই তারা পেয়েছিল প্যান-ইসলামী চেতনা; পেয়েছিল মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার। ফলে রাজাকারদের রাজনীতিতে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতা কোনরূপ গুরুত্ব পায়নি। ফলে একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন রাজাকারগণ সে লড়ায়ে যোগ দেয়নি। বরং সে সময় বহু হাজার বাঙালী রাজাকার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে।তারা মুজিব সরকারের জেল খেটেছে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। তাদের সে ত্যাগের পিছনে যে দর্শনটি কাজ করেছিল সেটি ছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন। সে দর্শনে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলভিত্তিক বিভেদের প্রাচীর গড়ার বৈধতা নেই।বরং বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গাটি তাদের কাছে ইবাদতে পরিণত হয়েছে। এমন দর্শনের প্রতিষ্ঠায় তারা অর্থ, শ্রম ও রক্তও দিয়েছে। রাজাকারের এ দর্শনের জন্মটি একাত্তরে নয়, সাতচল্লিশেও নয়। এ দর্শনের জন্ম তো তখন, যখন ইসলাম সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একমাত্র ধর্ম রূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ ধর্ম বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গতে শেখায়। বিভক্তির সে দেয়াল ভেঙ্গেই আরব, ইরানী, তুর্ক, কুর্দ, মুর ও অন্যান্য ভাষাভাষী মুসলিম ইসলামের পতাকা তলে একতাবদ্ধ হয়েছিল এবং উম্মতে ওয়াহেদার জন্ম দিয়েছিল। এটিই তো ইসলামের রীতি। রাজাকারগণ ছিল সে রীতির অনুসারি। শুধু একাত্তরে নয়, সর্বকালে ও সর্বস্থানে সে রীতি নিয়ে বাঁচাই হলো প্রকৃত ঈমানদারী। ইসলামের এ দর্শন বাঙালী মুসলিমদের মাঝে লক্ষ লক্ষ নিষ্ঠাবান অনুসারি পাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছিল। একাত্তেরর এ সত্যটি আবিস্কারে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যক্তির মন যা জানে না,তার চোখও সেটি দেখতে পায় না। চোখ তো তখনই দেখে যখন তার পিছনে আলোকিত মন কাজ করে।মনের অন্ধকারে তাই চোখও অন্ধ হয়। মহান আল্লাহতায়ালার কুদরত দেখতে হলে তাই জ্ঞানবান মন চাই।তাঁর সৃষ্ট বিশাল জগতে বসবাস করেও বেঈমানেরা তাই তাঁর কুদরত দেখতে ব্যর্থ হয়।অজ্ঞের পক্ষে তাই ঈমানদার হওয়া অসম্ভব।ইসলামে তাই জ্ঞানার্জন প্রথমে ফরজ করা হয়েছে, নামায-রোযা বা হজ-যাকাত নয়।একই কারণে ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্টগণ তাই রাজাকারদের দর্শনের বলটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ এবং সে সাথে নিজের দেশ বাঁচাতে যে ধর্মপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক মানুষগুলো অকাতরে প্রাণ দিল -তাদের কাছে তারা অর্থলোভী দালাল ও যুদ্ধাপরাধী মনে হয়েছে!
বাঙালী জাতীয়বাদীদের দর্শনটি ছিল ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে দেয়াল গড়া তথা বিভেদ গড়ার দর্শন। এটি পাপের পথ। ইসলামে এমন বিভক্তি হারাম, এবং শরিয়তের আইনে দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদীর অনুসারি; তাদের কাছে প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাটি পরিত্যক্ত হয়। এমন নীতি কাফেরদের থেকে সমর্থণ পাবে –সেটি স্বাভাবিক; কিন্তু কোরঅআন-হাদীস বা নবীজীর সূন্নাহ থেকে নয়। তাই একাত্তরে তাদের আশ্রয়দাতা, সাহায্যদাতা, প্রশিক্ষণদাতা ও একান্ত বন্ধু গণ্য হয় ভারতীয় কাফেরগণ, কোন মুসলিম দেশ নয়।তাদের কাছে রাজাকারগণ গণ্য হয় হত্যাযোগ্য প্রতিপক্ষ রূপে। ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে গভীর বিচ্যুতির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অবাঙালী মাত্রই “ছাতুখোর” শত্রু এবং ঘৃণার যোগ্য –এমনকি হত্যাযোগ্য গণ্য হয়েছে।অথচ রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। যেমন সাতচল্লিশে মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। বরং পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ তথা সকল ভাষার মুসলিমগণ গণ্য হয়েছে তার প্রাণপ্রিয় মুসলিম ভাই রূপে। কারণ সেরূপ গণ্য করাটাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম।-(সুরা হুজরাত, আয়াত ১০)। নইলে চরম অবাধ্যতা হয় মহান রাব্বুল আলামীনের। তাই ঈমানদারগণ কি তার পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ ভাইকে হত্যা করতে পারে? একাত্তরে বহুলক্ষ অবাঙালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে যেভাবে বস্তিতে বসানো হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়-সম্পদকে যেভাবে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। মানবতার সংস্কৃতিও নয়। এটি নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধের বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি।এমন অপরাধ কর্মের গভীর স্বাদৃশ্য মেলে হিটলারের ফ্যাসিবাদের সাথে। ইসলামে এমন কর্ম শুধু হারামই নয়, শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। সেটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক আইনেও। এরূপ বর্বর জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণেই জার্মানগণ লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে জ্যান্ত হত্যা করেছে। মুজিব ও তার অনুসারিগণ সে বর্বর ফ্যাসিবাদের আবাদ বাড়িয়েছে বাংলাদেশে। বঙ্গিয় ভূমিতে ইসলাম আগমনের পর এরূপ বর্বর অসভ্যতা আর কোন কালেই প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুজিব ও তার অনুসারিগণ আর কোন কারণে না হোক, অন্ততঃ এ অসভ্যতার কারণে বাঙালীর ইতিহাসে শত শত বছর বেঁচে থাকবে। বাঙলার মুসলিম সংস্কৃতিতে এমন অসভ্যতার কি স্থান আছে? বরং এ সংস্কৃতি তো তুর্কি বীর ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, ইয়েমেনি সুফিসাধক শাহ জালাল, আফগান বীর ঈসা খাঁ’দের ন্যায় নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মুসলিমদের বাংলার বুকে আপন করে নেয়ার সংস্কৃতি।
মহান আল্লাহতায়ালা ব্যক্তিকে ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠতে নির্দেশ দেন। পবিত্র কোরআনে বহু বার ঘোষিত হয়েছে সে নির্দেশ। বলা হয়েছে, “আক্বীমু দ্বীন ওয়ালা তাতাফাররাকূ” –(সুরা শুরা,আয়াত ১৩)। অর্থঃ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো এবং বিভক্ত হয়োনা। বলা হয়েছে, “ওয়া তাছিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওলা তাফাররাকু” -(সুরা আল ইমরান,আয়াত ১০৩)। অর্থঃ তোমরা আল্লাহর রশিকে (তথা কোরআনকে) শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না। প্রতি যুগে প্রতি ঈমানদার ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার এটিই হলো নির্দেশ। মুসলিম দেশে বিচ্ছন্নতার যুদ্ধ তাই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন যুদ্ধে পৌত্তলিক কাফেরগণ অর্থ দিবে, অস্ত্র দিবে, প্রশিক্ষণ দিবে এবং নিজ খরচে প্রকাণ্ড যুদ্ধও লড়ে দিবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছে।
মু’মিনের জীবনের এজেন্ডা তাই আল্লাহর প্রদর্শিত শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাবান হওয়া এবং বিভক্তি থেকে বাঁচা। ফলে ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত পালন নয়, মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়াও। কিন্তু বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের এজেন্ডাটি ঐক্য নয়, বরং ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার পরিচয়ে বিভক্তির দেয়াল গড়া। ফলে বিভক্তির এ রাজনীতি কি আদৌ কোন মুসলিমের রাজনীতি হতে পারে? এটি তো মহাপাপ। এ পাপ ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুণে নেয়। ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠার কারণেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বহু হাজার মাইল দূরের ভূমিতে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ (সাঃ)কে তারা প্রাণপ্রিয় রাসূল ও তার প্রচারিত ধর্মকে নিজ ধর্ম রূপে গ্রহণ করতে পেরেছিল। নামে মুসলিম হলেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে সে ইসলামী চেতনা ও সে ঈমানী দায়বদ্ধতা গুরুত্ব পায়নি। বাঙালী হওয়াটিই তাদের কাছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপরদিকে রাজাকারের জীবনে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের ইসলামী চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল। এ চেতনাটি ১৯৪৭’য়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমের জীবনে এতোটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অবাঙালী মুসলিমদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহু নগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। কারণ তারা ছিল বাংলার মুসলিম ভূমিতে মেহমান।ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অসহায় অবাঙালীদেরকে সাহায্য করাকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। ভারত থেকে আসা প্রায় ৭০ লাখ মুহাজিরদের প্রতি অভিন্ন ভালবাসা দেখানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানেও। অথচ তেমন একটি মানবিক আচরণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে একাত্তরে দেখা যায়নি। বরং তারা নেমেছে অবাঙালীদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে একাত্তর তাই ইসলামী চেতনা ও চরিত্রের এক গভীর অধঃপতনের দিন। অবাঙালী মুসলিমের বিরুদ্ধে এরূপ নৃশংস আচরণ সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের অতি বর্বর অধ্যায় রূপে বহুহাজার বছর বেঁচে থাকবে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে?
বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে
ঈমানদারকে শুধু ইবাদত নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় পারস্পারিক মুসলিম ভাতৃত্বের অটুট বন্ধন নিয়েও। কারণ, সে ভাবে বাঁচতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ফলে ভাতৃত্বের সে বন্ধন নিয়ে বাঁচার মধ্যেই প্রকৃত ঈমানদারী। অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমও তার কাছে তখন প্রাণপ্রিয় ভাই গণ্য হয়। এমন চেতনার কারণেই অতীতে ইসলামী খেলাফত বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বৃহৎ ভূমির উপর বিস্তার লাভ করেছিল; এবং সে বিশাল ভূমিতে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে দেয়াল গড়ে উঠেনি। সে ভূগোল বাঁচাতে দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়নি –যেমনটি পাকিস্তান বাঁচাতে একাত্তরে হয়েছে। ঈমানের প্রকাশ তাই শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাতে নয়,বরং সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্ব, রাজনীতি ও ভূগোলের মাঝে। যে মুসলিম দেশে সেরূপ ভাতৃত্ব নাই, বুঝতে হবে সে দেশের নাগরিকদের অপূর্ণতা আছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করা বা সে বন্ধনকে অস্বীকার করার অর্থ মুসলিম উম্মাহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহ তাই শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষিত নির্দেশমালার বিরুদ্ধেও। সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বিজয় শুধু এ নয় যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে তারা বাংলাদেশে গড়তে পেরেছে। বরং তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো, প্যান-ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্রোহটি সফল করতে পেরেছে। ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার মাটিতে এটিই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনে ঘোষিত প্যান-ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ।
প্যান-ইসলামী চেতনার কারণেই বাঙালী মুসলিমের কাছে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের মত অবাঙালী নেতারা ১৯৪৭ সালে আপন জন মনে হত। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদে তেমন মুসলিম ভাতৃত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। বরং সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তারা একটি ভাষা ভিত্তিক সীমারেখা টেনে দেয়, যারা সে সীমারেখা অতিক্রম করে তাদেরকে শত্রু গণ্য করা হয়। সাতচল্লিশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে অভিন্ন চেতনার ছিল -সেটি বুঝতে ইসলামের শত্রুপক্ষ আদৌ ভুল করেনা। একারণেই মুক্তিযোদ্ধরা শুধু নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ১৯৪৭-য়ের পাকিস্তান আন্দোলনের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। তাদের কাছে বরং অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, জেনারেল ম্যানেক শ' ও জেনারেল অরোরা ন্যায় ভারতীয় ব্যক্তিত্ব। এমন এক অসুস্থ চেতনার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল এবং ইকবাল হল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে মহান কবি আল্লামা ইকবালের নাম। অথচ বাংলার মানুষ যদি সাতচল্লিশে কায়েদে আজম, ইকবাল, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই প্রতিষ্ঠা পেত না। কাশ্মীরী মুসলিমদের ন্যায় তাদেরও তখন ভারতীয় সৈন্যদের হাতে প্রতিদিন হত্যার শিকার হতে হত এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিতা হতে হত। হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হত গরু কোরবানী ও গরুর গোশতো ভক্ষণ। শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে একটি চেতনা যে মানব মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হলো তার নজির। এ চেতনার ফলে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা দাড়ী-টুপিধারী বাঙালী যুবকটিও মুক্তিবাহিনীর কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ভারত কোন প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন বাড়াতে অতীতে যুদ্ধ করেনি। সাহায্যও দেয়নি। একাত্তরেও সে লক্ষ্যে যুদ্ধ করেনি। পাকিস্তান বিভক্ত করতে যুদ্ধ করলেও ভারতীয়গণ নিজ দেশের মধ্যে ঐক্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা দিতে তারা রাজী নয়। ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটির বেশী। বাংলার মত প্রায় বিশটির চেয়ে অধীক ভাষা রয়েছে ভারতে। ভাষাগত সে ভিন্নতা নিয়ে সেদেশে বাংলাদেশের মত ২০টি স্বাধীন দেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণা ভারতীয় হিন্দুদের মাথায় স্থান পায়নি। ১৯৪৭’য়ে যেমন নয়, আজও নয়। নানা ভাষার হিন্দুরা ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একটি মাত্র রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বের বুকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। বাঙালী মুসলিমগণ সেটি পারেনি। ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর হওয়ার নেশায় কি সেটি সম্ভব? মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু কোরআন পাঠ, নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাত পালনও নয়। সেটি ভাষা, বর্ণ ও ভৌগলিকতার উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমদের সাথে একাত্ব হওয়ার সামর্থ্য। এরূপ একতা গড়া ইসলামে ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। বিজয় ও ইজ্জত আসে তো এরূপ একতার পথেই। নইলে শক্তি লোপ পায়;বিলুপ্ত হয় ইজ্জতও। মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত এবং শক্তিহীন ও ই্জ্জতহীন করার এজেন্ডা তো ইসলামের শত্রুপক্ষের। একাত্তরে সে এজেন্ডা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী। মুজিবের এজেন্ডার সাথে ভারতের এজেন্ডাও তখন একাকার হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর পিছনে ভারতের অর্থদান, অস্ত্রদান ও প্রশিক্ষণদানের মতলবটি বুঝতে হলে ভারতের এজেন্ডাকেও তাই বুঝতে হবে। ভারত তো চায় তার সীমান্ত্র ঘিরে দুর্বল ভূটান,নেপাল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাক, শক্তিশালী পাকিস্তান নয়। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে সে ভারতীয় এজেন্ডাকে আদৌ তুলে ধরা হয়নি।
শেষ হয়নি একাত্তরের যুদ্ধ
একাত্তরের যুদ্ধ একাত্তরে শেষ হয়নি। সে যুদ্ধ এখনো অবিরাম চলছে। ভারতীয় এজেন্ডাটি শুধু পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি ছিল না। লক্ষ্য, বাংলাদেশের মেরুদন্ড ভাঙ্গাও। নইলে ভারতের ভয়, পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান সৃষ্টি হবে। সেটি রুখতে ভারত চায় তার পক্ষে সৈনিক। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একাত্তরের চেতনাধারিদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। একাত্তরের ন্যায় আজও যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধী তাদেরকে তারা রাজাকার বলছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের লড়াইটিও শেষ হচ্ছে না। যতদিন পাশে ভারত আছে, ততদিন এ যুদ্ধও আছে। মেরুদণ্ড ভাঙ্গার লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশকে খণ্ডিত করার চেষ্টাও করবে। সে লক্ষ্যে ভারত অতীতে চাকমা বিদ্রোহীদের নিজভূমিতে আশ্রয় দিয়েছে এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রও দিয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ নিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতারের ন্যায় যারা স্বাধীন বঙ্গভূমি গড়ার স্বপ্ন দেখে তারাও আশ্রয় পেয়েছে ভারতে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলত দু'টি চেতনার। নানা নামের নানা দল মূলতঃ এ রণাঙ্গনে সাইডশো মাত্র। একাত্তরে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে -এ দুটি চেতনারাই প্রবল প্রকাশ পেয়েছিল। বহু বাংলাদেশী বিষয়টি না বুঝলেও ভারত সেটি ষোলআনা বুঝে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরে ভারতের প্রতি সেবাদাস চরিত্র নিয়ে যে প্রবল বাঙালী সেক্যুলার পক্ষটি গড়ে উঠেছিল ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেক্যুলার বাংলাদেশীগণ চায় সেটি চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে। বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারদের সে ভারতসেবী চেতনাটিকেই তার বলছে একাত্তরের চেতনা। বাংলাদেশের শিল্পে কোন বিনিয়োগ না করলে কি হবে, তারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এ চেতনা বাঁচাতে। ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনীতি বাঁচানোর এ বিশাল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দল এবং এনিজিওকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়ার ময়দানে নামিয়েছে। সে লক্ষ্যপূরণে শত শত পত্র-পত্রিকা, বহুশত নাট্যদল, বহু সাংস্কৃতিক দল, বহু টিভি চ্যানেল এক যোগে কাজ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত এসব এজেন্টদের সংখ্যা এজন্যই অধিক। উপরুন্ত, ভারত থেকে নিয়মিত আমদানী করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ও বই-পুস্তক। দেশের অভ্যন্তরে ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তারাই। একাত্তরের বন্দুক যুদ্ধ থেমে গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এজন্যই থামেনি। যুদ্ধের প্রচণ্ড উত্তাপ তাই দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে। ভারতের একাত্তরের যু্দ্ধের এটিই হলো ধারাবাহিকতা। শত্রুর যুদ্ধ তো এভাবেই যুগ যুগ নানা স্ট্রাটেজী নিয়ে নানা রণাঙ্গনে বেঁচে থাকে। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় লাগে না। ভারতের পক্ষে সে যুদ্ধ সফল ভাবে লড়ার জন্য তাদের ট্রোজান হর্সরাই যথেষ্ট।
ক্ষতিসাধনের উৎসব
ব্যক্তির ঈমানদারী তো ইসলামের বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে সে কতটা হিতকর বা কল্যাণকর -সেটি প্রমান করায়। ঈমানদারকে তাই প্রতি মুহুর্তে বাঁচতে হয় এ ভাবনা নিয়ে, ইসলামের বিশ্বব্যাপী বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে কীভাবে সে আরো অধীক কাজে লাগতে পারে? এমন ভাবনা নিয়েই ঈমানদার ব্যক্তি জিহাদের ময়দান খোঁজে। সে ভাবনা নিয়ে বিখ্যাত তুর্কী বীর ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার বুকে ছুটে এসেছিলেন। এভাবেই বখতিয়ার খিলজী বাংলার কোটি কোটি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করেছিলেন। নইলে আজ যারা মুসলিম,তাদের অনেকেই হিন্দু থেকে যেত। এবং গরু-বাছুর, শাপ-শকুন, নদ-নদী,পাহাড়-পর্বত ও মুর্তি পূজায় জীবন কাটিয়ে নিশ্চিত জাহান্নামের যাত্রী হতো। মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে অকল্যাণকর বা অহিতকর কিছু করা তো শয়তানের কাজ। প্রশ্ন হলো, ইসলাম ও মুসলিমের কোন কল্যাণের এজেন্ডা নিয়ে কি গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী? ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণ কি ভারতের গর্ভে বা ভারতের সাহায্য নিয়ে সম্ভব? প্রশ্ন হলো, ভারতের মত একটি আগ্রাসী হিন্দু দেশ মুসলিমের কল্যাণের যুদ্ধ করবে বা একটি বাহিনী গড়ে তুলবে -সেটি কি ভাবা যায়? আজ পর্যন্ত কোথায়ও কি ভারত তেমন কর্ম করেছে? সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র –যা এখন বেঁচে থাকলে লোক সংখ্যাটি হতো ৩৫ কোটি। এদেশটিকে খণ্ডিত করায় আগ্রহ ছিল সকল ইসলাম বিরোধী শক্তির। পলাশীর পরাজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয়েছে পাকিস্তানের বিভক্তির মধ্য দিয়ে। আর সে বিভক্তির কারণ, বাঙালী সেক্যুলার নেতৃত্ব ও তাদের সৃষ্ট মুক্তিবাহিনী। এ বিভক্তির ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে সামরিক ভাবে পঙ্গু এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতের অধিকৃত একটি দুর্বল দেশে। মুসলিম উম্মাহর সে বিশাল ক্ষতিটি নিয়ে প্রচণ্ড উৎসব শুধু ভারতের হিন্দু শাসক মহলেই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা মহলেও।
রাজাকারের চেতনায় প্রবল ভাবে যা কাজ করেছিল তা হলো ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও সামরিক আগ্রাসন থেকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচানোর প্রেরণা। ভারতীয় প্রচারমাধ্যম বিপুল সংখ্যক বাঙালীদের বিভ্রান্ত করতে পারলেও রাজাকারদের বিভ্রান্ত করতে পারিনি। ভারতের মুসলিম বিরোধী ভূমিকাকে তারা যেমন ১৯৪৭’য়ে দেখেছে, তেমনি ১৯৭১’য়ের পূর্বে এবং পরও দেখেছে। পাকিস্তানের অকল্যাণই ছিল তাদের নীতি। ভারত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই শুধু বিরোধীতা করেনি, বিরোধীতা করেছে দেশটির বেঁচে থাকার বিরুদ্ধেও। সে শত্রুতা যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরদ্ধেও। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয়দের অধীক মহবব্ত থাকার কথা নয়। পূর্ব পাকিস্তানকে মরুভূমি করতেই তারা নির্মাণ করেছে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের আগ্রাসী আচরণটি দেখা গেছে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, মানভাদর ও সিকিমে। এমন আগ্রাসী ভারতকে মুক্তিযোদ্ধাগণ আপন রূপে বরণ করে নেয়। ভারতও যে মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করতে পারে রাজাকারগণ কখনোই বিশ্বাস করেনি। দেশটির শত্রুসুলভ আচরণ দেখেছে যেমন ১৯৪৭ ও ১৯৬৫’য়ে, তেমনি ১৯৭১’য়েও। মুসলিম কল্যাণে ভারতের কিছু করার আগ্রহ থাকলে সেটির শুরু হওয়া উচিত ছিল কল্যাণকর কিছু করার মধ্য দিয়ে; একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নয়।
রাজাকারের মিশন ও মুক্তিযোদ্ধার মিশন
রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়। একাত্তরে তাদের সে মিশনটি ছিল, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর। পাকিস্তানে অবিচার ছিল, বঞ্চনা ছিল, জুলুমও ছিল। রাজনৈতিক অনাচারও ছিল। তবে সমাধান যে ছিল না তা নয়। দেহ থাকলে যেমন রোগব্যাধীও থাকে। তেমনি বৃহৎ রাষ্ট্র থাকলে তাতে নানাবিধ সমস্যাও থাকে। শরীরের ভাঙ্গা হাড্ডিটি সারাতেও সময় লাগে। রাষ্ট্রের রোগ সারাতে সময় আরো বেশী লাগে। বহু দেশে এমন সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে। যেমন পাকিস্তানের বয়সের চেয়ে অধিক কাল ধরে চলছে ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা। কয়েক যুগ ধরে চলছে সূদানের দারফোরের সমস্যা। ভারত কাশ্মীরের সমস্যা বিগত ৬৫ বছরেও সমাধান করতে পারেনি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির দাবীটি একাত্তরের কয় মাস আগেও কেউ মুখে আনেনি। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনেও এটি কোন ইস্যু ছিল না। শেখ মুজিব ও তার লাখ লাখ শ্রোতা মুক্তিযুদ্ধের শুরু মাত্র কয়েক মাস আগেও নির্বাচনী জনসভাগুলোতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে অভিযোগ -সেটির অস্তিত্ব মার্চের ১৯৭১’য়ের মার্চের একমাস আগেও ছিল না। অথচ এমন একটি অভিযোগ পাশ্ববর্তী মায়ানমারে দেড় দশক ধরে চলছে। সেদেশে ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী অং সাঙ সূচীর হাতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাঁকে গৃহবন্দী করে। সে অপরাধে কি কেউ দেশভাঙ্গার জন্য ভারতীয় সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে? বরং মায়ানমারের স্বৈরাচারী সামরিক জান্তাদের সাথে ভারতের আচরণটি লক্ষ্য করার মত। সেদেশের সামরিক জান্তার সাথে ভারত শুরু থেকেই সদ্ভাব ও সহযোগিতা বজায় রেখেছে এবং পুরাদস্তুর বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তার দোসররা নির্বাচন পরবর্তী সে সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানকে আদৌ সময় দিতে রাজী ছিল না। সেটিকে বাহানা বানিয়ে ভারত দেশটির বিনাশে হাত দেয়। এটি ছিল অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অতিশয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের মিশনটি ছিল সে ভারতীয় এজেন্ডাকে সফল করা। সে মিশনে তারা সফলও হয়।
দেশ বাঁচলেই দেশের রাজনীতি বাঁচে। বাঁচে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠার স্বাধীনতাও। একাত্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল চিহ্নিত শত্রুর পরিকল্পিত হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকে বাঁচানোর দায়বদ্ধতা। এ দায়বদ্ধতাটি ছিল দেশের প্রতিটি ঈমানদারের উপর। তেমন এক ঈমানী দায়বদ্ধতায় নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে প্রাণপনে ময়দানে নেমে আসে হাজার হাজার আত্মত্যাগী তরুণ। পাকিস্তানের এবং সেসাথে বাংলাদেশের ইতিহাসে এরাই হলো রাজাকার। তাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বহু হাজার ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। অনেকে ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসে বাংলাভাষী মানুষ নিজ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এভাবে কাফের সেনা বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে -সে ইতিহাস খুব একটা নেই। বরং ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী যখন বাংলা দখল করে নেয় তখন বাংলার কোন তরুণ একটি তীরও ছুড়েনি। কেউ প্রাণ দিয়েছে -সে নজিরও নেই। বরং অনেকে মুর্শিদাবাদের রাস্তার দুই পার্শ্বে হাজির হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর বিজয় উৎসব দেখতে। ফকির বিদ্রোহ ও মহান মুজাহিদ হাজী নেসার আলী তিতুমীরের প্রতিরোধ এসেছে অনেক পরে।
একাত্তরের বহু হাজার রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার –এ দুই পক্ষের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছে এবং নির্যাতীত হয়েছে এই রাজাকারেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যা কিছু হয়েছে তা লড়াইয়ের মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে। কিন্তু রাজকারদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে একাত্তরের পরও। বরং তাদের উপর লাগাতর হামলা হচ্ছে বিগত ৪৪ বছর ধরে। সেটিকে অব্যাহত রাখারও অবিরাম চেষ্টা চলছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুধু গালিগালাজই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার মুসলিমদের কল্যাণে তাদেরও যে একটি রাজনৈতিক দর্শন, কৌশল বা স্ট্রাটেজী ছিল -সে সত্যটিকে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। রাজাকারদের অধিকার দেয়া হয়নি তাদের চেতনা ও দর্শনের কথাগুলো লোক-সম্মুখে তুলে ধরার। অথচ সেটিও হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাজাকারের দর্শন ও মুক্তিযোদ্ধার দর্শন
রাজকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মুল পার্থক্যটি ভাষা বা বর্ণের নয়। সেটি দর্শনের। রাজাকারের কাছে যেটি গুরুত্ব পেয়েছিল সেটি হলো ভাষা ও অঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধিতে কাজ করা। পাকিস্তান ছিল বহু ভাষাভাষি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতীক। আজও সেটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাই সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়ভার শুধু পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচদের উপর ছিল না। বহু বাঙালী মুসলিমও সে দায়িত্ব পালনকে ফরজ ভেবেছে। কারণ বাঙালীগণ ছিল সে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। শেখ মুজিব তাদের আদর্শ ছিল না। গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বা প্রীতিলতাও নয়। তাদের সামনে অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম -যাদের শতকরা ৭০ ভাগের অধিক শহীদ হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী উম্মাহ গড়ায়। তাদের দৃষ্টিতে বাঙালী মুসলিমের মূল কল্যাণটি বাঙালী রূপে বেড়ে উঠায় নয়, বরং ইসলামের বিজয়ে অঙ্গীকারটি হৃদয়ে ধারণ করে ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠায়। সে কল্যাণিট অনন্ত আখেরাতেও। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দিতে হবে ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণে কার কি অবদান সেটির। তাঁর মহান আদালতে কার কি ভাষা বা বর্ণ -সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। তাই ভাষার নামে রাষ্ট্র গড়ায় কোন কল্যাণ নেই। ইসলামে এটি ফরজ নয়,নবীজীর সেটি সূন্নতও নয়। এমন রাষ্ট্র গড়ায় প্রাণ দিলে কেউ শহীদ হয় না। শহীদ হতে হলে লড়াইটি নির্ভেজাল আল্লাহতায়ালার দ্বীনপালন ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হতে হয়। হতে হয় মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়। অথচ মুক্তিবাহিনী যে পথ ধরেছিল সেটি ছিল মুসলিম রাষ্ট্রকে ছোট করার তথা ক্ষতি সাধনের এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশের বুকে ভারতের ন্যায় কাফের রাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়ানো। তাই মুক্তিবাহিনীর গঠনে, প্রশিক্ষণে ও তাদের অস্ত্রদানে ভারত এতোটা আগ্রহী ছিল। ভারত তো পাকিস্তান ভাঙ্গার এমন একটি যুদ্ধ নিজ সৈন্য, নিজ অস্ত্র ও নিজ অর্থে ১৯৪৭ সাল থেকেই লড়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভাষা বা বর্ণ-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে সাহাবায়ে কেরাম প্রাণ দান দূরে থাক, সামান্য শ্রম, সময় বা অর্থ দান করেছেন -সে প্রমাণ নেই। এরূপ ভাঙ্গার কাজ গুরুত্ব পেলে হাজার বছর আগেই অখণ্ড খেলাফত ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় পঞ্চাশটিরও বেশী স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারতো।
একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরে ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কম্যুনিষ্ট পার্টি -মূলত এ তিনটি সেক্যুলার দল। ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের কোন অঙ্গীকার ছিল না। বরং তারা ছিল ইসলামের প্রতিপক্ষ শক্তি। পাকিস্তানকে তারা সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি মনে করতো। তারা দেশটির ভাঙ্গার লড়ায়ে ভারতের সহযোগী ছিল। এ দলগুলির ছিল নিজ নিজ দলীয় ছাত্র সংগঠন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিল এসব দলের ছাত্র সংগঠনেরর সদস্যরা। অপর শিবিরের দলগুলো হলো মুসলিম লীগের তিনটি মূল উপদল, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষম-শ্রমিক পার্টি এবং জমিয়তে আহলে হাদীস। এছাড়াও আরো কিছু ছোট দল ছিল। রাজাকারগণ মূলত আসে এসব দলগুলি থেকে। রাজাকারদের মাঝে বহু নির্দলীয় ব্যক্তিও ছিল। তারা ছিল বিভিন্ন পীরের মুরীদ, ছিল মাদ্রাসার নির্দলীয় ছাত্র। তাদের সবার কাছে পাকিস্তান ছিল স্বপ্নের দেশ;এবং ভারতীয় আধিপত্য থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ।
১৯৪৭’য়ের পূর্বে শেখ মুজিব নিজেও কলকাতায় থাকা কালে মুসলিম লীগের প্যান-ইসলামী দর্শনের স্রোতে কিছু কাল ভেসেছেন। কলকাতার রাজপথে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানও বলেছেন। কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর সে স্রোত কমে যাওয়ায় সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের চড়ে তিনি আটকা পড়েন। এভাবে ছিটকে পড়েন পাকিস্তান সৃষ্টির মূল মিশন থেকে এবং যোগ দেন পাকিস্তানের শত্রু শিবিরে। যাদের মাঝে ইসলামী দর্শনের বলটি প্রবল, একমাত্র তারাই ইসলামের পক্ষে প্রবল স্রোত সৃষ্টি করে এবং সে স্রোতে শুধু নিজেরাই চলে না, অন্যদেরও ভাসিয়েও নেয়। ইসলামী দর্শন তো অমর। ফলে প্যান-ইসলামী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তানের প্রয়োজনটি ফুরিয়ে যাবে -সেটি মুসলিম সন্তানেরা মেনে নেয় কি করে? ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্ট ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য কম্যিউনিষ্ট, নাস্তিক, হিন্দু, বাঙালী জাতীয়তাবাদী, ভারতীয় এজেন্ট, ইহুদী এজেন্ট ও সেক্যুলারগণ মেনে নিলেও কোন রাজাকার মেনে নেয়নি। মুক্তিযু্দ্ধের চেতনাধারিদের থেকে রাজাকারদের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই।
ভিন্নতা শত্রু-মিত্র চেনায়
কে শত্রু আর কে মিত্র –মানুষ সে ধারণাটি পায় তার দর্শন থেকে। তাই ইসলাম যাদেরকে শত্রু বা মিত্র রূপে চিহ্নিত করে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র তা করে না। মুসলিমের শত্রু বা মিত্র আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের শত্রু বা মিত্র -তাই এক নয়। এজন্যই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে বন্ধু রূপে গৃহীত হয় নাস্তিক সোসালিস্ট, কম্যিউনিস্ট এবং পৌত্তলিকরা। ফলে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল ভারতের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের সাথে কোয়ালিশন গড়াটিও। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারতীয় হিন্দু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, শিখ জেনারেল অরোরা, পারসিক জেনারেল মানেক শ’, ইহুদী জেনারেল জ্যাকব অতিশয় আপনজন মনে হয়েছে। এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমনকি নিজ দেশ, নিজ ধর্ম ও নিজ ভাষার নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাটিও বীর-সুলভ মনে হয়েছে। ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার নিরস্ত্র রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে তো এমন এক চেতনাতেই।
প্রতারণার স্বার্থে অতি দুর্বৃত্তদেরও ফেরেশতা সাজার আয়োজন দেখা যায়। সেটি যেমন তাদের কথাবার্তা ও বক্তৃতায়, তেমনি সাজগোজে। তবে ব্যক্তির মনের গোপন অভিলাষ ও তার আসল চরিত্রটি বুঝার মোক্ষম উপায়টি হলো তার নিকটতম বন্ধুদের দিকে তাকানো। কারণ বন্ধু নির্বাচনে সবাই তার মন ও মতের অতি কাছের লোকটিকে বেছে নেয়। তাই শেখ মুজিব বা তার বাঙালী জাতীয়তাবাদী সহচরদের চরিত্র ও তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা বুঝতে হলে ভারতীয় নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র ও এজেন্ডা বুঝতে হবে। এজন্য মুজিবের লম্বা লম্বা বক্তৃতা শোনার প্রয়োজন নেই। রাজাকারগণ তাই মুজিবকে চিনেছিল তার ঘনিষ্টতম বন্ধু ভারত সরকারের আগ্রাসী আধিপত্যবাদ ও মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস থেকে। একাত্তরের পর ভারতের অবাধ লুণ্ঠন, তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষে মৃত্যু এবং অধিকৃত বাংলাদেশের চিত্রটিই তাদের সে ধারণাকে শতভাগ সঠিক প্রমাণিত করেছে। মানুষকে শুধু বিষাক্ত পোকামাকড় ও হিংস্র পশুদের চিনলে চলে না। রাজনীতির ময়দানের ভদ্রবেশী প্রতারকদেরও চিনতে হয়। নইলে দেশ অধিকৃত হয় ও তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হয়। দেশে তখন দুর্ভিক্ষও নেমে আসে। গণতন্ত্রের বদলে তখন বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমদের ব্যর্থতাটি এক্ষেত্রে প্রকট। সে ব্যর্থতাটি মুক্তিযোদ্ধাদেরও। তারা যেমন শত্রুদের চিনতে পারিনি, তেমনি ব্যর্থ হয়েছে সত্যিকার বন্ধুদের চিনতেও। যে মুসলিম লীগ ১৯৪৭’য়ে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে স্বাধীনতা এনে দিল তাদেরকে বরং শত্রু মনে করেছে। পাশে আশ্রয় নেয়া অবাঙালী মুসলিমদেরভাই রূপে গ্রহণ করতেও ব্যর্থ হয়েছে। বিভাজন গড়েছে স্রেফ ভাষার ভিত্তিতে। অবিঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়ানো হয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণাবোধে। অথচ এমন বিভক্তি ও ঘৃণাবোধ ইসলামে হারাম। এ মহাপাপ আযাব ডেকে আনে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে ৬৫ লাখ ভারতীয় আশ্রয় পেয়েছিল, আশীর দশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর আশ্রয় পায় ৩০ লাখ আফগান, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লেবাননের জনসংখ্যার প্রায অর্ধেক হলো রিফিউজী। অথচ বাংলাদেশে কয়েক লাখ বিহারীর বসবাসের স্থান হয় না। তাদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বস্তিতে পাঠানো হয়। সাগরে ভাসমান প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমগণও বাংলাদেশের উপকূলে নৌকা ভেড়ানোর অনুমতি পায়নি। সেক্যুলার বাঙালীগণ মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে উঠায় যে কতটা ব্যর্থ –সেটি বুঝতে এর পরও কি কিছু বাঁকি থাকে?
রাজাকারের স্বপ্ন ও মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন
সবাই যেমন জীবনে একই লক্ষ্য নিয়ে বাঁচে না, তেমনি একই রূপ স্বপ্নও দেখে না। মানুষে মানুষে স্বপ্নের জগত জুড়ে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। সে বিশাল পার্থক্যটি ছিল রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার মাঝেও। রাজাকারের চেতনা-রাজ্যের সবটুকু জুড়ে যে বিরাট স্বপ্ন ছিল, সেটি বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উত্থানের। স্বপ্নটি ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার। সে জন্যই তারা বিশ্বের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্রটিকে ভারতীয় হামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। দেহে প্রাণ থাকা যেমন জীবনের লক্ষণ,তেমনি এরূপ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচাটিও ঈমানের লক্ষণ। আর প্রকৃত ঈমানদারের শুধু এ স্বপ্নটুকুই থাকে না, সে স্বপ্নের বাস্তবায়নে প্রাণপন প্রচেষ্টাও থাকে। এজন্যই তো ঈমানদার মাত্রই আল্লাহর পথের রাজাকার তথা স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক। এ কাজে তাকে ময়দানে নামতে কেউ বাধ্য করে না,নামে নিজ ঈমানী দায়বদ্ধতায়। আল্লাহর দ্বীনের এমন রাজাকার হলো প্রতিযুগের মুজাহিদগণ। রাজাকার ছিলেন তারাও যারা সাতচল্লিশে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বণিতে কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়েছেন। রাজাকার তাদেরও বলা হতো যারা ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনাধীন হায়দারাবাদের স্বাধীনতা বাঁচাতে যুদ্ধ লড়েছিল।
একাত্তরের রাজাকারগণ তাই মুসলিম ইতিহাসের একমাত্র রাজাকার নন। অতীতের ন্যায় এমন রাজাকার আজও অসংখ্য। এরাই আল্লাহর দ্বীনের বিজয় নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আজও তারা প্রতিরোধে নামে। এ সত্যটুকু বুঝতে শয়তান ভুল করে না। ভুল করে না শয়তানী শক্তির বাংলাদেশী সেবাদাসেরাও। তাই বাংলাদেশের রাজপথে যখন দাড়ি-টুপিধারীদের রাজাকার বলে লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। বিস্ময় তখনও জাগে না, যখন একাত্তরের পরে জন্ম নেয়া ইসলামী চেতনাধারী যুবককে রাজাকার বলে হত্যা করা হয়। বিস্ময় জাগে না, যখন একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি আশি বছরের এক বৃদ্ধ আলেমকে রাজাকার বলা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। রাজাকারের সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানশূণ্য ও চিন্তাশূণ্য মুসলিমদের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু সে সংশয় শয়তানের নেই। শয়তানের অনুসারিদেরও নেই। তাই রাজাকার চিনতে তারা ভুল করে না। শয়তানী শক্তির এজেন্টগণ যখন দেশের মাদ্রাসা-মসজিদ গুলোকে রাজাকার উৎপাদনের কারখানা বলে তখন তারা ভুল বলে না। কারণ এগুলোই লড়াকু মুজাহিদ তৈরীর কাজে মহান আল্লাহতায়ালার ইনস্টিটিউশন।
নবীজী (সাঃ)র হাদীস, “গুনাহ বা ক্ষতিকর কাজ হতে দেখলে ঈমানদারের দায়িত্ব হলো সে কাজ শক্তি বলে রুখা। শক্তি না থাকলে মুখের কথা দিয়ে প্রতিবাদ করা। আর সেটিও না থাকলে মন থেকে সেটিকে ঘৃণা করা। আর এ ঘৃণাটুকুও না থাকলে বুঝতে হবে, তার অন্তরে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই”। একটি মুসলিম দেশকে খন্ডিত করার চেয়ে জঘন্য খারাপ কাজ আর কি হতে পারে? মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজই বা আর কি হতে পারে? দেশ খন্ডিত হওয়ায় যে দূর্বলতা বাড়ে, সেটি কি মাথাপিছু আয়ু বাড়িয়ে দূর করা যায়? কুয়েত, আবুধাবি, কাতার, সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অধিক। কিন্তু তাতে কি শক্তি বেড়েছে? বেড়েছে কি প্রতিরক্ষার সামর্থ্য। শত্রুপক্ষ যখন কোন দেশকে দূর্বল করতে চায় তখন তারা সে দেশটির মানচিত্রে হাত দেয়। ভারত সেটি করেছিল পাকিস্তানের বিরদ্ধে। কোন ঈমানদার কি কাফের শক্তির হাতে মুসলিম উম্মাহর দেহ এভাবে টুকরো টুকরো হতে দেখে খুশি হতে পারে? খুশি হলে তার মনে যে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নাই -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? রাজাকারগণও তাই দর্শকের ভূমিকায় না থেকে ময়দানে নেমেছে। দেশের ভূগোলের উপর হামলা রুখতে সাহাবায়ে কেরাম জিহাদ করেছেন, দলে দলে শহীদও হয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অপুরণীয় ক্ষতি করতেই আরব বিশ্বকে খন্ডিত করেছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ। অখণ্ড আরব ভূগোলকে ভেঙ্গে তারা বাইশ টুকরায় বিভক্ত করেছে। আরবদের এভাবে দূর্বল ও নির্জীব করার পরই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল।
আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মুসলিমের বন্ধু হতে হলে তো তাকে মুসলিম ও ইসলামেরও বন্ধু হতে হয়। মুসলিম দেশের অখণ্ডতার হেফাজতে কাফেরদের বিরুদ্ধেও বীরদর্পে রুখে দাঁড়াতে হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর তায়ালার ঘোষণা,“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।..” আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার অর্থ শুধু আমিও মুসলমান –এ টুকু বলা নয়। কিছু ইবাদত-বন্দেগী নয়। আল্লাহপাক তার বান্দাহ থেকে বৃহ্ত্তর কিছু চান। সেটি ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায় অঙ্গীকার ও কোরবানী। এটিই ছিল রাজাকারের জীবনে মিশন। তারা ফেরেশতা ছিল না, তাদের জীবনেও বহু ভূল-ত্রুটি ছিল। কিন্তু একাত্তরে তাদের জীবনের পাকিস্তান বাঁচানোর মিশনটি পুরাপুরি ইসলামী ছিল। অপরদিকে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা ভারতের দেয়া রোডম্যাপকেই নিজেদের রাজনীতির রোডম্যাপে পরিণত করেছে। মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষার জন্য কিছু করার বদলে তারা সেটিকে ক্ষুদ্রতর করেছে। এভাবে প্রচণ্ড খুশি বাড়িয়েছে কাফেরদের। আর কাফেরদের মুখে হাসি বাড়িয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়া যায়?
মিথ্যাচার,দূর্নীতি ও স্বৈরাচার কখনোই কোন দেশে একাকী আসে না। নৈতিক এ রোগের মহামারিতে মৃত্যু বরণ করে জনগণের বিবেক।মিথ্যা বলা বা মিথ্যা লেখাও তখন অভ্যাসে পরিণত হয়। দেশের ইতিহাসও তখন মিথ্যাচারে পূর্ণ হয়। স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা দেয় ব্যক্তিপুঁজার।ফিরাউনের ন্যায় দুর্বৃত্তগণও তখন পুঁজণীয় হয়। তাছাড়া ইতিহাসের পাতায় স্বৈরচারী দুর্বৃত্তদের বাঁচার খায়েশটিও বিশাল। একারণেই বিস্তর মিথ্যাচার ঢুকে ইতিহাসে। একাত্তরের ইতিহাসের বিশাল অংশ জুড়ে তাই মুক্তিযুদ্ধের গুণকীর্তন। কিন্তু রাজাকারদের নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা নেই; উল্লেখ আছে স্রেফ ভিলেন রূপে। চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানের দালাল রূপে। কিন্তু দালালের কর্মে থাকে অর্থপ্রাপ্তির লোভ, তাতে মনের সম্পর্ক থাকে না। প্রাণদানের স্পৃহাও জাগে না। বাংলাভাষী হলেও প্রতিটি রাজাকার ছিল জন্মসূত্রে পাকিস্তানী; তারা মুক্তিবাহিনীর প্রতিপক্ষ রূপে দাঁড়িয়েছিল পাকিস্তানের গর্বিত ও নিষ্ঠাবান নাগরিক রূপে। কথা হলো, নিজ জন্মভূমির পক্ষে নামলে তাদেরকে কি দালাল বলা যায়? কিন্তু একাত্তরের ইতিহাসে রাজাকারের সে পরিচয়টি আলোচিত হয়নি। তাই আগামী প্রজন্মের জন্য প্রশ্ন থেকে যায়, কারা এ রাজাকার? কি ছিল তাদের মিশন? কেনই বা বাঙালী হয়েও তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় প্রাণপনে বিরোধীতা করলো এবং রক্ত দিল? কি ছিল তাদের রাজনৈতিক দর্শন? কিসে তারা অনুপ্রাণিত হলো? শুধু আজ নয়,বহুশত বছর পরও এ প্রশ্নগুলি বাংলাদেশের ইতিহাসের পাঠকের মনকে আন্দোলিত করবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই।
রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা –উভয়েই একাত্তরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি পক্ষ। যে কোন যুদ্ধে দুটি পক্ষ থাকে, সেটি একাত্তরেও ছিল। ইতিহাসের অর্থ স্রেফ একটি পক্ষের ধারাবিবরণী নয়। একাত্তরের যুদ্ধটি ছিল রাজনীতির দুটি বিপরীত ধারা ও দুটি বিপরীত দর্শনের সংঘাত। প্রতিদেশেই রাজনীতি নিয়ে এরূপ নানা মত থাকে, নানা প্রতিপক্ষও থাকে। সেসব মত ও পথ নিয়ে লড়াইও থাকে। কারণ, দেশের কল্যাণ নিয়ে সবাই একই ভাবে ভাবে না। বিপরীতমুখি নানা ভাবনা যেমন ১৯৭১ সালে ছিল, তেমনি ১৯৪৭ সালেও ছিল। আজ যেমন আছে, তেমনি আজ থেকে শত বছর বা হাজার বছর পরও থাকবে। এর মধ্যে কেউ হারবে এবং কেউ জিতবে। ইতিহাসে কারো বিজয়ই চিরস্থায়ী হয় না। দিন বদলের সাথে সরকারেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু কোন একটি পক্ষের পরাজয় বা বিদায় হলে সে পক্ষের ইতিহাসকে বিলুপ্ত করা যায় না। তাদের জন্যও ইতিহাসে স্থান ছেড়ে দিতে হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগ জিতেছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে তারা হেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস পড়লে মনে হয় দেশটির ইতিহাসের শুরুটি ১৯৭১ থেকে; বড় জোর ১৯৫২ সাল থেকে। এ ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের নায়কদের জন্য স্থান রাখা হয়নি। কারণ তা হলে কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, নবাব সলিমুল্লাহ, খাজা নাযিমুদ্দীন, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আকরাম খাঁ, নূরুল আমীন, মৌলভী তমিজউদ্দীন খান, আব্দুর সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী ন্যায় শত শত ব্যক্তিকে ইতিহাসে স্থান দিতে হয়। আর সেটি হলে শেখ মুজিবের ন্যায় ১৯৭১’য়ের নায়কদের জন্য স্থান বহুলাংশে কমে যায়। মুজিবের অনুসারিগণ সে ছাড় দিতে রাজী নয়। মুজিবের অনুসারিদের লড়াই তাই স্রেফ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল নিয়ে নয়, ইতিহাসের দখলদারি নিয়েও। বাংলাদেশের ইতিহাস তাদের হাতেই অধিকৃত। স্বৈরাচারী রাজনীতির এ হলো আরেক কুফল।
বাংলাদেশে পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচনার কাজটি শুরু করেছে ভারতের সাহায্যপুষ্ট একাত্তরের বিজয়ী পক্ষ। ইতিহাস রচনার নামে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে পাকিস্তানপন্থী ও ইসলামপন্থী নেতাদের গায়ে লাগাতর কালিমা লেপন। ফলে রাজাকারকে চিত্রিত করেছে যুদ্ধাপরাধি রূপে; এবং নিজেদেরকে চিত্রিত করেছে দেশের সর্বকালের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তান রূপে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে কোন মানুষ খুন, ধর্ষণ, গৃহ-লুট বা অন্য কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে -ইতিহাসে তার বিন্দুমাত্র বিবরণও নেই। লক্ষাধিক বিহারী, রাজাকার ও পাকিস্তানপন্থীদের মৃত্যু হয়েছে যেন আসমান থেকে বাজ পড়ায়। তাদের ঘরবাড়ি, ব্যাবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পদ লুট হয়েছে যেন কোন অজানা কারণে! বাংলাদেশের ইতিহাসে এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। দেশের ইতিহাস তো এভাবেই কলুষিত হয় এবং আঁস্তাকুড়ে গিয়ে পড়ে। প্রতিটি ব্যক্তির রাজনীতি, কর্ম ও আচরণ পরিচালিত হয় তার চিন্তা-চেতনা ও দর্শন থেকে। এমনকি অতিশয় দুর্বৃত্তও দুর্বৃত্তিতে অনুপ্রেরণা পায় জীবন-জগত নিয়ে তার বিশেষ ধ্যান-ধারণা থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণার সে উৎসটি কি? রাজাকারগণই বা কোত্থেকে পেল সে চরম দুর্দিনে স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণা? বাংলাদেশের ইতিহাসে সে সবেরও উত্তর নেই। সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া কি এতোই কঠিন? ভিলেন রূপে নয়, রাজাকারদেরকে রাজাকার রূপে দেখলে সে উত্তরটি সহজে পাওয়া যেত।
লড়াইটি দর্শনের
১৯৭১’য়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’টি দর্শন প্রবল ভাবে কাজ করেছিল। একটি হলো প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন-এ থেকেই জন্ম নিয়েছিল অখণ্ড পাকিস্তান বাঁচানোর চেতনা। এটিই হলো রাজাকারের চেতনা। অপরটি ছিল ভাষাভিত্তিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার দর্শন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনার উৎস হলো এটি। একাত্তরের ঘটনাবলীর যথার্থ বিশ্লেষণে এ দু’টি চেতনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং ঘটনার মূল্যায়নে সে দু’টিকে সামনে রাখতে হবে। নইলে বিচারে প্রচণ্ড অবিচার হবে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কর্ম, আচরণ, রুচীবোধ ও রাজনীতিতে যে ব্যাপক পার্থক্য -তা তো এই চেতনার পার্থক্যের কারণেই; খাদ্য-পানীয়, শারীরিক বৈশিষ্ট বা জলবায়ুর কারণে নয়। তাই একই রূপ পানাহার ও জলবায়ুতে বেড়ে উঠে কেউ রাজাকার হয়েছে এবং কেউ মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। ব্যক্তি ক্ষণজন্মা, কিন্তু চেতনা বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর। তাই আজকের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন বেঁচে আছে, তেমনি বেঁচে আছে রাজাকারের চেতনাও। এ দু’টি চেতনা ১৯৭১য়ে যেমন ছিল, তেমনি একাত্তরের পূর্বে ১৯৪৭য়েও ছিল। তেমনি বহু শতবছর পরও থাকবে।
ব্যক্তির চরিত্র, চেতনা ও রাজনৈতিক নীতিমালার নির্মাণে যেটি কাজ করে সেটি হলো একটি জীবন-দর্শন। মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এ দর্শন। দর্শন বেঁচে থাকে হাজার হাজার বছর ধরে। সেটি যদি হয় ইসলামী দর্শন, তবে তা তো অমর। ব্যক্তি তার দর্শন থেকেই কর্মে, ত্যাগে ও প্রাণদানে প্রেরণা পায়। রাজাকারের চেতনায় সে দর্শনটি ছিল ইসলামের। সে দর্শন থেকেই তারা পেয়েছিল প্যান-ইসলামী চেতনা; পেয়েছিল মুসলিম স্বার্থের প্রতি অঙ্গীকার। ফলে রাজাকারদের রাজনীতিতে ভাষা, বর্ণ বা আঞ্চলিকতা কোনরূপ গুরুত্ব পায়নি। ফলে একাত্তরে বাংলা ভাষার নামে যখন পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ হচ্ছিল, তখন রাজাকারগণ সে লড়ায়ে যোগ দেয়নি। বরং সে সময় বহু হাজার বাঙালী রাজাকার পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় প্রাণ দিয়েছে।তারা মুজিব সরকারের জেল খেটেছে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছে। তাদের সে ত্যাগের পিছনে যে দর্শনটি কাজ করেছিল সেটি ছিল মুসলিম ভ্রাতৃত্বের দর্শন। সে দর্শনে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা ভূগোলভিত্তিক বিভেদের প্রাচীর গড়ার বৈধতা নেই।বরং বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গাটি তাদের কাছে ইবাদতে পরিণত হয়েছে। এমন দর্শনের প্রতিষ্ঠায় তারা অর্থ, শ্রম ও রক্তও দিয়েছে। রাজাকারের এ দর্শনের জন্মটি একাত্তরে নয়, সাতচল্লিশেও নয়। এ দর্শনের জন্ম তো তখন, যখন ইসলাম সমগ্র মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে একমাত্র ধর্ম রূপে নির্ধারিত হয়েছিল। এ ধর্ম বিভেদের দেয়াল ভাঙ্গতে শেখায়। বিভক্তির সে দেয়াল ভেঙ্গেই আরব, ইরানী, তুর্ক, কুর্দ, মুর ও অন্যান্য ভাষাভাষী মুসলিম ইসলামের পতাকা তলে একতাবদ্ধ হয়েছিল এবং উম্মতে ওয়াহেদার জন্ম দিয়েছিল। এটিই তো ইসলামের রীতি। রাজাকারগণ ছিল সে রীতির অনুসারি। শুধু একাত্তরে নয়, সর্বকালে ও সর্বস্থানে সে রীতি নিয়ে বাঁচাই হলো প্রকৃত ঈমানদারী। ইসলামের এ দর্শন বাঙালী মুসলিমদের মাঝে লক্ষ লক্ষ নিষ্ঠাবান অনুসারি পাবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছিল। একাত্তেরর এ সত্যটি আবিস্কারে বাঙালী জাতীয়তাবাদীগণ ব্যর্থ হয়েছে।
ব্যক্তির মন যা জানে না,তার চোখও সেটি দেখতে পায় না। চোখ তো তখনই দেখে যখন তার পিছনে আলোকিত মন কাজ করে।মনের অন্ধকারে তাই চোখও অন্ধ হয়। মহান আল্লাহতায়ালার কুদরত দেখতে হলে তাই জ্ঞানবান মন চাই।তাঁর সৃষ্ট বিশাল জগতে বসবাস করেও বেঈমানেরা তাই তাঁর কুদরত দেখতে ব্যর্থ হয়।অজ্ঞের পক্ষে তাই ঈমানদার হওয়া অসম্ভব।ইসলামে তাই জ্ঞানার্জন প্রথমে ফরজ করা হয়েছে, নামায-রোযা বা হজ-যাকাত নয়।একই কারণে ইসলামী চেতনাশূণ্য সেক্যুলারিস্টগণ তাই রাজাকারদের দর্শনের বলটি দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশ এবং সে সাথে নিজের দেশ বাঁচাতে যে ধর্মপ্রেমিক ও দেশপ্রেমিক মানুষগুলো অকাতরে প্রাণ দিল -তাদের কাছে তারা অর্থলোভী দালাল ও যুদ্ধাপরাধী মনে হয়েছে!
বাঙালী জাতীয়বাদীদের দর্শনটি ছিল ভাষা ও আঞ্চলিকতার নামে দেয়াল গড়া তথা বিভেদ গড়ার দর্শন। এটি পাপের পথ। ইসলামে এমন বিভক্তি হারাম, এবং শরিয়তের আইনে দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। মুক্তিবাহিনীর সদস্যগণ ছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদীর অনুসারি; তাদের কাছে প্যান-ইসলামীক মুসলিম ভাতৃত্বের চেতনাটি পরিত্যক্ত হয়। এমন নীতি কাফেরদের থেকে সমর্থণ পাবে –সেটি স্বাভাবিক; কিন্তু কোরঅআন-হাদীস বা নবীজীর সূন্নাহ থেকে নয়। তাই একাত্তরে তাদের আশ্রয়দাতা, সাহায্যদাতা, প্রশিক্ষণদাতা ও একান্ত বন্ধু গণ্য হয় ভারতীয় কাফেরগণ, কোন মুসলিম দেশ নয়।তাদের কাছে রাজাকারগণ গণ্য হয় হত্যাযোগ্য প্রতিপক্ষ রূপে। ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে গভীর বিচ্যুতির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অবাঙালী মাত্রই “ছাতুখোর” শত্রু এবং ঘৃণার যোগ্য –এমনকি হত্যাযোগ্য গণ্য হয়েছে।অথচ রাজাকারদের কাছে সেটি মনে হয়নি। যেমন সাতচল্লিশে মনে হয়নি, তেমনি একাত্তরেও নয়। বরং পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ তথা সকল ভাষার মুসলিমগণ গণ্য হয়েছে তার প্রাণপ্রিয় মুসলিম ভাই রূপে। কারণ সেরূপ গণ্য করাটাই মহান আল্লাহতায়ালার হুকুম।-(সুরা হুজরাত, আয়াত ১০)। নইলে চরম অবাধ্যতা হয় মহান রাব্বুল আলামীনের। তাই ঈমানদারগণ কি তার পাঞ্জাবী, বিহারী, পাঠান, সিন্ধি, বেলুচ ভাইকে হত্যা করতে পারে? একাত্তরে বহুলক্ষ অবাঙালীকে নিজেদের ঘর থেকে বের করে যেভাবে বস্তিতে বসানো হয়েছে, তাদের ঘরবাড়ী, ব্যবসাবাণিজ্য ও সহায়-সম্পদকে যেভাবে ছিনতাই করা হয়েছে -সেটি মুসলিম সংস্কৃতি নয়। মানবতার সংস্কৃতিও নয়। এটি নিতান্তই মুক্তিযুদ্ধের বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি।এমন অপরাধ কর্মের গভীর স্বাদৃশ্য মেলে হিটলারের ফ্যাসিবাদের সাথে। ইসলামে এমন কর্ম শুধু হারামই নয়, শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। সেটি গুরুতর যুদ্ধাপরাধ আন্তর্জাতিক আইনেও। এরূপ বর্বর জাতীয়তাবাদী চেতনার কারণেই জার্মানগণ লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে জ্যান্ত হত্যা করেছে। মুজিব ও তার অনুসারিগণ সে বর্বর ফ্যাসিবাদের আবাদ বাড়িয়েছে বাংলাদেশে। বঙ্গিয় ভূমিতে ইসলাম আগমনের পর এরূপ বর্বর অসভ্যতা আর কোন কালেই প্রতিষ্ঠা পায়নি। মুজিব ও তার অনুসারিগণ আর কোন কারণে না হোক, অন্ততঃ এ অসভ্যতার কারণে বাঙালীর ইতিহাসে শত শত বছর বেঁচে থাকবে। বাঙলার মুসলিম সংস্কৃতিতে এমন অসভ্যতার কি স্থান আছে? বরং এ সংস্কৃতি তো তুর্কি বীর ইখতিয়ার মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী, ইয়েমেনি সুফিসাধক শাহ জালাল, আফগান বীর ঈসা খাঁ’দের ন্যায় নানা ভাষা ও নানা বর্ণের মুসলিমদের বাংলার বুকে আপন করে নেয়ার সংস্কৃতি।
মহান আল্লাহতায়ালা ব্যক্তিকে ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠতে নির্দেশ দেন। পবিত্র কোরআনে বহু বার ঘোষিত হয়েছে সে নির্দেশ। বলা হয়েছে, “আক্বীমু দ্বীন ওয়ালা তাতাফাররাকূ” –(সুরা শুরা,আয়াত ১৩)। অর্থঃ দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করো এবং বিভক্ত হয়োনা। বলা হয়েছে, “ওয়া তাছিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়াঁও ওলা তাফাররাকু” -(সুরা আল ইমরান,আয়াত ১০৩)। অর্থঃ তোমরা আল্লাহর রশিকে (তথা কোরআনকে) শক্ত ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না। প্রতি যুগে প্রতি ঈমানদার ব্যক্তির প্রতি মহান আল্লাহতায়ালার এটিই হলো নির্দেশ। মুসলিম দেশে বিচ্ছন্নতার যুদ্ধ তাই মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এমন যুদ্ধে পৌত্তলিক কাফেরগণ অর্থ দিবে, অস্ত্র দিবে, প্রশিক্ষণ দিবে এবং নিজ খরচে প্রকাণ্ড যুদ্ধও লড়ে দিবে -সেটিই কি স্বাভাবিক নয়? একাত্তরে তো সেটিই ঘটেছে।
মু’মিনের জীবনের এজেন্ডা তাই আল্লাহর প্রদর্শিত শরিয়ত প্রতিষ্ঠায় নিষ্ঠাবান হওয়া এবং বিভক্তি থেকে বাঁচা। ফলে ঈমানদার হওয়ার দায়বদ্ধতা শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাত পালন নয়, মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়াও। কিন্তু বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের এজেন্ডাটি ঐক্য নয়, বরং ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার পরিচয়ে বিভক্তির দেয়াল গড়া। ফলে বিভক্তির এ রাজনীতি কি আদৌ কোন মুসলিমের রাজনীতি হতে পারে? এটি তো মহাপাপ। এ পাপ ব্যক্তিকে জাহান্নামের আগুণে নেয়। ভাষা,বর্ণ ও আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠার কারণেই বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বহু হাজার মাইল দূরের ভূমিতে জন্ম নেয়া মুহাম্মদ (সাঃ)কে তারা প্রাণপ্রিয় রাসূল ও তার প্রচারিত ধর্মকে নিজ ধর্ম রূপে গ্রহণ করতে পেরেছিল। নামে মুসলিম হলেও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে সে ইসলামী চেতনা ও সে ঈমানী দায়বদ্ধতা গুরুত্ব পায়নি। বাঙালী হওয়াটিই তাদের কাছে সবেচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অপরদিকে রাজাকারের জীবনে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের ইসলামী চেতনাটি ধারাবাহিকতা পেয়েছিল। এ চেতনাটি ১৯৪৭’য়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমের জীবনে এতোটাই প্রবল ছিল যে, ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অবাঙালী মুসলিমদের জন্য ঢাকাসহ পূর্ব-পাকিস্তানের বহু নগরে পরিকল্পিত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। কারণ তারা ছিল বাংলার মুসলিম ভূমিতে মেহমান।ভারত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আসা অসহায় অবাঙালীদেরকে সাহায্য করাকে তারা পবিত্র ইবাদত মনে করতো। ভারত থেকে আসা প্রায় ৭০ লাখ মুহাজিরদের প্রতি অভিন্ন ভালবাসা দেখানো হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানেও। অথচ তেমন একটি মানবিক আচরণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের মাঝে একাত্তরে দেখা যায়নি। বরং তারা নেমেছে অবাঙালীদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনে। বাঙালী মুসলিমের ইতিহাসে একাত্তর তাই ইসলামী চেতনা ও চরিত্রের এক গভীর অধঃপতনের দিন। অবাঙালী মুসলিমের বিরুদ্ধে এরূপ নৃশংস আচরণ সমগ্র মুসলিম ইতিহাসের অতি বর্বর অধ্যায় রূপে বহুহাজার বছর বেঁচে থাকবে -তা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে?
বিদ্রোহ মহান আল্লাহতায়ালার বিরুদ্ধে
ঈমানদারকে শুধু ইবাদত নিয়ে বাঁচলে চলে না, তাকে বাঁচতে হয় পারস্পারিক মুসলিম ভাতৃত্বের অটুট বন্ধন নিয়েও। কারণ, সে ভাবে বাঁচতেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে পবিত্র কোরআনে। ফলে ভাতৃত্বের সে বন্ধন নিয়ে বাঁচার মধ্যেই প্রকৃত ঈমানদারী। অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমও তার কাছে তখন প্রাণপ্রিয় ভাই গণ্য হয়। এমন চেতনার কারণেই অতীতে ইসলামী খেলাফত বাংলাদেশের চেয়ে শতগুণ বৃহৎ ভূমির উপর বিস্তার লাভ করেছিল; এবং সে বিশাল ভূমিতে ভাষা, বর্ণ ও আঞ্চলিকতার নামে দেয়াল গড়ে উঠেনি। সে ভূগোল বাঁচাতে দেশের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধ করতে হয়নি –যেমনটি পাকিস্তান বাঁচাতে একাত্তরে হয়েছে। ঈমানের প্রকাশ তাই শুধু নামায-রোযা, হজ-যাকাতে নয়,বরং সেটির প্রবল প্রকাশ ঘটে প্যান-ইসলামীক ভাতৃত্ব, রাজনীতি ও ভূগোলের মাঝে। যে মুসলিম দেশে সেরূপ ভাতৃত্ব নাই, বুঝতে হবে সে দেশের নাগরিকদের অপূর্ণতা আছে মুসলিম রূপে বেড়ে উঠায়। মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন ছিন্ন করা বা সে বন্ধনকে অস্বীকার করার অর্থ মুসলিম উম্মাহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া। মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহ তাই শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল না, ছিল মহান আল্লাহতায়ালার ঘোষিত নির্দেশমালার বিরুদ্ধেও। সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের বিজয় শুধু এ নয় যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে তারা বাংলাদেশে গড়তে পেরেছে। বরং তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি হলো, প্যান-ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের বিদ্রোহটি সফল করতে পেরেছে। ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাতে বঙ্গ বিজয়ের পর বাংলার মাটিতে এটিই ছিল মহান আল্লাহতায়ালার কোরআনে ঘোষিত প্যান-ইসলামী নীতির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম সফল বিদ্রোহ।
প্যান-ইসলামী চেতনার কারণেই বাঙালী মুসলিমের কাছে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের মত অবাঙালী নেতারা ১৯৪৭ সালে আপন জন মনে হত। পূর্ব পাকিস্তানে তাদের নামে অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদে তেমন মুসলিম ভাতৃত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব ছিল। বরং সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে তারা একটি ভাষা ভিত্তিক সীমারেখা টেনে দেয়, যারা সে সীমারেখা অতিক্রম করে তাদেরকে শত্রু গণ্য করা হয়। সাতচল্লিশের মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও একাত্তরের রাজাকারেরা যে অভিন্ন চেতনার ছিল -সেটি বুঝতে ইসলামের শত্রুপক্ষ আদৌ ভুল করেনা। একারণেই মুক্তিযোদ্ধরা শুধু নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাতেই আনন্দ পায়নি, আনন্দ পেয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে ১৯৪৭-য়ের পাকিস্তান আন্দোলনের মুসলিম নেতাদের নাম মুছে ফেলতেও। তাদের কাছে বরং অতি আপনজন মনে হয়েছে গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, চিত্তরঞ্জন সুতোর, জেনারেল ম্যানেক শ' ও জেনারেল অরোরা ন্যায় ভারতীয় ব্যক্তিত্ব। এমন এক অসুস্থ চেতনার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হল হয়ে গেছে সূর্য সেন হল এবং ইকবাল হল থেকে বিলুপ্ত হয়েছে মহান কবি আল্লামা ইকবালের নাম। অথচ বাংলার মানুষ যদি সাতচল্লিশে কায়েদে আজম, ইকবাল, লিয়াকত আলী খানদের বাদ দিয়ে গান্ধি, নেহেরু, সূর্যসেন, ক্ষুদিরামের পথ ধরতো তবে আজকের বাংলাদেশই প্রতিষ্ঠা পেত না। কাশ্মীরী মুসলিমদের ন্যায় তাদেরও তখন ভারতীয় সৈন্যদের হাতে প্রতিদিন হত্যার শিকার হতে হত এবং মুসলিম রমনীদের ধর্ষিতা হতে হত। হত্যাযোগ্য অপরাধ গণ্য হত গরু কোরবানী ও গরুর গোশতো ভক্ষণ। শত্রু-মিত্র নির্ণয়ে একটি চেতনা যে মানব মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীরা হলো তার নজির। এ চেতনার ফলে আল্লাহর আইনের প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে রাজপথে নামা দাড়ী-টুপিধারী বাঙালী যুবকটিও মুক্তিবাহিনীর কাছে হত্যাযোগ্য মনে হয়। এজন্য তাকে পাঞ্জাবী বা বিহারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
ভারত কোন প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর স্বাধীন বাড়াতে অতীতে যুদ্ধ করেনি। সাহায্যও দেয়নি। একাত্তরেও সে লক্ষ্যে যুদ্ধ করেনি। পাকিস্তান বিভক্ত করতে যুদ্ধ করলেও ভারতীয়গণ নিজ দেশের মধ্যে ঐক্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কাশ্মীরের স্বাধীনতা দিতে তারা রাজী নয়। ভারতের জনসংখ্যা ১২০ কোটির বেশী। বাংলার মত প্রায় বিশটির চেয়ে অধীক ভাষা রয়েছে ভারতে। ভাষাগত সে ভিন্নতা নিয়ে সেদেশে বাংলাদেশের মত ২০টি স্বাধীন দেশ নির্মিত হতে পারতো। অথচ তেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারণা ভারতীয় হিন্দুদের মাথায় স্থান পায়নি। ১৯৪৭’য়ে যেমন নয়, আজও নয়। নানা ভাষার হিন্দুরা ভাষার উর্দ্ধে উঠে ভারতব্যাপী একটি মাত্র রাষ্ট্র গড়ার কারণেই তারা আজ বিশ্বের বুকে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। বাঙালী মুসলিমগণ সেটি পারেনি। ক্ষুদ্রতর ও দুর্বলতর হওয়ার নেশায় কি সেটি সম্ভব? মুসলিম হওয়ার অর্থ তাই শুধু কোরআন পাঠ, নামাজ-রোযা ও হজ-যাকাত পালনও নয়। সেটি ভাষা, বর্ণ ও ভৌগলিকতার উর্দ্ধে উঠে অন্য ভাষা ও অন্য বর্ণের মুসলিমদের সাথে একাত্ব হওয়ার সামর্থ্য। এরূপ একতা গড়া ইসলামে ফরজ তথা বাধ্যতামূলক। বিজয় ও ইজ্জত আসে তো এরূপ একতার পথেই। নইলে শক্তি লোপ পায়;বিলুপ্ত হয় ইজ্জতও। মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত এবং শক্তিহীন ও ই্জ্জতহীন করার এজেন্ডা তো ইসলামের শত্রুপক্ষের। একাত্তরে সে এজেন্ডা নিয়েই যুদ্ধে নেমেছিল আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী। মুজিবের এজেন্ডার সাথে ভারতের এজেন্ডাও তখন একাকার হয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর পিছনে ভারতের অর্থদান, অস্ত্রদান ও প্রশিক্ষণদানের মতলবটি বুঝতে হলে ভারতের এজেন্ডাকেও তাই বুঝতে হবে। ভারত তো চায় তার সীমান্ত্র ঘিরে দুর্বল ভূটান,নেপাল, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাক, শক্তিশালী পাকিস্তান নয়। অথচ একাত্তরের ইতিহাসে সে ভারতীয় এজেন্ডাকে আদৌ তুলে ধরা হয়নি।
শেষ হয়নি একাত্তরের যুদ্ধ
একাত্তরের যুদ্ধ একাত্তরে শেষ হয়নি। সে যুদ্ধ এখনো অবিরাম চলছে। ভারতীয় এজেন্ডাটি শুধু পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ সৃষ্টি ছিল না। লক্ষ্য, বাংলাদেশের মেরুদন্ড ভাঙ্গাও। নইলে ভারতের ভয়, পূর্ব সীমান্তে আরেক পাকিস্তান সৃষ্টি হবে। সেটি রুখতে ভারত চায় তার পক্ষে সৈনিক। তাই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একাত্তরের চেতনাধারিদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। একাত্তরের ন্যায় আজও যারা ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধী তাদেরকে তারা রাজাকার বলছে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের লড়াইটিও শেষ হচ্ছে না। যতদিন পাশে ভারত আছে, ততদিন এ যুদ্ধও আছে। মেরুদণ্ড ভাঙ্গার লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশকে খণ্ডিত করার চেষ্টাও করবে। সে লক্ষ্যে ভারত অতীতে চাকমা বিদ্রোহীদের নিজভূমিতে আশ্রয় দিয়েছে এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রও দিয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ নিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতারের ন্যায় যারা স্বাধীন বঙ্গভূমি গড়ার স্বপ্ন দেখে তারাও আশ্রয় পেয়েছে ভারতে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকৃত লড়াই মূলত দু'টি চেতনার। নানা নামের নানা দল মূলতঃ এ রণাঙ্গনে সাইডশো মাত্র। একাত্তরে রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে -এ দুটি চেতনারাই প্রবল প্রকাশ পেয়েছিল। বহু বাংলাদেশী বিষয়টি না বুঝলেও ভারত সেটি ষোলআনা বুঝে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একাত্তরে ভারতের প্রতি সেবাদাস চরিত্র নিয়ে যে প্রবল বাঙালী সেক্যুলার পক্ষটি গড়ে উঠেছিল ভারত সরকার ও ভারতভক্ত সেক্যুলার বাংলাদেশীগণ চায় সেটি চিরকাল বাঁচিয়ে রাখতে। বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারদের সে ভারতসেবী চেতনাটিকেই তার বলছে একাত্তরের চেতনা। বাংলাদেশের শিল্পে কোন বিনিয়োগ না করলে কি হবে, তারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে এ চেতনা বাঁচাতে। ভারতের আধিপত্যবাদী রাজনীতি বাঁচানোর এ বিশাল বিনিয়োগের মধ্য দিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক দল এবং এনিজিওকে তারা বাংলাদেশে রাজনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও মিডিয়ার ময়দানে নামিয়েছে। সে লক্ষ্যপূরণে শত শত পত্র-পত্রিকা, বহুশত নাট্যদল, বহু সাংস্কৃতিক দল, বহু টিভি চ্যানেল এক যোগে কাজ করছে। বাংলাদেশের সীমান্তে মোতায়েনকৃত ভারতীয় সেনাদের চেয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নিয়োজিত এসব এজেন্টদের সংখ্যা এজন্যই অধিক। উপরুন্ত, ভারত থেকে নিয়মিত আমদানী করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ও বই-পুস্তক। দেশের অভ্যন্তরে ভারতের পক্ষে মূল যুদ্ধটি লড়ছে তারাই। একাত্তরের বন্দুক যুদ্ধ থেমে গেলেও বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এজন্যই থামেনি। যুদ্ধের প্রচণ্ড উত্তাপ তাই দেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিতে। ভারতের একাত্তরের যু্দ্ধের এটিই হলো ধারাবাহিকতা। শত্রুর যুদ্ধ তো এভাবেই যুগ যুগ নানা স্ট্রাটেজী নিয়ে নানা রণাঙ্গনে বেঁচে থাকে। এজন্যই বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিপাই মুখ বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের পক্ষে কথা বলতে কোন ভারতীয় লাগে না। ভারতের পক্ষে সে যুদ্ধ সফল ভাবে লড়ার জন্য তাদের ট্রোজান হর্সরাই যথেষ্ট।
ক্ষতিসাধনের উৎসব
ব্যক্তির ঈমানদারী তো ইসলামের বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে সে কতটা হিতকর বা কল্যাণকর -সেটি প্রমান করায়। ঈমানদারকে তাই প্রতি মুহুর্তে বাঁচতে হয় এ ভাবনা নিয়ে, ইসলামের বিশ্বব্যাপী বিজয়ে ও মুসলিমের কল্যাণে কীভাবে সে আরো অধীক কাজে লাগতে পারে? এমন ভাবনা নিয়েই ঈমানদার ব্যক্তি জিহাদের ময়দান খোঁজে। সে ভাবনা নিয়ে বিখ্যাত তুর্কী বীর ইখতিয়ার মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার বুকে ছুটে এসেছিলেন। এভাবেই বখতিয়ার খিলজী বাংলার কোটি কোটি মুসলিমদের সবচেয়ে বড় কল্যাণটি করেছিলেন। নইলে আজ যারা মুসলিম,তাদের অনেকেই হিন্দু থেকে যেত। এবং গরু-বাছুর, শাপ-শকুন, নদ-নদী,পাহাড়-পর্বত ও মুর্তি পূজায় জীবন কাটিয়ে নিশ্চিত জাহান্নামের যাত্রী হতো। মুসলিম ও ইসলামের বিরুদ্ধে অকল্যাণকর বা অহিতকর কিছু করা তো শয়তানের কাজ। প্রশ্ন হলো, ইসলাম ও মুসলিমের কোন কল্যাণের এজেন্ডা নিয়ে কি গঠিত হয়েছিল মুক্তিবাহিনী? ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণ কি ভারতের গর্ভে বা ভারতের সাহায্য নিয়ে সম্ভব? প্রশ্ন হলো, ভারতের মত একটি আগ্রাসী হিন্দু দেশ মুসলিমের কল্যাণের যুদ্ধ করবে বা একটি বাহিনী গড়ে তুলবে -সেটি কি ভাবা যায়? আজ পর্যন্ত কোথায়ও কি ভারত তেমন কর্ম করেছে? সুলতান মুহাম্মদ ঘোরীর হাতে দিল্লি বিজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল পাকিস্তান সৃষ্টি। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী মুসলিম রাষ্ট্র –যা এখন বেঁচে থাকলে লোক সংখ্যাটি হতো ৩৫ কোটি। এদেশটিকে খণ্ডিত করায় আগ্রহ ছিল সকল ইসলাম বিরোধী শক্তির। পলাশীর পরাজয়ের পর উপমহাদেশের মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি হয়েছে পাকিস্তানের বিভক্তির মধ্য দিয়ে। আর সে বিভক্তির কারণ, বাঙালী সেক্যুলার নেতৃত্ব ও তাদের সৃষ্ট মুক্তিবাহিনী। এ বিভক্তির ফলে বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে সামরিক ভাবে পঙ্গু এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে ভারতের অধিকৃত একটি দুর্বল দেশে। মুসলিম উম্মাহর সে বিশাল ক্ষতিটি নিয়ে প্রচণ্ড উৎসব শুধু ভারতের হিন্দু শাসক মহলেই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা মহলেও।
রাজাকারের চেতনায় প্রবল ভাবে যা কাজ করেছিল তা হলো ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও সামরিক আগ্রাসন থেকে সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বাঁচানোর প্রেরণা। ভারতীয় প্রচারমাধ্যম বিপুল সংখ্যক বাঙালীদের বিভ্রান্ত করতে পারলেও রাজাকারদের বিভ্রান্ত করতে পারিনি। ভারতের মুসলিম বিরোধী ভূমিকাকে তারা যেমন ১৯৪৭’য়ে দেখেছে, তেমনি ১৯৭১’য়ের পূর্বে এবং পরও দেখেছে। পাকিস্তানের অকল্যাণই ছিল তাদের নীতি। ভারত পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠারই শুধু বিরোধীতা করেনি, বিরোধীতা করেছে দেশটির বেঁচে থাকার বিরুদ্ধেও। সে শত্রুতা যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়, ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরদ্ধেও। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয়দের অধীক মহবব্ত থাকার কথা নয়। পূর্ব পাকিস্তানকে মরুভূমি করতেই তারা নির্মাণ করেছে ফারাক্কা বাঁধ। ভারতের আগ্রাসী আচরণটি দেখা গেছে কাশ্মীর, হায়দারাবাদ, মানভাদর ও সিকিমে। এমন আগ্রাসী ভারতকে মুক্তিযোদ্ধাগণ আপন রূপে বরণ করে নেয়। ভারতও যে মুসলমানদের কল্যাণে কিছু করতে পারে রাজাকারগণ কখনোই বিশ্বাস করেনি। দেশটির শত্রুসুলভ আচরণ দেখেছে যেমন ১৯৪৭ ও ১৯৬৫’য়ে, তেমনি ১৯৭১’য়েও। মুসলিম কল্যাণে ভারতের কিছু করার আগ্রহ থাকলে সেটির শুরু হওয়া উচিত ছিল কল্যাণকর কিছু করার মধ্য দিয়ে; একাত্তরের যুদ্ধ, যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্রের ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নয়।
রাজাকারের মিশন ও মুক্তিযোদ্ধার মিশন
রাজাকার শব্দটি একটি ফার্সী শব্দ। ফার্সি থেকে এসেছে উর্দুতে। রাজাকার বলতে তাদেরকে বুঝায় যারা স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে কোন যুদ্ধ বা কল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়। একাত্তরে তাদের সে মিশনটি ছিল, ভারতীয় ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসন থেকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর। পাকিস্তানে অবিচার ছিল, বঞ্চনা ছিল, জুলুমও ছিল। রাজনৈতিক অনাচারও ছিল। তবে সমাধান যে ছিল না তা নয়। দেহ থাকলে যেমন রোগব্যাধীও থাকে। তেমনি বৃহৎ রাষ্ট্র থাকলে তাতে নানাবিধ সমস্যাও থাকে। শরীরের ভাঙ্গা হাড্ডিটি সারাতেও সময় লাগে। রাষ্ট্রের রোগ সারাতে সময় আরো বেশী লাগে। বহু দেশে এমন সমস্যা কয়েক যুগ ধরে চলে। যেমন পাকিস্তানের বয়সের চেয়ে অধিক কাল ধরে চলছে ইংল্যান্ডে আয়ারল্যান্ডের সমস্যা। কয়েক যুগ ধরে চলছে সূদানের দারফোরের সমস্যা। ভারত কাশ্মীরের সমস্যা বিগত ৬৫ বছরেও সমাধান করতে পারেনি। তবে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির দাবীটি একাত্তরের কয় মাস আগেও কেউ মুখে আনেনি। ১৯৭০’য়ের নির্বাচনেও এটি কোন ইস্যু ছিল না। শেখ মুজিব ও তার লাখ লাখ শ্রোতা মুক্তিযুদ্ধের শুরু মাত্র কয়েক মাস আগেও নির্বাচনী জনসভাগুলোতে পাকিস্তান জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়েছে। সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার যে অভিযোগ -সেটির অস্তিত্ব মার্চের ১৯৭১’য়ের মার্চের একমাস আগেও ছিল না। অথচ এমন একটি অভিযোগ পাশ্ববর্তী মায়ানমারে দেড় দশক ধরে চলছে। সেদেশে ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী অং সাঙ সূচীর হাতে সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তাঁকে গৃহবন্দী করে। সে অপরাধে কি কেউ দেশভাঙ্গার জন্য ভারতীয় সাহায্য নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়েছে? বরং মায়ানমারের স্বৈরাচারী সামরিক জান্তাদের সাথে ভারতের আচরণটি লক্ষ্য করার মত। সেদেশের সামরিক জান্তার সাথে ভারত শুরু থেকেই সদ্ভাব ও সহযোগিতা বজায় রেখেছে এবং পুরাদস্তুর বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারত ও তার দোসররা নির্বাচন পরবর্তী সে সমস্যার সমাধানে পাকিস্তানকে আদৌ সময় দিতে রাজী ছিল না। সেটিকে বাহানা বানিয়ে ভারত দেশটির বিনাশে হাত দেয়। এটি ছিল অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের অতিশয় ন্যাক্কারজনক ঘটনা। মুক্তিযোদ্ধাদের মিশনটি ছিল সে ভারতীয় এজেন্ডাকে সফল করা। সে মিশনে তারা সফলও হয়।
দেশ বাঁচলেই দেশের রাজনীতি বাঁচে। বাঁচে নিজ নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠার স্বাধীনতাও। একাত্তরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল চিহ্নিত শত্রুর পরিকল্পিত হামলা থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মুসলিম দেশটিকে বাঁচানোর দায়বদ্ধতা। এ দায়বদ্ধতাটি ছিল দেশের প্রতিটি ঈমানদারের উপর। তেমন এক ঈমানী দায়বদ্ধতায় নিজ নিজ সামর্থ্য নিয়ে প্রাণপনে ময়দানে নেমে আসে হাজার হাজার আত্মত্যাগী তরুণ। পাকিস্তানের এবং সেসাথে বাংলাদেশের ইতিহাসে এরাই হলো রাজাকার। তাদের অধিকাংশই ছিল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। বহু হাজার ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। অনেকে ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সমর্থক। বাংলার হাজার বছরের মুসলিম ইতিহাসে বাংলাভাষী মানুষ নিজ রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায় এভাবে কাফের সেনা বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে -সে ইতিহাস খুব একটা নেই। বরং ক্লাইভের ইংরেজ বাহিনী যখন বাংলা দখল করে নেয় তখন বাংলার কোন তরুণ একটি তীরও ছুড়েনি। কেউ প্রাণ দিয়েছে -সে নজিরও নেই। বরং অনেকে মুর্শিদাবাদের রাস্তার দুই পার্শ্বে হাজির হয়েছিল ব্রিটিশ বাহিনীর বিজয় উৎসব দেখতে। ফকির বিদ্রোহ ও মহান মুজাহিদ হাজী নেসার আলী তিতুমীরের প্রতিরোধ এসেছে অনেক পরে।
একাত্তরের বহু হাজার রাজাকার প্রাণ হারিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার –এ দুই পক্ষের মাঝে সবচেয়ে বেশী প্রাণ হারিয়েছে এবং নির্যাতীত হয়েছে এই রাজাকারেরা। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর যা কিছু হয়েছে তা লড়াইয়ের মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ চলাকালে। কিন্তু রাজকারদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলেছে একাত্তরের পরও। বরং তাদের উপর লাগাতর হামলা হচ্ছে বিগত ৪৪ বছর ধরে। সেটিকে অব্যাহত রাখারও অবিরাম চেষ্টা চলছে। সে লক্ষ্যে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাসের বইয়ে রাজাকারদের বিরুদ্ধে শুধু গালিগালাজই নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলার মুসলিমদের কল্যাণে তাদেরও যে একটি রাজনৈতিক দর্শন, কৌশল বা স্ট্রাটেজী ছিল -সে সত্যটিকে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। রাজাকারদের অধিকার দেয়া হয়নি তাদের চেতনা ও দর্শনের কথাগুলো লোক-সম্মুখে তুলে ধরার। অথচ সেটিও হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাজাকারের দর্শন ও মুক্তিযোদ্ধার দর্শন
রাজকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মুল পার্থক্যটি ভাষা বা বর্ণের নয়। সেটি দর্শনের। রাজাকারের কাছে যেটি গুরুত্ব পেয়েছিল সেটি হলো ভাষা ও অঞ্চলিকতার উর্দ্ধে উঠে মুসলিম উম্মাহর শক্তিবৃদ্ধিতে কাজ করা। পাকিস্তান ছিল বহু ভাষাভাষি একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতীক। আজও সেটি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। তাই সে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার দায়ভার শুধু পাঞ্জাবী, পাঠান, সিন্ধি ও বেলুচদের উপর ছিল না। বহু বাঙালী মুসলিমও সে দায়িত্ব পালনকে ফরজ ভেবেছে। কারণ বাঙালীগণ ছিল সে রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক। শেখ মুজিব তাদের আদর্শ ছিল না। গান্ধি, নেহেরু, ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন বা প্রীতিলতাও নয়। তাদের সামনে অনুকরণীয় আদর্শ ছিলেন সাহাবায়ে কেরাম -যাদের শতকরা ৭০ ভাগের অধিক শহীদ হয়েছেন ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী উম্মাহ গড়ায়। তাদের দৃষ্টিতে বাঙালী মুসলিমের মূল কল্যাণটি বাঙালী রূপে বেড়ে উঠায় নয়, বরং ইসলামের বিজয়ে অঙ্গীকারটি হৃদয়ে ধারণ করে ঈমানদার রূপে বেড়ে উঠায়। সে কল্যাণিট অনন্ত আখেরাতেও। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে হিসাব দিতে হবে ইসলাম ও মুসলিমের কল্যাণে কার কি অবদান সেটির। তাঁর মহান আদালতে কার কি ভাষা বা বর্ণ -সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক। তাই ভাষার নামে রাষ্ট্র গড়ায় কোন কল্যাণ নেই। ইসলামে এটি ফরজ নয়,নবীজীর সেটি সূন্নতও নয়। এমন রাষ্ট্র গড়ায় প্রাণ দিলে কেউ শহীদ হয় না। শহীদ হতে হলে লড়াইটি নির্ভেজাল আল্লাহতায়ালার দ্বীনপালন ও দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হতে হয়। হতে হয় মুসলিম উম্মাহ ও মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষায়। অথচ মুক্তিবাহিনী যে পথ ধরেছিল সেটি ছিল মুসলিম রাষ্ট্রকে ছোট করার তথা ক্ষতি সাধনের এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল উপমহাদেশের বুকে ভারতের ন্যায় কাফের রাষ্ট্রের আধিপত্য বাড়ানো। তাই মুক্তিবাহিনীর গঠনে, প্রশিক্ষণে ও তাদের অস্ত্রদানে ভারত এতোটা আগ্রহী ছিল। ভারত তো পাকিস্তান ভাঙ্গার এমন একটি যুদ্ধ নিজ সৈন্য, নিজ অস্ত্র ও নিজ অর্থে ১৯৪৭ সাল থেকেই লড়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল। ভাষা বা বর্ণ-ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজে সাহাবায়ে কেরাম প্রাণ দান দূরে থাক, সামান্য শ্রম, সময় বা অর্থ দান করেছেন -সে প্রমাণ নেই। এরূপ ভাঙ্গার কাজ গুরুত্ব পেলে হাজার বছর আগেই অখণ্ড খেলাফত ভেঙ্গে বাংলাদেশের ন্যায় পঞ্চাশটিরও বেশী স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মিত হতে পারতো।
একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি ছিল মূলত দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরে ছিল আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), কম্যুনিষ্ট পার্টি -মূলত এ তিনটি সেক্যুলার দল। ইসলামের প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের কোন অঙ্গীকার ছিল না। বরং তারা ছিল ইসলামের প্রতিপক্ষ শক্তি। পাকিস্তানকে তারা সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি মনে করতো। তারা দেশটির ভাঙ্গার লড়ায়ে ভারতের সহযোগী ছিল। এ দলগুলির ছিল নিজ নিজ দলীয় ছাত্র সংগঠন। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিল এসব দলের ছাত্র সংগঠনেরর সদস্যরা। অপর শিবিরের দলগুলো হলো মুসলিম লীগের তিনটি মূল উপদল, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, কৃষম-শ্রমিক পার্টি এবং জমিয়তে আহলে হাদীস। এছাড়াও আরো কিছু ছোট দল ছিল। রাজাকারগণ মূলত আসে এসব দলগুলি থেকে। রাজাকারদের মাঝে বহু নির্দলীয় ব্যক্তিও ছিল। তারা ছিল বিভিন্ন পীরের মুরীদ, ছিল মাদ্রাসার নির্দলীয় ছাত্র। তাদের সবার কাছে পাকিস্তান ছিল স্বপ্নের দেশ;এবং ভারতীয় আধিপত্য থেকে বাঁচার রক্ষাকবচ।
১৯৪৭’য়ের পূর্বে শেখ মুজিব নিজেও কলকাতায় থাকা কালে মুসলিম লীগের প্যান-ইসলামী দর্শনের স্রোতে কিছু কাল ভেসেছেন। কলকাতার রাজপথে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানও বলেছেন। কিন্তু ১৯৪৭’য়ের পর সে স্রোত কমে যাওয়ায় সেক্যুলার বাঙালী জাতীয়তাবাদের চড়ে তিনি আটকা পড়েন। এভাবে ছিটকে পড়েন পাকিস্তান সৃষ্টির মূল মিশন থেকে এবং যোগ দেন পাকিস্তানের শত্রু শিবিরে। যাদের মাঝে ইসলামী দর্শনের বলটি প্রবল, একমাত্র তারাই ইসলামের পক্ষে প্রবল স্রোত সৃষ্টি করে এবং সে স্রোতে শুধু নিজেরাই চলে না, অন্যদেরও ভাসিয়েও নেয়। ইসলামী দর্শন তো অমর। ফলে প্যান-ইসলামী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার মাত্র ২৩ বছরে পাকিস্তানের প্রয়োজনটি ফুরিয়ে যাবে -সেটি মুসলিম সন্তানেরা মেনে নেয় কি করে? ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রজেক্ট ইসলামে অঙ্গীকারশূণ্য কম্যিউনিষ্ট, নাস্তিক, হিন্দু, বাঙালী জাতীয়তাবাদী, ভারতীয় এজেন্ট, ইহুদী এজেন্ট ও সেক্যুলারগণ মেনে নিলেও কোন রাজাকার মেনে নেয়নি। মুক্তিযু্দ্ধের চেতনাধারিদের থেকে রাজাকারদের মূল পার্থক্য বস্তুত এখানেই।
ভিন্নতা শত্রু-মিত্র চেনায়
কে শত্রু আর কে মিত্র –মানুষ সে ধারণাটি পায় তার দর্শন থেকে। তাই ইসলাম যাদেরকে শত্রু বা মিত্র রূপে চিহ্নিত করে, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, সেক্যুলারিজম ও সমাজতন্ত্র তা করে না। মুসলিমের শত্রু বা মিত্র আর বাঙালী জাতীয়তাবাদী সেক্যুলারিস্টদের শত্রু বা মিত্র -তাই এক নয়। এজন্যই বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের কাছে বন্ধু রূপে গৃহীত হয় নাস্তিক সোসালিস্ট, কম্যিউনিস্ট এবং পৌত্তলিকরা। ফলে তাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছিল ভারতের ন্যায় ইসলামের শত্রুদের সাথে কোয়ালিশন গড়াটিও। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে ভারতীয় হিন্দু প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, শিখ জেনারেল অরোরা, পারসিক জেনারেল মানেক শ’, ইহুদী জেনারেল জ্যাকব অতিশয় আপনজন মনে হয়েছে। এবং তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এমনকি নিজ দেশ, নিজ ধর্ম ও নিজ ভাষার নিরস্ত্র রাজাকার হত্যাটিও বীর-সুলভ মনে হয়েছে। ১৯৭১য়ের ১৬ই ডিসেম্বরের পর হাজার হাজার নিরস্ত্র রাজাকারকে হত্যা করা হয়েছে তো এমন এক চেতনাতেই।
প্রতারণার স্বার্থে অতি দুর্বৃত্তদেরও ফেরেশতা সাজার আয়োজন দেখা যায়। সেটি যেমন তাদের কথাবার্তা ও বক্তৃতায়, তেমনি সাজগোজে। তবে ব্যক্তির মনের গোপন অভিলাষ ও তার আসল চরিত্রটি বুঝার মোক্ষম উপায়টি হলো তার নিকটতম বন্ধুদের দিকে তাকানো। কারণ বন্ধু নির্বাচনে সবাই তার মন ও মতের অতি কাছের লোকটিকে বেছে নেয়। তাই শেখ মুজিব বা তার বাঙালী জাতীয়তাবাদী সহচরদের চরিত্র ও তাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা বুঝতে হলে ভারতীয় নেতাদের রাজনৈতিক চরিত্র ও এজেন্ডা বুঝতে হবে। এজন্য মুজিবের লম্বা লম্বা বক্তৃতা শোনার প্রয়োজন নেই। রাজাকারগণ তাই মুজিবকে চিনেছিল তার ঘনিষ্টতম বন্ধু ভারত সরকারের আগ্রাসী আধিপত্যবাদ ও মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস থেকে। একাত্তরের পর ভারতের অবাধ লুণ্ঠন, তলাহীন ভিক্ষার ঝুলির অর্থনীতি, দুর্ভিক্ষে লক্ষ লক্ষ মানুষে মৃত্যু এবং অধিকৃত বাংলাদেশের চিত্রটিই তাদের সে ধারণাকে শতভাগ সঠিক প্রমাণিত করেছে। মানুষকে শুধু বিষাক্ত পোকামাকড় ও হিংস্র পশুদের চিনলে চলে না। রাজনীতির ময়দানের ভদ্রবেশী প্রতারকদেরও চিনতে হয়। নইলে দেশ অধিকৃত হয় ও তলাহীন ঝুলিতে পরিণত হয়। দেশে তখন দুর্ভিক্ষও নেমে আসে। গণতন্ত্রের বদলে তখন বাকশালী ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা পায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী মুসলিমদের ব্যর্থতাটি এক্ষেত্রে প্রকট। সে ব্যর্থতাটি মুক্তিযোদ্ধাদেরও। তারা যেমন শত্রুদের চিনতে পারিনি, তেমনি ব্যর্থ হয়েছে সত্যিকার বন্ধুদের চিনতেও। যে মুসলিম লীগ ১৯৪৭’য়ে অখণ্ড ভারত ভেঙ্গে স্বাধীনতা এনে দিল তাদেরকে বরং শত্রু মনে করেছে। পাশে আশ্রয় নেয়া অবাঙালী মুসলিমদেরভাই রূপে গ্রহণ করতেও ব্যর্থ হয়েছে। বিভাজন গড়েছে স্রেফ ভাষার ভিত্তিতে। অবিঙালী মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিষ ছড়ানো হয়েছে প্রচণ্ড ঘৃণাবোধে। অথচ এমন বিভক্তি ও ঘৃণাবোধ ইসলামে হারাম। এ মহাপাপ আযাব ডেকে আনে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানে ৬৫ লাখ ভারতীয় আশ্রয় পেয়েছিল, আশীর দশকে সোভিয়েত আগ্রাসনের পর আশ্রয় পায় ৩০ লাখ আফগান, ক্ষুদ্র রাষ্ট্র লেবাননের জনসংখ্যার প্রায অর্ধেক হলো রিফিউজী। অথচ বাংলাদেশে কয়েক লাখ বিহারীর বসবাসের স্থান হয় না। তাদের ঘরবাড়ি কেড়ে নিয়ে তাদেরকে বস্তিতে পাঠানো হয়। সাগরে ভাসমান প্রাণ বাঁচাতে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমগণও বাংলাদেশের উপকূলে নৌকা ভেড়ানোর অনুমতি পায়নি। সেক্যুলার বাঙালীগণ মানবিক গুণাবলি নিয়ে বেড়ে উঠায় যে কতটা ব্যর্থ –সেটি বুঝতে এর পরও কি কিছু বাঁকি থাকে?
রাজাকারের স্বপ্ন ও মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন
সবাই যেমন জীবনে একই লক্ষ্য নিয়ে বাঁচে না, তেমনি একই রূপ স্বপ্নও দেখে না। মানুষে মানুষে স্বপ্নের জগত জুড়ে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। সে বিশাল পার্থক্যটি ছিল রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধার মাঝেও। রাজাকারের চেতনা-রাজ্যের সবটুকু জুড়ে যে বিরাট স্বপ্ন ছিল, সেটি বিশ্বশক্তি রূপে মুসলিম উম্মাহর উত্থানের। স্বপ্নটি ইসলামের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার। সে জন্যই তারা বিশ্বের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্রটিকে ভারতীয় হামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। দেহে প্রাণ থাকা যেমন জীবনের লক্ষণ,তেমনি এরূপ স্বপ্ন নিয়ে বাঁচাটিও ঈমানের লক্ষণ। আর প্রকৃত ঈমানদারের শুধু এ স্বপ্নটুকুই থাকে না, সে স্বপ্নের বাস্তবায়নে প্রাণপন প্রচেষ্টাও থাকে। এজন্যই তো ঈমানদার মাত্রই আল্লাহর পথের রাজাকার তথা স্বেচ্ছাসেবী সৈনিক। এ কাজে তাকে ময়দানে নামতে কেউ বাধ্য করে না,নামে নিজ ঈমানী দায়বদ্ধতায়। আল্লাহর দ্বীনের এমন রাজাকার হলো প্রতিযুগের মুজাহিদগণ। রাজাকার ছিলেন তারাও যারা সাতচল্লিশে “লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান” ধ্বণিতে কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার গুণ্ডাদের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়েছেন। রাজাকার তাদেরও বলা হতো যারা ভারতের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনাধীন হায়দারাবাদের স্বাধীনতা বাঁচাতে যুদ্ধ লড়েছিল।
একাত্তরের রাজাকারগণ তাই মুসলিম ইতিহাসের একমাত্র রাজাকার নন। অতীতের ন্যায় এমন রাজাকার আজও অসংখ্য। এরাই আল্লাহর দ্বীনের বিজয় নিয়ে আজও স্বপ্ন দেখে। ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আজও তারা প্রতিরোধে নামে। এ সত্যটুকু বুঝতে শয়তান ভুল করে না। ভুল করে না শয়তানী শক্তির বাংলাদেশী সেবাদাসেরাও। তাই বাংলাদেশের রাজপথে যখন দাড়ি-টুপিধারীদের রাজাকার বলে লগি-বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকে না। বিস্ময় তখনও জাগে না, যখন একাত্তরের পরে জন্ম নেয়া ইসলামী চেতনাধারী যুবককে রাজাকার বলে হত্যা করা হয়। বিস্ময় জাগে না, যখন একাত্তরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি আশি বছরের এক বৃদ্ধ আলেমকে রাজাকার বলা হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। রাজাকারের সংজ্ঞা নিয়ে জ্ঞানশূণ্য ও চিন্তাশূণ্য মুসলিমদের সংশয় থাকতে পারে, কিন্তু সে সংশয় শয়তানের নেই। শয়তানের অনুসারিদেরও নেই। তাই রাজাকার চিনতে তারা ভুল করে না। শয়তানী শক্তির এজেন্টগণ যখন দেশের মাদ্রাসা-মসজিদ গুলোকে রাজাকার উৎপাদনের কারখানা বলে তখন তারা ভুল বলে না। কারণ এগুলোই লড়াকু মুজাহিদ তৈরীর কাজে মহান আল্লাহতায়ালার ইনস্টিটিউশন।
নবীজী (সাঃ)র হাদীস, “গুনাহ বা ক্ষতিকর কাজ হতে দেখলে ঈমানদারের দায়িত্ব হলো সে কাজ শক্তি বলে রুখা। শক্তি না থাকলে মুখের কথা দিয়ে প্রতিবাদ করা। আর সেটিও না থাকলে মন থেকে সেটিকে ঘৃণা করা। আর এ ঘৃণাটুকুও না থাকলে বুঝতে হবে, তার অন্তরে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নেই”। একটি মুসলিম দেশকে খন্ডিত করার চেয়ে জঘন্য খারাপ কাজ আর কি হতে পারে? মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে এর চেয়ে বড় ক্ষতিকর কাজই বা আর কি হতে পারে? দেশ খন্ডিত হওয়ায় যে দূর্বলতা বাড়ে, সেটি কি মাথাপিছু আয়ু বাড়িয়ে দূর করা যায়? কুয়েত, আবুধাবি, কাতার, সৌদি আরবের মাথাপিছু আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও অধিক। কিন্তু তাতে কি শক্তি বেড়েছে? বেড়েছে কি প্রতিরক্ষার সামর্থ্য। শত্রুপক্ষ যখন কোন দেশকে দূর্বল করতে চায় তখন তারা সে দেশটির মানচিত্রে হাত দেয়। ভারত সেটি করেছিল পাকিস্তানের বিরদ্ধে। কোন ঈমানদার কি কাফের শক্তির হাতে মুসলিম উম্মাহর দেহ এভাবে টুকরো টুকরো হতে দেখে খুশি হতে পারে? খুশি হলে তার মনে যে শরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও নাই -তা নিয়ে কি সন্দেহ থাকে? রাজাকারগণও তাই দর্শকের ভূমিকায় না থেকে ময়দানে নেমেছে। দেশের ভূগোলের উপর হামলা রুখতে সাহাবায়ে কেরাম জিহাদ করেছেন, দলে দলে শহীদও হয়েছেন। মুসলিম উম্মাহর অপুরণীয় ক্ষতি করতেই আরব বিশ্বকে খন্ডিত করেছে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গ। অখণ্ড আরব ভূগোলকে ভেঙ্গে তারা বাইশ টুকরায় বিভক্ত করেছে। আরবদের এভাবে দূর্বল ও নির্জীব করার পরই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসরাইল।
আল্লাহর কাছে প্রিয় এবং মুসলিমের বন্ধু হতে হলে তো তাকে মুসলিম ও ইসলামেরও বন্ধু হতে হয়। মুসলিম দেশের অখণ্ডতার হেফাজতে কাফেরদের বিরুদ্ধেও বীরদর্পে রুখে দাঁড়াতে হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর তায়ালার ঘোষণা,“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারি হয়ে যাও।..” আল্লাহর সাহায্যকারি হওয়ার অর্থ শুধু আমিও মুসলমান –এ টুকু বলা নয়। কিছু ইবাদত-বন্দেগী নয়। আল্লাহপাক তার বান্দাহ থেকে বৃহ্ত্তর কিছু চান। সেটি ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষায় অঙ্গীকার ও কোরবানী। এটিই ছিল রাজাকারের জীবনে মিশন। তারা ফেরেশতা ছিল না, তাদের জীবনেও বহু ভূল-ত্রুটি ছিল। কিন্তু একাত্তরে তাদের জীবনের পাকিস্তান বাঁচানোর মিশনটি পুরাপুরি ইসলামী ছিল। অপরদিকে মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারিরা ভারতের দেয়া রোডম্যাপকেই নিজেদের রাজনীতির রোডম্যাপে পরিণত করেছে। মুসলিম ভূমির প্রতিরক্ষার জন্য কিছু করার বদলে তারা সেটিকে ক্ষুদ্রতর করেছে। এভাবে প্রচণ্ড খুশি বাড়িয়েছে কাফেরদের। আর কাফেরদের মুখে হাসি বাড়িয়ে কি মহান আল্লাহতায়ালার কাছে প্রিয় হওয়া যায়?
Comment