পূর্ব তুরস্কের বিৎলিস প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম নুরস। ১৮৭৭ সালের এক বসন্তে সেই নুরস গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী। পিতা মির্জা আর মা নুরী’র চতুর্থ সন্তান সাঈদ নুরসীদের পরিবারটি ছিল কুর্দি গোত্রভুক্ত। মূলত **‘বদিউজ্জামান’ হলো তার উপাধি।
ছোট থেকেই সাঈদ নুরসী ছিলেন স্বাধীনচেতা। ১০ বছর বয়স হতেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। অল্প বয়সেই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। এ কারণে সুফি দর্শনে প্রভাবিত হলেও সুফি তরিকায় পুরোপরি যোগ দেননি। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কোনো বিষয় মুখস্ত করতে তাঁর বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো না। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করা সাঈদ ধর্মতত্ত্বের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এ সংক্রান্ত যে কোনো বিতর্কে তাঁর যুক্তিগুলো ছিল অখণ্ডনীয়। যা সে সময়ের আলেম সমাজকে বেশ অবাক করেছিল। পরবর্তীতে তাঁকে *‘বদিউজ্জামান’ উপাধি প্রদান করা হয়। এর অর্থ হলো সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
মারদিনে অবস্থানকালে নামিক কামালের তাত্ত্বিক লেখাগুলোর সাথে সাঈদ নুরসীর পরিচয় ঘটে। মূলত কামাল ছিলেন ‘ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্টের’ অন্যতম নেতা। মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখা নামিক কামালের পুস্তকগুলো তরুণ সাঈদ নুরসীর মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৮৯২ সালের দিকে তিনি ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্টে যোগ দেন। তখন থেকে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
ভ্যান প্রদেশের গভর্নরের আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবনে বসবাস করতে শুরু করেন সাঈদ নুরসী। এ সময় সেখানকার আর্কাইভ ও লাইব্রেরির বইপত্রগুলো অধ্যয়ন করতে থাকেন নুরসী। বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত- এসব বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সাথে সাথে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সরকারী ভাষার উপরও দক্ষতা লাভ করেন। থিওলজি তথা ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে সাঈদ নুরসী পরিবর্তিত সময়ে সময়োপযোগী চিন্তার সাথে পরিচিত হন। বুঝতে পারেন যে, শুধুমাত্র সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে মুসলিম জাতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। তাই পূর্ব তুরস্কে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার চিন্তা করতে থাকেন যেখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। পরবর্তীতে তাঁর সেই চিন্তানুযায়ী ১৯১৩ সালে ভ্যান প্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেহরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা ঐ অঞ্চলে ইসলাম সম্পর্কে খুবই উচ্চতর দর্শনের সূত্রপাত ঘটায়।
১৯০৯ সালে উসমানীয় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনে ও বিচারের মুখোমুখি করে। কারণ তিনি তখন Committee of Union Progress (CUP)– এর সাথে মিলে উদারবাদী সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং মুক্তি পান। উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষদিকে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। সুলতান আবদুল হামিদকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, সনাতনী মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাথে সুফিজম ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয় করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে খিলাফতের বিপন্ন অবস্থা দেখে নিজেই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। জ্ঞান অর্জনে তিনি যেমন তুখোড় ছাত্র, তেমনি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী সৈনিক। ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন আধাসামরিক বাহিনী। তুরস্কের পূর্বদিকে পাসিলোনা ফ্রন্টে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর বাহিনী নিয়ে। যুদ্ধের একপর্যায়ে বন্দী হয়ে রাশিয়ান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসিত হন। দুই বছর পর সেখান থেকে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ১৯১৮ সালে ইস্তান্বুলে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সে সময় ইস্তান্বুলের বুদ্ধিজীবী সংগঠন ‘দারুল হিকমাহ আল ইসলামীয়া’র সদস্য হিসেবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯২২ সালের ৯ নভেম্বর Grand National Assembly-তে বদিউজ্জামান নুরসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানানো হয়। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলেও বদিউজ্জামান নুরসী ইসলামের প্রতি অনেক সাংসদের উদাসীন মনোভাব দেখে হতাশ হন।
যুদ্ধের সময় নুরসী The Six Steps শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। নুরসীর এই লেখায় তুর্কি সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা হয়। স্বীকৃতি স্বরূপ কামাল আতাতুর্ক তাঁকে আঙ্কারায় আমন্ত্রণ জানান ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু নুরসীর ধর্মীয় প্রভাবে নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্রে কামালবাদী সেক্যুলার আদর্শ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। এ কারণে কামাল আতাতুর্ক সাঈদ নুরসীকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দেন। যাতে করে সাঈদ নুরসীকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু আদর্শের প্রতি দৃঢ় ও প্রজ্ঞাবান নুরসী বিনীতভাবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে জোর করে মুছে দিয়ে সেক্যুলারিজমকে চাপিয়ে দেয়ার বিরোধী ছিলেন সাঈদ নুরসী। মূলত তখন থেকেই কামাল আতাতুর্কের সাথে সাঈদ নুরসীর আদর্শিক সংঘাত শুরু হয়। সরকার সর্বক্ষেত্রে ইসলাম ও কোরআনকে নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষিতে তিনি ঘোষণা করেন, “আমি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করবো কোরআন নিঃশেষ হয়ে যাবার মতো কিছু নয়। এটা হলো এক শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। এক অফুরান আলোর উৎস”। সাঈদ নুরসী অবশ্য তারপর থেকে নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন।
১৯২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ সাঈদ নামে এক নকশবন্দী শেখের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হলো। এটি শেখ সাঈদ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। মূলত কুর্দিদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্বশাসনের জন্যে অনেক আগে থেকেই একটা গুঞ্জন ছিল। তবে তা খুবই বেশি বড় ছিল না। বিদ্রোহী নেতা শেখ সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসীর সমর্থন লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করে। বরং নুরসী এ বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে তুরস্ক সরকার এই ছোট্ট ঘটনাকে ইস্যু করে ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ একটা আইন পাশ করে। আগে থেকেই নুরসীকে আটক করার সুযোগ খুঁজছিল নয়া স্বৈর-সরকার। এই আইনের মাধ্যমে ডাইরেক্টরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেকের সাথে বদিউজ্জামান নুরসীকেও কারাবন্দী করে ইস্তান্বুল পাঠানো হয়।
১৯২৬ সালের দিক ইস্পার্তায় নির্বাসনে পাঠানো হয় বদিউজ্জামান নুরসীকে। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানকার মানুষগুলো তাঁর ভক্ত হয়ে যেতো এবং তাঁর ছাত্রে পরিণত হতো। এ কারণে তাঁকে আরো দুর্গম এলাকা ‘বারলায়’ নির্বাসন দেয়া হয়। কিন্তু এখানে তাঁর ছাত্র সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। এই বারলাতেই বদিউজ্জামান বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘রিসালা-ই-নূর’ রচনার দুই-তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন করেন।
তাফসীরটির রচনা সম্পূর্ণ হলে তাঁর ছাত্ররা নিজ হাতে এর অসংখ্য কপি তৈরি করে। এমনকি তাফসীরটি আরবি ছাড়াও স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তারপর ‘নূরস পোস্টাল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে পুরো তুরস্কে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তুরস্ক জুড়ে রিসালা-ই-নূরের ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এতে কর্তৃত্ববাদী সেক্যুলার স্বৈর-সরকার বুঝতে পারে যে, বদিউজ্জামানের আন্দোলনকে তারা থামিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য তাঁর উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়। তাঁর কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে শুধু বাক-স্বাধীনতাই নয়, তাঁর চলাফেরার উপরও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
রিসালা-ই-নূর গ্রন্থের যুক্তিগুলো জনে জনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইতোমধ্যে সাঈদ নুরসী শুধু একজন আলেম হিসেবেই নন, সংস্কারক হিসেবেও পরিচিত হয়ে উঠেন। সরকারের নানা চাপের ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৩৫ সালের এপ্রিল মাসে আবারো অসংখ্য ছাত্রসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। একইসাথে রিসালা-ই-নূরকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর যত কপি পাওয়া গেছে সবগুলো জব্দ করা হয়। এসবের ফলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। বদিউজ্জামান নুরসীকে যেখানেই নেওয়া হতো, সেখানেই জনতার ভীড় জমে যেতো।
গ্রেফতারকৃত সবার বিরুদ্ধে ফৌজদারী দণ্ডবিধি ১৬৩ ধারা অর্থাৎ সেক্যুলারিজমের মূলনীতি লংঘনের অভিযোগ আনা হয়। তারপর তাঁদেরকে ইসকিশেহির কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কারাগারে বদিউজ্জামান নুরসীকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়, যাতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেন। এছাড়া জেলকোড অনুযায়ী কারাগারে তাঁদের প্রাপ্য ন্যূনতম সুবিধাও প্রদান করা হতো না। তাদের মধ্য কয়েকজন শরীরিক নির্যাতনে মারাও যান।
পরবর্তীতে আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্বেও শুধু পোশাক সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদে কোরআনের আয়াত ব্যবহারের অযুহাতে বদিউজ্জামান নুসরীকে ১১ মাস এবং তাঁর ছাত্রদেরকে ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তিনি আদালতের সামনে দৃঢ়ভাবে তাঁর উপর আরোপিত অভিযোগের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এতে বিচারকগণ সর্বোচ্চ শাস্তির পরিবর্তে কারাদণ্ডের রায় প্রদান করতে বাধ্য হন।
কারামুক্তির পরও বদিউজ্জামান নুরসী ও তাঁর ছাত্রদের উপর নজরদারী রাখা হয়। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে রিসালা-ই-নূর তাফসীরটি অধ্যয়ন এবং প্রচারের অভিযোগে অসংখ্য সাধারণ মানুষ গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। কাস্তামনু শহরে বদিউজ্জামান নুরসীর বাসায় নজরদারী ও বার বার তল্লাশি চালানো হয়। এক পর্যায়ে মানুষকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু এতেও রিসালা-ই-নূরের জনপ্রিয়তা ও তাঁর ভক্তদের দমন করা যায়নি। তাই তাঁকে আবারো গ্রেফতার করা হয় এবং দেনজেলি কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ইসকিশেহির কারাগারের চেয়ে এই কারাগার ছিল আরো ভয়ানক। এখানে খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। তবে বিষক্রিয়ায় তিনি শারীরিকভাবে আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন।
১৯৪৪ সালের ২২ এপ্রিল রিসালা-ই-নূর খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি আঙ্কারা ফৌজদারী আদালতে সর্বসম্মত রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, রিসালা-ই-নূরের বিষয়বস্তুর ৯০ শতাংশই হলো ঈমানের সত্যতা, এর বিভিন্ন শাখা প্রশাখা সম্পর্কিত গবেষণামূলক ব্যাখ্যা। এই গ্রন্থটিতে গবেষণা ও ধর্মীয় মূলনীতি থেকে কোনো ধরনের বিচ্যুতি নেই। ধর্মকে স্বার্থ হাসিলের জন্যে ব্যবহার এবং কোনো সমিতি বা দল গঠনের অথবা জনশৃংখলা ভঙ্গ করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো আলামত এ গ্রন্থে পাওয়া যায়নি।
১৯৪৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সকল বন্দীকে মুক্তি প্রদান করা হয়। সাথে সাথে বেড়ে যায় রিসালা-ই-নূরের প্রচার ও প্রসার। তুর্কি জনগণের কাছে গ্রন্থটি নতুন করে আবেদন সৃষ্টি করে। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেকের ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে রিসালা-ই-নূর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
Fifth Ray বা পঞ্চম আলোকরশ্মি শিরোনামের এক প্রবন্ধে হাদীসের ব্যাখ্যায় শেষ জামানায় দাজ্জালের আগমন সম্পর্কিত আলোচনায় নুরসী দাজ্জাল বলতে কামাল আতাতুর্ককে বুঝিয়েছেন- এমন অভিযোগে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা করে আফিয়ান কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আফিয়ান কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত ২০ মাসের কারাদণ্ড উচ্চ আদালত খারিজ করে পুনর্বিচারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিচারকাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা হয় এবং পুরো ২০ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর বদিউজ্জামানকে মুক্তি দেয়া হয়। ফলে বিনা বিচারে তিনি ২০ মাসের দণ্ড ভোগ করতে বাধ্য হন। অবশ্য কারাবাসের মধ্যেও তাঁর অধ্যয়ন চলতে থাকে এবং সেখানেও তাঁর ছাত্র তৈরি হয়ে যায়।
১৯৫০ সালের সাধারণ নির্বাচনে কামালবাদী শাসনের পতন হলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালের জুন মাসে রিসালা-ই-নূরের উপর আদালত চূড়ান্তভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বদিউজ্জামান নুরসী ডেমোক্র্যাটদের প্রতি সমর্থন দেন। ৫০ সালের নির্বাচনেও তিনি কট্টরপন্থী সেক্যুলারিজমের (কামালবাদ) বিপরীতে ডেমোক্র্যাটকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, ডেমোক্র্যাটরা ধর্ম ও মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেকটা উদার। এ ব্যাপারে তাঁর ছাত্ররা প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন, ডেমোক্র্যাট পার্টি পরাজিত হলে কট্টর সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করবে। ফলে সামাজিক ও জাতীয় জীবনে এক বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। সুতরাং তারা যাতে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, তাই আমি আদনান মেন্দারিসকে অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটকে দেশ, ইসলাম ও কোরআন রক্ষার স্বার্থে সমর্থন দিয়েছি।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনের সময় থেকেই বদিউজ্জামান নুরসী পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ৫৭ সালের নির্বাচনে পুনরায় ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করে। কামালবাদী সেক্যুলার দল আরপিপি নিজেদের বিপর্যয়ের জন্যে নুরসীর আন্দোলনকে দায়ী করতে থাকে। ফলে কামালবাদী দলের সাথে নুরসী আন্দোলনের সমর্থক ও পাঠকদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু বদিউজ্জামান নুরসী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং বিজয়ী হন। ততদিনে তুরস্কে ধর্মচর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল করা হয়। তুরস্কের গণমানুষের কাছে বদিউজ্জামান নুরসী অসম্ভব জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর এবং পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে ৮৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ নুরসী পর্যায়ক্রমে একাধিকবার আঙ্কারা, ইস্তান্বুল ও কোনিয়া সফর করেন। রিসালা-ই-নূর আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষেণ এবং রিসালা-ই-নূর সেন্টার পরিদর্শন করতে তিনি এসব সফর করেন।
১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী উরফা প্রদেশে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পুরো উরফার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নরের চাপাচাপিতে পরদিনই তাঁকে দাফন করা হয় খলিলুর রহমান দরগার কবরস্থানে। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর সমাধিস্থলে প্রতিদিন প্রচুর লোক জমায়েত হতো। ১৯৬০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। আবারো ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়। জান্তা সরকার সাঈদ নুরসীর কবর স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ জুলাই সামরিক প্রশাসন রাতের আধারে জোর করে বদিউজ্জামান নুরসীর দেহাবশেষ উরফা থেকে ইয়োরিদিতে স্থানান্তর করে। এখন পর্যন্ত ইয়োরিদির পাহাড়ঘেরা অজ্ঞাত স্থানে শায়িত আছেন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই মানুষটি।
(COLLECTED)
ছোট থেকেই সাঈদ নুরসী ছিলেন স্বাধীনচেতা। ১০ বছর বয়স হতেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। অল্প বয়সেই ধর্মতত্ত্ব নিয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি। এ কারণে সুফি দর্শনে প্রভাবিত হলেও সুফি তরিকায় পুরোপরি যোগ দেননি। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। কোনো বিষয় মুখস্ত করতে তাঁর বেশি সময়ের প্রয়োজন হতো না। মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করা সাঈদ ধর্মতত্ত্বের উপর অগাধ পাণ্ডিত্য লাভ করেন। এ সংক্রান্ত যে কোনো বিতর্কে তাঁর যুক্তিগুলো ছিল অখণ্ডনীয়। যা সে সময়ের আলেম সমাজকে বেশ অবাক করেছিল। পরবর্তীতে তাঁকে *‘বদিউজ্জামান’ উপাধি প্রদান করা হয়। এর অর্থ হলো সময়ের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
মারদিনে অবস্থানকালে নামিক কামালের তাত্ত্বিক লেখাগুলোর সাথে সাঈদ নুরসীর পরিচয় ঘটে। মূলত কামাল ছিলেন ‘ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্টের’ অন্যতম নেতা। মানুষের অধিকার, মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে লেখা নামিক কামালের পুস্তকগুলো তরুণ সাঈদ নুরসীর মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৮৯২ সালের দিকে তিনি ইয়ং টার্কিশ মুভমেন্টে যোগ দেন। তখন থেকে তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করেন।
ভ্যান প্রদেশের গভর্নরের আমন্ত্রণে তাঁর বাসভবনে বসবাস করতে শুরু করেন সাঈদ নুরসী। এ সময় সেখানকার আর্কাইভ ও লাইব্রেরির বইপত্রগুলো অধ্যয়ন করতে থাকেন নুরসী। বিজ্ঞান, দর্শন, গণিত- এসব বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সাথে সাথে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সরকারী ভাষার উপরও দক্ষতা লাভ করেন। থিওলজি তথা ধর্মতাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষার সংস্পর্শে এসে সাঈদ নুরসী পরিবর্তিত সময়ে সময়োপযোগী চিন্তার সাথে পরিচিত হন। বুঝতে পারেন যে, শুধুমাত্র সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে মুসলিম জাতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না। তাই পূর্ব তুরস্কে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার চিন্তা করতে থাকেন যেখানে ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থাও থাকবে। পরবর্তীতে তাঁর সেই চিন্তানুযায়ী ১৯১৩ সালে ভ্যান প্রদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেহরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটিতে ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের সমন্বয়ে প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা ঐ অঞ্চলে ইসলাম সম্পর্কে খুবই উচ্চতর দর্শনের সূত্রপাত ঘটায়।
১৯০৯ সালে উসমানীয় সরকার তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনে ও বিচারের মুখোমুখি করে। কারণ তিনি তখন Committee of Union Progress (CUP)– এর সাথে মিলে উদারবাদী সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং মুক্তি পান। উসমানীয় সাম্রাজ্যের শেষদিকে শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন তিনি। সুলতান আবদুল হামিদকে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, সনাতনী মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাথে সুফিজম ও আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয় করে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। অবশ্য পরবর্তীতে খিলাফতের বিপন্ন অবস্থা দেখে নিজেই যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। জ্ঞান অর্জনে তিনি যেমন তুখোড় ছাত্র, তেমনি যুদ্ধক্ষেত্রে ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী সৈনিক। ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন আধাসামরিক বাহিনী। তুরস্কের পূর্বদিকে পাসিলোনা ফ্রন্টে রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁর বাহিনী নিয়ে। যুদ্ধের একপর্যায়ে বন্দী হয়ে রাশিয়ান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নির্বাসিত হন। দুই বছর পর সেখান থেকে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। ১৯১৮ সালে ইস্তান্বুলে তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। সে সময় ইস্তান্বুলের বুদ্ধিজীবী সংগঠন ‘দারুল হিকমাহ আল ইসলামীয়া’র সদস্য হিসেবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯২২ সালের ৯ নভেম্বর Grand National Assembly-তে বদিউজ্জামান নুরসীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন জানানো হয়। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলেও বদিউজ্জামান নুরসী ইসলামের প্রতি অনেক সাংসদের উদাসীন মনোভাব দেখে হতাশ হন।
যুদ্ধের সময় নুরসী The Six Steps শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। নুরসীর এই লেখায় তুর্কি সৈনিকদের মনোবল চাঙ্গা হয়। স্বীকৃতি স্বরূপ কামাল আতাতুর্ক তাঁকে আঙ্কারায় আমন্ত্রণ জানান ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। কিন্তু নুরসীর ধর্মীয় প্রভাবে নয়া তুর্কি প্রজাতন্ত্রে কামালবাদী সেক্যুলার আদর্শ বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল। এ কারণে কামাল আতাতুর্ক সাঈদ নুরসীকে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালের দায়িত্ব পালনের প্রস্তাব দেন। যাতে করে সাঈদ নুরসীকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু আদর্শের প্রতি দৃঢ় ও প্রজ্ঞাবান নুরসী বিনীতভাবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। মুসলিম জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে জোর করে মুছে দিয়ে সেক্যুলারিজমকে চাপিয়ে দেয়ার বিরোধী ছিলেন সাঈদ নুরসী। মূলত তখন থেকেই কামাল আতাতুর্কের সাথে সাঈদ নুরসীর আদর্শিক সংঘাত শুরু হয়। সরকার সর্বক্ষেত্রে ইসলাম ও কোরআনকে নিষিদ্ধ করার প্রেক্ষিতে তিনি ঘোষণা করেন, “আমি পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করবো কোরআন নিঃশেষ হয়ে যাবার মতো কিছু নয়। এটা হলো এক শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। এক অফুরান আলোর উৎস”। সাঈদ নুরসী অবশ্য তারপর থেকে নিজেকে রাজনীতি থেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেন।
১৯২৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শেখ সাঈদ নামে এক নকশবন্দী শেখের নেতৃত্বে বিদ্রোহ শুরু হলো। এটি শেখ সাঈদ বিদ্রোহ নামে পরিচিত। মূলত কুর্দিদের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্বশাসনের জন্যে অনেক আগে থেকেই একটা গুঞ্জন ছিল। তবে তা খুবই বেশি বড় ছিল না। বিদ্রোহী নেতা শেখ সাঈদ বদিউজ্জামান নুরসীর সমর্থন লাভের ব্যর্থ চেষ্টা করে। বরং নুরসী এ বিদ্রোহের বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে তুরস্ক সরকার এই ছোট্ট ঘটনাকে ইস্যু করে ১৯২৫ সালের ৪ মার্চ একটা আইন পাশ করে। আগে থেকেই নুরসীকে আটক করার সুযোগ খুঁজছিল নয়া স্বৈর-সরকার। এই আইনের মাধ্যমে ডাইরেক্টরি ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেকের সাথে বদিউজ্জামান নুরসীকেও কারাবন্দী করে ইস্তান্বুল পাঠানো হয়।
১৯২৬ সালের দিক ইস্পার্তায় নির্বাসনে পাঠানো হয় বদিউজ্জামান নুরসীকে। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানকার মানুষগুলো তাঁর ভক্ত হয়ে যেতো এবং তাঁর ছাত্রে পরিণত হতো। এ কারণে তাঁকে আরো দুর্গম এলাকা ‘বারলায়’ নির্বাসন দেয়া হয়। কিন্তু এখানে তাঁর ছাত্র সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। এই বারলাতেই বদিউজ্জামান বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘রিসালা-ই-নূর’ রচনার দুই-তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন করেন।
তাফসীরটির রচনা সম্পূর্ণ হলে তাঁর ছাত্ররা নিজ হাতে এর অসংখ্য কপি তৈরি করে। এমনকি তাফসীরটি আরবি ছাড়াও স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়। তারপর ‘নূরস পোস্টাল সিস্টেম’-এর মাধ্যমে পুরো তুরস্কে ছড়িয়ে দেয়া হয়। তুরস্ক জুড়ে রিসালা-ই-নূরের ব্যাপক প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এতে কর্তৃত্ববাদী সেক্যুলার স্বৈর-সরকার বুঝতে পারে যে, বদিউজ্জামানের আন্দোলনকে তারা থামিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্য তাঁর উপর নতুন করে চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়। তাঁর কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে শুধু বাক-স্বাধীনতাই নয়, তাঁর চলাফেরার উপরও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়।
রিসালা-ই-নূর গ্রন্থের যুক্তিগুলো জনে জনে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইতোমধ্যে সাঈদ নুরসী শুধু একজন আলেম হিসেবেই নন, সংস্কারক হিসেবেও পরিচিত হয়ে উঠেন। সরকারের নানা চাপের ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে ১৯৩৫ সালের এপ্রিল মাসে আবারো অসংখ্য ছাত্রসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। একইসাথে রিসালা-ই-নূরকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর যত কপি পাওয়া গেছে সবগুলো জব্দ করা হয়। এসবের ফলে সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। সুযোগ পেলেই এর বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। বদিউজ্জামান নুরসীকে যেখানেই নেওয়া হতো, সেখানেই জনতার ভীড় জমে যেতো।
গ্রেফতারকৃত সবার বিরুদ্ধে ফৌজদারী দণ্ডবিধি ১৬৩ ধারা অর্থাৎ সেক্যুলারিজমের মূলনীতি লংঘনের অভিযোগ আনা হয়। তারপর তাঁদেরকে ইসকিশেহির কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। কারাগারে বদিউজ্জামান নুরসীকে নিঃসঙ্গ অবস্থায় রাখা হয়, যাতে তিনি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেন। এছাড়া জেলকোড অনুযায়ী কারাগারে তাঁদের প্রাপ্য ন্যূনতম সুবিধাও প্রদান করা হতো না। তাদের মধ্য কয়েকজন শরীরিক নির্যাতনে মারাও যান।
পরবর্তীতে আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া সত্বেও শুধু পোশাক সংক্রান্ত জিজ্ঞাসাবাদে কোরআনের আয়াত ব্যবহারের অযুহাতে বদিউজ্জামান নুসরীকে ১১ মাস এবং তাঁর ছাত্রদেরকে ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। তিনি আদালতের সামনে দৃঢ়ভাবে তাঁর উপর আরোপিত অভিযোগের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এতে বিচারকগণ সর্বোচ্চ শাস্তির পরিবর্তে কারাদণ্ডের রায় প্রদান করতে বাধ্য হন।
কারামুক্তির পরও বদিউজ্জামান নুরসী ও তাঁর ছাত্রদের উপর নজরদারী রাখা হয়। চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে রিসালা-ই-নূর তাফসীরটি অধ্যয়ন এবং প্রচারের অভিযোগে অসংখ্য সাধারণ মানুষ গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। কাস্তামনু শহরে বদিউজ্জামান নুরসীর বাসায় নজরদারী ও বার বার তল্লাশি চালানো হয়। এক পর্যায়ে মানুষকে তাঁর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে তাঁকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু এতেও রিসালা-ই-নূরের জনপ্রিয়তা ও তাঁর ভক্তদের দমন করা যায়নি। তাই তাঁকে আবারো গ্রেফতার করা হয় এবং দেনজেলি কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ইসকিশেহির কারাগারের চেয়ে এই কারাগার ছিল আরো ভয়ানক। এখানে খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। তবে বিষক্রিয়ায় তিনি শারীরিকভাবে আগের চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েন।
১৯৪৪ সালের ২২ এপ্রিল রিসালা-ই-নূর খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি আঙ্কারা ফৌজদারী আদালতে সর্বসম্মত রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, রিসালা-ই-নূরের বিষয়বস্তুর ৯০ শতাংশই হলো ঈমানের সত্যতা, এর বিভিন্ন শাখা প্রশাখা সম্পর্কিত গবেষণামূলক ব্যাখ্যা। এই গ্রন্থটিতে গবেষণা ও ধর্মীয় মূলনীতি থেকে কোনো ধরনের বিচ্যুতি নেই। ধর্মকে স্বার্থ হাসিলের জন্যে ব্যবহার এবং কোনো সমিতি বা দল গঠনের অথবা জনশৃংখলা ভঙ্গ করার মতো আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো আলামত এ গ্রন্থে পাওয়া যায়নি।
১৯৪৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে সকল বন্দীকে মুক্তি প্রদান করা হয়। সাথে সাথে বেড়ে যায় রিসালা-ই-নূরের প্রচার ও প্রসার। তুর্কি জনগণের কাছে গ্রন্থটি নতুন করে আবেদন সৃষ্টি করে। দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনেকের ইতিবাচক মনোভাব তৈরিতে রিসালা-ই-নূর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
Fifth Ray বা পঞ্চম আলোকরশ্মি শিরোনামের এক প্রবন্ধে হাদীসের ব্যাখ্যায় শেষ জামানায় দাজ্জালের আগমন সম্পর্কিত আলোচনায় নুরসী দাজ্জাল বলতে কামাল আতাতুর্ককে বুঝিয়েছেন- এমন অভিযোগে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা করে আফিয়ান কারাগারে প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আফিয়ান কোর্ট কর্তৃক প্রদত্ত ২০ মাসের কারাদণ্ড উচ্চ আদালত খারিজ করে পুনর্বিচারের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বিচারকাজ ইচ্ছাকৃতভাবে বিলম্ব করা হয় এবং পুরো ২০ মাস অতিবাহিত হওয়ার পর বদিউজ্জামানকে মুক্তি দেয়া হয়। ফলে বিনা বিচারে তিনি ২০ মাসের দণ্ড ভোগ করতে বাধ্য হন। অবশ্য কারাবাসের মধ্যেও তাঁর অধ্যয়ন চলতে থাকে এবং সেখানেও তাঁর ছাত্র তৈরি হয়ে যায়।
১৯৫০ সালের সাধারণ নির্বাচনে কামালবাদী শাসনের পতন হলে পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু হয়। অবশেষে ১৯৫৬ সালের জুন মাসে রিসালা-ই-নূরের উপর আদালত চূড়ান্তভাবে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বদিউজ্জামান নুরসী ডেমোক্র্যাটদের প্রতি সমর্থন দেন। ৫০ সালের নির্বাচনেও তিনি কট্টরপন্থী সেক্যুলারিজমের (কামালবাদ) বিপরীতে ডেমোক্র্যাটকে সমর্থন করেছিলেন। কারণ, ডেমোক্র্যাটরা ধর্ম ও মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে ছিল অনেকটা উদার। এ ব্যাপারে তাঁর ছাত্ররা প্রশ্ন করলে তিনি জবাব দেন, ডেমোক্র্যাট পার্টি পরাজিত হলে কট্টর সেক্যুলার এবং জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতা দখল করবে। ফলে সামাজিক ও জাতীয় জীবনে এক বড় বিপর্যয় নেমে আসবে। সুতরাং তারা যাতে ক্ষমতা দখল করতে না পারে, তাই আমি আদনান মেন্দারিসকে অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটকে দেশ, ইসলাম ও কোরআন রক্ষার স্বার্থে সমর্থন দিয়েছি।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম নির্বাচনের সময় থেকেই বদিউজ্জামান নুরসী পুনরায় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে শুরু করেন। ৫৭ সালের নির্বাচনে পুনরায় ডেমোক্র্যাটরা জয়লাভ করে। কামালবাদী সেক্যুলার দল আরপিপি নিজেদের বিপর্যয়ের জন্যে নুরসীর আন্দোলনকে দায়ী করতে থাকে। ফলে কামালবাদী দলের সাথে নুরসী আন্দোলনের সমর্থক ও পাঠকদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু বদিউজ্জামান নুরসী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং বিজয়ী হন। ততদিনে তুরস্কে ধর্মচর্চার উপর নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল করা হয়। তুরস্কের গণমানুষের কাছে বদিউজ্জামান নুরসী অসম্ভব জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।
১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর এবং পরবর্তী বছরের জানুয়ারি মাসে ৮৩ বছরের বয়োবৃদ্ধ নুরসী পর্যায়ক্রমে একাধিকবার আঙ্কারা, ইস্তান্বুল ও কোনিয়া সফর করেন। রিসালা-ই-নূর আন্দোলনের সর্বশেষ অবস্থা পর্যবেক্ষেণ এবং রিসালা-ই-নূর সেন্টার পরিদর্শন করতে তিনি এসব সফর করেন।
১৯৬০ সালের ২৩ মার্চ বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসী উরফা প্রদেশে ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে পুরো উরফার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নরের চাপাচাপিতে পরদিনই তাঁকে দাফন করা হয় খলিলুর রহমান দরগার কবরস্থানে। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসীর সমাধিস্থলে প্রতিদিন প্রচুর লোক জমায়েত হতো। ১৯৬০ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। আবারো ধর্মীয় ও মৌলিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়। জান্তা সরকার সাঈদ নুরসীর কবর স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১২ জুলাই সামরিক প্রশাসন রাতের আধারে জোর করে বদিউজ্জামান নুরসীর দেহাবশেষ উরফা থেকে ইয়োরিদিতে স্থানান্তর করে। এখন পর্যন্ত ইয়োরিদির পাহাড়ঘেরা অজ্ঞাত স্থানে শায়িত আছেন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই মানুষটি।
(COLLECTED)
Comment