মহিলা সাহাবীদের পাতা থেকেঃ
হাফসা বিতন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)
=======================
উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা) দ্বিতীয় খলীফা ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) কন্যা। মা খুযা‘আ গোত্রের মেয়ে যয়নাব বিনত মাজ‘উন প্রখ্যাত সাহাবী ‘উসমান ইবন মাজ‘উনের আপন বোন। তিনি নিজেও একজন সাহাবী। আবদুল্লাহ ইবন উমার ও হাফসা (রা) আপন ভাই-বোন।১ হাফসা আবদুলত্মাহর চেয়ে ছয় বছরের বড়।২ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। উমার (রা) বলেনঃ মক্কার কুরাইশরা তখন কা‘বা ঘরের পুনঃনির্মাণের কাজে ব্যস্ত।৩
বিয়ের বয়স হলে পিতা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বনু সাহম গোত্রের সন্তান খুনাইস ইবন হুজাফার সাথেতাঁর প্রথম বিয়ে দেন। এই খুনাইস মক্কায় প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদেরান্যতম। হাবশায় হিজরাতকারী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন।৪ অবশ্য মূসা ইবন উকরবা ও আবু মা‘শার তাঁর হাবশায় হিজরাতের কথা উলে্খ করেননি।৫ সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে আবার মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় পৌঁছে কুবার বনু আমর ইবন আওফ গোত্রের রিফা‘য়া ইবন আবদিল মুনজিরের গৃহে আশ্রয় নেন।৬
হাফসার (রা) ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিচু জানা যায় না। তবে এতটুকু নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, ‘উমার ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেত৭ার নিজ গোত্র ও খান্দানের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন। সম্ভবতঃ হাফসাও সেই সময় পরিবারের লোকরেদ সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।৭
স্বামীর সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় আসার অর্পকাল পরেই বধবা হন। তখন তাঁর বয়স বিশ বছরও হয়নি।৮ খুনাইসের মৃত্যুর সময়কার নিয়ে কিঞ্চিত মতভেদ আছে। অধিকাংশ সীরাত বিশেষঝে্হর মতে তিনি বদর ও ইহুদ যুদ্ধে যোগদান করেন। উহুদে তাঁর দেহেরে একাধিক স্থানে জখম হয় এবং মদীনায় ফিরে এসে তাতেই মারা যান।৯ ভিন্ন মতে তিনিবদরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা জখম হন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর থেকে মদীনায় ফেরার পর হিজরী দ্বিতীয় সনে তিনি মারা যান।১০
মেয়ে বিধবা হওয়ার পর পিতা উমার (রা) তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে সেই সময় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়ে ও হযরত উসমানের (রা) স্ত্রী রুকাইয়্যা (রা) ইনতিকাল করেন! উমার (রা) সর্বপ্রথম উসমানের সাথে দেখা করে তাঁর সাথে হাফসার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উসমান বিষয়টি ভেবে দেখবো বলে সময় নেন। কয়েক দিন পর, ‘আমি এ সময় বিয়ে করতে চাচ্ছি না’-বলে জবাব দেন। তারপর উমার (রা) গেলেন আবু বকরের (রা) কাছে। বললেনঃ আপনার সাথে আমি হাফসাকে বিয়ে দিতে চাই। আবু বকর (রা) চুপ থাকলেন, কোন জবাব দিলেন না। উসমানের (রা) জবাবে উমার (রা) যতখানি আহত হন তার চেয়ে বেশি হন আবু বকরের (রা) আচরণে। উমার (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খিদমতে হাজির হয়ে মনের দুঃখ প্রকাশ করেন।১১ ইবনুল আসীর বলেন, ওমার (রা) প্রথমে আবু বকরকে (রা) প্রস্তাব করেন, কিন্তু তিনি কোন উত্তর না দেওয়ায় উসমানকে (রা) প্রস্তাব করেন।১২
‘আয়িশার (রা) সাথে বিয়ের মাধ্যমে আবু বকরের (রা) সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু উমারের (রা) সাথে কোন আত্মীয়তা ছিলনা। হাফসার (রা) সাথে বিয়ের মাধ্যমে এমন সম্পর্ক সৃষি।ট হওয়া আল্লাহর মর্জি চিল। উমারের (রা) দুঃখের কথা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ হাফসাকে বিয়ে করবে উসমানের চেয়েও ভালো এক ব্যক্তি এবং উসমান বিয়ে করবে হাফসার চেয়েও ভালো এক মহিলাকে।১৩ অন্য একটি বর্ণনায় এসেচে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন আমি কি তোমাকে উসমানের চেয়ে ভালো জামাই এবং উসমানকে তোমার চেয়ে ভালো শ্বশুরের সন্দান দেব না? উমার বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই দেবেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমার মেয়ে হাফসাকে আমার সাথেবিয়ে দাও, আর আমার মেয়ে উম্মু কুলসুমকে বিয়ে দিই উসমানের সাথে।১৪ এভাবে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। হাফসার পিতা উমার নিজেই ওলি হয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে চার শো দিরহাম দেন মোহর দান করেন।১৫
উমারের (রা) প্রস্তাবে উসমান ও আবু বকরের (রা) সাড়া না দেওয়ার কারণ হলো, তাঁর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার কথা আলোচনা করতে শুনেছিলেন। তারা বুঝেছিলেন, তিনি উমারের (রা) সম্মানার্থে হাফসাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁরা এ কথাটি উমারকে বলতে সাহস করেননি এই ভয়ে যে, তাঁদের বুঝার ভুলও হতে পারে।১৬ এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হাফসার বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পর আবু বকর (রা) একদিন উমারের (রা) সাথে দেখা করে বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন হাফসার কথা বলেছিলেন, আমি তাঁর গোপন কথা প্রকাশ করতে চাইনি। এছাড়া আপনার প্রস্তাবের জবাব না দেওয়ার আর কোন কারণ ছিল না।১৭
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হাফসার বিয়ে কখন হয় সে বিষয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতভেদ আছে। এ মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে মূলতঃ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর সময় নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে। ইবনুল আসীর বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে হিজরী তৃতীয় সনে এ বিয়ে হয়।১৮ আবু উবাসয়দার মতে, এ বিয়ে হন হিজরী দ্বিতীয় সনে। আর এটাই ইবন আবদিল বার-এর মত। ইবন হাজার আল-ইসাবা গ্রন্থেতৃতীয় সনের মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তাঁর প্রথম স্বামী উহুদে শাহাদাত বরণ করেন। অনেকে বলেন, হিজরাতের ২৫ মতান্তরে ৩০ মাস পরে এ বিয়ে হন। কোন কোন বর্ণনায় ২০ মাস পরের কথাও এসেছে! অথচ উহুদ যুদ্ধ হয় হিজরাতের ৩০ মাসেরও পরে। ইবন সাদ জোর দিয়ে বলেন, তাঁর প্রথম স্বামী বদর থেকে ফেরার পর মারা যান। ইবন সায়্যিদিন নাস বলেন, হিজরাতের ৩০ মাসের মাথায় মা‘বান মাসে এ বিয়ে হয়।২০
হাফসার (রা) মৃত্যুসন নিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে, তিনি ৪৫ হিজরীর শা‘বান মাসে মদীনায় ইনতিকাল করেন। আমীর মু‘য়াবয়িার ৯রা) খিলাফতকাল এবং মদীনার গভর্ণর তখন মারওয়ান। তিনি জানাযার নামায পড়ান, লাশের সাথে বাকী গোরস্থান পর্যন্ত যান এবং দাফন কার্য শেষ হওয়া পযৃন্ত বসে থাকেন। আলে হাযামের বাড়ী থেকে মুগীরার বাড়ী পর্যন্ত লাশবাহী খাটিয়ায় তিনি কাঁধ দেন এবং সেখানে ত৭ার স্থালে আবু হুরাইরা (রা) কাঁধ দিয়ে কবর পর্যন্ত নিয়ে যান। হাফসার (রা) ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) এবং তাঁর ছেলেরা-‘আসিম,সালিম, আবদুল্লাহ ও সামযা লাশ কবরে নামান। এভাবে তিনি বাকী গোরস্থানে সমাহিত হন। উল্লেখিত মতটি মা‘মার, যুহরী ও সালিমের সূত্রে আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন।২১ তবে ইবনুল আসীরে ঝোঁক এই দিকে যে, যে সময় হাসান ইবন আলী (রা) আমীর মুয়াবিয়ার (রা) হাতে বাইয়াত করেন সেই সময় হাফসার ওফাত হয়। আর সেটা ৪১ হিজরীর জামাদিউল আওয়াল মাস। আর এই সনকে আমুল জামা‘য়াহ বলা হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হিজরী ২৭ সনে উসম্যানের (রা) খিলাফতকালে মারা যান। এ মতটির ভিত্তি হলো, ওয়াহাব ইবন মালিক বলেছেন, যে বছর আপ্রিকা বিজয় হয়, সেই বছর তিনি মারা যান। আর আফ্রিকা বিজয় হয় হিজরী ২৭ সনে। কিন্তু এ এক মারাত্মক ভুল। কারণ আফ্রিকা বিঝয় হয় দুইবার। প্রথম বিজয় হয় হিজরী ২৭ সনে, আর দ্বিতীয় বিজয় হয় মু‘য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে। এ বিজয়ের গৌরবের অধিকারী ছিলেন মু‘য়াবিয়া ইবন খাদিজা (রা)।২২ মৃত্যুকালে হাফসার (রা) বয়স হয়েছিল ৬৩ অথবা ৫৯ বছর।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমারকে (রা) একই উপদেশ দান করেন যা তাঁর পিতা উমার (রা) তাঁকে মৃত্যুর সময় দান করেছিলেন। পিতা তাঁকে গাবা‘তে যে ভূ-সম্পত্তি দিয়ে যান তিনি আল্লাহর রাসআতয় ওয়াকফ করে দেণ।২৩ হাফসা (রা) কোন সন্তান রেখে যাননি।২৪
হাফসার (রা) সন্তানাদি না থাকলেও তিনি অনেক স্নেহভাজন নারী ও পুরুষ রেখে যান যারা তাঁর নিকট হাদীস মুনেছিলেন এবং তা বর্ণনাও করে গেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন উমার, হামযা ইবন আবদিল্লাহ, সাফিয়্যা বিনত আবী উবায়দা (আবদুল্লাহর স্ত্রী), মত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া, উম্মু মুবাশশির আল আনসারিয়্যা, আবদুর রহমান ইবন হারেস ইবন হিশাম, আবদুল্লাহ ইবন সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা, শুতাইর ইবন শাকাল, সাওয়া আল-খুযাঈ, আল-মুসায়্যিব ইবন রাফে, আল-মাজলায ও আরো অনেকে।২৫
হাফসা (রা) থেকে মোট ৬০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলি তিনি খোদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও পিতা উমার (রা) থেকে শুনেছিলেন।২৬ তার বর্ণিত চারটি হাদীস মুত্তাফাক ‘আলইহি এবং চয়টি হাদীস বুখারী হাদীস বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন।২৭
হযরত হাফসার (লা) তৎকালীন আরবের অন্য সকল নারী-পুরুষের মতই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছির না। তবে পিতা উমার (রা) ও স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেয়ে বড় শিক্ষক আর কে হতে পারতেন? তাঁদের প্রতিপালক ও তত্ত্ববধানে তাঁর মধ্যে জ্ঞানার্জন ও দীনকে বুঝার প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয়। দীনী বিষয়ে তাঁর যে গভীর জ্ঞান ছিল, বিভিন্ন ঘটনায় তা জানা যায়। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি আশা করি বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রণকারীগণ জাহান্নামে যাবে না।’ হযরত হাফসা (রা) বলে উঠলেন, আল্লাহ তো বলেছেনঃ
আরবী হবে
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে (জাহান্নামে) পৌঁছবে না।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে একথাও তো আল্লাহ বলেছেনঃ
আরবী হবে
‘‘অতঃপর আমি খোদাভীরু লোকদের উদ্ধার করবো এবং জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।’’ (সূরা মারইয়াম-৭১-৭২)২৮
হাফসার (রা) মধ্যে শেখা ও জানার প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করে রাসূলে কারীমও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবসময় তাঁকে বিভিন্ন বষিয়ে শেখানোর চিন্তা করতেন। হযরত শিফা বিনত আবদিল্লাহ ছিলেন একজন মহিলা সাহাবী। তিনি রিখতে ও পড়তে জানতেন। হযরত হাফসা তাঁর নিকট লেখা শেখেন। এই শিক্ষা নামলা’২৯ নামক এক প্রকার ক্ষত-রোল নিরাময়ের ঝাঁক-ফুঁক করতেন। একদিন তিনি রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে বললেনঃ আমি জাহিলী জীবনে ঝাঁড়-ফুঁক করতালম। আপনিআনুমতি দিলে তা আমি আপনাকে শুনাই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুনে বললেন, এই ঝাঁড়-ফুঁকটি তুমি হাফসাকেও শিখিয়ে দাও। অন্য একটি বর্ণায় এসেছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিফাকে বলেন, তুমি কি হাফসাকে এই নামলা’র দু‘আটি শিখিয়ে দেবে না যেমন তাকে লেখা শিখিয়েছো?৩০ রাসূলে পাপর্কের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় এবং পরবর্তী জীবনে হাফসা (রা) প্রচুর ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। সব সময় রোযা রাখতেন এবং অতিমাত্রায় রাত জেগে নামায আদায় করতেন। জিবরীল (আ) তাঁর সম্পর্কে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তিনি অতিমাত্রায় সিয়াম পালনকারিণী এবং রাতের বেলাতে খুব বেশি ইবাদাতকারিণী।৩১ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, জিবরীর (আ) বলেনঃ তিনি একজন সৎকর্মশীলা নারী।৩২ তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, রোযা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।৩৩
তিনি সব রকমের মতবিরোধকে অপছন্দ করতেন। সিফফীন যুদ্ধের পর যখন দুমাতুল জান্দালে শালিশ-ফয়সালার বিষয়টি এরো তখন তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) তা একটি ফিতনা ফাসাদ মনে করে ঘর থেকে বের হতে চাইলেন না। কিন্তু হাফসা তাঁকে বললেন, এতে অংশগ্রহণে তোমার কোন লাভ নেই, তবে তোমার অংশগ্রহণ করা উচিত। কারণ, মানুষ তোমার মতামতের অপেক্ষায় থাকবে। এমনও হতে পারে, তোমার এই দূরে থাকা তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।৩৪ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেনঃ উম্মাতে মুহাম্মদীর ম¨্যধ আপোষ-মীমাংষা হতে পারে এমন কোন বিয়ষ থেকে দূরে থাকা সমীচীন নয়। তুমি হচ্ছো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শ্যালক এবং উমার ইবনুল খাত্তাবের ছেলে।৩৫
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর হাফসা (লা) জনগণেল পক্ষে বিভিন্ন দাবী নিয়ে খলীফাদের সাথে, বিশেষত তাঁর পিতা দ্বিতীয় খলীফা উমারের (রা) সাথে কথা বরতেন। অনেক সময় খলীফাও ত৭ার মেয়ের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এ রকম কিচু ঘটনা সীরাতের গ্রন্থাবলীতে দেখা যায়।
‘উমার (রা) খলীফা হওয়ার পরও প্রথম খলীফা আবু বকরের (রা) সময় তঁর জন্য নির্ধারিত ভাতার উপর নির্ভর করে সংসার চালাতেন। কিন্তু তাতে তার সংসার ভালো মত চলে না দেখে উসমান আলী তালহা যুবাইর (রা) প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী একত্র হয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে খলীফা উমারের (রা) সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিনউত বিড়ারের গলায় ঘন্টা বাঁধবেন কে? বিষয়টি নিয়ে খলীফার সাথে কথা বরতে তাঁরা কেউ সাহস পেলেন না। শেষমেষ তাঁরা হাফসার দ্বারস্থ হলেন এবং তাকেই খলীফার সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলেন। হাফসা (রা) কথা বললেন, কিন্তু খলীফা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের আড়ম্বরহীনতা ও সরলতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে বিদায় দেন।৩৬
আর একবর তিনি তাঁর পিতা খলীফা উমারকে (রা) তাঁর পোশাক ও খাদ্যের মান বাড়ানোর জন্য আবেদন জানিয়ে বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা এখণ তো মুসলমানদের জীবিকায় আগের চেয়ে প্রশস্ততা দান করেছেন। উমার (রা) তাঁর মেয়েকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের কঠিন বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খুব কাঁদলেন।৩৭
একবার খলীফা উমারের (রা) নিকট কিছু অর্থ-সম্পদ এলো। হাফসা এসে বললেনঃ হে আমীলুল মুমিনীন! আল্লাহ তা‘আলা নিকট-আত্মীয়দের ব্যাপারে অসীয়াত করেছেন। এই সম্পদে আপনার নিকট আত্মীয়দের অধিকার আছে। মেয়ের কথা শুনে খলীফা বললেনঃ আমার নিট আত্মীয়দের অধিকার আমার সম্পদে। আর এই সম্পদ তো মুসলমানদের। মেয়ে, তুমি তোমার পিতাকে ধোঁকায় ফেরছো। ওঠো, এখান থেকে যাও। এরপর হাফসা চাদরের আচল টানতে চাইতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।৩৮ ইব জুরাইজ থেকে বির্ণত হয়েছে খলীফা উমার (রা) একদিন রাতের বেলা কা‘বা তাওয়াফ করা অবস্থায় এক মিলঞাকে করুণ সুরে একটি বিরহ সঙ্গীত গাইতে শুনলেন। যার দুইটি পংক্তি এই রকমঃ
আরবী হবে
-এই রাত দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়েছে, চতুর্দিক ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। একাকী আমি জেগে আছি, পাশে কোন প্রিয়জন নেই যার সাথে প্রেমালাপ করতে পারি।
-আল্লাহ-যিনি অতুলনীয়, যদি তাঁর ভয় না থাকতো হাতলে এই শয্যাধারের চারপাশ অবশ্যই কম্পিত হতো।
খলীফা উমার (রা) মহিলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কি হয়েছে? মহিলা বললোঃ কয়েক মাস যাবত আমার স্বামী আমার থেকে দূরে আছে। তাঁকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি আমার মধ্যে তীব্র হয়ে উঠেছে। তারপর উমার (রা) মেয়ে হাফসার কাছে গিয়ে বলেন, আমি তোমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে চাই, আমাকে তুমি সাহায্য কর। মেয়েরা স্বামী থেকে দূরে থাকলে কতদিন পর স্বামীকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে? হাফসা লজ্জায় মাথানত করে ফেলেন। উমার বললেনঃ আল্লাহ সত্য প্রকাশের ব্যাপারে লজ্জা করেন না। তখন হাফসা হাত দিয়ে উশারা করে তিন অথবা চার মাস বুঝিয়ে দেন। তখন উমার (রা) নির্দেশ দেন, কোন সৈনিককে যেন চার মাসের অধিক আটকে রাখা না হয়।৩৯
আল-বায়হাকী (৯/২৯) ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। একদিন আমার (রা) রাতের বেলা নগর পরিভ্রমণে বেরিয়ে এক মহিলাকে উপরোক্ত পংক্তি দুইটি গাইতে শোনেন। তারপর তিনি হাপসাকে জিজ্ঞেস করেনঃ মেয়েরা সর্বাধিক কতদিন স্বামী ছাড়া থাকতে পারে? হাফসা বলেনঃ ছয় অথবা চার মাস। উমার (রা) বলেনঃ আমি এর চেয়ে বেশিদিন কোন সৈনিককে আটকে রাখবো না।৪০
হাফসা (রা) ছিলেন উমারের (রা) কন্যা। পিতার মত তাঁর মেজাজেও ছিল কিছুটা তীক্ষ্মতা। কখনো কখনো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার পিঠে কথা বলতেন। ততে দাম্পত্য জীবনে মনোমালিন্যের উপক্রম হতো। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বুখারীসহ অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েচে। উমার (রা) একবার ইবন আববাসকে (রা) বললেনঃ জাহিলী আমলে কুরাইশ নারীরা পুরুষের অনুগত ও বাধ্য থাকতো। আমরা তাদের বিন্দুমাত্র মূল্য দিতাম না। ইসলাম তাদেরকে মর্যাদা দান করে। তাদের সম্পর্কে বহু আয়াত নাযিল হওয়ার পর আমরা তাদের স্থান ও মর্যদা অবগত হই। আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, মদীনায় নারীরা পুরুষদের বাধ্য ও অনুগত করে রেখেছে। ধীরে ধীরে আমাদের নারীরা তাদের কাছে শিক্ষা পেতে লাগলো। আমার বাড়ীটি ছিল আওয়ালীর বনু উমাইয়্যা ইবন যায়িদ পল্লীতে। আমি একদিন স্ত্রী উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলাম। সেও ছেড়ে দিল না, কথার পিঠে কথা শুনিয়ে দিল। তার এমন প্রত্যুর্ত্তর আমার মোটেই ভালো লাগলো না। তখন সে বললো, আমার এরূপ উত্তর করা আপনার পছন্দ নয়, অথচ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীরাও তাঁর কথার প্রত্যুত্তর করে থাকেন। কোন কোন স্ত্রী আজ সন্ধ্যা পর্যন্তত৭ার থেকে দূরে আছেন। অন্য একিট বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেনঃ আপনার মেয়ে হাপসা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখের উপর জবাব ছুড়ে দেয়। তাতে এমন হয় যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারাদিন বিমর্ষ থাকেন।
‘উমার (রা) বলেনঃ একথা শুনে আমি হাফসার কাছে ছুটে গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ তোমরা কি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতার প্রত্যুত্তর করে থাকে? হাফসা বললোঃ হাঁ। আমরা এমন করে থাকি। আমি প্রশ্ন করলামঃ তোমাদের কেউ কি রাত পর্যন্ত তার থেকে দূরে থাক? হাফসা বললোঃ হাঁ। বললামঃ তোমাদের মধ্যে যে এমন করে সে সফল হবে না। সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তোমাদের কেউ কি আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্রুদ্ধ হওয়ার পরেও আল্লাহর ক্রোধ থেকে নিরাপদ মনে করেছে? তোমার চেয়ে যে বেশি সুন্দরী ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অধিক প্রিয় সে যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে।৪২
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘উমার (রা) হাফসাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ সাবধান! এমন করোনা। আমি তোমাকে আল্লাহর শান্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি। তুমি তার অহমিকার ফাঁদে পড়োনা যার সৌন্দর্য রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিমোহিত করেছে। (অর্থাৎ আয়িমা রা.)৪৩ অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হাফসাকে (রা) বলেনঃ তুমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার উত্তর করবে না। তোমার না আছে যয়নাবের সৌন্দর্য ও আয়িশার সৌভাগ্য।৪৪ তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। একদিন উম্মুল মু‘মিনীন হযরত সাফিয়্যা বসে বসে কাঁদছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এসেতাঁকে কাঁদতে দেখে এভাবে কান্নার কারণ জানাতে চাইলেন। সাফিয়্যা বললেনঃ হাফসা আমাকে ইহুদীর মেয়ে’ বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তুমি আল্লাহকে ভয় কর।’ তারপর সাফিয়্যাকে বললেনঃ তুমি তো একজন নবীর মেয়ে, তোমার চাচাও একজন নবী। তারপর একজন নবীর স্ত্রী। কোন ব্যাপারে হাফসা তোমার উপর গর্ব করতে পারে?৪৫ আর একবার হাফসা ও আয়িশা (রা) সাফিয়্যাকে বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আমরা দউজিন তোমার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আমরা ত৭ার স্ত্রী, তদুপরি তাঁর চাচাতো বোন। কথাগুলো হযরত সাফিয়্যাকে ভীষণ আহত করে। তিনিতাঁদের বললেনঃ তুমি তাদেরকে কেন একথা বললে না যে, তোমরা আমার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী হতে পার না। কারণ, আমার স্বামী মুহাম্মাদ, আমাকে পিতা হারূন এবং চাচা মূসা।৪৬
‘আয়িশা ও হাফসা (রা) পরস্পর সতীন হলেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল বোনের মত। অধিকাংশ ব্যাপারে তাঁরা একে অপরের সহযোগী ছিলেন। ‘আয়িশা (রা) হাফসা সম্পর্কে বলেছেনঃ হাফসা বাপের বেটি। তাঁর বাপ যেমন প্রতিটি কথা ও কাজে দৃঢ়সংকল্প, হাফসাও তেমন।৪৭ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র হাফসাই আমার সমকক্ষতার দাবীদার ছিলেন।৪৮ আমরা দুইজন ছিলাম যেন একটি হাত।৪৯
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তিম রোগ শয্যায়। জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে দাঁড়িয়েছেন। নামাযের সময় হলো। তিনি বররেনঃ আবু বকরকে লোকদের নামায পড়াতে বল। আয়িশা বললেনঃ আবু বকর একজন কোমল মনের মানুষ। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থানে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ করতে গেলে কান্নায় তাঁর বাকরুদ্ধহয়ে যাবে, লোকেরা কিছুই শুনতে পাবে না-একথাগুলি তিনি হাফসাকে বললেন এবং তাঁর স্থলে আমারকে নির্দেশ দানেরজন্য রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে তাঁকে অনুরোধ করলেন। আয়িশার (রা) কথামত হাফসা (রা) রাসূরুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেই তিনি মন্তব্য করলেনঃ ‘তোমরা সবাই ইউসুফের সঙ্গী-সাথীদের মত।৫০
‘আয়িশা ও হাফসা, দুইজনের মনের এমন চমৎকার মিল এবং উভয়ের মধ্রে এত ভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে মাঝে মাঝে নারীর স্বাভাবিক প্ররণত মাথাচাড়া দিত। স্বামীসঙ্গ ও সোহাগ প্রাপ্তির ব্যাপারে তাঁরা ঈর্ষার শিকার হতেন। একবার একসফরে তাঁরা দুইজন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গী ছিলেন। রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার উটের উপর সওয়ার হয়ে তাঁর সাথে কথা বরতে বলতে পথ চরতেন। একদিন হাফসা আয়িশাকে বললেন, আজ রাতে তুমি যদি আমার উটের উপর, আর আমি তোমার উটের উপর সওয়ার হই তাহলোন্য একটা দৃশ্য দেখা যাবে। ‘আয়িশা (রা) রাজি হয়ে গলেনে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার সাথে তাঁর বাহনে পথ চললেন। মনযিলে পৌঁছে আয়িশা যখন রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেলেন না তখন নিজের চরণ দুইখানি ইযখীর ঘাসের মধ্যে ঝুরিয়ে বরতে রাগলেনঃ হে আল্লাহ! কোন সাপ অথবা বিচ্ছু যদি আমাকে দংশন করতো।৫১
‘আয়িশা ও হাফসা ছিলেন যথাক্রমে আবু বকর (রা) ও উমারের (রা) কন্যা। এই দুই মাহন ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি কাছের মানুষ। এ কারণে, ‘আয়িশা ও হাফসা দুইজন ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনে অন্যান্য আযওয়াজে মুতাহহারাতের বিপরীতে একজোট। তাঁদের এই জোটবদ্ধতা নবীপাকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনার পশ্চাতে কাজ করেছে।
আমাদের একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের সকল ছোট-বড় ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবনের মত নিছক কোন ঘটনা নয়। প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষাণীয় বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা এসব ঘটনার মাধ্যমে মানব জাতিকে বিভিন্ন বিধি-বিধান ও আচরণের বাস্তব শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তা না হলে ত৭ার নবীর জীবনে এসব ঘটনা না ঘটালেও পারতেন। আমাদের প্রিয় নবীজীর জীবনের প্রতিটি ঘটনা এভাবেই দেখতে হবে।
হিজরী ৯ম সনে সূরা আত-তাহরীম অবতীর্ণ হয়। এই অবতরনের পশ্চাতে রয়েছে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনের একটি ঘটনা। মিষ্টি ও মধু ছির রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি প্রিয় খাবার।তিনিসাধারণত আসরের নামাযের পর সকল সহধমির্ণীদের ঘরে গিয়ে দেখা করতেন। একদিন যয়নাবের (রা) নিকট সআবভাবিক সময়ের চেয়ে একটু দেরী হেয় যায়। এতে আয়িশার মনক্ষুণ্ণ হন। তিনি অবগত হন যে, কোন এক মহিলা যয়াবকে কিছু মধু উপকৌকনস্বরূপ পাটিয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মধু যয়নাবের নিকট পান করেছেন। আর সেই কারণে তাঁর ঘরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) অবস্থান দীর্ঘ হয়েছে। আয়িশা ও হাফসা জোটবদ্ধ হন। আয়িশা হাফসাকে বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আমার অথবা তোমার ঘরে আসবেন তখন আমরা তাকে বললো, আপনার মুখ থেকে মাগাফীর-এর দুর্গন্ধ আসছে। (মাগাফীর, মাগফুর-এর বহুবচন। একপ্রকার উদ্ভিদের ফুল যা থেকে মৌমাছি মধু আহরণকরে) আয়িশা একই কথা সাফিয়্যাকেও শিখিয়ে দিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁদের ঘরে আসলেন তখন তাঁরা পূর্ব সিদ্ধান্তমত একই কথা বললেন। রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট দুর্গন্ধ ছিল খুবই অপ্রয়। এরপর তিনি যখন আবার যয়নাবের নিকট যান তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, প্রয়োজন নেই। তারপর তিনি নিজের জন্য মধু পান হারাম করে নেন। রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে আয়িশা আফসোসের সুরে হাফসাকে বলেনঃ আমরা একটি মারাত্মক কাজ করে ফেলেছি। রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর একটি প্রিয় বন্তু থেকে বঞ্চিত করে ফেলেছি। এ ঘটনারই প্রেক্ষিতে নাযির হয় সূরা আত-তাহরীমের নিম্নোক্ত আয়াতঃ৫২
-হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করেছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্য তা নিজের জন্য হারাম করেছেন কেন? (আত-তাহরীম-১)
রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু পরিবেশনকারিনী হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন জনের নাম এসেছে। কোন কোন বর্ণনায় হাফসার নামটি এসেছে। সে ক্ষেত্রে আয়িশা সাওদা ও সাফিয়্যার সাথে দল বাঁধেন। ইবন সাদের একটি বর্ণনায় তেমনি বুঝা যায়।৫৩ কোন কোন বর্ণনায় উম্মু সালামার নামও এসেছে।৫৪
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের খুশী করার জন্য মধু পান না করার যে সিদ্ধান্ত নেন তা তিনি সংশ্লিষ্ট গোপন রাখতে বলেন। যাতে মধু পরিবেশনকারিনী মনে কষ্ট না পান। অধিকাংশ বর্ণনা মতে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার (রা) কাছে এই গোপন কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু হাফসা কথাটি গোপন রাখতে পারলেন না। তিনিতা আয়িশার কাছে প্রকাশ করে দেন। একথাই আল্লাহ সূরা আত-তাহরীমের তৃতীয় আয়াতে বলেছেন এভাবেঃ যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রী কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল আর আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিসয়ে স্ত্রীকে কিচু বললেন না এবং কিছু বললেন। নবী যখন তা স্ত্রী বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করলো? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন।
সূরা আত-তাহরীম মাযিলের কারণ সম্পর্কে আল-ওয়াকিদীসহ আরো অনেক সীরাত বিশেষজ্ঞ ভিন্ন ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। একদিন হাফসা (রা) ঘরে ছিলেন না। এ সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে আসেন এবং দাসী মারিয়া কিবতিয়্যাকে ডেকে সঙ্গ দেন। এর মধ্যে হাফসা ফিরে আসেন এবং অসন্তুষ্টির জন্য উক্ত দাসীর সাহচর্যকে নিজের জন্য হারাম করে নেন। আর একথা তিনি হাফসাকে গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তিনি তা গোপন রাখতে পারলেন না। আয়িশার কাছে প্রকাশ করে দেন। তখন সূরা আত-তাহরীম নাযিল হয়। নাফে বলেছেনঃ একথা কি ঠিক নয় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জন্য তার দাসীকে হারাম করেছিলেন, তারপর আল্লাহ তা‘আলা কসম ভঙ্গ করে কাফফারা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন?৫৫
যে দুইজন নাবী এসব ঘটনা সৃষ্টি করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলেন, তাঁদেই সম্পর্কে আল্লাহ নাযিল করেন আত-তাহরীমের চতুর্থ আয়তটি। -‘তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তাওবা কর, তবে ভালো কথা। আর যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ, জিবরীল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মু‘মিনগণ তাঁর সহায়।৫৬ এই দুই নারী হলেন আয়িশা (রা) ও হাফসা (রা)। এই দুইজন নারী কে, সে সম্পর্কে সহীহ বুখ্যারীতে ইবন আববাস (রা) এর একটি দীর্ঘ বর্ণনা আছে এতে তিনি বলেনঃ যে দুইজন নারী সম্পর্কে কুরআনে যদি তোমরা উভয়ে তাওবা কর’-বলা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে উমারকে (রা) প্রশ্ন করার ইচ্ছা বেশ কিছুকাল আমার মনে ছিল। অবশেষে একবার তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে সুযোগ বুঝে আমিও সফরসঙ্গী হয়ে গেলাম। পথিমধ্যে একদিন যখন তিনি অজু করেছিলেন এবং আমি পানি ঢেলে দিচ্ছিলাম, তখন প্রশ্ন কররামঃ কুরাআনের যে দুইজন নারী সম্পর্কে যদি তোমরা তাওবা কর’-বলা হয়েছে তাঁরা কে? উমার বললেণঃ আশ্চার্যের বিষয়, আপনি জানেন না, এঁরা দুইজন হলেন হাফসা ও আয়িশা (রা)।৫৭
নবী পরিবারের মধ্যে এই তুচ্ছ কলহ কোন সাধারণ ব্যাপার ছিল না। মুনাফিকরা সব সময় ধান্দায় থাকতো খোদ নবী পরিবার ও তাঁর বিশেষ আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে যে কোন ধরনের ফাটল ধরানোর। তারা আযওয়াজে মুতাহহারাতের এই মামুলি বিরোধের কথা জানতে পেরে হয়তো আরো একটু উস্কে দিতে চেয়েছিল। ভেবেছির আয়িশঅ ও হাফসার পিতা আবু বকর ও উমারকে (রা) এবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু তারা জানতো না, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পদতলে তাঁরা কন্যা কেন, নিজেরেদ জীবনও বিলিয়ে দিতে প্রস্ত্তত। তাই উমার (রা) হাফসার সাথে দেখা করার অনুমতি না পেয়ে চিৎকার করে বলে ওঠেনঃ অনুমতি পেলে হাপসার মাথা কেটে নিয়ে আসি।৫৮ সূরা আত-তাহরীমের ৪র্থ আয়াতে এদককেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আয়িশা ও হাফসা যদি ষড়যন্ত্র করে, আর মুনাফিকরা তা কাজে লাগায় তাহলেও আল্লাহ তাঁর নবীকে সাহায্য করবেন। আর আল্লাহর সাথে আছেন জিবরীল, ফিরিশতামন্ডলী ও সমস্ত বিশ্বের মু’মিন নর-নারী।৫৯
বর্ণিত হয়েছে উপরোক্ত ঘটনার পর রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে (রা) তালাক দেন। তারপর আবার ফিরিয়ে নেন। একথা আসেম ইবন উমার বলেছেন।৬০ তালাক দেওয়ার পর জিবরীল (আ) এসে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ হাফসা খুব বেশি রোযা পালনকারিণী এবং রাতে বেশি বেশি নামায আদায়কারিণী। জান্নাতে তিনি আপনার স্ত্রী হবেন। জিবরীলের এ কথায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার তাঁকে ফিরিয়ে নেন।৬১
ইবন সা‘দ কায়স ইবন ইয়াযীদ এবং ইবন সীরীনের একটি বর্ণনা নকল করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে (রা) এক তালাক দেন। তারপর হাফসার দুই মামা-কুদামা ও উসমান ইবন মাজ‘উন হাফসার সাথে দেখা করেন। হাফসা কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের বলেনঃ আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে কোন মন্দ কাজের জন্য তালাক দেননি। এমন সময় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত হলেন। তিনি বললেনঃ জিবরীল আমাকে বলেছেন, আপনি হাফসাকে ফিরিয়ে নিন। কারণ, তিনি খুব বেশি রোযা পালন করেন এবং বেশি নামায আদায় করেন। জান্নাতে তিনি আপনার স্ত্রী হবেন।’’৬২
‘‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতে লাগলেন। লোকমুখে প্রচার হলো, তিনি তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এটা হিজাবের হুকুমের আগের ঘটনা। আমি আয়িশার কাছে গিয়ে বললামঃ আবু বকরের মেয়ে! তুমি রাসূলুল্লাহকে কষ্ট দিয়ে থাক-লোকেরা সে একথা বলাবলি করছে, তাকি তুমি শুনেছো? ‘আয়িশা বললেনঃ ওহে খাত্তাবের পুত্র, আমার সাথে আপনার সম্পর্ক কি? আপনি অন্যত্র যেতে পারেন।
এরপর আমি হাফসার কাছে গিয়ে বললামঃ আল্লাহর কসম, আমি জেনেছি তিনি তোমাকে ভালোবাসেন না। আমি না থাকলে তিনি অবশ্যই তোমাকে তালাক দিতেন। একথা শুনে হাফসা খুব কাঁদলেন। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেথায়? বললোঃ পাশেই একটি ঘরে আছেন। আমি সেখানে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসা দেখতে পেলাম। দরজায় দাঁড়ানো তাঁর চাদর রাবাহ। তার মাধ্যমে আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলাম। তিনি বারের মাথায় অনুমতি পেলাম। আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললামঃ আপনার অনুমতি পেলে আমি হাফসার কল্লা কেটে ফেলবো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে নরম হওয়ার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করলেন। আমি শাস্ত হয়ে প্রশ্ন করলামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কিতাদেরকে তালাক দিয়েছেন? বললেনঃ না। তখন আমি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলামঃ রাসূলুলত্মাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেননি। তখণ নাযিল হয় সূরা আন-সিরার ৮৩ তম আয়াতটি।৬৩ বিভিন্ন সূত্রে ঘটনাটি ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
নবী পরিবারের মনোমালিন্য ও তালাক সম্পর্কিত বর্ণনাগুলির মাধ্যমে হাফসার (রা) অনেকগুরি বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা এবং শরীয়াতের কিছু বিধান আমাকে কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমনঃ
তালাক দান একটি বৈধ কাজ। যদি সে তালাক হয় কোন প্রয়োজন বা কল্যাণের নিম্মিত্তে, তবে তা কামালিয়াত বা পূর্ণতার পরিপন্থী নয়।৬৪
খোদ আল্লাহপাক হাফসার বেশি রোযা রাখা ও বেশি নামায পড়ার সনদ দিয়ে তাঁর প্রশংসা করেছেন।
জান্নাতেও তিনি নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন।
তাকে খুশী করার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুইটি হালাল বস্ত্তকে নিজের জন্য হারাম করে নেন।
আয়িশার (রা) বক্তব্যে জানা গেছে, তিনি ছিলেন তাঁর পিতার মত।’
6. দাম্পত্য জীবনে ছোট-খাট মনোমালিন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শ আমাদের জন্য অনুসরণীয।
হাফসার (রা) মধ্যে প্রবল দাজ্জাল-ভীতি ছিল। মদীনায় ইবন সাইয়্যাদ নামে এক ব্যক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাজ্জালের যতগুলো চিহ্ন বা আলামত বর্ণনা করেছিলেন, ললোকটির মধ্যে তার অনেকগুলি ছিল। এমনকি তার সম্পর্কে খোদ রাসূলুল্লাহরও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সনেদহ ছিল। একদিন হাফসা ও আবদুল্লাহ ইবন উমারের (রা) সাথে পথে সেই লোকটির দেখা হযে গেল। ইবন উমার তাঁকে কিছু বলতেই সে রেগে এত ফুলে উঠে যে পথই বন্ধ হয়ে গেল। ইবন উমার তাঁকে মারতে উদ্যত হন। হাফসা ভীত হয়ে পড়েন। তিনি ইবন উমারকে বলেন, তার সাথে তোমার সম্পর্কে কি? তুমি কি জাননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দাজ্জালের ক্রোধই তার বের হবার কারণ হবে?৬৫
উম্মুল মু’মিনীন হাফসার (রা) সম্মান ও মর্যাদা ছোট একটি প্রবন্ধে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এ পৃথিবীতে তিনি সীরাতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে যেমন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি আখিরাতের জীবনেও একাত্ম থাকবেন বলে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন।
সূত্রঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – পঞ্চম খন্ড
হাফসা বিতন ‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)
=======================
উম্মুল মু’মিনীন হাফসা (রা) দ্বিতীয় খলীফা ‘উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) কন্যা। মা খুযা‘আ গোত্রের মেয়ে যয়নাব বিনত মাজ‘উন প্রখ্যাত সাহাবী ‘উসমান ইবন মাজ‘উনের আপন বোন। তিনি নিজেও একজন সাহাবী। আবদুল্লাহ ইবন উমার ও হাফসা (রা) আপন ভাই-বোন।১ হাফসা আবদুলত্মাহর চেয়ে ছয় বছরের বড়।২ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর পূর্বে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। উমার (রা) বলেনঃ মক্কার কুরাইশরা তখন কা‘বা ঘরের পুনঃনির্মাণের কাজে ব্যস্ত।৩
বিয়ের বয়স হলে পিতা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বনু সাহম গোত্রের সন্তান খুনাইস ইবন হুজাফার সাথেতাঁর প্রথম বিয়ে দেন। এই খুনাইস মক্কায় প্রথম পর্বে ইসলাম গ্রহণকারীদেরান্যতম। হাবশায় হিজরাতকারী দ্বিতীয় দলটির সাথে হাবশায় হিজরাত করেন।৪ অবশ্য মূসা ইবন উকরবা ও আবু মা‘শার তাঁর হাবশায় হিজরাতের কথা উলে্খ করেননি।৫ সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে আবার মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় পৌঁছে কুবার বনু আমর ইবন আওফ গোত্রের রিফা‘য়া ইবন আবদিল মুনজিরের গৃহে আশ্রয় নেন।৬
হাফসার (রা) ইসলাম গ্রহণের সময়কাল সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিচু জানা যায় না। তবে এতটুকু নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে, ‘উমার ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেত৭ার নিজ গোত্র ও খান্দানের লোকেরা ইসলাম গ্রহণ করেন। সম্ভবতঃ হাফসাও সেই সময় পরিবারের লোকরেদ সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন।৭
স্বামীর সাথে তিনি মদীনায় হিজরাত করেন। মদীনায় আসার অর্পকাল পরেই বধবা হন। তখন তাঁর বয়স বিশ বছরও হয়নি।৮ খুনাইসের মৃত্যুর সময়কার নিয়ে কিঞ্চিত মতভেদ আছে। অধিকাংশ সীরাত বিশেষঝে্হর মতে তিনি বদর ও ইহুদ যুদ্ধে যোগদান করেন। উহুদে তাঁর দেহেরে একাধিক স্থানে জখম হয় এবং মদীনায় ফিরে এসে তাতেই মারা যান।৯ ভিন্ন মতে তিনিবদরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে ছিলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা জখম হন এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বদর থেকে মদীনায় ফেরার পর হিজরী দ্বিতীয় সনে তিনি মারা যান।১০
মেয়ে বিধবা হওয়ার পর পিতা উমার (রা) তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবতে লাগলেন। ঘটনাক্রমে সেই সময় রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মেয়ে ও হযরত উসমানের (রা) স্ত্রী রুকাইয়্যা (রা) ইনতিকাল করেন! উমার (রা) সর্বপ্রথম উসমানের সাথে দেখা করে তাঁর সাথে হাফসার বিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। উসমান বিষয়টি ভেবে দেখবো বলে সময় নেন। কয়েক দিন পর, ‘আমি এ সময় বিয়ে করতে চাচ্ছি না’-বলে জবাব দেন। তারপর উমার (রা) গেলেন আবু বকরের (রা) কাছে। বললেনঃ আপনার সাথে আমি হাফসাকে বিয়ে দিতে চাই। আবু বকর (রা) চুপ থাকলেন, কোন জবাব দিলেন না। উসমানের (রা) জবাবে উমার (রা) যতখানি আহত হন তার চেয়ে বেশি হন আবু বকরের (রা) আচরণে। উমার (রা) রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খিদমতে হাজির হয়ে মনের দুঃখ প্রকাশ করেন।১১ ইবনুল আসীর বলেন, ওমার (রা) প্রথমে আবু বকরকে (রা) প্রস্তাব করেন, কিন্তু তিনি কোন উত্তর না দেওয়ায় উসমানকে (রা) প্রস্তাব করেন।১২
‘আয়িশার (রা) সাথে বিয়ের মাধ্যমে আবু বকরের (রা) সাথে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। কিন্তু উমারের (রা) সাথে কোন আত্মীয়তা ছিলনা। হাফসার (রা) সাথে বিয়ের মাধ্যমে এমন সম্পর্ক সৃষি।ট হওয়া আল্লাহর মর্জি চিল। উমারের (রা) দুঃখের কথা শুনে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ হাফসাকে বিয়ে করবে উসমানের চেয়েও ভালো এক ব্যক্তি এবং উসমান বিয়ে করবে হাফসার চেয়েও ভালো এক মহিলাকে।১৩ অন্য একটি বর্ণনায় এসেচে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন আমি কি তোমাকে উসমানের চেয়ে ভালো জামাই এবং উসমানকে তোমার চেয়ে ভালো শ্বশুরের সন্দান দেব না? উমার বলেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই দেবেন। তখন রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ তোমার মেয়ে হাফসাকে আমার সাথেবিয়ে দাও, আর আমার মেয়ে উম্মু কুলসুমকে বিয়ে দিই উসমানের সাথে।১৪ এভাবে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে যায়। হাফসার পিতা উমার নিজেই ওলি হয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে চার শো দিরহাম দেন মোহর দান করেন।১৫
উমারের (রা) প্রস্তাবে উসমান ও আবু বকরের (রা) সাড়া না দেওয়ার কারণ হলো, তাঁর রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার কথা আলোচনা করতে শুনেছিলেন। তারা বুঝেছিলেন, তিনি উমারের (রা) সম্মানার্থে হাফসাকে বিয়ে করতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁরা এ কথাটি উমারকে বলতে সাহস করেননি এই ভয়ে যে, তাঁদের বুঝার ভুলও হতে পারে।১৬ এ কারণে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হাফসার বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবার পর আবু বকর (রা) একদিন উমারের (রা) সাথে দেখা করে বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন হাফসার কথা বলেছিলেন, আমি তাঁর গোপন কথা প্রকাশ করতে চাইনি। এছাড়া আপনার প্রস্তাবের জবাব না দেওয়ার আর কোন কারণ ছিল না।১৭
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হাফসার বিয়ে কখন হয় সে বিষয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতভেদ আছে। এ মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে মূলতঃ তাঁর স্বামীর মৃত্যুর সময় নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে। ইবনুল আসীর বলেন, অধিকাংশ আলেমের মতে হিজরী তৃতীয় সনে এ বিয়ে হয়।১৮ আবু উবাসয়দার মতে, এ বিয়ে হন হিজরী দ্বিতীয় সনে। আর এটাই ইবন আবদিল বার-এর মত। ইবন হাজার আল-ইসাবা গ্রন্থেতৃতীয় সনের মতটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, তাঁর প্রথম স্বামী উহুদে শাহাদাত বরণ করেন। অনেকে বলেন, হিজরাতের ২৫ মতান্তরে ৩০ মাস পরে এ বিয়ে হন। কোন কোন বর্ণনায় ২০ মাস পরের কথাও এসেছে! অথচ উহুদ যুদ্ধ হয় হিজরাতের ৩০ মাসেরও পরে। ইবন সাদ জোর দিয়ে বলেন, তাঁর প্রথম স্বামী বদর থেকে ফেরার পর মারা যান। ইবন সায়্যিদিন নাস বলেন, হিজরাতের ৩০ মাসের মাথায় মা‘বান মাসে এ বিয়ে হয়।২০
হাফসার (রা) মৃত্যুসন নিয়ে সীরাত বিশেষজ্ঞদের একটু মতপার্থক্য আছে। সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে, তিনি ৪৫ হিজরীর শা‘বান মাসে মদীনায় ইনতিকাল করেন। আমীর মু‘য়াবয়িার ৯রা) খিলাফতকাল এবং মদীনার গভর্ণর তখন মারওয়ান। তিনি জানাযার নামায পড়ান, লাশের সাথে বাকী গোরস্থান পর্যন্ত যান এবং দাফন কার্য শেষ হওয়া পযৃন্ত বসে থাকেন। আলে হাযামের বাড়ী থেকে মুগীরার বাড়ী পর্যন্ত লাশবাহী খাটিয়ায় তিনি কাঁধ দেন এবং সেখানে ত৭ার স্থালে আবু হুরাইরা (রা) কাঁধ দিয়ে কবর পর্যন্ত নিয়ে যান। হাফসার (রা) ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) এবং তাঁর ছেলেরা-‘আসিম,সালিম, আবদুল্লাহ ও সামযা লাশ কবরে নামান। এভাবে তিনি বাকী গোরস্থানে সমাহিত হন। উল্লেখিত মতটি মা‘মার, যুহরী ও সালিমের সূত্রে আল-ওয়াকিদী বর্ণনা করেছেন।২১ তবে ইবনুল আসীরে ঝোঁক এই দিকে যে, যে সময় হাসান ইবন আলী (রা) আমীর মুয়াবিয়ার (রা) হাতে বাইয়াত করেন সেই সময় হাফসার ওফাত হয়। আর সেটা ৪১ হিজরীর জামাদিউল আওয়াল মাস। আর এই সনকে আমুল জামা‘য়াহ বলা হয়।
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হিজরী ২৭ সনে উসম্যানের (রা) খিলাফতকালে মারা যান। এ মতটির ভিত্তি হলো, ওয়াহাব ইবন মালিক বলেছেন, যে বছর আপ্রিকা বিজয় হয়, সেই বছর তিনি মারা যান। আর আফ্রিকা বিজয় হয় হিজরী ২৭ সনে। কিন্তু এ এক মারাত্মক ভুল। কারণ আফ্রিকা বিঝয় হয় দুইবার। প্রথম বিজয় হয় হিজরী ২৭ সনে, আর দ্বিতীয় বিজয় হয় মু‘য়াবিয়ার (রা) খিলাফতকালে। এ বিজয়ের গৌরবের অধিকারী ছিলেন মু‘য়াবিয়া ইবন খাদিজা (রা)।২২ মৃত্যুকালে হাফসার (রা) বয়স হয়েছিল ৬৩ অথবা ৫৯ বছর।
মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমারকে (রা) একই উপদেশ দান করেন যা তাঁর পিতা উমার (রা) তাঁকে মৃত্যুর সময় দান করেছিলেন। পিতা তাঁকে গাবা‘তে যে ভূ-সম্পত্তি দিয়ে যান তিনি আল্লাহর রাসআতয় ওয়াকফ করে দেণ।২৩ হাফসা (রা) কোন সন্তান রেখে যাননি।২৪
হাফসার (রা) সন্তানাদি না থাকলেও তিনি অনেক স্নেহভাজন নারী ও পুরুষ রেখে যান যারা তাঁর নিকট হাদীস মুনেছিলেন এবং তা বর্ণনাও করে গেছেন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন উমার, হামযা ইবন আবদিল্লাহ, সাফিয়্যা বিনত আবী উবায়দা (আবদুল্লাহর স্ত্রী), মত্তালিব ইবন আবী ওয়াদায়া, উম্মু মুবাশশির আল আনসারিয়্যা, আবদুর রহমান ইবন হারেস ইবন হিশাম, আবদুল্লাহ ইবন সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা, শুতাইর ইবন শাকাল, সাওয়া আল-খুযাঈ, আল-মুসায়্যিব ইবন রাফে, আল-মাজলায ও আরো অনেকে।২৫
হাফসা (রা) থেকে মোট ৬০টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এগুলি তিনি খোদ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও পিতা উমার (রা) থেকে শুনেছিলেন।২৬ তার বর্ণিত চারটি হাদীস মুত্তাফাক ‘আলইহি এবং চয়টি হাদীস বুখারী হাদীস বুখারী এককভাবে বর্ণনা করেছেন।২৭
হযরত হাফসার (লা) তৎকালীন আরবের অন্য সকল নারী-পুরুষের মতই কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছির না। তবে পিতা উমার (রা) ও স্বামী রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চেয়ে বড় শিক্ষক আর কে হতে পারতেন? তাঁদের প্রতিপালক ও তত্ত্ববধানে তাঁর মধ্যে জ্ঞানার্জন ও দীনকে বুঝার প্রবল আগ্রহ জন্ম নেয়। দীনী বিষয়ে তাঁর যে গভীর জ্ঞান ছিল, বিভিন্ন ঘটনায় তা জানা যায়। একবার রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ আমি আশা করি বদর ও হুদাইবিয়ায় অংশগ্রণকারীগণ জাহান্নামে যাবে না।’ হযরত হাফসা (রা) বলে উঠলেন, আল্লাহ তো বলেছেনঃ
আরবী হবে
তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে সেখানে (জাহান্নামে) পৌঁছবে না।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ হ্যাঁ, তা ঠিক, তবে একথাও তো আল্লাহ বলেছেনঃ
আরবী হবে
‘‘অতঃপর আমি খোদাভীরু লোকদের উদ্ধার করবো এবং জালেমদেরকে সেখানে নতজানু অবস্থায় ছেড়ে দেব।’’ (সূরা মারইয়াম-৭১-৭২)২৮
হাফসার (রা) মধ্যে শেখা ও জানার প্রবল আগ্রহ লক্ষ্য করে রাসূলে কারীমও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সবসময় তাঁকে বিভিন্ন বষিয়ে শেখানোর চিন্তা করতেন। হযরত শিফা বিনত আবদিল্লাহ ছিলেন একজন মহিলা সাহাবী। তিনি রিখতে ও পড়তে জানতেন। হযরত হাফসা তাঁর নিকট লেখা শেখেন। এই শিক্ষা নামলা’২৯ নামক এক প্রকার ক্ষত-রোল নিরাময়ের ঝাঁক-ফুঁক করতেন। একদিন তিনি রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট এসে বললেনঃ আমি জাহিলী জীবনে ঝাঁড়-ফুঁক করতালম। আপনিআনুমতি দিলে তা আমি আপনাকে শুনাই। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শুনে বললেন, এই ঝাঁড়-ফুঁকটি তুমি হাফসাকেও শিখিয়ে দাও। অন্য একটি বর্ণায় এসেছে রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিফাকে বলেন, তুমি কি হাফসাকে এই নামলা’র দু‘আটি শিখিয়ে দেবে না যেমন তাকে লেখা শিখিয়েছো?৩০ রাসূলে পাপর্কের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবদ্দশায় এবং পরবর্তী জীবনে হাফসা (রা) প্রচুর ইবাদাত-বন্দেগী করতেন। সব সময় রোযা রাখতেন এবং অতিমাত্রায় রাত জেগে নামায আদায় করতেন। জিবরীল (আ) তাঁর সম্পর্কে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তিনি অতিমাত্রায় সিয়াম পালনকারিণী এবং রাতের বেলাতে খুব বেশি ইবাদাতকারিণী।৩১ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, জিবরীর (আ) বলেনঃ তিনি একজন সৎকর্মশীলা নারী।৩২ তাঁর সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, রোযা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন।৩৩
তিনি সব রকমের মতবিরোধকে অপছন্দ করতেন। সিফফীন যুদ্ধের পর যখন দুমাতুল জান্দালে শালিশ-ফয়সালার বিষয়টি এরো তখন তাঁর ভাই আবদুল্লাহ ইবন উমার (রা) তা একটি ফিতনা ফাসাদ মনে করে ঘর থেকে বের হতে চাইলেন না। কিন্তু হাফসা তাঁকে বললেন, এতে অংশগ্রহণে তোমার কোন লাভ নেই, তবে তোমার অংশগ্রহণ করা উচিত। কারণ, মানুষ তোমার মতামতের অপেক্ষায় থাকবে। এমনও হতে পারে, তোমার এই দূরে থাকা তাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে পারে।৩৪ অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেনঃ উম্মাতে মুহাম্মদীর ম¨্যধ আপোষ-মীমাংষা হতে পারে এমন কোন বিয়ষ থেকে দূরে থাকা সমীচীন নয়। তুমি হচ্ছো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শ্যালক এবং উমার ইবনুল খাত্তাবের ছেলে।৩৫
রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইনতিকালের পর হাফসা (লা) জনগণেল পক্ষে বিভিন্ন দাবী নিয়ে খলীফাদের সাথে, বিশেষত তাঁর পিতা দ্বিতীয় খলীফা উমারের (রা) সাথে কথা বরতেন। অনেক সময় খলীফাও ত৭ার মেয়ের পরামর্শ গ্রহণ করতেন। এ রকম কিচু ঘটনা সীরাতের গ্রন্থাবলীতে দেখা যায়।
‘উমার (রা) খলীফা হওয়ার পরও প্রথম খলীফা আবু বকরের (রা) সময় তঁর জন্য নির্ধারিত ভাতার উপর নির্ভর করে সংসার চালাতেন। কিন্তু তাতে তার সংসার ভালো মত চলে না দেখে উসমান আলী তালহা যুবাইর (রা) প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবী একত্র হয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন। তাঁরা বিষয়টি নিয়ে খলীফা উমারের (রা) সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিনউত বিড়ারের গলায় ঘন্টা বাঁধবেন কে? বিষয়টি নিয়ে খলীফার সাথে কথা বরতে তাঁরা কেউ সাহস পেলেন না। শেষমেষ তাঁরা হাফসার দ্বারস্থ হলেন এবং তাকেই খলীফার সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলেন। হাফসা (রা) কথা বললেন, কিন্তু খলীফা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের আড়ম্বরহীনতা ও সরলতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁকে বিদায় দেন।৩৬
আর একবর তিনি তাঁর পিতা খলীফা উমারকে (রা) তাঁর পোশাক ও খাদ্যের মান বাড়ানোর জন্য আবেদন জানিয়ে বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা এখণ তো মুসলমানদের জীবিকায় আগের চেয়ে প্রশস্ততা দান করেছেন। উমার (রা) তাঁর মেয়েকে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের কঠিন বাস্তবতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে খুব কাঁদলেন।৩৭
একবার খলীফা উমারের (রা) নিকট কিছু অর্থ-সম্পদ এলো। হাফসা এসে বললেনঃ হে আমীলুল মুমিনীন! আল্লাহ তা‘আলা নিকট-আত্মীয়দের ব্যাপারে অসীয়াত করেছেন। এই সম্পদে আপনার নিকট আত্মীয়দের অধিকার আছে। মেয়ের কথা শুনে খলীফা বললেনঃ আমার নিট আত্মীয়দের অধিকার আমার সম্পদে। আর এই সম্পদ তো মুসলমানদের। মেয়ে, তুমি তোমার পিতাকে ধোঁকায় ফেরছো। ওঠো, এখান থেকে যাও। এরপর হাফসা চাদরের আচল টানতে চাইতে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।৩৮ ইব জুরাইজ থেকে বির্ণত হয়েছে খলীফা উমার (রা) একদিন রাতের বেলা কা‘বা তাওয়াফ করা অবস্থায় এক মিলঞাকে করুণ সুরে একটি বিরহ সঙ্গীত গাইতে শুনলেন। যার দুইটি পংক্তি এই রকমঃ
আরবী হবে
-এই রাত দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়েছে, চতুর্দিক ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। একাকী আমি জেগে আছি, পাশে কোন প্রিয়জন নেই যার সাথে প্রেমালাপ করতে পারি।
-আল্লাহ-যিনি অতুলনীয়, যদি তাঁর ভয় না থাকতো হাতলে এই শয্যাধারের চারপাশ অবশ্যই কম্পিত হতো।
খলীফা উমার (রা) মহিলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কি হয়েছে? মহিলা বললোঃ কয়েক মাস যাবত আমার স্বামী আমার থেকে দূরে আছে। তাঁকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি আমার মধ্যে তীব্র হয়ে উঠেছে। তারপর উমার (রা) মেয়ে হাফসার কাছে গিয়ে বলেন, আমি তোমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে চাই, আমাকে তুমি সাহায্য কর। মেয়েরা স্বামী থেকে দূরে থাকলে কতদিন পর স্বামীকে কাছে পাওয়ার অনুভূতি তীব্র হয়ে ওঠে? হাফসা লজ্জায় মাথানত করে ফেলেন। উমার বললেনঃ আল্লাহ সত্য প্রকাশের ব্যাপারে লজ্জা করেন না। তখন হাফসা হাত দিয়ে উশারা করে তিন অথবা চার মাস বুঝিয়ে দেন। তখন উমার (রা) নির্দেশ দেন, কোন সৈনিককে যেন চার মাসের অধিক আটকে রাখা না হয়।৩৯
আল-বায়হাকী (৯/২৯) ইবন উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। একদিন আমার (রা) রাতের বেলা নগর পরিভ্রমণে বেরিয়ে এক মহিলাকে উপরোক্ত পংক্তি দুইটি গাইতে শোনেন। তারপর তিনি হাপসাকে জিজ্ঞেস করেনঃ মেয়েরা সর্বাধিক কতদিন স্বামী ছাড়া থাকতে পারে? হাফসা বলেনঃ ছয় অথবা চার মাস। উমার (রা) বলেনঃ আমি এর চেয়ে বেশিদিন কোন সৈনিককে আটকে রাখবো না।৪০
হাফসা (রা) ছিলেন উমারের (রা) কন্যা। পিতার মত তাঁর মেজাজেও ছিল কিছুটা তীক্ষ্মতা। কখনো কখনো রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার পিঠে কথা বলতেন। ততে দাম্পত্য জীবনে মনোমালিন্যের উপক্রম হতো। এ সম্পর্কে একটি ঘটনা বুখারীসহ অন্যান্য গ্রন্থে বর্ণিত হয়েচে। উমার (রা) একবার ইবন আববাসকে (রা) বললেনঃ জাহিলী আমলে কুরাইশ নারীরা পুরুষের অনুগত ও বাধ্য থাকতো। আমরা তাদের বিন্দুমাত্র মূল্য দিতাম না। ইসলাম তাদেরকে মর্যাদা দান করে। তাদের সম্পর্কে বহু আয়াত নাযিল হওয়ার পর আমরা তাদের স্থান ও মর্যদা অবগত হই। আমরা মদীনায় এসে দেখলাম, মদীনায় নারীরা পুরুষদের বাধ্য ও অনুগত করে রেখেছে। ধীরে ধীরে আমাদের নারীরা তাদের কাছে শিক্ষা পেতে লাগলো। আমার বাড়ীটি ছিল আওয়ালীর বনু উমাইয়্যা ইবন যায়িদ পল্লীতে। আমি একদিন স্ত্রী উপর ভীষণ ক্ষেপে গেলাম। সেও ছেড়ে দিল না, কথার পিঠে কথা শুনিয়ে দিল। তার এমন প্রত্যুর্ত্তর আমার মোটেই ভালো লাগলো না। তখন সে বললো, আমার এরূপ উত্তর করা আপনার পছন্দ নয়, অথচ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীরাও তাঁর কথার প্রত্যুত্তর করে থাকেন। কোন কোন স্ত্রী আজ সন্ধ্যা পর্যন্তত৭ার থেকে দূরে আছেন। অন্য একিট বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেনঃ আপনার মেয়ে হাপসা রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুখের উপর জবাব ছুড়ে দেয়। তাতে এমন হয় যে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সারাদিন বিমর্ষ থাকেন।
‘উমার (রা) বলেনঃ একথা শুনে আমি হাফসার কাছে ছুটে গেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ তোমরা কি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতার প্রত্যুত্তর করে থাকে? হাফসা বললোঃ হাঁ। আমরা এমন করে থাকি। আমি প্রশ্ন করলামঃ তোমাদের কেউ কি রাত পর্যন্ত তার থেকে দূরে থাক? হাফসা বললোঃ হাঁ। বললামঃ তোমাদের মধ্যে যে এমন করে সে সফল হবে না। সে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তোমাদের কেউ কি আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ক্রুদ্ধ হওয়ার পরেও আল্লাহর ক্রোধ থেকে নিরাপদ মনে করেছে? তোমার চেয়ে যে বেশি সুন্দরী ও রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অধিক প্রিয় সে যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে।৪২
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, ‘উমার (রা) হাফসাকে লক্ষ্য করে বলেনঃ সাবধান! এমন করোনা। আমি তোমাকে আল্লাহর শান্তির ব্যাপারে সতর্ক করছি। তুমি তার অহমিকার ফাঁদে পড়োনা যার সৌন্দর্য রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিমোহিত করেছে। (অর্থাৎ আয়িমা রা.)৪৩ অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, তিনি হাফসাকে (রা) বলেনঃ তুমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কথার উত্তর করবে না। তোমার না আছে যয়নাবের সৌন্দর্য ও আয়িশার সৌভাগ্য।৪৪ তিরমিযী বর্ণনা করেছেন। একদিন উম্মুল মু‘মিনীন হযরত সাফিয়্যা বসে বসে কাঁদছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে এসেতাঁকে কাঁদতে দেখে এভাবে কান্নার কারণ জানাতে চাইলেন। সাফিয়্যা বললেনঃ হাফসা আমাকে ইহুদীর মেয়ে’ বলেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তুমি আল্লাহকে ভয় কর।’ তারপর সাফিয়্যাকে বললেনঃ তুমি তো একজন নবীর মেয়ে, তোমার চাচাও একজন নবী। তারপর একজন নবীর স্ত্রী। কোন ব্যাপারে হাফসা তোমার উপর গর্ব করতে পারে?৪৫ আর একবার হাফসা ও আয়িশা (রা) সাফিয়্যাকে বললেনঃ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট আমরা দউজিন তোমার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। আমরা ত৭ার স্ত্রী, তদুপরি তাঁর চাচাতো বোন। কথাগুলো হযরত সাফিয়্যাকে ভীষণ আহত করে। তিনিতাঁদের বললেনঃ তুমি তাদেরকে কেন একথা বললে না যে, তোমরা আমার চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী হতে পার না। কারণ, আমার স্বামী মুহাম্মাদ, আমাকে পিতা হারূন এবং চাচা মূসা।৪৬
‘আয়িশা ও হাফসা (রা) পরস্পর সতীন হলেও তাঁদের সম্পর্ক ছিল বোনের মত। অধিকাংশ ব্যাপারে তাঁরা একে অপরের সহযোগী ছিলেন। ‘আয়িশা (রা) হাফসা সম্পর্কে বলেছেনঃ হাফসা বাপের বেটি। তাঁর বাপ যেমন প্রতিটি কথা ও কাজে দৃঢ়সংকল্প, হাফসাও তেমন।৪৭ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের মধ্যে একমাত্র হাফসাই আমার সমকক্ষতার দাবীদার ছিলেন।৪৮ আমরা দুইজন ছিলাম যেন একটি হাত।৪৯
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অন্তিম রোগ শয্যায়। জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে দাঁড়িয়েছেন। নামাযের সময় হলো। তিনি বররেনঃ আবু বকরকে লোকদের নামায পড়াতে বল। আয়িশা বললেনঃ আবু বকর একজন কোমল মনের মানুষ। তিনি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্থানে দাঁড়িয়ে কুরআন পাঠ করতে গেলে কান্নায় তাঁর বাকরুদ্ধহয়ে যাবে, লোকেরা কিছুই শুনতে পাবে না-একথাগুলি তিনি হাফসাকে বললেন এবং তাঁর স্থলে আমারকে নির্দেশ দানেরজন্য রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতে তাঁকে অনুরোধ করলেন। আয়িশার (রা) কথামত হাফসা (রা) রাসূরুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলতেই তিনি মন্তব্য করলেনঃ ‘তোমরা সবাই ইউসুফের সঙ্গী-সাথীদের মত।৫০
‘আয়িশা ও হাফসা, দুইজনের মনের এমন চমৎকার মিল এবং উভয়ের মধ্রে এত ভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে মাঝে মাঝে নারীর স্বাভাবিক প্ররণত মাথাচাড়া দিত। স্বামীসঙ্গ ও সোহাগ প্রাপ্তির ব্যাপারে তাঁরা ঈর্ষার শিকার হতেন। একবার একসফরে তাঁরা দুইজন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সফর সঙ্গী ছিলেন। রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ‘আয়িশার উটের উপর সওয়ার হয়ে তাঁর সাথে কথা বরতে বলতে পথ চরতেন। একদিন হাফসা আয়িশাকে বললেন, আজ রাতে তুমি যদি আমার উটের উপর, আর আমি তোমার উটের উপর সওয়ার হই তাহলোন্য একটা দৃশ্য দেখা যাবে। ‘আয়িশা (রা) রাজি হয়ে গলেনে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার সাথে তাঁর বাহনে পথ চললেন। মনযিলে পৌঁছে আয়িশা যখন রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পেলেন না তখন নিজের চরণ দুইখানি ইযখীর ঘাসের মধ্যে ঝুরিয়ে বরতে রাগলেনঃ হে আল্লাহ! কোন সাপ অথবা বিচ্ছু যদি আমাকে দংশন করতো।৫১
‘আয়িশা ও হাফসা ছিলেন যথাক্রমে আবু বকর (রা) ও উমারের (রা) কন্যা। এই দুই মাহন ব্যক্তিত্ব ছিলেন রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি কাছের মানুষ। এ কারণে, ‘আয়িশা ও হাফসা দুইজন ছিলেন রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনে অন্যান্য আযওয়াজে মুতাহহারাতের বিপরীতে একজোট। তাঁদের এই জোটবদ্ধতা নবীপাকের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনের অনেক ঘটনার পশ্চাতে কাজ করেছে।
আমাদের একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনের সকল ছোট-বড় ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবনের মত নিছক কোন ঘটনা নয়। প্রত্যেকটি ঘটনার মধ্যে রয়েছে মানবজাতির জন্য শিক্ষাণীয় বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা এসব ঘটনার মাধ্যমে মানব জাতিকে বিভিন্ন বিধি-বিধান ও আচরণের বাস্তব শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। তা না হলে ত৭ার নবীর জীবনে এসব ঘটনা না ঘটালেও পারতেন। আমাদের প্রিয় নবীজীর জীবনের প্রতিটি ঘটনা এভাবেই দেখতে হবে।
হিজরী ৯ম সনে সূরা আত-তাহরীম অবতীর্ণ হয়। এই অবতরনের পশ্চাতে রয়েছে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পারিবারিক জীবনের একটি ঘটনা। মিষ্টি ও মধু ছির রাসূলে কারীমের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অতি প্রিয় খাবার।তিনিসাধারণত আসরের নামাযের পর সকল সহধমির্ণীদের ঘরে গিয়ে দেখা করতেন। একদিন যয়নাবের (রা) নিকট সআবভাবিক সময়ের চেয়ে একটু দেরী হেয় যায়। এতে আয়িশার মনক্ষুণ্ণ হন। তিনি অবগত হন যে, কোন এক মহিলা যয়াবকে কিছু মধু উপকৌকনস্বরূপ পাটিয়েছে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেই মধু যয়নাবের নিকট পান করেছেন। আর সেই কারণে তাঁর ঘরে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল¬াম) অবস্থান দীর্ঘ হয়েছে। আয়িশা ও হাফসা জোটবদ্ধ হন। আয়িশা হাফসাকে বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন আমার অথবা তোমার ঘরে আসবেন তখন আমরা তাকে বললো, আপনার মুখ থেকে মাগাফীর-এর দুর্গন্ধ আসছে। (মাগাফীর, মাগফুর-এর বহুবচন। একপ্রকার উদ্ভিদের ফুল যা থেকে মৌমাছি মধু আহরণকরে) আয়িশা একই কথা সাফিয়্যাকেও শিখিয়ে দিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁদের ঘরে আসলেন তখন তাঁরা পূর্ব সিদ্ধান্তমত একই কথা বললেন। রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিকট দুর্গন্ধ ছিল খুবই অপ্রয়। এরপর তিনি যখন আবার যয়নাবের নিকট যান তিনি রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, প্রয়োজন নেই। তারপর তিনি নিজের জন্য মধু পান হারাম করে নেন। রাসূলুলত্মাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন সিদ্ধান্তের কথা জানতে পেরে আয়িশা আফসোসের সুরে হাফসাকে বলেনঃ আমরা একটি মারাত্মক কাজ করে ফেলেছি। রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর একটি প্রিয় বন্তু থেকে বঞ্চিত করে ফেলেছি। এ ঘটনারই প্রেক্ষিতে নাযির হয় সূরা আত-তাহরীমের নিম্নোক্ত আয়াতঃ৫২
-হে নবী, আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করেছেন, আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে খুশী করার জন্য তা নিজের জন্য হারাম করেছেন কেন? (আত-তাহরীম-১)
রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মধু পরিবেশনকারিনী হিসেবে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন জনের নাম এসেছে। কোন কোন বর্ণনায় হাফসার নামটি এসেছে। সে ক্ষেত্রে আয়িশা সাওদা ও সাফিয়্যার সাথে দল বাঁধেন। ইবন সাদের একটি বর্ণনায় তেমনি বুঝা যায়।৫৩ কোন কোন বর্ণনায় উম্মু সালামার নামও এসেছে।৫৪
রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রীদের খুশী করার জন্য মধু পান না করার যে সিদ্ধান্ত নেন তা তিনি সংশ্লিষ্ট গোপন রাখতে বলেন। যাতে মধু পরিবেশনকারিনী মনে কষ্ট না পান। অধিকাংশ বর্ণনা মতে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসার (রা) কাছে এই গোপন কথাটি বলেছিলেন। কিন্তু হাফসা কথাটি গোপন রাখতে পারলেন না। তিনিতা আয়িশার কাছে প্রকাশ করে দেন। একথাই আল্লাহ সূরা আত-তাহরীমের তৃতীয় আয়াতে বলেছেন এভাবেঃ যখন নবী তাঁর একজন স্ত্রী কাছে একটি কথা গোপনে বললেন, অতঃপর স্ত্রী যখন তা বলে দিল আর আল্লাহ নবীকে তা জানিয়ে দিলেন, তখন নবী সে বিসয়ে স্ত্রীকে কিচু বললেন না এবং কিছু বললেন। নবী যখন তা স্ত্রী বললেন, তখন স্ত্রী বললেনঃ কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করলো? নবী বললেনঃ যিনি সর্বজ্ঞ ওয়াকিফহাল, তিনি আমাকে অবহিত করেছেন।
সূরা আত-তাহরীম মাযিলের কারণ সম্পর্কে আল-ওয়াকিদীসহ আরো অনেক সীরাত বিশেষজ্ঞ ভিন্ন ঘটনাও বর্ণনা করেছেন। একদিন হাফসা (রা) ঘরে ছিলেন না। এ সময় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর ঘরে আসেন এবং দাসী মারিয়া কিবতিয়্যাকে ডেকে সঙ্গ দেন। এর মধ্যে হাফসা ফিরে আসেন এবং অসন্তুষ্টির জন্য উক্ত দাসীর সাহচর্যকে নিজের জন্য হারাম করে নেন। আর একথা তিনি হাফসাকে গোপন রাখতে বলেন। কিন্তু তিনি তা গোপন রাখতে পারলেন না। আয়িশার কাছে প্রকাশ করে দেন। তখন সূরা আত-তাহরীম নাযিল হয়। নাফে বলেছেনঃ একথা কি ঠিক নয় যে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজের জন্য তার দাসীকে হারাম করেছিলেন, তারপর আল্লাহ তা‘আলা কসম ভঙ্গ করে কাফফারা আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন?৫৫
যে দুইজন নাবী এসব ঘটনা সৃষ্টি করে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিলেন, তাঁদেই সম্পর্কে আল্লাহ নাযিল করেন আত-তাহরীমের চতুর্থ আয়তটি। -‘তোমাদের অন্তর অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে যদি তোমরা উভয়ে তাওবা কর, তবে ভালো কথা। আর যদি তোমরা নবীর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য কর, তবে জেনে রেখ আল্লাহ, জিবরীল এবং সৎকর্ম পরায়ণ মু‘মিনগণ তাঁর সহায়।৫৬ এই দুই নারী হলেন আয়িশা (রা) ও হাফসা (রা)। এই দুইজন নারী কে, সে সম্পর্কে সহীহ বুখ্যারীতে ইবন আববাস (রা) এর একটি দীর্ঘ বর্ণনা আছে এতে তিনি বলেনঃ যে দুইজন নারী সম্পর্কে কুরআনে যদি তোমরা উভয়ে তাওবা কর’-বলা হয়েছে, তাঁদের ব্যাপারে উমারকে (রা) প্রশ্ন করার ইচ্ছা বেশ কিছুকাল আমার মনে ছিল। অবশেষে একবার তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে সুযোগ বুঝে আমিও সফরসঙ্গী হয়ে গেলাম। পথিমধ্যে একদিন যখন তিনি অজু করেছিলেন এবং আমি পানি ঢেলে দিচ্ছিলাম, তখন প্রশ্ন কররামঃ কুরাআনের যে দুইজন নারী সম্পর্কে যদি তোমরা তাওবা কর’-বলা হয়েছে তাঁরা কে? উমার বললেণঃ আশ্চার্যের বিষয়, আপনি জানেন না, এঁরা দুইজন হলেন হাফসা ও আয়িশা (রা)।৫৭
নবী পরিবারের মধ্যে এই তুচ্ছ কলহ কোন সাধারণ ব্যাপার ছিল না। মুনাফিকরা সব সময় ধান্দায় থাকতো খোদ নবী পরিবার ও তাঁর বিশেষ আত্মীয়-বন্ধুদের মধ্যে যে কোন ধরনের ফাটল ধরানোর। তারা আযওয়াজে মুতাহহারাতের এই মামুলি বিরোধের কথা জানতে পেরে হয়তো আরো একটু উস্কে দিতে চেয়েছিল। ভেবেছির আয়িশঅ ও হাফসার পিতা আবু বকর ও উমারকে (রা) এবার রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু তারা জানতো না, রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পদতলে তাঁরা কন্যা কেন, নিজেরেদ জীবনও বিলিয়ে দিতে প্রস্ত্তত। তাই উমার (রা) হাফসার সাথে দেখা করার অনুমতি না পেয়ে চিৎকার করে বলে ওঠেনঃ অনুমতি পেলে হাপসার মাথা কেটে নিয়ে আসি।৫৮ সূরা আত-তাহরীমের ৪র্থ আয়াতে এদককেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ আয়িশা ও হাফসা যদি ষড়যন্ত্র করে, আর মুনাফিকরা তা কাজে লাগায় তাহলেও আল্লাহ তাঁর নবীকে সাহায্য করবেন। আর আল্লাহর সাথে আছেন জিবরীল, ফিরিশতামন্ডলী ও সমস্ত বিশ্বের মু’মিন নর-নারী।৫৯
বর্ণিত হয়েছে উপরোক্ত ঘটনার পর রাসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে (রা) তালাক দেন। তারপর আবার ফিরিয়ে নেন। একথা আসেম ইবন উমার বলেছেন।৬০ তালাক দেওয়ার পর জিবরীল (আ) এসে রাসূলকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ হাফসা খুব বেশি রোযা পালনকারিণী এবং রাতে বেশি বেশি নামায আদায়কারিণী। জান্নাতে তিনি আপনার স্ত্রী হবেন। জিবরীলের এ কথায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আবার তাঁকে ফিরিয়ে নেন।৬১
ইবন সা‘দ কায়স ইবন ইয়াযীদ এবং ইবন সীরীনের একটি বর্ণনা নকল করেছেন। নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাফসাকে (রা) এক তালাক দেন। তারপর হাফসার দুই মামা-কুদামা ও উসমান ইবন মাজ‘উন হাফসার সাথে দেখা করেন। হাফসা কাঁদতে কাঁদতে তাঁদের বলেনঃ আল্লাহর কসম! তিনি আমাকে কোন মন্দ কাজের জন্য তালাক দেননি। এমন সময় নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপস্থিত হলেন। তিনি বললেনঃ জিবরীল আমাকে বলেছেন, আপনি হাফসাকে ফিরিয়ে নিন। কারণ, তিনি খুব বেশি রোযা পালন করেন এবং বেশি নামায আদায় করেন। জান্নাতে তিনি আপনার স্ত্রী হবেন।’’৬২
‘‘উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেনঃ একবার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের থেকে দূরে থাকতে লাগলেন। লোকমুখে প্রচার হলো, তিনি তাঁর সকল স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। এটা হিজাবের হুকুমের আগের ঘটনা। আমি আয়িশার কাছে গিয়ে বললামঃ আবু বকরের মেয়ে! তুমি রাসূলুল্লাহকে কষ্ট দিয়ে থাক-লোকেরা সে একথা বলাবলি করছে, তাকি তুমি শুনেছো? ‘আয়িশা বললেনঃ ওহে খাত্তাবের পুত্র, আমার সাথে আপনার সম্পর্ক কি? আপনি অন্যত্র যেতে পারেন।
এরপর আমি হাফসার কাছে গিয়ে বললামঃ আল্লাহর কসম, আমি জেনেছি তিনি তোমাকে ভালোবাসেন না। আমি না থাকলে তিনি অবশ্যই তোমাকে তালাক দিতেন। একথা শুনে হাফসা খুব কাঁদলেন। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেথায়? বললোঃ পাশেই একটি ঘরে আছেন। আমি সেখানে রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বসা দেখতে পেলাম। দরজায় দাঁড়ানো তাঁর চাদর রাবাহ। তার মাধ্যমে আমি রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলাম। তিনি বারের মাথায় অনুমতি পেলাম। আমি রাসূলুল্লাহকে (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললামঃ আপনার অনুমতি পেলে আমি হাফসার কল্লা কেটে ফেলবো। রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে নরম হওয়ার জন্য হাত দিয়ে ইশারা করলেন। আমি শাস্ত হয়ে প্রশ্ন করলামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি কিতাদেরকে তালাক দিয়েছেন? বললেনঃ না। তখন আমি মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করলামঃ রাসূলুলত্মাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর স্ত্রীদের তালাক দেননি। তখণ নাযিল হয় সূরা আন-সিরার ৮৩ তম আয়াতটি।৬৩ বিভিন্ন সূত্রে ঘটনাটি ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে।
নবী পরিবারের মনোমালিন্য ও তালাক সম্পর্কিত বর্ণনাগুলির মাধ্যমে হাফসার (রা) অনেকগুরি বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদা এবং শরীয়াতের কিছু বিধান আমাকে কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেমনঃ
তালাক দান একটি বৈধ কাজ। যদি সে তালাক হয় কোন প্রয়োজন বা কল্যাণের নিম্মিত্তে, তবে তা কামালিয়াত বা পূর্ণতার পরিপন্থী নয়।৬৪
খোদ আল্লাহপাক হাফসার বেশি রোযা রাখা ও বেশি নামায পড়ার সনদ দিয়ে তাঁর প্রশংসা করেছেন।
জান্নাতেও তিনি নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্ত্রী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন।
তাকে খুশী করার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুইটি হালাল বস্ত্তকে নিজের জন্য হারাম করে নেন।
আয়িশার (রা) বক্তব্যে জানা গেছে, তিনি ছিলেন তাঁর পিতার মত।’
6. দাম্পত্য জীবনে ছোট-খাট মনোমালিন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদর্শ আমাদের জন্য অনুসরণীয।
হাফসার (রা) মধ্যে প্রবল দাজ্জাল-ভীতি ছিল। মদীনায় ইবন সাইয়্যাদ নামে এক ব্যক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দাজ্জালের যতগুলো চিহ্ন বা আলামত বর্ণনা করেছিলেন, ললোকটির মধ্যে তার অনেকগুলি ছিল। এমনকি তার সম্পর্কে খোদ রাসূলুল্লাহরও (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সনেদহ ছিল। একদিন হাফসা ও আবদুল্লাহ ইবন উমারের (রা) সাথে পথে সেই লোকটির দেখা হযে গেল। ইবন উমার তাঁকে কিছু বলতেই সে রেগে এত ফুলে উঠে যে পথই বন্ধ হয়ে গেল। ইবন উমার তাঁকে মারতে উদ্যত হন। হাফসা ভীত হয়ে পড়েন। তিনি ইবন উমারকে বলেন, তার সাথে তোমার সম্পর্কে কি? তুমি কি জাননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ দাজ্জালের ক্রোধই তার বের হবার কারণ হবে?৬৫
উম্মুল মু’মিনীন হাফসার (রা) সম্মান ও মর্যাদা ছোট একটি প্রবন্ধে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। এ পৃথিবীতে তিনি সীরাতে রাসূলের (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে যেমন একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন, তেমনি আখিরাতের জীবনেও একাত্ম থাকবেন বলে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন।
সূত্রঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – পঞ্চম খন্ড
Comment